
এবারের রমজানে গণভবনে কোনো ইফতার পার্টির আয়োজন করবেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব্যক্তিগতভাবেও তিনি এবার সাদামাটা ইফতার করবেন। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সাশ্রয়ী নীতি অবলম্বন করেই প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার সরকারপ্রধানের এ সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানান। তুষার বলেন, সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইফতার সাদামাটা। তিনি ব্যক্তিগত ইফতারে কৃচ্ছ্রসাধন করেন। ইফতারে তিনি সংযম ও ব্যয় সংকোচন করবেন। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন খাতে ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ইতিমধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকার মতো সাশ্রয় করেছে।
বিগত বছরগুলোতে বিশেষ করে করোনা মহামারীর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক, কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের সম্মানে ইফতার পার্টির আয়োজন করতেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে দেশবাসী ও বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর প্রতি আন্তরিক মোবারকবাদ জানিয়েছেন। গতকাল তিনি এক বাণীতে বলেন, ‘সিয়াম সাধনা ও সংযমের মাস পবিত্র মাহে রমজান আমাদের মাঝে সমাগত। পবিত্র এ মাসে আত্মসংযমের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে ও সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি, নৈকট্যলাভ এবং ক্ষমালাভের অপূর্ব সুযোগ হয়। সিয়াম ধনী-গরিব সবার মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করে।’
সার কারখানা ও বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ সীমিত করে প্রয়োজনে সিএনজি স্টেশন বন্ধ রেখে আমদানিকৃত গ্যাসের ওপর ভর দিয়ে রমজান এবং গ্রীষ্মে গ্যাসের চাহিদা পূরণের পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এরপরও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে ভুগতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, এভাবে গ্যাস বন্ধ কিংবা সীমিত করে জোড়াতালি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টার ফলে রমজান এবং গ্রীষ্মে গ্রাহকরা যেমন ঠিকমতো গ্যাস পাবে না, তেমনি গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়বে। সার কারখানায় গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষিতে।
গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাস-বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে বাড়তে এপ্রিল-জুন পর্যন্ত সর্বোচ্চ হয়। রমজান, সেচ মৌসুম ও গ্রীষ্মকালে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে পরিকল্পনা করেছে পেট্রোবাংলা। পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ২৭০০ থেকে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রে থেকে প্রায় ২২০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং বাকি গ্যাসের চাহিদা পূরণ হবে আমদানিকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি দিয়ে।
বর্তমানে দেশে দৈনিক প্রায় ২৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এবং বাকি গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ও খোলা বাজার থেকে আমদানিকৃত এলএনজির মাধ্যমে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৭০০ থেকে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হলে ঘাটতি থাকবে। যার প্রভাব পড়বে শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য খাতে।’
তিনি বলেন, ‘আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভর করে যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে তা ভুল। কারণ কদিন আগেও বিশ^বাজারে এলএনজির দাম ৩০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। এখন সেটা অনেক কমলেও যেকোনো পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই দাম বাড়তে পারে। তখন গ্যাসের সংকট আরও বাড়বে।’
‘সংকটের মুখে পড়ে সরকার ২০২৫ সাল নাগাদ ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা প্রশংসনীয়। আরও আগেই এ কাজ করা দরকার ছিল। অন্তত ২০১৮ সাল থেকে যখন আমদানি শুরু হয় তখন থেকেও যদি অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হতো তাহলে এতদিনে অনেক গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আজকের এ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না’ যোগ করেন তিনি।
বদরূল ইমাম বলেন, এলএনজি আমদানিতে যতবেশি নজর দেওয়া হয়েছে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ততটায় অবহেলিত রয়েছে। প্রতি বছর অন্তত ৫ থেকে ৭টা কূপ খনন করা গেলে সংকট অনেকটাই কাটানো সম্ভব হবে।
সূত্রমতে, বিশ^বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশ কিছুদিন ধরে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ ছিল। দাম কমতে থাকায় গত ফেব্রুয়ারিতে খোলাবাজার থেকে প্রতিদিন ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আনা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে গড়ে প্রতিদিন ২৬০০ থেকে ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। চলতি মাস থেকে এলএনজি সরবরাহ বৃদ্ধি করায় গ্যাসের সরবরাহও বেড়ে গেছে। এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট, মে মাসে ৩০০ মিলিয়ন এবং জুনে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি খোলাবাজার থেকে আমদানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ সময়ে দেশীয় গ্যাস এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ও খোলাবাজার থেকে আমদানিকৃত এলএনজির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে পেট্রোবাংলার। তবে এর মধ্যে যদি কোনো কারণে খোলাবাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যায় তাহলে গ্যাস সরবরাহ আরও কমবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, গ্যাস সরবরাহে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পকারখানায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ জন্য বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেলে বাসাবাড়ি ও সার কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ কমানো অথবা সরবরাহ বন্ধ করা হবে দিনের কিছু সময়ের জন্য। বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় প্রয়োজনে সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখা হবে। তবে রমজানে সাহরি ও ইফতার তৈরিতে প্রয়োজনীয় গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে মানুষের ভোগান্তি অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তারাবি নামাজের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং হলে সেই ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে।
এ প্রসঙ্গে বদরূল ইমাম বলেন, ‘এটা একটা জোড়াতালির পরিকল্পনা। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ সীমিত করা নাগরিক হিসেবে সমর্থনযোগ্য নয়। এতে এলপিজির দামও আরও বেড়ে যাবে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়বে।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, গত বছর বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ বছর বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। আমদানিকৃত ও দেশীয় বিদ্যুতের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা হবে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফার্নেস অয়েল ও অন্যান্য জ¦ালানির পাশাপাশি প্রতিদিন অন্তত ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১২০০ থেকে ১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে পেট্রোবাংলার। ফলে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা দুরূহ হয়ে যাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। অন্যদিকে ডলার সংকটের কারণে কয়লা ও অন্যান্য জ¦ালানি আমদানি ব্যাহত হওয়ায় অন্যান্য কেন্দ্রগুলো থেকেও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। সবমিলে এ বছর অন্তত দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মনে করেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সক্ষমতা সরকারের নেই। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি সরবরাহ করতে সরকারের ডলার খরচের যে সক্ষমতা দরকার তা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। জ্বালানি খাতে সরকারের ভুলনীতি আর অন্যায্য ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের কারণে দাম বেড়েই চলেছে। সেই ব্যয় মেটাতে এখন বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এ পরিস্থিতিতে উচ্চদামে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব ব্যাপার।’
বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অন্তরের আত্যন্তিক মিল, যা সহজেই অনুমেয়। বার মাস ও ছয় ঋতুর আবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি কেবলই রূপ বদলায়। বাইরের সেই রূপান্তর মানুষের চিত্তেও আনে রূপান্তর। অন্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রকৃতির রূপ বদলের সঙ্গে মানুষের সুখ-দুঃখের অনুভূতিতে পরিবর্তন আনে। প্রকৃতিকে মানুষ তাই তার সুখ-দুঃখের ভাগী করে নিয়েছে।
বার মাস ও ছয় ঋতুর আবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনের যে যোগ স্থাপিত হয় আমাদের লোকসাহিত্যে তার নানা প্রকাশ ঘটেছে। এদিক দিয়ে সারি গান লোকসাহিত্যের শাখা লোকসংগীতে স্থান করে নিয়েছে। আর যে লোকায়ত জীবন, যে লোকসংস্কৃতি আমাদের উন্নত ও অভিজাত সাহিত্য, সমাজ ও সভ্যতার উৎস, সারি গান সেই জীবন, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম আধার।
নড়াইল জেলার লোকসংস্কৃতিতে সারিগান একটি অন্যতম সংযোজন। জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে পরিবেশিত এ গান শ্রমসংগীত হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে । এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এবারের পরিবেশনা ‘নড়ইিলের সারি গান।’
সারি গান বিশ্বের সব ভাষা ও সাহিত্যে দেখা যায়। তবে এই শ্রেণির গীত সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাংলা সাহিত্যে ও বাংলাদেশে। বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন যুগ ও সময়ের সারি গান এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সারি গান মূলত এক ধরনের কর্মসংগীত। লোকসংগীতের ধারাই সারি গানের উদ্দীপনা। ছাদ পেটানোর সময়, নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতায়, ক্ষেতে কাজ করার সময় বা ধান ভানার ক্ষেত্রে সারি গান গাওয়া হয়। সারি গান অনেক সময় আমাদের জীবনবোধের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাস, ধর্মকথার আশ্রয়ে রচিত হয় স্বভাব কবিদের রচিত এ গীত। এ ধরনের একটি সারি গান নড়াইল সদর উপজেলা থেকে সংগৃহীত, যা বিপিন সরকার রচিত।
রাবণের শক্তিশেলে লক্ষণ পৈলো
গাও তোলোরে ও ভাই লক্ষণ রাম কেঁন্দে মলো।।
ওই ওরে- পিতৃসত্য পালন করতে আমি এলাম বন
সঙ্গে এলো সীতাসতী অনুজ ভাই লক্ষণ।।
বনবাসে এলাম আমি দেশে মলো পিতা,
পঞ্চবটি বনে এসে হারা হইলাম সীতা,
সীতা গেলে সীতা পাবো প্রতি ঘরে ঘরে,
প্রাণের ভাই লক্ষণ হারালে, ভাই বলিবো কারে।। গাও-তোলো গাও-তোলো লক্ষণ চলো দেশে নাই,
এ সংসারে মিলবে নারে তোমার মতো ভাই।।
বাংলাদেশের সর্বত্র সারি গান অত্যন্ত জনপ্রিয়। আমাদের লোকসাহিত্যের সারি গানে সাধারণত আধ্যাত্মিক, বীরত্বব্যঞ্জক, হালকা প্রেমমূলক বিষয় সন্নিবিষ্ট হয়। এমন কিছু তথ্য আছে, যা সাহিত্যিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে মূল্যবান। কর্মরত অবস্থায় সারি গান সমবেতভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলা থেকে সংগৃহীত একটি গান উদ্ধৃত করছি :
জয় বাংলা বলিয়া আমরা গেয়ে যাব দেশের গান
হারে আমরা বাংলা মায়েরই সন্তান।।
ওরে বাংালাদেশের নদী করে সাগরের সন্ধান
হাল ধরে পাল তুলে মাঝি গাহে সারিগান রে ।।
ওরে বাংলাদেশের মাঠেঘাটে ফলে সোনার ধান
আমাদেরি খাটনির ফসল, বিশ্বপতির দান রে ।।
ওরে বিশ্বকবি সোনার বাংলা রেখেছিলো নাম
কবি নজরুল গেয়ে গেলো বাংলার জয়গান রে।।
হিন্দু মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এক মায়ের সন্তান
বাংলা মায়ের গুণে মোদের নাইকো অভিমান রে।।
অসীম বলে বাংলা মায়ের চরণে জানাই
চির নির্বাণ হলে মাগো বক্ষে দিও ঠাঁই রে।।
নড়াইল জেলায় এক সময় প্রচুর সারি গান শোনা যেত। যার সুর টানাটানা ও চড়া এবং খুব জমাট। নৌকা চালানোর সময়, ছাদ পেটানোর সময়, ধান বা পাট কাটার সময় সমবেত কণ্ঠে যে গান গাওয়া হয় তাকে সারি গান বলে। সারি গানের সঙ্গে শ্রমজনিত কোনো কাজের যোগ থাকে। নদীমাতৃক নড়াইলে মাঝিমাল্লারা এই গান বেশি গেয়ে থাকে। এই গান সাধারণত নৌকা বাইচ, শব্দ তানের পর নৃত্য সহকারে গাওয়া হয়ে থাকে। লোহাগড়া উপজেলার দীঘলিয়া ইউনিয়নের আকরাবাড়ি গ্রামের সন্তোষ বিশ্বাসের একটি সারি গানের দল এখনো বিদ্যমান। আশ্বিন মাসে বিলে কাজ করার সময়, দুর্গাপূজায় এবং বড়দিয়ার নবগঙ্গা ও নড়াইলের চিত্রা নদীতে নৌকা বাইচের সময় সারি গান গেয়ে থাকে এ দলটি। এখানে তা উদ্ধৃত করছি :
সোনার কমল ভাসিয়ে কেরে জলেতে দিলো
আমার মা বুঝি কৈলাসে চলিলো
ঐ ওরে কালী ঘাটের কালী মাগো, কৈলাসে ভবানী,
বৃন্দাবনে রাধে তুমি গোকুলে গোপিনী
যাত্রাকালে সঙ্গে আমার এসেছিলো গুণের ভাই,
ওরে লক্ষণ গা তোলো দেশে যাই।।
বনে মলো বনরাজি, দেশে মলো পিতা
গুণের ভাই ছেড়ে হারা হলাম সীতা।
ওরে লক্ষণ গা তোলো দেশে যাই।।
সীতা গেলে সীতা পাব প্রতি ঘরে ঘরে
গুণের ভাই লক্ষণ হারালে ভাই বলিবো কারে।
ওরে লক্ষণ গা তোলো দেশে যাই
যে কালেতে আইলাম বনে, সীতা ছিলো ছোট
দিনে দিনে বাড়ে সীতা বাকল হলো খাটো।
ওরে লক্ষণ গা তোলো দেশে যাই। সব শেষে বলি- নড়াইলের সারি গান বাংলার লোকসাহিত্যে বিপুল ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে আছে। যা লোকায়ত বাংলার চিরায়ত সম্পদ।
জায়েদুল আলম
শিক্ষাবিদ ও লেখক
শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তে এখনো পিছিয়ে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে ২২৭ জন। সে হিসাবে দেশে যক্ষ্মা শনাক্তের হার ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ বা ৩৭ হাজার ৫০০ শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৪ শতাংশ বা দেড় হাজারের বেশি নয়। অর্থাৎ এখনো ৬ শতাংশ বা ২২ হাজার ৫০০ শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্তের বাইরে রয়েছে। এর অর্থ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও শনাক্ত না হওয়ায় এসব শিশু চিকিৎসা পাচ্ছে না।
অবশ্য দেশে শিশু রোগীর সংখ্যার সঠিক কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। গত এক বছরে কত শিশু যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, সে তথ্যও নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশে শিশু যক্ষ্মার এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্তে লক্ষ্যমাত্রা থেকে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে বলে স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মাহফুজার রহমান সরকার। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের লক্ষ্যমাত্রা মোট যক্ষ্মা রোগীর ৮ শতাংশ বা তার বেশি যেন শিশুদের যক্ষ্মা নির্ণয় করতে পারি। কিন্তু বাচ্চাদের শনাক্ত কম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আছি।
এ কর্মকর্তা বলেন, সারা দেশে ৪ শতাংশ বা তার কিছু বেশি শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করতে পারছি। মোট যে শনাক্তের হার, তার ৮ শতাংশ (বেসরকারি হিসেবে ১০ শতাংশ) শিশু হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে ৪ শতাংশের মতো। বাকি ৪ শতাংশ শনাক্ত হচ্ছে না।
শনাক্ত কম হওয়ার কারণ হিসেবে এই কর্মকর্তা বলেন, শিশুরা বলতে পারে না বা উপসর্গ বোঝে না, আবার অভিভাবকরাও সচেতন না। ফলে বেশিরভাগ শিশু শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। অথচ সার্বিক ক্ষেত্রে আমাদের যক্ষ্মা শনাক্ত হার অনেক বেশি। অনেক দেশের চেয়ে ভালো আছি। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী আমাদের মোট শনাক্তের হার ৮২ শতাংশ।
অবশ্য শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তের হার বাড়ানোর জন্য নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বলে জানান সরকারের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, শিশুদেরও যে যক্ষ্মা হতে পারে, সে তথ্য দেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রচার করা হচ্ছে। আগে শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তের হার আরও কম ছিল। কিন্তু এখন আমরা যেভাবে কাজ করছি তাতে সামনের দুই-এক বছরের মধ্যে শনাক্তের হার আরও বাড়বে।
এমন অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। ১৮৮২ সালে ২৪ মার্চ ডা. রবার্ট কক যক্ষ্মা রোগের জীবাণু আবিষ্কার করেন। এর ১০০ বছর পর ১৯৮২ সাল থেকে এই দিনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়Ñ ‘হ্যাঁ! আমরা যক্ষ্মা নির্মূল করতে পারি’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে।
১ বছরে ১ লাখ রোগী কমেছে : জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি দেশে যক্ষ্মা রোগীর সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেছে। কর্মসূচির হিসেবে, গত বছর বাংলাদেশে নতুন ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৩১ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে । এ সময় যক্ষ্মার উপসর্গ আছে এমন ২৯ লাখের বেশি লোকের নমুনা পরীক্ষা করে এ রোগী শনাক্ত হয়েছে। সে হিসাবে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশ।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির হিসেবে, এর আগের বছর ২০২১ সালে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৩ লাখ ৭৫ হাজার। সে হিসাবে গত এক বছরে দেশে যক্ষ্মা রোগী কমেছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৬৯ জন। চিকিৎসা নিরাময়ের হার গত ১০ বছর ধরে ৯৫ শতাংশের বেশি আছে। সর্বশেষ গত বছর তা আরও বেড়ে ৯৭ শতাংশ হয়েছে।
গত বছর সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে ঢাকা বিভাগে, ৭৪ হাজার ৯৪৫ জন ও সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে বরিশাল বিভাগে, ১৬ হাজার ৪৯১ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ৪৮ হাজার ৯৩৮, রাজশাহীতে ২৭ হাজার ৫৪৫, খুলনায় ২৭ হাজার ১১৭, রংপুরে ২৬ হাজার ৮২৮, সিলেটে ২২ হাজার ২০৭ ও ময়মনসিংহে ১৮ হাজার ৩৬০ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এখনো শনাক্তের বাইরে ২০% রোগী : এখন পর্যন্ত দেশে মোট রোগীর ৮০ শতাংশকে শনাক্ত করতে পারছে সরকার ও বাকি ২০ শতাংশ শনাক্তের বাইরে রয়েছে। ফলে এই ২০ শতাংশ রোগী কোনো চিকিৎসা পাচ্ছে না। এমনকি তাদের মধ্যে ঠিক কী পরিমাণ রোগী মারা যাচ্ছে, সে তথ্যও পাচ্ছে না সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে যক্ষ্মা নির্মূলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে সার্বিক শনাক্ত শতভাগ পূরণ করতে হবে। সব রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনতে না পারলে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে মোট শনাক্ত যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী বর্তমানে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে যক্ষ্মা রোগী ২২৭ জন। সে হিসাবে মোট রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫০ জন। কিন্তু সে বছর শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার। সে হিসাবে এখনো শনাক্তের বাইরে ৯৩ হাজার ৭৫০ জন। অর্থাৎ এই ২০ শতাংশ রোগী এখনো সরকারের শনাক্ত ও চিকিৎসার নেটওয়ার্কের মধ্যে আসেনি।
প্রতি ১২ মিনিটে যক্ষ্মায় মরছে ১ জন : গত ১০ বছরে দেশে যক্ষ্মায় মৃত্যু কমলেও এখনো এ সংখ্যা উদ্বেগজনক। গত ২০২১ সালে যক্ষ্মায় মারা গেছেন ৪২ হাজার মানুষ। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির হিসেবে, চিকিৎসার মাধ্যমে ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রায় ২৩ লাখ যক্ষ্মা রোগীকে বাঁচানো গেছে। ২০১৫ সালে যেখানে প্রতি ১ লাখে ৪৫ জন লোকের মৃত্যু হতো, সেখানে ২০২১ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যু প্রতি লাখে ২৫ জনে নেমে এসেছে। কিন্তু এখনো দেশে প্রতি মিনিটে একজন ব্যক্তি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি ১২ মিনিটে যক্ষ্মার কারণে একজন মারা যাচ্ছে।
যক্ষ্মা নির্ণয় ও চিকিৎসা বিনামূল্যে : যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, দেশে সরকারিভাবে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এ ব্যয় সরকার বহন করে। মানুষ এ সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু অনেক সময় মানুষ এ তথ্য জানে না। সে জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। যক্ষ্মা পরীক্ষার ব্যবস্থা জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও আছে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কর্মকর্তারা জানান, যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের জন্য বর্তমানে বাংলাদেশে ৫১৮টি জিনএক্সপার্ট মেশিন, ১ হাজার ১১৯টি মাইক্রোস্কোপ, ২০৫টি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন ও ৩৮টি ট্রুনেট মেশিন রয়েছে। এসব পদ্ধতিতে যক্ষ্মার প্রায় ৮২ শতাংশ রোগী শনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও একটি ন্যাশনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরি ও পাঁচটি রিজিওনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরির মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত করা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, সরকারি চারটি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, সাতটি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল এবং সরকারি সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও এনজিও ক্লিনিকে বিনামূল্যে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা দিচ্ছে সরকার।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আফজালুর রহমান জানান, যক্ষ্মা শনাক্ত হওয়ার পর প্রতিটি রোগীকে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের পাশাপাশি নিয়মিত ওষধু সেবন করার জন্য প্রতিটি রোগীর সঙ্গে একজন ডটস প্রোভাইডার নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে রোগী শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে যক্ষ্মায় মৃত্যুহার কমে এসেছে এবং চিকিৎসার সাফল্যের হার বেড়েছে। এ উদ্যোগ বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। এ সাফল্যের কারণে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার (এমডিআর টিবি) হারও কমে এসেছে।
কেন শিশুরা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে : এ ব্যাপারে রাজধানীর শ্যামলী ২৫০ শয্যার টিবি ও অ্যাজমা হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যক্ষ্মা বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক ব্যাধি। রোগটা সাধারণত মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস জীবাণুর সংক্রমণে হয়ে থাকে। এই জীবাণু যেকোনো অঙ্গেই সংক্রমিত হতে পারে। তবে যক্ষ্মায় আক্রান্ত শিশুরা তাদের লক্ষণগুলো বুঝিয়ে বলতে পারে না, তাই প্রায়ই তাদের ক্ষেত্রে এ রোগটি নির্ণয় করতে দেরি হয় এবং উপেক্ষিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। বিশ্বব্যাপী মোট যক্ষ্মা রোগীর ১২ শতাংশ শিশু। কিন্তু বাংলাদেশে সঠিকভাবে শনাক্ত না হওয়ার কারণে এ হার চার শতাংশের মতো। শিশুদের হার আরও বেশি হবে বলে মনে করা হয়।
এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, শিশুর শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু প্রবেশ করে বড়দের কাছ থেকে। ফুসফুসে আক্রান্ত একজন যক্ষ্মা রোগীর সংস্পর্শে এলে শিশুর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তবে বড় শিশুদের তুলনায় এক মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এরকম শিশুরা তাদের সময়ের একটা বড় অংশ পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় ও খেলার সাথীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সময় কাটায়। এ ছাড়া এমন বয়সী শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বড় শিশুদের তুলনায় কম থাকে। অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুদের যক্ষ্মার ঝুঁকি বেশি। কারণ অপুষ্টি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে এক যুবককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে থানায় দুইদিন নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই যুবকের নাম আবদুল আহমেদ ওরফে রুবেল (২৬)। অভিযোগ রয়েছে, মামলা ছাড়া শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের প্ররোচনায় হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে তিন পুলিশ সদস্য। পরে একটি ‘মিথ্যা’ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে নেওয়া হয়।
এ ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন রুবেলের মা আমেনা বেগম। ডাকযোগে পাঠানো অভিযোগ গত বুধবার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পৌঁছায়। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দিয়েছেন পুলিশ সুপার।
অভিযোগে বলা হয়, গত ১৪ মার্চ বিকেলে এএসআই আল আমিনসহ তিনজন সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্য রুবেলকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। এরপর বাঞ্ছারামপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তরুণ কান্তি দে, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আল-আমিন মানিক নির্যাতন করে জখম করে।
রুবেলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান জানান, ১৪ মার্চ বিকেলে রুবেলকে কোনো মামলা ছাড়ায় আটক করা হয়। এরপর দুইদিন নির্যাতন চালিয়ে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১৬ মার্চ আদালতে নেওয়া হয়।
তবে বাঞ্ছারামপুর থানা পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, ১৫ মার্চ রুবেলের পরিবারের প্রতিপক্ষ রবিউল্লাহ বাদী হয়ে রুবেলের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছে। এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। কোনো নির্যাতন করা হয়নি।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, রবিউল্লাহর সঙ্গে রুবেলের পরিবারের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে রুবেলের পরিবার রবিউল্লাহর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। মামলাটি বর্তমানে চলমান। এতে রবিউল্লাহ ক্ষিপ্ত হয়ে রুবেলের পরিবারের লোকজনের ক্ষতি করার চেষ্টা করে আসছিলেন। এরমধ্যে গত ১৪ মার্চ বিকেলে রবিউল্লাহর প্ররোচনায় এএসআই আল আমিনসহ সাদা পোশাকের তিন পুলিশ সদস্য রুবেলকে বাড়ি থেকে আটক করে। থানায় নিয়ে পরিদর্শক তরুণ কান্তি দে ও এএসআই আল-আমিন দফায় দফায় পিটিয়ে রুবেলকে জখম করে।
এদিকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে না পাঠিয়ে নির্যাতন করায় তার মা আমেনা বেগম সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নেন। বিষয়টি জানাজানি হলে তড়িঘড়ি করে ১৬ মার্চ দুপুরে একটি মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। রুবেলের শরীরের জখম দেখে আদালতের পুলিশ সদস্যরা তাকে গ্রহণ না করে চিকিৎসার পরামর্শ দেন। সে সময় আদালত থেকে রুবেলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পুনরায় আদালতে নেওয়া হয়। পরে আদালত তাকে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
এই ঘটনায় মা আমেনা বেগম গত ১৯ মার্চ নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে তিনজনকে আসামি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ দেন। পরদিন ২০ মার্চ জেলা ও দায়রা জজ শারমিন নিগার মামলাটি খারিজ করে পুলিশ সুপারকে জানানোর সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে কিছু নির্দেশনা দেন।
রুবেলের স্ত্রী মায়া মনি বলেন, ‘আমার স্বামীকে আটকের পর পুলিশ হেফাজতে রেখে নির্যাতন করে। ১৪ মার্চ তাকে আটক করলেও ১৬ মার্চ তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে আদালতে পাঠায়। রুবেলকে প্রচুর নির্যাতন করে আদালতে পাঠালে কোর্ট পুলিশ আহতাবস্থায় তাকে গ্রহণ করেনি। আদালত থেকে চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ সিসিটিভি ফুটেজ দেখলে প্রমাণ মিলবে। পুলিশের ভয়ে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি।’
বাঞ্ছারামপুর থানার ওসি মো. নূরে আলম বলেন, রবিউল্লাহর ভাই মাঈনুদ্দিন ও আবদুল আহমেদ রুবেল বাহরাইনে একসঙ্গে থাকত। রুবেল দেশে আসার সময় মাঈনুদ্দিন তার কাছে বাড়ির জন্য স্বর্ণালংকার দেয়। কিন্তু রুবেল দেশে ফিরে স্বর্ণালংকার ফেরত না দেওয়ায় গত ১৫ মার্চ রবিউল্লাহ বাদী হয়ে রুবেলের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দিয়েছে। রুবেলকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। রুবেলকে কোনো প্রকার নির্যাতন করা হয়নি।
জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন বলেন, লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দেবেন। সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঘনকালো মেঘ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করায় উপকূল থেকে উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নিচু রাস্তাঘাট ডুবে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। বৃষ্টিপাত আরও একদিন থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
গতকাল বৃহস্পতিবার আবহাওয়ার আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, দেশের চারটি বিভাগের দুই-এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে বলা হয়েছে, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দুই-এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন জানান, আরও একদিন বৃষ্টিপাতের পর মাঝখানে দু-তিন দিন বিরতি দিয়ে আবার বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। রাতের তাপমাত্রাও সামান্য বাড়তে পারে।
এদিকে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মৌসুমী লঘুচাপের প্রভাবে বাগেরহাটের মোংলাসহ সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আমাদের মোংলা প্রতিনিধি জানান, হঠাৎ বৃষ্টিতে পৌর শহরের নিচু রাস্তাঘাট ও শহরতলীর নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাটে পানি জমে জলাবদ্ধতার মতো অবস্থা হয়েছে। সকাল থেকে আকাশ রৌদ্রোজ¦ল থাকলেও দুপুর থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। এ সময় বজ্রপাতের পাশাপাশি হালকা বাতাসও বয়ে যায়। আর এ এলাকায় হঠাৎ হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে গত দুই-তিন দিন ধরেই। কখনো হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন আবার কখনো রৌদ্রোজ¦ল এমন আবহাওয়া বিরাজ করছে সাগর ও সুন্দরবনের এ উপকূলে।
এদিকে বৃষ্টিতে চৈত্রের খরতাপ থেকে স্বস্তি নেমেছে উপকূলীয় এ এলাকার মানুষের মাঝে। সুপেয় পানির সংকট থাকায় বৃষ্টি নামলেই এ পানি সংরক্ষণের হিড়িক পড়ে যায়। অপরদিকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও বৃষ্টি হলেই চলে যায় বিদ্যুৎ। গতকাল দুপুরে বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে যায়, আসে বৃষ্টি কমার পরপরই।
মোংলা আবহাওয়া দপ্তরের ইনচার্জ মো. হারুন অর রশিদ বলেন, বৃষ্টি ও মেঘলা আকাশ- এমন অবস্থা থাকতে পারে আগামী তিনদিন। পাশাপাশি বাড়বে তাপমাত্রাও। তবে লঘুচাপের ফলে আপাতত সর্তক সংকেত জারির কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে কখনো বৃষ্টি, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকাসহ এ এলাকায় তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাবে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।