
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, টাকা পাচারের জবাবদিহি কে করবে? সংসদে সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, মন্ত্রী এখানে থাকেন না। কোনো মন্ত্রীর কী দায়িত্ব সেটাও জানি না। কে কী কাজ করে, জবাবদিহিতাও নেই কোনো। ব্যাংকের যেমন জবাবদিহিতা নেই, মন্ত্রীদেরও জবাবদিহিতা নেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে কাজী ফিরোজ রশীদ এসব কথা বলেন। কোথাও জবাবদিহি না থাকলে দেশ কীভাবে চলবে প্রশ্ন রেখে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ব্যাংকের লাইসেন্স দেন। সেটা কীভাবে চলবে তা ঠিক করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ। তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। কেন জনগণের টাকা লুটপাট হচ্ছে, কে দায়ী এসবের জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান তিনি।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সাউথ বাংলা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন এক হাজার কোটি টাকা নিয়ে চলে গেছেন। তিনি পাচার করা অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও একাধিক বাড়ি কিনে বসবাস করছেন। তিনি একা এ কাজ করেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত প্রত্যেক ব্যাংকে অডিট করে। এক হাজার কোটি টাকা তো এক দিনেই নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় কী করল?
অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে জাতীয় পার্টির এ সংসদ সদস্য বলেন, এটা নিয়ে আমরা কথা বলতে পারব না। এখানে অর্থমন্ত্রী কখনো থাকেন না। উনি কোনো কথাই শুনতে চান না।
একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখিয়ে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো প্রতিবাদ করেনি। তারা জানেন এক হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই না। এখানে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হলে তারা নড়েচড়ে বসে। ১০ হাজার কোটি টাকা হলে আরেকটু নড়েচড়ে বসে। তিনি বলেন, জনগণের টাকা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ব্যাংকগুলো পারিবারিক হয়ে গেছে। এগুলো জনগণের ব্যাংক নেই। আমরা টাকা রাখি ঠিকই। ব্যাংকের মালিকদের চাকর-বাকরদেরও কোনো অসুখ হলে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক চলে যাবে চিকিৎসার জন্য।
এর আগে বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দেন ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। মন্ত্রীর বিবৃতির সমালোচনা করে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘ত্রাণপ্রতিমন্ত্রী বিরাট, লম্বা-চওড়া বিবৃতি শোনালেন, কত ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, উনি নিজে দিনরাত পরিশ্রম করে আগুন নিভেয়েছেন। আসলে আগুন নেভাননি, আগুন আজও (গতকাল) জ¦লছে।’
জাপা এমপি বলেন, ‘বিমানবাহিনী হেলিকপ্টারে পানি ছিটিয়েছে, পানি পড়তে পড়তে কিছু আর থাকে না। ওইটা অক্সিজেন হয়ে যায়। কোনোরকম তারা গিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার রক্ষা করতে পেরেছে। একটা দোকানদারও রক্ষা পায়নি। এটা হলো আসল কথা।’
হীরা ইয়া ইয়াসমিন রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা। ২০১৫ সালে স্বামীর বন্ধুর মাধ্যমে কথা হয় মুক্তারুল হক নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে, তখন তারা মোহাম্মদপুরে থাকতেন। সে সময় মুক্তারুল তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মা আমেনা ফার্মেসির কথা জানান। এখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিক মুনাফার প্রস্তাব দেন। এ ছাড়া তার স্বামী ও ছেলেকে এই ফার্মেসিতে চাকরি দেওয়ার কথা জানান। স্বামী-সন্তানের চাকরি ও বিনিয়োগের টাকা থেকে লাভের কথা বিবেচনা করে মুক্তারুলকে ওই বছর চার লাখ টাকা দেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে তাদের গচ্ছিত টাকা থেকে বিনিয়োগ বাড়িয়ে করেন ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু এই বিনিয়োগ যে ভুল জায়গায় হয়েছে যখন বুঝতে পারেন তারা ততক্ষণে তাদের টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে গেছেন মুক্তারুল।
এভাবে রাজধানীর আদাবরে ফার্মেসি খুলে নীরবে বড় ধরনের আর্থিক প্রতারণা করে পালিয়ে যান মুক্তারুল ও তার স্ত্রী রুবিনা আক্তার। তাদের এই বিনিয়োগ ভেলকিতে পড়ে টাকা খুইয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বহু মানুষ।
পুলিশ জানিয়েছে, মুক্তারুলের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন অর্ধশতাধিক ভুক্তভোগী। তাদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার লোক রয়েছে। তবে অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষজন। তাদের অনেকেই পৃথক মামলাও করেছেন। মুক্তারুল দম্পতির বিরুদ্ধে আদাবর থানায় প্রতারণার মামলা ছাড়াও অর্থ পাচার ও চেক ডিজঅনারের মামলা হয়েছে।
এই প্রতারণার ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট বাদী হয়ে অর্থ পাচার আইনে একটি মামলা করেছে। মামলার তদন্ত শেষে সংস্থাটি বলেছে, প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে জমি কেনার প্রমাণ মিলেছে।
সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির দেশ রূপান্তরকে জানান, মুক্তারুলের ব্যাংক হিসাবসহ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এসব তথ্য পর্যালোচনা ও বিস্তারিত তদন্তে ৫ কোটি ৭৭ লাখ ৬২ হাজার টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছেন তারা।
তবে ভুক্তভোগী ও স্থানীয় লোকজনের দাবি অনুযায়ী, আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি। মুক্তারুলের কেনা জমির দাম প্রায় ২০ কোটি টাকা হলেও দলিলে কম দেখানো হয়েছে।
ভুক্তভোগী হীরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, টাকা দেওয়ার পর লিখিত চুক্তিও করেন মুক্তারুল। তার স্বামী-সন্তান আমেনা ফার্মেসিতে চাকরি শুরুর পর কিছুদিন বেতন দিলেও একপর্যায়ে বন্ধ করে দেয়। এরপর মুক্তারুল কালক্ষেপণ করতে থাকেন। একপর্যায়ে জানতে পারেন মুক্তারুল অনেক মানুষের টাকা নিয়ে ভারত পালিয়ে গেছেন।
মুক্তারুল ও তার স্ত্রী বিনিয়োগের প্রলোভন দেওয়া ছাড়াও ওষুধ বিক্রির নামে হাতিয়েছেন বহু মানুষের টাকা। এমন একজন ভুক্তভোগী মো. শাহীন কাউসার। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য নিয়মিত ভারতীয় ওষুধ প্রয়োজন ছিল, যা দেশে পাওয়া যেত না। আমেনা ফার্মেসিতে ওইসব ওষুধ কেনার জন্য গেলে তারা আমাকে ভারত থেকে এনে দেওয়ার কথা বলে। এরপর এসব ওষুধের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো ওষুধ দেয়নি।’
সিআইডি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মুক্তারুল ও রুবিনা দম্পতির বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর এলাকায়। প্রায় ১০ বছর আগে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আসার পর শুরুতে আদাবর এলাকায় সাইকেলে ফেরি করে বিভিন্ন ফার্মাসিতে ওষুধ বিক্রি করতেন। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ফার্মাসির মালিকদের কাছ থেকে নগদ টাকায় ওষুধ নিয়ে বিক্রি করে অর্ধেক লাভ তাদের দিতেন। এভাবে তারা আদাবর এলাকায় বিশ্বস্ততা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর মুক্তারুল এলাকার লোকজনের সহযোগিতায় প্রায় আট বছর আগে বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটিতে মা-আমেনা ফার্মেসি নাম দিয়ে ওষুধের দোকান খোলেন। পরে স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফার্মেসির জন্য ওষুধ কিনে বিক্রি করে লাভের একটি অংশ দিতেন। এভাবে আদাবর এলাকায় তাদের দোকানটি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। পরে মুক্তারুল পর্যায়ক্রমে শেখেরটেক ৬ নম্বর রোডে মোল্লা ড্রাগ নামে তার দ্বিতীয় দোকান, একই এলাকার ১২ নম্বর রোডে তৃতীয়, আজিজ মহল্লায় মোহাম্মাদিয়া মেডিসিন নামে চতুর্থ দোকান, শেখেরটেক ৬ নম্বর রোডে ডক্টরস মেডিসিন নামে পঞ্চম দোকান খোলেন। এ ছাড়া বাবু বাজারের নগর লেন এলাকায় মা আমিনা ফার্মেসি নামের ওষুধের দোকান চালু করেন।
এরপরই মুক্তারুল দম্পতি অন্যান্য এলাকার লোকজনকে লোভনীয় লভ্যাংশ দেওয়ার ফাঁদ পেতে টাকা নিয়েছেন। শুরুতে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীকে লভ্যাংশের টাকা ঠিকভাবেই দিয়েছেন। এরপর ২০১৮ সাল থেকে পাওনাদারদের টাকা দেওয়া মোটামুটিভাবে বন্ধ করে দেন।
মোহাম্মদ হামিমুর রহমান শিকদার (৫১) নামে এক ভুক্তভোগী তার লভ্যাংশের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করলে অন্যরাও বিষয়টি জানতে পারেন। তারাও পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করেন। একপর্যায়ে মুক্তারুল দম্পতি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে যান। প্রায় ৬০ জন পাওনাদারের তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত মুক্তারুল হক (৩৮) এবং তার স্ত্রী রুবিনা আক্তার (৩১) ও তাদের দুই ছেলে ইমরান আহম্মেদ (১৩) ও মো. জাইন আহম্মেদকে (৭) নিয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করেন। পরে তাদের আত্মীয়স্বজনদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ২০১৯ সালের মার্চে ছেলেদের নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এ সময় তারা রাজধানীর শ্যামপুরের তাদের এক আত্মীয়র বাসায় অবস্থান করেন। বিষয়টি জানতে পেরে ভুক্তভোগী মোহাম্মদ হামিমুর রহমান শিকদার বাদী হয়ে আদাবর থানায় একটি মামলা করেন। এরপর আরও অনেকেই মামলা করেন। গ্রেপ্তার করা হয় মুক্তারুল দম্পতিকে। পরে তারা জামিন পান।
হাতিয়ে নেওয়া টাকার গন্তব্য : ভুক্তভোগী হামিমুর রহমান শিকদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার স্ত্রীর ৫৫ লাখসহ ৭৩ লাখ টাকা দিয়েছিলাম মুক্তারুলকে। আমরা শুনেছি তিনি আদাবরে জায়গা কিনেছেন, সেখানেও মালিকের ৩০ লাখ টাকা বাকি রেখে দলিল করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘মুক্তারুল তো ব্যবসা করতেন, এমন তো হয়নি তার সব টাকা লোকসান হয়েছে। কারণ তার ফার্মেসিতে বিক্রি ভালো ছিল। প্রতিদিন প্রায় এক লাখ টাকার বিক্রি হতো। অনেকেই দাবি করছেন, টাকাগুলো মুক্তারুল ভারতে পাচার করেছেন।’
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকার অধিকাংশই ভোগবিলাসে ব্যয় করেছেন মুক্তারুল দম্পতি। সার্বিক তদন্ত ও প্রতারক দম্পতির জবানবন্দি অনুযায়ী ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা পাঁচ কোটি টাকা গ্রহণ করেছেন। তবে অন্য কোনো সম্পদের প্রমাণ না পাওয়ায় টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ গীতপ্রধান দেশ। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের মনের সব ভাব, সব চিন্তার গীতিময় প্রকাশ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে লোকসংগীতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে আবহমান বাংলার মাটি আর আর মানুষের কথন। এই সংগীতে মিশে আছে মাটি আর মানুষের প্রাণের ছোঁয়া। তাদের সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনা, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা জীবন্ত হয়ে উঠেছে গানের কথায়, সুরে সুরে। তবে উত্তরবঙ্গের সরল সাধারণ জীবনের মনোরম আলেখ্য ও হৃদয়ের অনুপম মাধুর্যে ঋদ্ধ গীতধারা ভাওয়াইয়া লোকসংগীতের অপরাপর শাখার চেয়ে মানুষকে টেনেছে বেশি। জনপ্রিয় হয়েছে নর-নারীর প্রণয়ের আকুল আবেদন হিসেবে।
লোকায়ত বাংলা সিরিজে আমাদের আজকের পরিবেশনা বাংলাদেশের ভাওয়াইয়া গানে নর-নারীর প্রেম
বাংলাদেশের লোকসংগীত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর সুরাশ্রয়ী অংশের এক প্রধান বিষয় প্রেম। এ প্রেম কখনো ভগবদ্ভক্তি থেকে উৎসারিত, কখনো নর-নারীর পারস্পরিক আকর্ষণ থেকে। ভাওয়াইয়া গানগুলো বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের জেলাগুলোতে বহুকাল আগে থেকেই ব্যাপকভাবে প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এ লোকসংগীত বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিশেষভাবে প্রচলিত।
এ গান মাটির রসে এত প্রাণবন্ত যে, অন্য মাটির স্পর্শে এর রস ও সৌন্দর্য বিকৃত হয়। এ গান সুর লালিত্যে ভরপুর। এ গানের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো নিমেষে এ গানের সঙ্গে মানুষের মন, ধ্যান-ধারণা, চিন্তাভাবনা, মা আশা-আকাক্সক্ষা সব একাকার হয়ে যায়। এ গান শুনে মানুষের ঘুমন্ত আত্মা জাগ্রত হয়ে ওঠে এবং মাটির ধরায় মাটির মানুষের প্রেম ও ভালোবাসা স্থাপনের জন্য উদ্বুদ্ধ হয়। এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের ভাওয়াইয়া গান মাটির পৃথিবীকে মায়াময় ও মোহময় জগতে রূপান্তরিত করেছে।
বাংলা ভাওয়াইয়া গানের প্রধান উপজীব্য বিষয় পার্থিব প্রণয়। অবশ্য এ দেশের সমস্ত অকৃত্রিম লৌকিক প্রেম-সংগীতের বৈশিষ্ট্য এগুলোতে নারী এবং পুরুষ উভয়ের প্রেমেরই অভিব্যক্তি রয়েছে।
কিন্তু বিয়ের গীত ছাড়া আমাদের আর কোনো লৌকিক প্রেম-সংগীত বিশ্বের অন্যান্য দেশের লোকসংগীতের মতো নারী কণ্ঠে গীত হয় না। আর এসব গানের অধিকাংশই পল্লীকবি বা পল্লীগীতি-গায়কদের রচনা।
মূলত ভাওয়াইয়া গানের ধর্ম হলো বিরহ বেদনা ও বিচ্ছেদ। বিরহ বিধুর একটা করুণ সুর এই গানে ধ্বনিত হয়। বিচ্ছেদের বাধা মূর্ত হয়ে ওঠে ভাওয়াইয়া গানের কথা ও সুরে। বস্তুত বাংলাদেশের সর্বত্র, ভাব শব্দের একটি লৌকিক অর্থ প্রেম। এই অর্থের ভিত্তিতে প্রেম বা ভাবজাত সংগীতের নামই ভাওয়াইয়া। কারণ, প্রেমের সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয়, অথচ এমন ভাওয়াইয়া গানও দেখা যায়, যাতে নায়িকার অন্তরে প্রেমের কামনা আছে, কিন্তু প্রেমিক অনুপস্থিত। যেমন,
‘পর্থম যৌবনের কালে না হৈল মোর বিয়া,
আর কতকাল রহিম ঘরে একাকিনী হয়া,
রে বিধি নিদয়া ।।
হাইলা পৈল্ মোর সোনার যৌবন মালয়ার ঝড়ে,
মাও বাপে মোর হৈল বাদী, না দিল পরের ঘরে।।
বাপক্ না কঁও সরমে মুই, মাওক্ না কঁও লাজে,
ধিকিধিকি তুষির অঘুন জ্বলছে দেহির মাঝে।।---
এমন মন করে রে, বিধি, এমন মন মোর করে,
মনের মতন চেংড়া দেখি, ধরিয়া পালাও দূরে।।--’
তবে, এই গানে নায়িকার যে অনুভূতি তা’ ভাবেরই উৎগমনোন্মুখ রূপ। আত্মসমর্পণের উপযোগী পাত্রের সন্ধান যখন মেলে, তখন তা-ই প্রেমের বাৎসলতায় পরিণত হয়।
ভাওয়াইয়া গানের ভাব চিন্তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ গানের রচয়িতারাও প্রেমিকা হৃদয়ের বহুবিধ সাধারণ দৈনন্দিন চিন্তা ও অনুভূতিকে তাদের রচনার বিষয় করে নেন। এসব চিন্তা-অনুভূতির মূলে বিবাহপূর্ব প্রেম বা তার কামনা থাকা যেমন সম্ভব, তেমনি দাম্পত্য প্রেমও থাকতে পারে। কারণ ভাওয়াইয়া গানে দেখা যায়, বেদনাহত প্রেমের ভক্ত ভাওয়াইয়া-গীতিকারের দৃষ্টি মনুষ্যলোকের বাইরেও প্রসারিত। এখানে কবির দরদি মনের কাছে মানুষে পাখিতে সব প্রভেদ ঘুচে গেছে। বিষয়ের অনন্যতা আর সুর মাধুর্যের জন্য বিখ্যাত দিনাজপুরের একটি ভাওয়াইয়া গানের উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ্য :
“ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে।
ফান্দ বসাইছে ফান্দী রে, ভাই পুটি মাছো দিয়া।
ওরে, মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া রে ।।
ফান্দে পড়িয়া রে বগা করে টানাটুনা।
ওরে, আহা রে কুংকুরার সূতা, হলু লোহার গুণারে।।
ফান্দে পড়িয়া বগা করে হায় রে হায়।
ওরে, আহা রে দারুন বিধি, সাথী ছাইড়া যায় রে।।
আর বগা আহার করে আশে আরো পাশে।
আমার বগা আহার করে ধল্লা নদীর পারে।।
উড়িয়া যায় চকোয়া রে পঙ্খী, বগীক বলে ঠারে।
ওরে, তোমার বগা বন্দী হইছে ধল্লা নদীর পারে।।
এই কথা শুনিয়া রে বগী দুই পাখা মেলিল।
ওরে, ধল্লা নদীর পারে যাইয়া দরশন দিল রে।।
আবার দাম্পত্য প্রেমের ভাওয়াইয়া গানে বিরহের সুরই সবচেয়ে মুখর হয়ে উঠেÑ এই সুরের উৎস শুধু প্রোষিতভতৃকার দীর্ঘকালের প্রিয় বিরহই নয়। আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনাও সংগীতের জন্ম দিয়েছে। জীবনসঙ্গীকে জীবিকার সন্ধানে দূর দেশে যেতে হয়, এটা নায়িকার কাছে নতুন কিছু নয়।
তবু তার মন মানে না। জীবনসঙ্গীর প্রত্যাগমনকালের অনিশ্চয়তায় তার হৃদয় ভারাক্রান্ত। জীবনসঙ্গীর কাঁধের সামান্য গামছাখানি তার কাছে মহামূল্য স্মৃতিচিহ্নের রূপ নেয়। গানের মধ্যে তার প্রকাশ:
“কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে,
কোন দিন আসিবেন বন্ধু,
কয়া যাও রে ।।
যদি বন্ধু যাবার চাও,
ঘাড়ের গামছা থুয়া যাও রে।।
বট বৃক্ষের ছায়া যেমন রে,
মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে।।”
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাওয়াইয়া গানে উপেক্ষিত নায়িকার অন্তজর্¦ালাও করুণ সুর সৃষ্টি করেছে। এখানে নায়িকা বেদনার্ত জীবনসঙ্গীর পরকীয়াচর্চায়। এ ক্ষেত্রে নায়িকা নিজের জীবন-যৌবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। গানের মধ্যে তার প্রকাশ :
“কিসের মোর বাঁধন, কিসের মোর বাড়ন,
কিসের মোর হলুদি বাঁটা,
মোরে প্রাণনাথ অন্যের বাড়ী যায়
মোরে আঙ্গিনা দিয়া ঘাটা।
ও প্রাণ সজনী, কার আগে কব দুকের কথা।।
আর যদি দ্যাখোং, আর যদি শোনোং
অন্য জনের সঙ্গে কথা,
এহেন যৈবন সাগরে ভাসাব,
পাষাণে ভাঙ্গিব মাথা।।
পরিশেষে বলা যায়, এ গানের সুর শ্রোতার কণ্ঠে এক করুণ আবেশের সৃষ্টি করে। আর ভাওয়াইয়া গানের তাৎপর্যও সেই আবেশ মাখানো সুর সৃষ্টির মধ্যেই। টানা সুর এবং মাঝে মাঝে এক ধরনের স্বরভঙ্গ ভাওয়াইয়া গানের বৈশিষ্ট্য। তাই ভাওয়াইয়া গান আমাদের লোকসংগীতের ভাবসম্পদ। এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ আজকের বাংলাদেশে একান্ত প্রয়োজন।
আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম তৃণমূল নেতাকর্মীরাই সফল করবেন বলে মনে করে বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলনের গতি ধরে রাখতে দলটির হাইকমান্ডের নির্দেশে নেতারা তৃণমূলকে চাঙ্গা করতে রোজার মাসেও নানা কর্মসূচি পালন করছেন। নেতারা বলছেন, চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে তৃণমূলে নজর দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হচ্ছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সারা দেশের তৃণমূল নেতাকর্মীদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারকে দ্রুত ক্ষমতা থেকে হটাতে দলকে সুসংগঠিত করতে রমজানেও বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। আগামীর চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে চলছে বর্তমানের কর্মসূচি। দেশের ইতিহাসে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে তাতে তরুণরাই রাজপথে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমাদেরও ভরসা তরুণদের নিয়ে। অঙ্গ সংগঠনগুলোর তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়ায় উজ্জীবিত হচ্ছে তারা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ৯০-এ স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা আন্দোলনের সফলতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু তখন সে আন্দোলন সফল করেছিলেন ছাত্রদল ও যুবদলের তরুণ নেতারা। ঠিক একইভাবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এবারের আন্দোলন-সংগ্রাম সফল করবেন ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দলের তৃণমূল তথা তরুণরা। তাই রমজান মাসে তাদের চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য তৈরি করতে প্রতিটি বিভাগে তৃণমূল প্রতিনিধি সভা ও ইফতার মাহফিল শিরোনামে কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
ওই নেতা বলেন, ‘জ্যেষ্ঠ নেতারা বয়সের কারণে রাজপথে সাহসী ভূমিকা নিতে পারবেন না। তা ছাড়া জেলে যাওয়ার ভয়, সরকারের সঙ্গে আঁতাতসহ নানা কারণে পিছু হটতে পারেন তারা। এর বাইরে আগামী দিনে ক্ষমতায় এলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জ্যেষ্ঠদের মূল্যায়ন করবেন কি নাÑ তা নিয়ে তাদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তৃণমূল নেতাকর্মীরাই বিএনপির প্রাণ। বিগত ওয়ান-ইলেভেনে জ্যেষ্ঠ নেতারা দলের সঙ্গে বেইমানি করলেও তৃণমূল নেতাকর্মীরা করেননি। তারাই বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছেন। তাই ১০ দফা দাবি আদায়ে আগামী দিনে রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে অঙ্গ সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি সভা ও ইফতার মাহফিল করা হচ্ছে।’ তিনি জানান, ‘লন্ডন থেকে এসব কর্মসূচিতে ভার্চুয়ালি অংশ নিচ্ছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তৃণমূল নেতারা বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরছেন। তাদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখছেন তারেক রহমান। এতে উজ্জীবিত হচ্ছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।’
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল এরই মধ্যে বরিশাল ও কুমিল্লায় দুটি ইফতার পার্টি করেছে। ১০টি সাংগঠনিক বিভাগে পর্যায়ক্রমে ইফতার পার্টি করবে সংগঠনটি। সর্বশেষ রাজধানী ঢাকায় ইফতার পার্টি করবে সংগঠনটি।
‘রমজানের কর্মসূচিকে যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি’ আখ্যা দিয়ে যুবদলের সহসভাপতি জাকির হোসেন সিদ্দিকী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব কর্মসূচিতে বিভাগীয় পর্যায়ের যুবদলের নেতাদের পাশাপাশি বিএনপি নেতারাও থাকছেন। কেন্দ্র থেকে দায়িত্বশীল নেতারা এসব কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। অন্য সময়ে বিশেষ করে রমজানে বিভাগীয় পর্যায়ে এ ধরনের কর্মসূচি আমরা পালন করি না। তবে এবার আগামীর আন্দোলন-সংগ্রামকে সামনে রেখে যুবদল সারা দেশের সব বিভাগীয় শহরে প্রতিনিধি সভা ও ইফতার মাহফিল করছে।’
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সারা দেশে একাধিক ইফতার পার্টির আয়োজন করেছি। এসব ইফতার পার্টিতে তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য রাখার সুযোগ করে দিচ্ছি। তারা আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম সফল করতে বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরছেন। পারস্পরিক মতবিনিময় হচ্ছে এসব ইফতার পার্টিতে।’
ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সারা দেশে ছয়টি তৃণমূল প্রতিনিধি ও ইফতার মাহফিল করছি। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ ও বগুড়ায় দুটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামনে আরও কর্মসূচি আছে।’
স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এবার তারা ছয়টি বিভাগীয় ইফতার পার্টি ও ১২টি জেলায় কর্মিসভা করছেন। এসব কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে সংগঠন পুনর্গঠন ও আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম সফল করার পূর্ব প্রস্তুতি।’
গত ২৪ মার্চ রাজধানীর ইস্কাটনের লেডিস ক্লাবে বিএনপি এতিম, আলেম ওলামাদের সম্মানে ইফতার পার্টির আয়োজন করে। ইফতার-পূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘রমজান মাসে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু আজকে দেশে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, আমরা বাধ্য হয়েছি এই রমজান মাসেও তা চলমান রাখতে।’
কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১ এপ্রিল শনিবার সারা দেশের সব মহানগর ও জেলায় বেলা ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। আগামীকাল শনিবার সারা দেশের সব মহানগরের থানাপর্যায়ে এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে দলটি। পরদিন ৯ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিভাগীয় শহরগুলোতে ও সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রচারপত্র বিলি, মানববন্ধন করা হবে। এর মধ্যে ৯ এপ্রিল, রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগ। ১০ এপ্রিল, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগ। ১১ এপ্রিল, খুলনা ও কুমিল্লা বিভাগ। ১২ এপ্রিল, ঢাকা ও বরিশাল বিভাগ। ১৩ এপ্রিল, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর বিভাগে। এ ছাড়া ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় সভা, দুস্থ, অসহায় ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তাসহ বিভিন্ন গণসংযোগমূলক কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।
ফরিদপুর সদর উপজেলার একটি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের একজন সহকারী শিক্ষকের মূল বেতন প্রায় ১৮ হাজার টাকা। নিয়মানুযায়ী তিনি তার মূল বেতনের ২৫ শতাংশ ঈদ বোনাস পাবেন। সে হিসেবে তিনি আসন্ন ঈদুল ফিতরের বোনাস পাবেন সাড়ে চার হাজার টাকা। এ দিয়ে কী কেনাকাটা করবেন তা নিয়ে খুবই চিন্তিত তিনি।
নাম প্রকাশ না করে ওই শিক্ষক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি বাংলা বিষয়ের শিক্ষক বিধায় প্রাইভেট পড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে সরকার থেকে মূল বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা-ভাতা মিলিয়ে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পাই। যদিও স্কুলের অংশ থেকে মাসে অতিরিক্ত চার হাজার টাকা বেতন পাই। নিজ বাড়িতে থেকে এই বেতন দিয়ে মোটামুটিভাবে চলে যায়। কিন্তু এই ঈদে দুই সন্তান, মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা বোনাসে কীভাবে ঈদ করব?’ তিনি বলছিলেন, ‘জামা-কাপড়ের যে দাম, ছেলেমেয়ের পোশাক কিনতেই সাত-আট হাজার টাকার দরকার। আর পরিবারের অন্যদের জন্য কী কিনব? এ ছাড়া অন্যান্য বাজার করব কীভাবে?’
প্রায় ৩২ হাজার এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চার লাখ শিক্ষকের প্রশ্ন একই। বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিতের যেসব শিক্ষক রয়েছেন তারা প্রাইভেট পড়িয়ে মোটামুটিভাবে চললেও অন্যসব শিক্ষকের সে সুযোগ নেই। সরকারের দেওয়া বেতনই তাদের মূল ভরসা। এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের এক লাখ কর্মচারীও মাত্র ৫০ শতাংশ উৎসব-ভাতা পান। ফলে ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মনেই উৎসব নিয়ে বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই।
সূত্র জানায়, বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হয় ১২-১৩ হাজার কোটি টাকা। এখন যদি সব শিক্ষক-কর্মচারীকে শতভাগ উৎসব দিতে হয় তাহলে বছরে আরও ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার শিক্ষকদের প্রতি সব সময়ের জন্যই আন্তরিক। কিন্তু সরকারের সক্ষমতার ব্যাপারটিও বুঝতে হবে। করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধে সব জায়গাতেই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। তবে এ অবস্থা না থাকলে এত দিন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসব-ভাতায় পরিবর্তন আসত। হয়তো সামনে সরকারের সক্ষমতা বাড়লে শিক্ষকরা শতভাগ উৎসব-ভাতা পাবেন। এ জন্য কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে না। সব বিষয়ই প্রধানমন্ত্রীর নজরে আছে।’
২০০৪ সাল থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতনের ২৫ শতাংশ ও কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ উৎসব-ভাতা পেয়ে থাকেন। এরপর থেকেই শিক্ষকরা মূল বেতনের সঙ্গে শতভাগ উৎসব-ভাতা, সরকারি শিক্ষকদের মতো চিকিৎসা-ভাতা ও বাড়িভাড়া দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু ১৮ বছর পার হলেও সরকার উৎসব-ভাতায় কোনো পরিবর্তন আনেনি। আর ২০১৯ সাল থেকে মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা পেয়ে আসছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা।
শিক্ষকরা জানান, দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। যাদের বেশির ভাগ আবার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা একই নিয়মনীতি অনুসরণ করেন। একই পাঠ্যক্রমে পাঠদান করান। একই প্রশিক্ষণ নেন। অনেক সময়ই দেখা যায়, সরকারির চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফল ভালো হয়। এর পরও তারা বৈষম্যের শিকার। সরকারি শিক্ষকরা মূল বেতনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় বাড়িভাড়া, চিকিৎসা-ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা পান। চাকরি শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশনসহ নানা সুবিধা পান। কিন্তু একই কাজ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি নিজের টাকা কল্যাণ ফান্ড ও অবসর বোর্ডে জমিয়ে চাকরি শেষের পাঁচ-সাত বছরেও সে টাকা পান না।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একাধিক সংগঠন থাকলেও তারা সবাই মূলত একই দাবিতে আন্দোলন করছেন। তাদের অন্যতম দাবি, শতভাগ উৎসব-ভাতা, সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মতো বাড়িভাড়া, চিকিৎসা-ভাতা ও অন্যান্য ভাতা প্রদান। তবে এখন শিক্ষকদের সব সংগঠনই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আন্দোলনেই বেশি জোর দিয়েছেন।
জানতে চাইলে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষকরা কষ্টে আছেন। তাদের শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে আমাদের একাধিক কর্মসূচিতে আমরা শতভাগ উৎসব-ভাতার দাবি জানিয়েছি। আমরা জানি, সরকারও আর্থিক সমস্যায় আছেন। কিন্তু বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ উৎসব-ভাতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়নের সভাপতি মো. আবুল বাশার হাওলাদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি শিক্ষকদের সবাই শতভাগ উৎসব-ভাতা পান আর আমরা পাই ২৫ শতাংশ, এটা অমানবিক। আমরা ১৭ বছর ধরে শতভাগ উৎসব-ভাতার দাবিতে আন্দোলন করছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয় দেয় না। আর অর্থ মন্ত্রণালয় বলে শিক্ষা থেকে প্রস্তাব আসে না। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার বড় প্রকল্প করছে। অথচ শিক্ষার উন্নয়নে কেন যে ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করতে পারছে না, এটা আমাদের বোধগম্য নয়। আমি বলব, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষামন্ত্রী যদি আন্তরিক হন, তাহলে শতভাগ উৎসব-ভাতা পাওয়া কঠিন কোনো ব্যাপার না।’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোট। বর্তমানে তারা প্রতীকী অনশন পালন করছেন। মহাজোটের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মো. মাঈন উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই টাকায় কী হয়? আমরা মূল বেতনের বাইরে মাত্র এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা-ভাতা পাই। বিশ্বের কোনো দেশে এমন বৈষম্য নেই। এই বৈষম্য দূরীকরণেই জাতীয়করণ জরুরি।’
এবার সুপ্রিম কোর্ট বারের ইফতার মাহফিলে হামলা ভাঙচুর, হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের দোতলায় আইনজীবীদের নির্ধারিত ১ ও ২ নম্বর হলে এ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সরকারপন্থি আইনজীবীরা এ ঘটনায় বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের দায়ী করেছেন। তবে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
মধ্য মার্চে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি (সুপ্রিম কোর্ট বার) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারপন্থি ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থানে। ইতিমধ্যে উচ্চ আদালতের একাধিক কর্মদিবসে আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল, হাতাহাতি, ডিম ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে।
গত ৩০ মার্চ জ্যেষ্ঠ কয়েকজন আইনজীবীর নেতৃত্বে আইনজীবীদের একপক্ষ নতুন করে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে অন্তর্বর্তীকালীন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে। গত রবিবার সুপ্রিম কোর্ট বারের কার্যনির্বাহী কমিটির দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠানের দিন আইনজীবীদের মধ্যে ডিম ছোড়াছুড়ি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
গতকাল সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তনে ইফতার আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন আহ্বায়ক কমিটি। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিলনায়তন তালাবদ্ধ দেখা গেছে। দুপুর থেকেই বার ভবনের নিচে জড়ো হয়ে সরকারপন্থি আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সেøাগান ও মিছিল করতে থাকেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন গত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (নীল প্যানেল) থেকে সভাপতি ও সম্পাদক পদে অংশ নেওয়া মাহবুব উদ্দিন খোকন, রুহুল কুদ্দুস কাজল, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব কায়সার কামাল, একই সংগঠনের সুপ্রিম কোর্ট বার ইউনিট শাখার সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল।
পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সরকারপন্থি আইনজীবীরা বার ভবনের দোতলায় সভাপতি ও সম্পাদকের কক্ষের সামনে অবস্থান নেন। বিকেল ৪টার কিছু আগে বিএনপিপন্থিদের একটি মিছিল ভবনের ২ নম্বর হল অতিক্রম করার সময় ভেতরে থাকা টেবিল, চেয়ার ভাঙচুরের চেষ্টা করা হয়। এ সময় দুপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এর কিছুক্ষণ পরে ১ নম্বর হলে ভাঙচুর চলে। ভেতরের চেয়ার ও টেবিল তছনছ করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারপন্থি আইনজীবীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়ে মিছিল করেন। বিকেল ৫টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা তখন বার ভবনের নিচে অবস্থান নেন। এর কিছুক্ষণ পর ১ নম্বর হলে সুপ্রিম কোর্ট বারের ইফতার মাহফিল শুরু হয়। এতে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, সমিতির সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির, সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল, সাবেক সম্পাদক বশির আহমেদ অংশ নেন। তবে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ইফতার আয়োজন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বার ভবনের নিচে অবস্থান নিয়ে ইফতার সম্পন্ন করেন।
বিএনপিপন্থিদের আক্রমণের মুখে শামসুদ্দিন মানিক : সুপ্রিম কোর্ট বারের ইফতারে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সন্ধ্যা ৬টার দিকে বার ভবনে নিচে আসেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। বার ভবনের করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের হেনস্তা ও আক্রমণের শিকার হন তিনি। কয়েকজন আইনজীবী তার দিকে তেড়ে যান। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় তার দিকে কয়েকটি বোতল ছুড়ে মারেন আইনজীবীরা। এ সময় তার বিরুদ্ধে সেøাগান দিতে দেখা যায় বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের। একপর্যায়ে পুলিশি নিরাপত্তায় থাকায় শামসুদ্দিন মানিক ইফতার আয়োজনে পৌঁছান।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইফতার মাহফিলে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অন্য বিচারপতিদের আসার কথা ছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা ভাঙচুর করে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, তাতে বিচারপতিরা আসতে পারেননি। আমরা বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট বার ইউনিট শাখার সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভাঙচুরের ঘটনা তাদের (সরকারপন্থি আইনজীবী) অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ঘটেছে। এ ঘটনায় আমাদের কেউ জড়িত নন।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হলের আসন দখল করে রাখার বিরুদ্ধে অনশনরত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম প্রত্যয়সহ তাকে সমর্থন দেওয়া কয়েকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।তারা বলেন, ওই স্থানে গত বুধবার রাত থেকে অনশনে ছিলেন প্রত্যয়। তাকে মারধরের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় হামলায় জড়িতরা। এ সময় প্রত্যয়ের দাবির সঙ্গে সংহতি জানানো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হয়।
জানা গেছে, তিন দাবিতে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের খেলার মাঠে অনশনে বসেন প্রত্যয়। তিনি ওই হলের আবাসিক ছাত্র। তার অন্য দুটি দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা ও হলের গণরুমে অবস্থান করা বৈধ ছাত্রদের আসন নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং নবীন শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে লোডশেডিং চলছিল। হঠাৎ করেই প্রত্যয়সহ তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
হামলায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী, মার্কেটিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সৃষ্টি, চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মনিকা, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৮তম ব্যাচের সুরসহ আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা ও রসায়ন বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌতম কুমার দাস, তুষার, ফেরদৌস, নোবেল, গোলাম রাব্বি, মুরসালিন, মুরাদ, সোহেল, তানভীর, রায়হান, রাহাত, সৌমিক, তারেক মীর, সজীব ও নাফিস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যারা প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রত্যয়কে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। তখন তারা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে সেটি ফিরিয়ে দেয়। প্রক্টরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি আসেননি। একাধিক ছাত্রীর দিকেও চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ এমন একটি ফোনকল পেয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তবে কে কল দিয়েছিল সে সম্পর্কে চিকিৎসা কেন্দ্রের কেউ বলতে পারেননি।
তবে যে ফোন নাম্বার থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেটিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় নাম্বারটি শাখা ছাত্রলীগের নেতা গৌতম কুমার দাসের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করব।
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল নিয়ে তারা এ রাত পৌনে ১টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছেন।
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।