
মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের খিদিরপাড়া ইউনিয়নের ডহরী তালতলা খালে গত শনিবার রাতে বালুবাহী নৌযানের (বাল্কহেড) ধাক্কায় ট্রলারডুবিতে গতকাল রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সাতজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। তবে প্রশাসন বলছে, এই নৌপথে বাল্কহেড চলাচলে ছিল নিষেধাজ্ঞা। ডুবে যাওয়া ট্রলারটি গতকাল বেলা পৌনে ১২টার দিকে ক্রেন দিয়ে টেনে ওপরে তোলা হয়। ট্রলারডুবিতে এখনো তিনজন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাদের স্বজনরা।
এদিকে ট্রলারডুবির ঘটনায় মামলা হয়েছে। নিহত দুই তরুণী হ্যাপি আক্তার ও পপি আক্তারের ভাই রুবেল বাদী হয়ে গতকাল দুপুরে বাল্কহেডটির মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে লৌহজং থানায় মামলা করেন। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছেন মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক। জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আরাকে প্রধান করে গঠিত পাঁচ সদস্যের এই কমিটি গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
পরিদর্শন শেষে কমিটির সদস্যরা বলেন, মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় এখনো তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বালু বহনকারী বাল্কহেড চলাচলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া ট্রলারডুবির ঘটনায় তদন্তসাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে থানায় মামলা হয়েছে। জব্দ করা বাল্কহেডটি পুলিশের হেফাজতে রয়েছে।
লৌহজং ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার আব্দুল মতিন জানান, গত শনিবার রাত ২টা পর্যন্ত তাদের উদ্ধার অভিযান চলমান ছিল। পরে কিছু সময় বন্ধ রেখে গতকাল ভোর থেকে আবার উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়। বেলা পৌনে ১২টার দিকে ট্রলারটি উদ্ধার করা হয়। তবে তাতে নিখোঁজ থাকা কারও সন্ধান পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও জানান, শনিবার রাতে সাতজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তারা সবাই সিরাজদিখান উপজেলার লতব্দী ইউনিয়নের বাসিন্দা। তবে শনিবার রাতে ফায়ার সার্ভিস আটজনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল। নিখোঁজের সংখ্যা বলেছিল পাঁচজন। পরে তারা সংশোধন করে নিহত সাত এবং নিখোঁজ তিনজন বলে জানায়।
লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ডা. মো. আব্দুল আউয়াল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে খালটি দিয়ে বালু বহনকারী বাল্কহেড চলাচল করেছে। আমরা গত বছর বালিগাঁও ব্রিজের নিচে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছিলাম। নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এসব নৌযান চলাচল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কঠোর নজরদারি রাখব, সেই সঙ্গে যদি কেউ এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে খালটি দিয়ে বালু বহনকারী বাল্কহেড চালায়, তাহলে তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।’
লৌহজং থানার ওসি খন্দকার ঈমাম হোসেন জানান, নিহত দুই তরুণীর ভাইয়ের করা মামলায় পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ চলমান রয়েছে।
কাঁদছে লতব্দীবাসী : মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার লতব্দী ইউনিয়নের খিদিরপুর ও লতব্দী গ্রামের কয়েকটি পরিবারের ৪৬ জন সদস্য ট্রলারে করে পদ্মা সেতু দেখার জন্য পিকনিকে বের হন শনিবার। লৌহজংয়ের মাওয়ায় পদ্মা সেতু স্বচক্ষে দেখার পর ওই দিন রাতে ফিরছিলেন নিজ নিজ বাড়িতে। পদ্মা সেতু দেখার আনন্দে মাতোয়ারা পরিবারগুলোর নারী, পুরুষ ও শিশুদের সেই আনন্দ মুহূর্তেই পরিণত হয়েছে বিষাদে। উত্তাল পদ্মা পেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ডহরী খালে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় পিকনিকের সেই ট্রলার ডুবে নারী ও শিশুসহ সাতজনের সলিলসমাধি হয়েছে। এ ঘটনায় লতব্দী ইউনিয়নের লতব্দী ও খিদিরপুর গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে কান্নার রোল। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় যেন ভারী হয়ে উঠেছে লতব্দীর আকাশ-বাতাস। ট্রলারডুবিতে খিদিরপুর গ্রামের দুই বোন পপি আক্তার ও হ্যাপি আক্তার এবং হ্যাপি আক্তারের দুই ছেলে সাকিবুল (১০) ও সাজিবুল (৪) নিহত হয়েছে। ওই গ্রামের আব্দুল হাকিমের মেয়ে ও নাতি তারা। একই পরিবারের ৪ জনের এ বিদায়ে কান্না আর আহাজারিতে বুক ভারী হয়ে উঠেছে স্বজনদের। আব্দুল হাকিম এখন অনেকটা বাকরুদ্ধ। স্ত্রী হ্যাপি ও দুই ছেলে সাকিবুল ও সাজিবুলকে হারিয়ে কথা বলতে গিয়ে কেবলই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন রাজমিস্ত্রি মো. জাহাঙ্গীর। স্ত্রী, দুই সন্তান ও স্ত্রীর বড় বোনকে নিয়ে তিনিও গিয়েছিলেন পিকনিকে। পদ্মা সেতু দেখার আনন্দময় সময় কাটানোর পর বাড়ি ফেরার পথে ট্রলারডুবিতে নিজে সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও বেঁচে নেই তার স্ত্রী, দুই সন্তান ও স্ত্রীর বড় বোন। ছেলে সাকিবুল ও সাজিবুল আর স্ত্রী হ্যাপি আক্তারের চিরবিদায়ে এখন কান্নার লোনাজলে ভাসছে জাহাঙ্গীরের দুই চোখ। কিছু বলতে গেলেই কেঁদে ওঠেন, যেন অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি।
লতব্দী ইউনিয়নের অন্য নিহতরা হচ্ছে লতব্দী গ্রামের মো. শাজাহানের স্ত্রী মোকছেদা বেগম (৪০), খিদিরপুর গ্রামের শাহাদাত হোসেনের মেয়ে রোজা মনি (৪ মাস) ও ফিরোজ সরকারের ছেলে ফারিয়ান (৮)।
স্বজনদের দাবি, ট্রলারডুবির ঘটনায় এখনো ৩ জন নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ ৩ জনই শিশু। মামা আরিফ খান মাহিন, নাফা ও তুরান নামে ৩ শিশুর নিখোঁজের তথ্য জানান।
দেশে এখন ডেঙ্গুর পাশাপাশি আরও দুই ধরনের জ্বর নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এর মধ্যে বেশি পাওয়া যাচ্ছে ভাইরাসজনিত জ্বর। বিভিন্ন হাসপাতালের বহির্বিভাগে ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আসা জ্বরের রোগীর অর্ধেক ডেঙ্গু ও অর্ধেক সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বরের রোগী। এ দুই জ্বরের পাশাপাশি ঢাকা শহরে উদ্বেগজনকসংখ্যক টাইফয়েড জ্বরের রোগীও পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকরা বলছেন, কিছু নির্দিষ্ট উপসর্গের ভিত্তিতে ডেঙ্গু ও সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বরের রোগীদের আলাদা করা যাচ্ছে। কিন্তু টাইফয়েড জ্বরের উপসর্গ ডেঙ্গুজ¦রের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। সে কারণে এ মৌসুমে যে কারও জ্বর হলেই তাকেই ডেঙ্গু এনএস১ পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা গতকাল রবিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন দেশে তিন ধরনের জ্বর দেখা যাচ্ছে ও এ তিন ধরনের রোগীর সংখ্যাও অনেক। এগুলো হলো ডেঙ্গুজ্বর, সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বর বা ভাইরাল ফিভার ও টাইফয়েড জ্বর। পরীক্ষার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, কারও জ্বর হলেই ডেঙ্গু এনএস১ পরীক্ষা করে বাকি দুটি জ¦রকে আলাদা করে ফেলতে হবে। এতে চিকিৎসা সহজ হবে ও রোগীও দ্রুত সুস্থ হবে।
অর্ধেক ডেঙ্গ, অর্ধেক ভাইরাল ফিভারের রোগী : গত দুদিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে ভাইরাল ফিভার রোগীদের লম্বা লাইন দেখা গেছে। গতকাল দুপুরে ঢামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে কথা হয় যাত্রাবাড়ী থেকে আসা আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে। তার পাঁচ বছরের শিশু তামান্নার গত তিন দিন ধরে জ্বর। স্থানীয় এক চিকিৎসককে দেখিয়েছেন ও চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু জ্বর কমছে না। বাধ্য হয়ে তিনি গতকাল শিশুকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। তামান্নার বাবা বলেন, ডাক্তার দেখেছে। রক্ত পরীক্ষা করেছে। বলেছে সাধারণ জ্বর। এটা এখন হচ্ছে। তিনি ওষুধ দিয়েছেন। বলেছেন ভালো হয়ে যাবে।
কথা হয় এই হাসপাতালের বহির্বিভাগের অ্যাডমিশন ইনচার্জ আবদুল মামুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, গতকাল বহির্বিভাগে মেডিসিন ও শিশু বিভাগে সাড়ে সাতশর মতো রোগী এসেছে। এর মধ্যে শিশু বিভাগে আড়াইশ ও মেডিসিন বিভাগে পাঁচশর মতো। এ দুই বিভাগের সাধারণ জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছে ৪০ জন রোগী। তাদের মধ্যে শিশু ১০ জন। বাকিদের পরীক্ষা করে ও চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, গত ১৫ দিনে বহির্বিভাগে সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বরের রোগী বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান দেশ রূপান্তরকে জানান, প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৭০০-৮০০ জন জ¦রের রোগী আসছে। গত ১৫ দিনের তুলনায় এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। এসব জ¦রের রোগীর মধ্যে ২৫-৩০ শতাংশ ডেঙ্গুজ্বর, বাকি রোগীরা সাধারণ ভাইরাসজনিত জ¦র বা সাধারণ ঠান্ডাজ্বরের রোগী।
এ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজমুল আহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ল্যাবএইড হাসপাতালে আমার ব্যক্তিগত চেম্বারে এখন আসা মোট জ্বরের রোগীর অর্ধেক ডেঙ্গু ও অর্ধেক ঠান্ডাজ্বর। এ ছাড়া কিছু হেপাটাইটিস-এ রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। তবে বেশি পাওয়া যাচ্ছে ঠান্ডাজ্বরের রোগী।’
ভাইরাল ফিভারের উপসর্গ : অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা বলেন, ভাইরাল ফিভার এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো, শ্বাসনালির সংক্রমিত হয়। নাকে, গলায়, এমনকি ফুসফুসে এক ধরনের ভাইরাস সংক্রমণের কারণে জ¦র হয়। এটাতে গায়ে ব্যথাও হয়। সেজন্য অনেক সময় সংশয় দেখা দেয় এটা ডেঙ্গু, নাকি অন্য ভাইরাল ফিভার। ভাইরাল ফিভারের লক্ষণ হলো সাধারণত নাকে পানি পড়ে ও কাশি থাকে। কিন্তু ডেঙ্গুজ্বরের রোগীদের এ দুটি উপসর্গ থাকে না। এ ভাইরাল ফিভারে পাতলা পায়খানা হয় না, কিন্তু ডেঙ্গুজ্বরে অনেকের পাতলা পায়খানা হয়।
এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ডেঙ্গুজ্বর ও ভাইরাল ফিভার চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই চলে যায়। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে জ্বর চলে যাওয়ার পর কিছু জটিলতা দেখা দেয়। ভাইরাল ফিভার ভালো হওয়ার পর তেমন কোনো জটিলতা থাকে না, একটু দুর্বলতা থাকে। ভাইরাল ফিভার রোগীদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই। শুধু প্যারাসিটামল ও কাশির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ দিলেই হয়।
দেখা দিচ্ছে টাইফয়েড জ্বর : অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা বলেন, আরেকটা জ্বর ঢাকা শহরে বেশি দেখা যাচ্ছে। সেটা টাইফয়েড জ্বর। এটা টাইফয়েডের মৌসুম। এ ধরনের জ্বরের রোগীর সংখ্যাও একেবারে কম নয়, উদ্বেগজনকসংখ্যকই।
এ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, টাইফয়েড জ¦র যখন বেশি থাকে, তখন শুরুতে পাতলা পায়খানা থাকে। ডেঙ্গু ও টাইফয়েড জ্বর পরীক্ষা ছাড়া আলাদা করা কঠিন। তবে ডেঙ্গু হলে এনএস১ পরীক্ষা করে নির্ণয় করা যায়। সেজন্য যাদের চার-পাঁচ দিন পরও জ¦র থাকে, তাদের ক্ষেত্রে টাইফয়েড ধরে নেওয়া হয়। তাদের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এভাবে দ্রুত টাইফয়েড শনাক্ত করা যায়। তিনি জানান, এখন নিউমোনিয়া জ্বরের রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। তবে বছর জুড়ে যে পরিমাণ থাকে, তার চেয়ে বেশি না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজমুল আহসান বলেন, ভাইরাল ফিভারের বেশিরভাগ রোগী আক্রান্তের তিন-চার দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। নিজে নিজে চিকিৎসা নেওয়া যাবে না। যেকোনো সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখালেই হবে। সেখানেই শনাক্ত করা যায় কোন ধরনের জ্বর। এমন নয় যে এ জ্বরের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে হবে।
এ চিকিৎসক আরও বলেন, যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এ জ্বরের মৌসুমটা আগস্ট পর্যন্ত চলবে। তবে সেপ্টেম্বরেও থাকতে পারে। যতদিন বৃষ্টি থাকবে, ততদিন এ ধরনের জ¦র থাকবে।
“সব শালা কবি হবে/পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই;/বন থেকে দাঁতাল শুয়োর/রাজাসনে বসবেই” আদমজীর সামনে ২০ হাজার শ্রমিকের সমাবেশে এ কবিতা পড়ে এক কবি তার নাম রটিয়ে দিলেন মুখে মুখে। কবিতার নাম খোলা কবিতা। স্বৈরাচার এরশাদ তখন রাজাসনে। মানুষের মুক্তির জন্য পঞ্চাশের দশকের পর খুব কম আধুনিক কবিই কবিতা লিখেছেন, মোহাম্মদ রফিক তার মাটিবর্তী গাওদিয়া, কীর্তিনাশা থেকে বসবাস করা সত্ত্বেও এ শহরে ফিরে আসেননি। এবার চলে গেলেন একেবারে শেষবারের মতো।
তার অনুজ সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ তারেকের কাছেই শুনলাম মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া খবরটি। শিমুল, তোমার রফিক স্যার তো নাই। বরিশালে গিয়েছিলেন গতকাল রবিবার সকালে, বোনের বাড়ি থেকে ঢাকা আসার পথে মাদারীপুরের রাজৈরের কাছে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সেখানকার স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাকে নেওয়া হয়। চিকিৎসক সেখানেই তাকে রাত ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে মৃত ঘোষণা করেন। কবির প্রবাসী বড় ছেলে শুভব্রত রফিক তখন ছিলেন কবির সঙ্গেই, গাড়িতে। তাকে সেখান থেকে দ্রুত বাগেরহাটে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানান সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ তারেক। তার মানে রফিক স্যারের কথামতোই ঢাকায় তাকে আর আনা হচ্ছে না। কীর্তিনাশা, কপিলা, গাওদিয়ার কবি, কাটাখালী হয়ে ফিরে যাচ্ছেন বাগেরহাটে, মায়ের কবরের পাশেই সমাহিত হবেন তিনি।
বাংলা কবিতার আরেকটা বড় অধ্যায় শেষ হলো। ২২ শে শ্রাবণে।
সামান্য থিতু হয়ে যখন লিখছি, তখন সবার আগে মনে পড়ছে কপিলার কথা, তা ছাপিয়ে গাওদিয়া কথা, তা ছাপিয়ে আসছে কালাপানি দরিয়ার ঘ্রাণ ‘মাঠে-মাঠে ছড়িয়ে মেঘের লাশ,/রক্ত বন্যা, উজিয়ে নক্ষত্ররাজি, ফুটে ওঠে ঘাসফুল;/তাই বলে, আকাশ বলেনি পৃথিবীকে, চল বাঁধি ঘর!’// (কালাপানি, ২০০৬)
বাংলা কবিতার মনোযোগী পাঠককে স্বীকার করতেই হবে, ষাটের দশকে ‘সমকাল’ ও ‘কণ্ঠস্বরে’ লেখালেখি শুরু করা কবি মোহাম্মদ রফিক জীবনভর নদী, জল, কাদামাটির সঙ্গে যুক্ত জীবনযাপনের চিত্র তুলে এনে তার স্বাদু কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার ভাণ্ডার মণিরত্নে ভরে দিয়েছেন। কীর্তিনাশা, কপিলা, গাওদিয়া, খোলা কবিতা, বিষখালী সন্ধ্যা বা কালাপানি, অশ্রুময়ীর শব বা নোনাঝাউ তার এসব কাব্য বাংলা কবিতায় অনন্য সংযোজন বলে স্বীকার করবেন কবিতার পাঠক পদবাচ্যের যে কেউ। সামরিক শাসন ও শাসকের তথাকথিত কবি হওয়ার অভিলাষের বিরুদ্ধে তার রচিত বহুবিশ্রুত পঙ্ক্তি ‘সব শালা কবি হবে’। আধুনিক বাংলা কাব্যসম্ভারে তার ‘কপিলা’ (১৯৮৩) মহাকাব্যোপম এক সৃষ্টি।
অরুণ সেন বলতেন তাকে সর্বমানুষের মুক্তি-চেতনার কবি। মোহাম্মদ রফিকের জন্ম ১৯৪৩ সালে ২৩ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার বেমরতা ইউনিয়নের বৈটপুর (বর্তমান চিতলী) গ্রামে। পিতা সামছুদ্দীন আহমদ এবং মাতা রেশাতুন নাহার। আট ভাইবোনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মোহাম্মদ রফিক ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। খুলনার বাগেরহাটেই কেটেছে কবির শৈশব। স্থানীয় বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করলেও পরে পিরোজপুর জেলা স্কুল, বরিশাল ও খুলনা জেলা স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। খুলনা জেলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক) পাস করেন তিনি। এরপর ঢাকার নটর ডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু পরে ঢাকা কলেজে মানবিক বিভাগে চলে যান। এ সময় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়, যা তার সাহিত্যিক চেতনায় প্রগাঢ় ছাপ ফেলে। ১৯৬১ সালে ইন্টার মিডিয়েট (উচ্চ মাধ্যমিক) পাস করেন। সে বছরই রাজশাহী সরকারি কলেজে ইংরেজিতে অনার্সসহ স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন কবি মোহাম্মদ রফিক। এরপর অংশ নেন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে। সামরিক আইনে তাকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় সামরিক আদালত। এ সময় দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়ান। তবুও জেল এড়াতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় তাকে বহিষ্কার করা হয় রাজশাহী কলেজ থেকে। পরে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মামলায় জয়লাভ করে পাসকোর্সে বিএ পাস করেন ১৯৬৫ সালে। একই বছর ইংরেজি বিষয়ে এমএতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৬৭ সালে মোহাম্মদ রফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কবি যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে, আইয়ুব শাহির আমলে খুলনা, যশোর, বাগেরহাট এবং পরবর্তী সময়ে বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বৈশাখী পূর্ণিমায় প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ১ নম্বর সেক্টরের হয়ে। স্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে সংগঠিত করে তুলতে। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় মোহাম্মদ রফিকের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধুলোর সংসারে এই মাটি। আশির দশকের শুরুতে স্বৈরাচার এরশাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপটে দেশে সাম্প্রদায়িকতা, দারিদ্র্য ও একনায়কতন্ত্রের যে ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয়, তারই প্রেক্ষাপটে লেখেন খোলা কবিতা (১৯৮৩)। যার লাখ লাখ কপি বিলি করেছে স্বৈরাচারের পতনপ্রত্যাশী, গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের মানুষ।
কীর্তিনাশা (১৯৭৯), খোলা কবিতা ও কপিলা (১৯৮৩), গাওদিয়া (১৯৮৬), স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময় (১৯৮৮), মেঘে এবং কাদায় (১৯৯১), রূপকথা কিংবদন্তি (১৯৯৮), মৎস্যগন্ধা (১৯৯৯), মাতি কিসকু (২০০০), বিষখালী সন্ধ্যা (২০০৩), নির্বাচিত কবিতা (২০০৩), কালাপানি (২০০৬), নির্বাচিত কবিতা (২০০৭), নোনাঝাউ (২০০৮), দোমাটির মুখ (২০০৯), অশ্রুময়ীর শব (২০১১), কালের মান্দাস (২০১২), ঘোরলাগা অপরাহ্ণ (২০১৩), বন্ধু তুমি প্রসন্ন অবেলায় (২০১৫) এসবই মোহাম্মদ রফিকের কবিতাগ্রন্থ। ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে কীর্তিনাশা, গাওদিয়া ও কপিলা নিয়ে কাব্যসংকলন ত্রয়ী (২০০৯)। ঐতিহ্য আরও প্রকাশ করেছে মোহাম্মদ রফিক রচনাবলি-১ (২০০৯) মোহাম্মদ রফিক রচনাবলি-২ (২০১০)। ১৯৯৩ সালে অরুণ সেনের সম্পাদনায় কলকাতার প্রতিক্ষণ থেকে প্রকাশিত হয়েছে মোহাম্মদ রফিকের নির্বাচিত কবিতা। কবিতার পাশাপাশি তার রয়েছে বেশ কয়েকটি গদ্যগ্রন্থ। এর মধ্য ভালোবাসার জীবনানন্দ (২০০৩), আত্মরক্ষার প্রতিবেদন (২০০১, ২০১৫) ও স্মৃতি বিস্মৃতির অন্তরালে (২০০২) অন্যতম। কবি মোহাম্মদ রফিক আইওয়াতে ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন ১৯৯৩ সালে। মার্কিনিদের আইওয়া শহরের অভিজ্ঞতা, ভিনদেশের লেখকদের সঙ্গে কবির মতবিনিময়, দেশ-বিদেশের সাহিত্যের খবর ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘দূরের দেশ নয় আয়ওয়া’ বইটি। নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু ছোটগল্প লেখেন কবি।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান মোহাম্মদ রফিক। এ ছাড়া আলাওল পুরস্কারসহ (১৯৮১) বিভিন্ন পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
রাজধানী ঢাকা লাগোয়া নারায়ণগঞ্জ জেলার শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত রূপগঞ্জ উপজেলা। এ উপজেলায় পড়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি মহাসড়কের বড় একটি অংশ। মহাসড়ক দুটি হলো ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এবং এশিয়ান বাইপাস সড়ক। মহাসড়ক দুটিতে চাঁদাবাজ চক্র দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এখানে চাঁদা ছাড়া যেন ঘোরে না কোনো গাড়ির চাকা। মহাসড়ক দুটিতে চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহন থেকে মাসে প্রায় অর্ধকোটি টাকার চাঁদা আদায় হয়। চাঁদার টাকা যায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের পকেটে। নেতাকর্মীদের পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশকেও প্রতি মাসে চাঁদা দিতে হয়।
হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও মালিকরা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এ মহাসড়ক থেকে হাইওয়ে পুলিশ প্রতি মাসে চাঁদা হিসেবে অন্তত ১০ লাখ টাকা আদায় করে। হাইওয়ে পুলিশের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে পরিবহন চালক ও পরিবহন মালিকরা।
রূপগঞ্জ উপজেলায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যাত্রামুড়া এলাকা থেকে আধুরিয়া পর্যন্ত পড়েছে ১৪ কিলোমিটার ও এশিয়ান হাইওয়ে বাইপাস সড়কের ১৫ কিলোমিটার অংশ রয়েছে। আর এ দুটি মহাসড়ক কাঁচপুর হাইওয়ে থানা, ভুলতা হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্প ও বিশ্বরোড পুলিশ বক্সের অধীনে রয়েছে। কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ওসির দায়িত্বে রয়েছেন পরিদর্শক রেজাউল হক, ভুলতা হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন আবু নাঈম ও বিশ্বরোড পুলিশ বক্সের দায়িত্বে আছেন পরিদর্শক শরফ উদ্দিন। এ তিনজনের নেতৃত্বে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও এশিয়ান বাইপাস সড়কে হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি চলে বলে অভিযোগ স্থানীয় পরিবহন মালিক এবং চালক-শ্রমিকদের। এ দুটি মহাসড়ক ঘিরে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম কাপড়ের বাজার গাউছিয়া মার্কেট, পাইকারি কাঁচামালের আড়তসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা। এ ছাড়া রয়েছে পূর্বাচল উপশহর। এসব কারণে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসে। এ সবকিছুকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দূরপাল্লার বাস, ট্রাক ও পিকআপ স্ট্যান্ড। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিও। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজারো গাড়ি চলাচল করে। রূপগঞ্জের ভুলতা থেকে কাঁচপুর, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, কুড়িল বিশ্বরোড, সায়েদাবাদ, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন রুটে চলাচল করা বাস, ট্রাক, লেগুনা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার ও ট্রাকের বেশিরভাগই ফিটনেসবিহীন ও কাগজপত্র ছাড়া চলছে। এসব ফিটনেসবিহীন যানগুলো হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে চলছে বলে অভিযোগ। পরিবহন খাতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও রয়েছে বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ।
পরিবহন মালিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভুলতা থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত লেগুনা চলাচল করে ৭০-৮০টি। লেগুনাগুলোর কোনো বৈধ কাগজপত্র না থাকায় কাঁচপুর লেগুনাস্ট্যান্ড থেকে পুলিশ পায় মাসে ৬০ হাজার টাকা। এ ছাড়া কাঁচপুর অটোরিকশা, সিএনজি স্টেশন থেকে হাইওয়ে পুলিশ মাসে পায় ২০ হাজার টাকা। বরপা থেকে যাত্রাবাড়ী লেগুনাস্ট্যান্ড থেকে প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা হাইওয়ে পুলিশ পায়। মহাসড়কের পাশের চোরাই তেলের দোকানগুলো থেকে কামাল নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে মাসে ১০ হাজার ও মাসুম নামে আরেকজনের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা পায় হাইওয়ে পুলিশ। এ ছাড়া আরও কিছু চোরাই তেলের দোকান থেকে মাসিক ২০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় হয়। গোলাকান্দাইল গোলচত্বরের ভেতরে অবৈধ দোকানপাট থেকে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার মাধ্যমে হাইওয়ে পুলিশ পায় মাসে ১০ হাজার টাকা। গোলাকান্দাইল বাসস্টেশনের পশ্চিমপাড় থেকে সোহাগের মাধ্যমে পায় মাসে ২০ হাজার টাকা। গোলাকান্দাইল ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় প্রাইভেট কার স্ট্যান্ড থেকে মাসুমের মাধ্যমে হাইওয়ে পুলিশ পায় ২০ হাজার টাকা। ভুলতা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড, মীরের বাজার, কাঞ্চন সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে তালালের মাধ্যমে হাইওয়ে পুলিশ পায় ২০ হাজার টাকা। ভুলতা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত বিআরটিসি বাস স্টেশন থেকে যুবলীগের এক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার মাধ্যমে হাইওয়ে পুলিশ পায় ২০ হাজার টাকা। ভুলতা থেকে গুলিস্তানগামী গ্লোরী, আসিয়ান, গাউছিয়া এক্সপ্রেস বাসস্টেশন থেকে পায় ৩০ হাজার টাকা। ভুলতার প্রাইভেট কার, হাইএস স্ট্যান্ড থেকে এক আওয়ামী লীগ নেতার মাধ্যমে পায় ৩০ হাজার টাকা। ভুলতা ফাঁড়ির সামনের অটোস্ট্যান্ড থেকে জাহিদের মাধ্যমে পায় মাসে ২০ হাজার টাকা। ভুলতায় আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে নসিমনস্ট্যান্ড থেকে ১০ হাজার, নূর ম্যানশনের সামনে নসিমনস্ট্যান্ড থেকে মিজানের মাধ্যমে ১০ হাজার, মহাসড়কের ফুটপাত দখল করে বসা দোকানপাট থেকে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের মাধ্যমে ৭০-৮০ হাজার, রেদোয়ান টাওয়ারের সামনে বাসস্ট্যান্ড থেকে ২০ হাজার, মেঘলা বাস কাউন্টার থেকে ২০ হাজার, যুবকল্যাণ বেকার পরিবহন থেকে ১০ হাজার, যুবকল্যাণ এক্সপ্রেস থেকে ১০ হাজার, মদিনার পথে পরিবহন থেকে ১০ হাজার, মুক্তিযোদ্ধা পরিবহন থেকে ১০ হাজার এবং সততার পথে পরিবহন থেকে যুবরাজের মাধ্যমে হাইওয়ে পুলিশ পায় মাসে ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া দূরপাল্লার বাসগুলো থেকে মাসে প্রায় ১ লাখ টাকার মতো চাঁদা আদায় হয়। ভুলতায় অটোরিকশাস্ট্যান্ড থেকে ২০ হাজার, গোলাকান্দাইল পিকআপ স্ট্যান্ড থেকে খালেকের মাধ্যমে ২০ হাজার, সাওঘাট এলাকায় অটোরিকশা স্টেশন থেকে দেলোয়ারের মাধ্যমে ১০ হাজার, গোলাকান্দাইল পূর্বপাড়ে অটোরিকশা, সিএনজিস্ট্যান্ড থেকে ৪০ হাজার এবং গার্মেন্টেসের শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত বাসগুলো থেকে হাইওয়ে পুলিশ পায় ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া গোলাকান্দাইল, ভুলতা, রূপসী, বরপা এলাকার অটোরিকশা গ্যারেজগুলো থেকেও প্রতি মাসে টাকা পায় হাইওয়ে পুলিশ। রূপসী বাসস্টেশন, বরপা, বরাব, ভুলতা, বিশ্বরোড থেকে প্রাইভেট কার, পিকআপ, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান থেকে কাগজপত্র যাচাইয়ে নামে চাঁদা আদায় হয়। প্রতিটি গাড়ি থেকে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। এ সময় হাইওয়ে পুলিশের কারও পোশাকে নেমপ্লেট থাকে না বলে জানান পরিবহনচালকরা। হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে রয়েছে রেকার বাণিজ্যেরও অভিযোগ। বনিবনা না হলেই রেকার লাগিয়ে থানায় নেওয়া হয় গাড়ি।
হাইওয়ে পুলিশকে নিয়মিত চাঁদা দেওয়া কয়েকজন বলেন, চাঁদা না দিলেই কয়েক দিন পরপর লোকদেখানো অভিযান পরিচালনা করে। চাঁদা দিলে আবার সব ঠিকঠাক থাকে। প্রতি মাসে ১-৫ তারিখের মধ্যে হাইওয়ে পুলিশ বক্সে গিয়ে চাঁদা দিয়ে আসতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লেগুনাচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘গাড়ির জমা দিই ৯০০ টাকা। প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয় ৩০০ টাকা। যা টাকা ইনকাম করি তা গাড়ির জমা আর চান্দা দিতেই চইলা যায়। লেগুনার কাগজপত্র না থাকায় প্রতি মাসে কাঁচপুরে হাইওয়ে পুলিশকে ৮০০ টাকা কইরা দিতে অয়। আবার ভুলতার হাইওয়ে পুলিশরে দিতে অয় ৬০০ টাকা। চাঁদা না দিলে লেগুনা রাস্তায় চলাচল করতে দেয় না।’
আইয়ুব নামে সিএনজিচালিত অটোরিকশার এক চালক বলেন, ‘সরকার মহাসড়কে সিএনজি বন্ধ করলে আমার কি! আমি হাইওয়ে পুলিশকে প্রতি মাসে টাকা দিই, এ কারণে তারা আমার সিএনজি ধরে না।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ওসি রেজাউল হক ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রূপগঞ্জ অংশ তার দায়িত্বাধীন এলাকার মধ্যে পড়ে না বলে দায় এড়িয়ে যান। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ভুলতা হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্প ও বিশ্বরোড পুলিশ বক্সের অধীনে বলে জানান তিনি। অথচ পুলিশ ক্যাম্প ও পুলিশ বক্স থানার অধীনেই বলে জানা গেছে।
চাঁদা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভুলতা হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ আবু নাঈম বলেন, ‘আপনি নিউজ করেন, নিউজ করলে আমার কিছু আসবে যাবে না। নিউজ করলে আমার চাকরি যাবে না। হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে। এ ছাড়া হাইওয়ের পাশে ফুটপাত আমরা উঠিয়ে দিলে তারা আবার বসালে আমাদের কী করার আছে?’
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে বিশ্বরোড পুলিশ বক্সের পরিদর্শক শরফ উদ্দিনের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ ও অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে দেশের বাইরে অর্থ পাঠানো হয়েছিল কি না, অর্থ পাচার হয়েছে কি না, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও সিআইডিকে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে আদালত।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গতকাল রবিবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেয়। আগামী ৮ অক্টোবর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে।
গত ৪ আগস্ট ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রুপ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া সাইপ্রাস, সিঙ্গাপুর ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে অর্থ স্থানান্তর করেছে। সেখানে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার এস আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের সন্ধান পাওয়া গেছে।
ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমধ্য সাগরীয় ছোট দেশ সাইপ্রাস ২০০৭ সালে তাদের ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’ কর্মসূচি চালু করে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরামর্শদাতা সংস্থার মতে, এ প্রকল্পের আওতায় দেশটির আবাসন খাতে প্রায় ২ মিলিয়ন ইউরো (২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিয়োগ এবং সাইপ্রাস সরকারের গবেষণা ও ভূমি উন্নয়ন তহবিলে আরও ২ লাখ ইউরো অনুদানের বিনিময়ে ধনী বিদেশিদের সাইপ্রাসের নাগরিকত্বের সুযোগ দেওয়া হয়।
সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড করপোরেট রেগুলেটরি অথরিটি (এসিআরএ) থেকে পাওয়া প্রতিষ্ঠানের প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, এর দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট সাইফুল আলম ও ফারজানা পারভীন নিজেদের সাইপ্রাসের নাগরিক এবং সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা দেখিয়ে সিঙ্গাপুরে ক্যানালি লজিস্টিকস প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় কোম্পানিটির ইস্যু করা ও পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৩০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার)। এস আলম ও তার স্ত্রী একমাত্র শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। আলম ৩০ মিলিয়ন শেয়ারের ৭০ শতাংশ এবং তার স্ত্রী বাকি ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন।
সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশটিতে রেসিডেন্স পারমিট বা বিদেশিদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া এস আলম ও তার স্ত্রী ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের আরও একটি অফশোর শেল কোম্পানি পিকক প্রপার্টি লিমিটেডের সঙ্গেও যুক্ত। সিঙ্গাপুর থেকে ১৭ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরের ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস এমন এক ট্যাক্স হ্যাভেন বা কর স্বর্গ, যেখানে আয়কর, করপোরেট কর বা মূলধনী কর নেই।
আরেক কর স্বর্গ সাইপ্রাসে ২০১৬ সালে এস আলম অ্যাকলেয়ার ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান কেনেন। সাইপ্রাসের কোম্পানির রেজিস্ট্রার বিভাগ এবং অফিশিয়াল রিসিভারের নথি অনুসারে, পরবর্তীকালে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে অ্যাকলেয়ার ইন্টারন্যাশনাল রাখা হয়।
গতকাল হাইকোর্টের এ বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে এস আলমের অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশনা চান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। রুলে অভিযোগ ওঠা অর্থ পাচার রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত হবে না জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে অভিযোগ অনুসন্ধানে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না রুলে তাও জানতে চেয়েছে আদালত। দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ।
অ্যাডভোকেট খুরশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান বিএফআইইউ, দুদক ও সিআইডি প্রতিবেদন দেবে। আমাদের ওপর রুল হয়েছে।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুদ্দিন খালেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশের অনুলিপি পেলে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুসন্ধানের বিষয়ে অবহিত করা হবে।’
সকালের বৃষ্টিতেই ডুবছে চট্টগ্রাম। তিন দিন ধরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সারা দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও সকালের ভারী বৃষ্টিতেই নগরী জলমগ্ন হচ্ছে। দুপুর পর্যন্ত পানিবন্দি থাকছে নগরবাসী। আবার বিকেলের দিকে বৃষ্টির তীব্রতা কমে আসছে এবং রাতেও এই কম থাকার ধারা অব্যাহত থাকছে। কিন্তু সকাল হলেই যেন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। গত কয়েক দিনে নগরীতে জলাবদ্ধতার সময় ও বর্ষণের পরিমাণের উপাত্ত মিলিয়ে দেখলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত উপাত্তে দেখা যায়, গতকাল রবিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নগরীর আমবাগান আবহাওয়া কেন্দ্র ১৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে গতকাল সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় রেকর্ড হয়েছে ৭৩ মিলিমিটার। বাকি বৃষ্টি অবশিষ্ট ২১ ঘণ্টায় হয়েছে। শুধু গতকালই নয়, গত শনিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আমবাগান কেন্দ্র ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করলেও সকালের ৩ ঘণ্টায় হয়েছে ৪৩ মিলিমিটার। এর আগের দিন শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেও সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সময়ে হয়েছে ৫৫ মিলিমিটার।
সকালে এত বেশি বৃষ্টি কেন হয়? অনেকের সহজ উত্তর মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কারণে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আবহাওয়াবিজ্ঞান কী বলে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ কামরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় সকালে বেশি বৃষ্টিপাত হয় এবং সমুদ্র থেকে যত দূরে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে সেসব এলাকায় দুপুরের পর থেকে বৃষ্টিপাত বেশি হয়ে থাকে।’
এর কারণ কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাগরের ওপরে থাকা ঘনীভূত মেঘগুলো উপকূলীয় এলাকার দিকে সকালে অগ্রসর হয়। তাই সকালে উপকূলের কাছাকাছি বেশি বৃষ্টিপাত হয়। পরে ধীরে ধীরে স্থলভাগের ভেতরের দিকে (দেশের অভ্যন্তরে) প্রবেশ করে এবং বৃষ্টিপাত ঘটায়। এ জন্যই দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সকালে বেশি বৃষ্টি হয় এবং উত্তরাঞ্চল কিংবা মধ্যাঞ্চলে অন্য সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়।’
শুধু কি সকাল? ভোররাতেও কিন্তু চট্টগ্রাম এলাকায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এর আগে ভোরের বৃষ্টিতেই চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৭ সালের ১১ জুন রাতে প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় ও দেয়াল ধসে ১২৮ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। ২০০৮ সালে ভোরের প্রবল বর্ষণে মতিঝর্ণায় একই পরিবারের ৫ জন, ২০১১ সালে বাটালি হিলে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতি বছরই নগরীতে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে।
এদিকে গত দুই দিনের মতো গতকালের বৃষ্টিতেও চট্টগ্রাম মহানগরীর পূর্বাংশের ষোলশহর, মুরাদপুর, বহদ্দরহাট, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, বাদুরতলা, কাপাসগোলা, চকবাজার, কেবি আমান আলী রোড, ফুলতলা, বাকলিয়া সৈয়দ শাহ রোড, ডিসি রোড, চান্দগাঁও প্রভৃতি এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতা তীব্র আকার ধারণ করে। এ ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে ওয়াসা মোড়, জিইসি মোড়, জাকির হোসেন রোডের ঝাউতলা রেলগেট, ওয়ার্লেস মোড়, অলংকার মোড়, পশ্চিম ফিরোজশাহ কলোনি, সাগরিকা, নয়াবাজার মোড়, পোর্ট কানেকটিং রোডের তাসপিয়া থেকে ওয়াপদা পর্যন্ত রাস্তায় পানি জমেছে। অপরদিকে রামপুরা ওয়ার্ডের নয়াবাজার, উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের বসুন্ধরা, হালিশহর কে-ব্লক, এল-ব্লকসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি জমেছে।
বৃষ্টি আরও কত দিন থাকতে পারে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পতেঙ্গা কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াদি উজ্জ্বল কান্তি পাল বলেন, ‘মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কারণে চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। তবে এমন মুষলধারে বৃষ্টি আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এ ছাড়া এই সময়ে ভারী বর্ষণের সতর্কতা থাকায় পাহাড়ধস হতে পারে বলে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।’
এদিকে জানমালের ক্ষতি কমাতে পাহাড় থেকে অবৈধ বসতিদের সরিয়ে নিয়ে আসছে জেলা প্রশাসন। পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং করে এবং প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে জেলা প্রশাসনের একাধিক টিম পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরিয়ে আনতে কাজ করছে।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানে একটি অঙ্গ পাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশ বলছে। চক্রটির নেতা ফাওয়াদ মুখতারের বিরুদ্ধে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের কিডনি চুরি করে বের করে ধনী গ্রাহকদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা বিবিসি নিউজ।
বিবিসি জানায়, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহ থেকে কিডনি সরিয়ে ফেলা এবং ধনী গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অভিযোগে ফাওয়াদ মুখতার নামের এক চিকিৎসক ও তার দলের আট সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তান পুলিশ। ফাওয়াদ এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগীর কিডনি চুরি করেছেন।
এমনকি অস্ত্রোপচারকালে কিডনি চুরির সময় তার হাতে অন্তত তিনজন রোগী মারা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ফাওয়াদ এর আগে পাঁচবার অসদাচরণের জন্য গ্রেপ্তার হলেও প্রতিবারই জামিন নিয়ে মুক্তি পেয়ে যান। রোববার (১ অক্টোবর) পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পাকিস্তান পুলিশ। চক্রটি পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের পাশাপাশি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে কাজ করছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহসিন নকভি রবিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, “কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টগুলি বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনকে ক্লিনিক আকারে সাজিয়ে সেখানে রোগীদের অস্ত্রোপচার করার সময় রোগীদের অজান্তেই কিডনি সরিয়ে নেয়া হত।“
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাওয়াদ মুখতার জানিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন চক্র এখন পর্যন্ত মোট ৩২৮ রোগীর দেহ থেকে কিডনি চুরি করেছে। প্রতিটি কিডনি বিক্রি হয়েছে ১ কোটি রুপি করে।
২০১০ সালে মানবদেহের প্রত্যঙ্গ ব্যবসা নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান। এ অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।