
প্রতিবেশী দেশ ভারতের আদালতে একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও মানিকগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম। তিনি দাবি করেছেন, তাকে হয়রানি ও টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল মামলার বাদীর মূল উদ্দেশ্য। গতকাল বুধবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এমনটি দাবি করেন মমতাজ।
ওই পোস্টে মমতাজ বলেন, ‘আমার প্রিয় এলাকাবাসী ও সারা দেশে আমার গানের ভক্ত আশেকান এবং আমার শুভাকাক্সক্ষী যারা রয়েছেন, তারা কয়দিন যাবৎ একটা নিউজের পরিপ্রেক্ষিতে খুব মন খারাপ করে আছেন। এটার সত্যতা কতটুকু, জানতে চাচ্ছেন। আমি বিদেশ ছিলাম ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। দেশে ফিরেই ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবস নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটাই। এ জন্য এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে বেশ অনেক বছর আগে ভারতের বহরমপুর কোর্টে আমার বিরুদ্ধে এক ব্যক্তি একটা মিথ্যা বানোয়াট মামলা দায়ের করেন। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাকে ভয় দেখিয়ে কিছু টাকা হাতিয়ে নেওয়া। আর ওই ব্যক্তি ছাড়া আমি যেন কারও মাধ্যমে ভারতে কোনো কনসার্ট করতে না পারি। কোনো ডকুমেন্ট ছাড়া ১৪ লক্ষ টাকা নেওয়ার একটি মিথ্যা মামলা উনি সাজিয়েছেন, যার কোনো প্রমাণ এই ১৪ থেকে ১৫ বছরে কোর্টে দাখিল করতে পারেনি।’
মমতাজ আরও বলেন, ‘এই বছরও আমি দুইবার কোর্টে হাজির হই। কিন্তু দুঃখের বিষয় মামলার বাদী দুইবার অসুস্থ বলে কোর্টে অনুপস্থিত থাকেন। তার মূল উদ্দেশ্য হলো আমাকে হয়রানি করা। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে দ্রুত মামলাটি যাতে শেষ হয় বিজ্ঞ আদালতকে অনুরোধ করি। কিন্তু আদালত শেষ যে তারিখ দিয়েছিল, ওই সময় আমার আগে থেকেই কানাডায় একটা প্রোগ্রাম নেওয়া ছিল বিধায় আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। তবে আমি আদালতকে এ বিষয়ে অবহিত করি। পরে একটা সময় চাইলে বিজ্ঞ আদালত সেটা গ্রহণ করে আমাকে সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখ পুনরায় ডেট দেন। আশা করি আমি ৮ তারিখে হাজির হলে বিজ্ঞ আদালত একটা সিদ্ধান্ত নেবেন এবং পরবর্তী কী করণীয় তা জানতে পারব। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আমার বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আপনারা সবাই আমার ওপর আল্লাহর ওয়াস্তে এই আস্থা ও বিশ্বাস রাখবেন এবং আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেন কারও ক্ষতি না করি। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।’
চুক্তিভঙ্গ এবং প্রতারণার অভিযোগে করা মামলায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট অলক দাস ৯ আগস্ট লোকগানের জনপ্রিয় শিল্পী ও সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে এর আগে আরও তিনবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। এরপর মমতাজ উচ্চ আদালতের শরণাপন্নও হয়েছিলেন। ৯ আগস্ট মুর্শিদাবাদের মুখ্য বিচার বিভাগীয় আদালতে হাজির হওয়ার কথা ছিল মমতাজের। এর আগে এক নোটিসে জানানো হয়, সেদিন মুর্শিদাবাদের বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মমতাজ বেগমের মামলার অভিযোগ গঠন করা হবে। আর সেদিন মমতাজ উপস্থিত না হলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হবে।
কেরানীগঞ্জের গদাবাগ এলাকায় রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণে একই পরিবারের ৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আশপাশে আরও এমন গুদাম থাকতে পারে, আবারও ঘটতে পারে ভয়াবহ এমন দুর্ঘটনা সেই আশঙ্কায় তটস্থ স্থানীয়রা। তারা বলছেন, নিরাপত্তার খাতিরে পুরান ঢাকার কেমিক্যালপল্লী কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করার চাপ থাকায় এখানে কোনো নিয়ম না মেনে যত্রতত্র মজুদ করা হচ্ছে নানা ধরনের রাসায়নিক। তারা অনেকেই জানেন না তাদের আশপাশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ভয়াবহ সব রাসায়নিকের গুদাম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণে ১২৪ জন নিহত হওয়ার পরে পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক গুদাম কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেই পরিকল্পনা তখন আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপরে ২০১৯ সালে চকবাজারে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পরে প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক গুদাম কেরানীগঞ্জের নির্দিষ্ট একটি স্থানে স্থানান্তর করে গড়ে তোলা হবে কেমিক্যালপল্লী। সরকারের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলেও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পরে পুরান ঢাকার অনেক কেমিক্যাল ব্যবসায়ী তাদের গুদামগুলো কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে স্থানান্তর করেন।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পরই পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদামগুলো সরিয়ে কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা মৌজায় ২০ একর জায়গা নির্বাচন করা হয়েছিল কেমিক্যালপল্লী গড়ে তোলার জন্য। ২০১৫ সালে ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকার প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে তখন আর এ প্রকল্পটি সামনে এগোয়নি।
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর কালন্দি ইউনিয়নের ব্রাহ্মণকিত্তা মৌজায় ৫০ একর জায়গা প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয় কেমিক্যালপল্লী করতে। সেখানে গুদামের জন্য প্রায় ৯০০টির বেশি প্লট তৈরির পরিকল্পনার কথাও জানান শিল্পমন্ত্রী। তবে সে বছর কেরানীগঞ্জে চুনকুটিয়া এলাকায় একটি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে আবারও মুখ থুবড়ে পরে কেমিক্যালপল্লীর প্রকল্প। অবশ্য সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলেও পুরান ঢাকার অনেক ব্যবসায়ী কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় কোনো নিয়মনীতি না মেনেই গড়ে তোলেন কেমিক্যাল গোডাউন। কেরানীগঞ্জের অনেক ভবন ও জমির মালিক মোটা অঙ্কের অর্থের লোভে গোপনে কেমিক্যাল গোডাউন ভাড়া দিয়েছেন।
কালিন্দী ইউনিয়নের গদাবাগে যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে ওই এলাকার বাসিন্দা মো. মেহেদী বলেন, নিরাপত্তার খাতিরে পুরান ঢাকার কেমিক্যালপল্লী কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়েছে। এতে পুরান ঢাকার ঝুঁকি হয়তো কমেছে কিন্তু আমরা পড়েছি চরম ঝুঁকিতে। আমরা জানিও না কোথায় লুকিয়ে আছে রাসায়নিকের ভা-ার।
তিনি বলেন, গত পরশু দিনের দুর্ঘটনা তার একটা প্রমাণ। আমরা কেউই জানতাম না আমাদের পাশেই এমন একটা গুদাম আছে।
মো. আবুল হাসান নামে এক ব্যক্তি বলেন, এভাবে ঘিঞ্জি এলাকায় বা আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া উচিত। যেসব বাড়ির মালিক টাকার লোভে এলাকাবাসীকে ঝুঁকিতে ফেলছেন তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।
কেরানীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র ফায়ার স্টেশন অফিসার কাজল মিয়া জানান, কেরানীগঞ্জে বিভিন্ন স্থানে অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে কেমিক্যাল গোডাউন। এসব গোডাউন বন্ধে আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে থাকি। উপজেলা প্রশাসন এ বিষয়ে কাজ করলে আমরা তাদের সহযোগিতা করব।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সল বিন করিম বলেন, আমরা কেমিক্যাল গোডাউন কোথায় কোথায় আছে খোঁজ করছি। অভিযান চালাচ্ছি, নিয়মনীতির বাইরে যারা আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাঁচ জনের দাফন গতকাল বুধবার কেরানীগঞ্জের গদাবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত জায়গায় নিহতদের পরিবারের সদস্যরা শোকে কান্নাকাটি করছেন। আশপাশের লোকজন দুর্ঘটনাকবলিত স্থান দেখতে আসছে। ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। তিনদিন আগেও যেখানে ছিল ৮ জনের একটি সাজানো গোছানো পরিবার। ভয়াবহ বিস্ফোরণে এখন সেই বাড়িটি মৃত্যুপুরী।
পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার ভোররাতের বিস্ফোরণে নিহত ৫ জনের লাশ তাদের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে সোহাগ (২৫), সোহাগের স্ত্রী মিনা (২২) ও সোহাগের ছোট মেয়ে শিশু তাইয়েবাকে স্থানীয় গদাবাগ কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আর জেসমিন আক্তার (৩০) ও তার মেয়ে ইশাকে (১৬) লৌহজং থানার শিমুলিয়া গ্রামে দাফন করা হয়েছে।
কেরানীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দীন কবির জানান, নিহতের পরিবার লাশ দাফনে ব্যস্ত থাকায় এখন পর্যন্ত থানায় অভিযোগ জানাতে আসেনি। তারা এলে আমরা ব্যবস্থা নেব। আর যদি না আসে তাহলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দেবে।
বিহ্বলতার এক মাস আগস্ট। বাংলা কবিতার দুই প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এ মাসেই বিদায় নিয়েছেন। বিদায় নিয়েছেন কবি শামসুর রাহমানও। আর বাঙালির জন্য স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমির যিনি স্থপতি, বাংলাদেশের সেই অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের প্রস্থানও এ মাসেই। তার বিদায় এতটাই ট্র্যাজিক, সে কথা স্মরণে আনলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। একদিকে শোক পাথরের মতো বুকের ওপর চেপে বসে; অন্যদিকে ক্ষোভে, ক্রোধে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয়। যাই হোক, মৃত্যু দিবসকে সামনে রেখে ব্যক্তিত্বের স্মরণ স্বাভাবিক এক আনুষ্ঠানিকতা। এই সুবাদে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রয়াত ব্যক্তির নব জন্মলাভ ঘটে; অন্যদিকে তাকে পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনার একটি সুযোগও মেলে। কালের ক্যানভাসে রেখে ব্যক্তির সৃষ্টি বা অর্জনকে নতুন করে বুঝে নেওয়ার এই সংগত সংস্কৃতিতে এক ধরনের মেলবন্ধনের সুযোগও তৈরি হয়।
জীবদ্দশায় কিংবদন্তিতুল্য কবি হতে পারেন কবিতার এমন বরপুত্র বাংলায় খুব বেশি নেই; আর প্রয়াণের পর অমরত্বের গৌরব ছুঁয়ে চিরকালীন কবি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মতো কবিও অঙ্গুলিমেয়। বলা নিষ্প্রয়োজন, ‘আমাদের কালেই আমরা এমন একজন উজ্জ্বল কবিকে পেয়েছি, তিনি শামসুর রাহমান। বাংলা কবিতার জগতে দুটি বহু উচ্চারিত নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শামসুর রাহমান। বাঙালির এ দুই চিরকালীন কবিই দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন, পরিণত বয়সেই তারা বিদায় নেন। তবু বড় কবির প্রস্থান সব সময়ের জন্যই আমাদের কাছে অকালমৃত্যু বলে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে যারা সার্বক্ষণিক কবি, যাদের হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে একটি দেশের একটি ভাষার হৃৎস্পন্দন মেশে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে অনূদিত হতে থাকে বহুমাত্রিক কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের পর সংখ্যার বিচারে শামসুর রাহমানের চেয়ে আর কে বেশি লিখেছেন? রীতিমতো কবিতা-সাগর!
কবিকে বিচার করতে গেলে তার সমগ্র কবিতাকর্ম বিবেচনায় নেওয়াই সমীচীন। যদিও আজকের প্রজন্মের পাঠক তো বটেই, সমসাময়িক অধিকাংশ পাঠকের কাছেও শামসুর রাহমানের কবি জন্মকালীন সময়ে পরিচয় ম্লান হয়ে গেছে। এখন ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ বা ‘রৌদ্র করোটিতে’-র কবিতাগুচ্ছ নয়; শামসুর রাহমানের কবিতার উল্লেখ করতে গেলে প্রথমেই উচ্চারিত হয় ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, কিংবা ‘সুধাংশু যাবে না’-র প্রসঙ্গ। রাজনৈতিক-সামাজিক-স্বাদেশিক শামসুর রাহমানের উচ্চকিত পরিচয়ের নিচে চাপা পড়ে গেছেন শিল্পসন্ধানী, নান্দনিক, শুদ্ধতাবাদী শামসুর রাহমান। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতা দুটি মহামূল্যবান; তেমনি শাশ্বত বাঙালি পাঠকের কাছে ‘রূপালি স্নান’ কিংবা ‘আমার মা’কে রত্নসম কবিতা।
এ ভাষ্য আগেও দিয়েছি কবিতায় শামসুর রাহমানের সামগ্রিক অর্জনের কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে যে তিনি এই অঞ্চলে প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রাচীনত্বগন্ধী রিক্ত কাব্যভাষাকে হটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সুমার্জিত, আধুনিক, মুখের ভাষার কাছাকাছি নাগরিক কবিতার ভাষা। এ তাৎপর্যপূর্ণ কাজে তার আগেও দু-তিনজন কবি বাংলাদেশে সক্রিয় হয়েছিলেন, তবে সফল পদরেখা চিহ্নিত করেন তিনিই প্রথম। অনুগামী পেয়েছেন অনেক, অনুসারী প্রচুর। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ স্পষ্টতই বদলে দেয় বাংলা কবিতাবিশ্বকে। ভাষা, চেতনা, বোধ, আবেগ, বৈশিষ্ট্য সর্ববিচারে বাংলা কবিতার ঘটে পালাবদল। তবে পরে আমরা নতুন এক শামসুর রাহমানকে আবিষ্কার করি। এ শামসুর রাহমানের বর্ণনামূলক বাকভঙ্গি এমনই অবিকল্প হয়ে উঠেছিল যে, তা স্বচ্ছন্দভাবে কবিতায় ধারণে সক্ষম ছিল বাংলার আধুনিক মানুষের যেকোনো বিষয় বা বক্তব্য। কবিতা যেন হয়ে উঠেছিল দিনানুদৈনিক ঘটনা, অনুভূতি কিংবা অনুষঙ্গের সহযাত্রী।
শামসুর রাহমানের সমতুল্য ভাবমূর্তি, কবি-ব্যক্তিত্ব কিংবা সামাজিক প্রগতিশীল আইকন যেটাই বলি, আর কোনো কবির পক্ষে অর্জন এখন অসম্ভব ব্যাপার বলেই মনে হয়। কবি-অভিধাটির ওপর অপরাজনীতি ও কালের অবক্ষয় নেতিবাচক আস্তর ফেলে চললেও আমরা জেনে গেছি, কবিরও এক ধরনের সামাজিক অনিবার্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা থাকে। গজদন্তমিনারবাসী আখ্যা দিয়ে অর্বাচীনরা কবিদের যতই দূরবর্তী করে তোলার কসরত করুক না কেন, একজন সার্থক কবি পান অতিসাধারণ মানুষেরও ভালোবাসা ও সমীহ। কবিতার মর্মার্থ না-বোঝা গড়পড়তা সাধারণ লোকের হৃদয়েও কবির জন্য থাকে ‘পরম’ আসন। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি, জীবনযাপনে হিপোক্র্যাসি এবং সংকীর্ণ গোষ্ঠীমনস্কতা কবিকে না দেয় কবিখ্যাতি, না পান তিনি মানুষের সত্যিকারের শ্রদ্ধা। ধ্যানী অচঞ্চল স্রষ্টা ও দ্রষ্টার মতো কবি একাগ্র থাকেন তার নিজস্ব ভুবনে; কাব্যসৃজনই তার আরাধ্য।
‘গাছ, কফিন এবং নৌকা’, যেটি তিনি লিখেছিলেন তার চলে যাওয়ার এক দশক আগে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। কপট বঙ্গবন্ধুপ্রেমী নিন্দুকেরা বলে থাকেন শামসুর রাহমান অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে নিয়ে কবিতা লিখলেও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে তিনি নীরব। তাদের এই কবিতা এবং অন্তত ‘ইলেকট্রার গান’ (ইকারুসের আকাশ কাব্যের) পড়তে বলি। এ দুটি কবিতাই ঠিক সাধারণ মানুষের বোধগম্য কবিতা নয়, যেমনটা কবির স্বাধীনতাবিষয়ক অতিবিখ্যাত দুটি কবিতা। তাই বোধকরি বঙ্গবন্ধুকে আপন সত্তায় গভীর অনুভব করে লেখা এই চমৎকার দুটি কবিতা ১৫ আগস্টে ব্যাপকভাবে পঠিত হয় না। বিশেষ করে ঘাতকের বুলেটে ঝাঁজরা জাতির পিতার মরদেহ অবহেলায় অতিসাধারণ কফিনে রাখার ইতিহাসখচিত সত্যের এমন প্রতীকী ও ব্যঞ্জনাঋদ্ধ ‘গাছ, কফিন এবং নৌকা’ কবিতাকে আমাদের মাথায় তুলে রাখার কথা ছিল। একটি কফিন কীভাবে দেশব্যাপী সন্তরণশীল একটি নৌকা হয়ে ওঠে এবং তার আড়ালে জাগরূক থাকে একটি সুদীর্ঘ গাছ তারই শিল্পিত এবং অবশ্যই শামসুর রাহমানীয় বয়ান আমরা শুনি এই কবিতায়। আমাদের দুর্ভাগ্য আর আগের মতো আমাদের দেশে কবি ও কবিতার কদর নেই, নেই তেমন সংবেদনশীল বোদ্ধাপাঠক এবং সত্যিকারের কবিতার ব্যাখ্যাদাতা, বিশ্লেষক বা সমালোচক।
সেকালে কবি ও কবিতার সম্মান ছিল এই নষ্টভ্রষ্ট সমাজে; দুর্নীতিতে মহাসৃজনশীল এ রাষ্ট্রে। খবরের কাগজের যেকোনো বিশেষ দিবসের ক্রোড়পত্রে পাতাজুড়ে সাজানো থাকত কবিতা, যার শীর্ষে জ্বলজ্বল করত শামসুর রাহমানেরই কবিতা। তখন কালেভদ্রে কোনো কোনো কাগজের ওই পাতার একেবারে নিচের দিকে থাকত এই নগণ্য লেখকের লেখা। শামসুর রাহমানের বিরল একটি গুণ ছিল তিনি প্রত্যেকের কবিতা পড়তেন। আমার নিজের চোখেই তো দেখা আশির দশকের একেবারে শেষ দিকে দৈনিক বাংলা ভবন পরিত্যাগের পর সাপ্তাহিক মূলধারার প্রধান সম্পাদকের চাকরি করার সময় বিশেষ সংখ্যার জন্য কবিতা বাছাইয়ের অধিবেশনে বসতাম দুজনে। তিনি নবীনতম কবির কবিতাটিও মনোযোগ সহকারে পড়তেন। কবিতা পড়ার বেলায় তিনি রুচির ধার ধারতেন না বটে কিন্তু গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তার নিজের বিশেষ একটি হিসাব ছিল, যার তল আমি পাইনি। তখন ফরহাদ মজহার এক দিন নিজে সবগুলো কবিতার বই তাকে উপহার দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। অনেকেই আসতেন, তবু এই একটি নাম উচ্চারণ করলাম এটি বোঝাতে যে শামসুর রাহমান ছেপেছেন ফরহাদ মজহারের কবিতা, কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দেননি কখনই।
কবি শামসুর রাহমানের রচনার সংখ্যা এত বিপুল যেকোনো একটি দিক নিয়ে কথা বলতে গেলেও যথেষ্ট সময় ও পরিসরের প্রয়োজন। গবেষণাপত্রে লেখাপড়া আর কম্পিউটারের পর্দায় রচনাপাঠের ভেতর বৈশিষ্ট্য ও চারিত্র্য বিচারেই রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। এখানে বিন্দুর ভেতর সিন্ধু তুলে ধরার এক অসম্ভব কসরত করা লাগে।
শুধু কবিতার কথা আমরা বলি না। ব্যক্তির প্রয়াণের পর আমরা ব্যক্তিত্বকে পূর্ণতায় বুঝে নিতে চাই। কবি-ভাবমূর্তির সঙ্গে সে-অবয়ব সংযুক্ত হয়ে ব্যক্তিকে বিরাট ব্যাপ্তি দেয়। দেশের প্রধান কবির সম্মান আমরা দিয়েছি শামসুর রাহমানকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, আরও স্পষ্ট করে বললে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে সেনাশাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, সেই বাংলাদেশে জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর আমরা শুনেছি শামসুর রাহমানের কবিতায়। দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনকে অনুসরণ করেছে তার পঙ্ক্তিমালা, জুগিয়েছে শক্তি ও প্রেরণা। মৌলবাদ ও স্বৈরাচারের সমান্তরাল উত্থানে বিপন্ন বিপর্যস্ত বাংলাদেশে আন্দোলনে-সংগ্রামে শামসুর রাহমান গর্জে ওঠা শব্দে ও শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে এমন একটি পর্যায়ে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হন, যেখানে পৌঁছাতে পারেন শতাব্দীতে একজন কি দুজন। তার উজ্জ্বল অংশগ্রহণ নান্দনিক কবিতায় ও তীক্ষè প্রতিবাদে নিবিষ্ট পাঠক ছাড়াও গণমানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি হয়ে ওঠেন আইকন। সমৃদ্ধ শানিত শৈল্পিক আইকন। বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জগতের এক অসামান্য প্রতিভূ।
খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে হাসপাতালের সামনের ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের জের ধরে গতকাল বুধবারও পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তিন দফা দাবিতে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেননি।
অন্যদিকে, হামলাকারীদের গ্রেপ্তার, নিরাপত্তা ও দোকান ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ধর্মঘট পালন করছেন হাসপাতালের সামনের মার্কেটের ওষুধ ব্যবসায়ীরা।
দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা।
গতকাল বেলা পৌনে ১১টায় ক্লাস বর্জন করে তিন দফা দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা কলেজের প্রশাসনিক ভবনের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে রয়েছে, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি মডেল ফার্মেসি ও পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।
ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি সাইফুল ইসলাম অন্তর বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে তারা কলেজ কর্তৃপক্ষকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেটা করতে পারেননি। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কর্মবিরতি চলবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক মো. জিল্লুর রহমান জুয়েল বলেন, সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ওষুধের দোকান ভাঙচুর ও ব্যবসায়ীদের মারধর করেছেন। তাদের গ্রেপ্তার ও দোকান ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ না পাওয়া পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
হাসপাতালের রোগী ও তাদের স্বজনরা অভিযোগ করেন, দুই পক্ষের বিরোধের বলি হচ্ছেন তারা। গত সোমবার রাত থেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা রোগী দেখছেন না। আগে দিনে দু-তিনবার রোগী দেখতেন তারা। এ ছাড়া মেডিকেলের সামনের দোকান বন্ধ থাকায় রোগীর স্বজনদের ওষুধ কিনতে যেতে হচ্ছে অনেক দূরে। এতে অতিরিক্ত সময়ের পাশাপাশি অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার জামসেদ আকতার (৬৭) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের সামনের ওষুধের মার্কেট বন্ধ থাকার কারণে আমার স্ত্রী রিয়া বেগমকে শহরের মধ্যে ওষুধ কিনতে যেতে হচ্ছে। শহর ঠিকমতো না চেনার কারণে ওষুধ কিনতে গিয়ে তাকে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। দূরে যাতায়াতের কারণে টাকাও বেশি খরচ হচ্ছে।’
ফুলতলা উপজেলার গাড়াখোলা গ্রামের শহীদুল ইসলাম বলেন, তার মা ফারহানা বেগম ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তার মার জন্য জরুরিভাবে ওষুধের প্রয়োজন হয়। কিন্তু হাসপাতালের সামনের ওষুধের মার্কেট বন্ধ থাকায় তাকে ওষুধ কিনতে যেতে হয় শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের পাশের ওষুধের মার্কেটে। সেখানে গিয়ে দেখতে পান দোকানগুলোতে দীর্ঘ লাইন পড়েছে। ওষুধ কিনতে কিনতে রাত ১২টা বেজে যায়। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, একটি তুচ্ছ ঘটনার জেরে রোগী ও তাদের স্বজনদের কেন ভোগান্তিতে পড়তে হবে?
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ডা. নিয়াজ মুস্তাফী বলেন, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকলে রোগীদের দুর্ভোগে পড়তে হবে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দীন উল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা দুঃখজনক। কলেজের পক্ষ থেকে সোনাডাঙা থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি, শিগগির এ ঘটনার সমাধান হয়ে যাবে।’
নগরীর সোনাডাঙ্গা ওসি মমতাজুল হক বলেন, হামলার সঙ্গে জড়িতদের আটকের চেষ্টা চলছে।
গত সোমবার রাতে ওষুধ কেনাকে কেন্দ্র করে হাসপাতালের সামনে শিক্ষার্থী ও ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
জামায়াত নেতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এলাকায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তার ছেলে মাসুদ সাঈদীসহ অজ্ঞাতনামা পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে মামলা করেছে পুলিশ। এ ছাড়া সাঈদীর গায়েবানা জানাজা কেন্দ্র করে রাজধানীর পল্টন ও চট্টগ্রামের তিন থানায় চারটি মামলায় অভিযুক্ত পাঁচ শতাধিক। এদিকে সাঈদীকে চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসককে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ধানম-ি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।
বিএসএমএমইউ এলাকা এবং শাহবাগ মোড়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় করা মামলার এজাহারে মাসুদ সাঈদী ছাড়াও আরও তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন জামায়াতের সহকারী মহাসচিব হামিদুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ওরফে মাসুদ ও ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার কে এন রায় নিয়তি দেশ রূপান্তরকে জানান, গত মঙ্গলবার রাতে শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. জব্বার বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে। তবে এ মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
শাহবাগ থানায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গত সোমবার রাতে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সেই খবরে জামায়াত-শিবিরের হাজারো নেতাকর্মী রাতেই বিএসএমএমইউ ও শাহবাগ এলাকায় ভিড় করেন। তারা বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক সেøাগান দেন। একপর্যায়ে মিছিল করে তারা শাহবাগ থেকে বাংলামোটর ও শাহবাগ মৎস্য ভবনের মোড় পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় শাহবাগের বারডেম ও বিএসএমএমইউতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী আটকা পড়েন।
পুলিশ তাদের রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে পুলিশের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন তারা। সড়ক না ছেড়ে তারা সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী সোগান দিতে থাকেন। গতকাল ভোরের দিকে সাঈদীর মরদেহ পিরোজপুরে তার নিজ বাড়িতে নেওয়ার সময় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা ইটের টুকরো, লাঠিসোটা ও রড নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালান এবং সরকারি কাজে বাধা দেন। তারা বিএসএমএমইউর ভেতরে সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করে ক্ষতি করেন। পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেলও ছোড়েন এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। এ সময় পুলিশের গাড়ি, মোটরসাইকেল, সাঁজোয়া যানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। একপর্যায়ে পুলিশ সাঈদীর মরদেহ বহনকারী ফ্রিজিং ভ্যান বের করে আনে। এ সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
সাঈদীর গায়েবানা জানাজাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষের ঘটনায় ১১৬ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করে পুলিশ। পল্টন থানার ওসি সালাহউদ্দিন জানান, বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় একটি মামলা করা হয়েছে। ঘটনার সময় আটক ১৬ নেতাকর্মীকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এই ১৬ জনসহ মামলায় অজ্ঞাত আরও ১০০ জামায়াত নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, সাঈদীর মৃত্যুর ঘটনায় মঙ্গলবার বাদ জোহর জামায়াতের নেতাকর্মীরা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ভেতরে বিক্ষোভ মিছিল করেন। একপর্যায়ে তারা বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটকে বেরিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে তারা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কাছে শোক দিবসে অংশ নিতে আসা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালান।
এদিকে চট্টগ্রামে গায়েবানা জানাজাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষের ঘটনায় নগরের কোতোয়ালি থানায় দুটি ও খুলশী থানায় একটি মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে করা এসব মামলার মধ্যে কোতোয়ালি থানার দুই মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির মো. শাহাজাহানসহ ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। খুলশী থানার মামলায় আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০০ থেকে ১২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তিন মামলায় মঙ্গলবার ঘটনাস্থল থেকে আটক হওয়া ৪০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোতোয়ালি থানার ওসি জাহিদুল কবির এবং খুলশী থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা।
চিকিৎসককে হত্যার হুমকি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চিকিৎসা দেওয়া বিএসএমএমইউ চিকিৎসক অধ্যাপক এস এম মোস্তফা জামানকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত মঙ্গলবার রাতে ধানমন্ডি থানায় জিডি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার কে এন রায় নিয়তি।
জিডিতে বলা হয়েছে, সাঈদী অসুস্থ অবস্থায় বিএসএমএমইউয়ের হৃদরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক চৌধুরী মেশকাত আহমেদের অধীন চিকিৎসাধীন ছিলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের একজন সদস্য হিসেবে অধ্যাপক মোস্তফা জামান তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউবের বিভিন্ন আইডি থেকে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন এবং হত্যার হুমকি দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, তিনি (মোস্তফা জামান) কাল রাতে আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি সমস্ত ঘটনা বলেছেন। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, যিনি চিকিৎসক, যিনি সেবাদান করেন, তাকে চিকিৎসা দিয়েছেন, তাকেও তারা হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এটা আমার কাছে আশ্চর্য লাগে!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, তারা যে নোংরা চিন্তা করে, তারা যে সব সময় সন্ত্রাসী চিন্তা করে, তারা যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সব সময় চিন্তা করে তারই প্রতিফলন; হুমকির মাধ্যমে তারা জানান দিয়েছে।
গতকাল রাতে র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন, ঝিনাইদহের মহেশপুর থেকে তফসিরুল ইসলাম নামের এক হুমকিদাতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার উত্তরা থেকে হাফিজা মাহবুবা বৃষ্টি নামের একজনকে আটক করার কথা জানিয়েছে সিটিটিসি।
সাঈদীকে বিধিসম্মতভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে : বিএসএমএমইউ দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আন্তর্জাতিক প্র্যাকটিস অনুসরণ করে সব ধরনের চিকিৎসা বিধিসম্মতভাবে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্র্তৃপক্ষ। কর্র্তৃপক্ষ আরও বলেছে, সাঈদীর রোগের গতিপ্রকৃতি, চিকিৎসা ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে তার ছেলে মাসুদ সাঈদী অবগত ছিলেন। গতকাল বিকেলে বিএসএমএমইউ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানায়। বিএসএমএমইউ কর্র্তৃপক্ষ গতকাল বিকেল ৩টায় সাঈদীর চিকিৎসা বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকে। কিন্তু তার আগেই অনিবার্য কারণে সেই সংবাদ সম্মেলন বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ সাঈদীর চিকিৎসা বিষয়ে এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়।
কক্সবাজারে ৫ মামলায় আসামি ৭ হাজার : দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজা ঘিরে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়ায় পুলিশের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচটি মামলা হয়েছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় চকরিয়া ও পেকুয়া থানায় করা এসব মামলায় ৪৫২ জনের নাম উল্লেখসহ সাড়ে ৭ হাজার জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে চকরিয়া থানায় হত্যা মামলা, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে তিনটি এবং পেকুয়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়। চকরিয়া থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ এবং পেকুয়া থানার ওসি ওমর হায়দার মামলাগুলো নথিভুক্তের তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছে চট্টগ্রাম ব্যুরো ও কক্সবাজার প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় স্ত্রীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে এক বিচারককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেফরি ফার্গুসন নামক ৭২ বছর বয়সী ওই বিচারক অঙ্গরাজ্যটির অরেঞ্জ কাউন্টির সুপিরিয়র কোর্টে বসতেন। হত্যাকাণ্ডের পর নিজেই পুলিশে খবর দেন। পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধারের পাশাপাশি তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৪৭টি বন্দুক ও ২৬ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদও উদ্ধার করেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, ঘটনাটি গত ৩ আগস্টের। গত মঙ্গলবার লস অ্যাঞ্জেলেসের আদালতে ওই ঘটনায় শুনানির পর সেটি প্রকাশ্যে আসে।
আদালতের শুনানিতে বলা হয়, অ্যানাহেম শহরের একটি বাড়িতে থাকতেন ফার্গুসন এবং তার স্ত্রী শেরিল। গত ৩ আগস্ট এ দম্পতি বাড়ির কাছের একটি রেস্তোরাঁয় নৈশভোজে গিয়েছিলেন। সে সময় তাদের মধ্যে বাদানুবাদ শুরু হয়। অরেঞ্জ কাউন্টির ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ক্রিস্টোফার অ্যালেক্স আদালতে বলেন, বাদানুবাদের একপর্যায়ে ফার্গুসন তার স্ত্রীর দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করার মতো করে আঙুল তোলেন। তারা বাড়িতে ফেরার পরও ঝগড়া চলতে থাকে। ৬৫ বছর বয়সী শেরিল একপর্যায়ে তার স্বামীকে বলে ওঠেন ‘আমার দিকে সত্যিকারের বন্দুক তাক করছ না কেন?’ তখন ফার্গুসন তার গোড়ালিতে পিস্তল রাখার খাপ থেকে পিস্তল বের করে খুব কাছ থেকে স্ত্রীর বুকে গুলি করেন।
অ্যালেক্স আরও বলেন, এ ঘটনার পর ফার্গুসন নিজেই জরুরি সহায়তা নম্বর ৯১১-এ ফোন করে বলেন, তার স্ত্রী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বাড়িতে একজন চিকিৎসাকর্মী পাঠানোর অনুরোধ জানান তিনি। তখন ফোনের ওপাশ থেকে একজন জানতে চান ফার্গুসন নিজেই গুলি করেছেন কি না। তখন এ বিচারক বলেন, ওই সময় তিনি এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন না। ফোন রাখার পর বিচারক ফার্গুসন আদালতে তার ক্লার্কের মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা পাঠান। সেখানে তিনি লিখেন, আমি মেজাজ ধরে রাখতে পারিনি। মাত্রই আমার স্ত্রীকে গুলি করেছি। কাল আসতে পারব না। আমাকে নিরাপত্তা হেফাজতে চলে যেতে হবে। আমি দুঃখিত।
এএফপি বলছে, পরে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ও ওই বিচারককে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের সময় ফার্গুসনের মুখ দিয়ে মদের তীব্র গন্ধ বের হচ্ছিল। সে সময় তিনি পুলিশকে বলেন, ‘আমার ধারণা, কিছু সময়ের জন্য আমার কোনো হুঁশজ্ঞান ছিল না।’
মঙ্গলবার শুনানির সময় তিনি হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার আইনজীবী বলেছেন, আমরা এটা পরিষ্কার করতে চাই যে ঘটনাটি অনিচ্ছাকৃত এবং অনাকাক্সিক্ষত। এটা কোনো অপরাধের ঘটনা নয়।
আদালত ফার্গুসনকে জামিন দিয়েছে। তবে তাকে মদ পান না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৩০ অক্টোবর তার আবারও আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানে একটি অঙ্গ পাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশ বলছে। চক্রটির নেতা ফাওয়াদ মুখতারের বিরুদ্ধে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের কিডনি চুরি করে বের করে ধনী গ্রাহকদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা বিবিসি নিউজ।
বিবিসি জানায়, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহ থেকে কিডনি সরিয়ে ফেলা এবং ধনী গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অভিযোগে ফাওয়াদ মুখতার নামের এক চিকিৎসক ও তার দলের আট সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তান পুলিশ। ফাওয়াদ এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগীর কিডনি চুরি করেছেন।
এমনকি অস্ত্রোপচারকালে কিডনি চুরির সময় তার হাতে অন্তত তিনজন রোগী মারা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ফাওয়াদ এর আগে পাঁচবার অসদাচরণের জন্য গ্রেপ্তার হলেও প্রতিবারই জামিন নিয়ে মুক্তি পেয়ে যান। রোববার (১ অক্টোবর) পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পাকিস্তান পুলিশ। চক্রটি পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের পাশাপাশি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে কাজ করছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহসিন নকভি রবিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, “কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টগুলি বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনকে ক্লিনিক আকারে সাজিয়ে সেখানে রোগীদের অস্ত্রোপচার করার সময় রোগীদের অজান্তেই কিডনি সরিয়ে নেয়া হত।“
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাওয়াদ মুখতার জানিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন চক্র এখন পর্যন্ত মোট ৩২৮ রোগীর দেহ থেকে কিডনি চুরি করেছে। প্রতিটি কিডনি বিক্রি হয়েছে ১ কোটি রুপি করে।
২০১০ সালে মানবদেহের প্রত্যঙ্গ ব্যবসা নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান। এ অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।