ভরাট হয়ে গেছে ব্রিটিশ আমলের শতবর্ষী ‘কালীপুকুর’
শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি | ২ ডিসেম্বর, ২০২১ ২১:০৬
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া ও রাউতারা গ্রাম দুটিকে বলা হয় পুকুরের গ্রাম। গ্রাম দুটির একদিকে রয়েছে বড়াল নদী অন্য পাশে রয়েছে গোহালা নদী। এ গ্রাম দুটিতে রয়েছে অনেক জেলে পরিবার। তাদের কাছে থেকে জানা যায় মাছ চাষের পাশাপশি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বার মাস পুকুরের জল দিয়ে পূজা অর্চনা জন্য পুকুর খনন করে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, শাহজাদপুর উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পোতাজিয়া ও রাউতারা এলাকাটি ছিল হিন্দু বসতিপূর্ণ এলাকা। বহুকাল পূর্বে রাউতারার ঘোষ পরিবারের পক্ষ থেকে জনহিতকর কাজের অংশ হিসাবে রাউতারার পূর্বপাড়ার ১ একর ৩৫ শতাংশ জায়গায় পুকুর খনন করা হয়। একই সময়ে পোতাজিয়া গ্রামেও পুকুর খননের হিড়িক পড়ে যায়। শুধু পোতাজিয়াতেই ৫১টি পুকুর খনন করা হয়।
রাউতারায় ১ একর ৩৫ শতাংশ জায়গার পুকুরটি খনন করেন জোগেষ চন্দ্র ঘোষ। তিনি এলাকায় জোগেষ বাবু নামে পরিচিত। ১৯৪৬ সালে তিনি মারা যান।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, জোগেষ ঘোষের বড় ভাই গৌর ঘোষ। গৌর ঘোষের ছেলে সন্তোষ ঘোষ। তার ছেলে শোভন ঘোষ ও তার সহোদরেরা করোনার সুযোগ নিয়ে প্রাচীন এই পুকুরটি ভরাট করলে এ নিয়ে এলাকায় হইচই তৈরি হয়। পুকুরটি ভরাটের প্রতিবাদ জানিয়ে পুকুর খননকারী জোগেষ ঘোষের উত্তরসূরিরা পুকুরটি পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন স্থানে লিখিত আবেদন করলেও পুকুর ভরাট কারিদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছেন না।
অভিযোগ রয়েছে ঘোষ পরিবারের শোভন ও তার সহোদরেরা পুকুরের জায়গা বিক্রি করায় পুকুরের একটি বিশাল অংশ বেহাত হতে চলেছে।
পুকুর ভরাট নিয়ে কথা হয় রাউতারার মৎস্যজীবী পরেশ হালদারের ছেলে উত্তম হালদার ও আবুল হোসেনের ছেলে আবু তালেবের সঙ্গে।
তারা জানান, ভারত পাকিস্তান ভাগের আগে ঘোষ পরিবারের জোগেষ চন্দ্র ঘোষ রাউতারাতে তিনটি পুকুর খনন করেন। এর মধ্যে ১ একর ৩৫ শতাংশ জায়গার পুকুরটিকে আমরা জানি কালীর পুকুর হিসাবে। কালী প্রয়াত জোগেষ চন্দ্র ঘোষের মেয়ে। ঘোষ পরিবারের অন্য শরিক জোগেষ ঘোষের বড় ভাই গৌর ঘোষের নাতি সুবীর কুমার ঘোষ (কালা বাবু) ও শোভন ঘোষ এই দুই সহোদর মিলে করোনার সময় ড্রেজার দিয়ে পুকুরটি ভরাট করে। ভরাটকৃত জায়গা এখন বিক্রি করা হচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে বৃহত্তর পাবনা জেলার শাহজাদপুর থানার পোতাজিয়া ও রাউতারা গ্রামের জোতদার পরিবারের (বাবুরা নামে পরিচিত) পক্ষ থেকে এ পুকুরগুলো খনন করা হয়। অধিকাংশ পুকুর খনন করেন ঘোষ পরিবারের লোকজন। তখন থেকেই গ্রাম দুইটি পুকুরের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
এসব পুকুর বা জলাধারগুলো দেখতে এক সময়ের ভ্রমণ পিপাসুরা বর্ষা এলেই বজরা নৌকায় চরে এখানে বেড়াতে আসতেন। বজরা নৌকাগুলো ছিল পোতাজিয়া ও রাউতারা গ্রামেরই। সেগুলো এখন সবই অতীত। এখনো পোতাজিয়া গ্রামের পুকুরগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও রাউতারার তিনটি পুকুরের বিশাল একটি পুকুর টাকার লোভে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ভরাটের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার হয়নি ।
রাউতারা প্রাচীন এই পুকুরটি ভরাট নিয়ে কথা হয় রাউতারার ঘোষ পরিবারের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. প্রণব কুমার ঘোষের সঙ্গে। তিনি এলাকায় পনু বাবু নামেই পরিচিত।
তিনি জানান, ভরাটকৃত পুকুরটির পুরো জায়গা আমাদের। করোনার মধ্যে সবাই যখন বিপদগ্রস্ত তখন আমারই জ্ঞ্যাতিগোষ্ঠীর লোকেরা প্রাচীন এই শতবর্ষী পুকুরটি ভরাট করে। পুকুর ভরাটের কথা যখন জানতে পারি তখন আমি ঢাকায়। করোনা মহামারির কারণে আমি ঢাকা থেকে সে সময় আসতে পারিনি। এই সুযোগটিই নিয়েছে আমার পরিবারের লোকজন। এখন তারাই ভরাটকৃত পুকুরের জায়গা বিক্রিও করছে। আর এগুলো হচ্ছে জাল কাগজের মাধ্যমে।
জানা গেছে, পুকুর ভরাটের বিষয়টি অবহিত করে ডা. প্রণব কুমার সাহা- বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পুকুরটি পুনরুদ্ধারের জন্য আবেদন করেছেন। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হলে সহকারী কমিশনার ভূমি ও ইউএনও’র পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ মো. শামসুজ্জোহা জানান, যারা পুকুর ভরাট করেছেন তারা আইনের বরখেলাপ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে শোভন কুমার ঘোষ জানান, ডা. প্রণব কুমার ঘোষের সঙ্গে জমিজমা বাঁটোয়ারা করেই দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে পুকুরটি ভরাট করা হয়। তবে পুকুরটিতে আমাদের ৫৪ শতাংশ জায়গা রয়েছে। দাদা প্রনব কুমার ঘোষের সঙ্গে আলোচনা করেই পুকুর ভরাটের কাজ শুরু করি। এখন তিনি কেন বিপক্ষে অবস্থান নিলেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি | ২ ডিসেম্বর, ২০২১ ২১:০৬

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া ও রাউতারা গ্রাম দুটিকে বলা হয় পুকুরের গ্রাম। গ্রাম দুটির একদিকে রয়েছে বড়াল নদী অন্য পাশে রয়েছে গোহালা নদী। এ গ্রাম দুটিতে রয়েছে অনেক জেলে পরিবার। তাদের কাছে থেকে জানা যায় মাছ চাষের পাশাপশি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বার মাস পুকুরের জল দিয়ে পূজা অর্চনা জন্য পুকুর খনন করে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, শাহজাদপুর উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পোতাজিয়া ও রাউতারা এলাকাটি ছিল হিন্দু বসতিপূর্ণ এলাকা। বহুকাল পূর্বে রাউতারার ঘোষ পরিবারের পক্ষ থেকে জনহিতকর কাজের অংশ হিসাবে রাউতারার পূর্বপাড়ার ১ একর ৩৫ শতাংশ জায়গায় পুকুর খনন করা হয়। একই সময়ে পোতাজিয়া গ্রামেও পুকুর খননের হিড়িক পড়ে যায়। শুধু পোতাজিয়াতেই ৫১টি পুকুর খনন করা হয়।
রাউতারায় ১ একর ৩৫ শতাংশ জায়গার পুকুরটি খনন করেন জোগেষ চন্দ্র ঘোষ। তিনি এলাকায় জোগেষ বাবু নামে পরিচিত। ১৯৪৬ সালে তিনি মারা যান।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, জোগেষ ঘোষের বড় ভাই গৌর ঘোষ। গৌর ঘোষের ছেলে সন্তোষ ঘোষ। তার ছেলে শোভন ঘোষ ও তার সহোদরেরা করোনার সুযোগ নিয়ে প্রাচীন এই পুকুরটি ভরাট করলে এ নিয়ে এলাকায় হইচই তৈরি হয়। পুকুরটি ভরাটের প্রতিবাদ জানিয়ে পুকুর খননকারী জোগেষ ঘোষের উত্তরসূরিরা পুকুরটি পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন স্থানে লিখিত আবেদন করলেও পুকুর ভরাট কারিদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছেন না।
অভিযোগ রয়েছে ঘোষ পরিবারের শোভন ও তার সহোদরেরা পুকুরের জায়গা বিক্রি করায় পুকুরের একটি বিশাল অংশ বেহাত হতে চলেছে।
পুকুর ভরাট নিয়ে কথা হয় রাউতারার মৎস্যজীবী পরেশ হালদারের ছেলে উত্তম হালদার ও আবুল হোসেনের ছেলে আবু তালেবের সঙ্গে।
তারা জানান, ভারত পাকিস্তান ভাগের আগে ঘোষ পরিবারের জোগেষ চন্দ্র ঘোষ রাউতারাতে তিনটি পুকুর খনন করেন। এর মধ্যে ১ একর ৩৫ শতাংশ জায়গার পুকুরটিকে আমরা জানি কালীর পুকুর হিসাবে। কালী প্রয়াত জোগেষ চন্দ্র ঘোষের মেয়ে। ঘোষ পরিবারের অন্য শরিক জোগেষ ঘোষের বড় ভাই গৌর ঘোষের নাতি সুবীর কুমার ঘোষ (কালা বাবু) ও শোভন ঘোষ এই দুই সহোদর মিলে করোনার সময় ড্রেজার দিয়ে পুকুরটি ভরাট করে। ভরাটকৃত জায়গা এখন বিক্রি করা হচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে বৃহত্তর পাবনা জেলার শাহজাদপুর থানার পোতাজিয়া ও রাউতারা গ্রামের জোতদার পরিবারের (বাবুরা নামে পরিচিত) পক্ষ থেকে এ পুকুরগুলো খনন করা হয়। অধিকাংশ পুকুর খনন করেন ঘোষ পরিবারের লোকজন। তখন থেকেই গ্রাম দুইটি পুকুরের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

এসব পুকুর বা জলাধারগুলো দেখতে এক সময়ের ভ্রমণ পিপাসুরা বর্ষা এলেই বজরা নৌকায় চরে এখানে বেড়াতে আসতেন। বজরা নৌকাগুলো ছিল পোতাজিয়া ও রাউতারা গ্রামেরই। সেগুলো এখন সবই অতীত। এখনো পোতাজিয়া গ্রামের পুকুরগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও রাউতারার তিনটি পুকুরের বিশাল একটি পুকুর টাকার লোভে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ভরাটের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার হয়নি ।
রাউতারা প্রাচীন এই পুকুরটি ভরাট নিয়ে কথা হয় রাউতারার ঘোষ পরিবারের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. প্রণব কুমার ঘোষের সঙ্গে। তিনি এলাকায় পনু বাবু নামেই পরিচিত।
তিনি জানান, ভরাটকৃত পুকুরটির পুরো জায়গা আমাদের। করোনার মধ্যে সবাই যখন বিপদগ্রস্ত তখন আমারই জ্ঞ্যাতিগোষ্ঠীর লোকেরা প্রাচীন এই শতবর্ষী পুকুরটি ভরাট করে। পুকুর ভরাটের কথা যখন জানতে পারি তখন আমি ঢাকায়। করোনা মহামারির কারণে আমি ঢাকা থেকে সে সময় আসতে পারিনি। এই সুযোগটিই নিয়েছে আমার পরিবারের লোকজন। এখন তারাই ভরাটকৃত পুকুরের জায়গা বিক্রিও করছে। আর এগুলো হচ্ছে জাল কাগজের মাধ্যমে।
জানা গেছে, পুকুর ভরাটের বিষয়টি অবহিত করে ডা. প্রণব কুমার সাহা- বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পুকুরটি পুনরুদ্ধারের জন্য আবেদন করেছেন। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হলে সহকারী কমিশনার ভূমি ও ইউএনও’র পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ মো. শামসুজ্জোহা জানান, যারা পুকুর ভরাট করেছেন তারা আইনের বরখেলাপ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে শোভন কুমার ঘোষ জানান, ডা. প্রণব কুমার ঘোষের সঙ্গে জমিজমা বাঁটোয়ারা করেই দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে পুকুরটি ভরাট করা হয়। তবে পুকুরটিতে আমাদের ৫৪ শতাংশ জায়গা রয়েছে। দাদা প্রনব কুমার ঘোষের সঙ্গে আলোচনা করেই পুকুর ভরাটের কাজ শুরু করি। এখন তিনি কেন বিপক্ষে অবস্থান নিলেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।