
মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালিতে। গণভবনের রান্নাঘরের স্টোরকিপারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এই সুবাদেই ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেন মোশাররফ। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঠিক আগের দিন ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় গণভবনে জাতির পিতাকে সর্বশেষ দেখেছিলেন গণভবনের এই কর্মচারী। তবে ওইদিনই যে শেষ দেখা হবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। সেদিনও প্রতিদিনের মতোই বঙ্গবন্ধুকে স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে দেখেছেন গণভবনের ওই কর্মচারী। দেখেছেন পাইপ টানতে, লেকের পাড়ে হাঁটতে।
সেদিন গণভবন ত্যাগ করার আগে গণভবনের কর্মচারীদের এক দারুণ সারপ্রাইজ দিয়ে অবাক করে যান বঙ্গবন্ধু। নিজের কয়েকটি ছবিতে অটোগ্রাফ দিয়ে কন্ট্রোলার সুবেদার মেজর আবুল খায়েরকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, এই ছবিগুলো ওদের দিয়ে দিস। গণভবনের আরও কয়েকজন কর্মচারীর মতো বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ দিনের শেষ অটোগ্রাফযুক্ত একটি ছবির মালিক হন স্টোরকিপার মোশাররফ। তার কাছে এই ছবি এখন অমূল্য সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর হাতের শেষ ছোঁয়া জড়ানো ছবিটি আজও যত্নে রয়েছে মোশাররফের কাছে। প্রায় ২০টি বছর ছবিটি অনেকটা লুকিয়েই রাখতে হয়েছিল মোশাররফকে। তাই ছবিতে কিছুটা ফাঙ্গাস পড়েছে। ছবিটি দেখিয়ে দেখিয়ে প্রবীণ মোশাররফ হোসেন তার ছেলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সোয়েব-উর-রহমানকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের স্মৃতিজড়িত নানা গল্প শোনান।
এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতর্ষে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দেশ রূপান্তরের এই প্রতিবেদকের কাছে বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফযুক্ত ছবিটি পাওয়ার গল্প বলেছেন মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। ছবির গল্পের সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, গণভবনে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে দেখেছেন সেসব অনেক ঘটনাও। সেদিনের তরুণ মোশাররফ আজ প্রবীণ। রোগে ভুগে অনেকটাই কাতর। কথা বলতেও কষ্ট হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিটুকু প্রকাশ করার সময় একটুও যেন কষ্টবোধ হয়নি তার। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসার টান বোঝাতে গিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘ধর্ম-কর্ম করি বলে আমার ঘরে কোনো ছবি টানানো নেই। তবুও দুটি ছবি টানানো আছে। একটি বঙ্গবন্ধুর হাতের অটোগ্রাফযুক্ত সেই ছবি, আরেকটি আমার মায়ের ছবি। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে দেখেছেন তার স্মৃতিচারণ করে গণভবনের স্টোরকিপার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘চাকরি করাকালীন বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা পেয়েছি তা কখনো ভোলা যাবে না।’
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টও ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পাঠানো দুপুরের খাবার গণভবনে বসেই খেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ওইদিনও অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে দুপুরের খাবার পরিবেশনের কাজে মোশাররফও ছিলেন। ওইদিন বিকেলের ছবি পাওয়ার ঘটনাটিই এখন চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তার কাছে। তিনি বলেন, সেদিনটি ভীষণ আনন্দেরও ছিল। দেশের রাষ্ট্রপতি কর্মচারীদের নিজের অটোগ্রাফযুক্ত ছবি দিলেন। আর
ঠিক পরের দিনটাতে, ১৫ আগস্টই এই ছবি হয়ে উঠল চির-বেদনার। মোশাররফ বলতে থাকেন, ‘বঙ্গবন্ধু নেই, তার হাতের শেষ ছোঁয়া, শেষ স্মৃতি রয়ে গেল আমার কাছে। ১৫ আগস্ট যখন খুনিরা গণভবনে ঢুকল, শেষ স্মৃতিটুকু লুকিয়ে রাখলাম। যেন সেটা তাদের নজরে না পড়ে। পরে বাড়ি এসে বাড়ির দলিলপত্রের মধ্যে যত্ন করে ছবিটা লুকিয়ে রাখি।’
দায়িত্ব স্টোরকিপারের থাকলেও গণভবনে আগত অতিথিদের আতিথেয়তা-আপ্যায়নের দেখভালের দায়িত্বও ছিল মোশাররফ হোসেনের। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে বসবাস করলেও অফিস করতেন গণভবনে। সেই সুযোগে প্রায় তিন বছর খুব কাছ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। শুধু দেখাই নয়, চেনা-জানা, বঙ্গবন্ধুর অন্তরাত্মা বোঝা, ভেতরের মহানুভবতা বোঝার সুযোগ হয়েছে। সেই বোধ থেকেই মোশাররফ দাবি করে বলেন, ‘ধনী-গরিব সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তার কাছে ছিলেন এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর কাছে কে রাজা, কে প্রজা তার কোনো ভেদাভেদ দেখিনি।’
স্মৃতিচারণায় স্টোরকিপার মোশাররফ আরও বলেন, দেখা হলেই বঙ্গবন্ধুর প্রথম কথা, ভালো আছিস? খেয়েছিস? ওই খায়ের ওদের ঠিকঠাকভাবে দেখাশোনা করিস? বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে তুই শব্দটিই সবচেয়ে আপন মনে হতো। আমি যতদিন দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে, সবাইকেই তুই বলে সম্বোধন করতে। দুই একজনের ক্ষেত্রে তুমি বলতে শুনেছি। সে হোক বয়স্ক হোক তরুণ। একদিন গণভবনের লেকের পাশে হাঁটতে গিয়ে সুঠাম দেহের হারুন নামে গণভবনের এক কর্মচারীকে দেখেন বঙ্গবন্ধু। কাছে ডেকে তাকে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোর নাম কী? হারুন জবাবে তার নাম বলেন। বঙ্গবন্ধু পাল্টা প্রশ্ন করেন, তোর বাড়ি কোথায়? হারুন বলেন ফরিদপুর। ওখানে কোথায়? মধুপুর। তুই এখানে চাকরি করিস কেন? তোর যে শরীর-চেহারা তোর তো আর্মিতে চাকরি করার কথা। আরেক দিন বিকালে গণভবনের কর্মচারী রেজাউল নামে একজন বঙ্গবন্ধুকে চা দিচ্ছিলেন। এ সময় রেজাউলকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোর চেহারা মলিন কেন? উত্তরে রেজাউল বলেন, স্যার বেতন হয় না তিন মাস। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোলার আবুল খায়েরকে ডেকে পাঠান এবং জানতে চান ওদের বেতন হয় না কেন? খায়ের বলেন, জটিলতা আছে। বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ বলেন, আমি কিচ্ছু বুঝি না একদিনের মধ্যে বেতন হওয়া চাই। মোশাররফ বলেন, একদিন বাদেই বেতন হয়েছে। ঘটনাগুলো বলার কারণ হলোÑ বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা ছিলেন যার দৃষ্টিভঙ্গি ধনী-গরিব, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই তার চোখে সমান ছিল।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের একটি ঘটনা বলতে গিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, ১৯৭৪ সালের ১ মার্চ আমি বিয়ে করি। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের কোনো একদিন, তারিখ ঠিক মনে নেই। দুপুর বেলায় বঙ্গবন্ধু যখন খেতে বসলেন তখন বিয়ের কথা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিই। অবশ্য আমার সহকারী কন্ট্রোলার সুবেদার কাজী হাসানুজ্জামানের কথামতো বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দেওয়া হয়। সহকারী কন্ট্রোলার যখন বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন আমি তখন ওই রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বিয়ের কথা শুনেই বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন। জানতে চাইলেন কোথায় বিয়ে করছিস? বউ কী করে, শ্বশুর কী করে এমন অনেক প্রশ্ন? উত্তর দেওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমদকে ডেকে বললেন, ওকে এক হাজার টাকা দিয়ে দে। আর আমাকে বললেন, ‘তোর বউকে একটা বেনারসি শাড়ি ও একটা ঘড়ি কিনে দিস এ টাকায়।’ এই হলো বঙ্গবন্ধু। মোশাররফ বলেন, বঙ্গবন্ধুর কথামতো বউকে বেনারসি শাড়ি কিনেও দিয়েছি। চাকরি থাকাকালীন অনেক রাষ্ট্রপতি দেখেছি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো আর কাউকে দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসায় রকমফের দেখিনি।
স্মৃতিচারণ করতে করতে মোশাররফ আবারও পঁচাত্তরের ১৪ আগস্টে ফিরে যান। বলেন, বঙ্গবন্ধুর খাবারে সবসময়ই দেশি মাছ থাকত। পাতলা ডাল ছিল তার পছন্দের। বঙ্গবন্ধুর খাওয়া শেষে বেঁচে যাওয়া ওই ডাল কে খাবে তা নিয়ে গণভবনের কর্মচারীদের মধ্যে রীতিমতো লুকোচুরি খেলা হতো। সেই ডাল এতই সুস্বাদু ছিল, সবারই পছন্দ ছিল ওই পাতলা ডাল। আর নাস্তায় সমুচা একটু বেশিই পছন্দ ছিল বঙ্গবন্ধুর। মোশাররফ আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ছোট্ট জয়কেও (সজীব ওয়াজেদ জয়) মাঝে মাঝে গণভবনে নিয়ে আসতেন বঙ্গবন্ধু। গণভবনের ভেতরে পশ্চিম পাশের দক্ষিণ ওয়ালের সঙ্গে ময়ূরের ঘর ছিল। সেখানে জয়কে নিয়ে গিয়ে ময়ুর নাচ দেখাতেন বঙ্গবন্ধু।
১৫ আগস্ট ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখি গণভবনের বাউন্ডারি ঘেঁষে ট্যাঙ্ক দাঁড়ানো। কিছুই বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ বাদে রেডিও ছেড়ে প্রথম এ খবর পাই। বেলা ১০/১১টা নাগাদ খুনি মেজর ডালিম ও মোসলেমউদ্দিন গণভবনে প্রবেশ করে দলবল নিয়ে। বিভিন্ন রুমে তল্লাশি করে আমাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে আমাদের পরিচয় জানতে চায়। গণভবনের কর্মকর্তারা সবাই সবার পরিচয় দিলে খুনির দল আমাদের ছেড়ে দেয়। তবে আমিসহ আরও দুই একজনকে দুইমাস নজরবন্দি করে রাখে। পরে বঙ্গভবনে চলে যাই। ওখানে আর চাকরি করিনি।
লেখক : সাংবাদিক
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে তার প্রতি জানাই অসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি আমাদের জন্য শুধু অম্লান হয়ে আছে তা-ই নয়, তিনি আমাদের হৃদয়ের সত্তায় স্থান করে নিয়েছেন। তিনি সবসময় যেন আমাদের অন্তরেই আছেন। আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়, আমাদের জাতির আত্মসম্মান বোধ ফিরিয়ে দিতে এবং এই জাতিকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।
তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ বক্তা, অত্যন্ত মেধাবী রাজনীতিবিদ ((poet of politics) এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক, যাকে একনামে বিশ^বাসী চিনত। বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল শেখ মুজিবুরের দেশ হিসেবে। ইউনেস্কো (UNESCO) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে দেওয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শুধু আমাদের কাছে কেন, সারা বিশ্বে আজও বাঙালি জাতির পরিচয়। বঙ্গবন্ধুর পরিচয়ে বাংলাদেশের পরিচয়। যেখানে মানুষ এখনো জিজ্ঞাসা করে তোমরা কীভাবে তোমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করলে? এ কথা তো বিশ্বের যেকোনো জায়গায় জানে। আলজেরিয়া যান, কিউবা যান, রাশিয়া যান, পূর্ব ইউরোপের যেকোনো জায়গায় যান। আজকে বঙ্গবন্ধুর স্থান জর্জ ওয়াশিংটন যেমন জাতির পিতা আমেরিকায়, মহাত্মা গান্ধী যেমন ভারতের, সুকর্ণ যেমন ইন্দোনেশিয়ার, হো চি মিন যেমন ভিয়েতনামের, নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনি বাংলাদেশের। তবে বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশেরই নন, সারা পৃথিবীর একজন অনন্য নেতা, একজন বরেণ্য নেতা, তার প্রতি সম্মান দেখানো, তাকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা মানে আমরা নিজেরাই মহিমান্বিত হই, আমরাই তাতে বড় হই। তাকে যতভাবে আমরা দেখব, যত তার জীবন পর্যালোচনা করব, তার কীর্তি যত আলোচনা করব, তার রেখে যাওয়া স্মৃতি আমরা যত আলোচনা করব, ততই আমরা জানতে পারব। তাকে জানা মানেই বাঙালি জাতিকে জানা, ইতিহাসকে জানা, বাঙালি জাতির ঐতিহ্যকে জানা। কারণ এগুলোই তিনি লালন করেছেন সারা জীবন, এগুলো নিয়েই তিনি কাজ করেছেন এবং এরই ফলে বাঙালি জাতির এই জন্মভূমি, স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি।
১৪ আগস্ট প্রায় রাত ১১টার সময় আমি ৩২ নম্বরে আজকের বঙ্গবন্ধু ভবনে তার সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম। কেননা, পরদিন ১৫ আগস্ট সকাল বেলা তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার কথা ছিল।
সেজন্য ছিল চারদিকে সাজ সাজ রব, কীভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে, তার নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা হবে ইত্যাদি। কিন্তু তখন কেউ চিন্তাই করতে পারেনি যে আমাদের মধ্যে এ ঘরের শত্রু বিভীষণরা তার প্রতি তাদের রাইফেল তাক করে আছে। লক্ষ্য করে আছে তার হৃদয়ের দিকে এবং কেমন করে তাকে এই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে সেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। অবশ্য ১৪ আগস্টের আগেও মাঝেমধ্যে শোনা যেত নানা রকম গুঞ্জন; শোনা যেত যে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা বোধহয় বিঘিœত হচ্ছে, যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ইত্যাদি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই সময়টা এবং তার আগেও দেখেছি বিভিন্ন সময় যখনই নিরাপত্তার কথা উঠত বঙ্গবন্ধু এমনভাবে কথা বলতেন, তার ধারণা ছিল এবং অত্যন্ত সবলভাবেই বলতেন সে কথা আমাদেরকে যে ‘কোনো খাঁটি বাঙালি কখনই আমাকে হত্যা করতে পারে না’।
কথাটি কিন্তু তিনি ঠিকই বলেছিলেন। কোনো বাঙালি তো তাকে হত্যা করেনি। কোনো বাঙালি তার বুকের দিকে তার রাইফেল কিংবা মেশিনগান তাক করেনি। যারা তাকে হত্যা করেছে সেই হত্যাকারীরা, সেই মার্ডারারগুলো, সেই নরকীটগুলো তারা সবই ছিল বিদেশের চর, সব পাকিস্তানি এবং অন্য বিভিন্ন দেশের চর। এরা তো বাঙালি নয়, তাদের ভাষায় তারা বাংলাদেশিও নয়, তারা মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, বাঙালির শত্রু, বাংলাদেশের শত্রু।
১৫ আগস্ট সকালে এই জঘন্য হত্যাকা-ের ঘটনা শোনার পরপরই আমি প্রথমে টেলিফোন করলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধরলেন এবং বললেন ‘তওফিক’ আমিও শুনেছি, এই ঘটনা তো মনে হয় সত্য। এখন কী করা যায়। আমি বললাম আপনি নির্দেশ দিন, আপনি তো উপরাষ্ট্রপতি। তিনি বললেন আমি চিন্তা করে দেখি। তার পরেই আমি তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবকে টেলিফোন করলাম, তারপর মনছুর আলী সাহেবকে, কামারুজ্জামান সাহেবকে। এদের সবার সঙ্গেই কথা বলি। এরা সবাই একেবারে যেমন স্তম্ভিত তেমনি হতভম্ব হয়ে গেছেন এবং প্রত্যেকের কণ্ঠে কান্নার সুর, কান্নার স্বরের মতোই কেউ প্রকাশ্যে কাঁদতে পারছে না অথচ বুক ফেটে কান্না চলে আসছে। চোখে পানি আসতে গিয়েও পানি আটকে যাচ্ছে। এমন একটি অবস্থা এরকম কষ্টের মধ্যে থাকতে থাকতেই বিভিন্ন জায়গা থেকে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। মোটামুটি জানা গেল যে, এরাই করেছে এবং তখন নামগুলোও জানতে পারলাম। এর কিছুক্ষণ পর আমার কেমন ভেতর থেকে মনে হচ্ছিল এরা হয়তো আমাদের অন্যদেরও হত্যা করবে কারণ তারা তো জানে আমরা বঙ্গবন্ধুকে কতখানি কত কাছের এবং কে কী করতাম।
এছাড়াও ওই সময়টাতে, বাংলাদেশে আজকে যে ৬৪টি জেলা, এই জেলা বঙ্গবন্ধু প্রথম সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি প্রত্যেকটি সাব-ডিভিশনকে একটি করে জেলা ঘোষণা করে প্রত্যেকটি জেলার জন্য একজন করে জেলা গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন। ১৩ আগস্ট থেকে জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ চলছিল। আগের রাত্রে আমি প্রশিক্ষণেও গিয়েছিলাম বেইলি রোডে, এখনকার যে ডিএফপি সেখানে অনেকগুলো অফিস ছিল। সেখানে আমাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলছিল। এসব কাজকর্মের মধ্যে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, কখনো অন্যদিকে তাকানোর সময় হয়নি।
১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা- বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস হত্যার পূর্বে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুনর্গঠিত ও পুনর্বাসিত হয়ে অতি দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছিল। কৃষি এবং ভৌত অবকাঠামো ছিল সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। নিহত, আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার, কয়েক লাখ লাঞ্ছিত মা-বোন সবাই তাকিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। তিনি তাদের নিরাশ করেননি। খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, কৃষি পুনর্বাসন, শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃষ্টি দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যথাসাধ্য উন্নতি সাধন করেছিলেন।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরসহ দেশের বড় বড় ব্রিজ, জাহাজ, রেলওয়ে এবং প্রধান সড়কসমূহ পুনর্নির্মাণ করে যোগাযোগব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এসব উন্নয়ন পরিকল্পিতভাবে করার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩-৭৮ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বিমুখী : পুনর্বাসন এবং বিনিয়োগ; যাতে দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন করা যায়। অর্থনৈতিক কর্মকা- দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষিক্ষেত্রে সব উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করেন এবং সেই সঙ্গে কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন। পাশাপাশি শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দিয়ে প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন এবং পরে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। ১৯৭৫-এ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭.০০ শতাংশে পৌঁছতে পেরেছিল। যা তারপর জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া আর কোনো সরকার পারেননি। ’৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছিল। পরে পাকিস্তানপন্থি সরকারগুলো (খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া) অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করে। কতিপয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্র সহায়তা করে একটি নব্য ধনী গোষ্ঠী সৃষ্টি করা হয় এবং রাজনীতিতে সুযোগসন্ধানী-সুবিধাবাদীদের আমদানি করা হয়। রাজনৈতিক দিক থেকে এটিই ছিল সবচাইতে কালো অধ্যায়। বাংলাদেশকে সবাই চিনত সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে। রাজনীতি ছিল হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে যুক্ত হলো ৩রা নভেম্বর, ওই একই বছরে। সেদিন কারাগারে আটক, যেখানে মানুষকে সবসময় নিরাপত্তা প্রদান করা হয়, সেই নিরাপদ আশ্রয়ে, সরকারের হেফাজতে ছিলেন যে চার জাতীয় নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আমাদের রাষ্ট্রের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথম অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং আরেক মন্ত্রী কামারুজ্জামান সাহেব, যারা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেনÑ সেই চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয় অত্যন্ত নির্মমভাবে। আমার মনে আছে, এখনো খুবই স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার কয়েক দিন পরেই আমাদের সবাকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, নাজিমউদ্দিন রোডে, সেইখানে আমরা ছিলাম। আমরা বলছি এই জন্য যে, আমাদের তখনকার সরকারের প্রায় প্রধান চরিত্র যারা, অর্থাৎ খলনায়ক নন যারা, ওই ঘাতক দলের বাইরে যারা, সরকারের পক্ষে, অর্থাৎ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে এবং বাংলাদেশের সত্যিকারের সন্তান যারা, তাদের ষড়যন্ত্রকারীরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, আমি সবচেয়ে বেশিদিন কারাগারে ছিলাম (প্রায় দুই বছর)। পরবর্তী সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা অনেক হয়েছে, হয়রানি হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষের বিরাট সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা তার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। জনগণের বিশাল দাবির মুখে ১৯৮১ সালে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জননেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তিকে একত্রিত করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আবারও আসীন হয়। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কর্মযজ্ঞ। পরবর্তী সময়ে দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ‘দিন বদলের সনদ’কে সামনে রেখে জনগণের রায় নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসে। শুরু হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ। বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের প্রিয় নেত্রী, দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বিপুল জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে, তিনি বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আধুনিক, উন্নত, গণতান্ত্রিক ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলবেন।
‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’
লেখক : বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা
আমাদের ইতিহাসচর্চার দিকে তাকালে একটা সংকট, সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সংগ্রাম কবে থেকে শুরু হয়েছে, তার ধারাবাহিক ইতিহাস নিয়ে সংকট রয়েছে। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে, তারা মনে করে ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর থেকে এখানকার বাঙালিরা পাকিস্তানের প্রতি তাদের মনোভাব পাল্টে ফেলে এবং আন্দোলন শুরু করে। তাই তাদের কাছে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। আমি ইতিহাসের মানুষ হিসেবে মনে করি, ঘটনা ঘটার জন্য সময় প্রয়োজন। সেই বিবেচনায় এখানে স্বাধীনতার মতো ঘটনা ঘটতে সময় লেগেছে মাত্র ২০/২৫ বছর। তবে একটা জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা মাত্র ২০ বছরে তৈরি হওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর তেমন একটা প্রমাণ পাওয়া যায় না কেননা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি তৈরি হওয়ার পর প্রথম হরতাল হয়েছে ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দ্বন্দ্বটি জন্মলগ্ন থেকেই ছিল।
জন্মলগ্ন থেকে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার উৎস কী? আমি মনে করি আলাদা করে রাষ্ট্র গঠনের ভাবনা শুরু হয়েছে ১৯৪০ এর দশকের শুরু থেকেই। অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাব থেকেই এ ভাবনা শুরু হয় এবং এর ওপর ভিত্তি করে মুসলিম লীগ বাংলায় রাজনীতি শুরু করেছিল। এখন যারা মুসলিম লীগ করেছেন, তারা কী ধরনের মানুষ ছিলেন? তারা মূলত কৃষকনির্ভর ছিলেন। ১৯০৯ সালের পর যে কোনো নির্বাচনে জয়লাভ করতে গেলে কৃষকদের সমর্থন সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল। কারণ, তারাই ছিল তখনকার সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী। তাদের ভোটই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করত। সে কারণে চাইলেও কেউ কৃষকবিরোধী ধারণা পোষণ করতে পারত না। আমরা মুসলিম লীগ বলতে জিন্নাহকে বুঝি। কিন্তু তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের নেতা। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্ব বলতে যাদের বোঝানো হয়, তাদের মধ্যে একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে এসেছেন, সেই পরিস্থিতি অনুধাবন করলে তার মুসলিম লীগ করার যৌক্তিকতা বোঝা যায়। কংগ্রেস ছিল মূলত জমিদার এবং উঁচুতলার মানুষদের দল। তারা হয়তো ভালো লোক হতে পারেন, কিন্তু তারা ঐতিহাসিক কারণেই কৃষকের স্বার্থবিরোধী অবস্থানে ছিলেন। কিছুতেই এই দুটো রাজনৈতিক ধারার মিল হওয়া সম্ভব ছিল না। তারপরেও মিল হওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটা প্রচেষ্টা ভেঙে দিয়েছে দিল্লিকেন্দ্রিক কংগ্রেস। তারা পূর্ববঙ্গের মানুষদের নিয়ে একসঙ্গে রাজনীতি করার পক্ষপাতি ছিলেন না।
পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হতে থাকল কবে থেকে? মূলত ১৮৫৭ থেকে ১৯০৫Ñ এই সময়কালের মধ্যে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক সচেতনতা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে, পূর্ববঙ্গের মানুষদের মধ্যে এ সচেতনতা তৈরি হয়। আর পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে তাদের বৈশিষ্ট্য আলাদা ছিল। পশ্চিমবঙ্গ ছিল কলকাতার বাবুসমাজের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এই বাংলা বাবুবলয়ের বাইরে ছিল। ঠিক একইভাবে অতীতেও আমরা আর্য বলয়ের মধ্যে ছিলাম না। বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে সবচেয়ে বেশি কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে এ বাংলাতে। যদিও ১৭৭০ সালে দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। কিন্তু বিদ্রোহটাকে টেনে নিয়ে গেছে পূর্ববাংলার মানুষ। ১৭৬০ সালে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে তা কিন্তু আর থামেনি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়েছে এবং তারই সর্বশেষ পর্ব হলো বাংলাদেশের উত্থান। এই সময়ে এখানকার মানুষ অনেক বেশি সংঘবদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে জঙ্গিত্ব তৈরি হয়েছে এবং তারা সশস্ত্রভাবে প্রতিহত করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এই রাজনৈতিক সমীকরণ আমাদের ইতিহাসে থাকে না। আমরা শুরু করতে চাই ১৯৪৭ সাল থেকে। এই সময় থেকে যেহেতু পাকিস্তান বিরোধিতা শুরু হয়েছে, তাই আমরা এ সময়কালকে বেছে নিতে চাই। কিন্তু প্রকৃতঅর্থে সাধারণ মানুষ সবসময়ে তার বিরোধিতা করেছে, যে তার স্বার্থবিরোধী অবস্থানে গিয়েছে। এ কারণে বঙ্গবন্ধুকে ভালোভাবে পাঠ করা উচিত। তার আত্মজীবনী পড়ে দেখলে বোঝা যায়, যারা সাধারণ জনগণকে নিপীড়ন করছে, তাদের দাবিয়ে রাখতে চাচ্ছে, তিনি তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নিচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু যখন দেখলেন কংগ্রেস হিন্দু জমিদারদের পক্ষ নিচ্ছে, তখন তিনি এর বিরোধী অবস্থান নিলেন। এখানে কিন্তু ধর্ম মুখ্য বিষয় নয়। বরং মুখ্য বিষয়টি হলো নিপীড়ন। ১৯৪৯ সালে যখন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সভা করতে গেলেন, সেই সভা না করতে দেওয়ার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অবস্থান নিয়ে বললেন যে সভা হবে। যে কারণে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা হলো। এ ঘটনাগুলো বাদ দিয়ে আপনি যদি রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিচার করতে চান, তাহলে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। ১৯৫২ সালেই কি আমরা স্বাধীনতার কথা ভাবলাম? ১৯৪৭ সালে জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে পাকিস্তান তৈরি করলাম, আর মাত্র পাঁচ বছরেই আমরা স্বাধীনতার কথা ভাবলাম? এ ধারণাগুলোর উৎস পাকিস্তানবিরোধিতা থেকে। আমরা মনে করেছি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানেই পাকিস্তানবিরোধিতা। বস্তুতপক্ষে, শেখ সাহেবের রাজনীতি আর সাধারণ মানুষের রাজনীতির ঐকতান হচ্ছে, অত্যাচারীর বিরোধিতা করা। অত্যাচারীর চেহারায় যারা এসেছে, তিনি এবং জনগণ তার বিরুদ্ধেই লড়াই করেছে। পাঠক যদি সংহত রাজনৈতিক অবস্থান অন্বেষণ করতে যান, তাহলে দেখতে পাবেন সশস্ত্র সামাজিক প্রতিরোধই এর উৎস। ১৭৬০ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে কৃষক সমাজ। তারাই বঙ্গভঙ্গ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
১৮৫৭ সালে কলকাতা নিশ্চুপ থাকলেও কৃষকরা কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এখন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সিপাহি বিদ্রোহে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে সর্বভারতীয় কৃষক সমাজ। অর্থাৎ কৃষকরা ঔপনিবেশিক আমলে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী চরিত্র ধারণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সামাজিক আন্দোলনের পর্যায় তৈরি হয়েছে, ধীরে ধীরে তা সামাজিক প্রতিরোধে পরিণত হয়ে রাজনৈতিক প্রতিরোধের পর্যায়ে পৌঁছায় এবং সর্বশেষ তা একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘটায়। এরই ধারাবাহিকতা ধরে এগোলে দেখা যাবে যে ১৯৩৭ সালে মানুষ মুসলিম লীগ এবং কৃষক প্রজা পার্টিকে বেশি ভোট দিয়েছে। আবার ১৯৪০-৪৭ এর মধ্যে বাংলার প্রায় সমস্ত ভোট পাওয়া দলটিই মাত্র একটি কেন্দ্রে জয়লাভ করা দলে পরিণত হয়েছিল। এর মূল কারণ, কৃষকরা যখন দেখেছে এই দলটি কৃষকের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তখন তারা ভোট দিয়েছে। আবার কৃষকের স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার রাজনীতি ভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই সমীকরণ বাদ দিয়ে আমরা শুধু ১৯৪৭ পরবর্তী ইতিহাসকে তুলে ধরতে চাই। এটা একটা বড় ধরনের ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এটা পরিত্যাগ করে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতাকেই বিবেচনা করা উচিত।
এ কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ বলল, আলাদা রাষ্ট্রের স্থলে একটি রাষ্ট্র হবে। তার বিরুদ্ধে জনগণ ক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। এ বিষয়ে জিন্নাহ সাহেব খুব বাজে একটা যুক্তি দেখালেন যে টাইপিংয়ের ভুল হয়েছে। জিন্নাহ সাহেব এটা কী করে বলেন, যখন ১৯৪০-৪৬ পর্যন্ত কলকাতা, ঢাকায় মিছিল-মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে চলবে। আবুল হাশিম সাহেব তো তখন ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ নামে একটা ইশতেহার পর্যন্ত ছাপিয়ে ফেলেছেন। ১৯৪৬ সালের এ ঘটনার প্রভাব শেখ সাহেবসহ অনেক তরুণের ওপর পড়েছিল। অথচ এই ইতিহাস আমরা অনেকেই পর্যালোচনা করতে না চেয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরের সময়কেই বেছে নিতে চাই। প্রকৃতঅর্থে এটা যারা করেন, তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে গ্রহণযোগ্য করতে চান এবং তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাশীল। আমি তো মনেই করি না পাকিস্তান নামে কোনো রাষ্ট্র হয়েছিল। আমার মতে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল অনেক আগে। এর মধ্যে পাকিস্তান ছিল একটি চাপিয়ে দেওয়া বিষয়, যেটা বেশিদিন টিকতে পারেনি। আমি মনে করি, দুটো আলাদা রাষ্ট্রকে জোর করে পতাকা লাগিয়ে এক করা হয়েছিল। তার পরিণতিতেই ১৯৪৮ সাল থেকে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। তাই শেখ সাহেবকে এই বিদ্রোহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। শেখ সাহেব ছিলেন এই বিদ্রোহের একজন মুখপাত্র। তিনি ভদ্রলোকের রাজনীতি করেননি, করেছেন বিদ্রোহের রাজনীতি। তিনি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি না করে মাঠের রাজনীতি করেছেন। এটাই তার ধারাবাহিকতা।
আমি নিজে গবেষণা করে দেখেছি যে কৃষক যখন ভোটাধিকার পেয়েছে, তখন তারা সবচেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। তারা লড়াই করে যে ক্ষমতা দেখাতে পারেনি, ভোটাধিকার পাওয়ার পরে সে ক্ষমতা দেখাতে পেরেছিল। ইংরেজদের কৃষিনীতি দেখলে বোঝা যায় যে তারা কৃষককে পুঁজি করতে চেয়েছিল। তারা ১৯১১ এর পরে কলকাতার ওপর হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সালে দুটি রাষ্ট্রের চিন্তা প্রাধান্য তৈরি করেছিল আর ১৯৪৬ সালে সেটা জিন্নাহ ধ্বংস করলেন। ১৯৪৭ সালে যৌথ বাংলার আওয়াজ উঠল আর এটাকে ধ্বংস করল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের প্রভাবাধীন বঙ্গীয় কংগ্রেস। আসলে তারা চাপে পড়ে ভেবেছিল যে এই কৃষকদের অধীনে থাকা যাবে না। তাই যারা ভেবেছে যে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের সূচনা হয়েছে, তারা মস্ত বড় ভুল করেছে। এটা অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। যখন যৌথ বাংলার স্বপ্ন মার খেয়ে গেল, তখন মুসলিম লীগের কিছু নেতৃত্ব এ স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা নেয়। তাদের ‘ইনার গ্রুপ’ বলা হতো। আমি এদের প্রধান নেতা মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। সেখানে তিনি বলেছেন, তারা সেই সময় গোপন সভা করতেন এবং তাদের ধারণা ছিল এ রাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক নেতা হবেন গোপালগঞ্জের লম্বা লোকটা। এই ইতিহাসকে বাদ দিয়ে শুধু ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই বিভ্রান্তিকর। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত মূল্যায়ন তো দূরে থাক, বরং তাকে ইতিহাসেই প্রান্তিক করে তোলা হয়।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, শিক্ষক ও লেখক
আপাত সাদামাটা হোটেলটা যতই রাস্তার ওপরে হোক, শতকরা একশো জনের মধ্যে হলফ করে বলা যায় পথচলতি অন্তত আটানব্বই জনেরই তা চোখে পড়বে না। অথচ জায়গাটা কলকাতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র শিয়ালদায়। রাত্তির-দিন এখানে শহর জেগে থাকে। কাছেই কলকাতার সবচেয়ে বড় হোলসেল কোলে মার্কেট। দূরদূরান্ত থেকে ট্রেনে করে মাছ ও সবজি বিক্রেতারা দলে দলে রাত ভোর কোলে মার্কেটে নিজের নিজের পণ্য নিয়ে ভিড় জমান। অত জীবন্ত বাজার খুব কম দেখেছি। এ অঞ্চলের পোশাকি নাম বৈঠকখানা। লোকশ্রুতি, কলকাতার আদি যুগে জব চার্নক এখানকার কোনো এক বটগাছের নিচে বসে হুঁকো খেতে খেতে বৈঠক করতেন নেটিভদের সঙ্গে।
এক চক্কর পুরো এলাকাটা পায়ে হেঁটে ঘুরলে জানা-অজানা কত কত আখ্যান চোখের সামনে ভেসে উঠবে। কুতুব সরকারের নামে যে মসজিদটা তার বয়েস অনেক দিন আগেই একশো বছর পার হয়ে গেছে। এক পা হাঁটলেই দপ্তরিদের পুরনো মহল্লা। কলকাতা বইপাড়ার সঙ্গে এই দপ্তরিদের সম্পর্ক বহুদিনের। বই বাঁধাইয়ের কর্মীরা অধিকাংশই মুসলিম। দেশভাগের পর দপ্তরিদের অনেকেই এখান থেকে পূর্ববাংলায় চলে গেছেন। একে একে দেখে নিতে পারেন কাশিমবাজার রাজাদের বাড়ি অথবা ব্রাহ্ম নেতা কেশব সেনের সমাধি।
শিয়ালদা ফ্লাইওভারের আশপাশে প্রচুর হোটেল, রেস্তোরাঁ। নয়া অর্থনীতি কলকাতাকেও বদলে দিয়েছে। নিউ টাউন সল্টলেক দক্ষিণ কলকাতায় ঝাঁ চকচকে যত নতুন নতুন হোটেল গড়ে উঠেছে ততই মøান হয়েছে শিয়ালদার হোটেলপাড়া। অথচ একদিন এখানকার একাধিক হোটেল বিদেশি ট্যুরিস্ট ও ডিপ্লোম্যাটদের কাছেও ছিল বিপুল জনপ্রিয়। এখানেই মহল, ব্যারন। আরও কত কত নাম। ব্যারনের ইলিশ মাছ খেতে ছুটে এসেছিলেন স্বয়ং আমেরিকার হেনরি কিসিঞ্জার। পঞ্চাশ ষাট সত্তর দশকের শুরু অবধি এইসব হোটেলের ছিল রমরমা। এখানকার এক হোটেলেই বিয়ে করে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম ও তখনকার নামকরা গীতিকার, সুরকার কমল দাশগুপ্ত। শান্তি নিকেতন বোর্ডিংয়ে তাদের বিয়ে ও সংসার পাতা নিয়ে সে সময় কম বিতর্ক হয়নি।
মুশকিল হচ্ছে ব্যারন, মহল, শান্তি নিকেতন বোর্ডিং তবু চোখে পড়ে। কিন্তু অবিভক্ত বাংলার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যে হোটেলে তৈরি হয়েছিল সে একেবারেই লোকজনের চোখের আড়ালে থেকে গেছে। ইতিহাস সত্যিই বড় রহস্যময়। কত অখ্যাত বিষয় সে মনে রাখে। আবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সে নীরব থাকে। শিয়ালদার ‘টাওয়ার লজ’-কে ইতিহাস একেবারেই মনে রাখেনি। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতির বড় এক মাইলফলক ঘটেছিল এই আপাত ম্যাড়মেড়ে হোটেলটিতেই।
টাওয়ার লজ-কে লোকে আজ জানে কলকাতা শহরের সস্তায় মদ খাওয়ার ঠেক বলে। সন্ধ্যে হতে না হতেই স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেই মনে হবে কোনো এক নিষিদ্ধ গোপন ডেরায় ঢুকছেন। সস্তা মদের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠবে। বড় ঘরের ভেতরে অসংখ্য লোক। অধিকাংশই সম্ভবত মফস্বলের। এক আধ গ্লাস খেয়ে ছুটবে ট্রেন ধরতে। কেউ জানেনই না ১৯৫৪ সালে এই হোটেলে একসঙ্গে বেশ কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেছেন তৎকালীন পূর্ববাংলার রাজনীতির দুই নক্ষত্র চরিত্র মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সাধারণ লোকের আর কী দোষ! হোটেল কর্তৃপক্ষ, আমাদের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, বাংলাদেশ দূতাবাসের লোকজন, এমনকি শতবর্ষে শেখ সাহেবের নামে যারা সকাল বিকেল জয়ধ্বনি দিচ্ছেন তারাও প্রায় কেউই এমন এক ইতিহাসের আঁতুড়ঘর নিয়ে চুপচাপ। শেখ মুজিবুর রহমানের কলকাতা পর্ব নিয়ে কিছু লেখালেখি হচ্ছে। ইসলামিয়া কলেজ, বেকার হোস্টেল, লীগ রাজনীতি, ১৯৪৬-এ গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এসব ইদানীং নতুন করে আলোচনায় আসছে। স্বয়ং শেখ সাহেবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও কলকাতা নিয়ে দীর্ঘ এক অধ্যায় আছে। টাওয়ার হোটেলে ভাসানীর সঙ্গ নিয়ে এক আধটা লেখায় কিছুটা ছুঁয়ে গেছে মাত্র। তার পেছনে একটা কারণ অবশ্য থাকতে পারে। ১৯৫৪ সালের পর থেকে আজ অবধি টাওয়ার লজের মালিকানা অন্তত চারবার বদল হয়েছে। কয়েক মাস আগে টাওয়ার লজ আবার মালিকানা বদলেছে। নতুন মালিক ঐতিহ্যশালী টাওয়ার লজের নামও বোধহয় পাল্টে দিয়েছেন। ফলে পাকাপাকি ভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ইতিহাসের অতীব এক সন্ধিক্ষণের মাইলফলকটি।
১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানী তখন ইউরোপে। শান্তি আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক হয়ে লন্ডন, প্যারিস, স্টকহোমে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে পশ্চিম ও পূর্বের দ্বন্দ্ব ক্রমবর্ধমান। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে পূর্ববাংলার জেলায় জেলায়। মওলানা ভাসানী তখন প্রধান সেনাপতি ও শেখ মুজিবুর তার বিশ্বস্ত সেনানায়ক।
মুর্শিদাবাদের মীর জাফরের পরিবারের ছেলে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানের মসনদে বসেই ঘোষণা করলেন ইউরোপে ঘুরছেন ঘুরুন দেশে ফিরলেই এয়ারপোর্টে গুলি করে মারা হবে মওলানা ভাসানীকে।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে। পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আর বাধ্য হয়ে ইউরোপ থেকে ফিরে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন মওলানা। টাওয়ার লজ অস্থায়ী নিবাস। সেখানে দুই বাংলার নামি অনামিরা ছুটে আসছেন ভাসানীর কাছে। বঙ্গবন্ধুকে গণআন্দোলনের চাপে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানের শাসকরা। জেল থেকে বের হয়েই মুজিবুর রহমান ছুটলেন করাচি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করে মওলানা ভাসানীর ওপর থেকে পাকি শাসকদের অন্যায় আদেশ ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি নিয়ে। পাশাপাশি তিনি সোহরাওয়ার্দীকে অনুরোধ করলেন অন্য রাজবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিতে।
বস্তুত সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া পছন্দ করেননি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তা মুখের ওপর বলেও ছিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে। শেখ সাহেবের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার বিরুদ্ধপক্ষের লোকজনও স্বীকার করেন সবসময়। যে শেখ সাহেব চিরকাল মুখের ওপর কথা বলতে ভালোবাসতেন। রাখঢাক গুড়গুড় কলেজ জীবন থেকেই মুজিবুর রহমানের অপছন্দের।
করাচি পর্ব শেষ করে ঢাকায় ফেরার পর পরই আওয়ামী মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খানকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সোজা দমদম এয়ারপোর্টে নেমে সরাসরি চলে আসেন টাওয়ার লজ-এ। দীর্ঘ সময় ধরে লীগের তিন নেতা ভাসানী, মুজিব ও আতাউর রহমান মিটিং করেন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে। এখন যে যাই বলুন, অন্তত ১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানীর অগাধ আস্থা ছিল তরুণ নেতা শেখ মুজিবের ওপর, তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। টাওয়ার লজ-এ সেদিন কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তা আজ আর জানা সম্ভব নয়। তবে আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক করা যে জরুরি তা নিয়ে সম্ভবত ওই লজেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মওলানা ও মুজিবুর রহমান।
প্রথম দিনের মিটিংয়ের পরে আরও কয়েক দিন মুজিব ও ভাসানী নানা বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেছিলেন তা স্পষ্ট হয়, ১৯৫৫ সালের ৪ এপ্রিল ভাসানীর শেখ সাহেবকে লেখা এক চিঠিতে। মওলানা ভাসানী লিখছেন, ‘প্রিয় মজিবর রহমান, আমার দোয়া সালাম সকলে গ্রহণ করিও। আগামী ১১ই জুন ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভা ডাকবে। আমি সম্ভবত তার আগের দিন ঢাকা পৌঁছে যাব।’
ওই কাউন্সিল সভায় এজেন্ডার দ্বিতীয় পয়েন্ট ছিল আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করা। এর থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে টাওয়ার লজ-এ মুজিবুর রহমানের সবুজ সঙ্কেত পেয়েই মওলানা ভাসানী ঢাকা ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। তা প্রথম জানতে পারেন শেখ সাহেবই। এরকমই পারস্পরিক নির্ভরতা ছিল ভাসানী-মুজিবের মধ্যে।
অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের চিহ্নমাত্র আজ মাথা খুঁড়লেও টাওয়ার লজ-এ কেউই পাবেন না। আমাদের চমৎকার ইতিহাস বোধ সে সময়ের সব দলিল দস্তাবেজ বাতিল কাগজের বান্ডিল মনে করে নষ্ট করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে টাওয়ার লজের স্মৃতি কি কোনোভাবেই আর সংরক্ষণ করা যায় না!!
লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা,
লেখক ও কলামনিস্ট
বঙ্গবন্ধুর জীবন তিন কারণে আলাদা। প্রথমত, তিনি ছিলেন বাঙালির প্রথম মাটি ও মানুষের নেতা, যিনি সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এর আগে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রথম বাঙালি নেতা ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন একটি প্রাদেশিক সরকারের প্রধান। সিরাজুদ্দৌলা থেকে শুরু করে বাকি সবাই অন্য অঞ্চলের ছিলেন। এজন্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে পরিচিত হলেও তার সময়কার মানুষ তাকে ‘মুজিব ভাই’ বলেই ডাকতেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে চিনিয়েছেন। তার কারণেই বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে চিনেছে। বাংলাদেশে নামের পাশে বঙ্গবন্ধু নামটি চিরদিন থাকবে। এই দুটি বিষয় একজন বাঙালির কাছে গর্বের। তৃতীয় বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই লজ্জার। যার হাত ধরে একটি জাতি স্বাধীন রাষ্ট্র পেল, যিনি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই জাতিই তাকে সপরিবারে হত্যা করল!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে আমি এক দিন ইন্টারন্যাশনাল টেলি কমিউনিকেশন ইউনিয়নের প্রধান টি মিলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। আমি তার রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করতেই সোজা জিজ্ঞাসা করলেন, যড়ি how could you do? (তোমরা কীভাবে তাকে হত্যা করতে পারলে)। আমি তখন লজ্জিত ও বিব্রত ছিলাম। কোনো উত্তর আমার ছিল না। তার ওই প্রশ্নটি আজও আমায় ভাবায়। অথচ যারা এই হত্যায় জড়িত, তারা ছিল বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭২ সালে আবার লন্ডনে গেলেন, তখন তার হোটেলের রুমের দরজার দায়িত্বে ছিলেন মেজর ডালিমের শাশুড়ি। তিনিই ঠিক করতেন বঙ্গবন্ধুর রুমে কে যাবেন আর কে যাবেন না। তার শ্বশুর রফিকুল ইসলামও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ। আর সেই মেজর ডালিমই তাকে হত্যা করল! আরও লজ্জার হলো সেই হত্যাকারীদের দূতাবাসে চাকরি দেওয়া। যেটা আমাদের জন্য ছিল চরম অস্বস্তিকর। সবাই জেনারেল জিয়াকে এজন্য দোষারোপ করে। কিন্তু এ কথা কেউ বলে না যে, এরশাদ সাহেবও তাদের মেয়াদ বাড়িয়েছিলেন। চাইলে এরশাদ তো তাদের বিচার করতে পারতেন বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। এরশাদের কি এখানে কোনো দায় নেই?
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় সাক্ষাৎ ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। এই ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে আমি গর্বিত। আমার সঙ্গে আরও দুজন বাংলাদেশি কূটনীতিক এর সাক্ষী। আমি ব্রিটেনের বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করি। আমরা সেখানে ছয়-সাতজন বাঙালি ছিলাম। পাকিস্তান সরকার যখন বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির ঘোষণা দেয়, তখন আমার মন বলছিল তিনি সরাসরি লন্ডনে আসবেন। এর কারণ হলো, পাকিস্তান তাকে সরাসরি ভারত বা সৌদি আরব পাঠাবে না। আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর তিনি একবার লন্ডনে গিয়েছিলেন। ৮ জানুয়ারি ভোর ৪টার দিকে ব্রিটেন সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হলো, কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে আসছেন। আমাদের হাতে সময় কম। যে যেখানে ছিলাম সেখান থেকে সোজা বিমানবন্দরের দিকে রওনা হলাম। তাকে যে সংবর্ধনা দিতে হবে সেই চিন্তা কারও মাথায় নেই। আমাদের মনে তখন কাজ করছিল এক অন্য রকম অনুভূতি।
আমি গাড়ি চালিয়ে যখন বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন শুধু একটা ছবিই চোখের সামনে ভাসছিল। আর সেটা হলো বঙ্গবন্ধু, আমাদের মুজিব ভাই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার পরদিন আমরা জানতে পারি যে বঙ্গবন্ধু নিখোঁজ। কিন্তু কোথায় আছেন তা নিশ্চিত না। ওই দিন রাতে পাকিস্তান বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তাও আমরা ব্রিটেনের বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জেনেছিলম।
ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফে ৩০ মার্চ ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে সাংবাদিক সায়মন ড্রিং একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে তিনি গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। তখন আমরা ঢাকার বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাই। তবে তিনি বঙ্গবন্ধুর কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
আমাদের মনে প্রশ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু কোথায়? একটি অসমর্থিত সূত্র জানাল, তিনি আমাদের লোকদের কাছেই আছেন। কিন্তু সেটাও অতটা বিশ্বাসযোগ্য না। এখন যদি আমরা প্রচার করি যে তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন অথচ তিনি পাকিস্তানিদের হাতে, তাহলে বড় বিপদ। পাকিস্তানিরা তাকে মেরে ফেলে আমাদের ওপর দায় চাপাবে। তাই নিশ্চিত হওয়ার আগে তার সম্বন্ধে কোনো খবর প্রচার হতে দেওয়া যাবে না। এরই মধ্যে একটি পত্রিকামারফত জানতে পারলাম তিনি পাকিস্তানে আছেন। আমিসহ বেশ কয়েকজন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তারা মুজিবনগর সরকারের পক্ষে অবস্থান নিই। এরপর দীর্ঘ লড়াই চলল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কেউ স্বচক্ষে দেখেননি। এবারই প্রথম আমরা ও বিশ্ববাসী তাকে দেখব। গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় করছিলেন বিমানবন্দরে। সবাই সেই মানুষটিকে দেখার জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন। যিনি একটি দেশ এনে দিয়েছেন। যার ওপর বিশ্বাস রেখে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন। কোটি কোটি মুসলমান রোজা রেখেছেন, হিন্দুরা উপোস থেকেছেন। আজ সেই ‘মুজিব ভাই’ সবার সামনে আসবেন। তাকে সবার আগে আমরা দেখব এ কথা ভাবতেই চোখে পানি এসে গেল। বঙ্গবন্ধু সকাল ৬টার দিকে বিমানবন্দরে নামলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালাম। সবার চোখে পানি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্থির। তার সঙ্গী ছিলেন ড. কামাল হোসেন।
ওই দিন ছিল শনিবার। ব্রিটেনের সাপ্তাহিক ছুটি। তাই সে দেশের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথ চোকার্সে (প্রধানমন্ত্রীর ছুটি কাটানোর বাংলো) অবস্থান করছিলেন। এজন্য তিনি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে পারেননি। হিথ দুপুর নাগাদ এসে তার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধুর দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতেই হয়। একটি হলো তার সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য। যেটার খসড়া করেছিলেন রেজাউল করিম নামের এক কূটনৈতিক আর চূড়ান্ত করেছিলেন ড. কামাল হোসেন। মাত্র দেড় পৃষ্ঠার সেই লিখিত বক্তব্যে তিনি বিশ্ববাসীকে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেশকে গড়ে তোলার জন্য তিনি বিশ্ববাসীকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পেতে সহায়তার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আরেকটি হলো সাক্ষাৎ শেষে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানানোর সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথ বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ির দরজা নিজ হাতে খুলে দিয়েছিলেন। বিশ্বের অন্য কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এমন সম্মান পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। এই সম্মান শুধু বঙ্গবন্ধুর ছিল না, এটা ছিল সমগ্র বাংলাদেশের।
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল চমৎকার। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পররাষ্ট্র দর্শন হবে সুইজারল্যান্ডের মতো’। তিনি কারও পক্ষে বা বিপক্ষে ছিলেন না। এজন্য জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনে (ন্যাম) বাংলাদেশের সদস্য হওয়া। মূলত তার পররাষ্ট্রনীতি ছিল সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলা। তবে যেহেতু রাশিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তাই রাশিয়ার প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা দুর্বলতা ছিল। এটাকে অনেকটা কৃতজ্ঞতা বলা চলে। আর ভারত ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও তার ছিল অন্যরকম সম্পর্ক। এসবের পরও তিনি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে ও বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে বিশ্ব মুসলিম সংস্থায় (ওআইসি) তিনি যোগ দেন।
বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ নেওয়ায় ভারত ও রাশিয়া হয়তো কিছুটা মন খারাপ করেছিল বলে আমর মনে হয়। কিন্তু তিনি তাদের এই বলে বুঝিয়েছিলেন, ইন্দোনেশিয়াও সেক্যুলার রাষ্ট্র হয়েও ওআইসির সদস্য। তাই আমরাও হচ্ছি। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। এভাবেই তিনি ভারত ও রাশিয়াকে পক্ষে এনেছিলেন। বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য হওয়ায় অনেক লাভও হয়েছিল। এত বড় একটা মুসলিম সংস্থায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করেছিল।
আমার দীর্ঘ কূটনৈতিক ক্যারিয়ারে ১৯৭৪ সালকে মনে হয়েছে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কূটনৈতিক বছর। ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়। এটা খুব সহজ ছিল না। কারণ এর আগে চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান করায় বাংলাদেশকে ভেটো দিয়েছিল। ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম জাতিসংঘে কেউ বাংলায় ভাষণ দেন। এই দুটি বড় আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য হওয়ায় বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন দেশে সফর করেন। বিশ্বনেতারাও বাংলাদেশে আসেন। তাদের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি সাহায্য চান। এই বছরের ১৬ মে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আমি তখন দিল্লিতে দায়িত্ব পালন করছিলাম। এ ছাড়া ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে ব্রিটেন সফর করেন। তখন তিনি আমাদের সঙ্গেও দীর্ঘ সময় দিয়েছেন। আমাদের তিনি পররাষ্ট্র ব্যবস্থাকে জোরদার করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার একটি সাধারণ ছেলে বিশ্বনেতার কাতারে পৌঁছেছিলেন। অথচ ওই সময়ে বাংলাদেশেই অনেক বড় নেতা ছিলেন। ভাসানী তো আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিই ছিলেন। তাকে টপকে বঙ্গবন্ধুর এত উঁচুতে ওঠার কারণ হলো তিনি মানুষের কথা বুঝেছেন। জনগণকে যে কথা তিনি দিয়েছিলেন তাতে অটল থেকেছেন। কিন্তু ভাসানী সেটা পারেননি। ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হয়ে চীন সফর করেছেন। চীন থেকে ফিরে আইয়ুব খানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সর্বদা আপস করেছেন। ১৯৭০ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বন্যার অজুহাতে ভাসানী নির্বাচন বর্জন করলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটা করেননি।
বঙ্গবন্ধুর একটি কূটনৈতিক দর্শন এখানে তুলে ধরতে চাই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এ পর্যন্ত রেকর্ড করা ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এ ঝড়ের কারণে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। সারা বিশ্বের সাংবাদিকরা এই ঘূর্ণিঝড় কাভার করতে আসেন। তখন পাকিস্তানের নৌবাহিনী ছিল করাচিতে। উদ্ধারকাজে নৌবাহিনীর খুব প্রয়োজন ছিল। সিঙ্গাপুর বন্দর থেকে ব্রিটেনের নৌবাহিনী উদ্ধারকাজে যোগ দিলেও পাকিস্তানের নৌবাহিনী আসেনি।
বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের দেখিয়ে দিলেন যে আমরা কীভাবে অবহেলিত, বঞ্চিত। অথচ পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানি পণ্য পাট বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয়। আর সেই অর্থ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান উন্নত হচ্ছে। তিনি সাংবাদিকদের বললেন, তোমরা দেখো, আমাদের সাইক্লোন সেন্টার নাই, সরকারি স্কুল-কলেজ নাই। অবকাঠামো ব্যবস্থা নেই। আমরা পাকিস্তানের একটি কলোনি মাত্র। এমন দুর্যোগেও নৌবাহিনী আমাদের পাশে নাই। তাহলে আমাদের অধিকার কোথায়? এভাবেই তিনি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বৈষম্য তুলে ধরলেন। তিনি সবাইকে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দেখার জন্যও অনুরোধ জানালেন। সাংবাদিকরাও তার অনুরোধ রাখলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর এমন একচেটিয়া বিজয়ের মূল কারণও ছিল সেই ঘূর্ণিঝড়। তিনি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমাদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমাদের নিজেদের এক হতে হবে। জনগণ ফুঁসে উঠল। তাদের মুজিব ভাইকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করল। তার ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন দেশ স্বাধীন করল। নতুন রাষ্ট্রকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজে হাত দিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন শেষ করে দিল তার খুনিরা, যার খেসারত আজও বাংলাদেশ ও তার জনগণকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এখনো বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নামের পাশে লেখা আছে একটি কলঙ্ক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও কূটনীতিক, সাবেক সচিব,
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
জাপানের টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসে ১৯৯৬ সালে ১৫ আগস্ট ‘শোক দিবস ’ পালন প্রাক্কালে আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি জাপানি মহান নেতাদের শ্রদ্ধা, সম্মান ও মনোভাবের স্মৃতিচারণমূলক রচনা বা বক্তব্য বিষয়াদি অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হলাম। কমার্শিয়াল উইং-এ আমার দোভাষী শিরাই সান (মি. ইসামু শিরাই)-এর মাধ্যমে জানতে পারলাম জাপানের ডায়েটে প্রভাবশালী সদস্য তাকাশি হায়াকাওয়া
(১৯১৭-১৯৮২), যিনি বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি জাপানি জনগণ ও সরকারের সমর্থন সম্প্রসারণের নেপথ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। শিরাই সান জানালেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার খবর পেয়ে বিচলিত বিমর্ষ হায়াকাওয়া বাংলাদেশ দূতাবাসে এসে অনুরোধ জানান যে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র পিতৃমাতৃহারা শেখ রাসেলকে তিনি পেতে চান। ১৯৭৩-এ বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় শেখ রাসেল ও শেখ রেহানা জাপান সফর করেছিলেন। হায়াকাওয়া জানতেন না পিতামাতার সঙ্গে শেখ রাসেলও নিহত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ১১ দিনের মাথায় ২৬ আগস্ট টোকিওতে জাপান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন এক শোকসভার আয়োজন করে। অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সভাপতি তাকেশি হায়াকাওয়া বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে শোকসভায় যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেটি জাপানি ভাষায় রচিত তার স্মৃতিগ্রন্থে সংযোজিত আছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জাপানের জনগণ ও সরকারের গভীর শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে তাতে।..............
“আমার অন্তরঙ্গ ও অত্যন্ত সম্মানিত বন্ধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন জাতির পিতা এবং জনগণ যাকে আন্তরিকভাবে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন করত, গত ১৫ আগস্ট কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা কর্তৃক সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে, ৫৬ বছর বয়সে, সপরিবারে নিহত হয়েছেন। এই হৃদয়বিদারক সংবাদটি যখন আমি পাই তখন এক অবর্ণনীয় শোকে ও বেদনায় আমি মুহ্যমান হয়ে পড়ি।
আমাদের দেশেও অতীতে এ ধরনের নৃশংস ঘটনা একবার ঘটেছিল যা ৫.১৫ র ঘটনা (১৯৩২ সালের ১৫ মে জুনিয়র সামরিক অফিসারদের অভ্যুত্থান) নামে খ্যাত, সেদিন প্রধানমন্ত্রী মি. ইনুকি সেনা অফিসারদের বলেছিলেন, ‘আমি যা বলতে চাচ্ছি, আশা করি তোমরা তা বুঝবে’; উগ্র কর্মকর্তারা বলল, ‘এখন এসব যুক্তির কথার কোনো দরকার নেই’ এবং এ কথা বলেই তারা বয়োবৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে। আমি যখন শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার সংবাদ শুনলাম তখন আমার ৫.১৫ র ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বিদেশি বার্তা সংস্থা পরিবেশিত সংবাদ মতে ১৫ আগস্টের খুব ভোরে মুসলিম প্রার্থনা বা নামাজ পড়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের আক্রমণের শিকার হন। তার নিজের ব্যক্তিগত বাসভবনের তিনতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে তিনি আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান, ভুট্টো (এরা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট) যেখানে আমাকে হত্যা করেনি, সেখানে তোরা এসেছিস আমাকে হত্যা করতে?’ তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হয়। আরেকটি বিদেশি বার্তায় দেখা যায়, ‘প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহীদের অস্ত্রসমর্পণের শর্তে নিজে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যাওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, তার এই প্রস্তাবে হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর না পেয়েই তাকে নিহত হতে হয়।’ এটা একজন রাজনীতিকের সবচেয়ে মর্মান্তিক পরিণতি।
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল মূলত জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য উৎসর্গীকৃত। তিনি নিজের জীবনকে পাখির পালকের মতো হালকা মনে করতেন। তিনি জীবনে আটবার গ্রেপ্তার হন, কারাগারে কাটান সাড়ে দশ বছর, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সহযোগীদের পরিবর্তে তিনি নিজেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন, সেখানে ফাঁসিতে ঝোলানোর দু ঘণ্টা আগে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান, তিনি এভাবেই জাতীয় বীর হিসেবে এক সগৌরব জীবনের অধিকারী হয়ে জাতির পিতার সম্মানে সমাসীন হন।
মেধা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে ঢাকায় লক্ষ জনতার সামনে তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তার সেই বক্তৃতার ভাষা আমাকে আপ্লুত করে। এখনো তা আমার স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। তিনি বলেছিলেন, ‘যে মুহূর্তে আমি বুঝব জনগণের স্নেহ ও ভালোবাসা আমার ওপর নেই সে মুহূর্তেই আমি পদত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকব। তবে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, বাংলাদেশের সকল মানুষের মুখে হাসি না ফোটানো পর্যন্ত আমি আমার জীবন উৎসর্গ করে যাব।’
দেশ ও জাতির প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও তার মন অনুধাবন করার জন্য অনেক কিছু বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে, উপর্যুপরি বন্যা, মূল্যস্ফীতি ও আরও কিছু সমস্যা, যার সঙ্গে যোগ হয় কিছু শ্রেণির রাজনৈতিক নেতার দুর্নীতি, এসব কারণে সবার মুখে হাসি ফোটানোর সেই প্রতিশ্রুতি-প্রত্যয় পূরণ না করেই স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাত্র চার বছরের মাথায় তাকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো, যদিও অনেক কিছুই এখনো স্পষ্ট নয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যলাভ ও তার সাথে আমার নিবিড় বন্ধুত্বের সূত্রপাত চার বছর আগে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমার ব্যক্তিগত সমর্থন-সহানুভূতি থাকায়, দেশটির স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পরে জাপান সরকারের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে আমি ১৯৭২ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশ সফরে যাই। সেবারই আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম দর্শন লাভ করি তার কার্যালয়ে। সে মুহূর্তে তিনি আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী বীর হিসেবে প্রতিভাত হননি, হয়েছিলেন একজন অতি মহান উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হিসেবে। একটা আনন্দঘন অনুপম পরিবেশে আমি তার ব্যক্তিগত ঔদার্য ও মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জাপানের কাছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও অর্থনীতির পুনর্বাসন-পুনর্গঠনে যমুনা সেতুর নির্মাণসহ বহুবিধ অর্থনৈতিক সহায়তা প্রত্যাশা করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সে অনুরোধে যথাযোগ্য সাড়া দিতে দেশে ফিরেই আমি জাপান-বাংলাদেশ সমিতি গঠন করি এবং তাৎক্ষণিকভাবে জাপান সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের জন্য ২ লাখ টন চালসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সহায়তার সংস্থান করি। বলার অপেক্ষা রাখে না প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এতে বিশেষ খুশি হন। আর তার প্রিয় প্রকল্প যমুনা সেতুর ব্যাপারে জাপানি কারিগরি বিশেষজ্ঞের একটি দল গত দুবছর যাবৎ সমীক্ষার কাজে নিয়োজিত আছে। এসব কারণ ও উপলক্ষে আমাদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব নিবিড় থেকে নিবিড়তর হচ্ছিল।
দুবছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় সফরে জাপানে আসেন। জাপানের সরকার ও জনগণ গণমানুষের এই নেতা ও মহান ব্যক্তিত্বকে অত্যন্ত সমাদরে ও শ্রদ্ধায় উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। অনেক কিছু আয়োজনের মধ্যে টোকিওতে জাপান-বাংলাদেশ সমিতি আয়োজিত সংবর্ধনা সভার কথা আমার স্মৃতিতে এখনো সমুজ্জ্বল। সানফ্লাওয়ার জাহাজে হাস্যোজ্জ্বল শেখ মুজিব, তার পুত্র ও কন্যার তৃপ্তির হাসি এবং আমার নিজের নির্বাচনী এলাকা ওকায়ামা প্রিফেকচারে তিনি উৎফুল্ল জনতার যে গণসংবর্ধনা পেয়েছিলেন তার ছবি আমার চোখে এখনো ভাসছে। জাপান সফরের সময় শেখ মুজিবুর রহমান স্বভাবগতভাবেই ইচ্ছাপ্রকাশ করে কয়েকবার বলেন, তিনি জাপানের মডেলে তার বাংলাদেশকে গড়ে তুলবেন।
তাকে স্বাগত জানিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মি. তানাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘তিনি যেন আমাদের হিরোভুমি ইতো (হিরোভুমি ইতো জাপানের গৌরবোজ্জ্বল মেইজি যুগের প্রধান জাতীয় নেতা ছিলেন)।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে জাপান চেম্ব^ার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট মি. শিগেও নাগানো তৎক্ষণাৎ বলেন, ‘না, তিনি বরং একাধারে হিরোভুমি ইতো এবং তাকামোরি সাইগো’ (তাকামোরি সাইগো ছিলেন মেইজি জাপানের আরেক অবিসংবাদিত স্থপতি)। এই সমস্ত মহাজন মন্তব্যের স্মৃতি এখনো আমার কাছে সজীব। এমনকি মি. ওহিরার মতো স্বল্পভাষী জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন, আমাকে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আজকের পৃথিবীর প্রধান তিনজন রাজনৈতিক নেতার একজন।’ এভাবে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত আত্মিক সম্পর্কের পাশাপাশি জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রগাঢ় ভালোবাসা ও বন্ধনের সূত্রপাত হয় শেখ মুজিবের জাপান সফরের সময়।
গত বছরের আগের বছরে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সফরে যাই। সে সময়কার অনেক স্মৃতি আমার মনের মণিকোঠায় জমা হয়ে আছে আর সেখান থেকে মহান ব্যক্তিত্ব মুজিবের কথা আমার বারবার মনে ভেসে উঠছে।
যেদিন আমরা ঢাকায় পৌঁছাই, সেদিন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে তার সঙ্গে আমাদের সৌজন্য সাক্ষাতে যাওয়ার কথা কিন্তু আমাদের বিস্ময়াভিভূত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কূটনৈতিক আচার উপেক্ষা করে তার মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে নিজে আমার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে এলেন সাক্ষাৎ দিতে!
আমরা বলতে পারি এটাই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধুত্ব স্থাপনের এক অনুপম উপায়। অধিকন্তু বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে যেখানেই আমি গিয়েছি উৎফুল্ল জনতা আমাকে অনাবিল উষ্ণতায় ও প্রগাঢ় ভক্তি শ্রদ্ধায় ‘বাংলাদেশের আসল বন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আমাকে অভিবাদন জানিয়েছে। সব জায়গাতেই তারা আমাকে অজস্র ফুল দিয়ে আমাকে বরণ করত, ফুলের মালায় আমার চিবুক পর্যন্ত ঢেকে যেত। আমি নিশ্চিত যে আমার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক আগ্রহ ও বিবেচনার কারণেই সর্বত্র আমার এই সম্মান ও সমাদর।
সে সময় আমার অবস্থানকালে মি. আবদুর রউফ, এমপি আমার সার্বিক দেখাশুনার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সারাক্ষণ আতিথেয়তায় উদগ্রীব থাকতেন। তিনি আমাকে জানালেন, ‘প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক সকালে আমার কাছে জানতে চান হায়াকাওয়া সাহেবের রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তো!’ তার পর্যায় থেকে এত সূক্ষ্ম ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার আন্তরিকতায় আমি বিমুগ্ধ হয়েছি।
আমার মন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি কখনো মুছে যাওয়ার নয়। সারাক্ষণ তার কথা আমার মনের আঙিনায় ঘোরাফেরা করে। এই মহান জননায়কের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যদিও স্বল্পকালের, মাত্র চার বছরের, এই মুহূর্তে আমি তার সেই পবিত্র স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং তার ও তার পরিবারের নিহত সদস্যদের বিদেহী আত্মার মঙ্গল কামনা করি, তাদের জন্য স্বর্গবাস প্রার্থনা করি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য, যাদের শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত ভালোবাসতেন, এই প্রার্থনা ও প্রত্যাশা করি তারা যেন এই দুঃখজনক মর্মান্তিক ঘটনায় দিশেহারা হয়ে অন্ধকার ভবিষ্যতের পথে না গিয়ে, তাদের দেশকে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার মতো সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি ও সাহস পায়।”
দূতাবাসের দোভাষী শিরাই সানের সহায়তায় মূল জাপানি থেকে অনুবাদ
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সরকারের সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক কমার্শিয়াল কাউন্সেলর (১৯৯৪-২০০০)
বহু পণ্যের গায়ে লেখা থাকে ‘এতে ক্ষতিকারক ডিডিটি নেই’। ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা আশ্বস্ত হই। হয়তো আমাদের বহুজনের কাছেই ডিডিটির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে মশার স্প্রে, শুঁটকি মাছ বা কৃষিফসলে ডিডিটির ব্যবহারের কথা আমরা কমবেশি জানি। ‘ডাই ক্লোরো ডাই ফিনাইল ট্রাই ক্লোরো ইথেন’ বা ‘ডিডিটি’ হলো বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক দূষণের জন্য দায়ী বিপজ্জনক রাসায়নিক।
কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার রাসায়নীকরণের বিরুদ্ধে একটা প্রবল জনভিত্তি বিস্তার লাভ করছে বিশ্বময়। দীর্ঘ করোনা মহামারী, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকট সবকিছু ছাপিয়ে রাসায়নিক কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ এক বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ চার দশক পর বাংলাদেশ ডিডিটিমুক্ত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের বৃহত্তম ডিডিটির মজুদটি ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। প্রায় চার দশক পর নিষিদ্ধ ঘোষিত এই মারাত্মক রাসায়নিক বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর ডিডিটির শেষ চালানটি ধ্বংস করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে ফ্রান্সে যায়। ডিডিটি অপসারণের কাজটি কোনোভাবেই সহজ ছিল না। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত সতর্কতা, নীতিগত প্রশ্ন, অর্থায়ন এবং সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারÑসবকিছু এক কাতারে আসতে প্রায় চারটি দশক লেগেছে। জীবন ও প্রতিবেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই ডিডিটি অপসারণ ব্যবস্থাপনার নেতৃত্ব দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (জিইএফ) অর্থায়নে, বাংলাদেশ সরকার এবং এফএও এর সহ-অর্থায়নে ‘পেস্টিসাইড রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় ডিডিটি অপসারণ ও নিষ্ক্রিয়করণের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।
গণমাধ্যম সূত্র জানায়, ডিডিটি পাউডার নিষ্ক্রিয়করণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকা। ৩৫৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পে সরকারের নিজের খরচ ২১৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বাকি ৭০ কোটি ১০ লাখ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটিজ এবং ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ম্যালেরিয়া নির্মূলে ৫০০ টন ডিডিটি আমদানি করে এবং এর আগের আরও ৫০০ টনসহ এক হাজার টন ডিডিটি দীর্ঘ ৩৭ বছর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের গোডাউনে পড়েছিল। ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয় গ্রিসের একটি প্রতিষ্ঠান। বিশেষ পোশাক ও সতর্কতা অবলম্বন করে এসব রাসায়নিক কনটেইনারে ভরা হয় এবং পরিবহন করা হয়। অপসারণের সময় সমগ্র এলাকাকে রেড জোন বা বিপজ্জনক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। অপসারণ প্রক্রিয়ার পরিচালক গণমাধ্যমকে জানান, বিশেষ জাহাজের মাধ্যমে এই রাসায়নিক সমুদ্রপথে ১২টি বন্দর হয়ে ফ্রান্সে যাবে এবং সেখানে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি মেনে বিশেষ চুল্লিতে এসব নিষ্ক্রিয় করা হবে। বেশ কয়েক মাসের এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সর্বত্র ঝুঁকি ও বিপদ রয়েছে। তারপরও বিশ্ব থেকে বিপজ্জনক ডিডিটির সবচেয়ে বড় মজুদটি অপসারণ করা গেছে।
বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের জন্য এটি একটি গুরুত্ববহ ঘটনা। অবিস্মরণীয় এই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তবে ডিডিটি অপসারণের এই উদাহরণ বাংলাদেশকে আরও বেশি দায়িত্বশীল এবং দায়বদ্ধ করে তুলল। বিশেষত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় রাসায়নিকের ব্যবহার এবং নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে রাষ্ট্রকে এখন থেকেই আরও বেশি সতর্ক ও মনোযোগী হওয়ার বার্তা জানান দিল। ভাবলেই কেমন শিউরে ওঠে চারধার, দীর্ঘ ৩৭ বছর এক হাজার টন ডিডিটির সঙ্গে বসবাস করেছি আমরা। এমনকি এই মজুদ ছিল দেশের উপকূলের এক দুর্যোগপীড়িত ঘনবসতিপূর্ণ শিল্পাঞ্চল চট্টগ্রামে। ১৯৯১ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় চট্টগ্রাম এবং বন্যার পানিতে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে ডিডিটি বিষ। এ ছাড়া কৃষিতে ব্যবহৃত ডিডিটির কারণে আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও শরীরে মিশেছে এই ভয়াবহ বিষ। বাংলাদেশের মতো একটা ছোট্ট আয়তনের দেশে ৩৭ বছর ধরে এক হাজার টন ডিডিটি নিরাপদে মজুদ রাখা সবদিক থেকেই এক জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।
ডিডিটি, অলড্রিন, ডাইএলড্রিন, ক্লোরডেন, এনড্রিন, হেপ্টাক্লোর, মিরেক্স, টক্সাফিন, পিসিবি, হেক্সাক্লোরোবেনজিন, ডাইঅক্সিন ও ফিউরান পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী এই ১২টি মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিককে একত্রে ‘ডার্টি ডজন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ডার্টি ডজন সরাসরি মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির জীবন ও জন্মপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব তৈরি করে, ক্যানসার, ত্রুটিপূর্ণ জন্ম থেকে শুরু করে নানান দুরারোগ্য মরণব্যাধি ও প্রতিবেশগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। মাছসহ জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাবের কারণে ১৯৬২ সালে এনড্রিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে ডিডিটি ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ২০০০ সালে জোহানেসবার্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১২২টি দেশ ডার্টি ডজনের ব্যবহার সীমিত করতে বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০১ সালে স্টকহোম সম্মেলনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশকের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হয়। ১৭১টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও ২০০১ সালের ২৩ মে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং এটি কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ১২ মার্চ। চুক্তির ১৫ বছর পর বাংলাদেশ থেকে ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৮৭৪ সালে ডিডিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তা ম্যালেরিয়া ও টাইফাস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। ১৯৩৯ সাল থেকে কীটনাশক হিসেবে এর ব্যবহার শুরু হয়। আর তখন থেকে ডিডিটির বহুল উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত প্রতি বছর কৃষিক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০,০০০ টন ডিডিটি ব্যবহৃত হতো। কীটনাশক হিসেবে ডিডিটি আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৮ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান পল হারম্যান মুলার। মার্কিন মনস্যান্টো, সিবা, মনট্রোজ কেমিক্যাল কোম্পানি, পেন্নাওয়াল্ট, ভেলসিকল কোম্পানিগুলো মূলত বৃহৎ ডিডিটি উৎপাদনকারী কোম্পানি। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০৯ সালে ভারত ৩,৩১৪ টন ডিডিটি উৎপাদন করে এবং ২০০৭ সালে চীনে ডিডিটি উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা আনা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৫৬ সাল থেকে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। তখন প্রতি বছর ৩ টন কীটনাশক এবং ৫০০ ¯েপ্র ব্যবহার করা হতো। প্রথমদিকে যখন কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো তখন প্রথমত অধিকাংশ কৃষক বিশ্বাসই করতে পারল না উদ্ভিদের রোগবালাই দমনের জন্য বিষ ব্যবহার করা যায়। ক্রমান্বয়ে কৃষির ওপর চেপে বসা এই বিষ মানুষের প্রাণও সংহার করতে থাকল। কৃষিতে বিষের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু আত্মহত্যাই বাড়ল না, বরং এটি আরও নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি তৈরি করে প্রতিনিয়ত মানুষকে আরও বেশি সংকটাপন্ন করে তুলতে লাগল। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে ৮৮২ টাকার কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে মাত্র ৯৮ টাকার কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। বাংলাদেশের মাটিতে হিউমাসের সঙ্গে মিশে গেছে ১২.৫ শতাংশ ডিডিটি, যা ব্রিটেনের তুলনায় পাঁচ গুণ। এই সর্বনাশা বিষের ফলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে জলাশয়সহ স্থানীয় অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য আর মানুষের নানান রোগবালাই বাড়ছে। এই সর্বনাশা বিষের ব্যবহার ১ শতাংশ বাড়ার সঙ্গে কৃষকের চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যাচ্ছে দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে ৯২টি রাসায়নিক গ্রুপের প্রায় ৩৭৭টি বালাইনাশক বাজারজাতকরণের জন্য নিবন্ধনকৃত। প্রায় সব কীটনাশকের প্রয়োগের পর অপেক্ষাকাল তিন দিন থেকে ২১ দিন, কিন্তু বাস্তবতা হলো সকালে কীটনাশক স্প্রে করে বিকেলে বা বিকেলে স্প্রে করে পরদিন জমিন থেকে ফসল তুলে বাজারে বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে শসা, টমেটো, ক্ষীরা বা অন্যান্য ফল, যা আমরা সাধারণত কাঁচা খেয়ে থাকি সেসব গ্রহণের মাধ্যমে সেসব ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশক সরাসরি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ ভাগ আশপাশের জলাশয়ের পানিতে মিশে যায়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েই এক ডিডিটিমুক্ত বাংলাদেশে আমরা আজ নতুন প্রজন্মকে স্বাগত জানাতে পারছি। তবে ডিডিটি অপসারণের এই জটিল প্রক্রিয়া আমাদের আরও কী বার্তা দেয়? কেন বা কাদের কথায় আমরা এমন বিপজ্জনক রাসায়নিক আমদানি ও ব্যবহার করলাম? তথাকথিত সবুজবিপ্লব প্রকল্পের মাধ্যমে ডিডিটির মতো এমন বহু বিপদ আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় শুধু মুনাফার জন্য তৈরি হয়েছে। কোম্পানিগুলো মুনাফার পাহাড় চাঙা করার পর যখন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে এসব চাপিয়ে দেওয়া বাণিজ্য কারবারগুলো চরম ক্ষতি তৈরি করছে, তখন সেসব বন্ধ করতে আমাদের দীর্ঘ সময় লড়াই করতে হচ্ছে। শুধু ডিডিটি নয়, আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা এখনো দখল করে আছে বহুজাতিক কোম্পানি ও এজেন্সির নানামুখী ব্যবস্থাপত্র। মাটি থেকে শুরু করে মায়ের দুধ সর্বত্র মিশে যাচ্ছে বিষ আর প্লাস্টিক কণা। এক ডিডিটি নিষিদ্ধ ও অপসারণে আমরা বহু বছর ও বিপুল বাজেট ব্যয় করেছি। জনগণের টাকায় বিষ কিনে সেই বিষে জনগণের সর্বনাশ করে আবার সেই বিষ তাড়াতে আবারও জনগণের টাকাই গেল। তাহলে আমরা কেন এমন বিষের ব্যবহার শুরু করলাম এই প্রশ্নটি তোলা জরুরি। বিশেষ করে নিরাপদ কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার প্রসঙ্গ যখন আমরা আলাপে তুলেছি বিশ্বময়।
এখনো সময় আছে শুধু ডিডিটি নয়; সব রাসায়নিকের বন্দিদশা থেকেই আমাদের উৎপাদনব্যবস্থাকে মুক্ত করা জরুরি। আর ডিডিটি অপসারণের মতো রাষ্ট্র যেভাবে নীতিগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার করেছে সে রকম সব বিপজ্জনক রাসায়নিক বিষের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সমমনোযোগী হতে হবে। আমরা আশা করব রাষ্ট্র বিপজ্জনক রাসায়নিকমুক্ত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে তৎপর ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার জোরালো করবে। শুধু ডিডিটিমুক্ত নয়, ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত এক নিরাপদ কৃষিভুবনে আমরা সবাইকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষা করছি।
লেখক: লেখক ও গবেষক
কেউ বলছেন- ‘জয় শাহরুখ’, আবার সিনেমা হলেই কেউ চিৎকার করে বলছেন- ‘হিন্দুস্তান কি শান, শাহরুখ খান’। চার বছর ধরে অপেক্ষার পর নতুন সূর্যোদয় শাহরুখের ক্যারিয়ারে। ‘পাঠান’-এর বক্স অফিস রিপোর্ট দেখে নিঃসন্দেহে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন শাহরুখ খান। গতকাল (বুধবার) বিশ্বের প্রায় ৮০০০ স্ক্রিনে মুক্তি পেয়েছে যশ রাজ ফিল্মসের ‘পাঠান’। প্রথম দিন একাধিক রেকর্ড গুঁড়িয়ে দিল পরিচালক সিদ্ধার্থ আনন্দের এই ছবি। প্রথম দিন কেবলমাত্র ভারতের বক্স অফিসেই ৫৩ কোটি টাকা কামাই করেছে এই ছবি।
হিন্দি, তামিল ও তেলুগু সংস্করণ মিলিয়ে মোট ৫৩ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে শাহরুখ খানের ছবি। এর সুবাদেই আমির খানের ‘ঠগস অফ হিন্দুস্তান’-এর রেকর্ড ভেঙে দিল বাদশার ছবি। প্রথম দিনের আয়ের নিরিখে বলিউডি ছবির মধ্যে এতদিন এক নম্বরে ছিল ‘ঠগস অফ হিন্দুস্তান’ (৫০ কোটি), এবার সেই রেকর্ড গেল ‘পাঠান’-এর ঝুলিতে।
শুধু ভারতের বক্স অফিসেই নয়, বিদেশের বক্স অফিসেও শাহরুখ খানের ধুম! ট্রেড অ্যানালিস্ট রমেশ বালা জানিয়েছেন প্রথম দিনই বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে ১০০ কোটির বেশি গ্রস কালেকশন করেছে ‘পাঠান’। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুরে পুরোনো সব বলিউডি ছবির রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন কিং খান। প্রথমদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ মিলিয়ন ডলার কামিয়েছে এই ছবি।
বক্স অফিস বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছিলেন পাঠান-এর প্রথম দিনের কালেকশন থাকবে ৩৫-৪০ কোটির আশেপাশে। তাদের ধারণাতীত পারফর্ম করে চমকে দিলেন শাহরুখ-দীপিকারা।
ফিল্ম এক্সবিটর অক্ষয় রাঠি জানিয়েছেন, ‘পাঠান কেবলমাত্র ইন্ডিয়াতেই প্রথম দিন ৫৩ কোটির ব্যবসা করেছে। ছবির প্রথম শো শেষ হওয়ার আগে থেকে আশ্চর্যজনকভাবে ছবির অ্যাডভ্যান্স বুকিং-এর মাত্রা দেশজুড়ে বেড়েছে। এটা একটা ঐতিহাসিক কামব্যাক, এই প্রত্যাবর্তনটা শুধু শাহরুখের নয়, সার্বিকভাবে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির।’
শুধু ঠগস অফ হিন্দুস্তানই নয়, হৃতিকের ‘ওয়ার’-এর প্রথম দিনের আয়ের রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে ‘পাঠান’। কেবলমাত্র কেজিএফ টু-র হিন্দি ভার্সনের কালেকশনকে অল্পের জন্য পার করতে পারেননি শাহরুখ।
ছবির স্ক্রিনিং শুরুর পর টিকিটের চাহিদা দেখে আরও ৩০০টি অতিরিক্ত শো যোগ করা হয় প্রথম দিন। শাহরুখ ভক্তদের চাপে মধ্যরাতের পরেও থিয়েটারে ‘পাঠান’-এর শো চলছে।
একের পর এক ফ্লপের ভারে জর্জরিত শাহরুখ খান ‘জিরো’র (ডিসেম্বর, ২০১৮) পর লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের দুনিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ তিন বছর পর ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ‘পাঠান’-এর শ্যুটিং শুরু করেন শাহরুখ। ছবির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করতে আরও লম্বা সময় লাগিয়েছেন কিং খান। শাহরুখের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় ছিল ভক্তরা, সমালোচকরা আগেই বলেছিলেন ‘পাঠান’ শাহরুখের ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি হতে চলেছে, প্রত্যাশার পারদ শুরু থেকেই চড়ছিল এই ছবিকে ঘিরে। সেই প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি সফল শাহরুখ, এমনটা বলাই যায়।
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস
গত ১০ বছরে দেশে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে চারগুণের বেশি। বিপরীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যয় কমে অর্ধেকে নামলেও এ খাতের অগ্রগতি খুবই হতাশাজনক। বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজির দাম দেশীয় গ্যাসের চেয়ে অন্তত পাঁচ-সাতগুণ বেশি হলেও আমদানির তৎপরতা যে হারে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি দেশীয় জ্বালানির অনুসন্ধান কার্যক্রম।
গত ১৩ বছরে বিদ্যুতের দাম ১১ আর গ্যাসের দাম বেড়েছে ৬ বার। ধারাবাহিকভাবে দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে এ খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও সরকার সেদিকে যাচ্ছে না। বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। পাশাপাশি দেশের জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন না করে এলএনজি আমদানি করছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার সঙ্গে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। এর পরিণতি ভয়াবহ।’
তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে সরকার। কিন্তু এ জন্য ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা দরকার। এ টাকা সমন্বয় করে গ্যাস-বিদ্যুতের যে দাম হবে তা সোনার চেয়েও দামি হবে।’ তার মতে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার কারণেই লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়ছে। আর এটি চাপানো হচ্ছে ভোক্তার ওপর। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এখন বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ানো হচ্ছে। অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় না করে মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। এর চেয়ে অন্যায় আর কিছু হতে পারে না।
সূত্রমতে, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ২ টাকা ৬১ পয়সা। এখন তা বেড়ে ১০ টাকা ছাড়িয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ১৭৯ শতাংশ বাড়ানোর ফলে ব্যয় আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডিজেলে চালিত বিদ্যুকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গড়ে ৪৩.৪২, ফার্নেস অয়েল থেকে ১৫.৫১, কয়লা থেকে ১২.৭৭, নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সৌরবিদ্যুৎ) থেকে ১২.৬৪, গ্যাসে চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩.৪৬, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২.৬৭ এবং আমদানি করা বিদ্যুতের জন্য ৫.৯৫ টাকা ব্যয় হয়েছে।
বর্তমানে দেশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ১৭.৬২ সেন্ট থেকে ২২.৭১ সেন্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে অর্থাৎ ২২.৭১ সেন্ট দরে ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ১৮.৮৯ সেন্ট। বরিশাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম ১৭ দশমিক ৬২ সেন্ট এবং পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ১৭.২০ সেন্ট।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ার আগে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় গড়ে ২ টাকা বেড়ে প্রায় ১২ টাকায় দাঁড়াবে। তবে খোলাবাজার থেকে আমদানি করে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ালে এ ব্যয় আরও বাড়তে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ১০ টাকার কাছাকাছি। তবে সৌরবিদ্যুতের যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক কমালে দাম আরও কমবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতটুকু উৎপাদন ততটুকু বিল এ শর্তে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চুক্তি হওয়ায় শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেই তারা বিদ্যুৎ পাবে। কিন্তু তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ‘ক্যাপাসিটি পেমেন্ট’ হিসেবে অর্থ পরিশোধ করতে হয় সরকারকে। সৌরবিদ্যুতে কোনো জ্বালানি লাগে না। অর্থাৎ জ্বালানি আমদানির জন্য ডলার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের দাম ক্রমে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদ-ে একটা দেশে চাহিদার তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি সক্ষমতা থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়তি সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। ভুল পরিকল্পনার কারণে প্রয়োজন ছাড়াই একের পর এক বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অতিরিক্ত সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা গুনতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারকে কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়েছে ১৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার পাশাপাশি বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও নবায়নযোগ্য জ¦ালানির ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন সময়ে নানা পরিকল্পনার কথা বললেও তার অগ্রগতি খুব সামান্য।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় বলা হয়েছে, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৮৯ শতাংশ কমেছে। এ উৎস থেকে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে তারা কাজ করছেন। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যে অগ্রগতি, তাতে এ লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে পৌঁছানো নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৯৪২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো ২৩০ মেগাওয়াট। সে হিসাবে মোট বিদ্যুতের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ ছিল ৪.৬ শতাংশ। বর্তমানে দেশে গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে গ্রিডভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ থেকে মাত্র ২৫৯ মেগাওয়াট এবং জলবিদ্যুৎ (২০০৯-এর আগে স্থাপিত) থেকে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। শতকরা হিসাবে এর পরিমাণ ২ শতাংশ। এর বাইরে অফগ্রিড সৌরবিদ্যুতের পরিমাণ ৪১৮ মেগাওয়াট। যদিও অফগ্রিড সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থার ৭০-৮০ শতাংশ অকেজো হয়ে রয়েছে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল হক বলেন, ‘গত ১০ বছরে দেশে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। কিন্তু দেশে সৌরবিদ্যুতের আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। এ খাতে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। তাহলে বিদ্যুৎ জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে।’
গত ১৩ বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে ৪.৭৫ গুণ। এ সময়ে ১৮৫৪০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ গ্রিডে যোগ হয়েছে। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎ এসেছে মাত্র ২৩০ মেগাওয়াট।
জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা বাড়ায় ব্যয় বাড়ছে। ২০০৯ সালে দেশে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করা গ্যাসসহ মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৩৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুটে। কিন্তু গড়ে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে ২৬০০-২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে, গত ১৩ বছরে পাঁচটি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার এবং কিছু কূপ সংস্কারের মাধ্যমে দেশীয় উৎস থেকে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করছে সরকার। পাশাপাশি সরকার খোলাবাজার থেকে বেশি দামের এলএনজি আমদানি করছে।
দেশে এলএনজি সরবরাহে দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের সরবরাহ ক্ষমতা এরই মধ্যে নেমে গেছে ৫০ শতাংশের নিচে। তবু আরও দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তি করতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি এবং বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ এ টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছে।
সূত্রমতে, দেশীয় কোম্পানির উৎপাদিত গ্যাসের খরচ প্রতি ইউনিটে ১ টাকা ২৭ পয়সা। আর দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে উৎপাদিত গ্যাসের খরচ ২ টাকা ৯১ পয়সা। আমদানি করা গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে খরচ প্রায় ৫০ টাকা। বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে এ দাম কমবেশি হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম মনে করেন, আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ব্যয় বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘স্থলভাগে এখনো যে গ্যাস রয়েছে, তার একটি অংশ আমরা আবিষ্কার করে উত্তোলন করছি। বড় অংশের সন্ধান এখনো আমরা করিনি। আরও বেশি অনুসন্ধান করা দরকার। নিজেদের গ্যাস পেলে জ্বালানির দাম এভাবে বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না।’ বিদেশি কোম্পানি ও এলএনজি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে সরকার স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
'বাদশা ইজ় ব্যাক'। বুধবার সারাদিন এমন কথাই বার বার শোনা গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকে বড় পর্দায় দেখেছেন আপামর দর্শক। এক-দু'বার নয়, অনেকে দেখেছেন তিন-তিন বার! কখনো সিঙ্গল স্ক্রিনে, কখনো আবার মাল্টিপ্লেক্সে পপকর্ন খেতে খেতে। পয়সা উসুল করা হুল্লোড়ে মেতেছেন দর্শক, লাভের মুখ দেখেছেন প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ।
শাহরুখ খানের 'পাঠান'-এর প্রথম দিনের ব্যবসার ছবিটা স্পষ্ট। ছবিমুক্তির দিনেই প্রায় ৫৫ কোটির ব্যবসা করে ফেলেছে যশরাজ ফিল্মস প্রযোজিত ছবিটি।
এখনও পর্যন্ত প্রথম দিনে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছিল দক্ষিণী ছবি 'কেজিএফ-চ্যাপ্টার ২'- ৫৩ কোটি ৯৫ লাখ। ছবিমুক্তির দিনে দক্ষিণী মেগা হিটের ব্যবসাকে ছাপিয়ে গেল 'পাঠান'। শোনা যাচ্ছে, বুধবার প্রায় ৫৩-৫৫ কোটির ব্যবসা করেছে ছবিটি। যা ছাড়িয়ে গিয়েছে 'ওয়ার', 'থগস অব হিন্দুস্তান', 'ভারত' ছবির প্রথম দিনের উপার্জন।
প্রতিদ্বন্দীদের পরাস্ত করেই ক্ষান্ত নন 'পাঠান'। নিজের ছবি 'হ্যাপি নিউ ইয়ার', 'চেন্নাই এক্সপ্রেস'কেও হারালেন শাহরুখ। যাদের প্রথম দিনের ব্যবসার অঙ্ক ছিল ৪৪ কোটি ৯৭ লাখ ও ৩৩ কোটি ১২ লাখ।
দীর্ঘ ৪ বছর পরে বড় পর্দায় ফিরেছেন শাহরুখ খান। বলিউডের 'বাদশা'কে নিয়ে অনুরাগীদের উন্মাদনার ঝলক দেখা গিয়েছিল ট্রেলার মুক্তির পরেই। দুবাইয়ের বুর্জ খলিফাতেও শাহরুখের উপস্থিতিতে ট্রেলার প্রদর্শনের সময় ঢল নেমেছিল ভক্তদের। বক্স অফিসে যে ভালো অঙ্কের ব্যবসা করবে 'পাঠান', তার আভাস মিলেছিল অগ্রিম টিকিট বুকিংয়েই। দর্শকের উন্মাদনা দেখে সকাল ৬টা ও ৭টাতেও শো রেখেছিল বড় বড় শহরের একাধিক প্রেক্ষাগৃহ। এমনকি, দর্শকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে মধ্যরাতেও শো চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রযোজনা সংস্থা ওয়াইআরএফ।তবে মুক্তির প্রথম দিন সব হিসেব গুলিয়ে দিল 'পাঠান'। হিন্দি ছবির ইতিহাসে ছবিমুক্তির দিনে 'পাঠান'-এর ব্যবসাই সর্বোচ্চ। ইতিমধ্যে ব্লকবাস্টার খেতাবও পেয়েছে ছবি। আর হবে না-ই বা কেন, এ যে রাজার প্রত্যাবর্তন।
আর্তমানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল সার্ভিসেস ক্লাবের উদ্যোগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পথশিশু ও বৃদ্ধদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।
উক্ত শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অ্যাডভাইজার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আনিসুর রহমান, সোশ্যাল সার্ভিসেস ক্লাবের উপদেষ্টা এবং স্কুল অব বিজনেসের সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল হক এবং ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন।
দুঃস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রমে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তা, ক্লাব সদস্য ও ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দ্বিতীয় মেয়াদ আগামী ২৩ এপ্রিল শেষ হচ্ছে। ১০ বছর পর নতুন রাষ্ট্রপতি পাচ্ছে দেশ। যদিও ২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হবে, কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী দুই মাস আগে অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
সেই হিসেবে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগে বাকি আর ২২ দিন।
এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে নানা জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে কে বসছেন রাষ্ট্রপতির চেয়ারে। বেশ কয়েকজন আছেন আলোচনায়। তবে এদের মধ্যে বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন।
বিস্তারিত পড়ুন রবিবার দেশ রূপান্তরেরর প্রথম পাতায়।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।