
১.
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট গোপালগঞ্জে চলছিল ফুটবল খেলা। ছোট শহরে এ ধরনের আয়োজনে যে রকম উত্তেজনা থাকে, তা যারা দেখেছেন তারা সবাই অনুধাবন করতে পারবেন। মাঠে ২২ জন খেলোয়াড় যে পরিমাণ ঘাম ঝরিয়ে জয় ছিনিয়ে নেন, মাঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দর্শকরা তাদের চিৎকার-প্রতিক্রিয়া আর উত্তেজনায় তার চেয়ে কম ঘাম ঝরান না। এই ক্রীড়ামুখর একটা শহর পরদিনই ভয়ার্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এক স্তব্ধতা ও আতঙ্কের শহরে নিমজ্জিত হবে। যার রেশ বহু দিন পর্যন্ত বহন করতে হবে।
গোপালগঞ্জ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর নিজের শহর, তাই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সেখানকার জনগণের ওপর অন্যরকম চাপ ও আতঙ্ক তৈরি করেছিল। এই বিশেষ দিনটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে গোপালগঞ্জবাসীর ওপর ১৫ আগস্টের ট্রমা নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা হতে পারে। জেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এক দিনের ব্যবধানে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ, সরকারি চাকরিজীবীসহ অনেকের রোষের শিকার হতে হয়েছিল কাউকে কাউকে। মূলত আত্মগোপনেই চলে যেতে হয় সবাইকে।
ওই দিনটির আগে ও পরে জেলা আওয়ামী লীগের অবস্থা নিয়ে আমরা অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে এই প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরেই কাজ সারতে হয়েছে। ওই সময়ে যারা সক্রিয় ছিলেন, তাদের বয়স এবং অনেকের শারীরিক অবস্থার কারণে দেখা করা সম্ভব হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুকে তাদের শৈশব থেকে দেখেছেন এবং তার সান্নিধ্যে রাজনীতি করার সৌভাগ্য হয়েছে এ রকম দুজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগে ও পরের ঘটনা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়। তারা হলেন গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী এমদাদুল হক ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শেখ লুৎফর রহমান বাচ্চু।
২.
শেখ লুৎফর রহমান বাচ্চু জানান, ১৯৭৫ সালে, আমি তখন গোপালগঞ্জ ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ১৪ আগস্ট গোপালগঞ্জ একাদশ আর মাগুরা একাদশের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ ছিল। দুই দলের থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে, মাঠের খেলাটা যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, মানুষ যেন তা উপভোগ করতে পারে, সমস্ত দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। খেলা হয়েছিল চমৎকার। স্টেডিয়ামের কানায় কানায় দর্শকভর্তি। সবাই খুব উপভোগ করেছিল খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য। খেলা শেষে মাগুরা টিমকে আমরা যখন বিদায় দিলাম, রাত তখন প্রায় ১২টা। সে সময় গোপালগঞ্জ থেকে মাগুরা যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল বেশ জটিল। এখান থেকে নৌকায় করে হরিদাসপুর, সেখান থেকে লঞ্চে টেকেরহাট, সেখান থেকে আবার বাসে করে যেতে হবে ফরিদপুর। ফরিদপুর থেকে আবার আরেক বাস ধরে মাগুরা যেতে হয়। তাদের বিদায় দিয়ে গোপালগঞ্জ দলের খেলোয়াড়, দলের কিছু নেতাকর্মী এবং প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা আমরা সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া যখন শেষ করলাম, রাত তখন প্রায় ২টা।
তখন তো বয়স কম, এরপর প্রায় ভোররাত ৪টা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে আমি বাসায় ফিরে ঘুমাতে গেলাম ফজরের আজানের সময়। আর আমার পাশের ঘরেই কয়েকজন খেলোয়াড়ের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। নায়েব আলী নামে এক খেলোয়াড় ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন। তিনি এসে আমাকে ডেকে তুললেন, ভাই ওঠেন রেডিওটা একটু শোনেন। আমি ঘুমের ঘোরে জানতে চাইলাম, বলেন কী হয়েছে, তিনি জবাব না দিয়ে আমাকে হাত ধরে টেনে রেডিওর কাছে নিয়ে গেলেন। রেডিওতে তখন মেজর ডালিমের কণ্ঠ ভেসে এলো। বলল, ‘‘বঙ্গবন্ধু একজন বিট্রেয়ার, জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছেন, বিশ্বাসঘাতককে আমি হত্যা করেছি।’’ বিশ্বাস করতে পারিনি। তারপরও বারবার রেডিওতে ওই একই কণ্ঠ, একই ঘোষণা দিতে থাকল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি প্রায় কাণ্ডজ্ঞানহীন, বুদ্ধিহারা হয়ে গেলাম। বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম, দেখলাম গোপালগঞ্জের রাস্তাঘাটে কোথাও কোনো মানুষ নেই। একজন মানুষও দেখিনি আমি। শুধু কয়েকজন পুলিশকে দেখা গেল। সকাল ১০টা বা সাড়ে ১০টার দিকে আমাদের ক্রীড়া সংস্থার কিছু কর্মকর্তা, মরহুম মন্টু ভাই, তিনি নিজেও অত্যন্ত ভালো খেলোয়াড় ছিলেন, মোহাম্মদ আলী, খায়ের, মুকুল আমার কাছে এসে বললেন, আপনি তো গোপালগঞ্জে আর থাকতে পারবেন না। আর যদি চলে যান, তাহলে এই লোকগুলোর তো কিছু দেনা-পাওনা আছে। তখন আমি বললাম, যারা আমাদের কাছে টাকা পান, তারা যেন স্টেডিয়ামে আসেন। যেমন যারা খাবার সরবরাহ করেছেন, স্টেডিয়ামে চেয়ার সরবরাহ করেছেন, বিভিন্ন সহযোগিতা করেছেন। তাদের ডেকে ডেকে পাওনা মিটিয়ে দিলাম। এরপর আমি তখনকার এসডিও অফিসে গেলাম, এখন যেটা ডিসি অফিসে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তখন দায়িত্ব পালন করছিলেন কাদের সাহেব, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট, তার চেম্বারে। তিনি নিজেই মর্মাহত, কী বলবেন আর কিইবা শুনবেন বুঝতে পারছিলেন না।
আসলে গোপালগঞ্জের সবারই এই অবস্থাই হয়েছিল, একজন লোককেও আমি সেদিন স্বাভাবিক দেখিনি। আকাশটাও সেদিন অন্ধকার হয়েছিল, যেন কাঁদছে। বাতাসে গুমোট ভাব। কেউ কোনো কথাই বলতে পারছিল না। দোকানপাট কিছুই খোলেনি। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ থানার এক পুলিশ অফিসার আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বসল। কোনো কারণ ছাড়াই। তখন বুঝলাম, যারা ভাই বলে ডাকত আজকে তারা চোখ উলটে দিয়েছে। এদের কারও সঙ্গে কথা না বলে, আমি তখন আত্মগোপনে চলে গেলাম। নদীর ওপারে আমার এক বন্ধু, মরহুম আবুল খায়ের, তাদের বাড়িতে চলে গেলাম। তিন-চার দিন পর আবার গোপালগঞ্জে ফিরলাম। তখন যিনি এসডিও ছিলেন, তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাকে অভয় দিলেন। বললেন, আমি যত দিন দায়িত্বে আছি তত দিন আপনাদের কারও অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। তখন সামরিক শাসন জারি হয়ে গেছে। আরেকজন ভদ্রলোক ছিলেন ইন্সপেক্টর আবদুর রহমান, অত্যন্ত চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বললেন, যারা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী, যাদের রাজনৈতিক জীবনে কোনো কালো দাগ নেই, তাদের নিরাপত্তা তিনি দেখবেন। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেকেই ক্ষমতার দম্ভে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। যারা সে রকম নন, তাদের আমরা দেখব। আমি তখন বললাম, পুলিশ যদি আমাদের পেছনে ধাওয়া করে, তাহলে আমরা আর এই দেশে থাকতে পারব না। বরং আমরা ভারতে চলে যাই, সেখানে কিছু একটা করে খেতে পারব। তিনি বললেন, কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। এই ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী সময়ে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি।
এরপর প্রায় এক-দুই বছর সময় পর্যন্ত গোপালগঞ্জে উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। যেটুকু শুরু হয়েছে, তা খুবই ঘরোয়া পরিবেশে, নিজেদের মধ্যে, যাদের সঙ্গে মনের মিল আছে কিংবা বিশ্বাস করা যায় এ রকম কয়েকজন, যেমন ছাত্র ইউনিয়নের কিছু সদস্য আর অন্যরা একসঙ্গে হয়ে কিছু করার চেষ্টা হয়েছে। প্রায় এক বছর পর, দলের শীর্ষস্থানীয়দের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে, ১৯৭৬ সালে প্রথম আমরা কোনো মিছিল করতে পেরেছিলাম। তারপরই পুলিশ মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেপ্তার করে। সেই মিছিল হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে, শওকত চৌধুরীর নেতৃত্বে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, আর্মিরা গোপালগঞ্জ থেকে শওকত চৌধুরী, সিজি মোস্তফা, ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট, কামরুল ইসলামসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কিছু লিফলেট, পোস্টার এসব আসত ভারত থেকে, সেটা আনত মজিবর নামের একজন (এখন প্রয়াত), টুঙ্গিপাড়ার আওলাদ এবং জিল্লুর এ রকম কয়েকজন। খুলনার তেরখাদায় ফুল ভাই নামের একজন আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন, তিনিও নিয়ে আসতেন। সেগুলো আমরা বিভিন্ন জায়গায় বিলি করতাম। আওয়ামী লীগের যেসব নেতা সে সময় ভারতে গিয়ে সে দেশের সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার বিষয়ে। কিন্তু ভারত সরকার তাদের আশ্রয় দেবে বা সহযোগিতা করবে, সে রকম কোনো আশ্বাস দিতে পারেনি। সে কারণে তারা তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। একটা সময় তো ইন্দিরা গান্ধীর পরে যে সরকার আসে তারা জানিয়েই দিল যে এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তারা কোনো আশ্রয় দেবে না। সে সময় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো কর্মকাণ্ডকে নাশকতামূলক কাজ বলা হতো। তখন অনেক নেতাই ভারত থেকে ফিরে এসেছেন। অনেককে পুশব্যাক করা হয়েছে। তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ কর্মী, অনেকে না। পরে তাদের অনেকেই আবার বিএনপিতে চলে গেছেন। এর অর্থ হলোÑ মূল নেতৃত্ব যদি সঠিক নির্দেশনা দিতে না পারে, তাহলে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন আন্দোলন বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।
শেখ লুৎফর রহমান বাচ্চু জানান, ব্যক্তিগতভাবে আমার বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার প্রথম সুযোগ হয়, তিনি যখন আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হয়ে আসেন তখন। এর আগে তো ছয় দফা দাবি দিয়ে তিনি কারাগারে। সারা বাংলাদেশে তখন আওয়ামী লীগের নেতারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মামলার খরচের জন্য চাঁদা তুলেছেন। আমিও সঙ্গে থাকতাম। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ডেই আমি অংশ নিয়েছি। তো মামলা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি গোপালগঞ্জে এলেন। আমরা তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের বলে ছাত্রলীগের কার্যালয় তাকে দিয়ে উদ্বোধনের ব্যবস্থা করলাম এবং আমাদের এক-দেড় ঘণ্টা সময় দেবেন, যাতে করে অন্তত আমাদের সব নেতাকর্মীর মাথায় তিনি একটু হাত রাখতে পারেন। সে সময়ই কিন্তু বঙ্গবন্ধুর একটু স্পর্শ পাওয়া মানে বিশাল ব্যাপার। এটা জীবনের একটা বড় পাওনা, যার মাথায় তিনি একবার হাত রেখেছেন। শুধু ছাত্রলীগের কর্মীদের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য দুই ঘণ্টা সময় বরাদ্দ দেওয়া হলো, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীও সেখানে ঢুকবে না। তখন আমাদের কার্যালয় ছিল সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম জামাল চৌধুরী, তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার ভাই কামালও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাদের ব্যাংকপাড়ার বাসায় ছাত্রলীগের অফিস ছিল। বঙ্গবন্ধু সেখানে এলেন, সবাইকে ডেকে ডেকে কাছে বসিয়ে কথা বললেন। সবার আগে যার সঙ্গে কথা বললেন, তিনি আমার বন্ধু মরহুম মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেন খসরু, তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আগে থেকেই পরিচয় ছিল। আমার সঙ্গেও পরিচয় হলো, আমার সৌভাগ্য, তিনি কয়েকবার আমার নাম ধরে কথা বলেছিলেন সেদিন। সেখান থেকে আমরা মিছিল করে আওয়ামী লীগ অফিস পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দিলাম। পরে তিনি বলেন, তোদের অফিস তো দেখলাম চেয়ার-টেবিল-আলমারির অভাব। এগুলো কেনার জন্য নিজের পকেট থেকে বের করে ২০০ টাকা তিনি আমাদের দেন। এই ২০০ টাকা আমাদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার ছিল।
৩.
পরে আমরা কথা বলতে যাই চৌধুরী এমদাদুল হকের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় এবং রাজনীতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এইটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। আমি যখন প্রাইমারিতেও পড়ি না, আমি তখন একটা পাঠশালায় পড়ি। সে সময় বঙ্গবন্ধু শুধু কলকাতা থেকে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’তে ভর্তি হয়েছেন। তখন তিনি মাঝেমধ্যেই গোপালগঞ্জ আসতেন। তিনি কে, তা তো তখন আমার জানার কথা না। নাসের (আবু নাসের, বঙ্গুবন্ধুর ছোট ভাই, ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরে নিহত) ভাই থাকতেন যে ঘরে, টিনের একটা লম্বা ঘর, ইউ প্যাটার্নের। গোপালগঞ্জে তখন কোনো বিল্ডিং ছিল না, সিনেমা হলটাও টিনের ঘরে। তো নাসের ভাইয়ের কাছে আসতেন তিনি। আমরা থাকতাম তার পাশে। বাসার সামনে একটা কাঠের সিঁড়ি ছিল। সেখানে আমি আর আমার বড় বোন, সে তখন বীণাপাণিতে পড়ত ক্লাস সিক্সে আর আমি তো পাঠশালায়, স্কুলে যাওয়া শুরু করি নাই তখনো, পরেশ বাবুর পাঠশালায় পড়ি। তখনই প্রথম তাকে দেখি।
তারপর পরিচয় হলো ৫৪-এর নির্বাচনে। তিনি প্রার্থী। তার বিরুদ্ধে ক্যান্ডিডেট তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াহিদুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু তো তখন মাত্র শুরু করেছেন, নেতা হিসেবে পরিচিতিটা আসছে মাত্র। সে সময়, আমার বাড়ি তো মানিকদাহ, এখন যে চেহারা আর তখনকার মানিকদাহর চেহারা এক না। ওই সময় যারা আসছে সেখানে, তারা তো এখন আর চিনবে না মানিকদাহ। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে একটা খাল ছিল। আমাদের গ্রামে ঢুকতে হলে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে নৌকায় নামতে হতো। যাতায়াত ছিল একমাত্র টাবুরে নৌকা দিয়ে।
আমার জন্ম তো ব্রিটিশ আমলে, ৫৪-তে আমি তখন সিক্সে পড়ি। তো নির্বাচনের প্রচারে গ্রামে এসে বঙ্গবন্ধু তখন আমাদের বাড়িতে উঠলেন। আমাদের বাড়িটা, এখানে বাদশাহ ভাই, তিনি বঙ্গবন্ধুকে আমাদের বাড়িতে এনে ওঠালেন, চা-নাশতার ব্যবস্থা আগে থেকেই ছিল। ঠিক উনি যখন বাড়িতে ঢুকবেন এর মধ্যেই ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবও এসে উপস্থিত। আমার সম্পর্কের এক চাচা সে ওয়াহিদুজ্জামানের দলের লোক, মুসলিম লীগের, তিনি তাকে নিয়ে আসছেন। তো আমাদের বাড়িতে একটা বড় বৈঠকখানা ছিল, যেটাকে বলা হতো কাছারি ঘর। তো সেখানে দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারে এসে একসঙ্গে চা-নাশতা করলেন। তো চা-নাশতা খাওয়া শেষে ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ভাইজান আপনি যাবেন কোথায়। ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব বললেন, তিনি পশ্চিমপাড়ার দিকে যাবেন। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, ঠিক আছে আপনি ওদিকে যান আর আমি তাহলে উত্তরপাড়ার দিকে যাব। এরপর নির্বাচনের সময় আরও একবার আসছিলেন বঙ্গবন্ধু, তখনো দেখা হয়েছে।
৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগে ও পরের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই সময় তো বাকশাল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তো তখন ঢাকার সার্কিট হাউজ এলাকায় বাকশালের সেন্ট্রাল অফিস করা হয়েছে। আমাকে ডেকে পাঠালেন আবদুল্লাহ মিয়া, বাকশাল অফিসে গিয়ে দেখা করলাম মণি ভাইয়ের সঙ্গে। মণি ভাই আমাকে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। তোফায়েল আমাকে কয়েকজনের নাম সাজেস্ট করতে বলল, আমি বললাম সেটা তো আমি পারি না, সেন্ট্রাল যা করবে আমরা তো সেটা মেনে নেব। তখন তোফায়েল কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে খোঁজখবর জানতে চাইল। তাদের মধ্যে ছিলÑ নওফেল আহমেদ বাচ্চু, লুৎফর রহমান বাচ্চু, রহমান, ন্যাপের নুরুজ্জামান খোকন, কমিউনিস্ট পার্টি থেকে শওকত চৌধুরী আর আবু হোসেন। তো বাকশালের স্ট্রাকচারটা তো ছয়জনের, আমার কাছে এই ছয়জনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল তোফায়েল, তো আমি তো বুঝে গেলাম। হয়তো আমি সেক্রেটারি। তো আমি মণি ভাইকে বলে বাড়ি চলে আসব আর আসার আগে মোল্লা জালাল সাহেবের বাসায় যাব একবার। তো গেলাম ১৩ আগস্ট জালাল সাহেবের বাসায়, চাচি-আম্মার সঙ্গে কথা বললাম। জালাল সাহেব তিন দিন আগে ইসলামিক দেশগুলোর একটা সম্মেলন শেষে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরছেন। পরে শুনেছি ১৪ তারিখ জালাল সাহেব গণভবনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু মোল্লা জালালকে দেখে ৩২ নম্বর ফোন দিয়ে বেগম মুজিবকে সেই সংবাদ দিয়ে বললেনÑ আমরা একসঙ্গে খাব। ওখানে আর কথাবার্তা না বলে বাসায় চলে এলেন মোল্লা জালালকে নিয়ে। তো সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে বাড়ির নিচতলায় দুজন কথা বলতে ছিলেন। এ সময় রাজ্জাক ভাই ঢুকে বঙ্গবন্ধুর কানে কানে কী যেন বললেন। এটা দেখে জালাল সাহেবের মন খারাপ হয়। ফলে মোল্লা জালাল সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন। সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ খাওয়া আর সেটা ছিল তার বাল্যবন্ধু মোল্লা জালালের সঙ্গে।
তো যাক সে কথা।
আমি তো ১৪ তারিখ ভোরে চলে এলাম গোপালগঞ্জ। বাড়ি এসে ঘুমিয়ে আছি। তখন তো এক দিন সময় লাগত আসতে, ১৩ তারিখ মোল্লা জালালের সঙ্গে দেখা করে রওনা দিয়েছি, পরদিন ভোরে বাড়ি পৌঁছেছি। তো আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, সেই ভোরবেলা লাবলু উকিল বাসায় এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললÑ মামা রেডিও শোনেন। আমি বললাম কেন, কী হয়েছে, ও বলল, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। শুনেই আমি ওকে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসছি। কিন্তু পরে রেডিও শুনলাম, তারপর তো জানলাম ঘটনা সত্য। আমি সঙ্গে সঙ্গে গোপালগঞ্জ শহরে চলে এলাম। একদম সব স্তব্ধ হয়ে গেছে দেখলাম। প্রতিবাদ করবে কে, কেউ নেই শহরে।
শুনলে তোমরা আশ্চর্য হয়ে যাবা, তা ডেডবডি নিয়ে এই গোপালগঞ্জের ওপর দিয়ে যখন যায়, তখন এখানে একজন এডুকেশন অফিসার ছিলেন, আমি নিজের কানে শুনছি, মসজিদের সামনে সে বলতেছেন, ওরে আবার হেলিকপ্টারে নিয়ে যাচ্ছে, পোড়ায় দিল না কেন! তার ছেলে শেখ হাসিনার আশীর্বাদে বড় একজন সচিব। তো এই হলো একজন শিক্ষা অফিসারের মন্তব্য। তবে জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে চার দিনের দিন মিলাদ দিয়েছিলাম থানাপাড়ার মসজিদে। কয়েক দিন পর আমরা বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে গেলাম। এসব করতেও তখন লোক ভয় পেত।
আমরা কিছুদিনের মধ্যে মিছিল করেছি। কিন্তু তখন আমরা আরও বড় মিছিল-প্রতিবাদ করতে পারতাম কিন্তু করিনি, সেটা ভুল করেছি। ভয়ও ছিল। সে সময় ছাত্র ইউনিয়ন ভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছে। আমরাও করেছি, তবে আলাদাভাবে। এ কারণে অনেকে অ্যারেস্ট হয়েছে। শওকত চৌধুরী একটা চিঠিসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল, ওই চিঠিতে আমারও নাম ছিল।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে তার প্রতি জানাই অসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি আমাদের জন্য শুধু অম্লান হয়ে আছে তা-ই নয়, তিনি আমাদের হৃদয়ের সত্তায় স্থান করে নিয়েছেন। তিনি সবসময় যেন আমাদের অন্তরেই আছেন। আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়, আমাদের জাতির আত্মসম্মান বোধ ফিরিয়ে দিতে এবং এই জাতিকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।
তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ বক্তা, অত্যন্ত মেধাবী রাজনীতিবিদ ((poet of politics) এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক, যাকে একনামে বিশ^বাসী চিনত। বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল শেখ মুজিবুরের দেশ হিসেবে। ইউনেস্কো (UNESCO) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে দেওয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শুধু আমাদের কাছে কেন, সারা বিশ্বে আজও বাঙালি জাতির পরিচয়। বঙ্গবন্ধুর পরিচয়ে বাংলাদেশের পরিচয়। যেখানে মানুষ এখনো জিজ্ঞাসা করে তোমরা কীভাবে তোমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করলে? এ কথা তো বিশ্বের যেকোনো জায়গায় জানে। আলজেরিয়া যান, কিউবা যান, রাশিয়া যান, পূর্ব ইউরোপের যেকোনো জায়গায় যান। আজকে বঙ্গবন্ধুর স্থান জর্জ ওয়াশিংটন যেমন জাতির পিতা আমেরিকায়, মহাত্মা গান্ধী যেমন ভারতের, সুকর্ণ যেমন ইন্দোনেশিয়ার, হো চি মিন যেমন ভিয়েতনামের, নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনি বাংলাদেশের। তবে বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশেরই নন, সারা পৃথিবীর একজন অনন্য নেতা, একজন বরেণ্য নেতা, তার প্রতি সম্মান দেখানো, তাকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা মানে আমরা নিজেরাই মহিমান্বিত হই, আমরাই তাতে বড় হই। তাকে যতভাবে আমরা দেখব, যত তার জীবন পর্যালোচনা করব, তার কীর্তি যত আলোচনা করব, তার রেখে যাওয়া স্মৃতি আমরা যত আলোচনা করব, ততই আমরা জানতে পারব। তাকে জানা মানেই বাঙালি জাতিকে জানা, ইতিহাসকে জানা, বাঙালি জাতির ঐতিহ্যকে জানা। কারণ এগুলোই তিনি লালন করেছেন সারা জীবন, এগুলো নিয়েই তিনি কাজ করেছেন এবং এরই ফলে বাঙালি জাতির এই জন্মভূমি, স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি।
১৪ আগস্ট প্রায় রাত ১১টার সময় আমি ৩২ নম্বরে আজকের বঙ্গবন্ধু ভবনে তার সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম। কেননা, পরদিন ১৫ আগস্ট সকাল বেলা তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার কথা ছিল।
সেজন্য ছিল চারদিকে সাজ সাজ রব, কীভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে, তার নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা হবে ইত্যাদি। কিন্তু তখন কেউ চিন্তাই করতে পারেনি যে আমাদের মধ্যে এ ঘরের শত্রু বিভীষণরা তার প্রতি তাদের রাইফেল তাক করে আছে। লক্ষ্য করে আছে তার হৃদয়ের দিকে এবং কেমন করে তাকে এই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে সেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। অবশ্য ১৪ আগস্টের আগেও মাঝেমধ্যে শোনা যেত নানা রকম গুঞ্জন; শোনা যেত যে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা বোধহয় বিঘিœত হচ্ছে, যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ইত্যাদি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই সময়টা এবং তার আগেও দেখেছি বিভিন্ন সময় যখনই নিরাপত্তার কথা উঠত বঙ্গবন্ধু এমনভাবে কথা বলতেন, তার ধারণা ছিল এবং অত্যন্ত সবলভাবেই বলতেন সে কথা আমাদেরকে যে ‘কোনো খাঁটি বাঙালি কখনই আমাকে হত্যা করতে পারে না’।
কথাটি কিন্তু তিনি ঠিকই বলেছিলেন। কোনো বাঙালি তো তাকে হত্যা করেনি। কোনো বাঙালি তার বুকের দিকে তার রাইফেল কিংবা মেশিনগান তাক করেনি। যারা তাকে হত্যা করেছে সেই হত্যাকারীরা, সেই মার্ডারারগুলো, সেই নরকীটগুলো তারা সবই ছিল বিদেশের চর, সব পাকিস্তানি এবং অন্য বিভিন্ন দেশের চর। এরা তো বাঙালি নয়, তাদের ভাষায় তারা বাংলাদেশিও নয়, তারা মুক্তিযুদ্ধের শত্রু, বাঙালির শত্রু, বাংলাদেশের শত্রু।
১৫ আগস্ট সকালে এই জঘন্য হত্যাকা-ের ঘটনা শোনার পরপরই আমি প্রথমে টেলিফোন করলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধরলেন এবং বললেন ‘তওফিক’ আমিও শুনেছি, এই ঘটনা তো মনে হয় সত্য। এখন কী করা যায়। আমি বললাম আপনি নির্দেশ দিন, আপনি তো উপরাষ্ট্রপতি। তিনি বললেন আমি চিন্তা করে দেখি। তার পরেই আমি তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবকে টেলিফোন করলাম, তারপর মনছুর আলী সাহেবকে, কামারুজ্জামান সাহেবকে। এদের সবার সঙ্গেই কথা বলি। এরা সবাই একেবারে যেমন স্তম্ভিত তেমনি হতভম্ব হয়ে গেছেন এবং প্রত্যেকের কণ্ঠে কান্নার সুর, কান্নার স্বরের মতোই কেউ প্রকাশ্যে কাঁদতে পারছে না অথচ বুক ফেটে কান্না চলে আসছে। চোখে পানি আসতে গিয়েও পানি আটকে যাচ্ছে। এমন একটি অবস্থা এরকম কষ্টের মধ্যে থাকতে থাকতেই বিভিন্ন জায়গা থেকে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। মোটামুটি জানা গেল যে, এরাই করেছে এবং তখন নামগুলোও জানতে পারলাম। এর কিছুক্ষণ পর আমার কেমন ভেতর থেকে মনে হচ্ছিল এরা হয়তো আমাদের অন্যদেরও হত্যা করবে কারণ তারা তো জানে আমরা বঙ্গবন্ধুকে কতখানি কত কাছের এবং কে কী করতাম।
এছাড়াও ওই সময়টাতে, বাংলাদেশে আজকে যে ৬৪টি জেলা, এই জেলা বঙ্গবন্ধু প্রথম সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি প্রত্যেকটি সাব-ডিভিশনকে একটি করে জেলা ঘোষণা করে প্রত্যেকটি জেলার জন্য একজন করে জেলা গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন। ১৩ আগস্ট থেকে জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ চলছিল। আগের রাত্রে আমি প্রশিক্ষণেও গিয়েছিলাম বেইলি রোডে, এখনকার যে ডিএফপি সেখানে অনেকগুলো অফিস ছিল। সেখানে আমাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলছিল। এসব কাজকর্মের মধ্যে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, কখনো অন্যদিকে তাকানোর সময় হয়নি।
১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা- বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস হত্যার পূর্বে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুনর্গঠিত ও পুনর্বাসিত হয়ে অতি দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছিল। কৃষি এবং ভৌত অবকাঠামো ছিল সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। নিহত, আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার, কয়েক লাখ লাঞ্ছিত মা-বোন সবাই তাকিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। তিনি তাদের নিরাশ করেননি। খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, কৃষি পুনর্বাসন, শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃষ্টি দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যথাসাধ্য উন্নতি সাধন করেছিলেন।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরসহ দেশের বড় বড় ব্রিজ, জাহাজ, রেলওয়ে এবং প্রধান সড়কসমূহ পুনর্নির্মাণ করে যোগাযোগব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এসব উন্নয়ন পরিকল্পিতভাবে করার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩-৭৮ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বিমুখী : পুনর্বাসন এবং বিনিয়োগ; যাতে দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন করা যায়। অর্থনৈতিক কর্মকা- দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষিক্ষেত্রে সব উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করেন এবং সেই সঙ্গে কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন। পাশাপাশি শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দিয়ে প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন এবং পরে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। ১৯৭৫-এ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭.০০ শতাংশে পৌঁছতে পেরেছিল। যা তারপর জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া আর কোনো সরকার পারেননি। ’৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছিল। পরে পাকিস্তানপন্থি সরকারগুলো (খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া) অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করে। কতিপয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্র সহায়তা করে একটি নব্য ধনী গোষ্ঠী সৃষ্টি করা হয় এবং রাজনীতিতে সুযোগসন্ধানী-সুবিধাবাদীদের আমদানি করা হয়। রাজনৈতিক দিক থেকে এটিই ছিল সবচাইতে কালো অধ্যায়। বাংলাদেশকে সবাই চিনত সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে। রাজনীতি ছিল হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে যুক্ত হলো ৩রা নভেম্বর, ওই একই বছরে। সেদিন কারাগারে আটক, যেখানে মানুষকে সবসময় নিরাপত্তা প্রদান করা হয়, সেই নিরাপদ আশ্রয়ে, সরকারের হেফাজতে ছিলেন যে চার জাতীয় নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আমাদের রাষ্ট্রের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথম অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং আরেক মন্ত্রী কামারুজ্জামান সাহেব, যারা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেনÑ সেই চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয় অত্যন্ত নির্মমভাবে। আমার মনে আছে, এখনো খুবই স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার কয়েক দিন পরেই আমাদের সবাকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, নাজিমউদ্দিন রোডে, সেইখানে আমরা ছিলাম। আমরা বলছি এই জন্য যে, আমাদের তখনকার সরকারের প্রায় প্রধান চরিত্র যারা, অর্থাৎ খলনায়ক নন যারা, ওই ঘাতক দলের বাইরে যারা, সরকারের পক্ষে, অর্থাৎ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে এবং বাংলাদেশের সত্যিকারের সন্তান যারা, তাদের ষড়যন্ত্রকারীরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, আমি সবচেয়ে বেশিদিন কারাগারে ছিলাম (প্রায় দুই বছর)। পরবর্তী সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা অনেক হয়েছে, হয়রানি হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষের বিরাট সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা তার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। জনগণের বিশাল দাবির মুখে ১৯৮১ সালে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জননেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তিকে একত্রিত করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আবারও আসীন হয়। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কর্মযজ্ঞ। পরবর্তী সময়ে দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ‘দিন বদলের সনদ’কে সামনে রেখে জনগণের রায় নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসে। শুরু হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ। বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের প্রিয় নেত্রী, দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বিপুল জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে, তিনি বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আধুনিক, উন্নত, গণতান্ত্রিক ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলবেন।
‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’
লেখক : বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা
আমাদের ইতিহাসচর্চার দিকে তাকালে একটা সংকট, সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সংগ্রাম কবে থেকে শুরু হয়েছে, তার ধারাবাহিক ইতিহাস নিয়ে সংকট রয়েছে। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে, তারা মনে করে ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর থেকে এখানকার বাঙালিরা পাকিস্তানের প্রতি তাদের মনোভাব পাল্টে ফেলে এবং আন্দোলন শুরু করে। তাই তাদের কাছে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ। আমি ইতিহাসের মানুষ হিসেবে মনে করি, ঘটনা ঘটার জন্য সময় প্রয়োজন। সেই বিবেচনায় এখানে স্বাধীনতার মতো ঘটনা ঘটতে সময় লেগেছে মাত্র ২০/২৫ বছর। তবে একটা জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা মাত্র ২০ বছরে তৈরি হওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর তেমন একটা প্রমাণ পাওয়া যায় না কেননা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি তৈরি হওয়ার পর প্রথম হরতাল হয়েছে ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দ্বন্দ্বটি জন্মলগ্ন থেকেই ছিল।
জন্মলগ্ন থেকে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার উৎস কী? আমি মনে করি আলাদা করে রাষ্ট্র গঠনের ভাবনা শুরু হয়েছে ১৯৪০ এর দশকের শুরু থেকেই। অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাব থেকেই এ ভাবনা শুরু হয় এবং এর ওপর ভিত্তি করে মুসলিম লীগ বাংলায় রাজনীতি শুরু করেছিল। এখন যারা মুসলিম লীগ করেছেন, তারা কী ধরনের মানুষ ছিলেন? তারা মূলত কৃষকনির্ভর ছিলেন। ১৯০৯ সালের পর যে কোনো নির্বাচনে জয়লাভ করতে গেলে কৃষকদের সমর্থন সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল। কারণ, তারাই ছিল তখনকার সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী। তাদের ভোটই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করত। সে কারণে চাইলেও কেউ কৃষকবিরোধী ধারণা পোষণ করতে পারত না। আমরা মুসলিম লীগ বলতে জিন্নাহকে বুঝি। কিন্তু তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের নেতা। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্ব বলতে যাদের বোঝানো হয়, তাদের মধ্যে একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে এসেছেন, সেই পরিস্থিতি অনুধাবন করলে তার মুসলিম লীগ করার যৌক্তিকতা বোঝা যায়। কংগ্রেস ছিল মূলত জমিদার এবং উঁচুতলার মানুষদের দল। তারা হয়তো ভালো লোক হতে পারেন, কিন্তু তারা ঐতিহাসিক কারণেই কৃষকের স্বার্থবিরোধী অবস্থানে ছিলেন। কিছুতেই এই দুটো রাজনৈতিক ধারার মিল হওয়া সম্ভব ছিল না। তারপরেও মিল হওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটা প্রচেষ্টা ভেঙে দিয়েছে দিল্লিকেন্দ্রিক কংগ্রেস। তারা পূর্ববঙ্গের মানুষদের নিয়ে একসঙ্গে রাজনীতি করার পক্ষপাতি ছিলেন না।
পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হতে থাকল কবে থেকে? মূলত ১৮৫৭ থেকে ১৯০৫Ñ এই সময়কালের মধ্যে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক সচেতনতা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে, পূর্ববঙ্গের মানুষদের মধ্যে এ সচেতনতা তৈরি হয়। আর পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে তাদের বৈশিষ্ট্য আলাদা ছিল। পশ্চিমবঙ্গ ছিল কলকাতার বাবুসমাজের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এই বাংলা বাবুবলয়ের বাইরে ছিল। ঠিক একইভাবে অতীতেও আমরা আর্য বলয়ের মধ্যে ছিলাম না। বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে সবচেয়ে বেশি কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে এ বাংলাতে। যদিও ১৭৭০ সালে দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। কিন্তু বিদ্রোহটাকে টেনে নিয়ে গেছে পূর্ববাংলার মানুষ। ১৭৬০ সালে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে তা কিন্তু আর থামেনি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়েছে এবং তারই সর্বশেষ পর্ব হলো বাংলাদেশের উত্থান। এই সময়ে এখানকার মানুষ অনেক বেশি সংঘবদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে জঙ্গিত্ব তৈরি হয়েছে এবং তারা সশস্ত্রভাবে প্রতিহত করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। এই রাজনৈতিক সমীকরণ আমাদের ইতিহাসে থাকে না। আমরা শুরু করতে চাই ১৯৪৭ সাল থেকে। এই সময় থেকে যেহেতু পাকিস্তান বিরোধিতা শুরু হয়েছে, তাই আমরা এ সময়কালকে বেছে নিতে চাই। কিন্তু প্রকৃতঅর্থে সাধারণ মানুষ সবসময়ে তার বিরোধিতা করেছে, যে তার স্বার্থবিরোধী অবস্থানে গিয়েছে। এ কারণে বঙ্গবন্ধুকে ভালোভাবে পাঠ করা উচিত। তার আত্মজীবনী পড়ে দেখলে বোঝা যায়, যারা সাধারণ জনগণকে নিপীড়ন করছে, তাদের দাবিয়ে রাখতে চাচ্ছে, তিনি তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নিচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু যখন দেখলেন কংগ্রেস হিন্দু জমিদারদের পক্ষ নিচ্ছে, তখন তিনি এর বিরোধী অবস্থান নিলেন। এখানে কিন্তু ধর্ম মুখ্য বিষয় নয়। বরং মুখ্য বিষয়টি হলো নিপীড়ন। ১৯৪৯ সালে যখন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সভা করতে গেলেন, সেই সভা না করতে দেওয়ার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অবস্থান নিয়ে বললেন যে সভা হবে। যে কারণে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা হলো। এ ঘটনাগুলো বাদ দিয়ে আপনি যদি রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিচার করতে চান, তাহলে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। ১৯৫২ সালেই কি আমরা স্বাধীনতার কথা ভাবলাম? ১৯৪৭ সালে জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে পাকিস্তান তৈরি করলাম, আর মাত্র পাঁচ বছরেই আমরা স্বাধীনতার কথা ভাবলাম? এ ধারণাগুলোর উৎস পাকিস্তানবিরোধিতা থেকে। আমরা মনে করেছি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানেই পাকিস্তানবিরোধিতা। বস্তুতপক্ষে, শেখ সাহেবের রাজনীতি আর সাধারণ মানুষের রাজনীতির ঐকতান হচ্ছে, অত্যাচারীর বিরোধিতা করা। অত্যাচারীর চেহারায় যারা এসেছে, তিনি এবং জনগণ তার বিরুদ্ধেই লড়াই করেছে। পাঠক যদি সংহত রাজনৈতিক অবস্থান অন্বেষণ করতে যান, তাহলে দেখতে পাবেন সশস্ত্র সামাজিক প্রতিরোধই এর উৎস। ১৭৬০ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে কৃষক সমাজ। তারাই বঙ্গভঙ্গ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
১৮৫৭ সালে কলকাতা নিশ্চুপ থাকলেও কৃষকরা কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এখন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সিপাহি বিদ্রোহে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে সর্বভারতীয় কৃষক সমাজ। অর্থাৎ কৃষকরা ঔপনিবেশিক আমলে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী চরিত্র ধারণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সামাজিক আন্দোলনের পর্যায় তৈরি হয়েছে, ধীরে ধীরে তা সামাজিক প্রতিরোধে পরিণত হয়ে রাজনৈতিক প্রতিরোধের পর্যায়ে পৌঁছায় এবং সর্বশেষ তা একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘটায়। এরই ধারাবাহিকতা ধরে এগোলে দেখা যাবে যে ১৯৩৭ সালে মানুষ মুসলিম লীগ এবং কৃষক প্রজা পার্টিকে বেশি ভোট দিয়েছে। আবার ১৯৪০-৪৭ এর মধ্যে বাংলার প্রায় সমস্ত ভোট পাওয়া দলটিই মাত্র একটি কেন্দ্রে জয়লাভ করা দলে পরিণত হয়েছিল। এর মূল কারণ, কৃষকরা যখন দেখেছে এই দলটি কৃষকের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তখন তারা ভোট দিয়েছে। আবার কৃষকের স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার রাজনীতি ভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই সমীকরণ বাদ দিয়ে আমরা শুধু ১৯৪৭ পরবর্তী ইতিহাসকে তুলে ধরতে চাই। এটা একটা বড় ধরনের ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এটা পরিত্যাগ করে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতাকেই বিবেচনা করা উচিত।
এ কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ বলল, আলাদা রাষ্ট্রের স্থলে একটি রাষ্ট্র হবে। তার বিরুদ্ধে জনগণ ক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। এ বিষয়ে জিন্নাহ সাহেব খুব বাজে একটা যুক্তি দেখালেন যে টাইপিংয়ের ভুল হয়েছে। জিন্নাহ সাহেব এটা কী করে বলেন, যখন ১৯৪০-৪৬ পর্যন্ত কলকাতা, ঢাকায় মিছিল-মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে চলবে। আবুল হাশিম সাহেব তো তখন ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ নামে একটা ইশতেহার পর্যন্ত ছাপিয়ে ফেলেছেন। ১৯৪৬ সালের এ ঘটনার প্রভাব শেখ সাহেবসহ অনেক তরুণের ওপর পড়েছিল। অথচ এই ইতিহাস আমরা অনেকেই পর্যালোচনা করতে না চেয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরের সময়কেই বেছে নিতে চাই। প্রকৃতঅর্থে এটা যারা করেন, তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে গ্রহণযোগ্য করতে চান এবং তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাশীল। আমি তো মনেই করি না পাকিস্তান নামে কোনো রাষ্ট্র হয়েছিল। আমার মতে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল অনেক আগে। এর মধ্যে পাকিস্তান ছিল একটি চাপিয়ে দেওয়া বিষয়, যেটা বেশিদিন টিকতে পারেনি। আমি মনে করি, দুটো আলাদা রাষ্ট্রকে জোর করে পতাকা লাগিয়ে এক করা হয়েছিল। তার পরিণতিতেই ১৯৪৮ সাল থেকে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। তাই শেখ সাহেবকে এই বিদ্রোহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। শেখ সাহেব ছিলেন এই বিদ্রোহের একজন মুখপাত্র। তিনি ভদ্রলোকের রাজনীতি করেননি, করেছেন বিদ্রোহের রাজনীতি। তিনি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি না করে মাঠের রাজনীতি করেছেন। এটাই তার ধারাবাহিকতা।
আমি নিজে গবেষণা করে দেখেছি যে কৃষক যখন ভোটাধিকার পেয়েছে, তখন তারা সবচেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। তারা লড়াই করে যে ক্ষমতা দেখাতে পারেনি, ভোটাধিকার পাওয়ার পরে সে ক্ষমতা দেখাতে পেরেছিল। ইংরেজদের কৃষিনীতি দেখলে বোঝা যায় যে তারা কৃষককে পুঁজি করতে চেয়েছিল। তারা ১৯১১ এর পরে কলকাতার ওপর হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সালে দুটি রাষ্ট্রের চিন্তা প্রাধান্য তৈরি করেছিল আর ১৯৪৬ সালে সেটা জিন্নাহ ধ্বংস করলেন। ১৯৪৭ সালে যৌথ বাংলার আওয়াজ উঠল আর এটাকে ধ্বংস করল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের প্রভাবাধীন বঙ্গীয় কংগ্রেস। আসলে তারা চাপে পড়ে ভেবেছিল যে এই কৃষকদের অধীনে থাকা যাবে না। তাই যারা ভেবেছে যে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের সূচনা হয়েছে, তারা মস্ত বড় ভুল করেছে। এটা অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। যখন যৌথ বাংলার স্বপ্ন মার খেয়ে গেল, তখন মুসলিম লীগের কিছু নেতৃত্ব এ স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা নেয়। তাদের ‘ইনার গ্রুপ’ বলা হতো। আমি এদের প্রধান নেতা মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। সেখানে তিনি বলেছেন, তারা সেই সময় গোপন সভা করতেন এবং তাদের ধারণা ছিল এ রাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক নেতা হবেন গোপালগঞ্জের লম্বা লোকটা। এই ইতিহাসকে বাদ দিয়ে শুধু ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই বিভ্রান্তিকর। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত মূল্যায়ন তো দূরে থাক, বরং তাকে ইতিহাসেই প্রান্তিক করে তোলা হয়।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, শিক্ষক ও লেখক
আপাত সাদামাটা হোটেলটা যতই রাস্তার ওপরে হোক, শতকরা একশো জনের মধ্যে হলফ করে বলা যায় পথচলতি অন্তত আটানব্বই জনেরই তা চোখে পড়বে না। অথচ জায়গাটা কলকাতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র শিয়ালদায়। রাত্তির-দিন এখানে শহর জেগে থাকে। কাছেই কলকাতার সবচেয়ে বড় হোলসেল কোলে মার্কেট। দূরদূরান্ত থেকে ট্রেনে করে মাছ ও সবজি বিক্রেতারা দলে দলে রাত ভোর কোলে মার্কেটে নিজের নিজের পণ্য নিয়ে ভিড় জমান। অত জীবন্ত বাজার খুব কম দেখেছি। এ অঞ্চলের পোশাকি নাম বৈঠকখানা। লোকশ্রুতি, কলকাতার আদি যুগে জব চার্নক এখানকার কোনো এক বটগাছের নিচে বসে হুঁকো খেতে খেতে বৈঠক করতেন নেটিভদের সঙ্গে।
এক চক্কর পুরো এলাকাটা পায়ে হেঁটে ঘুরলে জানা-অজানা কত কত আখ্যান চোখের সামনে ভেসে উঠবে। কুতুব সরকারের নামে যে মসজিদটা তার বয়েস অনেক দিন আগেই একশো বছর পার হয়ে গেছে। এক পা হাঁটলেই দপ্তরিদের পুরনো মহল্লা। কলকাতা বইপাড়ার সঙ্গে এই দপ্তরিদের সম্পর্ক বহুদিনের। বই বাঁধাইয়ের কর্মীরা অধিকাংশই মুসলিম। দেশভাগের পর দপ্তরিদের অনেকেই এখান থেকে পূর্ববাংলায় চলে গেছেন। একে একে দেখে নিতে পারেন কাশিমবাজার রাজাদের বাড়ি অথবা ব্রাহ্ম নেতা কেশব সেনের সমাধি।
শিয়ালদা ফ্লাইওভারের আশপাশে প্রচুর হোটেল, রেস্তোরাঁ। নয়া অর্থনীতি কলকাতাকেও বদলে দিয়েছে। নিউ টাউন সল্টলেক দক্ষিণ কলকাতায় ঝাঁ চকচকে যত নতুন নতুন হোটেল গড়ে উঠেছে ততই মøান হয়েছে শিয়ালদার হোটেলপাড়া। অথচ একদিন এখানকার একাধিক হোটেল বিদেশি ট্যুরিস্ট ও ডিপ্লোম্যাটদের কাছেও ছিল বিপুল জনপ্রিয়। এখানেই মহল, ব্যারন। আরও কত কত নাম। ব্যারনের ইলিশ মাছ খেতে ছুটে এসেছিলেন স্বয়ং আমেরিকার হেনরি কিসিঞ্জার। পঞ্চাশ ষাট সত্তর দশকের শুরু অবধি এইসব হোটেলের ছিল রমরমা। এখানকার এক হোটেলেই বিয়ে করে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম ও তখনকার নামকরা গীতিকার, সুরকার কমল দাশগুপ্ত। শান্তি নিকেতন বোর্ডিংয়ে তাদের বিয়ে ও সংসার পাতা নিয়ে সে সময় কম বিতর্ক হয়নি।
মুশকিল হচ্ছে ব্যারন, মহল, শান্তি নিকেতন বোর্ডিং তবু চোখে পড়ে। কিন্তু অবিভক্ত বাংলার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যে হোটেলে তৈরি হয়েছিল সে একেবারেই লোকজনের চোখের আড়ালে থেকে গেছে। ইতিহাস সত্যিই বড় রহস্যময়। কত অখ্যাত বিষয় সে মনে রাখে। আবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সে নীরব থাকে। শিয়ালদার ‘টাওয়ার লজ’-কে ইতিহাস একেবারেই মনে রাখেনি। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতির বড় এক মাইলফলক ঘটেছিল এই আপাত ম্যাড়মেড়ে হোটেলটিতেই।
টাওয়ার লজ-কে লোকে আজ জানে কলকাতা শহরের সস্তায় মদ খাওয়ার ঠেক বলে। সন্ধ্যে হতে না হতেই স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেই মনে হবে কোনো এক নিষিদ্ধ গোপন ডেরায় ঢুকছেন। সস্তা মদের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠবে। বড় ঘরের ভেতরে অসংখ্য লোক। অধিকাংশই সম্ভবত মফস্বলের। এক আধ গ্লাস খেয়ে ছুটবে ট্রেন ধরতে। কেউ জানেনই না ১৯৫৪ সালে এই হোটেলে একসঙ্গে বেশ কয়েকটা দিন কাটিয়ে গেছেন তৎকালীন পূর্ববাংলার রাজনীতির দুই নক্ষত্র চরিত্র মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সাধারণ লোকের আর কী দোষ! হোটেল কর্তৃপক্ষ, আমাদের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, বাংলাদেশ দূতাবাসের লোকজন, এমনকি শতবর্ষে শেখ সাহেবের নামে যারা সকাল বিকেল জয়ধ্বনি দিচ্ছেন তারাও প্রায় কেউই এমন এক ইতিহাসের আঁতুড়ঘর নিয়ে চুপচাপ। শেখ মুজিবুর রহমানের কলকাতা পর্ব নিয়ে কিছু লেখালেখি হচ্ছে। ইসলামিয়া কলেজ, বেকার হোস্টেল, লীগ রাজনীতি, ১৯৪৬-এ গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এসব ইদানীং নতুন করে আলোচনায় আসছে। স্বয়ং শেখ সাহেবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও কলকাতা নিয়ে দীর্ঘ এক অধ্যায় আছে। টাওয়ার হোটেলে ভাসানীর সঙ্গ নিয়ে এক আধটা লেখায় কিছুটা ছুঁয়ে গেছে মাত্র। তার পেছনে একটা কারণ অবশ্য থাকতে পারে। ১৯৫৪ সালের পর থেকে আজ অবধি টাওয়ার লজের মালিকানা অন্তত চারবার বদল হয়েছে। কয়েক মাস আগে টাওয়ার লজ আবার মালিকানা বদলেছে। নতুন মালিক ঐতিহ্যশালী টাওয়ার লজের নামও বোধহয় পাল্টে দিয়েছেন। ফলে পাকাপাকি ভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ইতিহাসের অতীব এক সন্ধিক্ষণের মাইলফলকটি।
১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানী তখন ইউরোপে। শান্তি আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক হয়ে লন্ডন, প্যারিস, স্টকহোমে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে পশ্চিম ও পূর্বের দ্বন্দ্ব ক্রমবর্ধমান। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে পূর্ববাংলার জেলায় জেলায়। মওলানা ভাসানী তখন প্রধান সেনাপতি ও শেখ মুজিবুর তার বিশ্বস্ত সেনানায়ক।
মুর্শিদাবাদের মীর জাফরের পরিবারের ছেলে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানের মসনদে বসেই ঘোষণা করলেন ইউরোপে ঘুরছেন ঘুরুন দেশে ফিরলেই এয়ারপোর্টে গুলি করে মারা হবে মওলানা ভাসানীকে।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে। পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আর বাধ্য হয়ে ইউরোপ থেকে ফিরে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন মওলানা। টাওয়ার লজ অস্থায়ী নিবাস। সেখানে দুই বাংলার নামি অনামিরা ছুটে আসছেন ভাসানীর কাছে। বঙ্গবন্ধুকে গণআন্দোলনের চাপে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানের শাসকরা। জেল থেকে বের হয়েই মুজিবুর রহমান ছুটলেন করাচি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করে মওলানা ভাসানীর ওপর থেকে পাকি শাসকদের অন্যায় আদেশ ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি নিয়ে। পাশাপাশি তিনি সোহরাওয়ার্দীকে অনুরোধ করলেন অন্য রাজবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিতে।
বস্তুত সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া পছন্দ করেননি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তা মুখের ওপর বলেও ছিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে। শেখ সাহেবের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার বিরুদ্ধপক্ষের লোকজনও স্বীকার করেন সবসময়। যে শেখ সাহেব চিরকাল মুখের ওপর কথা বলতে ভালোবাসতেন। রাখঢাক গুড়গুড় কলেজ জীবন থেকেই মুজিবুর রহমানের অপছন্দের।
করাচি পর্ব শেষ করে ঢাকায় ফেরার পর পরই আওয়ামী মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খানকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সোজা দমদম এয়ারপোর্টে নেমে সরাসরি চলে আসেন টাওয়ার লজ-এ। দীর্ঘ সময় ধরে লীগের তিন নেতা ভাসানী, মুজিব ও আতাউর রহমান মিটিং করেন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে। এখন যে যাই বলুন, অন্তত ১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানীর অগাধ আস্থা ছিল তরুণ নেতা শেখ মুজিবের ওপর, তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। টাওয়ার লজ-এ সেদিন কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তা আজ আর জানা সম্ভব নয়। তবে আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক করা যে জরুরি তা নিয়ে সম্ভবত ওই লজেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মওলানা ও মুজিবুর রহমান।
প্রথম দিনের মিটিংয়ের পরে আরও কয়েক দিন মুজিব ও ভাসানী নানা বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেছিলেন তা স্পষ্ট হয়, ১৯৫৫ সালের ৪ এপ্রিল ভাসানীর শেখ সাহেবকে লেখা এক চিঠিতে। মওলানা ভাসানী লিখছেন, ‘প্রিয় মজিবর রহমান, আমার দোয়া সালাম সকলে গ্রহণ করিও। আগামী ১১ই জুন ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভা ডাকবে। আমি সম্ভবত তার আগের দিন ঢাকা পৌঁছে যাব।’
ওই কাউন্সিল সভায় এজেন্ডার দ্বিতীয় পয়েন্ট ছিল আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করা। এর থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে টাওয়ার লজ-এ মুজিবুর রহমানের সবুজ সঙ্কেত পেয়েই মওলানা ভাসানী ঢাকা ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। তা প্রথম জানতে পারেন শেখ সাহেবই। এরকমই পারস্পরিক নির্ভরতা ছিল ভাসানী-মুজিবের মধ্যে।
অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের চিহ্নমাত্র আজ মাথা খুঁড়লেও টাওয়ার লজ-এ কেউই পাবেন না। আমাদের চমৎকার ইতিহাস বোধ সে সময়ের সব দলিল দস্তাবেজ বাতিল কাগজের বান্ডিল মনে করে নষ্ট করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে টাওয়ার লজের স্মৃতি কি কোনোভাবেই আর সংরক্ষণ করা যায় না!!
লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা,
লেখক ও কলামনিস্ট
বঙ্গবন্ধুর জীবন তিন কারণে আলাদা। প্রথমত, তিনি ছিলেন বাঙালির প্রথম মাটি ও মানুষের নেতা, যিনি সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এর আগে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রথম বাঙালি নেতা ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন একটি প্রাদেশিক সরকারের প্রধান। সিরাজুদ্দৌলা থেকে শুরু করে বাকি সবাই অন্য অঞ্চলের ছিলেন। এজন্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে পরিচিত হলেও তার সময়কার মানুষ তাকে ‘মুজিব ভাই’ বলেই ডাকতেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে চিনিয়েছেন। তার কারণেই বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে চিনেছে। বাংলাদেশে নামের পাশে বঙ্গবন্ধু নামটি চিরদিন থাকবে। এই দুটি বিষয় একজন বাঙালির কাছে গর্বের। তৃতীয় বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই লজ্জার। যার হাত ধরে একটি জাতি স্বাধীন রাষ্ট্র পেল, যিনি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই জাতিই তাকে সপরিবারে হত্যা করল!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে আমি এক দিন ইন্টারন্যাশনাল টেলি কমিউনিকেশন ইউনিয়নের প্রধান টি মিলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। আমি তার রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করতেই সোজা জিজ্ঞাসা করলেন, যড়ি how could you do? (তোমরা কীভাবে তাকে হত্যা করতে পারলে)। আমি তখন লজ্জিত ও বিব্রত ছিলাম। কোনো উত্তর আমার ছিল না। তার ওই প্রশ্নটি আজও আমায় ভাবায়। অথচ যারা এই হত্যায় জড়িত, তারা ছিল বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭২ সালে আবার লন্ডনে গেলেন, তখন তার হোটেলের রুমের দরজার দায়িত্বে ছিলেন মেজর ডালিমের শাশুড়ি। তিনিই ঠিক করতেন বঙ্গবন্ধুর রুমে কে যাবেন আর কে যাবেন না। তার শ্বশুর রফিকুল ইসলামও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ। আর সেই মেজর ডালিমই তাকে হত্যা করল! আরও লজ্জার হলো সেই হত্যাকারীদের দূতাবাসে চাকরি দেওয়া। যেটা আমাদের জন্য ছিল চরম অস্বস্তিকর। সবাই জেনারেল জিয়াকে এজন্য দোষারোপ করে। কিন্তু এ কথা কেউ বলে না যে, এরশাদ সাহেবও তাদের মেয়াদ বাড়িয়েছিলেন। চাইলে এরশাদ তো তাদের বিচার করতে পারতেন বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। এরশাদের কি এখানে কোনো দায় নেই?
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় সাক্ষাৎ ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। এই ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে আমি গর্বিত। আমার সঙ্গে আরও দুজন বাংলাদেশি কূটনীতিক এর সাক্ষী। আমি ব্রিটেনের বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করি। আমরা সেখানে ছয়-সাতজন বাঙালি ছিলাম। পাকিস্তান সরকার যখন বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির ঘোষণা দেয়, তখন আমার মন বলছিল তিনি সরাসরি লন্ডনে আসবেন। এর কারণ হলো, পাকিস্তান তাকে সরাসরি ভারত বা সৌদি আরব পাঠাবে না। আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর তিনি একবার লন্ডনে গিয়েছিলেন। ৮ জানুয়ারি ভোর ৪টার দিকে ব্রিটেন সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হলো, কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে আসছেন। আমাদের হাতে সময় কম। যে যেখানে ছিলাম সেখান থেকে সোজা বিমানবন্দরের দিকে রওনা হলাম। তাকে যে সংবর্ধনা দিতে হবে সেই চিন্তা কারও মাথায় নেই। আমাদের মনে তখন কাজ করছিল এক অন্য রকম অনুভূতি।
আমি গাড়ি চালিয়ে যখন বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন শুধু একটা ছবিই চোখের সামনে ভাসছিল। আর সেটা হলো বঙ্গবন্ধু, আমাদের মুজিব ভাই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার পরদিন আমরা জানতে পারি যে বঙ্গবন্ধু নিখোঁজ। কিন্তু কোথায় আছেন তা নিশ্চিত না। ওই দিন রাতে পাকিস্তান বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তাও আমরা ব্রিটেনের বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জেনেছিলম।
ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফে ৩০ মার্চ ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে সাংবাদিক সায়মন ড্রিং একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে তিনি গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। তখন আমরা ঢাকার বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাই। তবে তিনি বঙ্গবন্ধুর কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
আমাদের মনে প্রশ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু কোথায়? একটি অসমর্থিত সূত্র জানাল, তিনি আমাদের লোকদের কাছেই আছেন। কিন্তু সেটাও অতটা বিশ্বাসযোগ্য না। এখন যদি আমরা প্রচার করি যে তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন অথচ তিনি পাকিস্তানিদের হাতে, তাহলে বড় বিপদ। পাকিস্তানিরা তাকে মেরে ফেলে আমাদের ওপর দায় চাপাবে। তাই নিশ্চিত হওয়ার আগে তার সম্বন্ধে কোনো খবর প্রচার হতে দেওয়া যাবে না। এরই মধ্যে একটি পত্রিকামারফত জানতে পারলাম তিনি পাকিস্তানে আছেন। আমিসহ বেশ কয়েকজন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তারা মুজিবনগর সরকারের পক্ষে অবস্থান নিই। এরপর দীর্ঘ লড়াই চলল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কেউ স্বচক্ষে দেখেননি। এবারই প্রথম আমরা ও বিশ্ববাসী তাকে দেখব। গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় করছিলেন বিমানবন্দরে। সবাই সেই মানুষটিকে দেখার জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন। যিনি একটি দেশ এনে দিয়েছেন। যার ওপর বিশ্বাস রেখে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন। কোটি কোটি মুসলমান রোজা রেখেছেন, হিন্দুরা উপোস থেকেছেন। আজ সেই ‘মুজিব ভাই’ সবার সামনে আসবেন। তাকে সবার আগে আমরা দেখব এ কথা ভাবতেই চোখে পানি এসে গেল। বঙ্গবন্ধু সকাল ৬টার দিকে বিমানবন্দরে নামলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালাম। সবার চোখে পানি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্থির। তার সঙ্গী ছিলেন ড. কামাল হোসেন।
ওই দিন ছিল শনিবার। ব্রিটেনের সাপ্তাহিক ছুটি। তাই সে দেশের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথ চোকার্সে (প্রধানমন্ত্রীর ছুটি কাটানোর বাংলো) অবস্থান করছিলেন। এজন্য তিনি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে পারেননি। হিথ দুপুর নাগাদ এসে তার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধুর দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতেই হয়। একটি হলো তার সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য। যেটার খসড়া করেছিলেন রেজাউল করিম নামের এক কূটনৈতিক আর চূড়ান্ত করেছিলেন ড. কামাল হোসেন। মাত্র দেড় পৃষ্ঠার সেই লিখিত বক্তব্যে তিনি বিশ্ববাসীকে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেশকে গড়ে তোলার জন্য তিনি বিশ্ববাসীকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পেতে সহায়তার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আরেকটি হলো সাক্ষাৎ শেষে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানানোর সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথ বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ির দরজা নিজ হাতে খুলে দিয়েছিলেন। বিশ্বের অন্য কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এমন সম্মান পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। এই সম্মান শুধু বঙ্গবন্ধুর ছিল না, এটা ছিল সমগ্র বাংলাদেশের।
বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল চমৎকার। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পররাষ্ট্র দর্শন হবে সুইজারল্যান্ডের মতো’। তিনি কারও পক্ষে বা বিপক্ষে ছিলেন না। এজন্য জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনে (ন্যাম) বাংলাদেশের সদস্য হওয়া। মূলত তার পররাষ্ট্রনীতি ছিল সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলা। তবে যেহেতু রাশিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তাই রাশিয়ার প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা দুর্বলতা ছিল। এটাকে অনেকটা কৃতজ্ঞতা বলা চলে। আর ভারত ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও তার ছিল অন্যরকম সম্পর্ক। এসবের পরও তিনি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে ও বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে বিশ্ব মুসলিম সংস্থায় (ওআইসি) তিনি যোগ দেন।
বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ নেওয়ায় ভারত ও রাশিয়া হয়তো কিছুটা মন খারাপ করেছিল বলে আমর মনে হয়। কিন্তু তিনি তাদের এই বলে বুঝিয়েছিলেন, ইন্দোনেশিয়াও সেক্যুলার রাষ্ট্র হয়েও ওআইসির সদস্য। তাই আমরাও হচ্ছি। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। এভাবেই তিনি ভারত ও রাশিয়াকে পক্ষে এনেছিলেন। বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য হওয়ায় অনেক লাভও হয়েছিল। এত বড় একটা মুসলিম সংস্থায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করেছিল।
আমার দীর্ঘ কূটনৈতিক ক্যারিয়ারে ১৯৭৪ সালকে মনে হয়েছে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কূটনৈতিক বছর। ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ লাভ করে। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়। এটা খুব সহজ ছিল না। কারণ এর আগে চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান করায় বাংলাদেশকে ভেটো দিয়েছিল। ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম জাতিসংঘে কেউ বাংলায় ভাষণ দেন। এই দুটি বড় আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য হওয়ায় বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন দেশে সফর করেন। বিশ্বনেতারাও বাংলাদেশে আসেন। তাদের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি সাহায্য চান। এই বছরের ১৬ মে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আমি তখন দিল্লিতে দায়িত্ব পালন করছিলাম। এ ছাড়া ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে ব্রিটেন সফর করেন। তখন তিনি আমাদের সঙ্গেও দীর্ঘ সময় দিয়েছেন। আমাদের তিনি পররাষ্ট্র ব্যবস্থাকে জোরদার করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার একটি সাধারণ ছেলে বিশ্বনেতার কাতারে পৌঁছেছিলেন। অথচ ওই সময়ে বাংলাদেশেই অনেক বড় নেতা ছিলেন। ভাসানী তো আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিই ছিলেন। তাকে টপকে বঙ্গবন্ধুর এত উঁচুতে ওঠার কারণ হলো তিনি মানুষের কথা বুঝেছেন। জনগণকে যে কথা তিনি দিয়েছিলেন তাতে অটল থেকেছেন। কিন্তু ভাসানী সেটা পারেননি। ভাসানী আইয়ুব খানের প্রতিনিধি হয়ে চীন সফর করেছেন। চীন থেকে ফিরে আইয়ুব খানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সর্বদা আপস করেছেন। ১৯৭০ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বন্যার অজুহাতে ভাসানী নির্বাচন বর্জন করলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটা করেননি।
বঙ্গবন্ধুর একটি কূটনৈতিক দর্শন এখানে তুলে ধরতে চাই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এ পর্যন্ত রেকর্ড করা ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এ ঝড়ের কারণে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। সারা বিশ্বের সাংবাদিকরা এই ঘূর্ণিঝড় কাভার করতে আসেন। তখন পাকিস্তানের নৌবাহিনী ছিল করাচিতে। উদ্ধারকাজে নৌবাহিনীর খুব প্রয়োজন ছিল। সিঙ্গাপুর বন্দর থেকে ব্রিটেনের নৌবাহিনী উদ্ধারকাজে যোগ দিলেও পাকিস্তানের নৌবাহিনী আসেনি।
বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের দেখিয়ে দিলেন যে আমরা কীভাবে অবহেলিত, বঞ্চিত। অথচ পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানি পণ্য পাট বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয়। আর সেই অর্থ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান উন্নত হচ্ছে। তিনি সাংবাদিকদের বললেন, তোমরা দেখো, আমাদের সাইক্লোন সেন্টার নাই, সরকারি স্কুল-কলেজ নাই। অবকাঠামো ব্যবস্থা নেই। আমরা পাকিস্তানের একটি কলোনি মাত্র। এমন দুর্যোগেও নৌবাহিনী আমাদের পাশে নাই। তাহলে আমাদের অধিকার কোথায়? এভাবেই তিনি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বৈষম্য তুলে ধরলেন। তিনি সবাইকে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দেখার জন্যও অনুরোধ জানালেন। সাংবাদিকরাও তার অনুরোধ রাখলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর এমন একচেটিয়া বিজয়ের মূল কারণও ছিল সেই ঘূর্ণিঝড়। তিনি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমাদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমাদের নিজেদের এক হতে হবে। জনগণ ফুঁসে উঠল। তাদের মুজিব ভাইকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করল। তার ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন দেশ স্বাধীন করল। নতুন রাষ্ট্রকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজে হাত দিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন শেষ করে দিল তার খুনিরা, যার খেসারত আজও বাংলাদেশ ও তার জনগণকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এখনো বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নামের পাশে লেখা আছে একটি কলঙ্ক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও কূটনীতিক, সাবেক সচিব,
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালিতে। গণভবনের রান্নাঘরের স্টোরকিপারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। এই সুবাদেই ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেন মোশাররফ। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ঠিক আগের দিন ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় গণভবনে জাতির পিতাকে সর্বশেষ দেখেছিলেন গণভবনের এই কর্মচারী। তবে ওইদিনই যে শেষ দেখা হবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। সেদিনও প্রতিদিনের মতোই বঙ্গবন্ধুকে স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে দেখেছেন গণভবনের ওই কর্মচারী। দেখেছেন পাইপ টানতে, লেকের পাড়ে হাঁটতে।
সেদিন গণভবন ত্যাগ করার আগে গণভবনের কর্মচারীদের এক দারুণ সারপ্রাইজ দিয়ে অবাক করে যান বঙ্গবন্ধু। নিজের কয়েকটি ছবিতে অটোগ্রাফ দিয়ে কন্ট্রোলার সুবেদার মেজর আবুল খায়েরকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, এই ছবিগুলো ওদের দিয়ে দিস। গণভবনের আরও কয়েকজন কর্মচারীর মতো বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ দিনের শেষ অটোগ্রাফযুক্ত একটি ছবির মালিক হন স্টোরকিপার মোশাররফ। তার কাছে এই ছবি এখন অমূল্য সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর হাতের শেষ ছোঁয়া জড়ানো ছবিটি আজও যত্নে রয়েছে মোশাররফের কাছে। প্রায় ২০টি বছর ছবিটি অনেকটা লুকিয়েই রাখতে হয়েছিল মোশাররফকে। তাই ছবিতে কিছুটা ফাঙ্গাস পড়েছে। ছবিটি দেখিয়ে দেখিয়ে প্রবীণ মোশাররফ হোসেন তার ছেলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সোয়েব-উর-রহমানকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের স্মৃতিজড়িত নানা গল্প শোনান।
এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতর্ষে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দেশ রূপান্তরের এই প্রতিবেদকের কাছে বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফযুক্ত ছবিটি পাওয়ার গল্প বলেছেন মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। ছবির গল্পের সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, গণভবনে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে দেখেছেন সেসব অনেক ঘটনাও। সেদিনের তরুণ মোশাররফ আজ প্রবীণ। রোগে ভুগে অনেকটাই কাতর। কথা বলতেও কষ্ট হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিটুকু প্রকাশ করার সময় একটুও যেন কষ্টবোধ হয়নি তার। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসার টান বোঝাতে গিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘ধর্ম-কর্ম করি বলে আমার ঘরে কোনো ছবি টানানো নেই। তবুও দুটি ছবি টানানো আছে। একটি বঙ্গবন্ধুর হাতের অটোগ্রাফযুক্ত সেই ছবি, আরেকটি আমার মায়ের ছবি। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে দেখেছেন তার স্মৃতিচারণ করে গণভবনের স্টোরকিপার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘চাকরি করাকালীন বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা পেয়েছি তা কখনো ভোলা যাবে না।’
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টও ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পাঠানো দুপুরের খাবার গণভবনে বসেই খেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ওইদিনও অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে দুপুরের খাবার পরিবেশনের কাজে মোশাররফও ছিলেন। ওইদিন বিকেলের ছবি পাওয়ার ঘটনাটিই এখন চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তার কাছে। তিনি বলেন, সেদিনটি ভীষণ আনন্দেরও ছিল। দেশের রাষ্ট্রপতি কর্মচারীদের নিজের অটোগ্রাফযুক্ত ছবি দিলেন। আর
ঠিক পরের দিনটাতে, ১৫ আগস্টই এই ছবি হয়ে উঠল চির-বেদনার। মোশাররফ বলতে থাকেন, ‘বঙ্গবন্ধু নেই, তার হাতের শেষ ছোঁয়া, শেষ স্মৃতি রয়ে গেল আমার কাছে। ১৫ আগস্ট যখন খুনিরা গণভবনে ঢুকল, শেষ স্মৃতিটুকু লুকিয়ে রাখলাম। যেন সেটা তাদের নজরে না পড়ে। পরে বাড়ি এসে বাড়ির দলিলপত্রের মধ্যে যত্ন করে ছবিটা লুকিয়ে রাখি।’
দায়িত্ব স্টোরকিপারের থাকলেও গণভবনে আগত অতিথিদের আতিথেয়তা-আপ্যায়নের দেখভালের দায়িত্বও ছিল মোশাররফ হোসেনের। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে বসবাস করলেও অফিস করতেন গণভবনে। সেই সুযোগে প্রায় তিন বছর খুব কাছ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। শুধু দেখাই নয়, চেনা-জানা, বঙ্গবন্ধুর অন্তরাত্মা বোঝা, ভেতরের মহানুভবতা বোঝার সুযোগ হয়েছে। সেই বোধ থেকেই মোশাররফ দাবি করে বলেন, ‘ধনী-গরিব সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তার কাছে ছিলেন এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর কাছে কে রাজা, কে প্রজা তার কোনো ভেদাভেদ দেখিনি।’
স্মৃতিচারণায় স্টোরকিপার মোশাররফ আরও বলেন, দেখা হলেই বঙ্গবন্ধুর প্রথম কথা, ভালো আছিস? খেয়েছিস? ওই খায়ের ওদের ঠিকঠাকভাবে দেখাশোনা করিস? বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে তুই শব্দটিই সবচেয়ে আপন মনে হতো। আমি যতদিন দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে, সবাইকেই তুই বলে সম্বোধন করতে। দুই একজনের ক্ষেত্রে তুমি বলতে শুনেছি। সে হোক বয়স্ক হোক তরুণ। একদিন গণভবনের লেকের পাশে হাঁটতে গিয়ে সুঠাম দেহের হারুন নামে গণভবনের এক কর্মচারীকে দেখেন বঙ্গবন্ধু। কাছে ডেকে তাকে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোর নাম কী? হারুন জবাবে তার নাম বলেন। বঙ্গবন্ধু পাল্টা প্রশ্ন করেন, তোর বাড়ি কোথায়? হারুন বলেন ফরিদপুর। ওখানে কোথায়? মধুপুর। তুই এখানে চাকরি করিস কেন? তোর যে শরীর-চেহারা তোর তো আর্মিতে চাকরি করার কথা। আরেক দিন বিকালে গণভবনের কর্মচারী রেজাউল নামে একজন বঙ্গবন্ধুকে চা দিচ্ছিলেন। এ সময় রেজাউলকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোর চেহারা মলিন কেন? উত্তরে রেজাউল বলেন, স্যার বেতন হয় না তিন মাস। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোলার আবুল খায়েরকে ডেকে পাঠান এবং জানতে চান ওদের বেতন হয় না কেন? খায়ের বলেন, জটিলতা আছে। বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ বলেন, আমি কিচ্ছু বুঝি না একদিনের মধ্যে বেতন হওয়া চাই। মোশাররফ বলেন, একদিন বাদেই বেতন হয়েছে। ঘটনাগুলো বলার কারণ হলোÑ বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা ছিলেন যার দৃষ্টিভঙ্গি ধনী-গরিব, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই তার চোখে সমান ছিল।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের একটি ঘটনা বলতে গিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, ১৯৭৪ সালের ১ মার্চ আমি বিয়ে করি। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের কোনো একদিন, তারিখ ঠিক মনে নেই। দুপুর বেলায় বঙ্গবন্ধু যখন খেতে বসলেন তখন বিয়ের কথা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিই। অবশ্য আমার সহকারী কন্ট্রোলার সুবেদার কাজী হাসানুজ্জামানের কথামতো বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দেওয়া হয়। সহকারী কন্ট্রোলার যখন বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে বঙ্গবন্ধুকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন আমি তখন ওই রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। বিয়ের কথা শুনেই বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন। জানতে চাইলেন কোথায় বিয়ে করছিস? বউ কী করে, শ্বশুর কী করে এমন অনেক প্রশ্ন? উত্তর দেওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমদকে ডেকে বললেন, ওকে এক হাজার টাকা দিয়ে দে। আর আমাকে বললেন, ‘তোর বউকে একটা বেনারসি শাড়ি ও একটা ঘড়ি কিনে দিস এ টাকায়।’ এই হলো বঙ্গবন্ধু। মোশাররফ বলেন, বঙ্গবন্ধুর কথামতো বউকে বেনারসি শাড়ি কিনেও দিয়েছি। চাকরি থাকাকালীন অনেক রাষ্ট্রপতি দেখেছি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো আর কাউকে দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসায় রকমফের দেখিনি।
স্মৃতিচারণ করতে করতে মোশাররফ আবারও পঁচাত্তরের ১৪ আগস্টে ফিরে যান। বলেন, বঙ্গবন্ধুর খাবারে সবসময়ই দেশি মাছ থাকত। পাতলা ডাল ছিল তার পছন্দের। বঙ্গবন্ধুর খাওয়া শেষে বেঁচে যাওয়া ওই ডাল কে খাবে তা নিয়ে গণভবনের কর্মচারীদের মধ্যে রীতিমতো লুকোচুরি খেলা হতো। সেই ডাল এতই সুস্বাদু ছিল, সবারই পছন্দ ছিল ওই পাতলা ডাল। আর নাস্তায় সমুচা একটু বেশিই পছন্দ ছিল বঙ্গবন্ধুর। মোশাররফ আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ছোট্ট জয়কেও (সজীব ওয়াজেদ জয়) মাঝে মাঝে গণভবনে নিয়ে আসতেন বঙ্গবন্ধু। গণভবনের ভেতরে পশ্চিম পাশের দক্ষিণ ওয়ালের সঙ্গে ময়ূরের ঘর ছিল। সেখানে জয়কে নিয়ে গিয়ে ময়ুর নাচ দেখাতেন বঙ্গবন্ধু।
১৫ আগস্ট ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখি গণভবনের বাউন্ডারি ঘেঁষে ট্যাঙ্ক দাঁড়ানো। কিছুই বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ বাদে রেডিও ছেড়ে প্রথম এ খবর পাই। বেলা ১০/১১টা নাগাদ খুনি মেজর ডালিম ও মোসলেমউদ্দিন গণভবনে প্রবেশ করে দলবল নিয়ে। বিভিন্ন রুমে তল্লাশি করে আমাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে আমাদের পরিচয় জানতে চায়। গণভবনের কর্মকর্তারা সবাই সবার পরিচয় দিলে খুনির দল আমাদের ছেড়ে দেয়। তবে আমিসহ আরও দুই একজনকে দুইমাস নজরবন্দি করে রাখে। পরে বঙ্গভবনে চলে যাই। ওখানে আর চাকরি করিনি।
লেখক : সাংবাদিক
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে সিমিত চন্দ্র (১২) নামের এক স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার (৭ জুন) ভোরে ওই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বেলগাছা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এক কিশোরকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সিমিত চন্দ্র বেলগাছা গ্রামের মানিক চন্দ্র ড্রাইভারের ছেলে। অভিযুক্ত কিশোর (১৬) একই গ্রামের প্রদীপ চন্দ্রের (দর্জি) ছেলে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আর সাঈদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের গীতা সংঘ অনুষ্ঠান দেখতে যায় সিমিত ও তার বড় ভাই। সিমিতকে অনুষ্ঠানস্থলে রেখে বাড়িতে ফেরে তার বড় ভাই। পরে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে সিমিতের সঙ্গে অভিযুক্ত কিশোরের কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনায় সিমিতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ওই কিশোর। পরে তাদের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের গর্তে সিমিতের মরদেহ পুতে রাখে। অনুষ্ঠান শেষে সিমিত বাড়িতে না ফিরলে স্বজনরা তার খোঁজে বের হয়। অভিযুক্ত কিশোরকে সিমিতের বিষয়ে জিজ্ঞাস করলে সে অসংলগ্ন আচরণ করে। পরে তার বাবা প্রদীপ চন্দ্র তাদের পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের একটি গর্তে সিমিতের মরদেহ দেখিয়ে দেন। বুধবার ভোরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে।
আটক কিশোরের স্বীকারোক্তিতে সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ বলেন, অভিযুক্ত কিশোরের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। এ নিয়ে সিমিতসহ অনেকেই ওই কিশোরকে খোঁচা দিত। গত রাতে সিমিত ওই কিশোরের সাথে এ নিয়ে আবারও খোঁচা দিলে সে সিমিতের গলা চেপে ধরে। এত শ্বাসরোধ হয়ে শিশুটি মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত কিশোর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনা স্বীকার করেছে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।