
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন - শামসুজ্জামান খান
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : আমিনুর রহমান সুলতান
ফোকলোরবিদ ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের সম্পদনায় প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা তিনটি গ্রন্থ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন। তিনটি বই-ই ব্যাপক পাঠকপ্রিয় ও সমাদৃত হয়েছে। বই তিনটি সম্পাদনার অভিজ্ঞতা নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন আমিনুর রহমান সুলতান
আ. সু : আজ এসেছি মুজিববর্ষ উপলক্ষে আপনার সঙ্গে কথা বলতে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থের সম্পাদনার সঙ্গে আপনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, সে প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। এ বছর প্রকাশিত হলো আমার দেখা নয়াচীন । আমরা আগের গ্রন্থ দুটি যখন পড়েছি, তখন দেখেছি ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন : অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে আমি ও বেবী মওদুদ পাণ্ডুলিপির সম্পাদনা, প্রুফ দেখা, টীকা লেখা, স্ক্যান ছবি নির্বাচন ইত্যাদি যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করি (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। কারাগারের রোজনামচার ভূমিকায় লিখেছেন : এই লেখাগুলো ছাপানোর জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে শামসুজ্জামান খান, বাংলা একাডেমির ডিজি সার্বক্ষণিক কষ্ট করেছেন। বারবার লেখাগুলো পড়ে প্রুফ দেখে দিয়েছেন। তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। তার পরামর্শ আমার জন্য অতি মূল্যবান ছিল। তার সহযোগিতা ছাড়া কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে সম্পাদনা প্রসঙ্গে আপনার নামটি এভাবে এসেছে। এই কাজের সঙ্গে আপনি কীভাবে যুক্ত হলেন?
শামসুজ্জামান খান: প্রধানমন্ত্রী ভূমিকা অংশে আমার কথা বিশেষভাবে লিখেছেন দুটো বইতেই। এরপর আমরা বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় বইটিরও সম্পাদনা সম্পন্ন করেছি। সে বইটির নাম ‘আমার দেখা নয়াচীন’।
আ. সু: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থ দুটি লিখেছেন জেলে থাকার সময়। কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থটিতে তার জেলে থাকা সময়ের দিনলিপি পাওয়া যায়। এ বই দুটির পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার, সংরক্ষণের ইতিহাস ও প্রকাশের যেসব অজানা তথ্য রয়েছে সে সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।
শামসুজ্জামান খান: কীভাবে এই কাজের সঙ্গে আমি যুক্ত হলাম সে বিষয়টি দিয়েই শুরু করি। ২০০২ সালের শেষের দিকের কথা; বেবী মওদুদ (বর্তমানে প্রয়াত) সাংবাদিক ছিলেন, তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিশিষ্ট বন্ধু, আমাদের খুব প্রিয়ভাজন (মানে ছোট বোনের মতো। বেবী মওদুদ আমাকে বলল, জামান ভাই, বঙ্গবন্ধুর কিছু পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে, বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এটা নিয়ে কাজ করছেন, আমিও এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। মাননীয় শেখ হাসিনা চাইছেন এ কাজের সঙ্গে আপনিও যুক্ত হোন, যেহেতু আপনি ছাত্রলীগ করেছিলেন, শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে আপনার কলেজজীবন থেকেই বন্ধুত্ব ছিল। আপনি আমাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক যে অবস্থা ও অবস্থান বেশ ভালো বুঝতে পারবেন। সে কারণে আমাদের সঙ্গে আপনিও যুক্ত হয়ে কাজ করলে ভালো হয়। আমি বললাম, বঙ্গবন্ধুর পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে, এটা তো আনন্দের কথা, সেই বইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করা গৌরবের বিষয়। এই সৌভাগ্য কজনের হয়?
আমি তার কাছে গেলাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলের নেত্রী। প্রথম গিয়েছিলাম বিরোধী দলের নেতার সরকারি বাড়িতে, তিনি তখন সেখানে ছিলেন। এ বিষয়ে কথাবার্তা হলো। আমি সানন্দে রাজি হলাম। তিনি বললেন, ‘এই পাণ্ডুলিপি এত দিন পর পেয়ে আমরা দুই অসহায় বোন কান্নায় বুক ভাসিয়ে দিয়েছি। পরে ভেবে দেখেছি কান্না করে তো লাভ হবে না। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া এসব অতিমূল্যবান সম্পদ যদি তার উত্তরাধিকারী হিসেবে জাতির কাছে তুলে ধরতে না পারি, তরুণ প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যেতে না পারি, তাহলে তো তা আমাদের দায়িত্বে অবহেলা বলে গণ্য হবে। সেজন্যই আমরা এ কাজটা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শুরু করেছি। প্রথমে আমরা দুই বোন শুরু করেছি, পরে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও দায়িত্বশীল লেখক এবং ইতিহাসসচেতন সাংবাদিক বেবী মওদুদকে যুক্ত করেছি। কাজটির শুরুতে আমরা আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করি এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ; এর সামগ্রিকতা, ঐতিহাসিক পটভূমি এবং যথাযথভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করার জন্য এ কাজে আমরা ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত করব। এজন্য আমরা বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমেদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুনকে উপদেষ্টা করে কাজ শুরু করি। তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শামসুল হুদা হারুন আমৃত্যু নিয়মিতভাবে আমাদের সম্পাদনা পরিষদের সভায় উপস্থিত থেকেছেন।
আমরা কাজটা জোরালো ও নিবিড়ভাবে করতে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে বিরোধী দলনেতা শেখ হাসিনা যখন সুধাসদনে উঠে এলেন, তখন কাজ গতি পেল। কাজের শুরুতে আমরা পাণ্ডুলিপি কীভাবে পাওয়া গেল জানতে চাইলাম।
আ. সু: মানে পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের ইতিহাস বা ঘটনাটা জানতে চাইলেন?
শামসুজ্জামান খান: হ্যাঁ। পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের ইতিহাস দুই পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বের উদ্ধারের ইতিহাস হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি কিংবা সামান্য কিছুকাল আগে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কিছু লোক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে এসে বলে, বাচ্চু লোগো কো সুকুল মে পাঠাও, মানে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাও। ওরা স্কুলকে, সুকুল বলে। উনি ভাবতে লাগলেন হঠাৎ কেন ওরা এটা বলছে? তো রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি তো জানেন, রেডিওতে শুনেছেন, পত্রিকাতেও দেখেছেন, পাকিস্তানিরা বলতে চাইছে এখানে আর কোনো সমস্যা নেই, স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান। তো স্বাভাবিক অবস্থা দেখানোর জন্য তো স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত এগুলো চালু দেখাতে হয়। আর এজন্যই বেগম মুজিবের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর তাগিদ দিচ্ছিল। বেগম মুজিব রাজনীতিসচেতন তীক্ষè বুদ্ধির মানুষ ছিলেন। তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল চমৎকার। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ভাবলেন জেলখানায় থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন এবং তার তিন-চারখানা ছোট ছোট এক্সারসাইজ বুক বত্রিশ নম্বর বাড়িতে একটা আলমারির মাথার ওপর রাখা আছে।
আ. সু: ওখানে থেকে গেলে তো খাতাগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
শামসুজ্জামান খান: হ্যাঁ, আলমারির ওপরে থেকে গেলে তো তাই হতো। তখন বেগম মুজিব বললেন যে, সুকুল মে বাচ্চাদের যে পাঠাব বই তো নেই, বই রয়েছে বত্রিশ নম্বর বাড়িতে। তখন ওরা বলল, লেআও ওধারছে। ওখান থেকে নিয়ে আসো, অসুবিধার কী? বেগম মুজিব নিজে গেলেন না, তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনাকে পাঠালেন। শেখ হাসিনা সে সময় বই আনার জন্য বত্রিশ নম্বরে গেলেন, অতি সাবধানে বইয়ের সঙ্গে সেই খাতাগুলোও কৌশল করে তিনি নিয়ে আসেন ওখান থেকে। এভাবেই বেগম মুজিবের হাতে প্রথমে চারটা খাতা আসে।
আ. সু: অর্থাৎ এই খাতাগুলো উদ্ধারে শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। হ্যাঁ, তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সুকৌশলে দখলদার সেনাদের চোখ এড়িয়ে খাতাগুলো নিয়ে আসেন।
শামসুজ্জামান খান: খাতাগুলো নিয়ে আসার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ও বেগম মুজিব দুজনই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বেগম মুজিব জানতেন খাতাগুলো কোথায় আছে এবং এক অস্বাভাবিক জীবন-মরণ অবস্থায়ও তিনি খাতাগুলোর কথাই বিশেষ করে ভেবেছেন এবং তিনিই বললেন খাতাগুলো উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্য; নয়তো জানাই যেত না বঙ্গবন্ধুর এই অমূল্য পাণ্ডুলিপি রয়েছে। বেগম মুজিব এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করলেন, কারণ পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে হয়তো আঁচ করে থাকতে পারে। অতএব, তিনি ভাবলেন খাতাগুলো তার অবরুদ্ধ বাসায় তীক্ষè নজরদারির মধ্যে রাখাটা ঠিক হবে না। তখন হাসপাতালে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণির কোনো আত্মীয়, বেগম মুজিব তাদের সঙ্গে কথা বললেন। তখন আরামবাগে থাকতেন শেখ মণির মা এবং তাদের পরিবার। তাই পা-ুলিপিগুলো তাদের বাড়িতে রাখা হলো এক অদ্ভুত কৌশলে। ঘরের বারান্দার ভেতরের ছাদের সঙ্গে ঝোলানো শিকায় মাটির পাত্রের ভেতরে লুকানো অবস্থায়। আর তার ওপর একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, যাতে কেউ বুঝতে না পারে।
আ. সু: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জীবনবিনাশী ত্রাসের মধ্যেও পাণ্ডুলিপি রক্ষা করা কীভাবে সম্ভব হয়?
শামসুজ্জামান খান: বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা ও শেখ মণির পরিবারের দুঃসাহসিকতায় এটা সম্ভব হয়।
আ. সু: এ তো গেল স্বাধীনতা-পূর্বকালে প্রথম পর্বের পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের ইতিহাস। স্বাধীনতা-উত্তরকালের দ্বিতীয় পর্বের কথা বলুন।
শামসুজ্জামান খান: স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে গণভবনে দুপুরের খাবারের পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু যখন বিশ্রাম নিতেন, তখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এবং তোয়াব খান তার জীবন কথা রেকর্ড করতেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সামরিক বাহিনীর কিছু দেশদ্রোহী কর্মকর্তা তাদের দেশি-বিদেশি শত্রুপক্ষের যোগসাজশে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়, তাতে বঙ্গবন্ধু লেখাপত্রের পাণ্ডুলিপি বিষয়টি সাময়িকভাবে চাপা পড়ে যায়।
বঙ্গভবনের তোশাখানায় পাওয়া যায় দুটি সুটকেসে রাখা দুটি টেপ। সম্ভবত এ দুটি টেপ গণভবনে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তোয়াব খানকে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের টেপ। একটা পাণ্ডুলিপি প্রধানমন্ত্রী অদ্ভুতভাবে পেয়েছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ঘনিষ্ঠজনের কাছ থেকে। প্রচণ্ড ধুলার স্তূপ থেকে এক নারী পুলিশকর্মী এটি উদ্ধার করেন। এ পাণ্ডুলিপিতে পুলিশের ঘুষ খাওয়ার কথা থাকায় এই পাণ্ডুলিপি গোপন স্থানে ফেলে রাখে। সবশেষে, শেখ মণির ভাই শেখ মারুফের কাছ থেকে উদ্ধার হয় অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি। সম্ভবত শেখ মণি এটি ছাপার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে থাকবেন। এই হলো পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর এই অমূল্য পাণ্ডুলিপিগুলো পাওয়া গেছে, এটা জাতির জন্য সৌভাগ্য।
২০০০ সাল থেকেই বলতে গেলে, শেখ হাসিনা ভাবলেন এগুলো প্রকাশ করা দরকার। তার পরের বাকি ইতিহাস তো বলেছি, যেভাবে সম্পাদনা পরিষদ গড়ে তোলা হলো ও কাজ করা হলো। সার্বিকভাবে প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে থাকলেন। এই পাণ্ডুলিপিগুলো যখন এডিটিংয়ের পর্যায়ে এলো, তখন আমরা কাজ শুরু করলাম। ছেঁড়া কাগজ, লেখা বোঝা যায় না, ভগ্ন অবস্থায় পাণ্ডুলিপি থেকে সেগুলো টাইপ করা হলো। তিনি পাণ্ডুলিপিগুলো যত্নের সঙ্গে টাইপ করার ব্যবস্থা করলেন, কখনো নিজেও টাইপ করলেন।
আ. সু: সম্পাদনার প্রক্রিয়া কেমন ছিল?
শামসুজ্জামান খান: সাধারণত পাণ্ডুলিপি যেভাবে এডিট করা হয়, সেগুলো সেভাবেই বানান ঠিক করা হয়েছিল। একই বানানের মধ্যে যদি বৈষম্য থাকে, সেটা ঠিক করা। অর্থাৎ একেক জায়গায় একেকভাবে যদি বানান লেখা থাকে, সেটাকে কোনো একটি নির্দিষ্টভাবে লেখা।
অথবা কিছু লেখা বা বাক্য তিনি তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন সেখানে ‘না’ হবে সেই ‘না’-এর জায়গায় দন্তন্য-এর (-া) আকারটা পড়েনি, এগুলো ঠিক করাই হলো এডিটিংয়ের কাজ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাক্যের ছোটখাটো সম্পাদনা করতে হয়েছে।
আমরা যেসব পৃষ্ঠার এডিট সম্পন্ন করি, সেগুলো তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টাইপ করান এবং তিনি নিজের হাতেও কিছু টাইপ করেছিলেন। এগুলো তার বাবার পাণ্ডুলিপি, সেজন্য যত্নটা ছিল একটু বেশি। যাতে কোনোভাবে কোনো ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি না হয়, তা নিয়ে তিনি সতর্ক ছিলেন।
আ. সু: তিনি নিজেও একজন লেখক, সাহিত্যের প্রতি তার অসম্ভব ভালোবাসা রয়েছে। তার লেখক পরিচয়টাও আমরা জানি।
শামসুজ্জামান খান: হ্যাঁ, বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে তার মধ্যে সাহিত্যের একটা বিশেষ বোধ আছে। মজার ব্যাপার হলো, আমরা যখন এই কাজ করি, ঢাকা বিসশবিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক যারা কিছুটা বঙ্গবন্ধুবিরোধী বলতে গেলে, তারা আমাদের কখনো কখনো বলতেন এটা আপনারা কী তৈরি করছেন?
আ. সু: মানে হাসিঠাট্টা করতেন?
শামসুজ্জামান খান: ঠিক হাসিঠাট্টার মতোই। তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রথম খণ্ড প্রকাশের পর তারা বললেন, আমরা তো ওই সময় সমালোচনা করেছিলাম কিন্তু এখন দেখছি এ লেখা শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। এটা পড়েই তা বোঝা যায়, শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব এবং সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ, কথা বলার ধরন ও তার বৈশিষ্ট্য পুরো বিষয়টি এ বইতে এসেছে, যাই হোক এসবের মধ্যেই আমরা কাজ করতে শুরু করি। একসময় প্রথম খণ্ডটা শেষ করলাম, সে বইটার নাম অসমাপ্ত আত্মজীবনী। অসমাপ্ত আত্মজীবনী যখন শেষ করলাম, ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলো। নেত্রী গ্রেপ্তার হলেন। বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে সতর্কতার কারণে বেবী মওদুদ পাণ্ডুলিপি আমার শ্যামলীর বাড়িতে রাখলেন। এখানেই বেবী আসতেন। আমরা সম্পাদনার কাজ করতাম। আমি তো বলেছি ২০০২ সালের শেষ থেকে কাজ শুরু করেছি, তবে আমি কাজটা ২০০৩ সাল থেকে চূড়ান্তভাবে শুরু করেছি। আর শেখ হাসিনা ২০০০ সালের শেষ থেকেই কাজ শুরু করেছেন। আমরা প্রথম বইটা প্রকাশ করলাম ২০১২ সালে। এ বইয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে আমরা যথেষ্ট পরিমাণ সময় নিয়েছি ও কাজ সুসম্পন্ন করেছি।
আ. সু: এ কাজে তাই এক যুগ সময় লেগে গেল।
শামসুজ্জামান খান: হ্যাঁ, এক যুগ লেগেছে। প্রথম বইটার ব্যাপারে অতিসতর্ক ছিলাম যেন কোথাও কোনো ত্রুটি না হয়। সেজন্য যত্নের সঙ্গে আমরা এটা সম্পাদনা করে, প্রুফ দেখে বানানে যত দূর সম্ভব সংহতি রক্ষা করে প্রকাশ করেছি এবং আমরা খুশি হয়েছিলাম বইটা প্রকাশের পর তেমন কোনো সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়নি, বরং প্রত্যেকেই প্রশংসা করেছেন। প্রথম বইটা প্রকাশের পর তুমুল সাড়া পাওয়া গেল। আসলে মানুষ ভাবতেই পারেনি বঙ্গবন্ধুর লেখালেখির এমন অসাধারণ দক্ষতা ছিল।
আ. সু: অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি প্রকাশের পর বঙ্গবন্ধুকে মানুষ নতুন করে আবিষ্কার করল।
শামসুজ্জামান খান: হ্যাঁ, তিনি রাজনীতিতে যেমন নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, লেখার ক্ষেত্রেও তেমনি অসামান্য ছাপ রেখেছেন। তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৫ বছর। বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। তারপরও এত যত্ন ও নিষ্ঠায় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সাহিত্যগুণসম্পন্ন যে অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ আরও তিন-চারখানা বই লিখে গেছেন, তাতে আমরা নতুন এক বঙ্গবন্ধুকে পেলাম। রাজনীতির সঙ্গে লেখক সত্তায় নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রনির্মাতা ও সাহিত্য স্রষ্টার সম্মিলনে বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্ব অন্যরকম উচ্চতায় স্থিত হলো।
আ. সু: লেখক বঙ্গবন্ধু এবং তার বইয়ের অনুবাদ প্রসঙ্গ...
শামসুজ্জামান খান: বঙ্গবন্ধুর বই প্রকাশ করার সঙ্গে অনুবাদের বিষয়ও স্থির করা হলো। প্রথম অনুবাদটা শামসুল হুদা হারুন সাহেব করেছিলেন। তার অনুবাদটা ক্ল্যাসিক্যাল ঢঙের ছিল। অনেকেই বলল যে, এখনকার ইংরেজি তো একটু অন্যরকম, সহজ, ঘরোয়া কখনো একটু মজলিশি ধরনের, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিতার স্বাদযুক্ত। তো অনুবাদটা সেভাবে করলে ভালো হয়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির সাহিত্যের অধ্যাপক ও অনুবাদক ফকরুল আলমকে অনুরোধ করা হলো, তিনি অনুবাদের কাজটা করলেন। তারপর ২০১২ সালে বইটা ইংরেজিতেও প্রকাশ পেল। এই হলো প্রথম বইটির ইতিহাস। বই প্রকাশের পর প্রকাশনা উৎসব হলো, উৎসবটাও ছিল খুবই আড়ম্বরপূর্ণ। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি প্রকাশের জন্য দেওয়া হয়েছিল ইউপিএল প্রকাশনীর মহিউদ্দিন আহমদকে। তারা মোটামুটি যত্নের সঙ্গে বইটি প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের জানামতে ইংরেজ আমল ও পাকিস্তান আমলে বাঙালি মুসলমানের লেখা সর্বাধিক বিক্রীত বই ছিল মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ ও মোহাম্মদ নজিয়র রহমানের ‘আনোয়ারা’। সেসব রেকর্ড এখন ভেঙে ফেলেছে বঙ্গবন্ধুর বই। বই বিক্রির ক্ষেত্রে পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এই বইটি। বঙ্গবন্ধুর লেখা বই তুমুল গ্রহণযোগ্যতা পায় পুরো জাতির কাছে। এরপর আমরা যে পাণ্ডুলিপিটি হাতে পেলাম, সেটি হলো কারাগারের রোজনামচা। বঙ্গবন্ধুর নির্মোহ বিবরণে কারাগারের কথাই থাকে, আশপাশের লোকজনের কথাই উঠে আসে। কারাসাহিত্য আমরা যতটা পড়েছি বঙ্গবন্ধুর মতো এতটা অনুপুঙ্খভাবে অন্য কোনো বইয়ে পাইনি। এ বইয়ে দেখা যায় রাজবন্দি ছাড়াও তিনি সাধারণ কয়েদিদের খোঁজখবর নিচ্ছেন নিবিড় অনুসন্ধিৎসায়। বিভিন্ন দাগি আসামির কথা তাদের জীবন কেন এমন হলো, সেটা যত্ন ও সংবেদনশীলতায় দেখার প্রয়াসও রয়েছে লেখায়। কখনো পকেটমারের, কখনো গোয়েন্দা বাহিনীর লোকরা অপরাধীদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে কিছু টাকা-পয়সা এদিক-সেদিক করে ভাগাভাগির মাধ্যমে কীভাবে দুষ্কর্মগুলো সেরে নেয়, সে কথা। আবার কারাগারে ভুক্তভোগীর একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্ব, পরিবার বিচ্ছিন্নতার মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক বেদনা। এই বই হয়ে ওঠে পূর্ববাংলার নির্যাতিত মানুষের কারা নির্যাতনের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু শুধু তার নিজের কারা নির্যাতনের কথা বলেননি, পূর্ববাংলার নানা শ্রেণি-পেশার ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতনের কথা তার বইয়ে বাক্সময় করে তুলেছেন।
আ. সু: তা ছাড়া জেলখানার পরিবেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তিনি।
শামসুজ্জামান খান: পরিবেশ বলতে কারাগারের ভেতরের খুঁটিনাটি বিষয় রয়েছে। কখনো সেটি রহস্যময়, কখনো সেটি হাসির উদ্রেক করে, কখনো নিষ্ঠুরতার চরম উদাহরণ। এসব বিষয়কে এতটা বাস্তবধর্মী করে এতটা একনিষ্ঠভাবে তিনি তুলে এনেছেন, যা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। কারাগারের ইতিহাসের নানা টেকনিক্যাল পরিভাষা যেমন দফা, যেমন কেষ্টাকল, শয়তানের কল, জলভরি দফা, বন্দুক দফা, ডালচাকি দফা, ছোকরা দফা ইত্যাদি তার বইকে দিয়েছে এক অনন্যতা। এসব অদ্ভুত, বিচিত্র দফার কথা আমরা আগে কেউ জানতাম না এবং এসব দফা বাংলাদেশের জেলেই উদ্ভাবিত। কোনো কোনো দফা নিয়ে হাসি পায়, কোনো কোনো দফা পড়লে মনে হয় কীসব কিম্ভূতকিমাকার ব্যাপার জেলের ভেতরে। আবার ওখানে পাগলদের জন্য যে সেল রয়েছে, সেটার বর্ণনাও দিয়েছেন। তাদের যে চিৎকার, উদ্ভট আচরণ, নানা অদ্ভুত, তবে কাণ্ডকারখানা লেখক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কখনো মানবিক চেতনায় কখনো মৃদু রসিকতায়। কখনো তাদের জন্য দুঃখ পেয়েছেন। কখনো পাগলদের সেলের পাশেই তার সেল নির্ধারণ করা হয়েছে, ঘুমের কষ্ট হয়েছে ইত্যাদি তিনি যেমন তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে তার পালিত একটা মোরগের কথা আছে। মোরগটা যখন হাঁটছে, তখন তা মনে হয়েছে মোরগটা এক রাজকীয় ভঙ্গিতে গৌরবের সঙ্গে ঝুঁটি ফুলিয়ে বীরের মতো হেঁটে যাচ্ছে। তার নির্জন সেলের পাশেই ছিল গাছ, সেই গাছে হলুদ পাখি বসত। দুটো হলুদ পাখি প্রতিদিন দেখে তিনি আনন্দিত হতেন। পশু-পাখির প্রতি তার যে প্রেম-ভালোবাসা, এটিও চমৎকারভাবে তার লেখায় উঠে এসেছে। এ ছাড়া তিনি বাগান করতে ভালোবাসতেন, ফুলের গাছ লাগাতেন। এতে তার প্রকৃতি গাছপালা, পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়।
আ. সু: মানবিক মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে বলতে পারি।
শামসুজ্জামান খান: আবার কখনো দেখা যাচ্ছে, একটা গেছো গিরগিটির সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে দাঁড়কাকের, সেখানে তিনি সামরিক শাসকদের সঙ্গে সাধারণ মানুষদের তুলনা করেছেন। এসব মিলিয়ে কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থ তিনি রাজনীতির সমাজের, দুঃশাসন ও স্বৈরাচারের নানা রকম ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।
আ. সু: বলতে হয় অসাধারণ এক কারাসাহিত্য। আপনি বঙ্গবন্ধুর আরও একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। সে সম্পর্কে বলুন।
শামসুজ্জামান খান হ্যাঁ, অপর যে বইটি প্রকাশিত হলো এ বছরের বইমেলায়, তা হলো আমার দেখা নয়াচীন। বঙ্গবন্ধু এই বইটির নাম দিয়েছিলেন ‘নয়াচীন’। প্রথমদিকে চিন্তা করা হয়েছিল এই বইটির নাম রাখা হবে ‘চীন-ভ্রমণ’। আমি তখন বলেছিলাম, একটি নতুন অভিধা সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে গড়া নতুন রাষ্ট্র, তাকে এই ভ্রমণ শিরোনামে আমলে এর যে গভীরতা বহন করে, তা এই নামটিতে অনুপস্থিত। কারণ, অনেকেই তো চীন ভ্রমণ করে, তাদের উদ্দেশ্য আনন্দ লাভের জন্য। তাই ‘চীন-ভ্রমণ’ নামটি এটা খুবই সাধারণ শোনায়। অন্য পর্যটকদের মতো তো বঙ্গবন্ধু আনন্দ ভ্রমণের জন্য যাননি। নয়াচীন হলো একটি নব্যরাষ্ট্রব্যবস্থা। যেখানে সমাজতান্ত্রিক নেতা মাওসেতুংয়ের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা লংমার্চ করেছে, লড়াই করেছে। জানা যায়, শেষ পর্যন্ত তারা ক্ষুধার কারণে বেল্টের চামড়া খেয়ে জীবন ধারণ করেছে, তারা লড়াই-সংগ্রাম করে একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, যা একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। অতএব, সে রাষ্ট্রটা কী রকম তা দেখার জন্য, এর ইতিহাস জানার জন্য, সেখানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, রাজনৈতিক এই যে পাটপরিবর্তন তা সে দেশের জনগণের জন্য সত্যিকার অর্থে কল্যাণকর কি না এসব দেখার জন্য তিনি সেখানে গিয়েছেন। তিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চীনের সব বিষয়কে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ এটি অসাধারণ এক রচনা এবং সেই চীন ভ্রমণে পাকিস্তানের পঁচিশজনের একটি প্রতিনিধিদল সেখানে শান্তিসম্মেলনে গিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সে দলে ছিলেন তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
আ. সু: তিনি কত সালে চীন ভ্রমণে যান?
শামসুজ্জামান খান: সময়টা ১৯৫২, সেপ্টেম্বর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আর গিয়েছিলেন উর্দু কবি ইউসুফ হাসান। ওখানে গিয়ে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নয়াচীনের সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এ ছাড়া ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা, সব বিষয় তিনি দেখতে চেয়েছেন। আমি বাংলা একাডেমিতে থাকাকালেই প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, বইটি বাংলা একাডেমিকে দেওয়ার জন্য। আমি মহাপরিচালক পদে থাকি বা না থাকি, বইটি যেন এখান থেকেই প্রকাশ হয়। কারণ, বাংলা একাডেমি আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান, আমাদের জাতির পিতার বই সেটা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ হওয়াই ভালো এবং তিনি আমার কথা রেখেছেন, বইটি বাংলা একাডেমি থেকেই প্রকাশ পাচ্ছে। এখানে আরেকটি কথা বলি, কারাগারের রোজনামচা বইটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করার পর সেটা অতিদ্রুত পাঠকের কাছে বিপুল সাড়া পায়। বাংলা একাডেমির বই বিক্রির ইতিহাসে কারাগারের রোজনামচা নতুন রেকর্ড অর্জন করে।
আ. সু: বঙ্গবন্ধুর বই প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার ক্ষেত্রের আপনার অনুভূতি কী?
শামসুজ্জামান খান: আমি আনন্দিত, আমি অভিভূত। জাতির পিতার এই অমূল্য পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশের কাজে যুক্ত থাকতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই সম্পাদনের আনন্দ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ।
মূলত কংগ্রেসের ভেতরের দক্ষিণপন্থি শক্তি ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু মহাসভার প্রবল আপত্তিতেই বাংলা ভাগ হয়েছিল। বিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশ-বরিশাল, খুলনা, যশোর, ঢাকা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেমন শরণার্থী ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এপারে। তেমনি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া দিনাজপুর বর্ধমান নানা জায়গা থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন মুসলিম জনতা। নিতান্তই বাধ্য হয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের বড় অংশ। জনশূন্য হয়ে গেল জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট বিডন স্ট্রিট মানিকতলা বাগমারি ঢাকুরিয়া বেলেঘাটার বিপুল এলাকা। জনশূন্য বললাম বটে, আসলে কথাটা হবে মুসলিমশূন্য। এভাবেই তারুণ্যের, বিদ্রোহ, ভালোবাসার কলকাতা থেকে চিরকালের মতো চলে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
সময় পেলেই কলকাতার অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে একটা অদ্ভুত ঘোর লেগে যায়। মনে হয় এ যেন এক অচেনা কলকাতা। ইতিহাস এখানে যেন থেমে রয়েছে। জাফরি দেওয়া বড় বড় বাড়ি। মুঘল, পাঠান ও ব্রিটিশ স্থাপত্যের চমৎকার মিশেলে পুরনো অট্টালিকা। বুড়ো আতরওয়ালা, নামি, অনামি রেস্তোরাঁয় হান্ডি বিরিয়ানির খুশবু, ঠুনঠুন করে চলে যায় প্রাচীন রিকশা। জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট, কলুটোলা, পার্ক সার্কাসে, বেকবাগান, মার্কুইস স্ট্রিট, ওয়েলেসলি, রিপন স্ট্রিট, আলিমুদ্দিন-গলির গলিতস্য গলিতে হেঁটে ঘুরতে ঘুরতে আপনি আনমনে পৌঁছে যাবেন ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগের এক শহরে। যেখানে অবিভক্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের এক বিপুল প্রভাবশালী অংশের রোজনামচা লেখা হতো।
দেশভাগ, মুসলিম জাগরণ, দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতার জানা-অজানা বহু আখ্যানের জন্ম হয়েছিল একদা এই তথাকথিত কম চেনা শহরের অলিগলিতে। এখন কেউ ফিরেও তাকায় না হারিয়ে যাওয়া এই স্মৃতির শহরের দিকে। অথচ এক দিন মাত্র সত্তর-আশি বছর আগে এই মহল্লায় মহল্লায় ছিল মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলনের গড়। দেশভাগকে শুধু দ্বি-জাতিতত্ত্ব বা ধর্মীয় কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা বোধ হয় অতি সরলীকরণ হয়ে যায়। যদিও আমাদের চেনা ইতিহাস পাঠে বছরের পর বছর এই বিভাজনের রাজনীতিতে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিশ্লেষণে জায়গা পেয়েছে। কিন্তু এখন যখন নতুন করে ইতিহাসের পুনঃপাঠ জরুরি হয়ে পড়েছে, তখন একমাত্রিক দৃষ্টিতে না দেখে দেশভাগের পেছনে বহুমাত্রিক কারণ খোঁজার সময় এসেছে।
সময় হয়েছে স্বাতন্ত্র্যবোধের বিকাশ কেন ও কীভাবে হলো, তা নিয়ে গভীর গবেষণার। জমি বা ভূমিস্বত্ব নিয়ে বিশদে আলোচনার। জাতীয়তাবাদের রাজনীতি কোন কোন কারণে নিছক হিন্দু আধিপত্যবাদী রাজনীতির চেহারা নিল, তা বোঝার। মুসলিম লীগের রাজনীতির ভেতরকার দলাদলি, ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব সব নিয়েই নতুন নতুন গবেষণার সময় এসেছে। উপমহাদেশেই ধর্ম এখন এমন এক ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে, সেখানে কাজটা কঠিন কিন্তু তবু নতুন গবেষণা করতে গেলে নির্মোহ, পক্ষপাতহীন হতে হবে। ইতিহাস কখনো কারও নিজস্ব সম্পত্তি নয়। সে চলমান, জীবন্ত। ইতিহাসের দায় শুধু সত্যের কাছে।
এই ইতিহাসের খোঁজে বেরিয়েই তো যত বিপত্তি। এত ভ্যান ভ্যান করার বা ধান ভাঙতে শিবের গীত গাওয়ার দরকারই হতো না, যদি না অখণ্ড বাংলার রাজধানী কলকাতার মুসলিম জনপদগুলো, দেশভাগ নিয়ে ডকুমেন্টারি করব বলে চষে না বেড়াতাম। এক একটা বাড়ি দেখছি আর ভাবছি এইটাই কি, এ বাড়িতেই কি থাকতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী! কিংবা এখানেই ছিল আজাদ কাগজের অফিস! পাগলের মতো এক-এক দিন সক্কাল সক্কাল খুঁজতে যেতাম ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশের কুখ্যাত গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের উপদ্রুত এলাকাগুলোয়।
ইতিহাস তো শুধু রাজারাজড়া নবাব নেতানেত্রীদের কথা লেখে। বেলেঘাটার হায়দর মঞ্জিলে যাই। ও বাড়িতে গান্ধীজি অনশনে বসেছিলেন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থামাতে। স্বাধীনতার আগ এবং স্বাধীনতার দিন। ১৫ আগস্ট। ১৯৪৭। কয়েক মাস আগে দুই বুড়ো মানুষকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা গান্ধীজিকে দেখেছিলেন কি না! দুজনেই বলেছিলেন, ছোটবেলায় মহাত্মা গান্ধীকে তারা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তাদের কাছে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছিলাম। ১. রোজ গান্ধীজির কাছে ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে বসে থাকতেন সোহরাওয়ার্দী। টকটকে ফর্সা সুন্দর অভিজাত সোহরাওয়ার্দীর নাম তারা পরে জেনেছিলেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর লাজুক নম্র বসার ভঙ্গিটি সেই ছোটবেলাতেই তাদের ভালো লেগেছিল। অথচ এই নম্র সোহরাওয়ার্দীর কোনো অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গে নেই। এখানে তিনি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের এক ও অদ্বিতীয় ‘খলনায়ক’। বুড়ো দুজন আর যেটা বলেছিলেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্তত দেশভাগের ইতিহাসের উপাদানে। বলছিলেন ‘এই এলাকার প্রায় পুরোটাই তখন মুসলিম অধ্যুষিত। কিছু কিছু পাড়া শুধু দ্বীপের মতো জেগে ছিল হিন্দু মহল্লা হয়ে। কিন্তু আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। মেলা মেশার তো প্রশ্নই নেই। পরস্পরকে চিনতাম না বলে এক ধরনের আতঙ্ক ছিল দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই। এ ওকে সন্দেহ করত আর ও ওকে। দূর থেকে আল্লাহ আকবর আওয়াজ উঠলেই হিন্দুপাড়ায় ভয় ধরত এই বুঝি হামলা হবে। আমরা তখন কত্ত ছোট কিন্তু বড়দের নির্দেশে নারায়ে তাকবির শুনলেই আমরাও জোরে চিৎকার করে উঠতাম বন্দেমাতরম বলে।
৪৬-৪৭ সালে যদি অবিশ্বাস ও ঘৃণা নিজেদের মধ্যে এ ধরনের হয়ে থাকে, তাহলে দেশভাগ আটকে রাখা যে অসম্ভব ছিল, তা বুঝতে কোনো পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। গান্ধীজির কলকাতার বাসস্থান বা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর এলগিন রোডের বাড়ি কিংবা অখণ্ড বাংলার অন্যতম তাত্ত্বিক শরৎচন্দ্র বসুর বাসস্থান ও হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জীবনযাপনের সব নিদর্শন চাইলেই আপনি খুঁজে পাবেন। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খোঁজ করলেও কোথাও চট করে পাবেন না সোহরাওয়ার্দী, আবদুল হাশিম কিংবা ফজলুল হকের স্মৃতি। কোনো অজ্ঞাত কারণে অদ্ভুতভাবে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছে ৪৬-৪৭ সালের বর্ণময় মুসলিম ইতিহাস।
অথচ দেশভাগের আগে ও পরের সময়টুকু বাদ দিলে শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক ক্ষমতা গড়ে উঠেছিল যে ইসলামিয়া কলেজে, তা অবশ্য আজও কলকাতার অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই ইসলামিয়া এখন হয়েছে মৌলানা আজাদ কলেজ। দেশভাগের আগে আগে অশান্ত সময়ে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ সাহেব। কখনো যেতে যেতে ইচ্ছা হলে অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়ুন ভেতরে। পুরনো লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখে নিতে পারেন বোর্ডে টাঙানো ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সম্পাদকের তালিকায় জ্বলজ্বল করছে ‘এম রহমানের’ নাম।
ওয়েলিংটন স্কয়ার থেকে রিপন স্ট্রিট, ওয়েলেসলি, আলিমুদ্দিন, মার্কুইস স্ট্রিট নিউ মার্কেটের কাছাকাছি বৃত্তের মধ্য থেকে গেছে এক ইতিহাসের নানা মাইলফলক। এখন এসব এলাকায় ছোট-বড় হোটেলে ভিড় করে থাকেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার মানুষজন। রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, যশোর, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও ঢাকার অসংখ্য মানুষ। কেউ আসেন ডাক্তার দেখাতে। কেউ বেড়াতে। তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই থাকেন, যারা ফেলে আসা অতীতের খোঁজ নেন। একটু দূরে, হাঁটাপথে বেকার হোস্টেল। চারতলার ২৪ নম্বর ঘরে থাকতেন তরুণ ছাত্রনেতা মুজিবুর। হেঁটে ঘুরতে ঘুরতে কল্পনায় দেখতে থাকুন তরুণ মুজিবকে। ওয়েলেসলি লেনের ভেতরে সামান্য গেলেই এক নম্বর বাড়ি ছিল মুসলিম লীগের অফিস। সোহরাওয়ার্দীর ডেরা ছিল কাছাকাছিই। তরুণ মুজিবুর রহমান প্রায়ই যেতেন সেখানে। সামান্য দূরে রিপন স্ট্রিটের ৬ নম্বর বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন মুসলিম লীগের তাত্ত্বিক নেতা ও যুক্তবাংলার প্রবল সমর্থক আবুল হাশিম। পরে অবশ্য তিনি উঠে গিয়েছিলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ভাড়া বাসায়। মন খারাপ নিয়ে পথ চলি। ফুটপাতের ওপর বৃদ্ধ বই বিক্রেতা সান্ত্বনা দেয়, যা যাওয়ার তা যাবেই বাবুজি। কিন্তু তুমি দেখবে ইতিহাস সব মনে রাখে।
শেখ মুজিবুর রহমানের ১০০ তম জন্মবার্ষিকী এবার। কতভাবে তাকে স্মরণ করবেন পণ্ডিতরা। আমি নিতান্তই ইতিহাসের এক সামান্য প্রেমিক। ইতিহাসের টানেই ঘুরে বেড়াই অতীতের খোঁজে। শেখ সাহেব শুধু কোনো নাম নন, ব্যক্তি নন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের এক শক্তিশালী চরিত্র। পার্শ্বচরিত্র থেকে কীভাবে তিনি রাজনীতির মহানায়ক হয়ে উঠলেন, তা সত্যিই রোমাঞ্চকর। কলকাতা তার মনন গড়ে দিয়েছিল। হয়তো ভবিষ্যৎ লক্ষ্যও। তরুণ মুজিবুর রহমানকে চিনতে গেলে তার সময়কে জানতে হবে। দেশভাগের নেপথ্যে কারণ, দাঙ্গা শেষ অবধি খণ্ডিত স্বাধীনতা পাওয়া।
এখন খুব কম লোকই কলকাতায় তরুণ মুজিবকে খোঁজ করেন। কলকাতায় তিনি ছিলেন নিতান্তই এক ছাত্রনেতা। আর পূর্ব পাকিস্তানে তার রাজনৈতিক জীবন বিকশিত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন। ফলে ওপারের উন্মাদনা এপারে আশা করাও অন্যায়। তবু একেবারে কিছু হবে না বা হচ্ছে না, তাও নয়। দূতাবাসে অনুষ্ঠান হবে। মুজিবুর রহমানের স্মৃতির বেকার হোস্টেল বা ইসলামিয়া কলেজেও নিশ্চিত হবে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান। মালা দেওয়া, ফুল দেওয়া এবং অবশ্যই গুরুগম্ভীর ভাষণ। উপমহাদেশের সর্বত্রই নানা আড়ম্বরের আড়ালে প্রকৃত মানুষটি কেমন যেন হারিয়ে যান। অন্তত আমার তাই মনে হয়। শেখ সাহেবের জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল ১৯৪৬ সালের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বা বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাই বলি না কেন! আমি তাই কল্পনায় হাঁটতে থাকি যে পথ দিয়ে এক দিন হেঁটে যেতেন মুজিবুর রহমান। শেখ সাহেবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় লেখা আছে ওই সময় তার মানসিক যন্ত্রণার বিস্তারিত বিবরণ। পাশাপাশি বইটি পড়লে বোঝা যায় পশ্চিমবঙ্গের চেনা ইতিহাসে যেভাবে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের লোকরা দাঙ্গার জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত হয়ে আছে, বাস্তবে তা মোটেও সত্যি নয়।
শেখ সাহেবের সময়ে, তার কোনো বন্ধু বা আত্মীয় অন্তত কলকাতায় আর বোধহয় কেউ নেই। ১০০ বছর বা তার কাছাকাছি কারও বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ঘটনাচক্রে ছিয়ানব্বই বছরের একজন এখনো আছেন যিনি বেকার হোস্টেলে কিছুদিন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পাশাপাশি ঘরে। একই ধরনের চারতলায়। মুজিবুর রহমানের চব্বিশ নম্বর ঘরের পাশে। তিনি নীহার চক্রবর্তী। আতাউর রহমানের বিখ্যাত পত্রিকা চতুরঙ্গের অন্যতম মালিক। এই প্রবীণ বয়সেও আশ্চর্য সতেজ তার স্মৃতিশক্তি। কথা বলতেও ভালোবাসেন খুব। কথায় কথায় বলছিলেন
‘আমার সঙ্গে মুজিবুরের খুব যে একটা মাখোমাখো সম্পর্ক ছিল, তা নয়। তবে চিনতাম। ও যেবার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হয়, আমিও সেবার স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি হই। মুজিবুর মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার। আর আমি বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের। তখন নানা সময়ে দেখাটেখা হয়েছে। দুটো আলাদা সংগঠনের লোক হলেও আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল। মুজিবুর রহমানের খুব প্রশংসা শুনতাম সিনিয়র দাদাদের কাছ থেকে। আর অন্যান্য কলেজের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও। শুনতাম ও খুব ভালো সংগঠক। দারুণ বক্তৃতা দেন। ভীষণ পরোপকারী ও অসাম্প্রদায়িক। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের রিহার্সাল মুজিবের হয়ে গিয়েছিল কলকাতায়। ৪৬-এর ভয়ংকর দাঙ্গার সময় মুজিব শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াননি, প্রাণবিপন্ন করে সাধ্যমতো পাশে থেকেছেন হিন্দু প্রতিবেশীদেরও। মুজিবুর রহমানের আর একটা মস্ত গুণ ছিল, যাকে একবার দেখেছেন, তাকে কখনো ভুলতেন না। নাম-ধাম ঠিক মনে রাখতেন। ৪৬-৪৭-এর পর মুজিবের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। শুনতাম ওর রাজনৈতিক উত্থানের সব রোমাঞ্চকর কাহিনী। তারপর বাংলাদেশ হওয়ার পর মুজিব যখন কলকাতায়, তখন একবার একজন এসে বললেন, মুজিবুর রহমান আপনাকে দেখতে চেয়েছেন। অমুক জায়গায় আছেন। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে আপনাকে যেভাবেই হোক ধরে নিয়ে যেতে।
আমি একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম। উনি এখন একটা দেশের রাষ্ট্রনায়ক, আমি গিয়ে কী কথা বলব! যা হোক, আমার ওজোর-আপত্তি শোনা হলো না। আক্ষরিক অর্থেই ধরে নিয়ে যাওয়া হলো শেখ সাহেবের কাছে, যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই-ই। চারপাশে লোকজন ওকে ঘিরে রয়েছেন। কে কত আপনজন, তা জানান দেওয়ার একটা যেন প্রতিযোগিতা চলছে। আচমকাই আমার ওপর চোখ গেল মুজিবুর রহমানের। উনি কিছু বলার আগেই বললাম চিনতে পারছেন? শেখ সাহেব হা হা করে উঠলেন কেন চিনব না! আমার স্মৃতি এত দুর্বল নয়। আমি আমতা-আমতা করে ওনার এক পুরনো বন্ধুর নাম বলতেই শেখ সাহেব চটে উঠলেন ওর নাম শুনতে চাই না। ওকে পেলে ফাঁসি দেব। পরে শুনলাম ওই পুরনো বন্ধুটির ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে খুব খারাপ ছিল। দু-একটা কথা বলে উঠে পড়লাম। শেখ সাহেব বিদায় দিতে দিতে বললেন, পরেরবার ঢাকায় দেখা হবে। দাওয়াত দেওয়া রইল। বুঝলাম, অন্তত এখনো শেখ মুজিবুর রহমান বদলে যাননি। আমাদের চেনা ছাত্রনেতাই থেকে গেছেন।’
ইসলামিয়া কলেজ ও বেকার হোস্টেল দুই জায়গাতেই দুটি সিঁড়ি আছে, যা এখন আর কলকাতায় কোনো বাড়িতে বিশেষ দেখা যায় না। ইসলামিয়া, যা এখন মৌলানা আজাদ কলেজের সিঁড়ি লোহার ঘোরানো আর বেকার হোস্টেলেরটা লোহার। সোজা। তবে বেশ উঁচু। একতলা উঠতেই হাঁফ ধরে যায়। এসব সিঁড়ি, লম্বা বারান্দা, হোস্টেল-লাগোয়া মসজিদ সবকিছুতেই যেন লেগে আছে শেখ মুজিবুর রহমানের ছোঁয়া। শুধু ‘অসাম্প্রদায়িক’ পশ্চিমবঙ্গের কোথাও দেশভাগের আগের লীগের কলকাতা আপনি খুঁজে পাবেন না। ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডে গেলে আপনি বুঝতেও পারবেন না যে, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এই বাড়ি এক দিন অবিভক্ত বাংলার রাজনীতির পীঠস্থান ছিল। সকাল থেকে রাত গমগম করত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভিড়ে। ওই কর্মীদের ভিড়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের ওয়েলেসলি ফাস্ট লেনে সোহরাওয়ার্দীর আর এক ঠিকানায় গেলেও সেই একই ধরনের জমাট বাঁধা অন্ধকার। উপমহাদেশের একদা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের ছিটেফোঁটাও আর আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ৮৬-এ লোয়ার সার্কুলার রোডে মৌলানা আক্রম খাঁ প্রতিষ্ঠিত ১৯৩৬ সালের আজাদ পত্রিকার অফিস কিংবা শেখ সাহেবের সাধের মিল্লাত প্রেস সবই এখন শুধুই স্মৃতি। এভাবেই হারিয়ে গেছে ইতিহাসের নানা আকর। জীবন্ত এক অধ্যায় কোনো এক জাদুমন্ত্রে রাতারাতি হয়ে গেছে অদৃশ্য।
আমরা এপারের লোকজন শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করি ধর্মনিরপেক্ষ মহান এক বাঙালি বলে। ওপারের মতো এপারেও তিনি বঙ্গবন্ধু। অথচ শেখ সাহেবের রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দী আজও এখানে, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ও বাম রাজনীতিতে, এমনকি তথাকথিত সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী মহলেও হয়ে রইলেন ৪৬ সালের দাঙ্গার খলনায়ক। বেলেঘাটার যে বাড়িতে দাঙ্গা থামাতে মহাত্মা গান্ধী অনশনে বসে ছিলেন, সেখানে একটা খুব পুরনো ছবিতে সোহরাওয়ার্দীর ঠিক পেছনে বসা প্রায় কিশোর মুজিবুর রহমানকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। রোগা-পাতলা সাধারণ চেহারা। একটু যেন বেশি লাজুক। তবে চোয়াল শক্ত করা মুখের দিকে তাকালে ভবিষ্যতের মুজিবের আদলটা চেনা যায়।
সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শঙ্কর রায় সবাই মিলে অখণ্ড বাংলার দাবি করলেন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলা। শোনা যায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাও রাজি হয়েছিলেন বাংলা ভাগ না করতে। গান্ধীজি ঈষৎ দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু ঘোরবিরোধী ছিলেন না। আসলে ওই সময় ক্ষমতার বৃত্ত থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
মূলত কংগ্রেসের ভেতরের দক্ষিণপন্থি শক্তি ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু মহাসভার প্রবল আপত্তিতেই বাংলা ভাগ হয়েছিল। বিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশ-বরিশাল, খুলনা, যশোর, ঢাকা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেমন শরণার্থী ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এপারে। তেমনি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া দিনাজপুর বর্ধমান নানা জায়গা থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন মুসলিম জনতা। নিতান্তই বাধ্য হয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের বড় অংশ। জনশূন্য হয়ে গেল জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট বিডন স্ট্রিট মানিকতলা বাগমারি ঢাকুরিয়া বেলেঘাটার বিপুল এলাকা। জনশূন্য বললাম বটে, আসলে কথাটা হবে মুসলিমশূন্য। এভাবেই তারুণ্যের, বিদ্রোহ, ভালোবাসার কলকাতা থেকে চিরকালের মতো চলে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
ষাটের দশক। কঠিন সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পূর্ববাংলা নিষ্পিষ্ট। স্বৈরাচারী সামরিক শাসক, তৎকালে ‘লৌহমানব’ বলে পরিচিত পাকিস্তানি জেনারেল ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের অত্যাচারে জর্জরিত সমগ্র পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ববাংলা। আর তার প্রতিবাদে, সামরিক শাসনের আশু অবসানের দাবিতে ছাত্র-যুবসমাজ, গণতন্ত্রকামী সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা দেশের রাজপথগুলোকে দৃপ্ত পদভারে প্রকম্পিত করে চলেছেন। সামরিক শাসনের কঠোরতা তার থোড়াই পরোয়া করে ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে তুলছেন। সরকার তার প্রতিশোধ নিচ্ছে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিনা বিচারে আটক করে কারারুদ্ধ করার মাধ্যমে। ওই কর্মসূচি যেমন পাকিস্তান সরকার, তেমনই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী গ্রুপ) ছাড়া অন্যসব দলকেও আতঙ্কিত করে তোলে। তারা সরাসরি শেখ মুজিবকে পুনর্বার ‘পাকিস্তান ও ইসলামের দুশমন’ আখ্যায়িত করেন। শেখ মুজিব তখন ঢাকায়।
দিন-কয়েকের মধ্যে তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ প্রথম সারির কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাসহ গ্রেপ্তার হলেন। শেখ মুজিব (তখনো তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত হননি) ছাড়া অন্য নেতাদের প্রদেশের অপরাপর কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলি করে দেওয়া হয়। মুজিব ভাই থেকে যান একা এক বিশাল ওয়ার্ডে। আমি ওই দফায় গ্রেপ্তার হই ঠিক যেদিন পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, দুপুরবেলায়। খেতে বসেছিলাম দেড় বছর কারারুদ্ধ থাকার পর। আগের দিন মুক্তি পেয়ে বাসায় আসি। পরদিনই আবার সরকারি আতিথ্য নিতে হলো, স্ত্রী-সন্তানদের রেখে।
এবার গ্রেপ্তার জন্মাদোষে। অর্থাৎ হিন্দুঘরে জন্ম নিয়েছিলাম তাই। পাকিস্তান সরকার যুদ্ধ লাগার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি অবস্থা দিয়ে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ জারি করে। পাশাপাশি নেতৃস্থানীয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের গ্রেপ্তার শুরু করে। অবশ্য ৮-৯ মাস পর অপর হিন্দু নেতাদের মুক্তি দেওয়া হলো। আর আমরা যারা ন্যাপ-সিপিবি করতাম, তাদের রেখে দেওয়া হলো। খুশি হয়েছিলাম, বাঁচা গেল, কারণ রাজনৈতিক পরিচয়টা পুনরুদ্ধার হলো। কিন্তু মুক্তি কবে পাওয়া যাবে, তা অনুমান করা যাচ্ছিল না। এমন সময় আমার স্ত্রী পূরবী মৈত্র এলো আমাদের ইন্টারভিউ নিতে। উৎসাহিত করল আমাকে ল’ পরীক্ষা দিতে। রাজি হলাম, বললাম নতুন পাস করা আইনজীবীদের জাছ থেকে সিলেবাস জেনে নিয়ে কিছু বইপত্র পাঠাতে। সে পাবনায় ফিরে সাধ্যমতো বই সংগªহ করে পাঠাল। আমাকে অনেক আগেই আরও কয়েকজন বন্দিসহ পাবনা জেলা কারাগার থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে গিয়েই পূরবী ইন্টারভিউ নেয়।
যা হোক, পরীক্ষা দিতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে, নিয়মিত কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তা জানিয়ে ওই মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত করতে হয়। ওই অনুমতি পাওয়ার পর উচ্চতম কারা কর্তৃপক্ষের (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস) কাছে দরখাস্ত করে পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন ও পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে আবেদন জানাতে হয়। এসব ফর্মালিটি শেষ হতে হতে কয়েক মাস লেগে গেল। সেই ফাঁকে পড়াশোনাও চলল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা জানানো হলো কতৃপক্ষকে। পরে আমাকে জানানো হলো, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের কারাগারগুলোর মধ্যে শুধু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পরীক্ষার কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সুতরাং সেখানে আমাকে বদলি করা হলো। তখন তো যমুনা সেতু নির্মিত হয়নি। তাই ট্রেনে সিরাজগঞ্জ-জগন্নাথগঞ্জ ফেরিতে যমুনা পার হতে হতো। সরাসরি ট্রেনে রাজশাহী থেকে ঢাকার ইন্টার-ক্লাস টিকিটের যাত্রী। সাথী তিন বন্দুকধারী পুলিশ, যার মধ্যে একজন সম্ভবত জমাদার-জাতীয় ছিলেন। পুলিশ দেখে ট্রেনের যাত্রীরা কেউ ভাবত চোর-ডাকত, কেউবা চোরাকারবারি প্রভৃতি। পরে কম্পার্টমেন্টের সবার ভুল ভাঙল যখন আমি একগাদা সংবাদপত্র কিনলাম এবং তাদের দু-একজনের সঙ্গে কথা বললাম। রাজবন্দি জানার পর কী যে সম্মান যাত্রীরা দিলেন, তা স্মরণীয়। তবে সেই আমলের মতো রাজবন্দিদের সম্মান আজ নাকি বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। কারণ সন্ত্রাসনির্ভর ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছে আমাদের রাজনীতি, এখান থেকে যখন নীতি-আদর্শ তিরোহিত হতে থাকে, তখন থেকে রাজবন্দিদের সম্মান-মর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়।
যা হোক, আমার সঙ্গে সঙ্গে এসকর্ট করা পুলিশরা পর্যন্ত চা-নাশতা-মিষ্টি পেয়ে গেলেন যাত্রীদের কাছ থেকে। আরও পেলাম দামি সিগারেটের কার্টন (তখন ধূমপানের অভ্যাস ছিল রীতিমতো)। ঢাকা পৌঁছালাম পরদিন সকাল ৮টার দিকে। জেলখানায় যেতে আরও ঘণ্টাখানেক। তখন ফুলবাড়ী স্টেশন ছিল ঢাকার স্টেশন। জেলখানায় গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই ডেপুটি জেলার, যিনি রাজবন্দিদের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, এলেন। দেখি তিনি পূর্বপরিচিত। চমৎকার ব্যবহার। কাগজপত্র সব জমা নিয়ে এসকর্ট পার্টিকে বিদায় দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে আমি কোন ওয়ার্ডে থাকতে চাই তা জানতে চাইলেন। জানালাম, এবার পরীক্ষা দিতে এসেছি। তাই পরীক্ষা পর্যন্ত জেনারেল ওয়ার্ডে যাব না। আমাকে নিরিবিলি পড়াশোনা করতে হবে, তাই কোনো সিটে দিলে ভালো হয়।
অতঃপর ঘণ্টাখানেক আরও অপেক্ষা করার পর ডেপুটি জেলার নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন সম্ভবত old 20 cells-এ; সেখানে ঢোকার গেটমুখী একটি সেল আমার জন্য বরাদ্দ। ইতিমধ্যেই তা ধুয়ে-মুছে একটি লোহার খাট, চেয়ার-টেবিল, খাবার জল, গস্নাস দেওয়া হয়েছে। বেলা প্রায় সাড়ে ১১ টা। কিছু কথাবার্তা বলে যাওয়ার সময় ডেপুটি জেলার বললেন, ‘আপনার এই সেলগুলোতে প্রবেশের প্রধান দরজা সর্বদা বন্ধ থাকবে। ভেতরে হাঁটাচলা করবেন। বললাম, ‘এটা তো শাস্তি’। হেসে ডেপুটি জেলার ‘উপায় নেই’, বলেই চলে গেলেন, ওই দরজাটাও তালাবন্ধ হয়ে গেল। স্নান সেরে বিছানা পেতে শুয়ে বিশ্রাম নিলাম। বেলা ১টার দিকে দুপুরের খাবার এলো। খেয়ে লম্বা ঘুম। রাতে ট্রেনে-স্টিমারে তো ঘুমাতে পারিনি তেমন একটা। বিকেল ৫টার দিকে এক সিপাহি এসে ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে বলল, বাইরে এসে দেখুন আপনার জন্য একজন অপেক্ষা করছেন। তাড়াতাড়ি উঠে হাত-মুখ ধুয়ে মূল দরজা খোলা পেয়ে বাইরে দেখি মুজিব ভাই দাঁড়িয়ে তার বিশাল বপু নিয়ে। হাতে সেই চিরচেনা চুরুট। হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ন্যাপ নেতাকেও গ্রেপ্তার করল? ন্যাপ তো আইয়ুবের পক্ষে।’ আমিও হেসে বললাম, ‘সেজন্যই তো আপনারও এক বছর আগে আমাকে ধরে এনেছে। ‘মুজিব ভাই বললেন, আরও কাউকে ধরেছে নাকি? বললাম অনেককে। সংখ্যায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর তিন গুণ হবে। খোঁজ নিয়ে দেখুন। উনি বললেন, বেশ চলুন এখন হাঁটা যাক।’
মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৫৩ সালে, পাবনায় আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত বগা ভাইয়ের বাড়িতে। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করি। ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল নিয়ে গিয়েছিলাম তার কাছে, ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার জন্য সব দলের (কমিউনিস্ট পার্টিসহ) একটি যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি ও মওলানা ভাসানী উদ্যোগী ভূমিকা নেন। তিনি বলেছিলেন, মওলানা সাহেব ও তিনি এ ব্যাপারে একমত। তবে শহীদ সাহেব (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। সেটা সফল হলে যুক্তফ্রন্ট হয়ে যাবে। আমরা বলেছিলাম, সফল তো হতেই হবে, নইলে আমরা ছাত্রসমাজ ছাড়ব না। এভাবে এরপর যতবারই তিনি পাবনা এসেছেন, ততবারই সাক্ষাৎ হয়েছে, অন্তরঙ্গভাবে আলাপ-আলোচনাও হয়েছে। পাবনায় তখন ছাত্র ইউনিয়ন ছিল প্রধান ছাত্র সংগঠন-ছাত্রলীগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ফলে তা বুঝতে পেরে সেভাবে তিনি গুরুত্ব দিতেন। মওলানা ভাসানীর তো কথাই নেই। তিনি তো ছাত্রলীগের চেয়ে ছাত্র ইউনিয়নকেই তার আপন বলে মনে করতেন, মূলত ছাত্র ইউনিয়নের অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সমাজতন্ত্রকামী নীতির জন্য।
১৯৬২ সালে বা তার কিছু পর যখন এনডিএফ গঠিত হয়, তখন মুজিব ভাই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাবনা আসেন জনসভা করতে। সেই জনসভার শুরুতে উপস্থিত বিশাল জনতাকে সামাল দিতে মাইক আমার হাতে দেওয়া হয়। আমরা মুহুমুহু সেস্নাগান তুলি ‘মওলানা ভাসানীর মুক্তি’, ‘এক ইউনিট’, ‘সিয়াটো-সিন্টে চুক্তি বাতিল’ প্রভৃতি দাবিতে। নেতারা ছিলেন সার্কিট হাউজে আর জনসভা ওই ভবনের সামনে পাবনা স্টেডিয়ামে। নেতারা মঞ্চে এলে তাদের স্বাগত জানাই; আমরা দিচ্ছি জিন্দাবাদ প্রভৃতি ; কণ্ঠে আরও ছিল মওলানা ভাসানীর মুক্তি, সাম্রাজ্যবাদ ও এক ইউনিট বিরোধিতা। স্লোগানগুলো শুনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মনে মনে ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন। সে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটালেন সভা শেষ হলে সার্কিট হাউজে ফিরে গিয়ে। সেখানে তিনি মুজিব ভাইকে ডেকে বললেন, ওই স্লোগানগুলো কেন এত দেওয়া হলো? মুজিব ভাই বাইরে এসে বারান্দায় আমার কাছে কৌশল করে বিষয়টি জানতে চাচ্ছিলেন। বললাম, স্লোগানগুলোর প্রতিটি পাবনা এনডিএফ কমিটিতে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত। আপনি প্রয়োজনে ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেবকে জিজ্ঞেস করুন। তিনি তাই করলেন। মনসুর সাহেব স্বীকার করলেন। তা শহীদ সাহেবকে জানালে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘What is their members?’ আমি তখন ওনার রুমের কাছাকাছি। তাই নিজেই জবাব দিলাম, ‘not less than Awami Leage’...তিনি এই জবাব শুনে ফুঁসতে থাকলেন।
যা হোক, অতঃপর পাবনা থেকে পরদিন তাদের সঙ্গেই আমি উত্তরবঙ্গ যাব ‘সংবাদ’-এর পক্ষ থেকে তাদের টু¨র কাভার করার জন্য। সারা পথ ট্রেনে। নানা জায়গায় এডিএফ নেতাদের এ সফর উত্তরবঙ্গের মানুষ ও বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের মনে সামরিক শাসনবিরোধী জোয়ারে সঞ্চার করেছিল। আর সংবাদে আমার রিপোর্টি দেখে মুজিব ভাই তো বেজায় খুশি। তিনি যাত্রাপথে সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিতে তাদের কামরায় ছুটে আসতেন, কোনো সমস্যা আছে কি না জানতে চাইতেন। হাতে করে আনতেন সংবাদ ও ইত্তেফাক। ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতার সামনেই বলতেন, ‘সংবাদের রিপোর্টটিই হচ্ছে বেস্ট’। যা হোক, এবার জেলখানার প্রসঙ্গে চলে আসি। প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটতে হাঁটতে শেষে আমার লকআউটের সময় এসে যাওয়ায় দুজন মিলে হাঁটা বন্ধ করতে হলো। মুজিব ভাই চলে গেলেন তার দেওয়ানি ওয়ার্ডে (বলা হতো দেওয়ানি ফটক)। গিয়ে তিনি দুখানি খবরের কাগজ পাঠিয়ে দিলেন। ওই পড়তে পড়তে আহার শেষ করে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে উঠে হাতমুখ ধুয়ে এক পেয়ালা চা মুখে দিতেই দরজার ওপাশে মুজিব ভাই এসে হাজির। বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। মুজিব ভাই দেশের কোনো খবর জানা আছে কি না, ঢাকায় আমার পক্ষে লোকজন কী বলল জানতে চাইলেন। আমি জানালাম, ক্রমেই মানুষ আইয়ুব সরকারের বিরোধী হয়ে উঠছে এবং ছয় দফার সমর্থনে এসে শামিল হচ্ছে। শিগগির একটা বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হলো, যদি আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ যৌথভাবে আহ্বান জানায়। তিনি বললেন, যৌথভাবে আহ্বান করা সম্ভব হবে কি না জানি না, তবে আওয়ামী লীগ যাতে আহ্বান জানায় সে চিন্তায় আছি। যে ভয়ংকর অত্যাচারী শাসক সে, তাই সংগঠিত হাতে সময় লাগতে পারে। তবে উভয়ের মধ্যে কথা থাকল দলীয় উৎস থেকে কোনো গোপন খবর এলে তা আমরা পরস্পর রক্ষা করব।
ন্যাপ তখনো অবিভক্ত, যদিও ভেতরে-ভেতরে রুশ-চীন মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে ভাঙনের সুর বেজে চলছিল। বাংলাদেশে যারা চীনের মতাদর্শের সমর্থক ছিলেন, জাতীয় রাজনীতিতে তারা সামরিক শাসক আইয়ুবকে সমর্থন দিয়ে বসায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। অন্যপক্ষে ন্যাপের বিশাল অংশ সমর্থন করতেন রুশ মতাদর্শ এবং জাতীয় রাজনীতিতে তারা সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রবিরোধী, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী। তাই দেখা গেল চীনপন্থি নামে অভিহিতরা উগ্র আওয়ামী লীগবিরোধী; অন্যপক্ষে রুশপন্থিরা আওয়ামী লীগের বহুদিকের বিরোধী হলেও গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠায় নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রত্যয়ী। ১৯৬৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাপ বিভক্ত হয়। চীনপন্থিরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এবং রুশপন্থিরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয়। স্বল্পকালের মধ্যেই এটি সমগ্র পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
বিরোধ দেখা দেয় মুজিব ভাইয়ের ছয় দফা কর্মসূচির প্রশ্নে। চীনাপন্থিরা আইয়ুবের সুরে ওই কর্মসূচিকে মার্কিনি ষড়যন্ত্র এবং পাকিস্তানের সংহতিবিরোধী বলে প্রচার করে। আর রুশপন্থিরা একে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের অনুসারী বলে তার প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু ১৯৬৬ সালে আনুষ্ঠানিক বিভক্তি না হওয়ায় রুশপন্থি ন্যাপ নেতারা ব্যক্তিগতভাবে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে ছয় দফা কর্মসূচিতে সমর্থন জানান। এ কথা মুজিব ভাইকে খোলামেলা বলে আমি নিজেও সেই মতের অর্থাৎ রুশপন্থি মতবাদের অনুসারী বলে উল্লেখ করল তিনি বিস্মিত ও আনন্দিত হন। যাই হোক, এভাবে দিন চলতে থাকল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঘোষণা করা হলো ৭ জুন আওয়ামী লীগ বন্দিমুক্তি ও অপরাপর দাবিতে হরতাল আহ্বান করেছে। খবরটি সংবাদপত্র মারফত আমরা জানতে পেলাম। দিবসটি ছয় দফা দিবস হিসেবেও কোনো কোনো সংবাদপত্রে উল্লিখিত হয়।
ইতিমধ্যে মে মাস থেকেই আমার ল’ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ৭ জুন তারিখের একটি পরীক্ষা হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃ©পক্ষ পূর্বাহ্ণেই জানিয়ে রেখেছে। দিনটি যতই কাছে আসতে লাগল, আওয়ামী লীগের ওপর সরকারি নির্যাতন-নিপীড়নও বাড়তে থাকল। ওইদিন হরতাল, মিছিল ও জনসভার কর্মসূচি ছিল। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়ালের বাইরে থেকে সহস্রকণ্ঠে যখন সেস্নাগান ধ্বনিত হতো ‘জয় বাংলা’, ‘জাগো বাঙালি জাগো’–কারাপ্রকোষ্ঠে লকআপে বসেও আমরা উজ্জীবিত হতাম। এভাবে ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোর নিয়ন্ত্রক বরাবর দরখাস্ত করলাম যেহেতু জনগণ ৭ জুন হরতাল বা কর্মবিরতি ডেকেছে, তাই তার সমর্থনে আমি ওইদিনকার পরীক্ষা দিতে বিরত থাকব। জমাদ্দারের হাতে দরখাস্ত দিয়ে অফিসে পাঠালাম। কিন্তু জমাদার অফিসে যাওয়ার পথে মুজিব ভাইয়ের ওয়ার্ডে গিয়ে সালাম জানাতেই তিনি দরখাস্তটি পড়ে জমাদার সাহেবকে বলে পাঠালেন আমি যেন দরখিস্তটি প্রত্যাহার করে নিই, কারণ পরীক্ষার সঙ্গে সারা জীবনের ক্যারিয়ারের প্রশ্ন জড়িত। আন্দোলনের জন্য তো সারাটি জীবনই রয়েছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে তার কথা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললাম, জনগণ আন্দোলনে থাকবে আর আমি নিজের ক্যারিয়ারের জন্য আরামে বসে পরীক্ষা দেব, তা হবে না। দরকার হলে পরের বছর পরীক্ষা দেব–এই বলে জমাদার সাহেবকে দ্রুত দরখাস্তটি অফিসে নিয়ে জমা দিতে বললাম। ছুটে এলেন ডেপুটি জেলার। তাদেরও একই অনুরোধ। আমি তা মানতে অপারগতা জানিয়ে দ্রুত দরখাস্তটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বললাম। তারা অফিসে ফেরত গিয়েই দরখাস্তটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
বিকেলে হাঁটার সময় মুজিব ভাই প্রসঙ্গটি তুলে বললেন, কাজটি কিন্তু ভালো হলো না। আমার ভিন্নমত পুনরায় তাকে জানালাম। উনি বললেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতা তো পরীক্ষা দেওয়া থেকে বিরত থাকবে না। সেখানে অন্তত নিজ দলের অনুমতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। বললাম, তারাও তো সম্ভবত আপনার অনুরূপ পরামর্শই দিতেন। পরে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আসলে আমার তো ছয় দফা না, এক দফা। স্বাধীন বাংলা।’ উত্তরে বললাম, ‘পারবেন না। কারণ আপনার কেবলা তো আমেরিকামুখী। তারা কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কদাপি সমর্থন করেনি, করবেও না।’ হেসে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমেরিকাই বটে তবে ভায়া ইন্ডিয়া।’ বললাম, ‘ইন্ডিয়ার কিছু লবি আছে, তাই তাদের মাধ্যমে রুশ শরণাপন্ন হোন।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘দেখা যাক।’ অতঃপর ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ হলো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে তা প্রত্যক্ষ করলেন। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বিজয়ীর বেশে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সম্ভবত ফেব্রম্নয়ারি মাসের কোনো এক দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি পাবনা সফরে এলেন। পাবনাবাসীর পক্ষ থেকে তাকে হেলিকপ্টারে থেকে নামার পর প্রায় হাজারখানেক অভ্যর্থনাকারীর অন্যতম হিসেবে পাবনা স্টেডিয়ামে আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে, তবে একটু পেছনের দিকে তৃতীয় সারিতে।
বঙ্গবন্ধু রুশপ্রদত্ত হেলিকপ্টার থেকে নেমে পুলিশের আনুষ্ঠানিকতা শেষে অভ্যর্থনাকারীদের প্রথম সারি থেকে করমর্দন করতে লাগলেন। হঠাৎ আমার ওপর চোখ পড়তেই লাইন ও কর্ডন ভেঙে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘ আলিঙ্গন শেষে বললেন, ‘কী, বলেছিলাম না দেশ স্বাধীন করে ছাড়ব?’ উত্তরে আমিও বললাম, ‘আপনার মার্কিনি কেবলার সহযোগিতায় বিজয় অর্জিত হয়নি, হয়েছে আমার বলা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায়।’ হেসে বললেন, ‘কথাটি পাঁচ বছর আগে ঢাকা জেলে হয়েছিল। আজও মনে আছে দেখছি।’ বললাম, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনিই এত দিন পর তা মনে করিয়ে দিলেন।’
এবার আবার ফিরে যাই সেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এক দিনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। তবে দিন-তারিখ মনে নেই। বিকেল ৪টার দিকে একটা সিস্নপ হাতে হেড ওয়ার্ডার এলেন, আমার হাতে দিলেন দেওয়ার জন্য। দেখি তাতে লেখা আছে–‘ফর ইন্টারভিউ মি, রণেশ মৈত্র, সিকিউরিটি প্রিজনার।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার সঙ্গে ইন্টারভিউ?’ হেড ওয়ার্ডার বলেন, ‘তা কিছু বলেনি।’ কাপড়-চোপড় পরে ডিটেনশন অর্ডারটা হাতে নিয়ে চললাম রাজবন্দিদের ইন্টারভিউ রুমে। ঢুকতেই দেখি, মুজিব ভাই বসা। সামনে বসে আছেন এক মহিলা তার কিশোরীকন্যাকে নিয়ে। তবে দুজনের কাউকে চিনি না। আর এক কোনায় বসে আছেন আমার বাল্যবন্ধু ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। তিনিই এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তার দিকে পা বাড়াতেই মুজিব ভাই একটু দাঁড়াতে বলে ভাবির দিকে ইশারা করে বললেন, ‘আপনার ভাবি।’ আমি তাকে সশ্রদ্ধ সালাম জানালাম। আর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের মেয়ে হাসিনা।’ বলেই মেয়েকে বললেন, ‘ইনি তোমার চাচা, রণেশ মৈত্র। পাবনার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা। বয়সে জুনিয়র হলেও আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। সালাম করো।’ হাসিনা এগিয়ে আসতেই বললাম, ‘তুমি অনেক বড় নেতার মেয়ে, নিজেও ভবিষ্যতে বড় হবে আশা করি। সেভাবে নিজেকে গড়ে তোলো।’
লেখক: একুশে পদক জয়ী সাংবাদিক, রাজনীতিক ও কলামনিস্ট
‘গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সঙ্গে আমি পরিচিত। এখানকার স্কুলে লেখাপড়া করেছি, মাঠে খেলাধুলা করেছি, নদীতে সাঁতার কেটেছি, প্রতিটি মানুষকে আমি জানি আর তারাও আমাকে জানে।...এমন একটা বাড়ি হিন্দু-মুসলমানের নাই, যা আমি জানতাম না। গোপালগঞ্জের প্রত্যেকটা জিনিসের সঙ্গে আমার পরিচয়। এ শহরের আলো-বাতাসে আমি মানুষ হয়েছি। এখানেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছে।...থানার দুপাশে দোকান, প্রত্যেকটা দোকানদারের নাম আমি জানতাম। সবাইকে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে করতেই থানার দিকে চললাম।’
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৭৬-১৭৭
গোপালগঞ্জ শহরের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা এভাবে নিজেই বলে গেছেন বঙ্গবন্ধু। এখানকার মানুষের কাছেও তিনি এক ধরনের ঘরের মানুষ। স্থায়ী বয়স্ক বাসিন্দা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কাউকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে দেখা যায় তাদের প্রায় প্রত্যেকের স্মৃতিতে একজন ‘উঁচা, লম্বা, ইয়া বড়, বিশাল, দীর্ঘ’ হয়ে তিনি বিরাজ করছেন, যিনি তাদের সেই শৈশব, কৈশোর বা তারুণ্যের সময় একবার অন্তত নাম ধরে ডেকেছিলেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন বঙ্গ বন্ধু হয়ে ওঠেননি, তারও আগে থেকে তার সঙ্গে এ এলাকার মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। স্কুলের দুরন্ত বালক থেকে তুখোড় ছাত্রনেতা, জাতীয় নেতা থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ও রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠা বঙ্গ বন্ধুকে তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের সঙ্গে এই এলাকার মানুষের পরিচয়টা অনেক নিবিড়। মজার বিষয় হলো, বঙ্গ বন্ধু তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তার এলাকার মানুষের সামান্য প্রয়োজন, সংকট ও আয়োজনে সাড়া দিয়ে অসামান্য হয়ে আছেন, আজও। তারই এক ছোট্ট উদাহরণ দিলেন, গোপালগঞ্জের ব্যাংকপাড়ার বাসিন্দা আজিজুল হক। তার দাদার সঙ্গে বঙ্গ বন্ধুর বাবার পাশাপাশি জমি থাকার কারণে, জমি-সংক্রান্ত কাজে পরস্পরের সঙ্গে চিঠি চালাচালি হতো। সেই সূত্রে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পারিবারিক ফার্মেসির লাইসেন্সের জন্য স্বয়ং বঙ্গ বন্ধুর কাছে ছুটে যান আজিজুল হকের বাবা মঞ্জুরুল হক। এত ছোট বিষয় নিয়ে তার দ্বারস্থ হওয়ায় একটুও বির ক্ত হননি বঙ্গ বন্ধু। এ ছাড়া বঙ্গ বন্ধু গোপালগঞ্জে এলে রাস্তাঘাটে দেখা হলেও মঞ্জুরুল হকের সঙ্গে কয়েকবার কুশলবিনিময় করেছেন।
মুজিববর্ষে গোপালগঞ্জবাসীর ভাবনার কথা জানতে গিয়ে উঠে এসেছে এমনই সব টুকরো টুকরো ঘটনা, আপাতদৃষ্টিতে হয়তো যার অনেকগুলোই তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তবু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ব্যি ক্ত মানুষের জীবনে কতটা ওতপ্রোতভাবে আজও জড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে যারা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাদের বেশির ভাগই আজ আর বেঁচে নেই। যারা বেঁচে রয়েছেন তাদের বেশির ভাগই এখন জীবন-সায়াহ্নে। তাদেরই একজন টুঙ্গি পাড়ার আবদুল হামিদ। বঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে একই স্কুলে পড়েছেন তিনি, কয়েক ক্লাস নিচে। স্কুল ছুটির পর, দল বেঁধে যাদের সঙ্গে গাছ থেকে আম পেড়ে খেতেন বঙ্গবন্ধু, তাদের মধ্যে আবদুল হামিদও থাকতেন। এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, চোখেও দেখেন না। বঙ্গ বন্ধুর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি আবেগি হয়ে পড়লেন– ‘দেখা হলেই কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরতেন, এই কেমন আছিস! সবার প্রতিই এমন মহব্বত ছিল তার। ফুটবল খেলায় তিনি ছিলেন এক নম্বর, তার সঙ্গে কেউ পেরে উঠত না, হেড দিয়েই গোল করতে পারতেন’। রাজনীতিক হিসেবে, বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে বঙ্গ বন্ধুর দৃঢ়সংকল্পের কথা জানা গেল শহরের প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তি ত্ব ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যাংকপাড়ার মিটু সর্দারের কাছে। তৎকালীন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের গোপালগঞ্জ সফরের সময়কার একটি ঘটনা তিনি তুলে ধরেন। খাজা নাজিমুদ্দিন আগমনে প্রটোকল দেওয়ার নামে এলাকাবাসীর কাছ থেকে চাঁদা তুলছিল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ও প্রশাসন। এ ঘটনা জানতে পেরে বাধা দেন বঙ্গ বন্ধু। মিটু সর্দারের বর্ণনায়, ‘বঙ্গ বন্ধু তখন বললেন এই টাকা উনি নিয়ে যেতে পারবেন না। এই নিয়ে অনেক মিটিং হলো, আলোচনা হলো। শেষ পর্যন্ত সত্যিই উনি এই টাকা কিছুতেই নিয়ে যেতে দিলেন না। এই টাকা দিয়ে কলেজ হলো, কোর্ট মসজিদ হলো।’
ঘটনাটির উল্লেখ বঙ্গ বন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও আছে। এই কোর্ট মসজিদেই পরে সদ্য গঠিত আওয়ামী লীগের ঢাকার বাইরে অনুষ্ঠিত প্রথম সভা হয়েছিল। সেটিও এক দারুণ উত্তেজনার ঘটনা। জনসভা বন্ধ করার জন্য মসজিদের ভেতরে ১৪৪ ধারা জারি করে পাকিস্তান সরকার। কিন্তু এলাকাবাসী তা উপেক্ষা করেই লাঠিসোঁটা হাতে জড়ো হয় জনসভায়। বিপদেরআশঙ্কায় পুলিশ বঙ্গবন্ধুকেই অনুরোধ করে, তিনি যাতে তাদের সরে যেতে বলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী জনসভায় বক্তৃতা করার পরই সমর্থকদের মসজিদ প্রাঙ্গণ ছেড়ে যেতে আহ্বান জানান তিনি। মিটু সর্দার বলেন, ‘উনি তো বিশাল মানুষ, শারীরিকভাবেও। ছোটবেলা থেকেই ওনাকে দেখেছি। মুজিব ভাই বলে ডাকতাম। ওনার সঙ্গে মেশার তেমন সুযোগ হয়নি, কিন্তু ওনার ছোট ভাই শেখ নাসেরের সঙ্গে ওঠাবসা করেছি। আমি যখন স্কুলে পড়ি, তার অনেক আগে থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ওনার তৎপরতা দেখেছি, ৫৪ সালের নির্বাচনের সময়ও দেখেছি। গোপালগঞ্জ থেকে উনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তখন। সে সময় থেকেই ওনার বক্তৃতা শোনার জন্য মানুষের খুব আগ্রহ ছিল, বড় কোনো জমায়েতে বক্তৃতা দিলে অনেক মানুষ জড়ো হতো। এখন যেখানে স্টেডিয়াম হয়েছে, সেখানে তখন একটা মাঠ ছিল, আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাকে বক্ত …তা দিতে দেখেছি কতবার! তখন তো মুসলিম লিগের দাপট অনেক, তার মধ্যেও অনেক মানুষ ছিল, যারা তার সমর্থক ছিল, বিশেষ করে যারা তরুণ, তাদের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তরুণদের একটা বড় অংশ মুজিবভক্ত ছিল। ৫৪ সালের সে নির্বাচনে মুসলিম লীগের একেবারে ভরাডূবি হয়। মুসলিম লীগের এত প্রভাব-প্রতিপত্তি সত্ত্বেও, শুধু শেখ সাহেবের কারণে তাদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতিই ছিল না, উনি ছাড়া আর কোনো নেতার ওই অর্থে সেই লিডারশিপ ছিল না। সংগঠক হিসেবে তার অসাধারণ দক্ষতার পাশাপাশি আরেকটি যে গুণ ছিল, সেটি তার স্মৃতিশক্তি। সারা দেশ ঘুরে রাজনীতি করেছেন তিনি, কারও সঙ্গে একবার আলাপ হলে অনেক বছর পরও তিনি সেটা মনে রাখতেন। দেখা হলে নাম-ঠিকানা নির্ভুল বলে দিতে পারতেন, এ ধরনের তীক্ষ্ণ স্মৃতিশি ক্ত ছিল তার।’ গোপালগঞ্জের এই প্রবীণ আইনজীবী বলেন, ‘তারপর ৬৮-৬৯-এর দিকে এলো ছয় দফা আন্দোলন। আমি তো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম ৬২ সাল থেকে, বাম রাজনীতি। মোজাফ্ফর সাহেবের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। মুক্তি যুদ্ধের সময় তিনটা রাজনৈতিক দল ছিল, এক আওয়ামী লীগ, আরেকটা কমিউনিস্ট পার্টি, আরেকটা হলো ন্যাপ। ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো শক্তি। তখন আমি কাছ থেকে দেখেছি বঙ্গ বন্ধুকে। একজন মহান নেতা। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। আমরা সরাসরি যদিও ওনার দল করি নাই, তবে ওনার খুব ভক্ত ছিলাম। এখনো।’ গোপালগঞ্জের ব্যাংকপাড়ার আরেক প্রবীণ বাসিন্দা নান্না মিয়ার কাছে বঙ্গ বন্ধুর কথা জানতে চাইলে, শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে তিনি একটি জনসভার কথা বলেন। সংগত কারণেই, সদ্য স্ট্রোকের আঘাত সামলে ওঠা অশীতিপর এই বৃদ্ধ এখন আর সেই সভার সঠিক দিন-তারিখ মনে করতে পারেন না। তবে তিনি এইটুকু মনে করতে পারেন, সেদিন আসলে জনসভা ছিল মুসলিম লীগের। বেশ কিছুদিন ধরেই সেই সভার প্রচারণা চালিয়ে আসছিল তখনকার অত্যন্ত প্রভাবশালী দলটি। অন্যদিকে, বঙ্গ বন্ধু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হঠাৎ করেই একই দিন একই সময়ে পাল্টাপাল্টি জনসভার ডাক দিলেন। তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই, আমতলার মাঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন তিনি। তার সেই দৃপ্তকণ্ঠ, অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা শুনে মুহূর্তে ভরে যায় মাঠ। নান্না মিয়ার কথায়– ‘মুসলিম লীগের জনসভা ভেঙে মানুষ তখন ছুটে যেতে থাকে বঙ্গ বন্ধুর ভাষণ শুনতে।’
মুজিববর্ষে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজতে খুঁজতে থানা পাড়ার রশিদা খানমের কাছে যাই। তিনি বঙ্গ বন্ধুর দূরসম্পর্কের মামা, আবদুর রাজ্জাক খানের মেয়ে। গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি কমরেড ফরহাদের শ্বশুর তিনি, অর্থাৎ কমরেড রীনা খানের বাবা। যিনি রাজা মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন।
রশিদা খানমের বাবা ও তার পরিবারে কথা আমরা বঙ্গ বন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও পাই–
“থানার পাশেই আমার এক মামার বাড়ি। তিনি নামকরা মোক্তার ছিলেন। তিনি আজ আর ইহজগতে নাই। আবদুস সালাম খান সাহেবের ভাই। আবদুর রাজ্জাক তার নাম ছিল। অনেক লেখাপড়া করতেন, রাজনীতিও তিনি বুঝতেন। তাকে সবাই ভালোবাসত। এ রকম একজন নিঃস্বার্থ দেশসেবক খুব কম আমার চোখে পড়েছে...একজন আদর্শবাদী লোক ছিলেন। তার মৃত্যুতে গোপালগঞ্জ এতিম হয়ে গেছে বলতে হবে। লোকে তাকে খুব ভালোবাসত ও বিশ্বাস করত...তাকে লোকে ‘রাজা মিয়া’ বলে ডাকত। আমি রাজা মামা বলতাম।’
–অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৭৭
আবদুর রাজ্জাকের পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আরও বলা হয়েছে– তিনি যখন গোপালগঞ্জে এক মামলার জন্য হাজিরা দিতে যেতেন, তখনকার কথা।
‘আবার পরের মাসে তারিখ পড়ল। আমি আগের মতো থানায় ফিরে এলাম। দুদিন সকাল ও বিকেলে সবার সঙ্গে দেখা হলো। রাজা মামা ও মামি কিছুতেই অন্য কোথাও খাবার বন্দোবস্ত করতে দিলেন না। মামি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। নানিও আছেন সেখানে। আমার খাবার তাদের বাসা থেকেই আসত।’ (–অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৯০)
সেই ঘনিষ্ঠতার কথাই জানা গেল রশিদা খানমের কথায়– ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের খুব আপন লোক, আমাদের আত্মীয়। উনি আমার ফুপাতো ভাই, আমার দাদি আর ওনার নানি দুই বোন ছিলেন। আমার নানির বড় বোনের ছেলে হলেন বঙ্গবন্ধু। ওনার নানির মা আমার দাদির বড় বোন। উনি আগে এই গোপালগঞ্জ থানাপাড়ায় ভাড়াবাসাতে থাকতেন। পরে ব্যাংকপাড়ার দিকে একটা বাসা করেছিলেন। আমার আব্বা বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক ছিলেন, আমার আব্বা তাকে খুব স্নেহ করতেন। আব্বাকে উনি মামা বলে ডাকতেন, আমার আম্মাকে মামি। আমার দাদি ওনার নানি হতেন। এই ছিল আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক। আমার আব্বা অনেক আগে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালে তিনি মারা যান। আব্বার মৃত্যুর পরও বঙ্গ বন্ধু পরিবারের সঙ্গে আমাদের অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার মনে পড়ে, একবার জেল থেকে বেরিয়ে তাকে যখন গোপালগঞ্জের মানুষ ফুলের মালা দিয়ে বরণ করল, উনি লোকজন নিয়ে আমাদের এই কাছারিঘরে এসেছিলেন। সবার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর উনি আমাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে এখানেই ঘুমাতেন।’
‘বঙ্গবন্ধু যখন গোপালগঞ্জ কারাগারে ছিলেন, সেটা উনিশশত ষাট সালেরও আগে, তখন আমার আম্মা তিনবেলা ওনাকে খাবার পাঠাতেন। আমাদের বাসা থেকে থানা বেশি দূর না, দুই মিনিটের পথ। আমাদের পরিবারের সঙ্গে বঙ্গ বন্ধুর সব সময়ই এ রকমই ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার আব্বার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে অনেক আলাপ করতেন উনি। উনি তো খুব অন্যরকম মানুষ ছিলেন। আমার আব্বার সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল, তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লেই তা বোঝা যায়। কোনো বিষয়ে পরামর্শ দরকার হলে বা কোনো কিছু জানতে হলে তিনি আব্বার কাছে আসতেন। আব্বার ওপর ভরসা করতেন। সেটা অবশ্য মুক্তি যুদ্ধের অনেক আগের কথা। আর একাত্তরে আমরা তখন ঢাকায় থাকতাম। মুক্তি যুদ্ধের পর ১০ জানুয়ারি উনি যখন দেশে ফিরলেন, আমার দুই ফুফু আর আম্মা তখন তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। উনি আমাদের খুব আপ্যায়ন করেছিলেন। আমার মাকে তিনি মায়ের মতোই দেখতেন। যদিও আমার মা বয়সে বঙ্গ বন্ধুর চেয়ে ছোটই ছিলেন।’
‘আমাদের বাসায় বঙ্গ বন্ধুর লেখা দুটি মূল্যবান চিঠি ছিল। আমার আব্বাও তাকে চিঠি লিখতেন। কারাগারের বন্দিত্বের সময়টায় তাকে বই পড়ার পরামর্শ দিতেন। তো বঙ্গ বন্ধু একবার উত্তর লিখেছিলেন, মামা আপনি সব সময় আমাকে বই পড়ার উৎসাহ দিতেন, কিন্তু ‘আমি সময় পেতাম না। এখন আমি জেলে এসে সে সময়টা পেয়েছি, বই পড়ছি।’
“আমার আব্বা সবারই খুব প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। উনি যখন মারা যান, তখন আমার ১৫ বছর বয়স। ছোট ছিলাম, ফলে বঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে খুব বেশি কথা হওয়ার সুযোগ ছিল না। খুব বেশি মনেও নেই। পরে অবশ্য ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসায় অনেক গিয়েছি। আমাদের খুব স্নেহ করতেন। আমার আব্বার কথা বলতেন। একবার আমার ভাইকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাবর রে, মামা যখন শেষ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেছেন, তখনো আমাকে চিঠি লিখেছেন।’ কিন্তু ‘দুর্ভাগ্যের বিষয়, ওইসব চিঠি আমরা সংরক্ষণ করতে পারিনি।”
এমনকি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও উনি গোপালগঞ্জে এলে প্রথমেই আমাদের বাসায় এসে আম্মার সঙ্গে দেখা করতেন, যত দিন বেঁচে ছিলেন, তাই করেছেন। ওনার স্ত্রীও আসতেন। আমার মনে আছে, তার গায়ের রং খুব ফর্সা ছিল, অনেক লম্বা চুল ছিল, গড়ন ছিল চিকন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে শুধু শেখ কামাল তার সেই রং পেয়েছিলেন। ছোটবেলায় তাদের দেখেছি। দেশের প্রধান হওয়ার পরও আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিতে কখনো ভোলেননি বঙ্গ বন্ধু। সবার খেয়াল রাখতেন, কে কেমন আছে।
বঙ্গবন্ধুর গোপালগঞ্জের ব্যাংকপাড়ার বাড়ির ঠিক পাশের বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন নূরজাহান আক্তার। জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া নূরজাহান আক্তারতার শৈশবে দেখা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যে অনেক দীর্ঘকায় ছিলেন, তার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘অনেক বড় ছিলেন তিনি। বাড়ির দেয়ালের ওপর দিয়েও তাকে দেখা যেত। আর যখন বাড়ি আসতেন, অনেক লোকজন থাকত তাকে ঘিরে। উনি এত লম্বা ছিলেন যে, দূর থেকে ওনাকে দেখতে পেতাম, আর অনেক লোকজনের আলাপ করত, শোরগোল শুনতাম, তবে কথা বুঝতে পারতাম না।’
শৈশবে দেখা অনেক কিছুই মানুষের কাছে অনেক বিশাল বলে মনে হয়, বড় হওয়ার পর যা ধরা দেয় স্বাভাবিক আকার নিয়ে। কিন্তু ‘শৈশবে নূরজাহান আক্তারের কাছে যাকে ‘অনেক বড়’ বলে মনে হয়েছিল, জন্মের একশ বছর পরও সেই মানুষটি ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষকে, বাঙালি জাতিকে। বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মহান নেতা ফিদেল কাস্ত্রো যেমন বলেছিলেন–‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি’।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
লেখাটি তৈরি করতে লেখককে সহায়তা করেছেন দেশ রূপান্তরের গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি রাজীব আহমেদ রাজু
১. আগুন যাকে ছোঁয় না...
বাংলা ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থরাজির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থগুলোর একটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। বাংলার বাইরেও ইংরেজি, উর্দু, স্পেনিশ, জার্মান, চীনা, জাপানিসমেত অনেকগুলো ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে। আরও বহু ভাষাতে অনুবাদের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, এই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পান্ডুলিপিসমেত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত অজস্র দলিলপত্র ও নথি একদা পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল তার প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে। প্রথমবার তা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে, তারা ২৬ মার্চ আবার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে তার বাসভবন লুণ্ঠন করে। তার লেখা আত্মজীবনীর কাগজপত্রগুলোকে তাদের কাছে ততটা মূল্যবান মনে হয়নি, সেগুলো তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে গিয়েছিল। শত্রুকবলিত সেই বাড়িটি থেকে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলের সঙ্গী হয়ে সেই রুলটানা খাতাগুলো উদ্ধার করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই স্মৃতিচারণ তিনি করেছেন কারাগারের রোজনামচার ভূমিকায়–
আমার মা আমাকে বললেন, ‘একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক, তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস।’ খাতাগুলো মার ঘরে কোথায় রাখা আছে, তাও বলে দিলেন। আমাদের সঙ্গে মিলিটারির দুটি গাড়ি, ভারী অস্ত্রসহ পাহারাদার গেল।
২৫ মার্চের পর এই প্রথম বাসায় ঢুকতে পারলাম। সমস্ত বাড়িতে লুটপাটের চিহ্ন, সব আলমারি খোলা, জিনিসপত্র ছড়ানো-ছিটানো। বাথরুমের বেসিন ভাঙা, কাচের টুকরা ছড়ানো, বীভৎস দৃশ্য!
বইয়ের শেলফে কোনো বই নাই। অনেক বই মাটিতে ছড়ানো, সবই ছেঁড়া অথবা লুট হয়েছে। কিছু তো নিতেই হবে। আমরা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাই, পাকিস্তান মিলিটারি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যায়। ভাই-বোনদের বললাম, যা পাও বইপত্র হাতে হাতে নিয়ে নাও।
আমি মায়ের কথামতো জায়গায় গেলাম। ড্রেসিং রুমের আলমারির ওপর ডানদিকে আব্বার খাতাগুলো রাখা ছিল, খাতা পেলাম কিন্তু ‘ সঙ্গে মিলিটারির লোক, কী করি? যদি দেখার নাম করে নিয়ে নেয়, সেই ভয় হলো। যা হোক, অন্য বই-খাতা কিছু হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে একখানা গায়ে দেওয়ার কাঁথা পড়ে থাকতে দেখলাম, সেই কাঁথাখানা হাতে নিলাম, তারপর এক ফাঁকে খাতাগুলো ওই কাঁথায় মুড়িয়ে নিলাম।
আমার মায়ের হাতে সাজানো বাড়ির ধ্বংস স্তুপ দেখে বারবার চোখে পানি আসছিল কিন্তু‘ নিজেকে শক্ত করলাম। খাতাগুলো পেয়েছি এইটুকুই বড় সান্ত্বনা। অনেক স্মৃতি মনে আসছিল।
যখন ফিরলাম মায়ের হাতে খাতাগুলো তুলে দিলাম। পাকিস্তানি সেনারা সমস্ত বাড়ি লুটপাট করেছে, তবে রুলটানা এই খাতাগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি বলেই খাতাগুলো পড়েছিল।
‘আব্বার লেখা এই খাতার উদ্ধার আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরাধের ফসল।’ (শেখ হাসিনা রচিত ভূমিকা, কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৮-৯, বাংলা একাডেমি, ২০১৭)
ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার একটি পর্যালোচনায় উল্লেখ করেন : ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, এমন গুঞ্জন উঠলে বাংলাদেশে কারও কারও ভ্রূকুঞ্চিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় এই আত্মকাহিনীর কথা শোনা যায়নি, তাই এর অকৃত্রিমতায় তারা আস্থা রাখতে পারেননি। এখন জানা যাচ্ছে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু না-হওয়া শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে বন্দি ছিলেন, সে সময় বেগম ফজিলাতুনেড়বছা মুজিব তাকে তার জীবনের কাহিনী লিখতে অনুরোধ করেছিলেন।... আত্মজীবনী লেখার প্রস্তাব শেখ মুজিব প্রথমে নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি লিখতে পারেন না বলে, তার ওপর, তা লিখে কী হবে, এমন ভেবে। শেষে স্ত্রীর পুনরায় অনুরোধে একদিন তিনি কারাগারে বসেই আত্মকথা লিখতে শুরু করেন। চারটি খাতায় তা লেখা হয়েছিল।’ (‘ইতিহাসের উপাদান মানবিক দলিল’, আনিসুজ্জামান, প্রথম আলো সাহিত্যপাতা, ২২ জুন ২০১২)
নিয়তির পরিহাস, গুরুত্ব অনুভব করেনি বলে পাকিস্তানিরা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিনষ্ট করায় মনোযোগী হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন করা বাংলাদেশে তার অর্জনকে বিনষ্ট করতে চাওয়া লোক জনাকয়েক হলেও ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ইতিহাস মুছে দেওয়ার এবং ইতিহাসকে ঘুরিয়ে দেওয়ার যে চূড়ান্ত ও তৎপরতা শুরু হয়, অসমাপ্ত আত্মজীবনীর একটি অনুলিপিসহ বঙ্গবন্ধুর নাম ও কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত বহু প্রামাণ্য দলিল তার হাত থেকে মুক্ত থাকেনি। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ভূমিকায়–
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে পরিবারের সবাইকে হত্যার পর তৎকালীন সরকার বাড়িটা বন্ধ করে রেখেছিল। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আমি প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আসি। তখনো বাড়িটা জিয়া সরকার সিল করে রেখেছিল। আমাকে ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয়নি। এরপর ওই বছরের ১২ জুন সাত্তার সরকার আমাদের কাছে বাড়িটা হস্তান্তর করে। তখন আব্বার লেখা স্মৃতিকথা ডায়েরি ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো পাই। আত্মজীবনী লেখা খাতাগুলো পাইনি। কিছু টাইপ করা কাগজ পাই, যা উইপোকা খেয়ে ফেলেছে। ফুলস্কেপ পেপারের অর্ধেক অংশই নেই শুধু ওপরের অংশ আছে। এসব অংশ পড়ে বোঝা যাচ্ছিল যে, এটি আব্বার আত্মজীবনীর পান্ডুলিপি, কিন্তু যেহেতু অর্ধেকটা নেই, সেহেতু কোনো কাজেই আসবে না। এরপর অনেক খোঁজ করেছি। মূল খাতা কোথায় কার কাছে আছে জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। একপর্যায়ে এগুলোর আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। (শেখ হাসিনা রচিত ভূমিকা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা x, ইউপিএল, ২০১২)
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মূল খাতাটি এভাবে কয়েক যুগের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিমাখা সব ঐতিহাসিক দলিলপত্রাদি বিনষ্টেরও একটা তোড়জোড় জোরদারভাবেই চলছিল। রীতিমতো ফরমান জারি করে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে কর্মকর্তা নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধুরই প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে এগুলোকে পুড়িয়ে দেওয়ার মহোৎসব চলেছে বঙ্গভবনে, সেখানে থাকা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর আরেকটি টাইপ করা কপিসহ আরও বহু দলিলপত্রের কোনো কিছুই যেন রেহাই না পায়, তার জন্য কঠোর হুকুম জারি করেছিল তৎকালীন সরকার। এই বহ্নুৎসবের বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার রচিত বঙ্গভবনে পাঁচ বছর (ইউপিএল, ১৯৯২) গ্রন্থে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত ইতিহাসের অমূল্য সব নিদর্শন এভাবে পুড়িয়ে ফেলার নজির সভ্য দুনিয়াতে খুব বেশি মিলবে না।
ইতিহাস মুছে ফেলার এত আয়োজনের পরও কীভাবে তা রক্ষা পেল, তা নিয়েও একটা বিশদ গবেষণা হওয়া এবং উত্তর প্রজন্মের জন্য গ্রন্থাকারে সংরক্ষিতও থাকা প্রয়োজন। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভবিষ্যতের ইতিহাসবেত্তারা ভস্মীভূত হতে গিয়ে কালোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার এই দৃষ্টান্তটিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরবেন। এর একটা সবিস্তার বিবরণ অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থদ্বয়ের ভূমিকায়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এই অংশটুকু আপাতত উদ্ধৃত করা যাক, যেখান থেকে আমরা জানতে পারি, অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সেই রুলটানা মূল খাতাগুলো কোথায় সংরক্ষিত রয়ে গিয়েছিল, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর সেই বিষাদময় সময়ে এই কাগজগুলো উদ্ধারের রোমাঞ্চকর কাহিনী–
‘আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভী রহমানসহ চব্বিশজন মৃত্যুবরণ করেন। আমি আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যাই। এ ঘটনার পর শোক-কষ্ট-বেদনায় যখন জর্জরিত, ঠিক তখন আমার কাছে এই খাতাগুলো এসে পৌঁছায়। এ এক আশ্চর্য ঘটনা। এত দুঃখ-কষ্ট বেদনার মধ্যেও যেন একটু আলোর ঝলকানি। আমি ২১ আগস্ট মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। মনে হয় যেন নতুন জন্ম হয়েছে। আর সে সময় আমার হাতে এলো আব্বার হাতের লেখা এই অমূল্য আত্মজীবনীর চারখানা খাতা! শেষ পর্যন্ত এই খাতাগুলো আমার এক ফুফাতো ভাই এনে আমাকে দিল। আমার আরেক ফুফাতো ভাই বাংলার বাণী সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সে এই খাতাগুলো পেয়েছিল। সম্ভবত আব্বা শেখ মণিকে টাইপ করতে দিয়েছিলেন, আত্মজীবনী ছাপাবেন এই চিন্তা করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনিও শাহাদতবরণ করায় তা করতে পারেননি। কাজটা অসমাপ্ত রয়ে যায়।’
‘খাতাগুলো হাতে পেয়ে আমি তো প্রায় বাকরুদ্ধ। এই হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি; তারপরই এই প্রাপ্তি। মনে হলো যেন পিতার আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছি। আমার যে এখনো দেশের মানুষের জন্য– সেই মানুষ, যারা আমার পিতার ভাষায় বাংলার দুঃখী মানুষ– সেই দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজ বাকি, তার স্বপেড়বর সোনার বাংলা গড়ার কাজ বাকি, সেই বার্তাই যেন আমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন। যখন খাতাগুলোর পাতা উল্টাছিলাম আর হাতের লেখাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম, আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আব্বা আমাকে যেন বলছেন, ভয় নেই মা, আমি আছি, তুই এগিয়ে যা, সাহস রাখ। আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহর তরফ থেকে ঐশ্বরিক অভয়বাণী এসে পৌঁছাল আমার কাছে। এত দুঃখ-কষ্ট বেদনার মাঝে যেন আলোর দিশা পেলাম। আব্বার হাতে লেখা চারখানা খাতা। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে খাতাগুলো নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। খাতাগুলোর পাতা হলুদ, জীর্ণ ও খুবই নরম হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় লেখাগুলো এত ঝাপসা যে পড়া খুবই কঠিন। একটা খাতার মাঝখানের কয়েকটা পাতা একেবারেই নষ্ট, পাঠোদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন। পরদিন আমি, বেবী মওদুদ ও রেহানা কাজ শুরু করলাম।’ (শেখ হাসিনা রচিত ভূমিকা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা xi-xii, ইউপিএল, ২০১২)
সাংবাদিক বেবী মওদুদ বেঁচে থাকলে অসমাপ্ত আত্মজীবনী সম্পাদনার ইতিহাস বিষয়ে বহু গল্প গবেষকরা তার কাছ থেকেই জানতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে এক আলাপচারিতার সময় তিনি দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেন কীভাবে তার পরম বন্ধু বেবী মওদুদের উৎসাহ ও লেগে থাকার স্পৃহা এই পান্ডুলিপিটি নিয়ে কাজ করার প্রক্রিয়াকে সম্ভব করেছিল।
অকালপ্রয়াত অধ্যাপক এনায়েতুর রহিমের কথাও শেখ হাসিনা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যিনি ২০০২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই চারটি খাতা পাওয়ার আগেকার পর্যায়ে প্রাপ্ত ডায়েরি ও স্মৃতিকথা অনুবাদ করেছেন বাংলা থেকে ইংরেজিতে।
এভাবে রক্ষা পাওয়া খাতাগুলো নিয়ে শুরু হয় সম্পাদনার কাজ। সম্পাদনার এই পর্ব বিষয়ে সম্পাদকদের অন্যতম অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন : ‘বইটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমেদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ, আমি এবং অধ্যাপক ফকরুল আলম যুক্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর লেখা পান্ডুলিপি উদ্ধার এবং যত্নের সঙ্গে গভীর মমতায় রক্ষা করে সম্পাদনা ও প্রকাশনার মূল ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ছোট বোন শেখ রেহানাও এ কাজে ছিলেন তার সহযোগী।
‘আমরা যখন এই কাজটি শুরু করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলের নেত্রী। তিনি সুধাসদনে অবস্থান করতেন। নির্ধারিত দিনে আমরা প্রকাশনা ও সম্পাদনার কাজে যুক্ত হতাম। কাজ হতো আনন্দময় ও আন্তরিক পরিবেশে। তবে কাজ করতে হতো খুব সিরিয়াসলি এবং সতর্কতার সঙ্গে। কারণ পান্ডুলিপি তো আর কারও নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সবাই মিলে যখন কিছু কিছু করে পান্ডুলিপি তৈরি হচ্ছিল তখন, তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী নিজেই তা কম্পিউটারে কম্পোজ করে দিতেন। তার এই নিষ্ঠা এবং যুক্তি-দক্ষতা আমাদের অভিভূত করেছিল।’ (‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের ইতিহাস কথা’, শামসুজ্জামান খান, অন্য আলো, প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১৬)
২. সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে...
অজস্রবার লুণ্ঠন, পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা কিংবা অবহেলায় উইপোকার খোরাক হতে হতে বেঁচে যাওয়া আত্মজীবনী এখন শুধু বাংলা ভাষায় বিপুল পঠিত গ্রন্থই নয়, পৃথিবীর প্রধানতম ভাষাগুলোতে অনূদিত একটি গ্রন্থ।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পূর্ণাঙ্গ পান্ডুলিপিটি কম্পোজ করা অবস্থায় ২০১০ সালে ইউপিএলের কাছে আসার পর তা বই আকারে প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সময় লেগেছিল ঠিক দুই বছর। তবে পান্ডুলিপিটির সঙ্গে ইউপিলের প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদের যুক্ত হওয়ার প্রথম ঘটনাটি ঘটে তারও অনেক আগে। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে পড়াশোনা করছি এবং আমার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ আমার কাছে থাকতে এসেছেন কিছুদিনের জন্য। তখন একদিন আমার বাড়িতে ফোন করে বাবার সঙ্গে কথা বললেন জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এনায়েতুর রহিম। আমাদের পরিবারের সঙ্গে এনায়েতুর রহিম এবং তার স্ত্রী জয়েস রহিমের ঘনিষ্ঠতা অনেক বছরের। তার সম্পর্কে বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা ও ডায়েরি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন। তখনো অসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতাগুলো বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে আসেনি। যখন তিনি বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তখন তিনি হাসপাতালে, মৃত্যুশয্যায়। বাবাকে বলেন যেন বাংলায় এবং ইংরেজিতে বইটি ইউপিএল প্রকাশ করে। অনুবাদের কাজটি তিনি আর শেষ করতে পারেননি; ৩১ মে ২০০৩ সালে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আরও দীর্ঘ ছয়-সাত বছর পর ড. সালাহ্উদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান এবং সাংবাদিক বেবী মওদুদ পান্ডুলিপিটি প্রকাশের আলোচনার উদ্দেশ্যে ইউপিএলে আসেন। দেশে বইটির যথাযথ বিপণন ও আন্তর্জাতিক প্রসারের পরিকল্পনা থেকেই আলাপ-আলোচনা শুরু হয়, চুক্তি সম্পাদিত হয় ৩০ জুলাই ২০১০ তারিখে। ইউপিএলের বদিউদ্দিন নাজির এবং মহিউদ্দিন আহমেদ, এই সম্পাদক-প্রকাশক জুটি দীর্ঘ দুই বছর পরিশ্রম করেন বইটির সম্পাদনা, টীকা তৈরি, নির্ঘণ্ট তৈরি থেকে নিয়ে বইটিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচার করার কাজে। পেঙ্গুইন ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গের রিজিওনাল ম্যানেজার নির্মাল্য রায়চৌধুরী ও দিল্লি অফিসে তখন কর্মরত সম্পাদক রঞ্জনা সেনগুপ্তের উদ্যোগে ইংরেজি সংস্করণটির বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের অন্য সব দেশে প্রচার করার জন্য ইউপিএলের সহ-প্রকাশক হিসেবে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া চুক্তিবদ্ধ হয় ২৮ অক্টোবর ২০১০ সালে। পাকিস্তানে ইংরেজি সংস্করণ এবং উর্দু সংস্করণের জন্য ৯ জুলাই ২০১১ সালে চুক্তি হয় করাচির অক্সফোর্ডের সঙ্গে। ২০১২ সালের জুন মাসে একযোগে বইটির বাংলা সংস্করণ ও ইংরেজি সংস্করণসমূহ প্রকাশিত হয়। ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের পক্ষে প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ ২০১২ সালের ১৯ জুনে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার ভূমিকা-সংবলিত শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি এবং ফকরুল আলমকৃত এর ইংরেজি অনুবাদ রচয়িতার দুই কন্যার হাতে তুলে দেন।’ (‘ইতিহাসের উপাদান মানবিক দলিল’, আনিসুজ্জামান, প্রথম আলো সাহিত্য পাতা, ২২ জুন ২০১২)
এরপর ৯ জুলাই ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে একটি অত্যন্ত আবেগঘন প্রকাশনা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বইটির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাসহ বক্তব্য দেন অধ্যাপক মুস্তফা নুরউল ইসলাম (প্রয়াত), কবি সৈয়দ শামসুল হক (প্রয়াত) এবং সাংবাদিক বেবী মওদুদ (প্রয়াত)। বরেণ্য নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বাংলা বই থেকে এবং অনুবাদক অধ্যাপক ফকরুল আলম ইংরেজি থেকে পাঠ করেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আসাদুজ্জামান নূর। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার বক্তব্যের সময় তারাসহ দর্শকের সারিতে আসীন প্রায় সহস্র মানুষের সম্ভবত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
১৯৭১ সালের নিউজউইক পত্রিকার এপ্রিল মাসের সংখ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ হিসেবে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত অন্য দুটি গ্রন্থ পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি একজন উঁচুদরের সাহিত্যিকও বটে। কথাকার আনিসুল হক ২০১২ সালে আগস্ট মাসে প্রকাশিত তার গ্রন্থ-পর্যালোচনা এই বলেই শুরু করেছেন যে : “বাংলা সাহিত্য সম্পªতি লাভ করেছে এক ‘গ্রেট স্টোরিটেলার’কে। তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।” (‘এ গ্রেট স্টোরিটেলার’, আনিসুল হক, প্রথম আলো সাহিত্য পাতা, ২৭ আগস্ট ২০১২)
প্রকাশক হিসেবে ইউপিলের প্রধানতম সৌভাগ্য ও গর্ব যে, বঙ্গবন্ধু রচিত প্রথম বইটির প্রকাশক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাছাই করা হয়েছে তার পেশাদারিত্ব ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কারণে। এটি অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ যে মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যাপক পাইরেসি সত্ত্বেও এ যাবৎ বইটির বাংলা সংস্করণের পাঁচ লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে, দেশ ও দেশের বাইরে। ইংরেজি সংস্করণ বিক্রি হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। পাকিস্তানের উর্দু সংস্করণটিও তৃতীয়বারের মতো পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ২০১৯ সালে। ২০১২ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে বইটি একদিনের জন্যও মুদ্রিত নেই এমনটি ঘটেনি– এবং পাঠক ও পুস্তকবি তারা এ কারণে বরাবর ইউপিএলের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। বইটির স্বত্বাধিকারী বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টকে নিয়মিত বইয়ের বিক্রির হিসাব ও রয়্যালটি ইউপিএল পরিশোধ করে আসছে ইউপিএল।
অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী প্রকাশের এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বিরাট মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার আগে কেমন ছিলেন ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান, তার সাক্ষ্য রয়েছে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর প্রতিটি পাতায়। এই বইয়ের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে কালোত্তীর্ণ হওয়ার মতো– কারণ বাংলাদেশের প্রতিটি প্রজন্মকে তার ইতিহাস ও আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে যে কটি বইয়ের শরণাপনড়ব হতে হবে, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী তার অন্যতম। বইটির ভাষা আড়ম্বরহীন, অকপট, কোথাও অতিরঞ্জনের কোনো ছাপ নেই এবং তা যেকোনো পাঠককে আপন করে নিতে বাধ্য।
এই বই আমাদের চিনতে সাহায্য করে সত্যিকার রক্তমাংসের বঙ্গবন্ধুকে– পরমতসহিষ্ণু রাজনীতির চর্চায়, অন্যান্য মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনে যিনি শুধু একজন দলীয় নেতা ছিলেন না, ছিলেন একজন অধিকার ও ন্যায়সচেতন সর্বজনীন নেতা। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী ব্যক্তি, বর্তমানকে বিশেস্নষণ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত যেমন পৌঁছাতে পারতেন, তেমনি ভবিষ্যৎকে দেখার অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল তার।
আমি নিজে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ এবং তাদের একজন, যাদের স্কুল-কলেজ জীবনে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। সত্যিকার ইতিহাস জানার জন্য যাদের অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে এই লেখাটি লিখতে পারাটা আমার জন্য তাই বিশেষভাবে আনন্দের, সৌভাগ্যের ও সম্মানের এবং এই সৌভাগ্যের ঋণ অনেকের কাছে– যারা নানা রকম ঝুঁকি নিয়ে, নিঃস্বার্থ পরিশ্রম করে সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বইকে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসকে দেশ ও বিদেশে আরও অনেক পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের পাশাপাশি তাই একটা গভীর ব্যক্তিগত দায় আমি অনুভব করি। এই কাজটি আমরা সততা, পেশাদারিত্ব, যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাব, মুজিববর্ষে এটিই আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
শোন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে-বাতাসে ওঠে রণী বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ॥
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও গানের এই কথাগুলো আমাদের শিহরিত করে। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে ও শ্রদ্ধায় নতজানু হতে অনুপ্রাণিত করে। এখনো বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতাকেন্দ্রিক জাতীয় দিবস ছাড়াও গানটি বিভিন্ন সময়ে এপার-ওপার বাংলায় প্রায়ই বাজে। তাই সবার কানে এটি খুব চিরচেনা একটি গান। গানটি শোনেননি এমন মানুষ দেশের মাটিতে বোধকরি খুব কমই। যতটুকু জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন লেখা এটিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সুরারোপসহ গীত ও রেকর্ড করা প্রথম গান। গানের কথা লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী অংশুমান রায় আর সংগীত পরিচালনা করেছেন দিনেন্দ্র চৌধুরী। গানটি আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রথম প্রচারিত হয় ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ (শিল্পী অংশুমান রায়ের ডায়েরির পাতায় তারিখ লেখার ঘষামাজায় ১৫ এপ্রিল ১৯৭১-ও মনে হতে পারে)। পরে ২২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে গানটি রেকর্ড করে গ্রামোফোন কোম্পানি হিন্দুস্তান রেকর্ড (এসএলএইচ-১৮৩)। গানটি এসপি রেকর্ড হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার সময় একটা বিপত্তি বাধে। এসপি রেকর্ডের দুই পৃষ্ঠায় একটি করে দুটি গান থাকে। এই গানটি রেকর্ড হলো, তাহলে অপর পৃষ্ঠায় কোন গান হবে এটি নিয়ে বাধল সমস্যা। যদিও সঙ্গে সঙ্গেই এর সমাধান করে দিলেন গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তিনি গানের কথা ও সুর ঠিক রেখে শুধু ভাষাটা ইংরেজি করে দিলেন। ফলে একই গানের একটি ইংরেজি ভার্সন তৈরি হলো। সেই গানে শিল্পী অংশুমান রায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠ মেলালেন শিল্পী কাবেরী নাথ। উল্লেখ্য, গানটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ভাষণের ওপর ভিত্তি করে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার রচনা করেছিলেন। গানটির ইংরেজি ভার্সন এখন আর শোনা যায় না বললেই চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যম বা ব্যক্তিপর্যায়েও ইংরেজি ভার্সনের কোনো হদিস মেলেনি।
বছর কয়েক আগের কথা। একই গ্রামোফোন কোম্পানি হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা আরেকটি গানকে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম গান হিসেবে দাবি করা হয়। গানের শিরোনাম ‘জয় বাংলা’ (হিন্দুস্তান রেকর্ড : এসএলএইচ-১৭৭)। গানটি লিখেছেন লক্ষ্মীকান্ত রায়, সুর করেছেন প্রার্থনা মুখোপাধ্যায় আর গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী দীপেন মুখোপাধ্যায়। দাবিটি করেছেন গানের গীতিকার লক্ষ্মীকান্ত রায় নিজে, ইউটিউবে একটি ভিডিও বার্তায় এবং বাংলাদেশের সব সাংবাদিকের উদ্দেশে তার নিজ নামাঙ্কিত প্যাডের পাতায় লেখা একটি চিঠিতে। সেখানে তিনি জানান, গানটি লেখার আটাশ দিন পর অংশুমান রায়ের ‘শোন একটি মুজিবের থেকে’ গানটি লেখা ও রেকর্ড করা হয়েছিল। অথচ তার গানটিকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। লক্ষ্মীকান্ত রায় ইউটিউব ভিডিওবার্তায় জানান, তার লেখা গানটির রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার কয়েক দিন পরই শেখ মুজিবুর রহমানের দুই মেয়ের উপস্থিতিতে তদানীন্তন বাংলাদেশ হাইকমিশনার হোসেন আলীর হাতে সেই রেকর্ডের কপি তিনি নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ৭৭ বছর বয়সে নিজে হাতে চিঠি লিখে তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে জানান, তিনি তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী নজরুল ইসলামসহ তাজউদ্দীনের কাছেও পৌঁছে দিয়েছিলেন তার লেখা গানের রেকর্ডটি। এমনকি ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রচারিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’ তার এই গান নিয়মিত প্রচারও করেছে। অথচ ‘জয় বাংলা’ গানটির কোনো স্বীকৃতি তিনি আজ পর্যন্ত পাননি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিসত্তার মহানায়ক, বাংলাদেশের জাতির পিতা। তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ তাকে সত্তরের দশকে দুই বাংলায়ই সমান জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। একাত্তরের ৭ মার্চ ভাষণের পর এপার বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ যখন স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত, তখন ওপার বাংলা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা জানিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশের থাকার প্রত্যয়ে অবিচল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে বাংলাদেশে গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, প্রচারিত হতে থাকে যুদ্ধের খবরাখবর, পাশাপাশি মুক্তিসেনাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে নানা আঙ্গিকে দেশপ্রেম, স্বাধীনতা আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত ভাষায় রচিত হয় গান। বাংলাদেশে সেই গানগুলো রেকর্ড করা হয় ‘ঢাকা রেকর্ড’ কোম্পানি থেকে। একই সঙ্গে কলকাতা থেকেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এগিয়ে আসে এইচএমভি গ্রামোফোন কোম্পানি। একাত্তর সালের জুন মাসে গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর গান তৈরির জন্য গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের অনুরোধ জানায়। বাংলা গানের নামিদামি শিল্পী, সুরকার, গীতিকাররাও সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মীরাদেব বর্মণ, সুবীর হাজরা, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত, অমিতাভ নাহা, বিশ্বনাথ দাস, পবিত্র মিত্রের মতো গীতিকাররা গান লিখেছেন। সুরকাররাও প্রাণবন্ত এবং আবেগপূর্ণ সুর করেছিলেন। এর মধ্যে শচীন দেববর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রাহুল দেববর্মণ, বাপ্পী লাহিড়ী, অপরেশ লাহিড়ী, নীতা সেন, দীনেন্দ্র চৌধুরী, অভিজিৎ, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখ সুর দিয়েছেন। আর এদের ছাপিয়ে যেন প্রজ¦লিত হয়েছিলেন যুদ্ধজয়ের গানে সলিল চৌধুরী। গণসংগীতের মূর্ছনায় তিনি ছিলেন অন্যরকম দিশারি। গেয়েছেন কলকাতার অনেক শিল্পীই। হেমন্ত, দ্বিজেন, শ্যামল, মানবেন্দ্র, সত্যব্রত দত্ত, ভূপেন হাজারিকা, বনশ্রী সেন গুপ্ত, নির্মলা মিশ্র, আশা ভোঁসলে, রাহুল দেববর্মণ, দেবব্রত বিশ্বাস, ললিতা ধর চৌধুরী, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, অংশুমান রায়, কাবেরী নাথ, দীপেন মুখোপাধ্যায়, দ্বীপের বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদ্বকাশ চাকী, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মিন্টু দাশ গুপ্ত প্রমুখ গেয়েছেন। এ ছাড়া রবিশংকরও এইচএমভি থেকে কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতে রেকর্ড করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ নামে একটি এলপি ডিস্ক।
হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে সে সময় মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে অনেক গান রেকর্ড করা হয়। একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুধু শিল্পী অংশুমান রায়ের গাওয়া, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটিই প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলকাতার শিল্পীদের প্রকাশিত গানের অন্যান্য রেকর্ড বাজানো হয়নি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যেসব গ্রামোফোন রেকর্ড বাজানো হয়েছে, তা ঢাকায় উৎপাদিত ছিল। তবে কেবল বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে, শ্যামল গুপ্তের লেখা এবং আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘হাজার বছর পরে’ এবং ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম’ গান দুটি বাজানো হয়েছিল। যার প্রকাশক ছিল হিন্দুস্তান রেকর্ড (এসএলএইচ-১৯০)।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কলকাতার বিভিন্ন গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক প্রকাশিত অন্য গানের রেকর্ডগুলো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। অথবা সংরক্ষণ করা গেলেও, লক্ষ করা যায়, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর আজ পর্যন্ত এই গানগুলো বাংলাদেশের মাটিতে আর বাজেনি। ধারণা করা হয়, গানগুলোর মূল রেকর্ড সরকারি বা ব্যক্তি সংগ্রাহকের সংরক্ষণেও নেই। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে, ৭৫-এরপর একটি কুচক্রীমহল দ্বারা বঙ্গবন্ধুসংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে, হয়তো সে কারণেই ৭১-এর সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বহুসংখ্যক গান হারিয়ে গেছে, যার মূল রেকর্ড আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ৭১-এর অসংখ্য কালজয়ী গান দেশের আনাচে-কানাচে থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন বই ও গবেষণায় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ৭১-এর অনেক গান, এখন পর্যন্ত কোনো বই বা গবেষণায় স্থান পায়নি। তাই ধরে নেওয়া যায়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা এই গানগুলো ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও গানে ঠাকুরবাড়ির অবদান অনস্বীকার্য। সে সাহিত্য ও গান বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ যেমন করেছে, তেমনি বিশ^দরবারে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। যদি গানের কথায় আসি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ, বোন স্বর্ণকুমারী দেবী সবাই গান লিখেছেন। ধ্রুপদ-ধামারে বাংলা কথা বসিয়ে গান লিখেছেন তাদের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তাদের অনুসরণ করেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি দিনেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথের মেয়ে ইন্দিরা দেবী, রবীন্দ্রনাথের আরেক ভাই বীরেন্দ্রনাথের ছেলে বলেন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা দেবী, হেমেন্দ্রনাথের মেয়ে প্রতিভা দেবীসহ ঠাকুরবাড়ির আরও কয়েকজন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লেখা হয়েছে ঠাকুরবাড়ি থেকে এবং তা রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৭১ সালে, হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে এমনটা শুনলে যে কেউ চমকে যেতে পারেন। এবার গল্পটা জানা যাক।
রবীন্দ্র ও গণসংগীতের রাজা জর্জ বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘জর্জ কাকা’ আমাদের কাছে মূলত তার পোশাকি নাম তিনি কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তার কোনো সাংগঠনিক বা সাংগীতিক তৎপরতার বিবরণ পাওয়া না গেলেও ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ হওয়াকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে পার্টির চিন্তার বিপরীতেই ছিল তার উপলব্ধি। এ ব্যাপারে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সহকর্মীদের কাছে তিনি বলেছিলেন, ‘যে পূর্ববঙ্গের মাটিতে (কিশোরগঞ্জ জেলা) আমার জন্ম হয়েছিল, যে পূর্ববঙ্গে আমি শিশুকাল থেকে বড় হয়েছি, যে পূর্ববঙ্গে আমার নিজের ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন রয়েছে, সেই পূর্ববঙ্গ এখন আর আমার স্বদেশ নয় তা হয়ে গেল বিদেশ এতে আমার মন একেবারে ভেঙে পড়েছে।’ দেশ ভাগের পর এই যোগাযোগ যত ক্ষীণই থাকুক, নিজের দেশ আর মানুষকে তিনি ভুলে যাননি কখনোই। তার বড় প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ঐকান্তিক অংশগ্রহণে।
তার রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া নিয়ে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের সঙ্গে ১৯৬৯ সাল থেকে চলে আসা বিরোধের কারণে তিনি ১৯৭১-৭২ সালের পর আর কোনো রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেননি। কিন্তু তাতে ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তার সখ্য ম্রিয়মাণ হয়নি। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের সন্তান। সাম্যবাদী ও মানবতাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চিরকাল ঠাকুর পরিবারের ব্যতিক্রমী পুরুষ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন তিনি। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পরই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বাঙালি হিসেবে সৌমেন্দ্রনাথ সমধিক আলোচিত ব্যক্তিত্ব।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে দেবব্রত বিশ্বাস সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি চিঠিতে লিখে জানান, ‘তার জন্মভূমি পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ বাংলাদেশের তার ভাই-বোনরা জীবনমরণপণে যে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই লড়াইকে তিনি (সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর) সমর্থন করেন কি না...। যদি সেই লড়াইয়ের প্রতি তার সামান্য একটু সমর্থন থাকে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে দুটি গান লিখে তাকে (দেবব্রত বিশ্বাস) পাঠাতে অনুরোধ জানান। দেবব্রতের চিঠির ভাষায়, ‘যাতে সেই গান দুটির রেকর্ড প্রকাশ করে এবং নানা অনুষ্ঠানে গেয়ে এপার বাংলার জনসাধারণকে বাংলাদেশের আমার ভাই-বোনদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল করে তুলতে পারি।’ এই চিঠি পাওয়ার পর সৌমেন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে বিশ্রামের জন্য বোম্বাই চলে যান এবং সেখান থেকে তার রচিত প্রথম গানটি স্বরলিপিসহ দেবব্রত বিশ্বাসকে ডাকযোগে পাঠান। কয়েক দিন পর তিনি কলকাতাতে ফিরে স্বরলিপিসহ দ্বিতীয় গানটিও ডাকযোগে পাঠান। এ সময় দেবব্রত বিশ্বাস নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুস্থ হয়ে উঠেই তিনি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্মতি নিয়ে গান দুটির কথা ও সুরে সামান্য পরিবর্তন করে গান দুটি রেকর্ড করেন। এই রেকর্ডটিও প্রকাশ করে হিন্দুস্তান রেকর্ড (এসএলএইচ-১৯০)। তার একটি গান,
ওই তারা চলে দলে দলে মুক্তি পতাকাতলে
পরাধীনতার কারা ধূলিতে মিশায় তারা,
হাতে হাত দিয়ে প্রাণে প্রাণ মিশে,
মুক্তিবাহিনী চলে।
মুক্তিবাহিনী নাশিছে শত্রু, বাংলার হবে জয়
স্বাধীন হইবে বাংলার লোক, জয় বাংলার জয়
জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা।
শোনো বিপ্লব হুংকার বাংলার জনতার।
লক্ষ লোকের চলার আগুনে বাংলার পথ জ্বলে।
জর্জ বিশ্বাস (দেবব্রত বিশ্বাস) তার নিজের রেকর্ডের ব্যাপারে কতগুলো নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলতে রেকর্ডিং কোম্পানিকে বাধ্য করতেন; রেকর্ডের প্রচারের ব্যাপারে কোনো প্রচার চালানো যাবে না, কোনো পত্রিকায় রিভিউ করার জন্য পাঠানো যাবে না; এমনকি প্রথমদিকে তার কোনো ছবিও ছাপতে দিতেন না রেকর্ডের মোড়কে; কোম্পানির অনেক জোরাজুরিতে শেষে অবশ্য একটি ছবি দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গাওয়া গানের এই রেকর্ডটির ব্যাপারে তার বেঁধে দেওয়া এসব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছিলেন রেকর্ডটির প্রচারের ক্ষেত্রে। এই গানগুলো তিনি নিজেই প্রচার করে বেড়াতেন নানা স্থানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাংগীতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, তার এই গান দুটি কোনো অজ্ঞাত কারণে মনে হয় এখন কিছুটা দুষ্প্রাপ্য ; তাই গান দুটি শোনা যায় না কোথাও। রেকর্ডের সংগ্রহও কারও কাছে সংরক্ষিত নেই।
আগরতলা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যারা পাক-হানাদার বাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র হাতে ময়দানে লড়াই করেননি, কিন্তু বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিলেন অনেকে। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিলেন কবি, লেখক, সাহিত্যিক, গায়কসহ বুদ্ধিজীবী। এমনই একজন গীতিকার আগরতলার সুবিমল ভট্টাচার্য। ১৯৭১ সালে সুবিমল ভট্টাচার্যের বয়স ছিল ৩৩ বছর, তখনকার সময় সংবাদমাধ্যম বলতে খবরের কাগজ আর রেডিও। সেই রেডিওতে পাক-হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর দ্বারা নিরীহ তৎকালীন পূর্ববাংলার নিরীহ হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে নিরীহ বাঙালি মানুষের ওপর অত্যাচারের খবর শোনা যেত। এসব খবর তিনি নিয়মিত শুনতেন আর মানসিকভাবে আহত হতেন। এ ধরনের অত্যাচারের খবর শুনে তিনি আগরতলায় বসে লিখলেন,
‘বুড়িগঙ্গা নদীরে, তোর বুকে আমি
ডিঙ্গা কেমনেরে ভাসাই,
পানি যে তোর রক্তে রাঙ্গা
বৈঠা কান্দে তাই’
গানটি কলকাতায় হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে রেকর্ড করা হয়। গানটি সে সময় খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিছুদিনের মধ্যে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে গানটি। এই গানের সাফল্য দেখে রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাকে আরও একটি গান লেখার অনুরোধ জানায়। তখন তিনি পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক গান লেখেন
(আরে) শোন শোন জগতবাসী, শোন মন দিয়া
বাংলাদেশে কীর্তি রাখলেন গোঁসাই ইয়াহিয়া।
পশ্চিম দেশের গোঁসাই ঠাকুর
কতই জানেন চাতুরী,
কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।
(আরে) দিবারাত্র বৈঠক করলেন
মুজিব ভাইয়ের শর্ত মানলেন। ও আহা বেশ!
আর তলে তলে ঢাকার পথে
নামাইলেন মিলিটারি।
কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।
(আরে) ঢাকা শহর ফাঁকা হইলো
লাখে রাখে জান মারিলো। ও আহা বেশ!
আর এরোপ্লেনে চইড়া গোঁসাই
চোরের মত দেন পাড়ি
কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।
স্কুল-কলেজ চুরমার করে
যুবতী পাইলে ধরে। ও আহা বেশ!
আর লালসা মিটাইয়া তাগো
পাঠায় রে যমের বাড়ি।
কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।
যুবক জোয়ান জ্যান্ত ধইরা
রক্ত শুষে মেশিন দিয়া। ও আহা বেশ!
রক্ত বোতল ভইরা ব্যাংকে জমায়
বাঁচাইতে মিলিটারি
কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।
এতো পাপ কইরা তোমার
উচিত শাস্তি হইলো এইবার
আহা! ইতিহাসের পাতায় তুমি
করলে খুনির নাম জারি
কি চমৎকার দেখলাম বাহাদুরি।
তার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন তিনি রেডিওতে শুনতে পান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়ক আবদুল জব্বার, সহিদুল চৌধুরী, আপেল মাহমুদ, স্বপ্না রায়সহ বেশ কয়েকজন শিল্পী আগরতলায় শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি আবদুল জব্বারসহ বাংলাদেশের অন্য শিল্পীদের কলকাতায় পাঠিয়ে হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করে দেন। পরে এই সংস্থা থেকে আবদুল জব্বারসহ বাংলাদেশের অন্য শিল্পীদের মোট ২৮টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গান রেকর্ড হয়। সেই গানগুলোর মূল রেকর্ড এখন আর খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই শোনা যায় না কোথাও।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে গত দশ বছরে, এপার বাংলা থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারের জন্য যেসব গান রেকর্ড করা হয়েছে, তার মোটামুটি একটা সংগ্রহ ও সংকলন করা গেছে, গ্রন্থভুক্তও করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ওপার বাংলা (কলকাতা) থেকে প্রকাশিত তিনটি গান ছাড়া বাকি গানগুলো সংগ্রহ ও গ্রন্থভুক্ত করা যায়নি এখনো। জয় বাংলা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক গান এখনো আমাদের শোনা হয়ে ওঠেনি, কারণ সেসব গানের মূল রেকর্ডগুলো কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিপর্যায়ে কারও সংগ্রহে নেই এমনটা ধারণা করা যায়। কিন্তু এই গানগুলোও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনন্য উপকরণ, বাস্তব দলিলও বটে। এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা আমাদের ইতিহাসের প্রয়োজনেই অতীব জরুরি এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় আমাদের নেই।
লেখক : চিত্রশিল্পী, সাহিত্যিক ও শৌখিন সংগ্রাহক
[email protected] গ্রামোফোন রেকর্ডগুলো লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে প্রকাশিত।
বাংলাদেশের যে কয়টি গর্ব করার বিষয়, তার মধ্যে অন্যতম পাট ও পাটশিল্প। বহুকাল বিশ্বের বুকে এ ভূখণ্ডের মর্যাদার অন্যতম প্রতীক ছিল সোনালি আঁশ নামে পরিচিত এ কৃষিপণ্য। কেবল অর্থকরী ফসল বলে নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে পাটের ভূমিকা একটি স্বীকৃত ইতিহাস। সেই গর্বের অতীত না থাকলেও পাট এখনো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি হয়েছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ২৬ লাখ ডলার। এর মধ্যে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। যা ওই বছর মোট রপ্তানি আয়ের ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পণ্যের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১২৮ কোটি ডলার। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় হলেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রথম। বর্তমানে বাংলাদেশ পাট দিয়ে ২৮২টি পণ্য উৎপাদন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। চলতি অর্থবছরে পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে ৫৮ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পাট ও পাটজাত পণ্য বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরে ‘সোনালি আঁশে অফুরান আশা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগামী ৫ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক সিটিতে ‘এনওয়াই নাও উইন্টার শো’ নামে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বাণিজ্যমেলায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ১৪টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পাটজাত পণ্য প্রদর্শন করা হবে। এটি আমাদের জন্য দারুণ একটি সুযোগ। পাট ও প্রাকৃতিক আঁশ জাতীয় পণ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলার পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে। পাটজাত পণ্য পরিবেশবান্ধব ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশে প্রচুর পাট উৎপাদন হলেও পাটজাত পণ্য প্রস্তুতকারকদের মধ্যে বৈশি^ক বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও এর প্রয়োগের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে পাটের উৎপাদনও কমছে। ফলে অনেক এসএমই উদ্যোক্তা পাটভিত্তিক পণ্য উৎপাদন করলেও বিবাজারে তাদের প্রবেশাধিকার সীমিত। বাংলাদেশ হর্টিকালচার অ্যাকটিভিটির এই উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় এসএমই প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাজার উপযোগী পণ্য দেখার, এ-সম্পর্কে শেখার এবং পণ্যের ডিজাইন করা ছাড়াও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরমে বাংলাদেশি পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন। এই আয়োজনে বাংলাদেশের পাটপণ্য প্রদর্শনের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া সংস্থা ও উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ প্রাপ্য। পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এ ধরনের আন্তর্জাতিক পরিম-লে উদ্যোগ ও আয়োজন আরও প্রয়োজন।
একুশ শতকে এসে সারা বিশ্বে সিনথেটিক ফাইবারের বদলে পাট এবং পাটের মতো অর্গানিক ফাইবারের কদর এবং চাহিদা দুটোই উত্তরোত্তর বাড়ছে। অথচ এই যুগে এসেই একদা সোনালি আঁশের দেশ খ্যাত বাংলাদেশে সব সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাটশিল্পের ধারাবাহিক ক্রমাবনতি কোনো যুক্তিতেই ধোপে টেকে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এবং দেশের বেসরকারি পাটকলগুলোও লাভজনক। আর প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে লোকসানের অজুহাতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাট খাত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, যে দেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার করতে পারেন, যে দেশকে বহির্বিশ্ব সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে চেনে, সেই দেশে ফের পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা কঠিন নয়। অন্যদিকে, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ এর প্রয়োগ পাটশিল্পকে বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারে। পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকার বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উদ্ভাবন, ব্যবহার সম্প্রসারণে গুরুত্বারোপ করতে হবে। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত করতে পাট ও পাটজাত পণ্য অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। কারণ আমাদের আছে দক্ষ পাটচাষি, আছে আধুনিক উপযোগী জাত, উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা, আর আছে বহুমুখী ব্যবহারের বিভিন্ন পাটপণ্য এবং ব্যবহারের বিভিন্ন উপযোগী ক্ষেত্র। সরকারি-বেসরকারি সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় পাট চাষ ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যম দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, দারিদ্র্যবিমোচন এবং সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে আরও বহুদূর। পাটের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন। পাটের উৎপাদক, পাটকল মালিক, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার স্বার্থ সমুন্নত রেখে পাট খাতকে এগিয়ে নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যেসব গণহামলার ঘটনা ঘটেছে তার অর্ধেক ক্ষেত্রে হামলাকারী ব্যক্তিগত সংকট, ঘরে অশান্তি এবং কর্মক্ষেত্রে জটিলতায় ভুগছিলেন বলে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার নতুন একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আগেই সতর্ক সংকেতগুলো চিহ্নিত করে সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ওই প্রতিবেদনটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রয়টার্স বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ‘ন্যাশনাল থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট সেন্টার’ বুধবার ৭০ পাতার ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে তারা ১৭৩টি ঘটনা যেখানে তিন বা তার বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখে। যেখানে কর্মক্ষেত্র, স্কুল, উপাসনালয়, গণ-পরিবহনসহ আরও কয়েকটি স্থান লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। ওই সব হামলায় ৫১৩ জন নিহত এবং এক হাজার ২৩৪ জন আহত হয়েছেন।
সেন্টারের প্রধান লিনা আলথারি বলেন, সাধারণত অপরাধীদের মধ্যে এমন আচরণ দেখা গেছে যা অন্যদের আগে থেকে সমস্যা চিহ্নিত করতে সাহায্য করতে পারে। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীদের মধ্যে সহিংসতার প্রতি আগ্রহ, পূর্ববর্তী গণহামলাকারীদের প্রতি আগ্রহ, তাদের সম্পর্কে পোস্ট করা, তাদের সম্পর্কে অন্যদের সঙ্গে কথা বলা, নিজের কর্মক্ষেত্রে অস্ত্র আনা, স্কুলে অস্ত্র আনা, সহকর্মীরা তাকে ভয় করা এবং ক্রমাগত অভিযোগ করে যাওয়া, ইত্যাদি আচরণ দেখা যায়।
ঘুরে-ফিরে আমরা বারবার এসবই দেখতে পেয়েছি।
হামলাকারীদের মনোরোগে ভোগার ইতিহাসও অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে, তারা আর্থিকভাবে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন অথবা গার্হস্থ্য সহিংসতায় জড়িত। বেশিরভাগ হামলাতেই অস্ত্র হিসেবে বন্দুককে বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭৩ শতাংশ ক্ষেত্রে হামলার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এসব হামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হামলাকারী পুরুষ।
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় চলতি সপ্তাহেও তিনদিনে দুইবার বন্দুক হামলায় ১৮ জন নিহত হয়েছেন। উভয় হামলাতেই হামলাকারী বয়স্ক পুরুষ ছিলেন। কী কারণে তারা এভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করলেন তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে পুলিশ।
অথচ, ভয়াবহ এই সংকট সমাধানে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে সে বিষয়ে দেশটির আইনপ্রণেতারা এখনো একমত হতে পারেননি।
গত সোমবার ২৩ জানুয়ারি আয়কর আইন-২০২৩-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, এই আইনের ফলে আয়কর নির্ধারণে কর্মকর্তার ক্ষমতা কিছুটা কমানো হয়েছে। সেই সঙ্গে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন প্রদান আরও সহজ করা হবে। ব্যবসায়ীদের আয়কর নির্ধারণে আগে ২৯টি বিষয় মানদ- ছিল। এখন তা কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। মানুষ যাতে ট্যাক্স দিতে উৎসাহিত হন এবং ট্যাক্সের পরিধি যাতে বাড়ে সেজন্য এই আইনটি করা হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, করদাতার করের পরিমাণ আয়কর কর্মকর্তার নির্ধারণ করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকছে না এই আইনে। করদাতার দেওয়ার তথ্যের ভিত্তিতেই কর নির্ধারিত হবে। ফলে কর্মকর্তার চাপিয়ে দেওয়া করের পরিমাণ ঠিক করার ফলে আপিলের পরিমাণ কমবে, কমবে করদাতার হয়রানি।
বাংলাদেশের আয়কর আইনের যদি সুরতহাল রিপোর্ট করা যায় তাহলে বিদ্যমান আয়কর আইনটি জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক এবং প্রায়োগিক দিক থেকে এখনো নিবর্তন ও প্রতিরোধাত্মক প্রতীয়মান হয়। এ দেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রদান, বিভিন্ন সেবার বিনিময়, কিংবা উৎপাদন বা সম্পদ ব্যবহার বাবদ নানান নামে নানান উপায়ে রাজস্ব বা টোল বা ট্যাক্স আদায়ের প্রথা সেই আদি যুগ থেকে চলে এলেও আধুনিক আয়কর বলতে যে বিশেষ কর রাজস্বের সঙ্গে আমরা পরিচিত, এ দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে তার প্রবর্তন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে, সাত সাগর তেরো নদীর পাড় থেকে আসা বিদেশি বেনিয়াদের দ্বারা। তাদের তৎকালীন সমাজে শিল্পবিপ্লবের পর পুঁজির প্রসার ঘটে এবং সেখানে সম্পদের ওপর, সম্পদ সৃষ্টি ও বিনিময় প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত আয় অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র ওই অতিরিক্ত আয়ের ওপর একটা হিস্যা দাবি করে বসে, যুক্তি এই, তুমি রাষ্ট্রের তৈরি অবকাঠামো ব্যবহার করে আয়-উপার্জন করছো, রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধা ভোগ করে লাভবান হচ্ছো সুতরাং এসব অবকাঠামো নির্মাণ, এসব সুযোগ-সুবিধার সমাহার বাবদ রাষ্ট্রের বিনিয়োগে তোমার অংশগ্রহণ চাই।
এ দেশে যারা আয়কর আইন আমদানি করেছিলেন, যে সময় এনেছিলেন, যাদের জন্য এনেছিলেন এবং যাদের ওপর অর্পিত হয়েছিল এর প্রয়োগ-প্রবর্তনের ভার তাদের প্রত্যেকের নাড়ি-নক্ষত্র পরীক্ষা-পর্যালোচনায় বিদ্যমান আয়কর আইনের চরিত্র ও চারিত্র্য, এর শরীর ও শারীর শনাক্তকরণ সহজ হতে পারে। আমরা জানি এ দেশ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। রেজা খান, সেতাব রায়দের মাধ্যমে রাজস্ব মাসোহারাপ্রাপ্তির পর্ব পেরিয়ে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানি মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতি পদ্ধতিতেই চালিয়েছিল শাসনকার্য।
কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল এক্সপোর্ট বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে ইমপোর্ট পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যার হাউজ অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভরকরণের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার কোম্পানির থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলেই শাসকের সঙ্গে শাসিতের দায়-দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন সামনে আসে এবং ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এ দেশের অর্থনীতি।
এই প্রেক্ষাপটেই উৎপাদন, বিপণন, বাণিজ্য ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ের যৌক্তিকতা দেখা দেয়। প্রথমে ১৮৬২ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত সীমিত অবয়বে আয়কর আদায়ের আয়োজন চলে। মাঝে বন্ধ হয় কার্যক্রম। আবার ১৮৮০-এর পর কয়েক বছর পরীক্ষামূলকভাবে চলে। সরকার স্থায়ীভাবে কোনো আইন না করে, স্থানীয়ভাবে এসআরও বা সার্কুলার জারি করে আয়কর আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে এসব সার্কুলার ব্রিটিশ আইনের আদলে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রণীত হলেও এ দেশীয় করদাতাদের প্রতি তাদের বশংবদ অদায়িত্বশীল আচরণ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা প্রতিরোধমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সেই সার্কুলারের বাকপ্রতিমায় প্রাধান্য পায়।
করযোগ্য আয় নির্ধারণ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে পরিপালনীয় বিধিবিধানের ভাষায় এমন এক ধরনের মনোভাবের প্রকাশ পায়, যা জটিল ও দ্ব্যর্থবোধক হয়ে ওঠে। এ ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতিতে, তৎকালীন প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে করদাতাদের শলাপরামর্শ দেওয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই একটি ব্যবহারজীবী বিজ্ঞ সহায়ক সমাজও গড়ে ওঠে। কিন্তু তাদেরও অগোচরে, কর আইনকে সহজ ও করদাতাবান্ধবকরণে তাদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ পরামর্শ সত্ত্বেও এ দেশে প্রবর্তিত আয়কর-সংক্রান্ত সার্কুলারসমূহে জটিলতা যুগলবন্দি হয়ে ওঠে সময়ের প্রেক্ষাপটে।
ঔপনিবেশিক সরকারের তরফে করদাতাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় না এলেও কর আদায়ের ক্ষেত্রে জমিদারদের পাইক-পেয়াদাসুলভ যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রকাশ পেতে থাকে। উদ্দেশ্য থেকে যায় ‘তোমার আয় হোক আর না হোক অর্থাৎ বাঁচো বা মরো রাজস্ব আমার চাই’। এ ধরনের আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির বদৌলতে কর আদায়কারী বিভাগের সঙ্গে করদাতাদের সম্পর্ক যুক্তিসংগতভাবে দর-কষাকষি বা কিছুটা জবরদস্তিমূলক, পরস্পরকে এড়িয়ে চলার কৌশলাভিমুখী হয়ে পড়ে। অন্তরালে ব্রিটিশ প্রশাসনে বহুল কথিত একটা সাধারণ নির্দেশনা ছিল যেন এ রকম, ‘চোর তো চুরি করিবেই কিন্তু গৃহস্থকে সজাগ থাকিতে হইবেই’। করদাতাদের এরূপ বিরূপ ধারণায় বিবেচনা এবং তাদের ধরার ইন্ধন কর আইনের ভাষ্যে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরূপ পরস্পর অবিশ্বাসের ও প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবেশে কর নির্ধারণ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে পরস্পরকে এড়িয়ে চলার এবং সে লক্ষ্যে অনৈতিক আঁতাতের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির সংস্কৃতিরও সূত্রপাত ঘটে।
ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ততার এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টিতে সেই সময়কার আয়কর আইনের ভাষায় যেন ছিল পরোক্ষ প্রেরণা। এমন অনেক আইন আছে যা বেআইনি আচরণকে উসকে দেয়। এ রকমই পরিবেশে আঁতাতের মাধ্যমে কর ফাঁকি কার্যক্রমে একটা অনভিপ্রেত সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। এই জটিল, অনভিপ্রেত ব্যবস্থাদি আয়কর সার্কুলারের ভাষায় যেন প্রতিফলিত হতে থাকে। তদানীন্তন ব্রিটেনে বিদ্যমান আয়কর আইন ও প্রয়োগ পদ্ধতি প্রক্রিয়া থেকে সে সময় এ দেশে প্রণীত ও প্রবর্তিত আইন ও পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বিচ্যুতি ও পরিবর্তন পরীক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তাই-ই ‘ভারতীয় আয়কর আইন’ আকারে ১৯২২ সালে সংকলিত ও প্রবর্তিত হয়।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও, এক যুগেরও বেশি সময় সেই ১৯২২ সালের আয়কর আইন ভারত স্থলে পাকিস্তান, পাকিস্তান স্থলে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত ও নামাঙ্কিত হওয়া ছাড়া প্রায় একই মেজাজে বলবৎ ও প্রযোজ্য থাকে। আয়কর অধ্যাদেশ (১৯৮৪ সালের ৩৬ নম্বর অধ্যাদেশ) জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয়। তবে তখন দেশে আইন পরিষদ বিদ্যমান না থাকায় রাষ্ট্র ও নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও গণগুরুত্বপূর্ণ আয়কর আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হওয়ায় এটির প্রণয়ন ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। দাবি উঠেছে অধ্যাদেশের স্থলে আয়কর আইন প্রণয়নের। আইনসভার অনুমোদনে প্রণীত না হওয়ায় লক্ষ করা যায় অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা, উপধারাসমূহ তথা বিধানাবলি মূলত ১৯২২ সালের মূল আইনেরই স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রদত্ত প্রেসক্রিপশনের আলোকে প্রণীত এবং এটি সে হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের ভাষা ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে গেলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, বছর বছর অর্থ আইনে যেসব ছিটেফোঁটা শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন অনুমোদিত হয়েছে তা ধারণ করা ছাড়া ১৯২২-এর মূল আইনের ভাব, ভাষায় দৃষ্টিভঙ্গিগত তেমন কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার দৃশ্যগোচর হয় না। বরং প্রতি বছর কর নির্ধারণ, শুনানি, বিচার-আচারে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বা এখতিয়ার, কর অবকাশ, নিষ্কৃতি তথা ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলির ধারা-উপধারা সংযোজন-বিয়োজন করতে করতে অনেক ক্ষেত্রেই করারোপ, আদায় ও করদাতার অধিকার, কর অবকাশ নিষ্কৃৃতিও সুবিধা-সংক্রান্ত মৌল দর্শন হয়েছে কখনো বা বিভ্রান্ত, কখনো বিকৃত ও ক্ষেত্রবিশেষে বিস্মৃত। পক্ষান্তরে, যুগধর্মের সঙ্গে সংগতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায়-সংক্রান্ত বিধানাবলি সহজীকরণ, সরলীকরণ তথা করদাতাবান্ধবকরণের পরিবর্তে ক্ষেত্রবিশেষে আরও জটিল হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতির সমকালীন পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে আয়কর ব্যবস্থাকে সংস্কারের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ-সংবলিত সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন প্রয়াস বারবার যেন উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাস্তব ও বাস্তবায়ন যোগ্যতার বিবেচনাকে সামনে রেখেই নতুন আয়কর আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, যা মন্ত্রিপরিষদ নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। নির্বাহী বিভাগ প্রণীত, প্রস্তাবিত খসড়া আইনটিকে প্রকৃত প্রস্তাবে আইনে পরিণত করার দায় এবং দায়িত্ব এখন আইন পরিষদের ওপর। জাতীয় সংসদে এটিকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যুগোপযোগী তথা প্রকৃত প্রস্তাবে বাস্তবায়নযোগ্য করেই অনুমোদিত হবেএটিই বিধিসংগত প্রত্যাশা। এটি যেন শতাব্দী ধরে চলে আসা ঔপনিবেশিক অসম্মান হয়রানির হেতুতে পরিণত না হয়, এটির মধ্যে যেন গণপ্রজাতন্ত্রী মনোভঙ্গির প্রকাশ পায়।
এ ক্ষেত্রে ২০১২ সালে পাস করা নয়া ভ্যাট আইন প্রবর্তনে অনাকাক্সিক্ষত বিড়ম্বনার অভিজ্ঞতা স্মর্তব্য। করদাতাদের কাছে সেবাধর্মী মনোভাব নিয়ে না গেলে, তাদের আস্থায় যেমন আনা হবে না এবং তাদের স্থায়ী করদাতা হিসেবেও পাওয়া যাবে না। আস্থা সৃষ্টির জন্য কর বিভাগে আপিল শোনার জন্য ট্রাইব্যুনালে বিচার বিভাগীয় সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার ব্যবস্থা এবং করদাতাদের আস্থা সৃষ্টিতে হয়রানি কমাতে কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা হ্রাস পরিকল্পনার পদক্ষেপ হিসেবে এ আইনের মধ্যে প্রতিবিধানের ব্যবস্থার নিশ্চয়তা কল্পে কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গটিও উঠে আসবে। উঠে আসবে কর প্রদানে সবাইকে আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে করের টাকা ব্যয়বণ্টনে স্বচ্ছতা বিধানের বিষয়টিও।
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক
প্রথম বিভাগ হ্যান্ডবল লিগ ২০২৩ এর উদ্বোধন আগামী রবিবার। বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং মৌসুমি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (কিউট) এর পৃষ্ঠপোষকতায় হবে হ্যান্ডবল লিগ।
গতকাল পল্টনের শহীদ (ক্যাপ্টেন) এম. মনসুর আলী জাতীয় হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের কনফারেন্স রুমে সংবাদ সম্মেলনে লিগ নিয়ে বিস্তারিত জানানো হয়। প্রথম বিভাগ লিগে অংশ নিচ্ছে ৬টি দল। দলগুলো হলো- ওল্ড আইডিয়ালস, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, স্টার স্পোর্টস, মনসুর স্পোর্টিং ক্লাব, পূর্বাচল পরিষদ ও সতীর্থ ক্লাব। রবিবার হ্যান্ডবল লিগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জনাব মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জনাব আসাদুজ্জামান কোহিনুর, লিগ কমিটির চেয়ারম্যান মো. মুজিবুল হকসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
একবার উইম্বলডন, দুবার ইউএস ওপেনের সেমিফাইনাল অবধি খেলেছিলেন আরিনা সাবালেঙ্কা। ফ্রেঞ্চ ওপেনে তিনবারই বিদায় নিয়েছেন তৃতীয় রাউন্ড থেকে। অথচ প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে অংশ নিয়েই উঠে গেলেন ফাইনালে। গতকাল মেলবোর্ন পার্কে একের পর এক চমকের জন্ম দিয়ে সেমিফাইনালে ওঠা মাগদা লিনেটকে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি ৭-৬, ৬-২ গেমে। আগামীকালের ফাইনালে সাবালেঙ্কার প্রতিপক্ষ গতবারের উইম্বলডন জয়ী ইলেনা রিবাকিনা। সাবেক চ্যাম্পিয়ন ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কাকে ৭-৬, ৬-৩ গেমে হারিয়ে দেন তিনি।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দ্বিতীয় মেয়াদ আগামী ২৩ এপ্রিল শেষ হচ্ছে। ১০ বছর পর নতুন রাষ্ট্রপতি পাচ্ছে দেশ। যদিও ২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হবে, কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী দুই মাস আগে অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
সেই হিসেবে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগে বাকি আর ২২ দিন।
এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে নানা জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে কে বসছেন রাষ্ট্রপতির চেয়ারে। বেশ কয়েকজন আছেন আলোচনায়। তবে এদের মধ্যে বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন।
বিস্তারিত পড়ুন রবিবার দেশ রূপান্তরেরর প্রথম পাতায়।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।