‘ভূমিহীন’ শহীদ এখন শিল্পপতি
আলাউদ্দিন আরিফ | ২২ জানুয়ারি, ২০১৯ ১০:৪০
দৈনিক ৫ কেজি গম মজুরিতে ‘ভূমিহীন’ শহীদুল ইসলাম (৬০) কাজ করতেন বন বিভাগের নার্সারিতে। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা বন বিভাগের খাতায় ভূমিহীন হলেও হবিরবাড়ি ইউনিয়নের শহীদ এখন বিশাল শিল্পপতি! হঠাৎ তার শিল্পপতি বনে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে ভালুকায় বন বিভাগের হাজারও একর ‘জমি বেদখল’।
নিজের দখলে থাকা প্রায় আড়াইশ একর জমিতে তিনি গড়েছেন শিল্পকারখানা; আছে আলিশান বাড়ি, সোয়েটার কারখানা, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কারখানা, অয়েল মিল, খাম্বা তৈরির কারখানা এবং একাধিক বিলাসবহুল গাড়িসহ নামে-বেনামে বিশাল সম্পদের পাহাড়। প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। গত নির্বাচনেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য ও সাবেক সেনা কর্মকর্তার পক্ষে তার এলাকায় গিয়ে কাজও করেন তিনি। অথচ একসময় শহীদ ছিলেন ভালুকা উপজেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
শহীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)। এ বিষয়ে দুদক ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এ মাসে অভিযোগ এসেছে বলে আমি শুনেছি। আমরা প্রাপ্ত সব অভিযোগ যাচাই করে অনুসন্ধানের অনুমোদন করার জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠাই। প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি পাওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু করি। শহীদের নামে অভিযোগ এলে সেটা ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে বলতে হবে।’
এদিকে ভালুকায় বনের জমি দখলমুক্ত করা হবে জানিয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভালুকায় বনের জমি যারাই দখল করে থাকুক আমরা দখলমুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ ‘বাউন্ডারি শহীদ’ ও তার সহযোগীদের বনের জমি দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দখলদার কারা আমি এখনো নিশ্চিত নই, আমি বন বিভাগের কাছে প্রতিবেদন চাইব। সে আলোকে জমিগুলো দখলমুক্ত করা হবে।’ শহীদের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, এখন তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। নিজে তো বটেই ছেলেসহ তার পরিবারের
অন্য সদস্যরা হজ করে এসেছে। তাই এসব দখলে আর মন নেই তার। স্থানীয় সাংবাদিক আতাউর রহমান বলেন, ‘ভালুকার হবিরবাড়ি অঞ্চলে শিল্পনগরী গড়ার কারিগর এই শহীদ। তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, জন্মসূত্রে গফরগাঁওয়ের বাসিন্দা হলেও তার বাবা আলাউদ্দিন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন হবিরবাড়ি ইউনিয়নে বাড়ি করেন। তিনি ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। তার ছেলে বন বিভাগের কর্মচারী শহীদ বনের জমি দখল করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন হবিরবাড়ি, জমিরদিয়া, কাশর, পাড়াগাঁওসহ আশপাশের এলাকায় নিজের দখল সাম্রাজ্য তৈরি করেন। তিনি বিএনপি সরকারের আমলে উপজেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। পরে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ বনে যান।
স্থানীয়রা জানায়, নিজেই দখল করে ক্ষান্ত হননি। বাইরে থেকে শিল্পপতিদের ডেকে এনে বিশাল অর্থের বিনিময়ে নিজের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে শত শত জমি দখল করে দিয়েছেন। জমি দখলের পদ্ধতিও সেখানে ভিন্ন রকমের। প্রথমে ব্যক্তিমালিকানার কিছু জমি কেনা হয়। এরপর তার চারপাশে বন বিভাগের কয়েকশ বিঘা জমি বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে নেন। এতে নেতৃত্বে দেওয়ার কারণেই শহীদুল ইসলামের নাম হয় ‘বাউন্ডারি শহীদ’। এলাকাবাসীর কাছে তার পরিচয় ‘শহীদ ভাই’। তার রয়েছে কয়েকশ লাঠিয়ালের বিশাল বাহিনী। আর প্রশাসন যাতে কোনো বাধা না হয় সেজন্য আছে নগদ নারায়ণ। ময়মনসিংহ থেকে বন অধিদপ্তরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাজি শহীদুল ইসলাম ওরফে বাউন্ডারি শহীদের কারণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে ময়মনসিংহ বন বিভাগের ভালুকা রেঞ্জ। এরই মধ্যে মল্লিকবাড়ি বন বিটের ১ হাজার ৫৯৯ একর জমির পুরোটাই দখল হয়ে গেছে। খোদ বিট অফিসারই এখন অন্য বিটে আশ্রিত। হবিরবাড়ি বিটের প্রায় ৭ হাজার ১০ একর জমির মধ্যে ৪ হাজার ১৪৪ একর জমি এবং কাদিগড় বিটের ৪ হাজার ৬৮৬ একর জমির মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি অর্থাৎ ৩হাজার ৬০ একর জমি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে গেছে। এই বিটের পারাগাঁও মৌজায় বন বিভাগের জমি ছিল ১ হাজার ৬৪৬ একর ৭২ শতক। এ জমির এক শতকও আর বন বিভাগের দখলে নেই। আর এসব বিটের বেদখল হওয়া জমির ৬০ শতাংশই হয়েছে বাউন্ডারি শহীদের মাধ্যমে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সিডস্টোর বাজারের জায়গাটি রিজার্ভ ফরেস্টের। যেখানে বন থাকার কথা, সেই জায়গায় এখন সারি সারি অট্টালিকা। বিশাল বিশাল শিল্পকারখানা। যার অধিকাংশই দখল ও স্থাপন হয় শহীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়।
স্থানীয় একজন বন কর্মকর্তা জানান, ভালুকা শিল্পাঞ্চল হওয়ায় সেখানকার জমি সোনার চেয়ে দামি। এ কারণে বনের জমিতে দৃষ্টি পড়ে ভূমিদস্যুদের। আর দখলে তাদের সহযোগিতা করেন শহীদ। দিনে যদি কোনো বনকর্মী শহীদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, রাতেই তার ওপর হামলা হয়। মুখে কালো কাপড় বেঁধে হামলা করে কিল-ঘুসি দিয়ে আধমরা করে চলে যায় তারা। অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় দেখানোর ঘটনাও ঘটেছে।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, শহীদের বিরুদ্ধে হত্যা ও বন দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে প্রায় ২৫টি মামলা আছে। কিন্তু সব মামলাতেই হয় তার নাম নতুবা পিতার নাম ভুল। আবার কোনো কোনো মামলায় তার ঠিকানা ভুল দেওয়া হয়েছে। কখনও জমির দাগ নম্বরে ভুল করে তাকে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে বরাবরই পার পেয়ে যান শহীদ।
স্থানীয়রা জানায়, হাজি শহীদ এখন বিশাল শিল্পপতি। সিডস্টোর বাজারের পূর্বদিকে ২০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে সুপ্তি সোয়েটার ও সুপ্তি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কারখানা, দক্ষিণ দিকে ১০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে সুপ্তি অয়েল লিমিটেড। কোকাকোলার পশ্চিমে সাত বিঘা জমির ওপর রয়েছে তার হাজি এন্টারপ্রাইজ নামে আরসিসি পিলারের (খাম্বা) কারখানা। রাজধানী ঢাকাতেও তার একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে।
বন কর্মকর্তারা জানান, শহীদের নামে প্রথম মামলা হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে। একই বছর তার বিরুদ্ধে আরও ৩টি মামলা করে বন বিভাগ। কিন্তু এসব মামলায় তার কিছুই হয়নি। ২০০৪-০৬ সাল পর্যন্ত সেই সময়কার বিট অফিসার মুস্তফিজুল হক (ফরেস্টার) বেশ কয়েকটি মামলা করেন। কিন্তু সবগুলো মামলায় তার বা বাবার নামের ক্ষেত্রে নানা রকম ত্রুটি রাখা হয়। এর মধ্যে ২২হবি/৩১ ভালুকা থানার মামলায় শহীদুল ইসলামের বদলে কৌশলে এস. ইসলাম এবং বাবার নাম আলাউদ্দিনের বদলে আ. উদ্দিন লেখা হয়। এরপর মামলা নম্বর ২৩হবি/৩২ ভালু একই ভুল করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮হবি/৮ভালু মামলায় শহীদের নাম ঠিক লিখলেও বাবার নাম অফিমুদ্দিন লেখা হয়।
এ ছাড়া ১৯৯৮ সালে কোরবানির ঈদের দিন নিজের ঘরে খুন হন ভালুকার আকবর মেম্বার। ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয় ‘বাউন্ডারি শহীদকে’। ওই মামলায় বেশ কিছুদিন জেল খাটতে হয় শহীদকে। পরে ওই মামলা তুলে নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
ভালুকা থানার ওসি মো. ফিরোজ তালুকদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শহীদুল ইসলাম ওরফে বাউন্ডারি শহীদ আগে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন আওয়ামী লীগ করেন। তিনি এবারও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত একজন এমপির পক্ষে কাজ করেন। বাউন্ডারি শহীদের নামে ভালুকা থানায় বেশ কিছু মামলা ছিল; যার সবই চার্জশিট হওয়ার পর আদালতে বিচারাধীন।’
তিনি আরও বলেন, তিনি থানায় আসার পর বাউন্ডারি শহীদের নামে ভালুকা থানায় কোনো মামলা হয়নি।
রেঞ্জ অফিসার মোজাম্মেল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শহীদ ওরফে বাউন্ডারি শহীদের বন বিভাগের অনেক জমি অবৈধ দখল করার বিষয়ে শুনেছি। আমি এলাকায় নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। শহীদের নামে আগে কী মামলা ছিল, সেগুলোর ফাইলপত্র দেখছি। তার অবৈধ দখলের বিষয়ে বন বিভাগের প্রধান কার্যালয়কে অবহিত করা হবে।’
ভালুকা উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একসময় বন বিভাগে চাকরি করলেও মূলত জমির দালালি করে এখন শহীদুল ইসলাম ওরফে বাউন্ডারি শহীদ বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক। তার বাবা একসময় হবিরবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন। শহীদের ছেলে এখন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি মূলত ব্যবসা দেখাশোনা করেন।’ তবে শহীদ এখন আর ওইসব কাজের সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান তিনি।
কেন্দ্রীয় বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক রকিবুল হাসান মুকুল বলেন, ‘ভালুকাসহ সারা দেশে বনের জমি ডিমারকেশন করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এখানে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলে থাকবে। মার্ক করার কাজ শেষ হলে উদ্ধারে বিশেষ অভিযান করা হবে। সেখানে কেউ ছাড় পাবে না।’
বনের জমি অবৈধভাবে দখলের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চেষ্টা করেও হাজি শহীদুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠানো হলেও জবাব দেননি তিনি।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
আলাউদ্দিন আরিফ | ২২ জানুয়ারি, ২০১৯ ১০:৪০

দৈনিক ৫ কেজি গম মজুরিতে ‘ভূমিহীন’ শহীদুল ইসলাম (৬০) কাজ করতেন বন বিভাগের নার্সারিতে। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা বন বিভাগের খাতায় ভূমিহীন হলেও হবিরবাড়ি ইউনিয়নের শহীদ এখন বিশাল শিল্পপতি! হঠাৎ তার শিল্পপতি বনে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে ভালুকায় বন বিভাগের হাজারও একর ‘জমি বেদখল’।
নিজের দখলে থাকা প্রায় আড়াইশ একর জমিতে তিনি গড়েছেন শিল্পকারখানা; আছে আলিশান বাড়ি, সোয়েটার কারখানা, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কারখানা, অয়েল মিল, খাম্বা তৈরির কারখানা এবং একাধিক বিলাসবহুল গাড়িসহ নামে-বেনামে বিশাল সম্পদের পাহাড়। প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। গত নির্বাচনেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য ও সাবেক সেনা কর্মকর্তার পক্ষে তার এলাকায় গিয়ে কাজও করেন তিনি। অথচ একসময় শহীদ ছিলেন ভালুকা উপজেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
শহীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)। এ বিষয়ে দুদক ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এ মাসে অভিযোগ এসেছে বলে আমি শুনেছি। আমরা প্রাপ্ত সব অভিযোগ যাচাই করে অনুসন্ধানের অনুমোদন করার জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠাই। প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি পাওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু করি। শহীদের নামে অভিযোগ এলে সেটা ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে বলতে হবে।’
এদিকে ভালুকায় বনের জমি দখলমুক্ত করা হবে জানিয়ে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভালুকায় বনের জমি যারাই দখল করে থাকুক আমরা দখলমুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ ‘বাউন্ডারি শহীদ’ ও তার সহযোগীদের বনের জমি দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দখলদার কারা আমি এখনো নিশ্চিত নই, আমি বন বিভাগের কাছে প্রতিবেদন চাইব। সে আলোকে জমিগুলো দখলমুক্ত করা হবে।’ শহীদের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, এখন তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। নিজে তো বটেই ছেলেসহ তার পরিবারের
অন্য সদস্যরা হজ করে এসেছে। তাই এসব দখলে আর মন নেই তার। স্থানীয় সাংবাদিক আতাউর রহমান বলেন, ‘ভালুকার হবিরবাড়ি অঞ্চলে শিল্পনগরী গড়ার কারিগর এই শহীদ। তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, জন্মসূত্রে গফরগাঁওয়ের বাসিন্দা হলেও তার বাবা আলাউদ্দিন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন হবিরবাড়ি ইউনিয়নে বাড়ি করেন। তিনি ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। তার ছেলে বন বিভাগের কর্মচারী শহীদ বনের জমি দখল করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন হবিরবাড়ি, জমিরদিয়া, কাশর, পাড়াগাঁওসহ আশপাশের এলাকায় নিজের দখল সাম্রাজ্য তৈরি করেন। তিনি বিএনপি সরকারের আমলে উপজেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। পরে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ বনে যান।
স্থানীয়রা জানায়, নিজেই দখল করে ক্ষান্ত হননি। বাইরে থেকে শিল্পপতিদের ডেকে এনে বিশাল অর্থের বিনিময়ে নিজের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে শত শত জমি দখল করে দিয়েছেন। জমি দখলের পদ্ধতিও সেখানে ভিন্ন রকমের। প্রথমে ব্যক্তিমালিকানার কিছু জমি কেনা হয়। এরপর তার চারপাশে বন বিভাগের কয়েকশ বিঘা জমি বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে নেন। এতে নেতৃত্বে দেওয়ার কারণেই শহীদুল ইসলামের নাম হয় ‘বাউন্ডারি শহীদ’। এলাকাবাসীর কাছে তার পরিচয় ‘শহীদ ভাই’। তার রয়েছে কয়েকশ লাঠিয়ালের বিশাল বাহিনী। আর প্রশাসন যাতে কোনো বাধা না হয় সেজন্য আছে নগদ নারায়ণ। ময়মনসিংহ থেকে বন অধিদপ্তরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাজি শহীদুল ইসলাম ওরফে বাউন্ডারি শহীদের কারণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে ময়মনসিংহ বন বিভাগের ভালুকা রেঞ্জ। এরই মধ্যে মল্লিকবাড়ি বন বিটের ১ হাজার ৫৯৯ একর জমির পুরোটাই দখল হয়ে গেছে। খোদ বিট অফিসারই এখন অন্য বিটে আশ্রিত। হবিরবাড়ি বিটের প্রায় ৭ হাজার ১০ একর জমির মধ্যে ৪ হাজার ১৪৪ একর জমি এবং কাদিগড় বিটের ৪ হাজার ৬৮৬ একর জমির মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি অর্থাৎ ৩হাজার ৬০ একর জমি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে গেছে। এই বিটের পারাগাঁও মৌজায় বন বিভাগের জমি ছিল ১ হাজার ৬৪৬ একর ৭২ শতক। এ জমির এক শতকও আর বন বিভাগের দখলে নেই। আর এসব বিটের বেদখল হওয়া জমির ৬০ শতাংশই হয়েছে বাউন্ডারি শহীদের মাধ্যমে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সিডস্টোর বাজারের জায়গাটি রিজার্ভ ফরেস্টের। যেখানে বন থাকার কথা, সেই জায়গায় এখন সারি সারি অট্টালিকা। বিশাল বিশাল শিল্পকারখানা। যার অধিকাংশই দখল ও স্থাপন হয় শহীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়।
স্থানীয় একজন বন কর্মকর্তা জানান, ভালুকা শিল্পাঞ্চল হওয়ায় সেখানকার জমি সোনার চেয়ে দামি। এ কারণে বনের জমিতে দৃষ্টি পড়ে ভূমিদস্যুদের। আর দখলে তাদের সহযোগিতা করেন শহীদ। দিনে যদি কোনো বনকর্মী শহীদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, রাতেই তার ওপর হামলা হয়। মুখে কালো কাপড় বেঁধে হামলা করে কিল-ঘুসি দিয়ে আধমরা করে চলে যায় তারা। অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় দেখানোর ঘটনাও ঘটেছে।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, শহীদের বিরুদ্ধে হত্যা ও বন দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে প্রায় ২৫টি মামলা আছে। কিন্তু সব মামলাতেই হয় তার নাম নতুবা পিতার নাম ভুল। আবার কোনো কোনো মামলায় তার ঠিকানা ভুল দেওয়া হয়েছে। কখনও জমির দাগ নম্বরে ভুল করে তাকে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে বরাবরই পার পেয়ে যান শহীদ।
স্থানীয়রা জানায়, হাজি শহীদ এখন বিশাল শিল্পপতি। সিডস্টোর বাজারের পূর্বদিকে ২০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে সুপ্তি সোয়েটার ও সুপ্তি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কারখানা, দক্ষিণ দিকে ১০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে সুপ্তি অয়েল লিমিটেড। কোকাকোলার পশ্চিমে সাত বিঘা জমির ওপর রয়েছে তার হাজি এন্টারপ্রাইজ নামে আরসিসি পিলারের (খাম্বা) কারখানা। রাজধানী ঢাকাতেও তার একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে।
বন কর্মকর্তারা জানান, শহীদের নামে প্রথম মামলা হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে। একই বছর তার বিরুদ্ধে আরও ৩টি মামলা করে বন বিভাগ। কিন্তু এসব মামলায় তার কিছুই হয়নি। ২০০৪-০৬ সাল পর্যন্ত সেই সময়কার বিট অফিসার মুস্তফিজুল হক (ফরেস্টার) বেশ কয়েকটি মামলা করেন। কিন্তু সবগুলো মামলায় তার বা বাবার নামের ক্ষেত্রে নানা রকম ত্রুটি রাখা হয়। এর মধ্যে ২২হবি/৩১ ভালুকা থানার মামলায় শহীদুল ইসলামের বদলে কৌশলে এস. ইসলাম এবং বাবার নাম আলাউদ্দিনের বদলে আ. উদ্দিন লেখা হয়। এরপর মামলা নম্বর ২৩হবি/৩২ ভালু একই ভুল করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮হবি/৮ভালু মামলায় শহীদের নাম ঠিক লিখলেও বাবার নাম অফিমুদ্দিন লেখা হয়।
এ ছাড়া ১৯৯৮ সালে কোরবানির ঈদের দিন নিজের ঘরে খুন হন ভালুকার আকবর মেম্বার। ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয় ‘বাউন্ডারি শহীদকে’। ওই মামলায় বেশ কিছুদিন জেল খাটতে হয় শহীদকে। পরে ওই মামলা তুলে নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
ভালুকা থানার ওসি মো. ফিরোজ তালুকদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শহীদুল ইসলাম ওরফে বাউন্ডারি শহীদ আগে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন আওয়ামী লীগ করেন। তিনি এবারও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত একজন এমপির পক্ষে কাজ করেন। বাউন্ডারি শহীদের নামে ভালুকা থানায় বেশ কিছু মামলা ছিল; যার সবই চার্জশিট হওয়ার পর আদালতে বিচারাধীন।’
তিনি আরও বলেন, তিনি থানায় আসার পর বাউন্ডারি শহীদের নামে ভালুকা থানায় কোনো মামলা হয়নি।
রেঞ্জ অফিসার মোজাম্মেল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শহীদ ওরফে বাউন্ডারি শহীদের বন বিভাগের অনেক জমি অবৈধ দখল করার বিষয়ে শুনেছি। আমি এলাকায় নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। শহীদের নামে আগে কী মামলা ছিল, সেগুলোর ফাইলপত্র দেখছি। তার অবৈধ দখলের বিষয়ে বন বিভাগের প্রধান কার্যালয়কে অবহিত করা হবে।’
ভালুকা উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একসময় বন বিভাগে চাকরি করলেও মূলত জমির দালালি করে এখন শহীদুল ইসলাম ওরফে বাউন্ডারি শহীদ বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক। তার বাবা একসময় হবিরবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন। শহীদের ছেলে এখন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি মূলত ব্যবসা দেখাশোনা করেন।’ তবে শহীদ এখন আর ওইসব কাজের সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান তিনি।
কেন্দ্রীয় বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক রকিবুল হাসান মুকুল বলেন, ‘ভালুকাসহ সারা দেশে বনের জমি ডিমারকেশন করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এখানে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলে থাকবে। মার্ক করার কাজ শেষ হলে উদ্ধারে বিশেষ অভিযান করা হবে। সেখানে কেউ ছাড় পাবে না।’
বনের জমি অবৈধভাবে দখলের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চেষ্টা করেও হাজি শহীদুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠানো হলেও জবাব দেননি তিনি।