জাহালমকাণ্ডে নিজেদের যেসব দোষ খুঁজে পেল দুদক
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১১ জুলাই, ২০১৯ ২১:৫৯
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে নিরপরাধ জাহালমকে কারাবাস করতে হয়েছে বলে জানিয়েছে খোদ দুদক। তবে ব্র্যাক ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলো তাদের ভুল পথে পরিচালতি করেছে বলে জানিয়েছে দুদক।
আদেশের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার দুদকের পক্ষে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করেন সংস্থার আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।
দুদক আইনজীবী প্রতিবেদনের বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সমন্বয়হীনতার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে আমার কছে মনে হয়েছে। জাহালম তিন বছর জেল খেটেছে- এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এখন এর জন্য কে কতটুকু দায়ী তা আদালতই নির্ধারণ করবেন।’
মঙ্গলবার এ প্রতিবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট। আদালতে জাহালমের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ঋন জালিয়াতির ঘটনার মূল হোতা ৩৩ মামলার আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ধুবুড়িয়া গ্রামের নিরপরাধ জাহালমকে গ্রেপ্তার করে দুদক। পরে ২৬টি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি গত ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত।
শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট জাহালমকে তাৎক্ষণিক কারামুক্তির নির্দেশ দিলে ওই দিন দিবাগত রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান জাহালম।
পাশাপাশি জাহালমের ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এছাড়া জাহালমের কারাবাসে কে বা কারা দায়ী তা খতিয়ে দেখতে গত ১৭ এপ্রিল এক আদেশে দুদকের প্রতিবেদন চেয়েছিল হাইকোর্টের এই বেঞ্চ। এরই ধারাবাহিকতায় দুদকের তদন্ত কমিটির প্রধান প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (লিগ্যাল) আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদের তৈরি এ প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করা হয়।
প্রতিবেদনে ঘটনার প্রেক্ষাপট, আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমকে আসামি করা, দুদকের এই মামলাগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্ব নিরুপনসহ ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার রোধে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেছেন, ‘জাহালমকে আবু সালেকরূপে চিহ্নিত করার যে ভুলটি হয়েছে, তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে। আর তাদের ভুল পথে চালিত করতে সহায়তা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং অ্যাকাউন্টের ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয়দানকারীরা।’
তিনি বলেন, ‘এই মামলাগুলোতে ১২ তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করেছিলেন। কিন্তু তাদের কেউ জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করেননি। আমি আমার তদন্তকালে জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করেছি। তার বাড়িটির দৈন্যদশা এতটাই প্রকট যে, যে কোনো ব্যাক্তির মনে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত একজন ব্যক্তির বাড়ির এই দৈন্যদশা কেন? এক্ষেত্রে জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করলেই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মনে সন্দেহ দেখা দিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাহালমকে যখন দুদকে তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ প্রথম দেখে, তখন সে একজন পাটকল শ্রমিক- এই প্রশ্নটি কেন তদন্ত কর্মকর্তাদের মনে আসল না সেটি আমার কাছে বোধগম্য নয়।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহালমের ইংরেজি লিখতে না জানা, লেখা পড়া না জানা, তার সামাজিক অবস্থান ও আর্থিক সঙ্গতি বিবেচনায় না নেয়া হয়নি। এগুলো ঠিকমতো বিবেচনা করলে তখনি উদঘাটিত হতো যে জাহালম প্রকৃত আসামি নন। এছাড়া এই ঘটনায় আত্মসাত হয়েছে ১৮ কেটি টাকার বেশি। কিন্তু এই টাকা কোথায় গেল তদন্তকারী কর্মকর্তারা সে বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করেননি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই মামলায় অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা জড়িত থাকলেও এবং তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকলেও তাদের কাউকে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযুক্ত করা হয়নি। কিন্তু তাদেরকে এই ধারায় চার্জশিটে অন্তর্ভূক্ত করা উচিৎ ছিল।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১১ জুলাই, ২০১৯ ২১:৫৯

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে নিরপরাধ জাহালমকে কারাবাস করতে হয়েছে বলে জানিয়েছে খোদ দুদক। তবে ব্র্যাক ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলো তাদের ভুল পথে পরিচালতি করেছে বলে জানিয়েছে দুদক।
আদেশের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার দুদকের পক্ষে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করেন সংস্থার আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।
দুদক আইনজীবী প্রতিবেদনের বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সমন্বয়হীনতার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে আমার কছে মনে হয়েছে। জাহালম তিন বছর জেল খেটেছে- এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এখন এর জন্য কে কতটুকু দায়ী তা আদালতই নির্ধারণ করবেন।’
মঙ্গলবার এ প্রতিবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট। আদালতে জাহালমের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ঋন জালিয়াতির ঘটনার মূল হোতা ৩৩ মামলার আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ধুবুড়িয়া গ্রামের নিরপরাধ জাহালমকে গ্রেপ্তার করে দুদক। পরে ২৬টি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি গত ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত।
শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট জাহালমকে তাৎক্ষণিক কারামুক্তির নির্দেশ দিলে ওই দিন দিবাগত রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান জাহালম।
পাশাপাশি জাহালমের ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এছাড়া জাহালমের কারাবাসে কে বা কারা দায়ী তা খতিয়ে দেখতে গত ১৭ এপ্রিল এক আদেশে দুদকের প্রতিবেদন চেয়েছিল হাইকোর্টের এই বেঞ্চ। এরই ধারাবাহিকতায় দুদকের তদন্ত কমিটির প্রধান প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (লিগ্যাল) আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদের তৈরি এ প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করা হয়।
প্রতিবেদনে ঘটনার প্রেক্ষাপট, আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমকে আসামি করা, দুদকের এই মামলাগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্ব নিরুপনসহ ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার রোধে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেছেন, ‘জাহালমকে আবু সালেকরূপে চিহ্নিত করার যে ভুলটি হয়েছে, তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে। আর তাদের ভুল পথে চালিত করতে সহায়তা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং অ্যাকাউন্টের ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয়দানকারীরা।’
তিনি বলেন, ‘এই মামলাগুলোতে ১২ তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করেছিলেন। কিন্তু তাদের কেউ জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করেননি। আমি আমার তদন্তকালে জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করেছি। তার বাড়িটির দৈন্যদশা এতটাই প্রকট যে, যে কোনো ব্যাক্তির মনে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত একজন ব্যক্তির বাড়ির এই দৈন্যদশা কেন? এক্ষেত্রে জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করলেই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মনে সন্দেহ দেখা দিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাহালমকে যখন দুদকে তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ প্রথম দেখে, তখন সে একজন পাটকল শ্রমিক- এই প্রশ্নটি কেন তদন্ত কর্মকর্তাদের মনে আসল না সেটি আমার কাছে বোধগম্য নয়।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহালমের ইংরেজি লিখতে না জানা, লেখা পড়া না জানা, তার সামাজিক অবস্থান ও আর্থিক সঙ্গতি বিবেচনায় না নেয়া হয়নি। এগুলো ঠিকমতো বিবেচনা করলে তখনি উদঘাটিত হতো যে জাহালম প্রকৃত আসামি নন। এছাড়া এই ঘটনায় আত্মসাত হয়েছে ১৮ কেটি টাকার বেশি। কিন্তু এই টাকা কোথায় গেল তদন্তকারী কর্মকর্তারা সে বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করেননি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই মামলায় অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা জড়িত থাকলেও এবং তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকলেও তাদের কাউকে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযুক্ত করা হয়নি। কিন্তু তাদেরকে এই ধারায় চার্জশিটে অন্তর্ভূক্ত করা উচিৎ ছিল।