এরশাদ: সেনাশাসক থেকে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ এক রাজনীতিক
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৪ জুলাই, ২০১৯ ১১:১৬
ছবি: সংগৃহীত
সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রবিবার সকালে মারা গেছেন। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায় চার দশকের এক আলোচিত রাজনীতিবিদের অধ্যায় শেষ হলো।
রাজনীতিতে এরশাদের উত্থানের আভাস কিছুটা টের পাওয়া গেলেও গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার রাজনীতির গতিবিধি বোঝা ছিল দুষ্কর। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে তার নামটা রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, ওই পরিস্থিতে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদের ক্ষমতায় আসাটা ‘অনেকটা নিশ্চিত’ ছিল। তবে কবে নাগাদ তিনি ক্ষমতা নিচ্ছেন সেটাই ছিল দেখার।
ওই সময়ের রাজনীতি নিয়ে কিছু লেখায় পাওয়া যায়, সেনাপ্রধান হওয়ার পর জিয়াউর রহমান জীবিত থাকতেই আমলা, বুদ্ধিজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ দেশের নেতৃস্থানীয়, আলোচিত ও প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এরশাদ। এ থেকেই রাজনীতির প্রতি এই সেনা কর্মকর্তার উচ্চাভিলাষের বিষয়টি টের পাওয়া যায়।
ফলে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর এরশাদের রাজনীতিতে আসা ছিল অনেকটা অনুমেয়। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন।
এরপর ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই দলের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
স্বৈরাচারবিরোধী প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদ গ্রেপ্তার হন। তাকে কারাবন্দি করে রাখা হয়।
বিএনপি সরকার তার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
বলা হয়ে থাকে, এরশাদের কারামুক্তির শর্তেই ৯৬ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর কারামুক্তির পথ খোলে সাবেক এই স্বৈরশাসকের।
এর পরই অনেকটা পাল্টে যান এরশাদ। রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার গতিবিধি টের পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তার ঘনিষ্ঠরা জানান, কারাজীবনই এরশাদকে বদলে দিয়েছে। তিনি কারাগারকে মারাত্মক ভয় পেতেন।
কারণ এরশাদ কারামুক্ত হলেও তার মাথায় ঝুলছিল অনেকগুলো মামলা। একে একে ৪২টি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন সাবেক এই স্বৈরশাসক। মৃত্যুর আগপর্যন্ত মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যা মামলায় তিনি আটকে ছিলেন।
এরশাদ নিজেও মামলার কারণে চাপে থাকার কথা মাঝেমধ্যেই বলতেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখনো আমার নামে মামলা আছে। একটা দিনের জন্যও মুক্ত ছিলাম না, এখনো নেই। আমার মতো দুঃখী রাজনীতিবিদ আর কেউ নেই।’
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যাওয়ার দোড়-ঝাঁপের মধ্যেই এরশাদ ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়।
এরপর ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে চরম নাটকীয়তার জন্ম দেন এরশাদ। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কথা এই বললেন তো কিছুক্ষণ পরে বেঁকে বসেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাপের মুখে আত্মহত্যার হুমকিও দিয়ে বসেন এরশাদ। তিনি বলেন, “এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জনগণ আমাকে থুথু দেবে।”
অবশ্য শেষ পর্যন্ত ‘অসুস্থ’ এরশাদকে সিএমএইচে চিকিৎসা দিতে নিয়ে যাওয়া হলে এই নাটকীয়তার অবসান হয়। বিএনপিসহ নিবন্ধিত প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দলের বর্জনের ওই নির্বাচনে এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পার্টির একটি অংশ অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হন এরশাদ।
সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি একক নাকি জোটগতভাবে অংশগ্রহণ করবে সে নিয়ে সিদ্ধান্তহীন ছিলেন এরশাদ। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবেই অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। তবে সরকারে না গিয়ে এরশাদ হন চলতি জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের নেতা।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৪ জুলাই, ২০১৯ ১১:১৬

সাবেক রাষ্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রবিবার সকালে মারা গেছেন। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায় চার দশকের এক আলোচিত রাজনীতিবিদের অধ্যায় শেষ হলো।
রাজনীতিতে এরশাদের উত্থানের আভাস কিছুটা টের পাওয়া গেলেও গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার রাজনীতির গতিবিধি বোঝা ছিল দুষ্কর। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে তার নামটা রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, ওই পরিস্থিতে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদের ক্ষমতায় আসাটা ‘অনেকটা নিশ্চিত’ ছিল। তবে কবে নাগাদ তিনি ক্ষমতা নিচ্ছেন সেটাই ছিল দেখার।
ওই সময়ের রাজনীতি নিয়ে কিছু লেখায় পাওয়া যায়, সেনাপ্রধান হওয়ার পর জিয়াউর রহমান জীবিত থাকতেই আমলা, বুদ্ধিজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ দেশের নেতৃস্থানীয়, আলোচিত ও প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এরশাদ। এ থেকেই রাজনীতির প্রতি এই সেনা কর্মকর্তার উচ্চাভিলাষের বিষয়টি টের পাওয়া যায়।
ফলে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর এরশাদের রাজনীতিতে আসা ছিল অনেকটা অনুমেয়। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন।
এরপর ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই দলের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
স্বৈরাচারবিরোধী প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদ গ্রেপ্তার হন। তাকে কারাবন্দি করে রাখা হয়।
বিএনপি সরকার তার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
বলা হয়ে থাকে, এরশাদের কারামুক্তির শর্তেই ৯৬ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর কারামুক্তির পথ খোলে সাবেক এই স্বৈরশাসকের।
এর পরই অনেকটা পাল্টে যান এরশাদ। রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার গতিবিধি টের পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তার ঘনিষ্ঠরা জানান, কারাজীবনই এরশাদকে বদলে দিয়েছে। তিনি কারাগারকে মারাত্মক ভয় পেতেন।
কারণ এরশাদ কারামুক্ত হলেও তার মাথায় ঝুলছিল অনেকগুলো মামলা। একে একে ৪২টি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন সাবেক এই স্বৈরশাসক। মৃত্যুর আগপর্যন্ত মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যা মামলায় তিনি আটকে ছিলেন।
এরশাদ নিজেও মামলার কারণে চাপে থাকার কথা মাঝেমধ্যেই বলতেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখনো আমার নামে মামলা আছে। একটা দিনের জন্যও মুক্ত ছিলাম না, এখনো নেই। আমার মতো দুঃখী রাজনীতিবিদ আর কেউ নেই।’
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যাওয়ার দোড়-ঝাঁপের মধ্যেই এরশাদ ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়।
এরপর ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে চরম নাটকীয়তার জন্ম দেন এরশাদ। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কথা এই বললেন তো কিছুক্ষণ পরে বেঁকে বসেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাপের মুখে আত্মহত্যার হুমকিও দিয়ে বসেন এরশাদ। তিনি বলেন, “এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জনগণ আমাকে থুথু দেবে।”
অবশ্য শেষ পর্যন্ত ‘অসুস্থ’ এরশাদকে সিএমএইচে চিকিৎসা দিতে নিয়ে যাওয়া হলে এই নাটকীয়তার অবসান হয়। বিএনপিসহ নিবন্ধিত প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দলের বর্জনের ওই নির্বাচনে এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পার্টির একটি অংশ অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হন এরশাদ।
সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি একক নাকি জোটগতভাবে অংশগ্রহণ করবে সে নিয়ে সিদ্ধান্তহীন ছিলেন এরশাদ। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবেই অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। তবে সরকারে না গিয়ে এরশাদ হন চলতি জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের নেতা।