ব্যবস্থাপনা সংকটে বাড়ছে মৃত্যু
প্রতীক ইজাজ | ৭ আগস্ট, ২০১৯ ০৮:৪১
দিন দিন ডেঙ্গুর ধরন জটিল হয়ে উঠছে। আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড নিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর এবার বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা। গত এক সপ্তাহ ধরেই রাজধানীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর আসছে। জুলাইয়ের শেষের দিকেও যেখানে সাধারণ চিকিৎসাতেই একজন ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে যেতেন; এখন সেখানে হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এমনকি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় যাওয়ার পর হঠাৎ করেই রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে এবং হাসপাতালে আসতে আসতেই মারা যাচ্ছেন।
এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও রোগতত্ত্ববিদরা রোগী ও চিকিৎসকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা রোগীদের উদ্দেশে বলছেন, জ¦র হওয়া মাত্রই দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হবে। ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। এ হাসপাতালে সে হাসপাতালে না ঘুরে আশপাশে যে হাসপাতাল রয়েছে, সেখানেই চিকিৎসা নিতে হবে।
অন্যদিকে, চিকিৎসকদের উদ্দেশে তারা বলেছেন, যেহেতু এবার ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে, তাই জ¦র সেরে যাওয়ার পরও রোগীকে হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এ সময় রোগীর ‘ক্লোজ মনিটরিং’ দরকার। রোগীকে ছেড়ে দিলে ফের হাসপাতালে আসতে দেরি করে ও জটিলতা বাড়ে।
চিকিৎসক ও রোগতত্ত্ববিদরা মৃত্যুর জন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ও রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা মারা যাওয়া ও জটিল রোগীদের পরীক্ষা করে দেখেছি, অনেক রোগী এমন অবস্থায় হাসপাতালে আসে তখন আর কিছু করার থাকে না। মারা যান। আবার কিছু রোগী আছেন যাদের ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্যান্য রোগও রয়েছে।
বিশেষ করে গর্ভবতী নারীরা খুবই ঝুঁকির মধ্যে। এসব রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবে মারা যাওয়া বা জটিল রোগীদের বেশিরভাগই রোগটিতে দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত। এসব রোগীরা সুস্থ হয়ে বাসায় যাওয়ার পরও আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ও মারা যাচ্ছেন।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সে ক্ষেত্রে রোগীদের জ¦র হওয়ামাত্রই হাসপাতালে আসতে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, রোগী জটিল হলে চিকিৎসকরা প্রয়োজনে বারান্দায় রেখেও চিকিৎসা দিচ্ছেন। কিন্তু সময়মতো আসতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতাকেও ডেঙ্গুর জটিলতা বৃদ্ধি ও মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, এখনো এডিস নিধনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছেই।
গত দুদিন ধরেই বেসরকারি হিসেবে ডেঙ্গুতে এ মৌসুমে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গতকাল মঙ্গলবার এক দিনে সারা দেশে আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকায় ছয়জন ও ঢাকার বাইরে দুজনের মৃত্যু হয়। এর আগে গত রবিবার সন্ধ্যা থেকে গত সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এক দিনের হিসাবে সর্বোচ্চ সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
এমনকি গত তিন দিন ধরেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড হচ্ছে। এর মধ্যে গতকাল সারা দেশে এক দিনে এ মৌসুমের সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৩৪৮ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ সংখ্যা ঘণ্টায় ৯৮ জন। এর আগে গত সোমবার এ সংখ্যা ছিল ঘণ্টায় ৮৬ জন।
এমনকি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সরকারি হিসাবেই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর নতুন রেকর্ডের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবেই মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ জনে পৌঁছেছে। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুর প্রকোপের বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সরকারি হিসাবে ৯৩ জন। এরপর প্রতি বছর মৃতের সংখ্যা ক্রমেই কমেছে। একপর্যায়ে কয়েক বছর মৃত্যুর তথ্যও আসেনি। তবে গত তিন বছর ধরেই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১৪ জনের। দুই বছর পর ২০১৮ সালে মৃতের সংখ্যা হয় ২৬। এ বছর ডেঙ্গু মৌসুমের মূল দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এখনো বাকি। এরই মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ হয়েছে। অবশ্য বেসরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। দেশ রূপান্তরের হিসাবে এ সংখ্যা ৬৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এবার ডেঙ্গুতে দেশে গত ১৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড হয়েছে। গত ১৮ বছরের মধ্যে দুবারে সর্বোচ্চ রেকর্ড ভেঙে গত ২৭ জুলাই শনিবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছায় ১০ হাজার ৫২৮ জনে।
এর আগে প্রথম ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন ও পরে গত বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন। অবশ্য গতকাল সে রেকর্ড ছড়িয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৯১২ জনে।
ডেঙ্গুতে এবার আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মৃতের সংখ্যাও সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে বহুজন দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছে এই জ¦রে। আবার আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করাও একটি কারণ।
অবশ্য আক্রান্ত অনুপাতে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা খুবই সামান্য বলে মত দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, মৃত্যু বেড়ে গেছে এমনটা মনে হয় না।
রোগী অনুপাতে মৃত্যু দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ১ শতাংশের অনেক কম। তবে এ মৃত্যুও কাক্সিক্ষত না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ও আক্রান্তরা সতর্ক থাকলে এটাও রোধ করা যেত। এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, এবার ডেঙ্গুর ধরন কিছুটা জটিল হয়েছে। তাই জ¦র ছেড়ে যাওয়ার পর ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আক্রান্তদের সতর্ক থাকতে হবে। এই সময়টা খুবই ‘ক্রিটিক্যাল’।
এই মৌসুমে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করেছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেসব রোগী মারা গেছে, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি, এসব রোগীর বেশিরভাগই অনেক হাসপাতাল ঘুরে একটাতে ভর্তি হয়েছে। এর ফলে ডেঙ্গু জটিল আকার ধারণ করেছে। রোগীকে বাঁচানো যায়নি। দ্বিতীয় কারণ আক্রান্তদের অনেকে দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছে।
এই সেকেন্ডারি ইনফেকশন জটিল। তাছাড়া যেসব রোগীর অন্যান্য রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা অন্য রোগ আছে, তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি।
এই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে বলেন, রোগীর জ¦র ভালো হলেও সতর্ক থাকতে হবে। জ¦র ছাড়ার পর বমি বমি ভাব থাকলে, খাবারে অনীহা দেখা দেয়, শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, তাহলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যাপারে বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের ক্লোজ মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। প্লাটিলেট নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। প্লাটিলেট অনেক কমে যাওয়ার পরও (যেমন ৫-১০ হাজারে নামলেও) ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কত দ্রুত নামছে সেটাই মুখ্য।
একজন মানুষের শরীরে দেড় লাখ প্লাটিলেট থাকলেই চলে, এক লাখ হলেও সমস্যা নেই। ৩০ হাজার পর্যন্ত হলেও তার হাসপাতালে ভর্তির দরকার নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলবে। চিকিৎসক যদি মনে করেন রোগী জটিল, তাহলে বেড না থাকলেও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেবেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে পরিমাণে আক্রান্ত, সে অনুপাতে মৃত্যু বেশি না। মাত্র এক শতাংশের ছয় ভাগের এক ভাগ। কিন্তু মৃত্যুর আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। রোগীরা অন্য রোগে বা কারণে মারা গেলেও মৃত্যু বলে প্রচার করা হচ্ছে। সুতরাং মৃত্যুর ব্যাপারে সঠিক তথ্য প্রচার করতে হবে।
এই পরিচালক বলেন, আমার হাসপাতালে ১৭ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছে বলে বলা হচ্ছে। অথচ আমরা কিন্তু এ তথ্য দিইনি। যেমনÑ গতকাল এক রোগী এলেন সন্ধ্যা ৬টার দিকে। তখন তার কোনো অর্গানই কাজ করছিল না। তিনি মারা যান। অথচ বলা হলো তিনি ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। তাই আমরা ডেথ রিভিউ কমিটি করেছি। এই কমিটি যাচাই-বাছাই করে মৃত্যুর সংখ্যা জানাবে। ভুল তথ্য প্রচার করলে মানুষ ভয় পাবে।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঠেকাতে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, জ¦র হলে সাধারণত তিন দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন দিনের আগেই যদি রোগীর খুব খারাপ লাগে, নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তাহলে আগেই পরীক্ষা করাতে হবে। আমরা এমনও দেখেছি, খুব ক্রিটিক্যাল রোগীদের ভর্তির পর সাধারণ স্যালাইন দিয়েই সুস্থ করা গেছে। সুতরাং সময়মতো হাসপাতালে আসতে হবে। বেড না থাকলেও আমরা বারান্দায় মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেব। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে শয্যা না পেয়ে রোগ জটিল করা উচিত হবে না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, সময়মতো হাসপাতালে না এলে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। আমরা দেখেছি এমনও রোগী আছে যারা এমন অবস্থায় এসেছে তখন আইসিইউ ছাড়া তাকে বাঁচানো যাচ্ছে না। অথচ হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ কম। সুতরাং আগেভাগেই হাসপাতালে আসতে হবে। আমরাই সিদ্ধান্ত নেব তাকে কী করতে হবে।
আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান ডেঙ্গুর ধরন বদলে যাওয়ার কারণে এবার ডেঙ্গু জটিল আকার নিয়েছে বলে মত দেন।
তিনি বলেন, সেরোটাইপ ডেঙ্গু এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি গত বছর থেকেই লক্ষ করা গেছে। এবার তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তবে বিষয়টি এখনো নতুন, তাই স্বচ্ছ ধারণার জন্য অধিকতর গবেষণা প্রয়োজন। তা না হলে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা দাঁড়াবে না।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
প্রতীক ইজাজ | ৭ আগস্ট, ২০১৯ ০৮:৪১

দিন দিন ডেঙ্গুর ধরন জটিল হয়ে উঠছে। আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড নিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর এবার বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা। গত এক সপ্তাহ ধরেই রাজধানীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর আসছে। জুলাইয়ের শেষের দিকেও যেখানে সাধারণ চিকিৎসাতেই একজন ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হয়ে যেতেন; এখন সেখানে হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এমনকি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় যাওয়ার পর হঠাৎ করেই রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে এবং হাসপাতালে আসতে আসতেই মারা যাচ্ছেন।
এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও রোগতত্ত্ববিদরা রোগী ও চিকিৎসকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা রোগীদের উদ্দেশে বলছেন, জ¦র হওয়া মাত্রই দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হবে। ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। এ হাসপাতালে সে হাসপাতালে না ঘুরে আশপাশে যে হাসপাতাল রয়েছে, সেখানেই চিকিৎসা নিতে হবে।
অন্যদিকে, চিকিৎসকদের উদ্দেশে তারা বলেছেন, যেহেতু এবার ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে, তাই জ¦র সেরে যাওয়ার পরও রোগীকে হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এ সময় রোগীর ‘ক্লোজ মনিটরিং’ দরকার। রোগীকে ছেড়ে দিলে ফের হাসপাতালে আসতে দেরি করে ও জটিলতা বাড়ে।
চিকিৎসক ও রোগতত্ত্ববিদরা মৃত্যুর জন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ও রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা মারা যাওয়া ও জটিল রোগীদের পরীক্ষা করে দেখেছি, অনেক রোগী এমন অবস্থায় হাসপাতালে আসে তখন আর কিছু করার থাকে না। মারা যান। আবার কিছু রোগী আছেন যাদের ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্যান্য রোগও রয়েছে।
বিশেষ করে গর্ভবতী নারীরা খুবই ঝুঁকির মধ্যে। এসব রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবে মারা যাওয়া বা জটিল রোগীদের বেশিরভাগই রোগটিতে দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত। এসব রোগীরা সুস্থ হয়ে বাসায় যাওয়ার পরও আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ও মারা যাচ্ছেন।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সে ক্ষেত্রে রোগীদের জ¦র হওয়ামাত্রই হাসপাতালে আসতে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, রোগী জটিল হলে চিকিৎসকরা প্রয়োজনে বারান্দায় রেখেও চিকিৎসা দিচ্ছেন। কিন্তু সময়মতো আসতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতাকেও ডেঙ্গুর জটিলতা বৃদ্ধি ও মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, এখনো এডিস নিধনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছেই।
গত দুদিন ধরেই বেসরকারি হিসেবে ডেঙ্গুতে এ মৌসুমে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গতকাল মঙ্গলবার এক দিনে সারা দেশে আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকায় ছয়জন ও ঢাকার বাইরে দুজনের মৃত্যু হয়। এর আগে গত রবিবার সন্ধ্যা থেকে গত সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এক দিনের হিসাবে সর্বোচ্চ সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
এমনকি গত তিন দিন ধরেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড হচ্ছে। এর মধ্যে গতকাল সারা দেশে এক দিনে এ মৌসুমের সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৩৪৮ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ সংখ্যা ঘণ্টায় ৯৮ জন। এর আগে গত সোমবার এ সংখ্যা ছিল ঘণ্টায় ৮৬ জন।
এমনকি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সরকারি হিসাবেই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর নতুন রেকর্ডের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবেই মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ জনে পৌঁছেছে। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গুর প্রকোপের বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সরকারি হিসাবে ৯৩ জন। এরপর প্রতি বছর মৃতের সংখ্যা ক্রমেই কমেছে। একপর্যায়ে কয়েক বছর মৃত্যুর তথ্যও আসেনি। তবে গত তিন বছর ধরেই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১৪ জনের। দুই বছর পর ২০১৮ সালে মৃতের সংখ্যা হয় ২৬। এ বছর ডেঙ্গু মৌসুমের মূল দুই মাস আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এখনো বাকি। এরই মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ হয়েছে। অবশ্য বেসরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। দেশ রূপান্তরের হিসাবে এ সংখ্যা ৬৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এবার ডেঙ্গুতে দেশে গত ১৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড হয়েছে। গত ১৮ বছরের মধ্যে দুবারে সর্বোচ্চ রেকর্ড ভেঙে গত ২৭ জুলাই শনিবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছায় ১০ হাজার ৫২৮ জনে।
এর আগে প্রথম ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন ও পরে গত বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন। অবশ্য গতকাল সে রেকর্ড ছড়িয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৯১২ জনে।
ডেঙ্গুতে এবার আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মৃতের সংখ্যাও সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে বহুজন দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছে এই জ¦রে। আবার আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করাও একটি কারণ।
অবশ্য আক্রান্ত অনুপাতে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা খুবই সামান্য বলে মত দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, মৃত্যু বেড়ে গেছে এমনটা মনে হয় না।
রোগী অনুপাতে মৃত্যু দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ১ শতাংশের অনেক কম। তবে এ মৃত্যুও কাক্সিক্ষত না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ও আক্রান্তরা সতর্ক থাকলে এটাও রোধ করা যেত। এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, এবার ডেঙ্গুর ধরন কিছুটা জটিল হয়েছে। তাই জ¦র ছেড়ে যাওয়ার পর ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আক্রান্তদের সতর্ক থাকতে হবে। এই সময়টা খুবই ‘ক্রিটিক্যাল’।
এই মৌসুমে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করেছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেসব রোগী মারা গেছে, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি, এসব রোগীর বেশিরভাগই অনেক হাসপাতাল ঘুরে একটাতে ভর্তি হয়েছে। এর ফলে ডেঙ্গু জটিল আকার ধারণ করেছে। রোগীকে বাঁচানো যায়নি। দ্বিতীয় কারণ আক্রান্তদের অনেকে দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছে।
এই সেকেন্ডারি ইনফেকশন জটিল। তাছাড়া যেসব রোগীর অন্যান্য রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা অন্য রোগ আছে, তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি।
এই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে বলেন, রোগীর জ¦র ভালো হলেও সতর্ক থাকতে হবে। জ¦র ছাড়ার পর বমি বমি ভাব থাকলে, খাবারে অনীহা দেখা দেয়, শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, তাহলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যাপারে বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের ক্লোজ মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। প্লাটিলেট নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। প্লাটিলেট অনেক কমে যাওয়ার পরও (যেমন ৫-১০ হাজারে নামলেও) ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কত দ্রুত নামছে সেটাই মুখ্য।
একজন মানুষের শরীরে দেড় লাখ প্লাটিলেট থাকলেই চলে, এক লাখ হলেও সমস্যা নেই। ৩০ হাজার পর্যন্ত হলেও তার হাসপাতালে ভর্তির দরকার নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলবে। চিকিৎসক যদি মনে করেন রোগী জটিল, তাহলে বেড না থাকলেও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেবেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে পরিমাণে আক্রান্ত, সে অনুপাতে মৃত্যু বেশি না। মাত্র এক শতাংশের ছয় ভাগের এক ভাগ। কিন্তু মৃত্যুর আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। রোগীরা অন্য রোগে বা কারণে মারা গেলেও মৃত্যু বলে প্রচার করা হচ্ছে। সুতরাং মৃত্যুর ব্যাপারে সঠিক তথ্য প্রচার করতে হবে।
এই পরিচালক বলেন, আমার হাসপাতালে ১৭ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছে বলে বলা হচ্ছে। অথচ আমরা কিন্তু এ তথ্য দিইনি। যেমনÑ গতকাল এক রোগী এলেন সন্ধ্যা ৬টার দিকে। তখন তার কোনো অর্গানই কাজ করছিল না। তিনি মারা যান। অথচ বলা হলো তিনি ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। তাই আমরা ডেথ রিভিউ কমিটি করেছি। এই কমিটি যাচাই-বাছাই করে মৃত্যুর সংখ্যা জানাবে। ভুল তথ্য প্রচার করলে মানুষ ভয় পাবে।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঠেকাতে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, জ¦র হলে সাধারণত তিন দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন দিনের আগেই যদি রোগীর খুব খারাপ লাগে, নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তাহলে আগেই পরীক্ষা করাতে হবে। আমরা এমনও দেখেছি, খুব ক্রিটিক্যাল রোগীদের ভর্তির পর সাধারণ স্যালাইন দিয়েই সুস্থ করা গেছে। সুতরাং সময়মতো হাসপাতালে আসতে হবে। বেড না থাকলেও আমরা বারান্দায় মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেব। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে শয্যা না পেয়ে রোগ জটিল করা উচিত হবে না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, সময়মতো হাসপাতালে না এলে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। আমরা দেখেছি এমনও রোগী আছে যারা এমন অবস্থায় এসেছে তখন আইসিইউ ছাড়া তাকে বাঁচানো যাচ্ছে না। অথচ হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ কম। সুতরাং আগেভাগেই হাসপাতালে আসতে হবে। আমরাই সিদ্ধান্ত নেব তাকে কী করতে হবে।
আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান ডেঙ্গুর ধরন বদলে যাওয়ার কারণে এবার ডেঙ্গু জটিল আকার নিয়েছে বলে মত দেন।
তিনি বলেন, সেরোটাইপ ডেঙ্গু এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি গত বছর থেকেই লক্ষ করা গেছে। এবার তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তবে বিষয়টি এখনো নতুন, তাই স্বচ্ছ ধারণার জন্য অধিকতর গবেষণা প্রয়োজন। তা না হলে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা দাঁড়াবে না।