ঈদে গ্রামে ডেঙ্গু মোকাবিলা নিয়ে উদ্বেগ
প্রতীক ইজাজ | ৮ আগস্ট, ২০১৯ ০৮:৪৫
ঈদে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। গতকাল বুধবার অগ্রিম টিকিটের যাত্রীদের নিয়ে ৫২টি ট্রেন দেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে গেছে। আজ শুরু হচ্ছে বাস ও লঞ্চের অগ্রিম টিকিটের যাত্রীদের যাত্রা। এর মধ্য দিয়ে মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করল এবার।
এমন পরিস্থিতিতে ঈদের সময় সারা দেশে ডেঙ্গু নিয়ে বেশ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, গ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের
বেশিরভাগই ঢাকা থেকে যাওয়া। স্থানীয় পর্যায়ে আক্রান্ত সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশের বেশি নয়। কোনো কোনো জেলায় শূন্য শতাংশ। সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ঈদে গ্রামে ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত।
তবে ঈদে গ্রামে, বিশেষ করে জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) পরামর্শক ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। নতুবা আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি আক্রান্তদের দুর্ভোগও পোহাতে হবে।
অবশ্য এই দুই বিশেষজ্ঞই ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতেই আক্রান্তদের ঈদে নিজ নিজ জেলা ত্যাগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেন, যাদের ডেঙ্গু নিশ্চিত হয়েছে ও চিকিৎসা নিচ্ছেন, চিকিৎসা শেষ না করা পর্যন্ত তাদের কোথাও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর প্রথম জ¦রের ১-৭ দিনের মধ্যে তাকে মশা কামড়ালে ভাইরাস ছড়ায়। অন্তত এই সময় পর্যন্ত নিজ স্থান ত্যাগ করা উচিত হবে না। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় নিয়েই সবার এই পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
তবে ঈদে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তিত সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। রোগী অনুপাতে জেলা ও উপজেলাগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থাপনার নানা সংকট থাকায় ডেঙ্গু রোগীদের নানাভাবে সতর্ক করে দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করছেন, ঢাকায় আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীই ঈদে গ্রামে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সেখানেও নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সরকারি পর্যায়ে বিদ্যমান গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় এত বিপুলসংখ্যক ডেঙ্গু রোগীদের ঠিক কতটুকু সামাল দেওয়া যাবে, তা নিয়ে তারা চিন্তিত।
অবশ্য সার্বিক প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, চিন্তার বিষয় হলেও আমরা চিকিৎসা ব্যবস্থা করে ফেলেছি। প্রস্তুত আছি। এখন মানুষকেও সতর্ক থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এসব মানুষ ঈদে গ্রামে গেলে ডেঙ্গুর ভাইরাস সারা দেশে আরও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেমন থাকবেন, তেমনি জ¦র নিয়ে যাওয়া রোগীদের মধ্যেও ডেঙ্গু দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া ডেঙ্গু ছড়াতে পারে এডিস মশার এমন একটি প্রজাতি (এডিস এলবোপিক্টাস) আগে থেকেই গ্রামে রয়েছে। এই মশা ঢাকা থেকে যাওয়া কোনো ডেঙ্গু রোগীকে কামড়ালে ওই মশার মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়বে।
এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, অনেকের ভেতর ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় থাকবে। গ্রামে যাওয়ার পর ডেঙ্গু দেখা দিতে পারে। তেমন হলে যে যেখানে থাকবে সেখানকার সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাবেন ও চিকিৎসা নেবেন। মশারির ভেতর থাকতে হবে।
এরমধ্যেই দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে এবার। গত ১৮ বছরের মধ্যে দুবারে সর্বোচ্চ রেকর্ড ভেঙে গত ২৭ জুলাই শনিবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছায় ১০ হাজার ৫২৮ জনে। এর আগে প্রথম ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন ও পরে গত বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন।
অবশ্য গতকাল ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ডের তিনগুণ বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি এর আগে যেখানে দেশে মাত্র দুই জেলা চট্টগ্রাম ও খুলনায় কিছু ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যেত, এবার সেখানে তা দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ আগস্ট থেকেই ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ১ আগস্ট ঢাকার বাইরে রোগী ছিল ৫৯০ ও ঢাকায় ১ হাজার ১৪৭ জন, ২ আগস্ট ঢাকার বাইরে ৭০৭ ও ঢাকায় ৯৭৫ জন, ৩ আগস্ট ঢাকার বাইরে ৬৮৬ ও ঢাকায় ১ হাজার ১৭ জন, ৪ আগস্ট ঢাকার বাইরে ৮২১ ও ঢাকায় ১ হাজার ৭৫ জন, ৫ আগস্ট ঢাকার বাইরে ৯০৬ ও ঢাকায় ১ হাজার ১১৭ জন, ৬ আগস্ট ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৬৪ ও ঢাকায় ১ হাজার ২৮৪ জন এবং গতকাল ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫৩ ও ঢাকায় ১ হাজার ২৭৫ জন। গতকাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ৮৮৫ জন। এর মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৩ হাজার ৩১৮ জন।
চিন্তিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর : ঈদে গ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, তা নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, ঈদে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আরও ছড়াতে পারে। সে জন্যই আমরা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছি। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশজুড়ে চিকিৎসকদের ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার সর্বসাম্প্রতিক কৌশলসহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব জিনিস কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া কেনার জন্য জেলা হাসপাতালের জন্য ১০ লাখ ও উপজেলার জন্য দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার আগে মানুষকে দুটি দিক ভাবতে হবে- একটি স্বাস্থ্যগত দিক, অন্যটি ফেলে যাওয়া বাড়িঘর এবং জিনিসপত্র। যদি কারও জ্বর থাকে, তা হলে সেই ব্যক্তির ঢাকার বাইরে ভ্রমণ করা উচিত হবে না। এমন হতে পারে মশা কামড়েছে, ইনফেকশন শরীরে রয়ে গেছে, তাদের গ্রামে গিয়ে জ¦র দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ও ডেঙ্গু কি না তা পরীক্ষা করতে হবে। যদি ডেঙ্গুজ্বর হয়, তা হলে মশারির মধ্যে থাকতে হবে, যাতে তাকে মশা কামড়াতে না পারে।
এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, যারা ঈদে যাবেন তারা সতর্ক থাকবেন, একজনের দ্বারা যেন অন্যজন সংক্রমিত হতে না পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কবার্তা : ঈদে গ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করেছে অধিদপ্তর। বৈঠকে ঈদের ছুটিতে যারা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাবেন তাদের জন্য বেশকিছু সতর্কতামূলক পরামর্শ দেওয়া হয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ঈদের ছুটিতে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের হেল্পডেস্ক খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঈদের দিন কমিউনিটি ক্লিনিকের সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অন-কল এ চিকিৎসা দেবেন। স্থানীয় কোনো রোগীর যেকোনো সমস্যায় তাদের মুঠোফোনে কল করতে পারবেন।
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং চালু থাকবে। এর আগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় করা সরকারি গাইডলাইন অনুযায়ী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে সরকারি হাসপাতালে ৩৪০টি আইসিইউ বেড ও ৩৩৫টি ডায়ালাইসিস ইউনিট চালু রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতালেও এই সেবা চালু আছে।
এবারের ঈদের ছুটি সব মিলিয়ে ৯ দিনের মতো। একটি মশার ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে সাত দিন সময় লাগে ও শরীরে সুপ্ত জীবাণু থেকে রোগ দেখা দিতে তিন-চার দিন লাগে। সেক্ষেত্রে এ সময়ের মধ্যে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ : ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে কী করতে হবে সে সম্পর্কে ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শ’ শিরোনামে সরকারের একটি তথ্য বিবরণী দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে বাড়িতে চিকিৎসা চলাকালীন সতর্কতার ব্যাপারে বলা হয়, জ্বর কমার প্রথম দিন রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি, বারবার বমি/মুখে তরল খাবার খেতে না পারা, পেটে তীব্র ব্যথা, শরীর মুখ বেশি দুর্বল অথবা নিস্তেজ হয়ে পড়া বা হঠাৎ করে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া, শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া বা শরীর অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে যেতে হবে।
বাড়িতে চিকিৎসার বিষয়ে রোগীদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম (জ্বর চলাকালীন এবং জ্বরের পর এক সপ্তাহ), স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার, যেমন খাবার স্যালাইন, গ্লুকোজ, ভাতের মাড়, বার্লি, ডাবের পানি, দুধ/হরলিকস, বাসায় তৈরি ফলের রস, স্যুপ ইত্যাদি খেতে বলা হয়েছে।
জ¦র থাকাকালীন চিকিৎসার বিষয়ে পূর্ণবয়স্কদের জন্য দুটি করে প্রতি ৬-৮ ঘণ্টা পর পর প্যারাসিটামল খেতে বলা হয়েছে। বাচ্চাদের জন্য বয়স ও ওজন অনুসারে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া জ্বর থাকাকালীন রোগীকে দিনরাত সব সময় মশারির ভেতরে থাকতে বলা হয়েছে।
সতর্কবার্তায় জ্বর থাকাকালীন যে ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, সেগুলো হলোÑ ব্যথানাশক ওষুধ (এন.এস.এ.আই.ডি গ্রুপ যেমন- ডাইক্লোফেন, আইবুপ্রোফেন, ন্যাপারক্সেন, মেফেন)। এসপিরিন বা ক্রোপিডোপ্রেল (অ্যান্টি প্লাটিলেট গ্রুপ) ও ওয়ারফারিন (অ্যান্টি কোয়াগুলেন্ট) হৃদরোগীদের জন্য জ্বর থাকাকালীন ও প্লাটিলেট হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ (বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকে) খাওয়া যাবে না।
সতর্কবার্তায় বলা হয়, জ্বর হলে কুসুম গরম পানি বা স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দ্বারা সারা শরীর মুছতে হবে।
অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, গ্রামে ও শহরে সর্বত্র বাড়ি ও এর আশপাশের এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল নিশ্চিহ্ন করতে হবে এবং মশার আবাসস্থলে স্প্রে করতে হবে।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
প্রতীক ইজাজ | ৮ আগস্ট, ২০১৯ ০৮:৪৫

ঈদে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। গতকাল বুধবার অগ্রিম টিকিটের যাত্রীদের নিয়ে ৫২টি ট্রেন দেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে গেছে। আজ শুরু হচ্ছে বাস ও লঞ্চের অগ্রিম টিকিটের যাত্রীদের যাত্রা। এর মধ্য দিয়ে মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করল এবার।
এমন পরিস্থিতিতে ঈদের সময় সারা দেশে ডেঙ্গু নিয়ে বেশ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, গ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের
বেশিরভাগই ঢাকা থেকে যাওয়া। স্থানীয় পর্যায়ে আক্রান্ত সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশের বেশি নয়। কোনো কোনো জেলায় শূন্য শতাংশ। সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ঈদে গ্রামে ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত।
তবে ঈদে গ্রামে, বিশেষ করে জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) পরামর্শক ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। নতুবা আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি আক্রান্তদের দুর্ভোগও পোহাতে হবে।
অবশ্য এই দুই বিশেষজ্ঞই ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতেই আক্রান্তদের ঈদে নিজ নিজ জেলা ত্যাগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেন, যাদের ডেঙ্গু নিশ্চিত হয়েছে ও চিকিৎসা নিচ্ছেন, চিকিৎসা শেষ না করা পর্যন্ত তাদের কোথাও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর প্রথম জ¦রের ১-৭ দিনের মধ্যে তাকে মশা কামড়ালে ভাইরাস ছড়ায়। অন্তত এই সময় পর্যন্ত নিজ স্থান ত্যাগ করা উচিত হবে না। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় নিয়েই সবার এই পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
তবে ঈদে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তিত সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। রোগী অনুপাতে জেলা ও উপজেলাগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থাপনার নানা সংকট থাকায় ডেঙ্গু রোগীদের নানাভাবে সতর্ক করে দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করছেন, ঢাকায় আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীই ঈদে গ্রামে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সেখানেও নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সরকারি পর্যায়ে বিদ্যমান গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় এত বিপুলসংখ্যক ডেঙ্গু রোগীদের ঠিক কতটুকু সামাল দেওয়া যাবে, তা নিয়ে তারা চিন্তিত।
অবশ্য সার্বিক প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, চিন্তার বিষয় হলেও আমরা চিকিৎসা ব্যবস্থা করে ফেলেছি। প্রস্তুত আছি। এখন মানুষকেও সতর্ক থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এসব মানুষ ঈদে গ্রামে গেলে ডেঙ্গুর ভাইরাস সারা দেশে আরও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেমন থাকবেন, তেমনি জ¦র নিয়ে যাওয়া রোগীদের মধ্যেও ডেঙ্গু দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া ডেঙ্গু ছড়াতে পারে এডিস মশার এমন একটি প্রজাতি (এডিস এলবোপিক্টাস) আগে থেকেই গ্রামে রয়েছে। এই মশা ঢাকা থেকে যাওয়া কোনো ডেঙ্গু রোগীকে কামড়ালে ওই মশার মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়বে।
এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, অনেকের ভেতর ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় থাকবে। গ্রামে যাওয়ার পর ডেঙ্গু দেখা দিতে পারে। তেমন হলে যে যেখানে থাকবে সেখানকার সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাবেন ও চিকিৎসা নেবেন। মশারির ভেতর থাকতে হবে।
এরমধ্যেই দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে এবার। গত ১৮ বছরের মধ্যে দুবারে সর্বোচ্চ রেকর্ড ভেঙে গত ২৭ জুলাই শনিবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছায় ১০ হাজার ৫২৮ জনে। এর আগে প্রথম ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন ও পরে গত বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন।
অবশ্য গতকাল ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ডের তিনগুণ বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি এর আগে যেখানে দেশে মাত্র দুই জেলা চট্টগ্রাম ও খুলনায় কিছু ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যেত, এবার সেখানে তা দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ আগস্ট থেকেই ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ১ আগস্ট ঢাকার বাইরে রোগী ছিল ৫৯০ ও ঢাকায় ১ হাজার ১৪৭ জন, ২ আগস্ট ঢাকার বাইরে ৭০৭ ও ঢাকায় ৯৭৫ জন, ৩ আগস্ট ঢাকার বাইরে ৬৮৬ ও ঢাকায় ১ হাজার ১৭ জন, ৪ আগস্ট ঢাকার বাইরে ৮২১ ও ঢাকায় ১ হাজার ৭৫ জন, ৫ আগস্ট ঢাকার বাইরে ৯০৬ ও ঢাকায় ১ হাজার ১১৭ জন, ৬ আগস্ট ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৬৪ ও ঢাকায় ১ হাজার ২৮৪ জন এবং গতকাল ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫৩ ও ঢাকায় ১ হাজার ২৭৫ জন। গতকাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ৮৮৫ জন। এর মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৩ হাজার ৩১৮ জন।
চিন্তিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর : ঈদে গ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, তা নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, ঈদে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আরও ছড়াতে পারে। সে জন্যই আমরা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছি। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশজুড়ে চিকিৎসকদের ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার সর্বসাম্প্রতিক কৌশলসহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব জিনিস কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া কেনার জন্য জেলা হাসপাতালের জন্য ১০ লাখ ও উপজেলার জন্য দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার আগে মানুষকে দুটি দিক ভাবতে হবে- একটি স্বাস্থ্যগত দিক, অন্যটি ফেলে যাওয়া বাড়িঘর এবং জিনিসপত্র। যদি কারও জ্বর থাকে, তা হলে সেই ব্যক্তির ঢাকার বাইরে ভ্রমণ করা উচিত হবে না। এমন হতে পারে মশা কামড়েছে, ইনফেকশন শরীরে রয়ে গেছে, তাদের গ্রামে গিয়ে জ¦র দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ও ডেঙ্গু কি না তা পরীক্ষা করতে হবে। যদি ডেঙ্গুজ্বর হয়, তা হলে মশারির মধ্যে থাকতে হবে, যাতে তাকে মশা কামড়াতে না পারে।
এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, যারা ঈদে যাবেন তারা সতর্ক থাকবেন, একজনের দ্বারা যেন অন্যজন সংক্রমিত হতে না পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সতর্কবার্তা : ঈদে গ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করেছে অধিদপ্তর। বৈঠকে ঈদের ছুটিতে যারা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাবেন তাদের জন্য বেশকিছু সতর্কতামূলক পরামর্শ দেওয়া হয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ঈদের ছুটিতে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের হেল্পডেস্ক খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঈদের দিন কমিউনিটি ক্লিনিকের সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অন-কল এ চিকিৎসা দেবেন। স্থানীয় কোনো রোগীর যেকোনো সমস্যায় তাদের মুঠোফোনে কল করতে পারবেন।
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং চালু থাকবে। এর আগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় করা সরকারি গাইডলাইন অনুযায়ী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে সরকারি হাসপাতালে ৩৪০টি আইসিইউ বেড ও ৩৩৫টি ডায়ালাইসিস ইউনিট চালু রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতালেও এই সেবা চালু আছে।
এবারের ঈদের ছুটি সব মিলিয়ে ৯ দিনের মতো। একটি মশার ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে সাত দিন সময় লাগে ও শরীরে সুপ্ত জীবাণু থেকে রোগ দেখা দিতে তিন-চার দিন লাগে। সেক্ষেত্রে এ সময়ের মধ্যে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ : ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে কী করতে হবে সে সম্পর্কে ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শ’ শিরোনামে সরকারের একটি তথ্য বিবরণী দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে বাড়িতে চিকিৎসা চলাকালীন সতর্কতার ব্যাপারে বলা হয়, জ্বর কমার প্রথম দিন রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি, বারবার বমি/মুখে তরল খাবার খেতে না পারা, পেটে তীব্র ব্যথা, শরীর মুখ বেশি দুর্বল অথবা নিস্তেজ হয়ে পড়া বা হঠাৎ করে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া, শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া বা শরীর অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে যেতে হবে।
বাড়িতে চিকিৎসার বিষয়ে রোগীদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম (জ্বর চলাকালীন এবং জ্বরের পর এক সপ্তাহ), স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল জাতীয় খাবার, যেমন খাবার স্যালাইন, গ্লুকোজ, ভাতের মাড়, বার্লি, ডাবের পানি, দুধ/হরলিকস, বাসায় তৈরি ফলের রস, স্যুপ ইত্যাদি খেতে বলা হয়েছে।
জ¦র থাকাকালীন চিকিৎসার বিষয়ে পূর্ণবয়স্কদের জন্য দুটি করে প্রতি ৬-৮ ঘণ্টা পর পর প্যারাসিটামল খেতে বলা হয়েছে। বাচ্চাদের জন্য বয়স ও ওজন অনুসারে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া জ্বর থাকাকালীন রোগীকে দিনরাত সব সময় মশারির ভেতরে থাকতে বলা হয়েছে।
সতর্কবার্তায় জ্বর থাকাকালীন যে ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, সেগুলো হলোÑ ব্যথানাশক ওষুধ (এন.এস.এ.আই.ডি গ্রুপ যেমন- ডাইক্লোফেন, আইবুপ্রোফেন, ন্যাপারক্সেন, মেফেন)। এসপিরিন বা ক্রোপিডোপ্রেল (অ্যান্টি প্লাটিলেট গ্রুপ) ও ওয়ারফারিন (অ্যান্টি কোয়াগুলেন্ট) হৃদরোগীদের জন্য জ্বর থাকাকালীন ও প্লাটিলেট হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ (বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকে) খাওয়া যাবে না।
সতর্কবার্তায় বলা হয়, জ্বর হলে কুসুম গরম পানি বা স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দ্বারা সারা শরীর মুছতে হবে।
অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, গ্রামে ও শহরে সর্বত্র বাড়ি ও এর আশপাশের এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল নিশ্চিহ্ন করতে হবে এবং মশার আবাসস্থলে স্প্রে করতে হবে।