চোখে অন্ধকার দেখছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ৫ কোটি শ্রমজীবী
অনলাইন ডেস্ক | ১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০৯:২৭
সাধারণ ছুটিতে বন্ধ রয়েছে অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা
চরম দুর্দশায় পড়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কয়েক কোটি শ্রমজীবী। তারা সরাসরি সরকারি আর্থিক প্রণোদনার আওতায় নেই। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাদের কথা।
বাংলাদেশে রিকশাচালক, হকার থেকে শুরু করে দিনমজুর সবাই আসলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অন্তর্ভূক্ত। আবার যারা মাসভিত্তিক বেতন পান এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন যেগুলো সরকারের ট্রেড লাইসেন্স কিংবা শ্রম আইনের অধীনে নয়, তারাও এই খাতের অংশ।
শ্রম আইনের বাইরে থাকায় তাদের পেনশন কিংবা ন্যুনতম ক্ষতিপূরণের সুযোগও নেই, এমনকি যে কোনো সময় চাকরিচ্যুত করা যায়।
দেশে এ ধরনের শ্রমজীবীর সংখ্যা ৫ কোটি ১৭ লাখেরও বেশি। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫.১ শতাংশ। সাধারণ ছুটির কারণে তারা এখন চোখে অন্ধকার দেখছে।
তিন বছর আগে অনলাইনে পণ্য বেচা-কেনার একটি ব্যবসা শুরু করেন সামিয়া আফরোজ। এবারের পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে কেন্দ্র করে আয় ও ব্যবসা দুটোই বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এক মাস আগেই ব্যবসার সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয় তাকে।
সামিয়া আফরোজ জানাচ্ছেন, নিজে তো আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেনই একই সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবী পাঁচজনও পড়েছেন ক্ষতিতে।
তিনি বলেন, “বৈশাখ এবং ঈদে আমরা ব্যবসা তো করতে পারলামই না, এখন আমাদের পরিবারই আর্থিকভাবে হুমকির মধ্যে। আমার কর্মীদের আমি গত মাসের বেতন দিয়েছি। সামনের মাসে দিতে পারবো কি-না জানি না। এমনকি তাদেরকে চাকরিতে রাখবো না ছেড়ে দেবো সেটাও বুঝতে পারছি না। এখন তাদের অবস্থা তো আরো খারাপ।”
জহুরুল একটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপে অন্যের গাড়িয়ে চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে কিভাবে জীবন চালাবেন তা নিয়েই দুঃশ্চিন্তায়। তিনি বলেন, “আমি আরেকজনের গাড়ি চালাইতাম। কোম্পানির বিল, গ্যাসের খরচ বাদে যা থাকতো তার ৪০ শতাংশ টাকা মালিক আমাকে দিতো। এখন জিরো। কোন বাসা বাড়িতেও ড্রাইভার নেয় না। নিবে কি, ঢুকতেই তো দেয় না।”
জহিরুল বলছেন, এখনো তিনি বাড়ি ভাড়া দিতে পারেননি। ধার-দেনা করে আপাতত চলছেন। পরে কী হবে তা বুঝতে পারছেন না।
বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই আছে যারা এখনো তাদের কর্মীদের বেতন দেয়নি। তারাও রয়েছেন বিপদে।
ঢাকার একটি বিউটি পার্লারে কাজ করেন এরকম একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, তারা গত মার্চ মাসের বেতন পাননি। এমনকি মার্চের শেষ দিকে যখন পার্লার বন্ধ হয়ে যায়, তখন প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার টাকা ধার নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন তিনি। চলতি মাসেও বেতন পাবেন কি-না, না পেলে কীভাবে সংসার চালাবেন তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
এ পরিস্থিতিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি'র নির্বাহী পারিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, বাংলাদেশে শ্রমজীবীরা মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেই বেশি এবং করোনা ভাইরাসের কারণে এখন যে পরিস্থিতি তাতে করে বিশাল আকারের এই শ্রমজীবীদের প্রতি আলাদা করে নজর না দিলে তা অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব করে তুলবে।
তিনি বলেছেন, “প্রাতিষ্ঠানিক খাতের লোকদের কিন্তু চাকরির কোন নিশ্চয়তা নেই, বেতনেরও নিশ্চয়তা নেই। অতি দরিদ্র, দরিদ্র এমনকি দারিদ্রসীমার উপরে যারা স্বল্প আয়ের লোক তাদেরও কিন্তু সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ছে। কারণ অনেকেরই কিন্তু আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”
আরও বলেন, “সবচেয়ে বড় বিপদটা হলো যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত স্বল্প আয়ের লোক তাদের চাওয়ারও কোন জায়গা নেই। এই জনগোষ্ঠীকে কিন্তু আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার সময় এখন। তাদেরকে বাইরে রেখে আমরা অর্থনীতির এই সংকটকে মোকাবিলা করতে পারবো না।”
কিছুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল আকারের এক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। সেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, বয়স্ক ভাতা কিংবা এ ধরণের কর্মসূচির আওতায় এসব মানুষকে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ১০টাকা কেজি চাল কর্মসূচিও আছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম বলছেন, কাজ কিংবা উপার্জন হারানো মানুষের জন্য এখন সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিই বড় ভরসা। এসব মানুষকে সরকারের সহায়তার অন্তর্ভূক্ত হতে হবে।
তবে সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, সরকার যে তালিকা ধরে ত্রাণ কিংবা সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে আসছে সেই তালিকায় স্বচ্ছতা আনতে হবে সবার আগে। এক্ষেত্রে বেসরকারি এনজিও, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
অনলাইন ডেস্ক | ১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০৯:২৭

চরম দুর্দশায় পড়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কয়েক কোটি শ্রমজীবী। তারা সরাসরি সরকারি আর্থিক প্রণোদনার আওতায় নেই। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাদের কথা।
বাংলাদেশে রিকশাচালক, হকার থেকে শুরু করে দিনমজুর সবাই আসলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অন্তর্ভূক্ত। আবার যারা মাসভিত্তিক বেতন পান এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন যেগুলো সরকারের ট্রেড লাইসেন্স কিংবা শ্রম আইনের অধীনে নয়, তারাও এই খাতের অংশ।
শ্রম আইনের বাইরে থাকায় তাদের পেনশন কিংবা ন্যুনতম ক্ষতিপূরণের সুযোগও নেই, এমনকি যে কোনো সময় চাকরিচ্যুত করা যায়।
দেশে এ ধরনের শ্রমজীবীর সংখ্যা ৫ কোটি ১৭ লাখেরও বেশি। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫.১ শতাংশ। সাধারণ ছুটির কারণে তারা এখন চোখে অন্ধকার দেখছে।
তিন বছর আগে অনলাইনে পণ্য বেচা-কেনার একটি ব্যবসা শুরু করেন সামিয়া আফরোজ। এবারের পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে কেন্দ্র করে আয় ও ব্যবসা দুটোই বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এক মাস আগেই ব্যবসার সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয় তাকে।
সামিয়া আফরোজ জানাচ্ছেন, নিজে তো আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেনই একই সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবী পাঁচজনও পড়েছেন ক্ষতিতে।
তিনি বলেন, “বৈশাখ এবং ঈদে আমরা ব্যবসা তো করতে পারলামই না, এখন আমাদের পরিবারই আর্থিকভাবে হুমকির মধ্যে। আমার কর্মীদের আমি গত মাসের বেতন দিয়েছি। সামনের মাসে দিতে পারবো কি-না জানি না। এমনকি তাদেরকে চাকরিতে রাখবো না ছেড়ে দেবো সেটাও বুঝতে পারছি না। এখন তাদের অবস্থা তো আরো খারাপ।”
জহুরুল একটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপে অন্যের গাড়িয়ে চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে কিভাবে জীবন চালাবেন তা নিয়েই দুঃশ্চিন্তায়। তিনি বলেন, “আমি আরেকজনের গাড়ি চালাইতাম। কোম্পানির বিল, গ্যাসের খরচ বাদে যা থাকতো তার ৪০ শতাংশ টাকা মালিক আমাকে দিতো। এখন জিরো। কোন বাসা বাড়িতেও ড্রাইভার নেয় না। নিবে কি, ঢুকতেই তো দেয় না।”
জহিরুল বলছেন, এখনো তিনি বাড়ি ভাড়া দিতে পারেননি। ধার-দেনা করে আপাতত চলছেন। পরে কী হবে তা বুঝতে পারছেন না।
বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই আছে যারা এখনো তাদের কর্মীদের বেতন দেয়নি। তারাও রয়েছেন বিপদে।
ঢাকার একটি বিউটি পার্লারে কাজ করেন এরকম একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, তারা গত মার্চ মাসের বেতন পাননি। এমনকি মার্চের শেষ দিকে যখন পার্লার বন্ধ হয়ে যায়, তখন প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার টাকা ধার নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন তিনি। চলতি মাসেও বেতন পাবেন কি-না, না পেলে কীভাবে সংসার চালাবেন তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছেন তিনি।
এ পরিস্থিতিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি'র নির্বাহী পারিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, বাংলাদেশে শ্রমজীবীরা মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেই বেশি এবং করোনা ভাইরাসের কারণে এখন যে পরিস্থিতি তাতে করে বিশাল আকারের এই শ্রমজীবীদের প্রতি আলাদা করে নজর না দিলে তা অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব করে তুলবে।
তিনি বলেছেন, “প্রাতিষ্ঠানিক খাতের লোকদের কিন্তু চাকরির কোন নিশ্চয়তা নেই, বেতনেরও নিশ্চয়তা নেই। অতি দরিদ্র, দরিদ্র এমনকি দারিদ্রসীমার উপরে যারা স্বল্প আয়ের লোক তাদেরও কিন্তু সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ছে। কারণ অনেকেরই কিন্তু আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”
আরও বলেন, “সবচেয়ে বড় বিপদটা হলো যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত স্বল্প আয়ের লোক তাদের চাওয়ারও কোন জায়গা নেই। এই জনগোষ্ঠীকে কিন্তু আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার সময় এখন। তাদেরকে বাইরে রেখে আমরা অর্থনীতির এই সংকটকে মোকাবিলা করতে পারবো না।”
কিছুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল আকারের এক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। সেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ, বয়স্ক ভাতা কিংবা এ ধরণের কর্মসূচির আওতায় এসব মানুষকে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ১০টাকা কেজি চাল কর্মসূচিও আছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম বলছেন, কাজ কিংবা উপার্জন হারানো মানুষের জন্য এখন সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিই বড় ভরসা। এসব মানুষকে সরকারের সহায়তার অন্তর্ভূক্ত হতে হবে।
তবে সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, সরকার যে তালিকা ধরে ত্রাণ কিংবা সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে আসছে সেই তালিকায় স্বচ্ছতা আনতে হবে সবার আগে। এক্ষেত্রে বেসরকারি এনজিও, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।