পাইলিংয়েই সোয়া কোটি টাকা ব্যয়!
নিহার সরকার অংকুর | ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনতলা কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। নির্মাণকাজ শুরুর পর ছয় মাস পার হলেও ২ হাজার ২৫২ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে মসজিদের তেমন কিছুই দৃশ্যমান হয়নি। অথচ নির্মাণকাজের বিলবাবদ ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, প্রকৃত ব্যয়ের বেশি দেখিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমকেটি-এনএইচই (জেভি) মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছে। শুধু মসজিদ নির্মাণ নয়, অনিয়মের নানা অভিযোগ রয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ের অস্থায়ী গেস্ট হাউজ নির্মাণেও।
এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ করতে ঠিকাদারকে বারবার চাপ দেওয়া হচ্ছে। অনিয়মের অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট কমিটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ মিললে আমরাও কঠোর হব। তবে আপাতত কমিটির বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ^বিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ ভিতসহ তিনতলা মসজিদ ভবন, ইমাম ও মুয়াজ্জিনের আবাসনের ব্যবস্থাসহ প্রকল্প নিয়েছে। বছর মেয়াদি এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমকেটি-এনএইচই’র (জেভি) সঙ্গে ৯ কোটি ২ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ টাকা ৮০৪ পয়সার চুক্তি করে প্রশাসন। চলতি বছরের ৭ এপ্রিল মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত জমির একপাশে কেবল চুক্তির সাইনবোর্ড ছাড়া মসজিদ ভবনের পুরো অংশ ফাঁকা। অথচ এরই মধ্যে নির্মাণকাজের বিল হিসেবে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সহযোগিতায় নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণ ছাড়াই অর্থ ছাড় করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, অর্থছাড়ের পর একাধিক অসাধু কর্মকর্তাকে ঠিকাদার কমিশন দেন। এমনকি অর্থ উত্তোলন নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তাদের কথাবার্তাতেও অসামঞ্জস্যতা পাওয়া গেছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. নিজামুল বলেন, ‘করোনার কারণে আমরা নির্মাণকাজ দৃশ্যমান করতে পারিনি। তবে এ পর্যন্ত আমরা ৯৬টি পাইলিং পিলার করেছি। যার ব্যয় হিসেবে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকার বেশি বিল নেওয়া হয়েছে।’
ঠিকাদারের তথ্যমতে, প্রতি পাইলিং পিলার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৯১৭ টাকা। প্রতিটি পাইলিং পিলারের দৈর্ঘ্য ৯১ ফিট এবং প্রশস্ত ১৬দ্ধ১৬ ইঞ্চি। প্রতি পাইলিং পিলারে ২০ মিলি আটটি রড রয়েছে। পিলারের সংযোগ পয়েন্টে ১২ মিলির অতিরিক্ত ছয়টি ৫ ফিট করে রড ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকৃত মূল্যের কয়েকগুণ বেশি বিল করা হচ্ছে। সবই প্রশাসন জানে। এমনকি প্রশাসনের অনেকে বিলের কমিশন পান। মসজিদ আল্লাহর ঘর। এখানেও বাড়তি মূল্য দেখিয়ে অর্থ লুটপাট করা হচ্ছে।’
প্রকল্প ব্যয় বাবদ ফের অর্থ উত্তোলনের আভাস দেন ঠিকাদার নিজামুল। তিনি বলেন, ‘পাইলিং পিলার গাঁথুনির পর দেড় কোটি টাকার বিল চাওয়া হবে।’ তবে মসজিদের নির্মাণকাজ কত শতাংশ শেষ হয়েছে, তা জানাতে পারেননি তিনি।
একই বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের প্রধান মোহাম্মদ মাহবুবুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, ‘কতটুকু কাজ হয়েছে, এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। এখানে নিয়ম অনুযায়ী সব কাজ হচ্ছে। সময়মতো কাজ শেষ করতে ঠিকাদারের ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে। তবে সময়মতো কাজ শেষ না হলে ব্যয় একটু বাড়েই। আমরা সেটি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি। ঠিকাদারকে বিল প্রদানে নিয়ম অনুযায়ী আমরা অনুমোদন বা সুপারিশ করে থাকি।’
অর্থছাড়ের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক ড. তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কেবল বিল এলে সেটি প্রদান করি। অডিট বা কাজ হয়েছে কি না, সেটা দেখা আমাদের কাজ নয় বা এর কোনো সুযোগও আমাদের হাতে নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণ দেখিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ^বিদ্যালয়ের একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্থগিত করেছে। মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, এসব প্রকল্পে ব্যয় ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়ানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘প্রশাসনের সমর্থন ছাড়া এত অনিয়ম কীভাবে সম্ভব? প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তারা নিজেদের পকেট ভারী করতে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করছেন। তা না হলে একই প্রতিষ্ঠান এত কাজ একসঙ্গে কীভাবে পায়? প্রশাসনের ভেতরের কারও সহযোগিতা ছাড়া এটি কখনো সম্ভব নয়।’
শেয়ার করুন
নিহার সরকার অংকুর | ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনতলা কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। নির্মাণকাজ শুরুর পর ছয় মাস পার হলেও ২ হাজার ২৫২ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে মসজিদের তেমন কিছুই দৃশ্যমান হয়নি। অথচ নির্মাণকাজের বিলবাবদ ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, প্রকৃত ব্যয়ের বেশি দেখিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমকেটি-এনএইচই (জেভি) মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছে। শুধু মসজিদ নির্মাণ নয়, অনিয়মের নানা অভিযোগ রয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ের অস্থায়ী গেস্ট হাউজ নির্মাণেও।
এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ করতে ঠিকাদারকে বারবার চাপ দেওয়া হচ্ছে। অনিয়মের অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট কমিটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ মিললে আমরাও কঠোর হব। তবে আপাতত কমিটির বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ^বিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ ভিতসহ তিনতলা মসজিদ ভবন, ইমাম ও মুয়াজ্জিনের আবাসনের ব্যবস্থাসহ প্রকল্প নিয়েছে। বছর মেয়াদি এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমকেটি-এনএইচই’র (জেভি) সঙ্গে ৯ কোটি ২ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ টাকা ৮০৪ পয়সার চুক্তি করে প্রশাসন। চলতি বছরের ৭ এপ্রিল মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত জমির একপাশে কেবল চুক্তির সাইনবোর্ড ছাড়া মসজিদ ভবনের পুরো অংশ ফাঁকা। অথচ এরই মধ্যে নির্মাণকাজের বিল হিসেবে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সহযোগিতায় নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণ ছাড়াই অর্থ ছাড় করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, অর্থছাড়ের পর একাধিক অসাধু কর্মকর্তাকে ঠিকাদার কমিশন দেন। এমনকি অর্থ উত্তোলন নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তাদের কথাবার্তাতেও অসামঞ্জস্যতা পাওয়া গেছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. নিজামুল বলেন, ‘করোনার কারণে আমরা নির্মাণকাজ দৃশ্যমান করতে পারিনি। তবে এ পর্যন্ত আমরা ৯৬টি পাইলিং পিলার করেছি। যার ব্যয় হিসেবে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকার বেশি বিল নেওয়া হয়েছে।’
ঠিকাদারের তথ্যমতে, প্রতি পাইলিং পিলার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৯১৭ টাকা। প্রতিটি পাইলিং পিলারের দৈর্ঘ্য ৯১ ফিট এবং প্রশস্ত ১৬দ্ধ১৬ ইঞ্চি। প্রতি পাইলিং পিলারে ২০ মিলি আটটি রড রয়েছে। পিলারের সংযোগ পয়েন্টে ১২ মিলির অতিরিক্ত ছয়টি ৫ ফিট করে রড ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকৃত মূল্যের কয়েকগুণ বেশি বিল করা হচ্ছে। সবই প্রশাসন জানে। এমনকি প্রশাসনের অনেকে বিলের কমিশন পান। মসজিদ আল্লাহর ঘর। এখানেও বাড়তি মূল্য দেখিয়ে অর্থ লুটপাট করা হচ্ছে।’
প্রকল্প ব্যয় বাবদ ফের অর্থ উত্তোলনের আভাস দেন ঠিকাদার নিজামুল। তিনি বলেন, ‘পাইলিং পিলার গাঁথুনির পর দেড় কোটি টাকার বিল চাওয়া হবে।’ তবে মসজিদের নির্মাণকাজ কত শতাংশ শেষ হয়েছে, তা জানাতে পারেননি তিনি।
একই বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের প্রধান মোহাম্মদ মাহবুবুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, ‘কতটুকু কাজ হয়েছে, এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। এখানে নিয়ম অনুযায়ী সব কাজ হচ্ছে। সময়মতো কাজ শেষ করতে ঠিকাদারের ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে। তবে সময়মতো কাজ শেষ না হলে ব্যয় একটু বাড়েই। আমরা সেটি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি। ঠিকাদারকে বিল প্রদানে নিয়ম অনুযায়ী আমরা অনুমোদন বা সুপারিশ করে থাকি।’
অর্থছাড়ের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক ড. তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কেবল বিল এলে সেটি প্রদান করি। অডিট বা কাজ হয়েছে কি না, সেটা দেখা আমাদের কাজ নয় বা এর কোনো সুযোগও আমাদের হাতে নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণ দেখিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ^বিদ্যালয়ের একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্থগিত করেছে। মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, এসব প্রকল্পে ব্যয় ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়ানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘প্রশাসনের সমর্থন ছাড়া এত অনিয়ম কীভাবে সম্ভব? প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তারা নিজেদের পকেট ভারী করতে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করছেন। তা না হলে একই প্রতিষ্ঠান এত কাজ একসঙ্গে কীভাবে পায়? প্রশাসনের ভেতরের কারও সহযোগিতা ছাড়া এটি কখনো সম্ভব নয়।’