পুলিশের তালিকায় নেই কেউ
মো. আমিনুল ইসলাম, গাজীপুর | ২০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুর থানা এলাকায় হাত বাড়ালেই মিলছে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইনসহ হরেক রকমের মাদকদ্রব্য। শতাধিক স্পটে চলছে মাদকের জমজমাট কারবার। মাঝেমধ্যে দু-চারজন খুচরা কারবারি মাদকসহ গ্রেপ্তার হলেও নেপথ্যের কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। যে কারণে মাদকসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে ফের মাদক কারবারে যুক্ত হচ্ছে খুচরা কারবারিরা। এমনকি মাদকচক্রের গডফাদার বা বড় কারবারিদের কোনো তালিকা নেই স্থানীয় থানা পুলিশের কাছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অনেকটা নির্বিঘে্ন মাদক কেনাবেচা করছে কারবারিরা।
এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপকালে তারা জানায়, নগরীর ছয়টি ওয়ার্ড নিয়ে কাশিমপুর থানা এলাকা। শিল্পাঞ্চল হওয়ায় সেখানে জনবসতি যেমন বেশি, তেমনি অপরাধের হারও নগরীর অন্য এলাকার চেয়ে তুলনামূলক বেশি। মাদক কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে কাশিমপুর থানা এলাকায় বাড়ছে খুন ও অপহরণের মতো নানা অপরাধ। গত দেড় মাসে কাশিমপুর থানায় মামলা হয়েছে ২৫টি। এর মধ্যে ১২টিই মাদকের। অথচ থানা পুলিশের খাতায় একজন মাদক কারবারির নামও নেই।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সাইদা গাফফার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত যে নির্মাণশ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেও মাদকাসক্ত ছিল বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মূলত মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা এবং মাদকের টাকা জোগাতেই অধ্যাপক সাইদা গাফফারকে হত্যা করে নির্মাণশ্রমিক আনারুল ইসলাম। সে ওই অধ্যাপকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে।’ দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত শ্রমিক ও ভাসমান মানুষ অধ্যুষিত এলাকা কাশিমপুর। থানাটির বেশিরভাগ এলাকায় চলে মাদকের রমরমা কারবার। যা নিয়ন্ত্রণ করে শতাধিক কারবারি। গাঁজা থেকে শুরু করে ইয়াবা ও হেরোইন পর্যন্ত এখানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।
অনেক প্রভাবশালী মাদক কারবারি থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ কথা বলারও সাহস পায় না। যদিও পুলিশের তালিকায় মাদক কারবারি হিসেবে তাদের কারও নাম নেই। এদের অনেকে স্থানীয় আবার কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
গত ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাশিমপুর থানার পানিশাইলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবাসন প্রকল্পের ভেতরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন অধ্যাপক সাইদা গাফফার।
স্থানীয় লোকজন জানায়, অরক্ষিত এ আবাসন প্রকল্পটি মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য। বিশাল এ প্রকল্পে মাত্র তিনজন নিরাপত্তাকর্মী প্রতি শিফটে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। প্রকল্প এলাকার ঝোঁপঝাড়ের ভেতরে নিয়ম করে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। এসব মাদকসেবীর কাছে নিরাপত্তাকর্মীরাও অনেকটা অসহায়।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি ইনচার্জ জয়নাল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিন শিফটে তিনজন করে নয়জন প্রকল্পটি পাহারা দেন। প্রতি শিফটে তিনজনের মধ্যে মূল গেটে একজন এবং বাকি দুজন ভেতরে লাঠি হাতে দায়িত্ব পালন করেন। পুরো এলাকা ঘুরতে একজনের প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। বেশিরভাগ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া। বেড়া টপকে অনেকেই ভেতরে ঢুকে নেশা করে। অনেক সময় ধাওয়া দিয়ে মাদকসেবীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়।’
অধ্যাপক সাইদা গাফফার হত্যাকাণ্ডের পর প্রকল্প কর্র্তৃপক্ষ প্রকল্পের ভেতরে পর্যাপ্তসংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানান সিকিউরিটি ইনচার্জ জয়নাল।
কাশিমপুরে শিশু ও নারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী মাদক কারবারি রয়েছে জানিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর মীর মো. আসাদুজ্জামান তুলা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। পুলিশ বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে এসব মাদক কারবারিকে ধরলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের আগের পেশায় চলে যায় তারা। যে পর্যন্ত মাদকচক্রের গডফাদারসহ তাদের মূল উৎপাটন না করা হবে, সে পর্যন্ত কাশিমপুরে মাদক নির্মূল সম্ভব নয়।’
তবে জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় বাসিন্দারা মাদকের জমজমাট কারবার ও একে ঘিরে বিভিন্ন অপরাধ বাড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেও কাশিমপুর থানার ওসি মাহবুবে খোদার দাবি, এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সার্বিকভাবে ভালো।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে মাদকের সাতটি ও দুটি দুর্ঘটনাসহ মাত্র ১৪টি মামলা হয়েছে। জানুয়ারি মাসে রবিবার পর্যন্ত ১৬ দিনে মামলা হয়েছে ১১টি। এর মধ্যে পাঁচটি মাদকের। অধ্যাপক সাইদা হত্যা ছাড়া সম্প্রতি বড় কোনো আলোচিত ঘটনা ঘটেনি।’
শেয়ার করুন
মো. আমিনুল ইসলাম, গাজীপুর | ২০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুর থানা এলাকায় হাত বাড়ালেই মিলছে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইনসহ হরেক রকমের মাদকদ্রব্য। শতাধিক স্পটে চলছে মাদকের জমজমাট কারবার। মাঝেমধ্যে দু-চারজন খুচরা কারবারি মাদকসহ গ্রেপ্তার হলেও নেপথ্যের কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। যে কারণে মাদকসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে ফের মাদক কারবারে যুক্ত হচ্ছে খুচরা কারবারিরা। এমনকি মাদকচক্রের গডফাদার বা বড় কারবারিদের কোনো তালিকা নেই স্থানীয় থানা পুলিশের কাছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অনেকটা নির্বিঘে্ন মাদক কেনাবেচা করছে কারবারিরা।
এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপকালে তারা জানায়, নগরীর ছয়টি ওয়ার্ড নিয়ে কাশিমপুর থানা এলাকা। শিল্পাঞ্চল হওয়ায় সেখানে জনবসতি যেমন বেশি, তেমনি অপরাধের হারও নগরীর অন্য এলাকার চেয়ে তুলনামূলক বেশি। মাদক কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে কাশিমপুর থানা এলাকায় বাড়ছে খুন ও অপহরণের মতো নানা অপরাধ। গত দেড় মাসে কাশিমপুর থানায় মামলা হয়েছে ২৫টি। এর মধ্যে ১২টিই মাদকের। অথচ থানা পুলিশের খাতায় একজন মাদক কারবারির নামও নেই।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সাইদা গাফফার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত যে নির্মাণশ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেও মাদকাসক্ত ছিল বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মূলত মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা এবং মাদকের টাকা জোগাতেই অধ্যাপক সাইদা গাফফারকে হত্যা করে নির্মাণশ্রমিক আনারুল ইসলাম। সে ওই অধ্যাপকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে।’ দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত শ্রমিক ও ভাসমান মানুষ অধ্যুষিত এলাকা কাশিমপুর। থানাটির বেশিরভাগ এলাকায় চলে মাদকের রমরমা কারবার। যা নিয়ন্ত্রণ করে শতাধিক কারবারি। গাঁজা থেকে শুরু করে ইয়াবা ও হেরোইন পর্যন্ত এখানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।
অনেক প্রভাবশালী মাদক কারবারি থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ কথা বলারও সাহস পায় না। যদিও পুলিশের তালিকায় মাদক কারবারি হিসেবে তাদের কারও নাম নেই। এদের অনেকে স্থানীয় আবার কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
গত ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাশিমপুর থানার পানিশাইলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবাসন প্রকল্পের ভেতরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন অধ্যাপক সাইদা গাফফার।
স্থানীয় লোকজন জানায়, অরক্ষিত এ আবাসন প্রকল্পটি মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য। বিশাল এ প্রকল্পে মাত্র তিনজন নিরাপত্তাকর্মী প্রতি শিফটে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। প্রকল্প এলাকার ঝোঁপঝাড়ের ভেতরে নিয়ম করে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। এসব মাদকসেবীর কাছে নিরাপত্তাকর্মীরাও অনেকটা অসহায়।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি ইনচার্জ জয়নাল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিন শিফটে তিনজন করে নয়জন প্রকল্পটি পাহারা দেন। প্রতি শিফটে তিনজনের মধ্যে মূল গেটে একজন এবং বাকি দুজন ভেতরে লাঠি হাতে দায়িত্ব পালন করেন। পুরো এলাকা ঘুরতে একজনের প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। বেশিরভাগ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া। বেড়া টপকে অনেকেই ভেতরে ঢুকে নেশা করে। অনেক সময় ধাওয়া দিয়ে মাদকসেবীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়।’
অধ্যাপক সাইদা গাফফার হত্যাকাণ্ডের পর প্রকল্প কর্র্তৃপক্ষ প্রকল্পের ভেতরে পর্যাপ্তসংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানান সিকিউরিটি ইনচার্জ জয়নাল।
কাশিমপুরে শিশু ও নারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী মাদক কারবারি রয়েছে জানিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর মীর মো. আসাদুজ্জামান তুলা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। পুলিশ বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে এসব মাদক কারবারিকে ধরলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের আগের পেশায় চলে যায় তারা। যে পর্যন্ত মাদকচক্রের গডফাদারসহ তাদের মূল উৎপাটন না করা হবে, সে পর্যন্ত কাশিমপুরে মাদক নির্মূল সম্ভব নয়।’
তবে জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় বাসিন্দারা মাদকের জমজমাট কারবার ও একে ঘিরে বিভিন্ন অপরাধ বাড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেও কাশিমপুর থানার ওসি মাহবুবে খোদার দাবি, এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সার্বিকভাবে ভালো।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে মাদকের সাতটি ও দুটি দুর্ঘটনাসহ মাত্র ১৪টি মামলা হয়েছে। জানুয়ারি মাসে রবিবার পর্যন্ত ১৬ দিনে মামলা হয়েছে ১১টি। এর মধ্যে পাঁচটি মাদকের। অধ্যাপক সাইদা হত্যা ছাড়া সম্প্রতি বড় কোনো আলোচিত ঘটনা ঘটেনি।’