
যে মানুষটি শারীরিকভাবে উপস্থিত নেই; অথচ তাঁর নামে পরিচালিত হচ্ছে একটি জাতির মুক্তির সংগ্রাম বা স্বাধীনতা যুদ্ধ। তাঁরই সম্মোহনী ডাকে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে হাসিমুখে, এসব দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে এমন মহান নেতাই বা ক’জন আছেন? তিনি জন্মেছিলেন বাংলা মায়ের কোলে। টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ে। বাংলার কাদা জলে তাঁর বেড়ে উঠা। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। তিনি আমাদের মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বাঙালী জাতির ইতিহাসে এমনই একটি বেদনাবিধুর দিন যা কখনও ভুলবার নয় । শ্রাবনের সেই রাতে আকাশে ভয়াল কালো মেঘের গর্জন হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টি নয় ঝরেছিল রক্ত। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের মতো বিশাল বুক থেকে রক্ত ঝরেছিল। রক্ত ঝরেছিল তাঁর পরিবারের প্রাণপ্রিয় সদস্যদের বুক থেকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই রক্ত যেন রক্তজবার মতো ফুটে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এর কারণও ছিল বটে- তার রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিই ছিল ন্যায় ও সাম্য। দেশপ্রেম ও সরলতা ছিল তার চরিত্রের ভূষণ, নমনীয়তা, বিনয়, শিষ্টাচার ও চারিত্রিক দৃঢ়তা বঙ্গবন্ধুকে করেছে অসম্ভব জনপ্রিয়। জীবন- যাপনে বঙ্গবন্ধুকে অন্য দশজন সাধারণ বাঙালি থেকে আলাদা করা কঠিন ছিল। চলনে বলনে, পোশাকে পরিচ্ছদে, ভাবনায়-কল্পনায় তিনি ছিলেন একজন পুরোদ¯ুÍর বাঙালি। বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি তাকে কখনও আকর্ষণ করেনি। সুরম্য সুরক্ষিত বঙ্গভবন ছেড়ে তিনি নেমে এসেছিলেন বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডির নিজস্ব বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার পিছনে কাজ করেছিলো দুর্লভ চারিত্রিক দৃঢ়তা। শৈশব- কৈশর থেকে তিনি লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিলো বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালী জাতিসত্ত্বার প্রতিষ্ঠা। তিনি অন্য কারোও সাহায্য নয় নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। অথচ আমরা দেখে কি অমুক ভাই তমুককে নেতা বানিয়েছে। অমুক তমুককে পোস্ট পাইয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ নিজগুণে নয় ভাইয়ের তোষামোদি করে নেতা। তাহলে ঐ নেতা পরবর্তীতে ভাইয়ের পা চাটা ছাড়া কোন উপায় আছে বলে তো আমার মনে হয়না।
অনেক নামে তাঁকে ডাকা হতো। বাংলার নয়নমনি ,বঙ্গশার্দুল, অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালির মুক্তিদাতা। বিভিন্ন নামে ভূষিত করা হলেও অপূর্ন ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের উপাধি। সে অপূর্ণতা পূরণ হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। আর ঐতিহাসিক হয়ে গেল সেদিনের তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত গণসংবর্ধনা সমাবেশ। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুন উপাধিতে ভূষিত করার। ডাকসু ভিপি সেদিন গণমাধ্যমে বলেছিলেন “‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির অর্থ সে কি বিশাল! তিনিই বঙ্গবন্ধু যিনি ভালবাসেন, শুধু ভালবাসেননা; ভালবাসার জন্য আপোষহীন আমৃত্যু সংগ্রাম করেন। যার ভালবাসা নির্লোভ -নিঃস্বার্থ। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বন্ধু, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের বন্ধু সুতরাং তিনিই আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”।আগুনে পুড়ে পুড়ে যেমন সোনা খাঁটি হয় তেমনি আন্দোলন-সংগ্রামে পুড়ে পুড়ে ইস্পাত কঠিন হয়েছিলেন শেখ মুজিব।আমরা দেখতে পাই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায়ও তিনি সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। দক্ষ সংগঠক ও তরুন নেতা হিসেবে খ্যাত শেখ মুজিব তাঁর চেয়ে বয়সে প্রবীন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অগ্রসর কিংবা জেল জুলুম খাটা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া সব নেতাকে ছাপিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মকে কেবল ইতিহাসের পটে রেখে স্মরণ করলে তাঁকে আংশিক পাওয়া যাবে। তাঁকে পাওয়া ও বোঝা পূর্ণতা পাবে একই সংগে তাঁর অর্জন ও অবদানকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ণ করলে। ইতিহাস চলে তার আপন গতিতে। সময় নির্ধারণ করে দেয় ইতিহাসের গতিপ্রবাহ। তবে পৃথিবীতে কিছু মহা মানব তাঁদের কর্ম ও দর্শনের মাধ্যমে সেই সময়কে দেয় নতুন মাত্রা। তাঁরা নির্মান করেন সমাজ, সংস্কৃতি আর অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। স্থান কালের সীমানা পেরিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মমান্তরে তাঁরা থাকেন আমাদের কোটি কোটি হৃদয়ের অন্ত:স্থলে অনুপ্রেরণা আর ভরসার সৌম্যহনী শক্তি হিসেবে।
১৫ ই আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম হত্যাকা-ের সাক্ষী। অনেকে বলেন এটি নিছক হত্যাকান্ড ছিল। কিছু মানুষ বঙ্গবন্ধুর উপর ক্ষুব্দ হয়ে উঠেছিল সেই ক্ষোপের বিস্ফোরণ হত্যাকা-। এই ব্যাখ্যা ভুল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছে যার রূপায়ণ ঘটেছে বিপথগামী একদল সেনা অফিসারদের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক। তাঁকে সপরিবারে হত্যা করাছিল সেই আদর্শকে সমূলে বিনাশ করা। কিন্তু নির্বোধ আর মূর্খের দুঃসাহস বরাবরই বেশি থাকে। মূর্খতা ও মূঢ়তার বশবর্তী হয়েই খুনীরা সেদিন বাঙালিদের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার এক দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। এ কূপম-ুকতার কি কোন জবাব আছে! বরেণ্য সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধুর মর্মস্পর্শী মৃত্যু, এ যেনো কোটি হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর নতুনকরে দ্বিগুণ শক্তিতে জেগে উঠা। তার সাহিত্যের ভাষার সরল অর্থ এই যে, একি সম্ভব যে, জোনাকি পোকা চাঁদের দ্যুতি হরণ করে নেবে? সিংহের বিক্রমে বনে দাপিয়ে বেড়াবে ছাগল? মেঘও কদাচিৎ সূর্যের মুখ ঢেকে দিতে পারে বটে তবে তা সাময়িক। কিন্তু সূর্য্য পুরো দিবসের। তাকে ঢেকে রাখার যত অপচেষ্টাই করা হোক না কেন তা আপন রূপে উদ্ভাসিত হবেই। বাংলার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো। তাঁকে ঢেকে রাখার বা অস্বীকার করার সাধ্য কারোও নেই। কিন্তু মূর্খদের তো তা জানার কথা নয়।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার সেই হৃদয়বিদারক সংবাদটি শোনার পর তাৎক্ষনিকভাবে সাহিত্যিক- সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দিন তাঁর ডায়রিতে লিখেছিলেন; মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী রূপে আবির্ভূত হবেন। দ্যা টাইমস অব লন্ডনের ১৯৭৫ সালের ১৬ ই আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় “সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনও অস্তিত্ব নেই। তাদের এ ভবিষ্যদ্বানীর আমোঘতা প্রত্যক্ষ করার জন্য জাতিকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। জাতির বিবেকই সেদিন কথা বলে উঠেছিল। কেঁদে উঠেছিল মুজিবময় লক্ষ কোটি হৃদয়। আর তা যথারীতি মূর্ত হয়ে উঠেছিল কবি -সাহিত্যিক- শিল্পীদের লেখায়, রেখায় ও তুলিতে। বাদ যায়নি রাখালের বাঁশি কিংবা বাউলের একতারাও। সাধারণ মানুষের কোটি হৃদয়ের জমিনে অতি সযতনে মুজিব হত্যার শোক মুজিব আদর্শের দানা বেঁধে পরিনত হয়েছিল এক একটি বীজে। সেই প্রতিটি বীজে শিশু মুজিব ভ্রূণ হয়ে সুপ্ত অবস্থায় লুকিয়েছিলো কোটি বাঙালির হৃদয়ে আর অপেক্ষায় ছিলো অনুকূল পরিবেশে অঙ্কুরোদগমের। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকার প্রধান । সমগ্র বাংলায় মুজিব চর্চার অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান। এই অনুকূল পরিবেশে মুজিব আদর্শের সেই ভ্রূণ অঙ্কুরিত হয়ে পত্র-পল্লবে, ফুলে-ফলে সু-শোভিত হয়ে সমগ্র বাংলায় বিস্তৃতি লাভ করবে। একদিন মুজিব আদর্শের এই সু-শোভিত বৃক্ষগুলো শাখা -প্রশাখা বিস্তার করে মহীরূহে পরিনত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় ছায়া দান করবে আর ছড়িয়ে দিবে মুজিব আদর্শের নব নব সম্ভাবনা। এই বিশ্বাসই হোক আমাদের শোককে শক্তিতে রূপান্তরের শপথ। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, দেশীয় ও বৈশ্বিক ভাবনার ক্ষেত্রে আমরা ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি দিনকেদিন। সে কারণেই সৃষ্টি হয়নি নতুন করে বড় কোন ধরণের তরুন বুদ্ধিজীবী সমাজ। এই আত্মকেন্দ্রিকতার কারণেই আমরা লক্ষচ্যুত হয়ে পড়েছি শোককে শক্তিতে রূপান্তরের শপথ থেকে।
তাই জাতীয় শোক দিবসের এই দিনে আসুন কণ্ঠস্বর তুলি- আর নয় সুপ্ততা! এবার জেগে উঠি মুজিব আদর্শে উদ্দীপ্ত কোটি প্রাণ। এইতো সঠিক সময় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার পিতার আদর্শের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার মননে ও কর্মে। যে বাংলায় থাকবেনা কোন সাম্প্রদায়িকতা,ধর্মান্ধতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, জঙ্গিবাদ, ভোগসর্বস্বতা, মাদক ও নেশার করাল গ্রাস। বঙ্গবন্ধু এদেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে চির ভাস্বর, চির অম্লান হয়ে আছেন,থাকবেন অপার ভালবাসা ও শ্রদ্ধায়। মুজিব আদর্শ ছড়িয়ে পড়বে কোটি হৃদয় থেকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এভাবেই প্রতিবছর রক্তঝরা আগস্ট আসবে বাংলার ইতিহাসে দেশ গড়ার সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আগামী প্রজন্মের কাছে কোটি মুজিবের জন্মক্ষণ রূপে।
লেখক: মোসা. সেলিনা আকতার, সহকারী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, পটুয়াখালী সরকারি কলেজ, পটুয়াখালী।
চোরের মন পুলিশ পুলিশ কিন্তু পুলিশের মন ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল কি না সেটা অন্তত আপ্তবাক্য হিসেবে প্রচলিত না। তা না থাক, বহুদিন ধরেই ‘পুলিশকে আরও মানবিক আচরণ করতে হবে’ বলে কথাটি চালু আছে। তার মানে পরিষ্কার– পুলিশের আচরণে নিশ্চয়ই সমস্যা আছে। আরেকটি কথাও প্রচুর শোনা যায়– বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। তো বেশ পশুত্ব, হিংস্রতা, অমানবিকতার এই বাক্যে পুলিশ সদস্যরা শ্লাঘা বোধ করেন কি না তা জানি না। কিন্তু এটা জানি যে পুলিশের কাছে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয় অনেক মানুষকে।
পুলিশের আচরণ নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। বাহিনীটির শীর্ষ কর্মকর্তারা বারবার সদস্যদের পরিশীলিত হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, বলছেন, অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রয়োগ হলে শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি হচ্ছেও মাঝেমধ্যে, তবু অভিযোগের শেষ নেই। বলা হয়ে থাকে কলোনিয়াল মাইন্ডসেটের কথা। এর সত্যতা থাকলেও পুরোটাই কি সেই ঔপনিবেশিকতার জের, নাকি আরও কিছু ফাঁকফোকরকে ইতিহাসের কাঁধে চেপে আড়াল করে যাওয়া? পুলিশের এই বিকলাঙ্গ আচরণ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের পঙ্গুত্বকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
পুলিশের অবদান নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাদের কর্মকাণ্ড যেমন আলোচিত, পাশাপাশি সমালোচিত। সাধারণ মানুষকে পুলিশ বিষয়ে প্রশ্ন করলে নেগেটিভ মন্তব্যই বেশি পাওয়া যাবে। প্রশ্ন হলো, কেন সাধারণ মানুষ পুলিশের সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়? কেন সাধারণ মানুষের অভিযোগ বা মন্তব্যে কেউ কর্ণপাত করছে না? এই বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে।সম্পªতি ১ জুন অর্থমন্ত্রী আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন, ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বিশাল আকারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতাসহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কোনো ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়নি। প্রতিবন্ধী ভাতা পাঁচ হাজার টাকা করাসহ ১১ দফা দাবিতে রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে পুলিশের বাধায় পড়ে ‘সংক্ষুব্ধ প্রতিবন্ধী নাগরিক সমাজ’।
আন্দোলনকারীদের ভাষ্য মতে, প্রধানমন্ত্রী তাদের দাবি না মানলে সড়ক থেকে উঠবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে তাদের রুখতে সজাগ দৃষ্টিতে অবস্থান করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে রবিবার সকাল থেকে শুরু হয় আন্দোলনকারীদের অবস্থান কর্মসূচি। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেখান থেকে কর্মসূচি শেষে যাত্রা শুরু করলে তাদের শাহবাগেই আটকে দেয় পুলিশ। পরে একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের সড়ক আটকে দিলে তারা সড়কে বসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে শুরু করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বারবার তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরতে নারাজ। ধরে নিলাম, পুলিশের বক্তব্যই সঠিক। এই বক্তব্যকে এক পাশে রেখে চিন্তা করি যে একটি আদর্শ সমাজে কী হয়। প্রতিবাদ করা একটি অধিকার এবং প্রতিবাদের জন্য অনুমতির প্রয়োজন হওয়ার কথা না।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টে আন্দোলনকারীরা পুলিশের যে আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। তারা জানান, পুলিশ সামনে হুইল চেয়ারে বসা আন্দোলনকারীদের সামনে এগোতে বাধা দিলে তারা সেখানেই অবস্থান নেন। কিন্তু পুলিশ তাদের ধাক্কা দিয়ে, বলপ্রয়োগ করেই ক্ষান্ত হয়নি, হুইল চেয়ারসহ আন্দোলনকারীদের কাউকে কাউকে তুলে পেছনের দিকে ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করেছে। একজন নারীকে হুইল চেয়ার থেকে টেনে ফেলে দিয়েছে পুলিশ। হুইল চেয়ারের চাকা ভেঙে দিয়েছে। শ্রবণপ্রতিবন্ধী হুইল চেয়ারে বসা আন্দোলনকারীদের বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। পুলিশকে বাধা দিতে গেলে তারা আরও মারমুখী হয়ে ওঠে এবং আন্দোলনকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হয়। একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এক আন্দোলনকারী বলেন, পরিস্থিতি নাজুক বুঝতে পেরে আন্দোলনকারীরাই নিজেদের শান্ত করেছেন। তিনি বলেন, আমরা যদি পরিস্থিতি শান্ত না করতাম তাহলে আরও বড় কিছু হয়ে যেত। এই পর্যায়ে আসলেই প্রশ্ন জাগে যে সেখানকার পুলিশ সদস্যরাই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কি না। যেখানে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের এই বিক্ষোভ-আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের চেয়ে তাদের দাবি-দাওয়া প্রকাশে নিরাপত্তা দেওয়াই স্বাভাবিক পুলিশি তৎপরতা হওয়ার কথা ছিল, সেখানে তারা যে আচরণ করেছে কেবল এজন্যই ওই পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার দাবি রাখে। এখানেই শেষ নয়। অপর একজন প্রতিবন্ধী আন্দোলনকারী জানাচ্ছেন, পুলিশ তাদের তুই-তোকারি করে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছে। পাবলিককে, জনগণকে এই তুই-তোকারি করার পুলিশি খাসলতের কারণেও অনেকে পারতপক্ষে পুলিশের কাছে যান না।
রাজনৈতিক আন্দোলন, সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, সহিংসতা দমনের ধরন আর প্রতিবন্ধীভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, হাঁটাচলায় অক্ষম ব্যক্তিদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে যে পুলিশ পার্থক্য করতে পারে না, সেই পুলিশ দিয়ে আমরা কী আশা করতে পারি! এখানে ‘অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে’ বলে কি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ বাহিনী দায় এড়াতে পারে? গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদ জানানোর, দাবি জানানোর অধিকার সবার আছে। কিন্তু তা মোকাবিলায় পুলিশের যে আচরণ সেটা ন্যক্কারজনক। আমরা পুলিশকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে দেখতে চাই না।
বিদ্যমান পুলিশি আইনে পুলিশকে মানবিক করা যাবে না। কারণ পুলিশ চলছে ১৮৬১ সালের আইনে। যে আইনটি ব্রিটিশরা করেছিল এ অঞ্চলের মানুষকে শোষণ করার জন্য। যতদিন এ আইন পরিবর্তন করার যাবে না ততদিন পুলিশ এমন অমানবিক আচরণ করবে। এ আইন পরিবর্তন করে পুলিশকে বাহিনীর বদলে সেবাদাতায় পরিণত করতে হবে। তবে অন্যায্য বা অন্যায় আচরণ করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয় না, এমনটা নয়। গত ছয় বছরে ৭৬ হাজার পুলিশকে নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এই হিসাবে দেশের প্রতি দুজনের একজনই বাহিনীর শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কোনো না কোনোভাবে সাজাপ্রাপ্ত।
প্রতিবন্ধীদের আন্দোলন দমনে সর্বশেষ পুলিশ সদস্যরা যে আচরণ করেছে, তাতে করে গণতন্ত্র রক্ষা না, অমানবিকতার দায়েই বাংলাদেশের পুলিশের ওপর উন্নত দেশগুলো বিশেষ ভিসানীতি দিতে পারে। পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য চিকিৎসা জরুরি। এটা দীর্ঘদিনের আলোচনার বিষয়। কারণ যে মানুষটি সারা দিন অপরাধ বা অপরাধী নিয়ে থাকেন বা থাকছেন, তার মানসিক অবস্থার উন্নতি না হলে তিনি কখনো ইয়াসমিনদের তুলে নিয়ে যাবেন, কখনো লতা সমাদ্দারদের টিপ-কাপড় নিয়ে কথা বলবেন, আবার কখনো বা নারীর ব্রা-এর ফিতা কোন দিক দিয়ে বের হয়ে আছে, তা খুঁজে বেড়াবেন। দেখা যাচ্ছে যেখানে নিরাপত্তার প্রশ্ন সেখানে পুলিশ খড়গহস্ত– কেন?
বিপ্নবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থার উদ্যোগে বাংলাদেশে নির্মিত 'বীরকন্যা প্রীতিলতা' চলচ্চিত্রটি সম্প্রতি প্রদর্শন করা হয়েছে শহীদ সূর্যসেন ভবনে। সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, চলচ্চিত্র প্রযোজক, শিক্ষক ও বিদ্ধজনেরা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে- মাত্র ২১ বছরের একজন সাধারণ ঘরের মেয়ের বীরত্বের কাহিনি সিনেমার পর্দায় দেখতে।
বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থার কিছু কাজের সূত্রে আলোচনা করতে গিয়ে একজন শিক্ষক বলেছিলেন, দেখুন, মাস্টারদা প্রণম্য মানুষ, আমি শ্রদ্ধা করি। তবে একশ বছর আগে কি ঘটেছে এ নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করতে চাই না।
সম্প্রতি সূর্যসেন ভবনের কাজের সূত্রে এক সরকারি কর্মকর্তার গলায় শুনলাম, সূর্য সেনের নামে পাড়ায় পাড়ায় অনেক ক্লাব আছে, সূর্যসেন কোনোদিন এই জায়গাগুলোতে এসেছেন বা পা রেখেছেন তা মনে হয় না। সূর্যসেন ফাঁসিতে আত্মবলিদান দেন ১২ জানুয়ারি, ১৯৩৪। তাই বলছি- সূর্যসেন, নির্মল সেন, গণেশ ঘোষ, অস্বিকা চক্রবর্তী, অনস্ত সিংহ, কঙ্গনা দত্ত, প্রীতিলতাদের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন শ্রী প্রদীপ ঘোষ।
কিন্তু মাস্টারদার নেতৃত্বে ১৩ থেকে ২৩ বছরের ৬৪ জন যুবককে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, সংগ্রামী কর্মসূচিতে উদ্বুদ্ধ করে একই রাতে ব্রিটিশের দুটো অস্ত্রাগার দখল করা, ৩ দিন চট্টগ্রামকে স্বাধীন রেখে ভারতের পতাকা উড্ডান রাখা ও জালালাবাদ পাহাড়ে প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ৮০ জন ব্রিটিশ সৈন্যকে নিধন করার বীরগাথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্থান পায়নি। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রাম শাখার সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে জালালাবাদ যুদ্ধের পর, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বৃহৎ যুদ্ধ ছিল প্রীতিলতার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ইংরেজদের প্রমোদ কেন্দ্র ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। মাত্র সাতজন বিপ্লবী সাথী নিয়ে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সফল অভিযানের পর আত্মাহুতি দিয়েছেন গুলিতে আহত প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
এই ইউরোপিয়ান প্রমোদ কেন্দ্রের গেটে লেখা ছিল 'ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড' (কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ)। কথাটা কোনো কোনো মানুষের মনকে ভয়ঙ্করভাবে বিদ্ধ করেছে অনুমান করা যায়। কিন্তু মাস্টারদার নেতৃত্বে সফল সশন্ত্র বিপ্নবের ফলে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত নড়ে গিয়েছিল, অবশেষে আমরা স্বাধীনতা লাভ করলাম, শৃঙ্খলমুক্ত হলাম- সেই অনুভূতি আমাদের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রাম শাখার ৯ জনকে ফাঁসিতে শহীদের মৃত্যু বরণ করতে হলো। ৫৯ জনের আত্মত্যাগ ছাড়াও বিপ্লবীদের প্রত্যেককেই অমানুষিক নির্যাতন ভোগসহ অসংখ্য আশ্রয়দাতা ও সাহায্যকারীর অবর্ণনীয় নির্যাতনের কাহিনি আমাদের কাছে প্রনিধানযোগ্য নয়! আমরা শুধু মুক্ত থাকতে চাই। মাস্টারদার এই বীরত্বপূর্ণ মর্মস্পর্শী অভিযানের কাহিনি, বিপ্লবী পরিবারের কিছু লোকজন, দু-একটি বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য এবং হাতেগোনা পণ্ডিতদের বাইরে কেউ কিছু জানেন বলে মনে হয় না। জানবার সুযোগও নেই। নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লব অন্তর্ভুক্ত থাকলে নতুন প্রজন্মের পক্ষে সঠিক ইতিহাস জানা সহজ হতো।
এই চলচ্চিত্রের পরিচালক প্রদীপ ঘোষকে আন্তরিক অভিনন্দন। একইসঙ্গে প্রীতিলতা চরিত্রের অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা ও কলাকুশলীদের প্রতি, ভারতবাসীর পক্ষ থেকে শুভকামনা।
লেখক : সহ-সাধারণ সম্পাদক, বিপ্লব তীর্থ চট্টগ্রাম, কলকাতা
সব মানুষের স্বপ্ন থাকে সুন্দর একটা বাড়ি করার। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে ঘরে ফিরে সবাই চায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস। নিজের একটা বাসস্থান মানুষের স্থিতিশীলতা, আত্মমর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত সবারই ন্যূনতম চাওয়া একটা সুন্দর ফ্ল্যাট তথা নিজস্ব ঠিকানা। কিন্তু এবার বাজেট প্রস্তাব এর পর অসংখ্য নাগরিকের ফ্ল্যাট এর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। আমাদের বেসরকারি ডেভেলপারদের একান্ত চেষ্টায় অনেক স্বল্পবিত্ত নাগরিকও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে মনে হচ্ছে ফ্ল্যাট আবার উচ্চ বিত্তের পণ্য হয়ে যাবে। সবার জন্য যে আবাসন এই স্লোগান এখন স্লোগানই থেকে যাবে।
এবার বাজেটে অনেক এলাকায় ২০ লক্ষ টাকা প্রতি কাঠা সরকারি ট্যাক্স ধরা হয়েছে। অথবা চুক্তি মূল্যের ৮ শতাংশ। এটা আগে ৪ শতাংশ ছিল। আবার শর্ত আছে যেটা বেশি হবে সেটা দিতে হবে। তার মানে কমপক্ষে কাঠা প্রতি ২০ লক্ষ টাকা ট্যাক্স। ক্ষেত্র বিশেষ এটা আরও বেশি দিতে হবে। এটা গেল জমির ক্ষেত্রে। ফ্ল্যাট এর ক্ষেত্রে আগে ১০-১২.৫ শতাংশ ট্যাক্স ছিল এটা এবার হবে ১৪-১৬.৫ শতাংশ। আবাসন খাতে কি অবস্থা দাঁড়াবে চিন্তা করা যায়?
আমরা আবাসন ব্যবসায়ীরা রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) থেকে এই ট্যাক্স ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। দীর্ঘ দিন ধরে গণমাধ্যম এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলাম। একটা সময় ১৫ শতাংশ ট্যাক্স ছিল তখন জমি–ফ্ল্যাট বিক্রি অনেক হ্রাস পেয়েছিল। চার বছর আগে কিছুটা হ্রাস করার পর এই ট্যাক্স ছিল ১০-১২.৫% পর্যন্ত। নতুন করে ৪ শতাংশ ট্যাক্স বৃদ্ধিতে এই খাতে স্থবিরতা নেমে আসবে। অধিক ট্যাক্স কালেকশন করতে গিয়ে উল্টো ট্যাক্স কমবে বলে আমাদের শঙ্কা।
ড্যাপ এ ফার হ্রাস, নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি সহ নানাবিধ কারণে ব্যবসা সংকটে রয়েছে, এ অবস্থায় স্বস্তির কোনো উদ্যোগ নেই বাজেটে। উল্টো জমি-ফ্ল্যাট নিবন্ধন ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে রেজিস্ট্রেশন ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি সিমেন্ট, পাথর, টাইলস, লিফট, সিরামিক, গ্লাস, সুইচ-সকেট, ক্যাবল, কিচেনওয়্যারসহ কম পক্ষে ১২-১৩টি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যে সকল পণ্যের দাম বাড়বে তার ক্রেতা হচ্ছি আমরা যারা ফ্ল্যাট তৈরি করি। আর সব শেষ এই পণ্যের দাম গিয়ে পড়বে ফ্ল্যাট ক্রেতার ওপর। ফ্ল্যাটের দাম আরেক দফা বাড়বে। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে অনেকেই ফ্ল্যাট কেনার সক্ষমতা হারাবেন এবং আবাসন ব্যবসায়ীরা ক্রেতা হারাবেন। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা আরও কঠিন হয়ে যাবে। মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসন অনেকেই সঠিকভাবে পাবেন না। এমনিতেই ফ্ল্যাট তৈরি কমে গেছে ফলে আগামীতে ফ্ল্যাটের সংকট তৈরি হবে।যার প্রভাব পড়বে বাড়ি ভাড়ায়। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পাবে। ফলে ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে স্বল্প আয়ের কর্মজীবীদের কষ্ট আরও বাড়বে।
রিহ্যাব জাতীয় বাজেট উপলক্ষে আবাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সংস্থায় যোগাযোগ করেছে কয়েক বছর ধরে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তার কোনোটার প্রতিফলন হয়নি।
নীতি সহায়তার অভাবে ক্রমে দেশের আবাসন খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পতিত হয়েছে। অতিরিক্ত কর আরোপ এর কারণে এই আবাসন খাতকে ভয়ংকর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।
এই অবস্থায় আশু পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই সংকট উত্তরণ অসম্ভব। এই মুহূর্তে নতুন করে নানা পণ্যের কর বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমাদের শঙ্কা। আবাসন খাত মানে শুধু আবাসন খাত নয়। এর সঙ্গে ৪ শতাধিক লিংকেজ শিল্প জড়িত। আবাসন খাতে সংকট মানে এই সব উপখাতে সংকট। আবাসন খাতে ৪০ লক্ষ নাগরিকের কর্মস্থান। এই খাতের সংকট অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করবে আমাদের শঙ্কা। কাজেই বাজেট পাশের আগে এই দিকে অবশ্যই সুনজর দেওয়ার আহ্বান জানাই।
কামাল মাহমুদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট (প্রথম), রিহ্যাব
আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক রীতি-নীতি অনুযায়ী, বয়স্কদের জন্য আলাদা নিবাস অনেকটা 'বনবাসে' যাওয়া বা পাঠানোর মতোই ঘটনা
আধুনিক জমানায় বৃদ্ধাশ্রম একটি জনপ্রিয় কনসেপ্ট। উন্নত দেশে ডে-কেয়ার সেন্টারের পাশাপাশি ওল্ড হোমও জনপ্রিয়। পাশ্চাত্য ধারণায় তাড়িত হয়ে আমাদের দেশেও প্রবীণ নিবাস, ওল্ড হোম বা বৃদ্ধাশ্রম ক্রমেই আলোচিত হয়ে উঠছে।
বিপক্ষে— বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বয়স্কদের ঠিকানা
আমাদের দেশের যৌথ পরিবারের হই-হুল্লোড়ের মধ্যে আগে যখন শুনতাম বিদেশে নাকি বুড়ো হলে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে, তখন ওসম দেশের লোকদের প্রতি ঘৃণা ও করুণা হতো
মনুসংহিতায় চতুরাশ্রমের তৃতীয় আশ্রম ‘বানপ্রস্থ’ কি কেবলই একটা ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক এষণা, নাকি নীরবে ও শান্তিপূর্ণভাবে সামাজিক ক্ষমতা হস্তান্তর। অন্যভাবে বললে সংসারের বোঝা নামিয়ে বা দায়িত্ব শেষ করে নিজেকে সময় দেওয়ার, ফেলে আসা জীবনকে অবসরে উদযাপনের সুযোগ।
পক্ষে— তবুও শান্তি তবু আনন্দ
নানা অপপ্রচার, নেতিবাচক সমালোচনার মধ্যে ভারতের জম্মু কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে জি ২০ সম্মেলনের পর্যটন খাতের বিকাশ নিয়ে কয়েকটি অধিবেশন শুরু হল ২২ মে। গত কয়েক দিন থেকে সম্মেলনে অংশ নিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিনিধিরা আসতে শুরু করেছেন। চীন বাদে অন্য সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা পর্যটন সম্পর্কিত তৃতীয় ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের জন্য সোমবার শ্রীনগরে পৌঁছেছেন। 'অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের জন্য ফিল্ম টুরিজম' শীর্ষক একটি পার্শ্ব ইভেন্টের মাধ্যমে তিন দিনের বৈঠকের সূচনা হয়। ভারত সভাপতি হিসাবে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশকে ২০২৩ সালের জি-২০ প্রক্রিয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে।‘ এটা বাংলাদেশকে খাদ্য এবং জ্বালানি নিরাপত্তা কিংবা পরিবেশের জন্য জীবনযাত্রা কিংবা নারীর নেতৃত্বে উন্নয়ন, সব ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ হওয়ার এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জি ২০ এর প্রধান সমন্বয়কারী হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।
এ প্রসঙ্গে জি ২০ এর প্রধান সমন্বয়কারী হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, জি-২০ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ার এক অনন্য সুযোগ। তিনি আরও বলেছেন জি-২০-এর সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ শুধু ভারতের জন্যই সুযোগ নয়; বরং সব উন্নয়নশীল দেশের জন্যও এটা একটা বিরাট সুযোগ। বিশেষ করে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য সুযোগ তো বটেই। তিন দিনের শীর্ষ সম্মেলন ঘিরে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তিন দিনের বৈঠকে আগের বৈঠকগুলোর তুলনায় বিদেশি প্রতিনিধিদের সর্বাধিক অংশগ্রহণ দেখা যাবে বলে ধারণা করছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অশান্ত কাশ্মীরে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই সম্মেলন করছে স্বাগতিক ভারত। বিশ্বকে দেখাতে চাইছে যে সেখানকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। ধারণা করা হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীরে জি-২০ সম্মেলন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতির একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। নতুন নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা এ অঞ্চলের নাগরিকদের জীবনের মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বলেছেন, কাশ্মীরে পরিবর্তন এসেছে এবং ধর্মঘটের ডাক আর নেওয়ার কেউ নেই। এখানে শহরের কেন্দ্রস্থল সহ কাশ্মীর জুড়ে বাজারগুলি সারা দিন খোলা ছিল এবং বুলেভার্ড রোডে ট্র্যাফিক ডাইভার্সন ব্যতীত লোকজনের চলাচল বা পরিবহনে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না।
ইতিমধ্যে কাশ্মীরের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে।’ জি২০ ফোরামের বর্তমান সভাপতি হিসেবে ভারত ৫৫টি স্থানে ২১৫টি অধিবেশনের পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে অন্তত চারটি অধিবেশনে পর্যটনের ওপর আলোকপাত করা হবে। পর্যটনের ওপর তৃতীয় জি ২০ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা চলবে আগামী ২৪ মে পর্যন্ত শ্রীনগরে। ভারত বর্তমানে জি-২০-এর সভাপতি। শিল্পোন্নত ১৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে জি -২০ গঠিত। বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) 80 শতাংশ এই দেশগুলোর হাতে।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ড. সমীরা গুপ্তা বলেন, জম্মু ও কাশ্মীরে জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে এই অঞ্চলের অপার সম্ভাবনা বিশ্বের কাছে তুলে ধরার এক অনন্য সুযোগ পেয়েছে ভারত। সম্মেলনে কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা তুলে ধরা হচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করছে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করছে। তিনি আরও বলেন, "জি ২০ সম্মেলন কাশ্মীরকে বৈশ্বিক মানচিত্রে স্থান দিয়েছে, এটিকে বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং পর্যটনের জন্য একটি প্রতিশ্রুতিশীল গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত করার অনুমতি দিয়েছে৷ এই এক্সপোজার নিঃসন্দেহে অবদান রাখবে উপত্যকার আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য।"
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় উদ্যোগগুলি জম্মু ও কাশ্মীরের অবকাঠামো উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে বলে মনে করছেন ভারতের অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ডঃ রাজেশ ভার্মা। তিনি বলেন অত্যাধুনিক বিমানবন্দর, মহাসড়ক এবং আধুনিক শহুরে অবকাঠামো নির্মাণ এই অঞ্চলে সংযোগ বৃদ্ধি করেছে এবং ব্যবসা করার সহজতর করেছে। এই উন্নয়নের ঢেউ শুধুমাত্র স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনকে উন্নত করেনি বরং বিনিয়োগ ও চাকরির সুযোগের দরজাও খুলে দিয়েছে। তার মতে, "জি-২০ উদ্যোগের ফলে পরিকাঠামোর আপগ্রেড গুলি কাশ্মীরের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে এবং এর নাগরিকদের জীবনযাত্রার সামগ্রিক মান উন্নত করবে।
স্থানীয় জনগণের ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে, জম্মু ও কাশ্মীরে জি-২০ উদ্যোগ দক্ষতা উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তার ওপর জোর দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সামাজিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ডক্টর আয়েশা খান। তিনি বলেন, বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, বৃত্তিমূলক কোর্স এবং ব্যবসায়িক ইনকিউবেটর গুলির মাধ্যমে, উদ্যোগগুলি উদ্যোক্তার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এবং একটি দক্ষ কর্মী বাহিনী তৈরি করতে জি ২০ সম্মেলনে বিশদ আলোকপাত হবে। দক্ষতা বিকাশ এবং উদ্যোক্তার ওপর জোর দেওয়া কাশ্মীরের যুবকদের ক্ষমতায়ন করবে, তাদের এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে এবং একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করার অনুমতি দেবে।
জম্মু ও কাশ্মীরের অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এটিকে একটি প্রধান পর্যটন গন্তব্য করে তুলেছে। জি-২০ উদ্যোগগুলি উপত্যকায় পর্যটনের প্রচার, বিশ্ব ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করার এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করার ওপর জোর দিয়েছে। পর্যটন বিশেষজ্ঞ ড. রাঘব মালহোত্রা বলেছেন, জি-২০ উদ্যোগগুলি কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রয়োজনীয় গতি প্রদান করেছে। দর্শনার্থীদের এই আগমন শুধুমাত্র রাজস্ব তৈরি করবে না বরং সাংস্কৃতিক বিনিময়কেও উৎসাহিত করবে এবং শান্তি ও বোঝাপড়ার প্রচার করবে।
এত কিছুর মধ্যেও নয়াদিল্লি ভারত-শাসিত কাশ্মীরকে তার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনার পর থেকে, সরকার বেশ কয়েকটি আইন ও নীতি প্রয়োগ করেছে যা নিয়ে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে উপত্যকার কাশ্মীরিদের মধ্যে। তারা বলেছে তাদের অধিকার ও সংগ্রামকে দুর্বল করার লক্ষ্যে এসব আইন ও নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে। এ রকম একটি অবস্থার মধ্যে কাশ্মীরে জি ২০ সম্মেলন আয়োজন করতে ভারতকে বেশ সতর্কতা ও অনেক বহি শত্রুর হুমকি মোকাবিলা করতে হয়েছে। স্থানীয় এক মানবাধিকার কর্মী বলেন, কাশ্মীরের জনগণের নিরাপত্তার অনুভূতি শুধু সম্মেলন দিয়ে নিশ্চিত করা যাবে না। তিনি বলেন এমন বিশাল একটি সম্মেলনের জন্য এ অঞ্চলে আমাদের একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী থাকা উচিত ছিল এবং আমাদের তা নেই। আমি আশা করি বিশ্ব এই বিষয়গুলি লক্ষ্য করবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান আল জাজিরাকে বলেছেন, ভারত, জি২০ ইভেন্টের মাধ্যমে এই অঞ্চলে শান্তি রয়েছে বলে দাবি করতে চায়। তিনি বলেছিলেন। আসলে, নয়া দিল্লির জন্য, শ্রীনগরে এই সভা অনুষ্ঠিত করার অর্থ হল 'সব ঠিক আছে' এবং 'সব স্বাভাবিক'-এর বার্তা বহির্বিশ্বে প্রচার করা।
জি ২০ সম্মেলন নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ফার্নান্ড ডি ভারেনেস বলেছেন, কাশ্মীর নয়াদিল্লির প্রত্যক্ষ শাসনের অধীনে আসার পর থেকে "ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের" ঘটনা ঘটেছে এর মধ্যে রয়েছে অত্যাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, কাশ্মীরি মুসলমান এবং সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার অস্বীকার করা, বিতর্কিত অঞ্চলে জি-২০ বৈঠকের মাধ্যমে "কাশ্মীরি মুসলিম ও সংখ্যালঘুদের গণতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অধিকারের নৃশংস ও দমনমূলক অস্বীকৃতি" স্বাভাবিক করার জন্য ভারতের এই আয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। যদিও জেনেভায় জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী মিশন "ভিত্তিহীন এবং অযৌক্তিক অভিযোগ" বলে তার ওই বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবে নয়াদিল্লি-ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সরল শর্মা মনে করেন এই বৈঠকটি কেবল কাশ্মীরের পর্যটন সম্ভাবনাই নয়, এর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য হল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান একটি ধারণাকে ভেঙে দিয়ে নতুন ধারণার জন্ম দেওয়া যে কাশ্মীরে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়েছে। অতএব, এই সভার স্থান হিসাবে শ্রীনগরের নির্বাচন তাৎপর্যপূর্ণ। শর্মা বলেন, যদিও কিছু দেশ, যেমন পাকিস্তান, শ্রীনগরে জি ২০ বৈঠক আয়োজনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভারতের সমালোচনা করার চেষ্টা করে আসছে, এটা মনে রাখা অপরিহার্য যে পাকিস্তান জি ২০ গ্রুপের সদস্য নয়। তাই তাদের আপত্তির কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই।
(প্রকাশিত লেখার আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায় সম্পূর্ণরূপে লেখকের, এর কোনো প্রকার দায়ভার দেশ রূপান্তর নেবে না)
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হলের আসন দখল করে রাখার বিরুদ্ধে অনশনরত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম প্রত্যয়সহ তাকে সমর্থন দেওয়া কয়েকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।তারা বলেন, ওই স্থানে গত বুধবার রাত থেকে অনশনে ছিলেন প্রত্যয়। তাকে মারধরের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় হামলায় জড়িতরা। এ সময় প্রত্যয়ের দাবির সঙ্গে সংহতি জানানো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হয়।
জানা গেছে, তিন দাবিতে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের খেলার মাঠে অনশনে বসেন প্রত্যয়। তিনি ওই হলের আবাসিক ছাত্র। তার অন্য দুটি দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা ও হলের গণরুমে অবস্থান করা বৈধ ছাত্রদের আসন নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং নবীন শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে লোডশেডিং চলছিল। হঠাৎ করেই প্রত্যয়সহ তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
হামলায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী, মার্কেটিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সৃষ্টি, চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মনিকা, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৮তম ব্যাচের সুরসহ আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা ও রসায়ন বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌতম কুমার দাস, তুষার, ফেরদৌস, নোবেল, গোলাম রাব্বি, মুরসালিন, মুরাদ, সোহেল, তানভীর, রায়হান, রাহাত, সৌমিক, তারেক মীর, সজীব ও নাফিস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যারা প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রত্যয়কে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। তখন তারা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে সেটি ফিরিয়ে দেয়। প্রক্টরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি আসেননি। একাধিক ছাত্রীর দিকেও চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ এমন একটি ফোনকল পেয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তবে কে কল দিয়েছিল সে সম্পর্কে চিকিৎসা কেন্দ্রের কেউ বলতে পারেননি।
তবে যে ফোন নাম্বার থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেটিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় নাম্বারটি শাখা ছাত্রলীগের নেতা গৌতম কুমার দাসের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করব।
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল নিয়ে তারা এ রাত পৌনে ১টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছেন।
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।