শিক্ষকের স্নেহছায়া
ফারুক সুমন | ৫ অক্টোবর, ২০২০ ২০:৫৮
‘পৃথিবীতে কোনো মানুষই মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। ক্রমশ তাকে মানুষ হয়ে উঠতে হয়’। এরিস্টটলের এরকম একটি কথা পড়েছিলাম অনেক আগে। অর্থাৎ মানুষ অন্য সব প্রাণির মতোই প্রাণ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কেবল অবয়বে মানুষের মতো দেখালেই তিনি মানুষ হয়ে যান না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে মানবীয় গুণাবলি অর্জন করে তবেই মানুষ হয়ে উঠতে হয়। দেখতে মানুষের মতো কেউ যখন অমানুষের মতো আচরণ করে, তখন তাকে মানুষ না বলে আমরা ‘পশু’ বলে সম্বোধন করি। তার আচরণকে ‘পাশবিক আচরণ’ বলে অভিহিত করি।
মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার এই যে যাত্রা, এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ভূমিকা রাখেন বাবা ও মা। তাদের পরেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন শিক্ষক কিংবা গুরুজন। কখনো কখনো আচরণগত শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের চেয়ে শিক্ষকদের বেশি অনুকরণ করে শিক্ষার্থীরা। ফলে একজন আদর্শ শিক্ষক সারাজীবনের জন্য শিক্ষার্থীর মানসগঠনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারী হয়ে থাকেন। এই বিবেচনায় শিক্ষককে বলা হয় ‘দ্বিতীয় জন্মদাতা’। একজন মহৎ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেন। কেবল দেখতে মানুষের মতো হলেই মানুষ হওয়া যায় না। অন্তর থেকে পশুসুলভ যাবতীয় আচরণ মুছে দিয়ে সেখানে স্থাপন করতে হয় মনুষ্যত্বের সুউচ্চ ইমারত। তবেই কেবল মানুষ হওয়া সম্ভব।
আমাদের জীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা প্রতিষ্ঠানের বাইরে এমন শিক্ষক নিশ্চয় আছেন। যিনি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ব্যক্তিত্ব ও আদর্শের দ্যুতি ছড়িয়ে জীবনের সঠিক পথে আমাদের ধাবিত করেন। অনুকরণ ও অনুসরণের আসন নিয়ে তিনি অনুক্ষণ অনুভবে থাকেন। জীবনের নানাপর্বে এমন অসংখ্য শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি আমি।
আজ ‘শিক্ষক দিবস’। মূলত এই বিশেষ দিনে তাদের স্মৃতি স্মরণে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের কয়েকজন শিক্ষকের সান্নিধ্য নিয়ে লেখার প্রয়াস পাব। নিশ্চয় অন্য কোনো সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নিয়েও লিখব।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। মনে পড়ে, মানবিক বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম। গ্রাম থেকে হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তারিত বিদ্যায়তনে প্রবেশ আমার জন্য এক মহাবিস্ময়। প্রথমেই মনমাতানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। পুরাতন কলাভবনের নিচতলায় ছিলো বাংলা বিভাগ। যদ্দুর মনে পড়ে, ককশিটে কালো অথবা হলুদ হরফে বড় করে লেখা ছিলো ‘বাংলা বিভাগ’। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ঘেঁষে ছিলো একটি ফটোকপির দোকান। এই ভবনে বাংলা বিভাগ ছাড়াও প্রত্নতত্ত্ব, নাট্যতত্ত্ব ও ইতিহাস বিভাগ ছিল। নিচতলায় বাংলা বিভাগের সামনেই, করিডোরের কোলঘেঁষে ছিল সবুজ ঘাসের বিস্তার এবং বাহারি ফুলের সমাহার। বলতে দ্বিধা নেই, এই সবুজ ঘাসের গালিচা আর বাহারি ফুলের আবহ আমাকে আপ্লুত করেছিল। বিভাগ সম্মুখে এই একখণ্ড মনোরম সবুজ সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ আমাকে প্রেমাগ্রহী করে তুলেছিলো। পুরাতন কলাভবনের ঈষৎ শেওলা পড়া দেয়াল কিছুতেই ভুলতে পারি না। এখনো ক্যাম্পাসে গেলে পুরাতন কলাভবনের দেয়াল ছুঁয়ে প্রণাম করি। কারণ এখানে আমার গুরুজনদের পদচারণা ছিলো। তাদের পদধুলি এবং নিশ্বাসের প্রবাহ ছিলো। এখনো চোখে ভাসে শ্রদ্ধেয় স্যার-ম্যাডামদের সেই কক্ষগুলো।
ভর্তি হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মোজাম্মেল স্যারকে হারিয়েছি। যিনি আমাদের ‘পুঁথিপাঠ ও পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা’ বিষয়ক কোর্সের পাঠদান করতেন। (পরে অধ্যাপক শামীমা সুলতানা লাকী ম্যাডাম পড়িয়েছিলেন।) এ ছাড়া স্যারের মুখেই প্রথম রুবাই, হাইকু, লিমেরিক এই শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এগুলো এক ধরনের কবিতা। মোজাম্মেল স্যারের মুখেই প্রথম এমন অভিনব আঙ্গিকের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম।
তখন বেশ বোকাসোকা ছিলাম। কেবল তাকিয়ে থাকতাম ফুলের দিকে। ফুলের ফাঁকে দেখে নিতাম অন্য কোনো ফুল। নিঃশ্বাসে টেনে নিতাম অন্য কোনো সুরভী। বলছিলাম আমার বোকামির কথা।
নবীন বরণের দিন খেয়েছি ধরা। সবার নজর কাড়তে গিয়ে নিজেকে উজাড় করে গেয়েছি শিল্পী রবি চৌধুরীর গাওয়া বিখ্যাত বাজারি একটা গান।
‘তুমি দুঃখ পাও, তুমি কষ্ট পাও, এই আমি চাই।
তুমি বোঝনি, এই আমাকে, ছিলে ছলনায়’।
তো গানটি শোনানোর পর ভেবেছিলাম সবার মন জয় করে ফেলেছি। কিন্তু বিধিবাম। উল্টো হা হা হি হি হাসির রোল পড়ে গেলো সারা হল ঘরজুড়ে। আমার মন খারাপ হলো।
প্রথম দিকে অতি বিনয় এবং লাজুকতার ভারে আমি কিছুটা কুঁজো হয়ে হাঁটতাম। আমার শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৌদা আক্তার ম্যাডাম আমাকে দেখলেই আঙুলে ইশারা করে বলতেন, ‘না না সুমন, এভাবে নয় পিঠ টান করে হাঁটো। মেরুদণ্ড সোজা হবে’। তারপর থেকে এই বাক্যটি আমি ভুলিনি। ম্যাডাম ‘উত্তরাধুনিক সাহিত্য’ কিংবা ‘উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য’ নিয়ে যা যা পড়িয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত লেখালেখির প্রয়োজনে বেশ কাজে দিয়েছে। নাইজেরিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও আফ্রিকার আধুনিক সাহিত্যের জনক চিনুয়া আচেবের নাম প্রথম ম্যাডামের মুখে শুনেছিলাম। তিনি আচেবের বিখ্যাত বই’'থিংস ফল অ্যাপার্ট’ পড়াতেন। উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি বই এই ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’। ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য’ শিরোনামে তিনি একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন। সেখানে বেশ ভালো নম্বর পেয়েছিলাম।
শ্রদ্ধেয় দানীউল স্যার। একজন ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত, সুপরিচিত। ভাষাবিজ্ঞানের গাম্ভীর্য নিয়ে সত্য এবং শুভ্রতাকে ধারণ করে পথ চলতেন। ধীরস্থির, পরিমিত এবং গোঁফের ফাঁক দিয়ে ঊষালগ্ন আলোর মতো হাসি ছড়িয়ে দিতেন। আমরাও ভয়ে ভয়ে হাসতাম। কিন্তু আমাদের হাসি ততোটা উন্মোচিত হওয়ার ফুরসত পাওয়ার আগেই স্যারের হাসি মিলিয়ে যেতো। এই সুযোগে ব্যক্তিগত ঋণের কথা স্বীকার করে নিচ্ছি। যা স্যারের দেওয়া প্রতিজ্ঞা মেনে কোনো দিন কাউকে বলিনি। স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা একবার কুষ্টিয়া অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম ঐ অঞ্চলের ভাষা জরিপের লক্ষ্যে। সে সময় কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আমাদের সহযোগিতা করেছিলো। শিক্ষা সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে আমি আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলাম। ক্লাসের সবাই সফরে যাবে কেবল আমি ছাড়া। স্যার এটা জানতে পেরে আমাকে গোপনে তার কক্ষে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘এই নাও সুমন, টাকাটা তোমাকে ধার হিসেবে দিলাম। যখন তোমার হাতে টাকা হবে আমাকে ফেরত দিও’। নাহ, আমি দিতে চাইলেও স্যার সেই টাকা আর ফেরত নেননি। এই ঘটনার সাক্ষী আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন বন্ধু মোস্তাফিজ জুয়েল।
অধ্যাপক ড. রাবেয়া মঈন। যার সাক্ষাতে যে কারো মন ঝলমলে হয়ে উঠত। এমন সরল প্রাণ, জটিলতামুক্ত মানুষের দেখা সচরাচর দেখা যায় না। ম্যাডামকে কখনোই বিমর্ষ দেখিনি। মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্য রসিয়ে রসিয়ে পড়াতে তার জুড়ি মেলা ভার। বিশেষ করে কাব্যালংকারের প্রয়োগ ও প্রাসঙ্গিকতা পাঠদানকালে আমরা যেন মোমের মতো গলে যেতাম। এমনকি রবীন্দ্রকাব্যের ভেতর রবীন্দ্র দর্শনের যে বাঁক বদল, রাবেয়া ম্যাডাম অত্যন্ত সুললিত ভাষায় আমাদের কাছে তা উপস্থাপন করতেন। তিনি কবি সৈয়দ আলী আহসানের ভক্ত ছিলেন। ক্লাসে পাঠদানের ফাঁকে প্রসঙ্গক্রমে সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতাটির কিছু অংশ পড়ে শোনাতেন। যেমন-
‘আমার পূর্ব-বাংলা
এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ’।
আমি এখন কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ লিখি। এই প্রবন্ধ লেখার পেছনে ম্যাডামের উৎসাহ কখনো ভোলার নয়। আমার থিসিস পেপার পড়ে ম্যাডাম ডেকে বললেন, ‘সুমন, তুমি ভালো কবিতা লেখো সেটা জানি। কিন্তু প্রবন্ধ কেন লিখছ না? তোমার লেখা গদ্য প্রাঞ্জল। কবির হাতের গদ্যের মতো’। ম্যাডামের সেদিনের মন্তব্য আমার মনে গেঁথে যায়। মূলত অদ্যাবধি যত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছি। এসবের নেপথ্যে রাবেয়া ম্যাডামের সেই মন্তব্যটি ছিলো।
শ্রদ্ধেয় নাসিম স্যার (আ. খ. ম. আশরাফ উদ্দিন) আমাদের ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ (comparative literature) পড়াতেন। তিনি নিয়মিত কালো টি-শার্ট গায়ে, চা ভর্তি কাঁচের গ্লাস হাতে নিয়ে ক্লাস নিতেন। এটা স্যারের এক ধরনের স্টাইল। কোনোদিন এর ব্যত্যয় চোখে পড়েনি। টানা দেড়-দু’ঘণ্টা তুলনামূলক সাহিত্য পড়ানোর ক্ষমতা কেবল স্যারেরই ছিলো। স্যারের লেকচার ছিলো যুগপৎ ক্লান্তিকর ও ক্লান্তিহীন বিশ্বসাহিত্য ভ্রমণ। প্রতিদিন প্রাচীন সাহিত্য দিয়ে পাঠদান শুরু করতেন। অতঃপর মধ্যযুগ পাড়ি দিয়ে আধুনিক সাহিত্যে প্রবেশ করতেন। এভাবে আধুনিক হয়ে উত্তরাধুনিক সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনার ভেতর দিয়ে স্যারের লেকচার শেষ হতো। আলোচনার পরতে পরতে নতুন ডায়মেনশন তৈরি হতো। হোমারের ‘ইলিয়ড’ ও ‘অডিসি’, জ্যাঁ পল সাঁত্রের ‘অস্তিত্ববাদী দর্শন’, ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো ‘মধ্যবিত্তের মন’ স্যারের আলোচনায় অনিবার্য ছিলো। জেমস জয়েস থেকে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ্ পর্যন্ত তার পাঠদানের বিস্তার কখনো ভোলার নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষের দিকে বেশ ক’জন নতুন শিক্ষক বিভাগে যোগদান করলেন। তারা হলেন নাহিদ হক ম্যাডাম, সোহানা ম্যাডাম, শামীমা সুলতানা লাকী ম্যাডাম, ফারহানা ম্যাডাম, সুমন সাজ্জাদ স্যার এবং হিমেল বরকত স্যার। তাদের নিয়েও অনেক স্মৃতি আছে। আগামীতে নিশ্চয় তাদের নিয়েও লিখবো। এই লেখা মূলত স্মৃতিপথ ধরে গুরুজনের আশ্রমে বেড়িয়ে আসার বাসনামাত্র। গুরু তোমার চরণধূলি দিও আমার গায়।
ফারুক সুমন: কবি ও প্রাবন্ধিক।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
ফারুক সুমন | ৫ অক্টোবর, ২০২০ ২০:৫৮

‘পৃথিবীতে কোনো মানুষই মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। ক্রমশ তাকে মানুষ হয়ে উঠতে হয়’। এরিস্টটলের এরকম একটি কথা পড়েছিলাম অনেক আগে। অর্থাৎ মানুষ অন্য সব প্রাণির মতোই প্রাণ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কেবল অবয়বে মানুষের মতো দেখালেই তিনি মানুষ হয়ে যান না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে মানবীয় গুণাবলি অর্জন করে তবেই মানুষ হয়ে উঠতে হয়। দেখতে মানুষের মতো কেউ যখন অমানুষের মতো আচরণ করে, তখন তাকে মানুষ না বলে আমরা ‘পশু’ বলে সম্বোধন করি। তার আচরণকে ‘পাশবিক আচরণ’ বলে অভিহিত করি।
মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার এই যে যাত্রা, এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ভূমিকা রাখেন বাবা ও মা। তাদের পরেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন শিক্ষক কিংবা গুরুজন। কখনো কখনো আচরণগত শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের চেয়ে শিক্ষকদের বেশি অনুকরণ করে শিক্ষার্থীরা। ফলে একজন আদর্শ শিক্ষক সারাজীবনের জন্য শিক্ষার্থীর মানসগঠনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারী হয়ে থাকেন। এই বিবেচনায় শিক্ষককে বলা হয় ‘দ্বিতীয় জন্মদাতা’। একজন মহৎ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেন। কেবল দেখতে মানুষের মতো হলেই মানুষ হওয়া যায় না। অন্তর থেকে পশুসুলভ যাবতীয় আচরণ মুছে দিয়ে সেখানে স্থাপন করতে হয় মনুষ্যত্বের সুউচ্চ ইমারত। তবেই কেবল মানুষ হওয়া সম্ভব।
আমাদের জীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা প্রতিষ্ঠানের বাইরে এমন শিক্ষক নিশ্চয় আছেন। যিনি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ব্যক্তিত্ব ও আদর্শের দ্যুতি ছড়িয়ে জীবনের সঠিক পথে আমাদের ধাবিত করেন। অনুকরণ ও অনুসরণের আসন নিয়ে তিনি অনুক্ষণ অনুভবে থাকেন। জীবনের নানাপর্বে এমন অসংখ্য শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি আমি।
আজ ‘শিক্ষক দিবস’। মূলত এই বিশেষ দিনে তাদের স্মৃতি স্মরণে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের কয়েকজন শিক্ষকের সান্নিধ্য নিয়ে লেখার প্রয়াস পাব। নিশ্চয় অন্য কোনো সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের নিয়েও লিখব।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। মনে পড়ে, মানবিক বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম। গ্রাম থেকে হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তারিত বিদ্যায়তনে প্রবেশ আমার জন্য এক মহাবিস্ময়। প্রথমেই মনমাতানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। পুরাতন কলাভবনের নিচতলায় ছিলো বাংলা বিভাগ। যদ্দুর মনে পড়ে, ককশিটে কালো অথবা হলুদ হরফে বড় করে লেখা ছিলো ‘বাংলা বিভাগ’। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ঘেঁষে ছিলো একটি ফটোকপির দোকান। এই ভবনে বাংলা বিভাগ ছাড়াও প্রত্নতত্ত্ব, নাট্যতত্ত্ব ও ইতিহাস বিভাগ ছিল। নিচতলায় বাংলা বিভাগের সামনেই, করিডোরের কোলঘেঁষে ছিল সবুজ ঘাসের বিস্তার এবং বাহারি ফুলের সমাহার। বলতে দ্বিধা নেই, এই সবুজ ঘাসের গালিচা আর বাহারি ফুলের আবহ আমাকে আপ্লুত করেছিল। বিভাগ সম্মুখে এই একখণ্ড মনোরম সবুজ সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ আমাকে প্রেমাগ্রহী করে তুলেছিলো। পুরাতন কলাভবনের ঈষৎ শেওলা পড়া দেয়াল কিছুতেই ভুলতে পারি না। এখনো ক্যাম্পাসে গেলে পুরাতন কলাভবনের দেয়াল ছুঁয়ে প্রণাম করি। কারণ এখানে আমার গুরুজনদের পদচারণা ছিলো। তাদের পদধুলি এবং নিশ্বাসের প্রবাহ ছিলো। এখনো চোখে ভাসে শ্রদ্ধেয় স্যার-ম্যাডামদের সেই কক্ষগুলো।
ভর্তি হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মোজাম্মেল স্যারকে হারিয়েছি। যিনি আমাদের ‘পুঁথিপাঠ ও পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা’ বিষয়ক কোর্সের পাঠদান করতেন। (পরে অধ্যাপক শামীমা সুলতানা লাকী ম্যাডাম পড়িয়েছিলেন।) এ ছাড়া স্যারের মুখেই প্রথম রুবাই, হাইকু, লিমেরিক এই শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এগুলো এক ধরনের কবিতা। মোজাম্মেল স্যারের মুখেই প্রথম এমন অভিনব আঙ্গিকের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম।
তখন বেশ বোকাসোকা ছিলাম। কেবল তাকিয়ে থাকতাম ফুলের দিকে। ফুলের ফাঁকে দেখে নিতাম অন্য কোনো ফুল। নিঃশ্বাসে টেনে নিতাম অন্য কোনো সুরভী। বলছিলাম আমার বোকামির কথা।
নবীন বরণের দিন খেয়েছি ধরা। সবার নজর কাড়তে গিয়ে নিজেকে উজাড় করে গেয়েছি শিল্পী রবি চৌধুরীর গাওয়া বিখ্যাত বাজারি একটা গান।
‘তুমি দুঃখ পাও, তুমি কষ্ট পাও, এই আমি চাই।
তুমি বোঝনি, এই আমাকে, ছিলে ছলনায়’।
তো গানটি শোনানোর পর ভেবেছিলাম সবার মন জয় করে ফেলেছি। কিন্তু বিধিবাম। উল্টো হা হা হি হি হাসির রোল পড়ে গেলো সারা হল ঘরজুড়ে। আমার মন খারাপ হলো।
প্রথম দিকে অতি বিনয় এবং লাজুকতার ভারে আমি কিছুটা কুঁজো হয়ে হাঁটতাম। আমার শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৌদা আক্তার ম্যাডাম আমাকে দেখলেই আঙুলে ইশারা করে বলতেন, ‘না না সুমন, এভাবে নয় পিঠ টান করে হাঁটো। মেরুদণ্ড সোজা হবে’। তারপর থেকে এই বাক্যটি আমি ভুলিনি। ম্যাডাম ‘উত্তরাধুনিক সাহিত্য’ কিংবা ‘উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য’ নিয়ে যা যা পড়িয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত লেখালেখির প্রয়োজনে বেশ কাজে দিয়েছে। নাইজেরিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও আফ্রিকার আধুনিক সাহিত্যের জনক চিনুয়া আচেবের নাম প্রথম ম্যাডামের মুখে শুনেছিলাম। তিনি আচেবের বিখ্যাত বই’'থিংস ফল অ্যাপার্ট’ পড়াতেন। উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি বই এই ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’। ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য’ শিরোনামে তিনি একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন। সেখানে বেশ ভালো নম্বর পেয়েছিলাম।
শ্রদ্ধেয় দানীউল স্যার। একজন ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত, সুপরিচিত। ভাষাবিজ্ঞানের গাম্ভীর্য নিয়ে সত্য এবং শুভ্রতাকে ধারণ করে পথ চলতেন। ধীরস্থির, পরিমিত এবং গোঁফের ফাঁক দিয়ে ঊষালগ্ন আলোর মতো হাসি ছড়িয়ে দিতেন। আমরাও ভয়ে ভয়ে হাসতাম। কিন্তু আমাদের হাসি ততোটা উন্মোচিত হওয়ার ফুরসত পাওয়ার আগেই স্যারের হাসি মিলিয়ে যেতো। এই সুযোগে ব্যক্তিগত ঋণের কথা স্বীকার করে নিচ্ছি। যা স্যারের দেওয়া প্রতিজ্ঞা মেনে কোনো দিন কাউকে বলিনি। স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা একবার কুষ্টিয়া অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম ঐ অঞ্চলের ভাষা জরিপের লক্ষ্যে। সে সময় কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আমাদের সহযোগিতা করেছিলো। শিক্ষা সফরে যাওয়ার প্রাক্কালে আমি আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলাম। ক্লাসের সবাই সফরে যাবে কেবল আমি ছাড়া। স্যার এটা জানতে পেরে আমাকে গোপনে তার কক্ষে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘এই নাও সুমন, টাকাটা তোমাকে ধার হিসেবে দিলাম। যখন তোমার হাতে টাকা হবে আমাকে ফেরত দিও’। নাহ, আমি দিতে চাইলেও স্যার সেই টাকা আর ফেরত নেননি। এই ঘটনার সাক্ষী আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন বন্ধু মোস্তাফিজ জুয়েল।
অধ্যাপক ড. রাবেয়া মঈন। যার সাক্ষাতে যে কারো মন ঝলমলে হয়ে উঠত। এমন সরল প্রাণ, জটিলতামুক্ত মানুষের দেখা সচরাচর দেখা যায় না। ম্যাডামকে কখনোই বিমর্ষ দেখিনি। মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্য রসিয়ে রসিয়ে পড়াতে তার জুড়ি মেলা ভার। বিশেষ করে কাব্যালংকারের প্রয়োগ ও প্রাসঙ্গিকতা পাঠদানকালে আমরা যেন মোমের মতো গলে যেতাম। এমনকি রবীন্দ্রকাব্যের ভেতর রবীন্দ্র দর্শনের যে বাঁক বদল, রাবেয়া ম্যাডাম অত্যন্ত সুললিত ভাষায় আমাদের কাছে তা উপস্থাপন করতেন। তিনি কবি সৈয়দ আলী আহসানের ভক্ত ছিলেন। ক্লাসে পাঠদানের ফাঁকে প্রসঙ্গক্রমে সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতাটির কিছু অংশ পড়ে শোনাতেন। যেমন-
‘আমার পূর্ব-বাংলা
এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ’।
আমি এখন কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ লিখি। এই প্রবন্ধ লেখার পেছনে ম্যাডামের উৎসাহ কখনো ভোলার নয়। আমার থিসিস পেপার পড়ে ম্যাডাম ডেকে বললেন, ‘সুমন, তুমি ভালো কবিতা লেখো সেটা জানি। কিন্তু প্রবন্ধ কেন লিখছ না? তোমার লেখা গদ্য প্রাঞ্জল। কবির হাতের গদ্যের মতো’। ম্যাডামের সেদিনের মন্তব্য আমার মনে গেঁথে যায়। মূলত অদ্যাবধি যত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছি। এসবের নেপথ্যে রাবেয়া ম্যাডামের সেই মন্তব্যটি ছিলো।
শ্রদ্ধেয় নাসিম স্যার (আ. খ. ম. আশরাফ উদ্দিন) আমাদের ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ (comparative literature) পড়াতেন। তিনি নিয়মিত কালো টি-শার্ট গায়ে, চা ভর্তি কাঁচের গ্লাস হাতে নিয়ে ক্লাস নিতেন। এটা স্যারের এক ধরনের স্টাইল। কোনোদিন এর ব্যত্যয় চোখে পড়েনি। টানা দেড়-দু’ঘণ্টা তুলনামূলক সাহিত্য পড়ানোর ক্ষমতা কেবল স্যারেরই ছিলো। স্যারের লেকচার ছিলো যুগপৎ ক্লান্তিকর ও ক্লান্তিহীন বিশ্বসাহিত্য ভ্রমণ। প্রতিদিন প্রাচীন সাহিত্য দিয়ে পাঠদান শুরু করতেন। অতঃপর মধ্যযুগ পাড়ি দিয়ে আধুনিক সাহিত্যে প্রবেশ করতেন। এভাবে আধুনিক হয়ে উত্তরাধুনিক সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনার ভেতর দিয়ে স্যারের লেকচার শেষ হতো। আলোচনার পরতে পরতে নতুন ডায়মেনশন তৈরি হতো। হোমারের ‘ইলিয়ড’ ও ‘অডিসি’, জ্যাঁ পল সাঁত্রের ‘অস্তিত্ববাদী দর্শন’, ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো ‘মধ্যবিত্তের মন’ স্যারের আলোচনায় অনিবার্য ছিলো। জেমস জয়েস থেকে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ্ পর্যন্ত তার পাঠদানের বিস্তার কখনো ভোলার নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষের দিকে বেশ ক’জন নতুন শিক্ষক বিভাগে যোগদান করলেন। তারা হলেন নাহিদ হক ম্যাডাম, সোহানা ম্যাডাম, শামীমা সুলতানা লাকী ম্যাডাম, ফারহানা ম্যাডাম, সুমন সাজ্জাদ স্যার এবং হিমেল বরকত স্যার। তাদের নিয়েও অনেক স্মৃতি আছে। আগামীতে নিশ্চয় তাদের নিয়েও লিখবো। এই লেখা মূলত স্মৃতিপথ ধরে গুরুজনের আশ্রমে বেড়িয়ে আসার বাসনামাত্র। গুরু তোমার চরণধূলি দিও আমার গায়।
ফারুক সুমন: কবি ও প্রাবন্ধিক।