নীপিড়নের হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করতে হলে
নেছা জিনাত | ১২ নভেম্বর, ২০২০ ২৩:০৮
দুই দিন আগের ঘটনা। আমতলী উপজেলায় কাউনিয়াতে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিশুকে দুই বন্ধু মিলে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করে। তারা এ ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে এবং পরবর্তীতে তাদের প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ভিডিও সোস্যাল মিডিয়াতে দেওয়ার হুমকি ও দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে অভিভাবকরা কোনো আইনী পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। অভিযোগ রয়েছে এ ঘটনা ঘটাতে সাহায্য করেছেন একজন নারী (সূত্র: বরিশাল বাণী পত্রিকা)।
ঘটনা শোনার পর থেকে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।একজন সন্তানের অভিভাবক হিসেবে আরো বেশি অস্থির হয়ে যাচ্ছি ভেতরে ভেতরে। কারণ আমারো একজন ছেলে শিশু আছে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রতি ছয় ছেলে শিশুর মধ্যে একজন এবং চার মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, যৌন নিপীড়নের শিকার শতকরা পাঁচ ভাগ ছেলে শিশু। মেয়ে শিশু শতকরা ৯৫ ভাগ।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) এক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সে বছর ৪২ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
২০১৭ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে ৪৪ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে ২২ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৯৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৮ শিশু। ৫০ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ছয় শিশু। ধর্ষণের শিকার হয় ৩৮ শিশু। নানা ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয় ৭৪ শিশু। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করতে গিয়ে যৌন হয়রানিকারীদের মারধরের শিকার হয় ১৮ শিশু।
২০১৪ সালে ১৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয় ২০১৫ সালে ৫২১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, ২০১৬ সালে ৪৪৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, ২০১৭ সালে ৫৯৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, কিন্তু সেই অর্থে কোনো মামলা করা হয়নি।
২০১৮ সালে ৭২৭ শিশু ধর্ষণের মামলা হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৮৪ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া এক বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ। গত বছর যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১৩৮৩ শিশু, তার ভেতর ৯০২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।। ২০১৮ সাল থেকে ২০১৯ সালে এসে শিশু ধর্ষণ ৭৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেড়েছে।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের এক গবেষণা তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে ৮০ ভাগ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু ফোরাম বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১২ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।শিশুদের যৌন হয়রানির মধ্যে যে কেবল ধর্ষণ বিদ্যমান তা নয়। এ ছাড়া তাদের ওপর নানা ধরনের শারীরিক আক্রমণ, বলাৎকার, স্পর্শকাতর ও যৌনাঙ্গে অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ অন্যতম। আর এসব যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে পারিবারিক আবহের মধ্যেই।
এই ক্ষেত্রে অভিভাবকদের করনীয়সমূহ-
বিশেষজ্ঞদের মতে একটি শিশুকে তার শরীরের তিনটি জায়গা সম্পর্কে জানাতে হবে। তার ঠোঁট, গোপনাঙ্গ ও পায়ুপথ। তাকে জানাতে হবে এই তিনটা তার বিশেষ জায়গা। এখানে বাবা-মা গোসল করানো বা পরিষ্কার করার সময় ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ সেটি করলে সে কী করবে সেটিও তাকে জানাতে হবে। সেটা বাবা মাকে যে জানাবে সেটি শেখাতে হবে।
শিশুদের বুঝিয়ে বলতে হবে, শরীরের কোন অংশগুলো একান্ত ব্যাক্তিগত এবং স্পর্শকাতর। সঙ্গে তাদের ভালো স্পর্শ ও মন্দ স্পর্শ সম্পর্কে বুঝাতে হবে। তাদের নিজেদের যৌনাঙ্গকে চিনতে সাহায্য করতে হবে। শিশুদের বুঝাতে হবে তাদের শরীর কেবলই তাদের এবং শরীর স্পর্শ করার অধিকার অন্য কারোর নাই এবং শিশুদের সবসময় সতর্ক করতে হবে যেন কেউ তাদের একান্ত ব্যাক্তিগত অঙ্গে স্পর্শ না করে।
বাবা-মাকে শিশুর সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে বলতে হবে এবং শিশুকে ও উৎসাহিত করতে হবে মন খুলে কথা বলার। তাদের খোলামেলা প্রশ্ন করতে হবে যেন শিশুরাও বাবামাকে নিঃসংকোচে সব জানাতে পারে। বাবামাকে শিশুর সব প্রশ্নের উত্তর সততার সঙ্গে দিতে হবে। তাহলেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
শিশুকে একা বাড়িতে রেখে কোথাও যাওয়া যাবে না। এতে ঝুঁকি বাড়ে।
অপরিচিত কাউকে বাড়িতে প্রবেশের আগে ভালো করে পরিচয় জেনে নিতে হবে। নতুবা শিশুর ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়ে।
শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। শিশুকে বলতে হবে আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করি, তোমাকে বিশ্বাস করি। শিশুর সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
শিশুকে বলতে হবে তার সঙ্গে কোনো যৌন হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটলে যেন বাবা-মাকে জানায়। এর জন্য শিশু কোনোভাবে দায়ী নয় তা বুঝাতে হবে। এর জন্য নিপীড়নকারী দায়ী এবং এ ধরনের ঘটনা মেনে নেয়া ঠিক নয় তাও শিশুকে বলুন।
কোনোভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সুরক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা, কাউন্সেলিং কিংবা আইনী সেবা ও নেয়া লাগতে হতে পারে তাও শিশুকে বুঝিয়ে বলুন।
শিশু ইন্টারনেটে কী ব্যবহার করছে, কী দেখছে এ বিষয়ে খেয়াল রাখুন। কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন করলে খোলামেলা বুঝিয়ে বলুন।
ইন্টারনেটে অপরিচিত কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করা ঠিক নয় এটা শিশুকে বুঝিয়ে বলুন। কোনো ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া উচিত নয় তাও জানিয়ে রাখুন।
শিশুদের সঙ্গে বাবা-মা হিসেবে খেলা করুন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে আলাদা করে সময় দিন।তাদের ছবি এঁকে স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো সম্পর্কে বুঝান।তাদের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল হন। তাদের সঙ্গে রাগ কখনোই করা যাবে না। এতে তাদের মানসিক চাপ বাড়বে।
শিশুদের বুঝিয়ে বলতে হবে কোন আত্মীয় বন্ধু- বান্ধব, পরিচিত যে কেউ হোক না কেন এমন আচরণ করলো যা শিশুর খারাপ লেগেছে তা যেন তার বাবা-মার সঙ্গে শেয়ার করে। চিৎকার না করে যেন দৌড়ে পালিয়ে আসে। বাবা-মাকে জানায়।
শিশুরা যদি স্কুলে যেতে না চায় তাহলে জোর করে পাঠানো যাবে না। বরং কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। তার থেকে জানতে চেষ্টা করতে হবে কেন যেতে চাইছে না? স্কুলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
খুব গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে যে, সন্তানের ভেতর লিঙ্গ বৈষম্য করা যাবে না এবং শিশুদের পারস্পরিক সম্মানবোধ ও পরমতসহিষ্ণুতার সঙ্গে লালন-পালন করতে হবে।
ছেলে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে এই চিন্তা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পিতামাতারা ভাবতেই পারে না। আর যদি হয়ে ও থাকে তাহলে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয় না বললেই চলে। ছেলেশিশু মানেই তারা নিরাপদ এবং নারী তত্ত্বাবধায়ককে তুলনামূলক নিরাপদ ভেবে নেওয়া হয়। তবে পর্যবেক্ষণ বলছে, মেয়ে ও ছেলে—উভয় শিশুর যৌন নিপীড়নের জন্য কাছের আত্মীয়-স্বজনদের পাশাপাশি তাদের নারী তত্ত্বাবধায়করাও দায়ী। শিশুকে নিরাপদ রাখতে অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করেন। ঘরে বন্দী করে রাখেন।এটা করা উচিত নয়। এতে শিশুর সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বরং যৌন নিপীড়নের শিকার শিশু অনেক সময় অস্বাভাবিক আচরণ করে, কিংবা নানা সংকেত দেওয়ার চেষ্টা করে—সেগুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে অভিভাবকদের। একইসঙ্গে বয়স অনুযায়ী শিশুকে বিজ্ঞানভিত্তিক যৌনশিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করাও জরুরী বলে মতামত দিয়েছেন অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ।
নেছা জিনাত: নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
নেছা জিনাত | ১২ নভেম্বর, ২০২০ ২৩:০৮

দুই দিন আগের ঘটনা। আমতলী উপজেলায় কাউনিয়াতে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিশুকে দুই বন্ধু মিলে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করে। তারা এ ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে এবং পরবর্তীতে তাদের প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ভিডিও সোস্যাল মিডিয়াতে দেওয়ার হুমকি ও দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে অভিভাবকরা কোনো আইনী পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। অভিযোগ রয়েছে এ ঘটনা ঘটাতে সাহায্য করেছেন একজন নারী (সূত্র: বরিশাল বাণী পত্রিকা)।
ঘটনা শোনার পর থেকে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।একজন সন্তানের অভিভাবক হিসেবে আরো বেশি অস্থির হয়ে যাচ্ছি ভেতরে ভেতরে। কারণ আমারো একজন ছেলে শিশু আছে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রতি ছয় ছেলে শিশুর মধ্যে একজন এবং চার মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, যৌন নিপীড়নের শিকার শতকরা পাঁচ ভাগ ছেলে শিশু। মেয়ে শিশু শতকরা ৯৫ ভাগ।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) এক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সে বছর ৪২ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
২০১৭ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে ৪৪ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে ২২ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৯৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৮ শিশু। ৫০ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ছয় শিশু। ধর্ষণের শিকার হয় ৩৮ শিশু। নানা ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয় ৭৪ শিশু। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করতে গিয়ে যৌন হয়রানিকারীদের মারধরের শিকার হয় ১৮ শিশু।
২০১৪ সালে ১৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয় ২০১৫ সালে ৫২১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, ২০১৬ সালে ৪৪৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, ২০১৭ সালে ৫৯৩ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, কিন্তু সেই অর্থে কোনো মামলা করা হয়নি।
২০১৮ সালে ৭২৭ শিশু ধর্ষণের মামলা হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৮৪ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া এক বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ। গত বছর যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১৩৮৩ শিশু, তার ভেতর ৯০২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।। ২০১৮ সাল থেকে ২০১৯ সালে এসে শিশু ধর্ষণ ৭৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বেড়েছে।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৩৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের এক গবেষণা তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে ৮০ ভাগ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিশু ফোরাম বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১২ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।শিশুদের যৌন হয়রানির মধ্যে যে কেবল ধর্ষণ বিদ্যমান তা নয়। এ ছাড়া তাদের ওপর নানা ধরনের শারীরিক আক্রমণ, বলাৎকার, স্পর্শকাতর ও যৌনাঙ্গে অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ অন্যতম। আর এসব যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে পারিবারিক আবহের মধ্যেই।
এই ক্ষেত্রে অভিভাবকদের করনীয়সমূহ-
বিশেষজ্ঞদের মতে একটি শিশুকে তার শরীরের তিনটি জায়গা সম্পর্কে জানাতে হবে। তার ঠোঁট, গোপনাঙ্গ ও পায়ুপথ। তাকে জানাতে হবে এই তিনটা তার বিশেষ জায়গা। এখানে বাবা-মা গোসল করানো বা পরিষ্কার করার সময় ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ সেটি করলে সে কী করবে সেটিও তাকে জানাতে হবে। সেটা বাবা মাকে যে জানাবে সেটি শেখাতে হবে।
শিশুদের বুঝিয়ে বলতে হবে, শরীরের কোন অংশগুলো একান্ত ব্যাক্তিগত এবং স্পর্শকাতর। সঙ্গে তাদের ভালো স্পর্শ ও মন্দ স্পর্শ সম্পর্কে বুঝাতে হবে। তাদের নিজেদের যৌনাঙ্গকে চিনতে সাহায্য করতে হবে। শিশুদের বুঝাতে হবে তাদের শরীর কেবলই তাদের এবং শরীর স্পর্শ করার অধিকার অন্য কারোর নাই এবং শিশুদের সবসময় সতর্ক করতে হবে যেন কেউ তাদের একান্ত ব্যাক্তিগত অঙ্গে স্পর্শ না করে।
বাবা-মাকে শিশুর সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে বলতে হবে এবং শিশুকে ও উৎসাহিত করতে হবে মন খুলে কথা বলার। তাদের খোলামেলা প্রশ্ন করতে হবে যেন শিশুরাও বাবামাকে নিঃসংকোচে সব জানাতে পারে। বাবামাকে শিশুর সব প্রশ্নের উত্তর সততার সঙ্গে দিতে হবে। তাহলেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
শিশুকে একা বাড়িতে রেখে কোথাও যাওয়া যাবে না। এতে ঝুঁকি বাড়ে।
অপরিচিত কাউকে বাড়িতে প্রবেশের আগে ভালো করে পরিচয় জেনে নিতে হবে। নতুবা শিশুর ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়ে। শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। শিশুকে বলতে হবে আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করি, তোমাকে বিশ্বাস করি। শিশুর সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
শিশুকে বলতে হবে তার সঙ্গে কোনো যৌন হয়রানিমূলক ঘটনা ঘটলে যেন বাবা-মাকে জানায়। এর জন্য শিশু কোনোভাবে দায়ী নয় তা বুঝাতে হবে। এর জন্য নিপীড়নকারী দায়ী এবং এ ধরনের ঘটনা মেনে নেয়া ঠিক নয় তাও শিশুকে বলুন।
কোনোভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সুরক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা, কাউন্সেলিং কিংবা আইনী সেবা ও নেয়া লাগতে হতে পারে তাও শিশুকে বুঝিয়ে বলুন।
শিশু ইন্টারনেটে কী ব্যবহার করছে, কী দেখছে এ বিষয়ে খেয়াল রাখুন। কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন করলে খোলামেলা বুঝিয়ে বলুন।
ইন্টারনেটে অপরিচিত কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করা ঠিক নয় এটা শিশুকে বুঝিয়ে বলুন। কোনো ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া উচিত নয় তাও জানিয়ে রাখুন।
শিশুদের সঙ্গে বাবা-মা হিসেবে খেলা করুন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে আলাদা করে সময় দিন।তাদের ছবি এঁকে স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো সম্পর্কে বুঝান।তাদের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল হন। তাদের সঙ্গে রাগ কখনোই করা যাবে না। এতে তাদের মানসিক চাপ বাড়বে।
শিশুদের বুঝিয়ে বলতে হবে কোন আত্মীয় বন্ধু- বান্ধব, পরিচিত যে কেউ হোক না কেন এমন আচরণ করলো যা শিশুর খারাপ লেগেছে তা যেন তার বাবা-মার সঙ্গে শেয়ার করে। চিৎকার না করে যেন দৌড়ে পালিয়ে আসে। বাবা-মাকে জানায়।
শিশুরা যদি স্কুলে যেতে না চায় তাহলে জোর করে পাঠানো যাবে না। বরং কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। তার থেকে জানতে চেষ্টা করতে হবে কেন যেতে চাইছে না? স্কুলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
খুব গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে যে, সন্তানের ভেতর লিঙ্গ বৈষম্য করা যাবে না এবং শিশুদের পারস্পরিক সম্মানবোধ ও পরমতসহিষ্ণুতার সঙ্গে লালন-পালন করতে হবে।
ছেলে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে এই চিন্তা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পিতামাতারা ভাবতেই পারে না। আর যদি হয়ে ও থাকে তাহলে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয় না বললেই চলে। ছেলেশিশু মানেই তারা নিরাপদ এবং নারী তত্ত্বাবধায়ককে তুলনামূলক নিরাপদ ভেবে নেওয়া হয়। তবে পর্যবেক্ষণ বলছে, মেয়ে ও ছেলে—উভয় শিশুর যৌন নিপীড়নের জন্য কাছের আত্মীয়-স্বজনদের পাশাপাশি তাদের নারী তত্ত্বাবধায়করাও দায়ী। শিশুকে নিরাপদ রাখতে অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করেন। ঘরে বন্দী করে রাখেন।এটা করা উচিত নয়। এতে শিশুর সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বরং যৌন নিপীড়নের শিকার শিশু অনেক সময় অস্বাভাবিক আচরণ করে, কিংবা নানা সংকেত দেওয়ার চেষ্টা করে—সেগুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে অভিভাবকদের। একইসঙ্গে বয়স অনুযায়ী শিশুকে বিজ্ঞানভিত্তিক যৌনশিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করাও জরুরী বলে মতামত দিয়েছেন অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ।
নেছা জিনাত: নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক।