সাম্য ও ইনসাফের লড়াইয়ে বিপ্লবী ম্যারাডোনার রাজনৈতিক গুরুত্ব
মঈনুল ইসলাম | ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ১৮:২৪
দেশে ডিয়েগো ম্যারাডোনার ভক্তের দেখি অভাব নাই। খেলার ক্ষেত্রে ভক্ত হওয়ার জন্য সরাসরি খেলা দেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বাংলাদেশের এ প্রজন্মের অনেকেই সরাসরি তার খেলা দেখেনি। যা দেখেছে তা হাইলাইটস আর প্রচুর লেখালেখি। এখান থেকেই ম্যারাডোনাকে চিনেছে বেশির ভাগ। ফলে তার পলিটিক্যাল সিগনিফিকেন্স কিন্তু আলোচ্য হচ্ছে না।
বেশির ভাগের ম্যারাডোনার স্মৃতিচারণ প্রিয় দল আর্জেন্টিনার লিজেন্ড, তাই আমার লিজেন্ড। আরেক গ্রুপ আছে, ব্রাজিল করলেও আমি তার ভক্ত! আমি এই আবেগকে উড়িয়ে দিই না। কিন্তু যে লোকের পরিষ্কার রাজনৈতিক অবস্থান আছে তার সিগনিফিকেন্স কেবল অরাজনৈতিক খেলা দিয়ে করা, তাকে মূল্যায়নের সঠিক আচরণ নয়। তবুও লোকে করছে। এই যে একটি লোকের আদর্শ ফেলে তার থাকা-খাওয়া নিয়ে মেতে থাকা, এটাই চায় পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ। আর এ ফাঁদেই মিডিয়া, সাংবাদিক আর কথিত ফুটবলপ্রেমীরা পড়ে, এমন কী বামপন্থী নামে পরিচিত 'ক্যাপিটালিস্ট কমরেডরা'ও সেটিই করছে। একটা মানুষ ঠিক কী জীবন যাপন করল, সারাটা জীবন কী আদর্শে বেঁচে রইল, কীসের বিরুদ্ধে লড়াই করল তা নিয়ে একেবারেই ভাবনা-আলোচনা-প্রতিক্রিয়া নাই! এই কয়দিনে তাই দেখলাম বসে বসে!
আর এ কারণেই ১৯৮৬ এর 'ঈশ্বরের হাতের গোল' এই ফুটবলপ্রেমী, ক্রীড়া সাংবাদিক, উপস্থাপক-উপস্থাপিকা আর কথিত বিশ্লেষকদের নিকট নিছক একটি খেলার ম্যাচ। কিন্তু এর আড়ালে যে ব্রিটিশদের ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়ার প্রতিবাদ রয়েছে, রয়েছে সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যয়- সে নিয়ে আলাপ নেই পশ্চিমা মিডিয়া কিংবা পশ্চিমের দেখানো পথে হাঁটা প্রাচ্য বা দেশীয় মিডিয়ায় বা বিশ্লেষণে।
যে সময়টিতে ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা বিশ্বের সুপারহিরো, সে সময় পৃথিবীর ব্লক-পলিটিকস চলমান আর প্রায় শেষের দিকে। বাংলাদেশের মানুষ এরশাদের মতো স্বৈরাচারের শাসনামলে। তখন ম্যারাডোনার মতো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিবাদী চরিত্রটির প্রতি অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্টে মোহাচ্ছন্ন অনেকের ভালো লাগা জন্ম নেয়।
তিনি বিপ্লবী, প্রতিরোধকারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী চরিত্রের বিরোধী, ব্রিটিশ দখলদার বিরোধী। তাই ভরা মজলিশে এই তো ২০০৪ সালেও তিনি ঘোষণা করে বলেছেন তার অর্থ দাঁড়ায়, "...যা কিছু স্বার্থপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে আসে তার আমি বিরোধী, কারণ এই রাষ্ট্রটি শোষক"।
তিনি কমরেড ফিদেল কাস্ত্রোকে ভালোবাসেন, কমরেড চে গেভারাকে ভালোবাসেন। তিনি শোষিত মানুষকে ভালোবাসেন। ট্যাটুর মাধ্যমে কাস্ত্রো থাকেন তার জাদুকরী পায়ে আর ফিদেল তার বাহুতে। আমাদের পুস্তকনির্ভর রাজনীতি-অসচেতন মানসিকতার অনেকে বলতে পারেন, 'ছি ছি! কমরেড কাস্ত্রোর ছবি পায়ে এঁকে পাপ করেছে ম্যারাডোনা!'
কিন্তু পপুলার কালচারের মাধ্যমে চে গেভারা ও কাস্ত্রোকে লাতিন আমেরিকা ও গোটা পৃথিবীর তারুণ্যের কাছে পৌঁছে দিতে ম্যারাডোনার এ ট্যাটুর ভূমিকা মুখস্থনির্ভর বাংলাদেশের গণবিচ্ছিন্ন বামপন্থী কমরেডদের চেয়ে অধিক।
মাঠের ম্যারাডোনা হাত দিয়ে 'প্রতারিত' (খেলায় রেফারির ভুল এখন হচ্ছে না? কই খেলোয়াড়দের প্রতারণার দায় আছে? কিন্তু সে সময়ের ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ম্যারাডোনাকে অতিরিক্ত ক্রিমিনালাইজড করে ব্রিটিশ ও মার্কিন মিডিয়া! আমরা আজো মানসিক দাসত্বের শৃঙ্খলে থেকে সেই বুলিই আওড়াই। আমরা বলতে বাংলাদেশ বা ভারতের মিডিয়া!) করে ম্যাচ জয় করলেও, মাঠের বাইরের ম্যারাডোনার আদর্শে কোনো প্রতারণা নেই। তিনি স্পষ্ট বলে দেন, পৃথিবীর শোষকদের পরাজিত করতে না পারলে মানুষের মুক্তি নেই৷ তিনি জোরালো গলায় বলেন, চে আমার অনুপ্রেরণা, ফিদেল আমার 'দ্বিতীয় পিতা' (রয়টার্স, ২০১৬)। কোন ফিদেল? পুঁজিবাদের ভিত্তিভূমি মার্কিন মুল্লুকের মধ্যে বসে যে ফিদেল কাস্ত্রো কাস্তে আর হাতুড়ির জয় ঘোষণা করেন সেই বিপ্লবী ফিদেল।
ম্যারাডোনা বুক ফুলিয়ে বলতেন, 'আমি ফুটবলের চে গুয়েভারা ( ল্যাটিন উচ্চারণ গেভারা)'। এই কথা বলার জন্য বলা নয়। তিনি এ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। তাই ভেনেজুয়েলার চে'পন্থী বিপ্লবী হুগো চাভেজকে তিনি ভালোবেসে নিজের পরিচয় দিয়েছেন 'আমি চাভেস্তা' আমিও হুগো চাভেজ। চাভেজ ও কাস্ত্রো আমার জন্য যা করে তা সর্বোত্তম (রয়টার্স,২০০৭)- এই হচ্ছে ম্যারাডোনার স্পষ্ট স্বর।
তো ম্যারাডোনার প্রিয়, ম্যারাডোনার অভিভাবক এই চাভেজটা কে? এই সেই চাভেজ (অনেকে হুগো শ্যাভেজ উচ্চারণ করেন ইংরেজি রীতি অনুযায়ী) যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে দাঁড়িয়ে বিশ্বনেতাদের মধ্যে বুক ফুলিয়ে, আঙুল উঁচু করে বলেছিলেন, '...আমি ডেস্কের এখান থেকে বারুদের গন্ধ পাচ্ছি। কারণ, আমার আগে এখানে কথা বলে গিয়েছি এক যুদ্ধবাজ শয়তান (জর্জ ডব্লিউ বুশ)...'। যে বুশের তল্পি বহন করতে সৌদি সালমান, আমিরাতের আমির প্রমুখ ওঠাবসা করে; ব্রিটিশ-ফরাসি-কামালি তুর্কি-জার্মান এঙ্গেলা মেরকেল-ইহুদি নেতানিয়াহু যার কথা মতো ইরাক ও আফগানিস্তান আগ্রাসনে জড়াল তাকে নিয়ে কথা বলার হিম্মত দেখানো চাভেজ হচ্ছেন ম্যারাডোনার প্রিয়।
এমনকি চাভেজ মরার পর সাম্যের নৌকার হাল ধরা নিকোলাস মাদুরোর পাশেও দাঁড়ান তিনি। এরা ম্যারাডোনার প্রিয় মানুষ। আর ম্যারাডোনা যাদের প্রিয় তাদের অনেকের প্রিয় আবার ম্যারাডোনার নীতি ও আদর্শবিরোধী বুশ, ট্রাম্প, মোদি, নেতানিয়াহু প্রমুখ! এই হচ্ছে আমাদের 'ম্যারাডোনাপ্রেমীদের' অবস্থান।
২০০৫ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে বুশ-বিরোধী ব্যাপক সমাবেশ হয়। তার সূত্রপাত ঘটায় কে? হ্যাঁ, এই ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা বুকে 'Stop Bush' (দ্য গার্ডিয়ান, ২০০৫) লিখে। তিনি ইরাক যুদ্ধের ব্যাপক বিরোধিতা করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে বলেছেন 'আবর্জনা' ( Human Trash) [Borger, J. & Goni, U, 2005, The Guardian]। বুশের তথা পুঁজিবাদী লোভীদের কথিত 'মুক্ত বাণিজ্য' নীতিকে তিনি মনে করতেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার দেশের জন্য হুমকি। কারণ, অসম প্রতিযোগিতায় এই সব সর্বগ্রাসী আমেরিকা, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রমুখ দেশের সঙ্গে সাম্যবাদনির্ভর বা 'লেভেল প্লেয়িং' ফিল্ড ছাড়া খেলতে নামা নির্ঘাত আত্মঘাতী গোল দেওয়ার শামিল।
বাস্তবে তাই হচ্ছে না? মুক্ত বাণিজ্যের নামে যেসব ক্ষেত্রে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম সেসব ক্ষেত্রেও কি পরনির্ভরশীল হচ্ছি না? বিশ্বায়ন নামের সুশীল সাম্রাজ্যবাদী শব্দযুগল যে বাজার দখলের জন্য চটকদার প্রতিশব্দ তা আমরা আর কবে বুঝব? এশিয়া-আফ্রিকা-মধ্যপ্রাচ্য-ল্যাটিন আমেরিকায় আধিপত্যবাদীদের পণ্য, নীতি ও দালালদের (দালাল বলছি ডেনিয়াল লার্নার যাকে পশ্চিমা স্বার্থে Change agents বলেছেন তার বাংলা করে) প্রবেশ করাতে; কিন্তু কথিত উন্নত দেশে কথিত তৃতীয় বিশ্ব থেকে মানুষ কিন্তু প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। তাহলে কীসের বিশ্বায়ন? কার জন্য মুক্ত বাণিজ্য? আমার তাঁত শিল্প, আমার কৃষি, আমার কর্মকে ধ্বংস করতে সব আয়োজন নয়? এক সময় মসলিন যারা বানিয়েছে তারা এখন অন্যের অর্ডার কাটে আর কিছু ফড়িয়া অর্থ বানায়! এ বিষয়ে শিখা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আমার লিখিত 'বিশ্বায়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও গণমাধ্যম' শীর্ষক বইটিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করার চেষ্টা করেছি। আহা, ম্যারাডোনা, প্রিয় বিপ্লবী তোমাকে অভিবাদন মুক্ত বাণিজ্যের আড়ালের রূপ তুমি ধরতে পেরেছিলে। আমাদের ইনসাফ ও সাম্যের ভাবনা করাতে চেষ্টা করেছিলে।
আমি এই সাম্যবাদী ম্যারাডোনার প্রতি অনুরক্ত। ফিফার মতো দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানের ভক্ত অনেকে। তারা জানে না, ফুটবলের মনোপলি দিয়ে পশ্চিমের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছে ফিফা। কেন মাত্র ৩২টি দল নিয়ে বিশ্বকাপ হয়, কেন এশিয়ায়, লাতিন আমেরিকায় ও আফ্রিকায় পৃথিবীর সর্বাধিক মানুষ বাস করলেও সেখান থেকে দল কম যায়, কেন ক্ষুদ্র ইউরোপ থেকে এত দল খেলে এসব প্রশ্ন তুলতেন ম্যারাডোনা ও তার মতো আরো অনেকে। বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজ-এ অতি উচ্চতার অভিযোগে ফিফা খেলা নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ম্যারাডোনা সেখানে হাজির হয়ে প্রতিবাদী ম্যাচ খেলেন সাবেকদের নিয়ে। ম্যারাডোনা ও তৎকালীন বলিভিয়ার সাম্যবাদী প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস উভয়েই দৃঢ়ভাবে বলেছেন, 'ফিফার এই নিষেধাজ্ঞা আসলে নির্লজ্জ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত'। কী সেই উদ্দেশ্য? ইভো মোরালেস ছিলেন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ও পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনকে বলিভিয়ায় আসতে দিতে নারাজ, প্রতিরোধকারী। আর এ জন্য ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার বলিভিয়া বিরোধী জোটের তথা ব্লেয়ার-বুশের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন বলে সরাসরি বলে দেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা (Schipani, A., 2008, BBC News)। পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির দায়ে নিন্দিত সেপ ব্লাটার ও ফিফার কর্মচারীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আঁতাত ও অর্থ বিনিময় (কাতারে ২০২২ বিশ্বকাপ স্ক্যান্ডাল) প্রকাশ হওয়ায় ম্যারাডোনার অবস্থানের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়। যা হোক ম্যারাডোনার সেই বলিভিয়ার প্রতিবাদী ম্যাচের টিকিট কী ছিল জানেন? এক প্যাকেট চাল অথবা পাস্তা বা ময়দা ইত্যাদি, যা বন্যাকবলিতদের দেওয়া হয়। এই হচ্ছেন ম্যারাডোনা, রাজনৈতিক ম্যারাডোনা। ফুটবলের চে গেভারা।
দরিদ্র পরিবারে বড় হওয়া ম্যারাডোনা দেখেছেন দারিদ্র্য কাকে বলে। জীবনকে কাছে থেকে দেখেছেন বলে অর্থকড়ি যা করেছেন তা মানুষের পেছনেই খরচ করেছেন। চ্যারিটি ম্যাচে ডাকলেই অসুস্থ হলেও খেলতেন। ধর্মের নামে অতিরিক্ত ব্যয় তিনি মানতেই পারতেন না। ক্যাথলিক ছিলেন। কিন্তু বিশ্বাস হারালেন কীভাবে তাও বলেছেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
তাকে ভ্যাটিকান সিটিতে আমন্ত্রণ জানান পোপ দ্বিতীয় সেইন্ট পল ও আর্জেন্টিনার সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স। তিনি দেখেন, পোপ যেখানে থেকে 'ভালো ভালো' কথা বলেন; বিশ্বের দরিদ্র বাচ্চাদের গিয়ে চুমু খান; সেই তিনি তার বাহিনী নিয়ে যেখানে বাস করেন সেখানে রয়েছে বিশাল বিলাসবহুল অট্টালিকা। সেখানের ছাদ-সিলিং স্বর্ণে মোড়ানো। এই বিলাসবহুল ভ্যাটিকান জীবনে ম্যারাডোনা ঈশ্বরকে পাননি। তিনি রাখঢাক না রেখে বলেছেন, এই স্বর্ণের সিলিং বেচে দিয়ে না খাওয়া মানুষদের খাওয়াতে! পেটে গলা পর্যন্ত ভাত নিয়ে অভুক্ত আফ্রিকান-লাতিন আমেরিকান শিশুদের কাছে খ্রিষ্টের প্রেম বিলাতে যাওয়ার মধ্যে ধর্মের কী আছে? অভুক্তকে খাওয়াও---এটাই ধর্মের আহ্বান। ম্যারাডোনার ভাষাটি এখানে না দিলে বুঝবেন না না কী শক্তিদায়ী তার প্রতিবাদের ভাষা।
“I went into the Vatican and saw that golden roof. And I said to myself how could somebody be such a son of bitch as to live with a golden roof and then go to poor countries and kiss children with a full belly? I stopped believing.” (Barreiro, R. El Pais, 2016)
ম্যারাডোনা ছিলেন কাস্ত্রো, হিউগো চাভেজ, নেলসন ম্যান্ডেলার মতোই পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের বন্ধু, তাদের ভালোবাসার মানুষ। তিনি ছিলেন আজীবন ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সমর্থক। তিনি ভীষণ আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলতেন, 'আমি মনেপ্রাণে একজন ফিলিস্তিনি। কারণ আমি সংগ্রাম করে বেড়ে উঠেছি এবং আমি জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। আমি ফিলিস্তিনিদের (লড়াই-সংগ্রামের) এক নম্বর ভক্ত।' (Ynetnews, 2012)।
২০১২ সালে দুবাইয়ে একটি ক্লাবের দায়িত্ব নেন। আল ওয়াসল নাম। সেখানে ইয়াসির আরাফাত যা মাথায় প্যাঁচাতেন সেই হেড স্কার্ফ নিয়ে 'ভিভা ফালেস্তাইন' বলতে ভুল করেননি ম্যারাডোনা। এই (https://bit.ly/33gIEq4) লিংকে গিয়ে দেখতে পারেন।
২০১৪ সালে এই কথিত সভ্য পৃথিবীতে যখন অবৈধ ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজায় বর্বরভাবে বোমা বর্ষণ করে শত শত নিরীহ ফিলিস্তিনি মানুষ হত্যা করে (আল-জাজিরার তথ্যমতে তিন হাজার, মিডল ইস্ট মনিটরের মতে ৫ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী); সেই বেলায় যখন বিশ্বের কথিত রথী-মহারথীদের মুখে কুলুপ আঁটা তখন আমাদের অসহায়ের বন্ধু ডিয়েগো ম্যারাডোনা নির্দ্বিধায় ফিলিস্তিনের ওপর এই হামলাকে লজ্জাজনক বলে এটি বন্ধ করতে বলেন। এখানে তার প্রামাণ্য দেখতে পারেন ( https://bit.ly/33koZFA )।
যে ইহুদীবাদীদের ধর্মভিত্তিক, বর্ণবাদী রাষ্ট্র গঠনের জন্য আর্জেন্টিনাকে একটি 'অপশন' ভেবেছিল ইউরোপীয়রা সেই আর্জেন্টিনা থেকে ইহুদিবাদী হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ আসে, আসে শান্তির বাণীরূপে ডিয়েগো ম্যারাডোনার বলিষ্ঠ স্বরে। ২০১৮ সালে মস্কোতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেছিলেন "In my heart, I am a Palestinian' এবং একই বছর তিনি সিরিয়ায় পশ্চিমা তথা মার্কিন নীতির সমালোচনা করে বলেন, 'আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যে সিরিয়ার অস্তিত্ব মুছে দিতে চায় এটি বুঝতে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া লাগবে না' (আল জাজিরা, ২০২০)।
এই নিবন্ধটি লেখার সময় আমি যখন ইনসাইডার এর আজমি হারুনের লেখাটি পড়ছি তখন মনে হলো ম্যারাডোনা বিষয়ে একটু ইসরায়েলের পত্র-পত্রিকা দেখে আসি। দেখলাম, যদিও নেতানিয়াহু টুইট করে তাকে বন্ধু বলেছে কিন্তু কীভাবে ও কেন এ বন্ধুত্ব তার কোনো কথা নেই। বরং বেশির ভাগ ইহুদিবাদী মিডিয়ায় তাকে 'নেশাসক্ত ও ইসরায়েল বিরোধী ফুটবল কিংবদন্তি' হিসেবে তুলে ধরেছে। টাইমস অব ইসরায়েল, জেরুজালেম পোস্ট, হারেৎজ অবশ্য ইসরাঈলী জুলুম নিপীড়নের ব্যাপারে ম্যারাডোনার অবস্থানকে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে যাতে করে ফুটবলপ্রেমী ইহুদিরা তাঁর ব্যাপারে আবেগ প্রকাশের ব্যাপারে নতুন করে ভাবে। তো আসল কথা হচ্ছে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা এক চির বিপ্লবী- জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের সাহসী কণ্ঠস্বর।
এসব কারণে আর্জেন্টিনার এই ফুটবল কিংবদন্তির পলিটিক্যাল সিগনিফিকেন্স বা রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। যখন বিশ্বব্যাপী ডানপন্থী উগ্রদের উত্থান, তখনো তিনি জিজেকের মতো সমাজতন্ত্রেই মানবমুক্তি দেখেছেন। পাশের বলসোনারোর উত্থানকে তিনি দিলমাদের জন্য অশনিসংকেত ভেবেছেন। ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তির জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটগুলোকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি, আগ্রাসীরূপেই তাদের পাঠ করেছেন।
তার সমাজতন্ত্র আবার অন্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভক্তি নয়, তিনি কনটেক্সটকে গুরুত্ব দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যুক্ত থেকেছেন। করপোরেট মুনাফার কাছে ব্যক্তিত্ব বিক্রি করে তিনিও পারতেন বিলাসিতার শিখরে জীবনযাপন করতে। তিনি তা করেননি। কফির বিজ্ঞাপনে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে তিনি কফি উৎপাদনকারী ন্যায্যমূল্য না পাওয়া শ্রমিকদের কথা ভেবেছেন। তাই বিজ্ঞাপনে তাকে খুবই কম দেখা গেছে। সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদকে তিনি তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে সুযোগ নিতে দেননি।
কোকেইনের প্রতি তার আসক্তি ছিল। দেখলাম, তিনি আসলে চিকিৎসাজনিত কারণেও মাদক সেবন করেছেন। আমাদের গণমাধ্যম বা তার ভক্ত-অভক্ত এই দিকটি নিয়ে বেশি তাকে কাভারেজ দিয়েছে বলে কোনো দিন দেখিনি। সে সময় তার প্রতি রাজনৈতিক বিদ্বেষ থেকেও ডোপ কেলেঙ্কারির এই সিদ্ধান্ত আসতে পারে এটি কেউ ভাবেনি, ভাবে না। যে ব্যক্তি দেদারসে ক্লাবে খেলছে সেই ব্যক্তিই বিশ্বকাপে আসলে ডোপ টেস্ট উতরাতে পারছে না- এসব ব্যাপারে প্রশ্ন না তুলে তার গায়ে কোকেন কালিমা আরোপ এমনভাবে পশ্চিমা মিডিয়া করেছে যে তার ভীষণ স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান ও দর্শন একদমই আলোচ্য হচ্ছে না। অথচ তার রাজনৈতিক জীবন গভীরভাবে সমৃদ্ধ, ভীষণ নৈতিকতা ও ব্যাপক মানবতাবাদী। তা থেকে শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু রয়েছে। নিচ্ছে কজন?
শেষ কথায় আসি। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবরে এক বস্তিতে জন্ম নিয়ে এই আর্জেন্টাইন মহাতারকা ফুটবলার যে গোটা পৃথিবী মাতাবেন সেটি কেউ ভাবেনি। আর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও প্রভুত্ববাদের কড়া সমালোচনা করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সাম্য ও ইনসাফের পক্ষে থাকা ডিয়েগো ম্যারাডোনা যে বিশ্বের তরুণদের নিকট ভীষণ জনপ্রিয় সেটি ফিফা ও তার পুঁজিবাদী কর্ণধাররা ভাবতে পারেনি। সে কারণেই ম্যারাডোনা যখন 'শতাব্দীর সেরা ফুটবলার' নামের ইন্টারনেট জরিপে ৫৩.৬% ভোট পেয়ে জনতার জয়ের মালা পেল তখন ফিফার আবার নতুন করে শুধু ফিফার বাছাই করা ফিফাপন্থী সাংবাদিক, বিচারক কর্মীদের ভোটার ধরে ভোট আয়োজন করতে হলো। এবার তারা পেলেকে ৭২.৭৫% ভোটে বিজয়ী করল এবং অপেক্ষাকৃত পশ্চিমানীতির প্রতি সহানুভূতিশীল পেলেকে ম্যারাডোনার সঙ্গে যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করল। এর কারণ, একক শ্রেষ্ঠত্ব পেয়ে প্রথম হলে ম্যারাডোনার রাজনৈতিক দর্শন সাধারণ তরুণ-তরুণীদের ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতে পারে বলে হয়তো ভেবেছিল ফিফা ও তার নিয়ন্ত্রকেরা।
২০২০ এর ২৫ নভেম্বর এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অনন্ত-অসীম ঈশ্বরের কাছে চলে গেলেন ফুটবলের ঈশ্বর ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। আমরা হারালাম সর্বহারাদের নেতাকে, যার জীবন-যৌবন-জবান ও যার কর্ম-বর্ম-মর্ম অসহায়, মুক্তিকামী, নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের জন্য নিবেদিত ছিল।
পৃথিবীর নিয়মে হাজারো ফুটবল খেলোয়াড় আসবে, খ্যাত হবে, চলে যাবে আবার নতুন কেউ আসবে; এই চক্র নিশ্চিত- কিন্তু মানুষের জন্য রাজনৈতিকভাবে এতটা সোচ্চার কেউ আসবে কী না সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না।
কারণ, এখন আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর সময় পার করছে মানবসভ্যতা। এ সভ্যতায় আমিকেন্দ্রিক কর্ম, গা বাঁচিয়ে 'শক্তের ভক্ত আর নরমের যম নীতি' অনুসরণ করছে অধিকাংশ পাবলিক ফিগার বা সেলিব্রিটি। অন্যদিকে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা হতে হলে নিজেকে নিয়ে, নিজের অর্থ-সুখ-বিলাসিতা নিয়ে ভেবে পড়ে থাকলে চলে না। নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয় মানুষের জন্য, ইনসাফের জন্য, অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্য। তাই ম্যারাডোনা চলে গেলে করোনার এই দুঃসময়েও মুষড়ে পড়ে বিশ্ব, কাঁদে কোটি কোটি ভক্ত-অনুরাগী-শিষ্য।
এই মুহূর্তে পৃথিবী শোকাহত। এই শোককে শক্তিতে পরিণত করে ম্যারাডোনার মতো প্রবলভাবে আধিপত্যবাদী অপশক্তির অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুললেই ডিয়েগো ম্যারাডোনা হাসবেন, আসবেন ফের এই পৃথিবীতে- অসহায় সর্বহারাদের আনন্দে মাতাতে; আঘাত করে খাঁচাতে; জালিমদের ভীত কাঁপাতে!
মঈনুল ইসলাম: প্রভাষক, জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, খুলনা; গবেষক।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
মঈনুল ইসলাম | ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ১৮:২৪

দেশে ডিয়েগো ম্যারাডোনার ভক্তের দেখি অভাব নাই। খেলার ক্ষেত্রে ভক্ত হওয়ার জন্য সরাসরি খেলা দেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বাংলাদেশের এ প্রজন্মের অনেকেই সরাসরি তার খেলা দেখেনি। যা দেখেছে তা হাইলাইটস আর প্রচুর লেখালেখি। এখান থেকেই ম্যারাডোনাকে চিনেছে বেশির ভাগ। ফলে তার পলিটিক্যাল সিগনিফিকেন্স কিন্তু আলোচ্য হচ্ছে না।
বেশির ভাগের ম্যারাডোনার স্মৃতিচারণ প্রিয় দল আর্জেন্টিনার লিজেন্ড, তাই আমার লিজেন্ড। আরেক গ্রুপ আছে, ব্রাজিল করলেও আমি তার ভক্ত! আমি এই আবেগকে উড়িয়ে দিই না। কিন্তু যে লোকের পরিষ্কার রাজনৈতিক অবস্থান আছে তার সিগনিফিকেন্স কেবল অরাজনৈতিক খেলা দিয়ে করা, তাকে মূল্যায়নের সঠিক আচরণ নয়। তবুও লোকে করছে। এই যে একটি লোকের আদর্শ ফেলে তার থাকা-খাওয়া নিয়ে মেতে থাকা, এটাই চায় পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ। আর এ ফাঁদেই মিডিয়া, সাংবাদিক আর কথিত ফুটবলপ্রেমীরা পড়ে, এমন কী বামপন্থী নামে পরিচিত 'ক্যাপিটালিস্ট কমরেডরা'ও সেটিই করছে। একটা মানুষ ঠিক কী জীবন যাপন করল, সারাটা জীবন কী আদর্শে বেঁচে রইল, কীসের বিরুদ্ধে লড়াই করল তা নিয়ে একেবারেই ভাবনা-আলোচনা-প্রতিক্রিয়া নাই! এই কয়দিনে তাই দেখলাম বসে বসে!
আর এ কারণেই ১৯৮৬ এর 'ঈশ্বরের হাতের গোল' এই ফুটবলপ্রেমী, ক্রীড়া সাংবাদিক, উপস্থাপক-উপস্থাপিকা আর কথিত বিশ্লেষকদের নিকট নিছক একটি খেলার ম্যাচ। কিন্তু এর আড়ালে যে ব্রিটিশদের ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়ার প্রতিবাদ রয়েছে, রয়েছে সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যয়- সে নিয়ে আলাপ নেই পশ্চিমা মিডিয়া কিংবা পশ্চিমের দেখানো পথে হাঁটা প্রাচ্য বা দেশীয় মিডিয়ায় বা বিশ্লেষণে।
যে সময়টিতে ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা বিশ্বের সুপারহিরো, সে সময় পৃথিবীর ব্লক-পলিটিকস চলমান আর প্রায় শেষের দিকে। বাংলাদেশের মানুষ এরশাদের মতো স্বৈরাচারের শাসনামলে। তখন ম্যারাডোনার মতো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিবাদী চরিত্রটির প্রতি অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্টে মোহাচ্ছন্ন অনেকের ভালো লাগা জন্ম নেয়।
তিনি বিপ্লবী, প্রতিরোধকারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী চরিত্রের বিরোধী, ব্রিটিশ দখলদার বিরোধী। তাই ভরা মজলিশে এই তো ২০০৪ সালেও তিনি ঘোষণা করে বলেছেন তার অর্থ দাঁড়ায়, "...যা কিছু স্বার্থপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে আসে তার আমি বিরোধী, কারণ এই রাষ্ট্রটি শোষক"।
তিনি কমরেড ফিদেল কাস্ত্রোকে ভালোবাসেন, কমরেড চে গেভারাকে ভালোবাসেন। তিনি শোষিত মানুষকে ভালোবাসেন। ট্যাটুর মাধ্যমে কাস্ত্রো থাকেন তার জাদুকরী পায়ে আর ফিদেল তার বাহুতে। আমাদের পুস্তকনির্ভর রাজনীতি-অসচেতন মানসিকতার অনেকে বলতে পারেন, 'ছি ছি! কমরেড কাস্ত্রোর ছবি পায়ে এঁকে পাপ করেছে ম্যারাডোনা!'
কিন্তু পপুলার কালচারের মাধ্যমে চে গেভারা ও কাস্ত্রোকে লাতিন আমেরিকা ও গোটা পৃথিবীর তারুণ্যের কাছে পৌঁছে দিতে ম্যারাডোনার এ ট্যাটুর ভূমিকা মুখস্থনির্ভর বাংলাদেশের গণবিচ্ছিন্ন বামপন্থী কমরেডদের চেয়ে অধিক।
মাঠের ম্যারাডোনা হাত দিয়ে 'প্রতারিত' (খেলায় রেফারির ভুল এখন হচ্ছে না? কই খেলোয়াড়দের প্রতারণার দায় আছে? কিন্তু সে সময়ের ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ম্যারাডোনাকে অতিরিক্ত ক্রিমিনালাইজড করে ব্রিটিশ ও মার্কিন মিডিয়া! আমরা আজো মানসিক দাসত্বের শৃঙ্খলে থেকে সেই বুলিই আওড়াই। আমরা বলতে বাংলাদেশ বা ভারতের মিডিয়া!) করে ম্যাচ জয় করলেও, মাঠের বাইরের ম্যারাডোনার আদর্শে কোনো প্রতারণা নেই। তিনি স্পষ্ট বলে দেন, পৃথিবীর শোষকদের পরাজিত করতে না পারলে মানুষের মুক্তি নেই৷ তিনি জোরালো গলায় বলেন, চে আমার অনুপ্রেরণা, ফিদেল আমার 'দ্বিতীয় পিতা' (রয়টার্স, ২০১৬)। কোন ফিদেল? পুঁজিবাদের ভিত্তিভূমি মার্কিন মুল্লুকের মধ্যে বসে যে ফিদেল কাস্ত্রো কাস্তে আর হাতুড়ির জয় ঘোষণা করেন সেই বিপ্লবী ফিদেল।
ম্যারাডোনা বুক ফুলিয়ে বলতেন, 'আমি ফুটবলের চে গুয়েভারা ( ল্যাটিন উচ্চারণ গেভারা)'। এই কথা বলার জন্য বলা নয়। তিনি এ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। তাই ভেনেজুয়েলার চে'পন্থী বিপ্লবী হুগো চাভেজকে তিনি ভালোবেসে নিজের পরিচয় দিয়েছেন 'আমি চাভেস্তা' আমিও হুগো চাভেজ। চাভেজ ও কাস্ত্রো আমার জন্য যা করে তা সর্বোত্তম (রয়টার্স,২০০৭)- এই হচ্ছে ম্যারাডোনার স্পষ্ট স্বর।

তো ম্যারাডোনার প্রিয়, ম্যারাডোনার অভিভাবক এই চাভেজটা কে? এই সেই চাভেজ (অনেকে হুগো শ্যাভেজ উচ্চারণ করেন ইংরেজি রীতি অনুযায়ী) যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে দাঁড়িয়ে বিশ্বনেতাদের মধ্যে বুক ফুলিয়ে, আঙুল উঁচু করে বলেছিলেন, '...আমি ডেস্কের এখান থেকে বারুদের গন্ধ পাচ্ছি। কারণ, আমার আগে এখানে কথা বলে গিয়েছি এক যুদ্ধবাজ শয়তান (জর্জ ডব্লিউ বুশ)...'। যে বুশের তল্পি বহন করতে সৌদি সালমান, আমিরাতের আমির প্রমুখ ওঠাবসা করে; ব্রিটিশ-ফরাসি-কামালি তুর্কি-জার্মান এঙ্গেলা মেরকেল-ইহুদি নেতানিয়াহু যার কথা মতো ইরাক ও আফগানিস্তান আগ্রাসনে জড়াল তাকে নিয়ে কথা বলার হিম্মত দেখানো চাভেজ হচ্ছেন ম্যারাডোনার প্রিয়।
এমনকি চাভেজ মরার পর সাম্যের নৌকার হাল ধরা নিকোলাস মাদুরোর পাশেও দাঁড়ান তিনি। এরা ম্যারাডোনার প্রিয় মানুষ। আর ম্যারাডোনা যাদের প্রিয় তাদের অনেকের প্রিয় আবার ম্যারাডোনার নীতি ও আদর্শবিরোধী বুশ, ট্রাম্প, মোদি, নেতানিয়াহু প্রমুখ! এই হচ্ছে আমাদের 'ম্যারাডোনাপ্রেমীদের' অবস্থান।
২০০৫ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে বুশ-বিরোধী ব্যাপক সমাবেশ হয়। তার সূত্রপাত ঘটায় কে? হ্যাঁ, এই ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা বুকে 'Stop Bush' (দ্য গার্ডিয়ান, ২০০৫) লিখে। তিনি ইরাক যুদ্ধের ব্যাপক বিরোধিতা করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে বলেছেন 'আবর্জনা' ( Human Trash) [Borger, J. & Goni, U, 2005, The Guardian]। বুশের তথা পুঁজিবাদী লোভীদের কথিত 'মুক্ত বাণিজ্য' নীতিকে তিনি মনে করতেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার দেশের জন্য হুমকি। কারণ, অসম প্রতিযোগিতায় এই সব সর্বগ্রাসী আমেরিকা, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রমুখ দেশের সঙ্গে সাম্যবাদনির্ভর বা 'লেভেল প্লেয়িং' ফিল্ড ছাড়া খেলতে নামা নির্ঘাত আত্মঘাতী গোল দেওয়ার শামিল।
বাস্তবে তাই হচ্ছে না? মুক্ত বাণিজ্যের নামে যেসব ক্ষেত্রে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম সেসব ক্ষেত্রেও কি পরনির্ভরশীল হচ্ছি না? বিশ্বায়ন নামের সুশীল সাম্রাজ্যবাদী শব্দযুগল যে বাজার দখলের জন্য চটকদার প্রতিশব্দ তা আমরা আর কবে বুঝব? এশিয়া-আফ্রিকা-মধ্যপ্রাচ্য-ল্যাটিন আমেরিকায় আধিপত্যবাদীদের পণ্য, নীতি ও দালালদের (দালাল বলছি ডেনিয়াল লার্নার যাকে পশ্চিমা স্বার্থে Change agents বলেছেন তার বাংলা করে) প্রবেশ করাতে; কিন্তু কথিত উন্নত দেশে কথিত তৃতীয় বিশ্ব থেকে মানুষ কিন্তু প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। তাহলে কীসের বিশ্বায়ন? কার জন্য মুক্ত বাণিজ্য? আমার তাঁত শিল্প, আমার কৃষি, আমার কর্মকে ধ্বংস করতে সব আয়োজন নয়? এক সময় মসলিন যারা বানিয়েছে তারা এখন অন্যের অর্ডার কাটে আর কিছু ফড়িয়া অর্থ বানায়! এ বিষয়ে শিখা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আমার লিখিত 'বিশ্বায়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও গণমাধ্যম' শীর্ষক বইটিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করার চেষ্টা করেছি। আহা, ম্যারাডোনা, প্রিয় বিপ্লবী তোমাকে অভিবাদন মুক্ত বাণিজ্যের আড়ালের রূপ তুমি ধরতে পেরেছিলে। আমাদের ইনসাফ ও সাম্যের ভাবনা করাতে চেষ্টা করেছিলে।

আমি এই সাম্যবাদী ম্যারাডোনার প্রতি অনুরক্ত। ফিফার মতো দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানের ভক্ত অনেকে। তারা জানে না, ফুটবলের মনোপলি দিয়ে পশ্চিমের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছে ফিফা। কেন মাত্র ৩২টি দল নিয়ে বিশ্বকাপ হয়, কেন এশিয়ায়, লাতিন আমেরিকায় ও আফ্রিকায় পৃথিবীর সর্বাধিক মানুষ বাস করলেও সেখান থেকে দল কম যায়, কেন ক্ষুদ্র ইউরোপ থেকে এত দল খেলে এসব প্রশ্ন তুলতেন ম্যারাডোনা ও তার মতো আরো অনেকে। বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজ-এ অতি উচ্চতার অভিযোগে ফিফা খেলা নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ম্যারাডোনা সেখানে হাজির হয়ে প্রতিবাদী ম্যাচ খেলেন সাবেকদের নিয়ে। ম্যারাডোনা ও তৎকালীন বলিভিয়ার সাম্যবাদী প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস উভয়েই দৃঢ়ভাবে বলেছেন, 'ফিফার এই নিষেধাজ্ঞা আসলে নির্লজ্জ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত'। কী সেই উদ্দেশ্য? ইভো মোরালেস ছিলেন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ও পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনকে বলিভিয়ায় আসতে দিতে নারাজ, প্রতিরোধকারী। আর এ জন্য ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার বলিভিয়া বিরোধী জোটের তথা ব্লেয়ার-বুশের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন বলে সরাসরি বলে দেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা (Schipani, A., 2008, BBC News)। পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির দায়ে নিন্দিত সেপ ব্লাটার ও ফিফার কর্মচারীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আঁতাত ও অর্থ বিনিময় (কাতারে ২০২২ বিশ্বকাপ স্ক্যান্ডাল) প্রকাশ হওয়ায় ম্যারাডোনার অবস্থানের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়। যা হোক ম্যারাডোনার সেই বলিভিয়ার প্রতিবাদী ম্যাচের টিকিট কী ছিল জানেন? এক প্যাকেট চাল অথবা পাস্তা বা ময়দা ইত্যাদি, যা বন্যাকবলিতদের দেওয়া হয়। এই হচ্ছেন ম্যারাডোনা, রাজনৈতিক ম্যারাডোনা। ফুটবলের চে গেভারা।
দরিদ্র পরিবারে বড় হওয়া ম্যারাডোনা দেখেছেন দারিদ্র্য কাকে বলে। জীবনকে কাছে থেকে দেখেছেন বলে অর্থকড়ি যা করেছেন তা মানুষের পেছনেই খরচ করেছেন। চ্যারিটি ম্যাচে ডাকলেই অসুস্থ হলেও খেলতেন। ধর্মের নামে অতিরিক্ত ব্যয় তিনি মানতেই পারতেন না। ক্যাথলিক ছিলেন। কিন্তু বিশ্বাস হারালেন কীভাবে তাও বলেছেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
তাকে ভ্যাটিকান সিটিতে আমন্ত্রণ জানান পোপ দ্বিতীয় সেইন্ট পল ও আর্জেন্টিনার সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স। তিনি দেখেন, পোপ যেখানে থেকে 'ভালো ভালো' কথা বলেন; বিশ্বের দরিদ্র বাচ্চাদের গিয়ে চুমু খান; সেই তিনি তার বাহিনী নিয়ে যেখানে বাস করেন সেখানে রয়েছে বিশাল বিলাসবহুল অট্টালিকা। সেখানের ছাদ-সিলিং স্বর্ণে মোড়ানো। এই বিলাসবহুল ভ্যাটিকান জীবনে ম্যারাডোনা ঈশ্বরকে পাননি। তিনি রাখঢাক না রেখে বলেছেন, এই স্বর্ণের সিলিং বেচে দিয়ে না খাওয়া মানুষদের খাওয়াতে! পেটে গলা পর্যন্ত ভাত নিয়ে অভুক্ত আফ্রিকান-লাতিন আমেরিকান শিশুদের কাছে খ্রিষ্টের প্রেম বিলাতে যাওয়ার মধ্যে ধর্মের কী আছে? অভুক্তকে খাওয়াও---এটাই ধর্মের আহ্বান। ম্যারাডোনার ভাষাটি এখানে না দিলে বুঝবেন না না কী শক্তিদায়ী তার প্রতিবাদের ভাষা।
“I went into the Vatican and saw that golden roof. And I said to myself how could somebody be such a son of bitch as to live with a golden roof and then go to poor countries and kiss children with a full belly? I stopped believing.” (Barreiro, R. El Pais, 2016)
ম্যারাডোনা ছিলেন কাস্ত্রো, হিউগো চাভেজ, নেলসন ম্যান্ডেলার মতোই পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের বন্ধু, তাদের ভালোবাসার মানুষ। তিনি ছিলেন আজীবন ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সমর্থক। তিনি ভীষণ আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলতেন, 'আমি মনেপ্রাণে একজন ফিলিস্তিনি। কারণ আমি সংগ্রাম করে বেড়ে উঠেছি এবং আমি জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। আমি ফিলিস্তিনিদের (লড়াই-সংগ্রামের) এক নম্বর ভক্ত।' (Ynetnews, 2012)।

২০১২ সালে দুবাইয়ে একটি ক্লাবের দায়িত্ব নেন। আল ওয়াসল নাম। সেখানে ইয়াসির আরাফাত যা মাথায় প্যাঁচাতেন সেই হেড স্কার্ফ নিয়ে 'ভিভা ফালেস্তাইন' বলতে ভুল করেননি ম্যারাডোনা। এই (https://bit.ly/33gIEq4) লিংকে গিয়ে দেখতে পারেন।
২০১৪ সালে এই কথিত সভ্য পৃথিবীতে যখন অবৈধ ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজায় বর্বরভাবে বোমা বর্ষণ করে শত শত নিরীহ ফিলিস্তিনি মানুষ হত্যা করে (আল-জাজিরার তথ্যমতে তিন হাজার, মিডল ইস্ট মনিটরের মতে ৫ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী); সেই বেলায় যখন বিশ্বের কথিত রথী-মহারথীদের মুখে কুলুপ আঁটা তখন আমাদের অসহায়ের বন্ধু ডিয়েগো ম্যারাডোনা নির্দ্বিধায় ফিলিস্তিনের ওপর এই হামলাকে লজ্জাজনক বলে এটি বন্ধ করতে বলেন। এখানে তার প্রামাণ্য দেখতে পারেন ( https://bit.ly/33koZFA )।
যে ইহুদীবাদীদের ধর্মভিত্তিক, বর্ণবাদী রাষ্ট্র গঠনের জন্য আর্জেন্টিনাকে একটি 'অপশন' ভেবেছিল ইউরোপীয়রা সেই আর্জেন্টিনা থেকে ইহুদিবাদী হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ আসে, আসে শান্তির বাণীরূপে ডিয়েগো ম্যারাডোনার বলিষ্ঠ স্বরে। ২০১৮ সালে মস্কোতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেছিলেন "In my heart, I am a Palestinian' এবং একই বছর তিনি সিরিয়ায় পশ্চিমা তথা মার্কিন নীতির সমালোচনা করে বলেন, 'আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যে সিরিয়ার অস্তিত্ব মুছে দিতে চায় এটি বুঝতে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া লাগবে না' (আল জাজিরা, ২০২০)।
এই নিবন্ধটি লেখার সময় আমি যখন ইনসাইডার এর আজমি হারুনের লেখাটি পড়ছি তখন মনে হলো ম্যারাডোনা বিষয়ে একটু ইসরায়েলের পত্র-পত্রিকা দেখে আসি। দেখলাম, যদিও নেতানিয়াহু টুইট করে তাকে বন্ধু বলেছে কিন্তু কীভাবে ও কেন এ বন্ধুত্ব তার কোনো কথা নেই। বরং বেশির ভাগ ইহুদিবাদী মিডিয়ায় তাকে 'নেশাসক্ত ও ইসরায়েল বিরোধী ফুটবল কিংবদন্তি' হিসেবে তুলে ধরেছে। টাইমস অব ইসরায়েল, জেরুজালেম পোস্ট, হারেৎজ অবশ্য ইসরাঈলী জুলুম নিপীড়নের ব্যাপারে ম্যারাডোনার অবস্থানকে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে যাতে করে ফুটবলপ্রেমী ইহুদিরা তাঁর ব্যাপারে আবেগ প্রকাশের ব্যাপারে নতুন করে ভাবে। তো আসল কথা হচ্ছে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা এক চির বিপ্লবী- জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের সাহসী কণ্ঠস্বর।
এসব কারণে আর্জেন্টিনার এই ফুটবল কিংবদন্তির পলিটিক্যাল সিগনিফিকেন্স বা রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। যখন বিশ্বব্যাপী ডানপন্থী উগ্রদের উত্থান, তখনো তিনি জিজেকের মতো সমাজতন্ত্রেই মানবমুক্তি দেখেছেন। পাশের বলসোনারোর উত্থানকে তিনি দিলমাদের জন্য অশনিসংকেত ভেবেছেন। ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তির জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটগুলোকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি, আগ্রাসীরূপেই তাদের পাঠ করেছেন।
তার সমাজতন্ত্র আবার অন্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভক্তি নয়, তিনি কনটেক্সটকে গুরুত্ব দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যুক্ত থেকেছেন। করপোরেট মুনাফার কাছে ব্যক্তিত্ব বিক্রি করে তিনিও পারতেন বিলাসিতার শিখরে জীবনযাপন করতে। তিনি তা করেননি। কফির বিজ্ঞাপনে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে তিনি কফি উৎপাদনকারী ন্যায্যমূল্য না পাওয়া শ্রমিকদের কথা ভেবেছেন। তাই বিজ্ঞাপনে তাকে খুবই কম দেখা গেছে। সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদকে তিনি তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে সুযোগ নিতে দেননি।
কোকেইনের প্রতি তার আসক্তি ছিল। দেখলাম, তিনি আসলে চিকিৎসাজনিত কারণেও মাদক সেবন করেছেন। আমাদের গণমাধ্যম বা তার ভক্ত-অভক্ত এই দিকটি নিয়ে বেশি তাকে কাভারেজ দিয়েছে বলে কোনো দিন দেখিনি। সে সময় তার প্রতি রাজনৈতিক বিদ্বেষ থেকেও ডোপ কেলেঙ্কারির এই সিদ্ধান্ত আসতে পারে এটি কেউ ভাবেনি, ভাবে না। যে ব্যক্তি দেদারসে ক্লাবে খেলছে সেই ব্যক্তিই বিশ্বকাপে আসলে ডোপ টেস্ট উতরাতে পারছে না- এসব ব্যাপারে প্রশ্ন না তুলে তার গায়ে কোকেন কালিমা আরোপ এমনভাবে পশ্চিমা মিডিয়া করেছে যে তার ভীষণ স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান ও দর্শন একদমই আলোচ্য হচ্ছে না। অথচ তার রাজনৈতিক জীবন গভীরভাবে সমৃদ্ধ, ভীষণ নৈতিকতা ও ব্যাপক মানবতাবাদী। তা থেকে শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু রয়েছে। নিচ্ছে কজন?
শেষ কথায় আসি। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবরে এক বস্তিতে জন্ম নিয়ে এই আর্জেন্টাইন মহাতারকা ফুটবলার যে গোটা পৃথিবী মাতাবেন সেটি কেউ ভাবেনি। আর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও প্রভুত্ববাদের কড়া সমালোচনা করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সাম্য ও ইনসাফের পক্ষে থাকা ডিয়েগো ম্যারাডোনা যে বিশ্বের তরুণদের নিকট ভীষণ জনপ্রিয় সেটি ফিফা ও তার পুঁজিবাদী কর্ণধাররা ভাবতে পারেনি। সে কারণেই ম্যারাডোনা যখন 'শতাব্দীর সেরা ফুটবলার' নামের ইন্টারনেট জরিপে ৫৩.৬% ভোট পেয়ে জনতার জয়ের মালা পেল তখন ফিফার আবার নতুন করে শুধু ফিফার বাছাই করা ফিফাপন্থী সাংবাদিক, বিচারক কর্মীদের ভোটার ধরে ভোট আয়োজন করতে হলো। এবার তারা পেলেকে ৭২.৭৫% ভোটে বিজয়ী করল এবং অপেক্ষাকৃত পশ্চিমানীতির প্রতি সহানুভূতিশীল পেলেকে ম্যারাডোনার সঙ্গে যৌথ বিজয়ী ঘোষণা করল। এর কারণ, একক শ্রেষ্ঠত্ব পেয়ে প্রথম হলে ম্যারাডোনার রাজনৈতিক দর্শন সাধারণ তরুণ-তরুণীদের ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতে পারে বলে হয়তো ভেবেছিল ফিফা ও তার নিয়ন্ত্রকেরা।
২০২০ এর ২৫ নভেম্বর এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অনন্ত-অসীম ঈশ্বরের কাছে চলে গেলেন ফুটবলের ঈশ্বর ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। আমরা হারালাম সর্বহারাদের নেতাকে, যার জীবন-যৌবন-জবান ও যার কর্ম-বর্ম-মর্ম অসহায়, মুক্তিকামী, নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের জন্য নিবেদিত ছিল।
পৃথিবীর নিয়মে হাজারো ফুটবল খেলোয়াড় আসবে, খ্যাত হবে, চলে যাবে আবার নতুন কেউ আসবে; এই চক্র নিশ্চিত- কিন্তু মানুষের জন্য রাজনৈতিকভাবে এতটা সোচ্চার কেউ আসবে কী না সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না।
কারণ, এখন আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর সময় পার করছে মানবসভ্যতা। এ সভ্যতায় আমিকেন্দ্রিক কর্ম, গা বাঁচিয়ে 'শক্তের ভক্ত আর নরমের যম নীতি' অনুসরণ করছে অধিকাংশ পাবলিক ফিগার বা সেলিব্রিটি। অন্যদিকে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা হতে হলে নিজেকে নিয়ে, নিজের অর্থ-সুখ-বিলাসিতা নিয়ে ভেবে পড়ে থাকলে চলে না। নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয় মানুষের জন্য, ইনসাফের জন্য, অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্য। তাই ম্যারাডোনা চলে গেলে করোনার এই দুঃসময়েও মুষড়ে পড়ে বিশ্ব, কাঁদে কোটি কোটি ভক্ত-অনুরাগী-শিষ্য।
এই মুহূর্তে পৃথিবী শোকাহত। এই শোককে শক্তিতে পরিণত করে ম্যারাডোনার মতো প্রবলভাবে আধিপত্যবাদী অপশক্তির অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুললেই ডিয়েগো ম্যারাডোনা হাসবেন, আসবেন ফের এই পৃথিবীতে- অসহায় সর্বহারাদের আনন্দে মাতাতে; আঘাত করে খাঁচাতে; জালিমদের ভীত কাঁপাতে!
মঈনুল ইসলাম: প্রভাষক, জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, খুলনা; গবেষক।