প্রতিজ্ঞা হোক রুখতেই হবে মৌলবাদ
ড. কাজী এরতেজা হাসান | ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:৪৪
১৪ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহরের এই দিনে হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন দেশের অগ্রণী কিছু মানুষ। আর একদিন পরই ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে লক্ষ–কোটি নারী–পুরুষের আত্মত্যাগ আর সমগ্র দেশবাসীর অবর্ণনীয় দুঃখ–কষ্টের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তাই ৫০ বছর আগের এ দিনটি আমাদের কাছে একাধারে অনেক দুঃখ আর বেদনার এবং অনেক আনন্দ ও বিজয়েরও।
পাক-বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আলশামস কর্তৃক বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞের স্মরণে বাঙালি জাতি স্বশ্রদ্ধ চিত্তে ১৯৭২ সাল থেকে ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে আসছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেছিলেন। কারণ অপহরণ ও পরে নির্বিচারে হত্যা এই ১৪ ডিসেম্বরেই অর্থাৎ পাক-বাহিনীর আত্ম-সমর্পণ এবং বাঙালির বিজয় অর্জন তথা বিজয় দিবসের ঠিক দু’দিন পূর্বে, সংঘটিত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি।
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ, মুজিবনগর সরকারের এক মুখপাত্র জানান, ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা মিলে ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে । ১৯৯৪ সালে পুনর্মুদ্রিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কিত তথ্যকোষে’ শহীদ আখ্যায়িত হয়েছেন তারা যাদের পাক-বাহিনী এবং দোসরেরা (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) বিভিন্ন সময় নির্বিচারে হত্যা করেছিল এবং যারা ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সময়কাল থেকে নিখোঁজ।
লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, উকিল, চিকিৎসক, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মী, নাট্য-কর্মী, জনসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ নামক প্রামাণ্য চিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ-শিক্ষককে হত্যা করা হয়। দৈনিক পত্রিকাগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গোপন তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে, ১৮ ডিসেম্বরে একদল সাংবাদিক ঢাকার পশ্চিমে, রায়ের বাজার এলাকায় পচনশীল, ক্ষত-বিক্ষত লাশের একটি গণ-কবরের সন্ধান লাভ করে। জাতির মেধাবী ব্যক্তিবর্গের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, একে-অন্যের নিচে চাপা পড়ে ছিল। লালমাটিয়ায় শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাংবাদিকরা একটি বন্দীশালা আবিষ্কার করে, যা ছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং কামালউদ্দিন, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলিম চৌধুরী, আবুল খায়ের এবং সাংবাদিক মুহাম্মদ আখতার পচনশীল লাশগুলো পরিবার কর্তৃক শনাক্ত করা হয় সেদিনই। সাংবাদিক সেলিনা পারভিন এর লাশ শনাক্ত করা হয় পরের দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, ফাইজুল মহি এবং চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর ও মনসুর আলী’র লাশ পরে চিহ্নিত করা হয়। লাশ সনাক্তকরণের সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছিলেন।
এরকম আরও বধ্যভূমি ছিল মিরপুর এবং রায়ের বাজার এলাকায়, তেজগাঁও এর কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টি.বি. হাসপাতাল সহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। অনেক লাশই পরে সনাক্তকরণের পর্যায়ে ছিল না। এসময় সংবাদপত্রগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের (নভেম্বরের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অপহরণ অথবা গ্রেফতারকৃত) নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছিল।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডটি যে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সেটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে ওঠে মানুষের কাছে। মফিজউদ্দিনের (লাশ বহনকারী বাহনের চালক) স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আশরাফুজ্জামান খান, ইসলামি ছাত্র সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য এবং পাকিস্তান রেডিও’র সাবেক কর্মী, নিজ হাতে সাতজন শিক্ষককে গুলি করেন। মফিজউদ্দনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এমন দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণকারী শিক্ষকদের লাশ উদ্ধার করা হয় রায়ের বাজার বধ্যভূমি এবং মিরপুরের শিয়াল বাড়ির গণকবর থেকে। তার ডায়েরিতে ২০ জন শিক্ষক সহ আরো অনেক বাঙালির তালিকা ছিল। তার ডায়েরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষকের নাম ছিল যারা পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনায় পাক-বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাসেম এবং ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ছিল মূল হোতা। নভেম্বর মাসের কোন এক সময় তারা মওলানা আব্দুল মান্নানের বাসগৃহে মাদ্রাসা শিক্ষক সংঘের প্রেসিডেন্ট সহকারে বৈঠক করে। গবেষকরা বলছেন, মওলানা আব্দুল মান্নানের বাসগৃহে অনুষ্ঠিত আলোচনাতেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মূল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নিশ্চিত পরাজয় জেনেই একাত্তরে যারা এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারাই এ দেশের সূর্যসন্তানদের মেধাশূণ্য করতেই এমন নির্মমতার পথ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ওই পরাজিত শক্তি কখনোই বুঝতেই পারেনি, ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়; কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করা যায়না। এখনো এই স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তির সময়কালে এসেও দেখছি, মৌলবাদীদের মুখোশে সেই পরাজিত শক্তির আস্ফালন। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালেরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরও ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল, তারা সফল হয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ কৃপায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকায় সেদিন বেঁচে যান। কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করেছেন। এখনো ষড়যন্ত্রকারীদের উৎপাত থেমে নেই। তাদের রুখতেই হবে। কেননা বিশ্বাসঘাতকরা সব সময়ই ছোবল মারার জন্য বসে থাকে। যেমনটা যারা ১৪ ডিসেম্বর করেছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। কিন্তু শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না, তাই বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে।
তাই আজকের এই দিনে সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, এদেশে মৌলবাদকে রুখতেই হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম;
পরিচালক, এফবিসিসিআই; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইরান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
ড. কাজী এরতেজা হাসান | ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:৪৪

১৪ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহরের এই দিনে হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন দেশের অগ্রণী কিছু মানুষ। আর একদিন পরই ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে লক্ষ–কোটি নারী–পুরুষের আত্মত্যাগ আর সমগ্র দেশবাসীর অবর্ণনীয় দুঃখ–কষ্টের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তাই ৫০ বছর আগের এ দিনটি আমাদের কাছে একাধারে অনেক দুঃখ আর বেদনার এবং অনেক আনন্দ ও বিজয়েরও।
পাক-বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আলশামস কর্তৃক বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞের স্মরণে বাঙালি জাতি স্বশ্রদ্ধ চিত্তে ১৯৭২ সাল থেকে ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে আসছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেছিলেন। কারণ অপহরণ ও পরে নির্বিচারে হত্যা এই ১৪ ডিসেম্বরেই অর্থাৎ পাক-বাহিনীর আত্ম-সমর্পণ এবং বাঙালির বিজয় অর্জন তথা বিজয় দিবসের ঠিক দু’দিন পূর্বে, সংঘটিত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি।
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ, মুজিবনগর সরকারের এক মুখপাত্র জানান, ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকবাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা মিলে ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে । ১৯৯৪ সালে পুনর্মুদ্রিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কিত তথ্যকোষে’ শহীদ আখ্যায়িত হয়েছেন তারা যাদের পাক-বাহিনী এবং দোসরেরা (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) বিভিন্ন সময় নির্বিচারে হত্যা করেছিল এবং যারা ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সময়কাল থেকে নিখোঁজ।
লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, উকিল, চিকিৎসক, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মী, নাট্য-কর্মী, জনসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ নামক প্রামাণ্য চিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ-শিক্ষককে হত্যা করা হয়। দৈনিক পত্রিকাগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গোপন তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে, ১৮ ডিসেম্বরে একদল সাংবাদিক ঢাকার পশ্চিমে, রায়ের বাজার এলাকায় পচনশীল, ক্ষত-বিক্ষত লাশের একটি গণ-কবরের সন্ধান লাভ করে। জাতির মেধাবী ব্যক্তিবর্গের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, একে-অন্যের নিচে চাপা পড়ে ছিল। লালমাটিয়ায় শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাংবাদিকরা একটি বন্দীশালা আবিষ্কার করে, যা ছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং কামালউদ্দিন, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলিম চৌধুরী, আবুল খায়ের এবং সাংবাদিক মুহাম্মদ আখতার পচনশীল লাশগুলো পরিবার কর্তৃক শনাক্ত করা হয় সেদিনই। সাংবাদিক সেলিনা পারভিন এর লাশ শনাক্ত করা হয় পরের দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, ফাইজুল মহি এবং চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর ও মনসুর আলী’র লাশ পরে চিহ্নিত করা হয়। লাশ সনাক্তকরণের সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছিলেন।
এরকম আরও বধ্যভূমি ছিল মিরপুর এবং রায়ের বাজার এলাকায়, তেজগাঁও এর কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টি.বি. হাসপাতাল সহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। অনেক লাশই পরে সনাক্তকরণের পর্যায়ে ছিল না। এসময় সংবাদপত্রগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের (নভেম্বরের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অপহরণ অথবা গ্রেফতারকৃত) নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছিল।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডটি যে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সেটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে ওঠে মানুষের কাছে। মফিজউদ্দিনের (লাশ বহনকারী বাহনের চালক) স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আশরাফুজ্জামান খান, ইসলামি ছাত্র সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য এবং পাকিস্তান রেডিও’র সাবেক কর্মী, নিজ হাতে সাতজন শিক্ষককে গুলি করেন। মফিজউদ্দনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এমন দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণকারী শিক্ষকদের লাশ উদ্ধার করা হয় রায়ের বাজার বধ্যভূমি এবং মিরপুরের শিয়াল বাড়ির গণকবর থেকে। তার ডায়েরিতে ২০ জন শিক্ষক সহ আরো অনেক বাঙালির তালিকা ছিল। তার ডায়েরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষকের নাম ছিল যারা পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনায় পাক-বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাসেম এবং ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ছিল মূল হোতা। নভেম্বর মাসের কোন এক সময় তারা মওলানা আব্দুল মান্নানের বাসগৃহে মাদ্রাসা শিক্ষক সংঘের প্রেসিডেন্ট সহকারে বৈঠক করে। গবেষকরা বলছেন, মওলানা আব্দুল মান্নানের বাসগৃহে অনুষ্ঠিত আলোচনাতেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মূল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নিশ্চিত পরাজয় জেনেই একাত্তরে যারা এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারাই এ দেশের সূর্যসন্তানদের মেধাশূণ্য করতেই এমন নির্মমতার পথ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ওই পরাজিত শক্তি কখনোই বুঝতেই পারেনি, ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়; কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করা যায়না। এখনো এই স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তির সময়কালে এসেও দেখছি, মৌলবাদীদের মুখোশে সেই পরাজিত শক্তির আস্ফালন। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালেরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরও ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল, তারা সফল হয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ কৃপায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকায় সেদিন বেঁচে যান। কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করেছেন। এখনো ষড়যন্ত্রকারীদের উৎপাত থেমে নেই। তাদের রুখতেই হবে। কেননা বিশ্বাসঘাতকরা সব সময়ই ছোবল মারার জন্য বসে থাকে। যেমনটা যারা ১৪ ডিসেম্বর করেছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। কিন্তু শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না, তাই বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে।
তাই আজকের এই দিনে সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, এদেশে মৌলবাদকে রুখতেই হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম;
পরিচালক, এফবিসিসিআই; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইরান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ