মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান? দৃশ্যত গণতন্ত্র থেকে নগ্ন কর্তৃত্ববাদের দিকে
আলী রীয়াজ | ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৩:৩০
গত এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল স্থানীয় সময় সোমবার সকালে তা বাস্তব রূপ নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা অং সান সূচি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্তসহ এনএলডি’র শীর্ষ নেতাদের আটক করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে গত কয়েক সপ্তাহে একাধিকবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল যেন তাঁরা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা না করে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে তাঁরা সংবিধান মেনে চলবে। সেনাবাহিনীর এই প্রতিশ্রুতি যদিও কাউকেই প্রায় আশ্বস্ত করেনি, কিন্তু এসব যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছিলে তা এখন বোঝা যাচ্ছে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের কথা এখনও সরাসরি না বললেও তাঁর প্রত্যক্ষভাবেই দেশ শাসনে হস্তক্ষেপ করেছে।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সূচি’র দল এনএলডি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হওয়ার পর সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তোলে। ৪৭৬টি আসনের ভেতরে বিরোধী দল পায় ৩৩টি আসন। এই নির্বাচনে বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের ভোট থেকে বঞ্চিত করা হয় এই যুক্তিতে যে তাঁদের এলাকায় সংঘাত বহাল থাকায় সেখানে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের পরিকল্পিতভাবেই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। সোমবার নতুন সংসদের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরাকান রাজ্যে সেনাবাহিনী গণহত্যা চালানোর পরে কমপক্ষে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত – আইসিজে’তে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দ্য হেগে এই বিষয়ে প্রাথমিক শুনানির পরে আইসিজে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সহিংসতা ও বৈষম্যের নীতিতে গণহত্যার উদ্দেশ্য থেকে থাকতে পারে বলে মত দেয়। আদালত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য অবিলম্বে বন্ধ করার এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার লক্ষ্যে মিয়ানমারের প্রতি চার দফা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। এই শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন অং সান সূ চি। তিনি দেশের সেনা বাহিনীর পক্ষে সাফাই বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং গণহত্যার কথা অস্বীকার করেছিলেন।
২০১৫ সালে নির্বাচনে সূ চি এবং তার দল ব্যাপকভাবে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও ক্ষমতার চাবিকাঠি কার্যত সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল; সেনাবাহিনী ১৯৬২ সালে থেকে প্রত্যক্ষভাবে দেশ শাসন করেছে। দেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ব্যবস্থায় দেশের পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা আছে, এ ছাড়া তিনটি প্রধান মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত আছে। সেনাবাহিনীর এই ধরনের নিয়ন্ত্রণের কারণে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তা ছাড়া সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা এবং কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার কারণে একে হাইব্রিড রেজিম বলেই চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা শাসন ব্যবস্থার লক্ষণ হচ্ছে গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদানের দৃশ্যত উপস্থিতি এবং কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার আধিপত্য। এই ধরনের ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন বহাল থাকলে তা গণতন্ত্র অভিমুখী হয় না তা আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী রূপ লাভ করে এই নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কিন্তু অধিকাংশ হাইব্রিড রেজিম যে হয় বেসামরিক কর্তৃত্ববাদী শাসনে বা সামরিক কর্তৃত্ববাদেই উপনীত হয় মিয়ানমারের ঘটনা প্রবাহ সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে মিয়ানমারে কী ঘটবে তা নিশ্চয় আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করবো, অং সান সূ চি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির কোনও রকম আপসের দিকে যাবেন কিনা সেটাও দেখার বিষয়। কিন্ত ইতিমধ্যেই যা বোঝা যাচ্ছে তা হচ্ছে আধাগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা ভঙ্গুর গণতন্ত্রের পথ কর্তৃত্ববাদের দিকেই।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
(আলী রীয়াজ ডট অনলাইন থেকে)
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
আলী রীয়াজ | ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৩:৩০

গত এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল স্থানীয় সময় সোমবার সকালে তা বাস্তব রূপ নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা অং সান সূচি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্তসহ এনএলডি’র শীর্ষ নেতাদের আটক করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে গত কয়েক সপ্তাহে একাধিকবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল যেন তাঁরা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা না করে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে তাঁরা সংবিধান মেনে চলবে। সেনাবাহিনীর এই প্রতিশ্রুতি যদিও কাউকেই প্রায় আশ্বস্ত করেনি, কিন্তু এসব যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছিলে তা এখন বোঝা যাচ্ছে। সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের কথা এখনও সরাসরি না বললেও তাঁর প্রত্যক্ষভাবেই দেশ শাসনে হস্তক্ষেপ করেছে।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সূচি’র দল এনএলডি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হওয়ার পর সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তোলে। ৪৭৬টি আসনের ভেতরে বিরোধী দল পায় ৩৩টি আসন। এই নির্বাচনে বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের ভোট থেকে বঞ্চিত করা হয় এই যুক্তিতে যে তাঁদের এলাকায় সংঘাত বহাল থাকায় সেখানে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের পরিকল্পিতভাবেই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। সোমবার নতুন সংসদের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরাকান রাজ্যে সেনাবাহিনী গণহত্যা চালানোর পরে কমপক্ষে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত – আইসিজে’তে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দ্য হেগে এই বিষয়ে প্রাথমিক শুনানির পরে আইসিজে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সহিংসতা ও বৈষম্যের নীতিতে গণহত্যার উদ্দেশ্য থেকে থাকতে পারে বলে মত দেয়। আদালত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য অবিলম্বে বন্ধ করার এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার লক্ষ্যে মিয়ানমারের প্রতি চার দফা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। এই শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন অং সান সূ চি। তিনি দেশের সেনা বাহিনীর পক্ষে সাফাই বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং গণহত্যার কথা অস্বীকার করেছিলেন।
২০১৫ সালে নির্বাচনে সূ চি এবং তার দল ব্যাপকভাবে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও ক্ষমতার চাবিকাঠি কার্যত সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল; সেনাবাহিনী ১৯৬২ সালে থেকে প্রত্যক্ষভাবে দেশ শাসন করেছে। দেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ব্যবস্থায় দেশের পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা আছে, এ ছাড়া তিনটি প্রধান মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত আছে। সেনাবাহিনীর এই ধরনের নিয়ন্ত্রণের কারণে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তা ছাড়া সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা এবং কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার কারণে একে হাইব্রিড রেজিম বলেই চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা শাসন ব্যবস্থার লক্ষণ হচ্ছে গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদানের দৃশ্যত উপস্থিতি এবং কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার আধিপত্য। এই ধরনের ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন বহাল থাকলে তা গণতন্ত্র অভিমুখী হয় না তা আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী রূপ লাভ করে এই নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কিন্তু অধিকাংশ হাইব্রিড রেজিম যে হয় বেসামরিক কর্তৃত্ববাদী শাসনে বা সামরিক কর্তৃত্ববাদেই উপনীত হয় মিয়ানমারের ঘটনা প্রবাহ সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে মিয়ানমারে কী ঘটবে তা নিশ্চয় আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করবো, অং সান সূ চি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির কোনও রকম আপসের দিকে যাবেন কিনা সেটাও দেখার বিষয়। কিন্ত ইতিমধ্যেই যা বোঝা যাচ্ছে তা হচ্ছে আধাগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা ভঙ্গুর গণতন্ত্রের পথ কর্তৃত্ববাদের দিকেই।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
(আলী রীয়াজ ডট অনলাইন থেকে)