মাও সে-তুঙের প্রয়াণ দিবসে কয়েকটি কথা
সৌভিক রেজা | ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ২১:৪৯
চিনা প্রবাদে আছে, মৃত্যুর পরেও যিনি জীবিত থাকেন, তিনিই দীর্ঘজীবী। একজন মানুষ তার শারীরিক মৃত্যুর পরে কীভাবে জীবিত থাকেন? জীবিত থাকেন তার কাজের মধ্যে দিয়ে, মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি তার নিবিষ্ট কর্তব্য পালনের মধ্যে দিয়ে, তার সততা ও সাহস দিয়ে, তার লেখনি দিয়ে।
কমরেড মাও সে-তুঙ ছিলেন এমন একজন মানুষ, যাকে মানবজাতির অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা যায়। কাদের শিক্ষক ছিলেন তিনি? ছিলেন বিপ্লবীদের শিক্ষক, নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত মানুষের শিক্ষক। শুধু এশিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকা—সর্বত্রই দেখতে পাই মাওয়ের ছাত্রদের। যারা শোষকের অন্যায়ের প্রতিবাদে জীবন দিচ্ছেন, জীবন দিচ্ছেন জুলুমবাজির প্রতিরোধে।
২.
কমরেড মাও আমাদের শিক্ষা দেন যে, ‘বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে’। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও শিক্ষা দিতে ভোলেননি, ‘আমাদের নীতি হচ্ছে— পার্টি বন্দুককে কমান্ড করে, বন্দুককে কোনোমতেই পার্টির ওপর কমান্ড করতে দেওয়া হবে না’।
এ-থেকে আমরা বুঝতে পারি মাওয়ের শিক্ষা আপসের শিক্ষা যেমন নয়, তেমনি এটা হঠাকারিতার শিক্ষাও নয়।
৩.
মানুষকে, জনগণকে, নিপীড়িত শ্রেণিকে তিনি বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, ‘জনগণ, কেবল জনগণই হচ্ছে বিশ্ব-ইতিহাস নির্মাণের চালিকা-শক্তি’। জনসাধারণই যে প্রকৃত বীর, তাদের কাছ থেকেই বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনেক কিছু জানার আছে, বোঝার আছে, সেই গুরুত্বটাও মাও সে-তুঙ অনুধাবন করত পেরেছিলেন।
৪.
মাওয়ের শিক্ষা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। জীবনের বহুমাত্রিকতাকে তিনি যেমন স্বীকার করতেন, তেমনই সেই বহুমাত্রিক জীবনকে শুধু তত্ত্ব দিয়ে নয়, নিরন্তর অনুশীলনের সাহায্যে সক্রিয়তার সঙ্গে পরিবর্তনের বিষয়ে আস্থা রেখেছিলেন।
৫.
মাও সে-তুঙ বা তার মতবাদ মানেই ‘গোলাগুলি’ নয়, ‘যুদ্ধবাজি’ নয়। গণযুদ্ধের প্রয়োজনিয়তাকে তিনি স্বীকার করেছেন, কিন্তু আবার এটাও মনে করতেন যে, বিপ্লবী যুদ্ধের মাধ্যমেই দুনিয়া থেকে যুদ্ধের চক্রান্তকারীদের নির্মূল করতে হবে, অন্য কোনো পন্থায় নয়। মাও পরিষ্কারভাবে যুদ্ধ দিয়েই যুদ্ধের অভিশাপ থেকে দুনিয়ার মানুষকে মুক্ত করবার কথা ভাবতেন।
৬.
মাও যৌক্তিকভাবেই মনে করতেন, ‘বিপ্লব কোনো ভোজসভা নয়’। এই বিপ্লব প্রসঙ্গে তিনি বলপ্রয়োগের কথা উচ্চারণ করেছেন বারবার। কিন্তু কখনো এইটা বলতে ভোলেননি যে, ‘অস্ত্র হচ্ছে যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কিন্তু নির্ধারক উপাদান নয়’। কমরেড মাওয়ের মতে, যুদ্ধের ‘নির্ধারক উপাদান হচ্ছে—মানুষ, বস্তু নয়’। সে কারণে দ্বিধাহীনভাবে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘গণ-ফৌজ না থাকলে জনগণের কিছুই থাকে না’।
৭.
মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা যে আকাশ থেকে নেমে আসে না, এগুলো কোনো অলৌকিক জিনিস নয়, সেই বিষয়েও তিনি আমাদের সতর্ক করে গিয়েছেন। সামাজিক অনুশীলন, সমাজের উৎপাদন-সংগ্রাম আর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা—এইগুলোই নির্ভুল চিন্তাধারার উৎপত্তিস্থল।
৮.
মাও সে-তুঙ বিশ্বাস করতেন, মানুষের মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিটি মানুষকেই এই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। কিন্ত সব মৃত্যু যে এক মৃত্যু নয়, তার তাৎপর্য যে ব্যক্তিভেদে, কর্মভেদে আলাদা-আলাদা সেইদিকেও তিনি আমাদের দৃষ্টিপাত করান। তিনি বিবেচনা করতেন, ‘জনগণের জন্য যিনি মৃত্যুবরণ করেন, তার মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী’।
৯.
বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) কমরেড মাও সে-তুঙের প্রয়াণ দিবাস। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তিনি শারীরিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেও তার কর্ম, চিন্তা, অনুশীলন, বিপ্লবী উদ্দীপনা সৃষ্টি করবার জন্যে আমাদের মধ্যে বেঁচে এখনও আছেন। বেঁচে সারা দুনিয়ার বিপ্লবীদের মধ্যে। কেন বেঁচে আছেন? তিনি বেঁচে আছেন এক আপসহীন পথ-প্রদর্শকের ভূমিকায় নিরন্তর অবতীর্ণ হওয়ার জন্য। কেননা, কমরেড মাওয়ের পথ বিপ্লবের পথ। শোষণমুক্তির পথ। মানব সভ্যতাকে অগ্রসর করার পথ। মাওয়ের দেখানো পথে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া আর নিজেদের মানবিক বোধটাকে টিকিয়ে রাখা আজকের এই প্রতিকূল সময়ে সবচেয়ে বড় একটি সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য বিকল্প আমাদের হাতে নেই।
১০.
লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ের আরেক নাম—মাও সে-তুঙ! সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হওয়া ছাড়াও মাওকে বোঝার অন্যতম একটি রাস্তা হচ্ছে, তার রচনাকর্ম নিবিড়ভাবে পাঠ করা এবং আজকের পরিপ্রেক্ষিতে, দেশ-কাল বিবেচনার কথা মাথায় রেখে, সেগুলো সৃজনশীলভাবে ব্যাখ্যা করা।
সরদার ফজলুল করিম তার ‘দিনলিপি’-তে লিখেছিলেন, ‘মাও সে-তুঙের মতো সহজ, জীবনঘনিষ্ঠ ভাষায় মনের কথা প্রকাশ করার, বিশ্বকে ব্যাখ্যা করার মতো লেখক খুব কমই আছেন’।
মৃত্যুহীন কমরেড মাও সে-তুঙ লাল সালাম!
সৌভিক রেজা: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
সৌভিক রেজা | ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ২১:৪৯

চিনা প্রবাদে আছে, মৃত্যুর পরেও যিনি জীবিত থাকেন, তিনিই দীর্ঘজীবী। একজন মানুষ তার শারীরিক মৃত্যুর পরে কীভাবে জীবিত থাকেন? জীবিত থাকেন তার কাজের মধ্যে দিয়ে, মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি তার নিবিষ্ট কর্তব্য পালনের মধ্যে দিয়ে, তার সততা ও সাহস দিয়ে, তার লেখনি দিয়ে।
কমরেড মাও সে-তুঙ ছিলেন এমন একজন মানুষ, যাকে মানবজাতির অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা যায়। কাদের শিক্ষক ছিলেন তিনি? ছিলেন বিপ্লবীদের শিক্ষক, নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত মানুষের শিক্ষক। শুধু এশিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকা—সর্বত্রই দেখতে পাই মাওয়ের ছাত্রদের। যারা শোষকের অন্যায়ের প্রতিবাদে জীবন দিচ্ছেন, জীবন দিচ্ছেন জুলুমবাজির প্রতিরোধে।
২. কমরেড মাও আমাদের শিক্ষা দেন যে, ‘বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে’। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও শিক্ষা দিতে ভোলেননি, ‘আমাদের নীতি হচ্ছে— পার্টি বন্দুককে কমান্ড করে, বন্দুককে কোনোমতেই পার্টির ওপর কমান্ড করতে দেওয়া হবে না’।
এ-থেকে আমরা বুঝতে পারি মাওয়ের শিক্ষা আপসের শিক্ষা যেমন নয়, তেমনি এটা হঠাকারিতার শিক্ষাও নয়।
৩. মানুষকে, জনগণকে, নিপীড়িত শ্রেণিকে তিনি বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, ‘জনগণ, কেবল জনগণই হচ্ছে বিশ্ব-ইতিহাস নির্মাণের চালিকা-শক্তি’। জনসাধারণই যে প্রকৃত বীর, তাদের কাছ থেকেই বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনেক কিছু জানার আছে, বোঝার আছে, সেই গুরুত্বটাও মাও সে-তুঙ অনুধাবন করত পেরেছিলেন।
৪. মাওয়ের শিক্ষা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। জীবনের বহুমাত্রিকতাকে তিনি যেমন স্বীকার করতেন, তেমনই সেই বহুমাত্রিক জীবনকে শুধু তত্ত্ব দিয়ে নয়, নিরন্তর অনুশীলনের সাহায্যে সক্রিয়তার সঙ্গে পরিবর্তনের বিষয়ে আস্থা রেখেছিলেন।
৫. মাও সে-তুঙ বা তার মতবাদ মানেই ‘গোলাগুলি’ নয়, ‘যুদ্ধবাজি’ নয়। গণযুদ্ধের প্রয়োজনিয়তাকে তিনি স্বীকার করেছেন, কিন্তু আবার এটাও মনে করতেন যে, বিপ্লবী যুদ্ধের মাধ্যমেই দুনিয়া থেকে যুদ্ধের চক্রান্তকারীদের নির্মূল করতে হবে, অন্য কোনো পন্থায় নয়। মাও পরিষ্কারভাবে যুদ্ধ দিয়েই যুদ্ধের অভিশাপ থেকে দুনিয়ার মানুষকে মুক্ত করবার কথা ভাবতেন।
৬. মাও যৌক্তিকভাবেই মনে করতেন, ‘বিপ্লব কোনো ভোজসভা নয়’। এই বিপ্লব প্রসঙ্গে তিনি বলপ্রয়োগের কথা উচ্চারণ করেছেন বারবার। কিন্তু কখনো এইটা বলতে ভোলেননি যে, ‘অস্ত্র হচ্ছে যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কিন্তু নির্ধারক উপাদান নয়’। কমরেড মাওয়ের মতে, যুদ্ধের ‘নির্ধারক উপাদান হচ্ছে—মানুষ, বস্তু নয়’। সে কারণে দ্বিধাহীনভাবে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘গণ-ফৌজ না থাকলে জনগণের কিছুই থাকে না’।
৭. মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা যে আকাশ থেকে নেমে আসে না, এগুলো কোনো অলৌকিক জিনিস নয়, সেই বিষয়েও তিনি আমাদের সতর্ক করে গিয়েছেন। সামাজিক অনুশীলন, সমাজের উৎপাদন-সংগ্রাম আর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা—এইগুলোই নির্ভুল চিন্তাধারার উৎপত্তিস্থল।
৮. মাও সে-তুঙ বিশ্বাস করতেন, মানুষের মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিটি মানুষকেই এই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। কিন্ত সব মৃত্যু যে এক মৃত্যু নয়, তার তাৎপর্য যে ব্যক্তিভেদে, কর্মভেদে আলাদা-আলাদা সেইদিকেও তিনি আমাদের দৃষ্টিপাত করান। তিনি বিবেচনা করতেন, ‘জনগণের জন্য যিনি মৃত্যুবরণ করেন, তার মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী’।
৯. বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) কমরেড মাও সে-তুঙের প্রয়াণ দিবাস। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তিনি শারীরিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেও তার কর্ম, চিন্তা, অনুশীলন, বিপ্লবী উদ্দীপনা সৃষ্টি করবার জন্যে আমাদের মধ্যে বেঁচে এখনও আছেন। বেঁচে সারা দুনিয়ার বিপ্লবীদের মধ্যে। কেন বেঁচে আছেন? তিনি বেঁচে আছেন এক আপসহীন পথ-প্রদর্শকের ভূমিকায় নিরন্তর অবতীর্ণ হওয়ার জন্য। কেননা, কমরেড মাওয়ের পথ বিপ্লবের পথ। শোষণমুক্তির পথ। মানব সভ্যতাকে অগ্রসর করার পথ। মাওয়ের দেখানো পথে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া আর নিজেদের মানবিক বোধটাকে টিকিয়ে রাখা আজকের এই প্রতিকূল সময়ে সবচেয়ে বড় একটি সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য বিকল্প আমাদের হাতে নেই।
১০. লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ের আরেক নাম—মাও সে-তুঙ! সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হওয়া ছাড়াও মাওকে বোঝার অন্যতম একটি রাস্তা হচ্ছে, তার রচনাকর্ম নিবিড়ভাবে পাঠ করা এবং আজকের পরিপ্রেক্ষিতে, দেশ-কাল বিবেচনার কথা মাথায় রেখে, সেগুলো সৃজনশীলভাবে ব্যাখ্যা করা।
সরদার ফজলুল করিম তার ‘দিনলিপি’-তে লিখেছিলেন, ‘মাও সে-তুঙের মতো সহজ, জীবনঘনিষ্ঠ ভাষায় মনের কথা প্রকাশ করার, বিশ্বকে ব্যাখ্যা করার মতো লেখক খুব কমই আছেন’।
মৃত্যুহীন কমরেড মাও সে-তুঙ লাল সালাম!
সৌভিক রেজা: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।