উদ্যাপনের নামে জীববৈচিত্র্য বিধ্বংসী উন্মাদনা পরিহার জরুরি
মোল্যা রেজাউল করিম | ২ জানুয়ারি, ২০২২ ১৬:০৩
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে নতুন বছর নিয়ে আসে নতুনের বারতা। বিগত বছরের গ্লানি, ক্লেদ, পঙ্কিলতাকে পেছনে ফেলে নতুনভাবে বিশ্বকে ঢেলে সাজাতে আসে নতুন আরেকটা ক্যালেন্ডার- ২০২২।
নতুন বছর মানে সম্মুখের অনাগত দিনগুলোকে মঙ্গলময়তার পানে অপরিসীম প্রত্যাশার রঙে উপজীব্য করা। সেই প্রত্যাশা শুধু মানুষের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্ব পরিমণ্ডলে সুখের বারতা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রকৃতির অমূল্য অনুষঙ্গসমূহের সামগ্রিক ও সমন্বিত সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লক্ষ্য করলাম- গতকাল রাত ১২টা অতিক্রম করার সময়ে নগরসভ্যতায় ইংরেজি বর্ষবরণ তথা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ রূপান্তরিত হয় এক উন্মাতাল উন্মাদনায়। বিকট শব্দের গগনবিদারী আনন্দ লহরীতে যুক্ত হয় আতশবাজির নানা কারিশমা ও প্রতিযোগিতা। শান্ত নগরীর গহিন রাত্রি প্রহরের নীরবতাকে বিদীর্ণ করে আলোক ঝলমলে উন্মাদনায় শতধাছিন্ন হয় নাগরিক জীবনের সৌম্য-সৌন্দর্য ও শান্তির পরিবেশ।
উন্মাতাল উন্মাদনায় প্রজ্বলিত হাজার হাজার আতশবাজির গগনবিদারী শব্দ ও আলোর ঝলকানিতে সৃষ্টি হয় Localized Abnormal Carbon Density এবং যুদ্ধাবস্থার ন্যায় ভীতিকর পরিস্থিতি। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার গভীরে নিকটস্থ পাখি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য তৈরি করে অসহনীয় পরিবেশ। বাতাসে সৃষ্ট কার্বন ঘনত্বের মাত্রা হঠাৎ করেই প্রায় ২০-২৫ শতাংশ পরিমাণ বৃদ্ধি পায় মর্মে ধারণা করা হয়। আর এ অবস্থা শুধু পাখি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য নয়, হৃদ্রোগে আক্রান্ত, অসুস্থ ও বৃদ্ধ মানুষের জন্যও তা অতিক্রম করেছে সহ্যের সীমা।
দিনান্তের ক্লান্ত পাখিরা দিন শেষে ফিরে আসে নীড়ে। রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গে অকাতরে ঘুমিয়ে পার করে রাতের প্রহরগুলো। এমনই ঘুমন্ত পাখিদের রাতের ঘুমের সময় যুদ্ধাবস্থা পরিস্থিতির ন্যায় আতশবাজির আলো ও বিকট শব্দে হার্ট ফেল করেছে বহু পাখি, ডিমে তা দেওয়া পাখিরা প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে আহত ও নিহত হয়েছে হাজারো পাখি। ভীতবিহ্বল পাখিরা আর ফিরে আসেনি তার আবাসে, ফেরেনি তা দেওয়া ডিমের বাসায়। ফলে পাখি ও জীববৈচিত্র্যের সম্ভারে বিপর্যয় নেমে এসেছে উন্মাদনায় প্লাবিত নববর্ষে।
কুকুর, বিড়াল, বেজি, গুইসাপসহ নগর জীববৈচিত্র্যের উপাদান সমৃদ্ধ স্থিতিশীল ইকোসিস্টেম ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে মারাত্মকভাবে যা জনস্বাস্থ্য ও বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য মানব সৃষ্ট মহাবিপর্যয়। মানুষের অজ্ঞতাপ্রসূত অহংকারী জীবনাচরণে ফলশ্রুতিতে বিপন্ন হচ্ছে মানুষের সভ্যতা ও টিকে থাকার সম্ভাবনা।
নতুন বছরের আনন্দের উল্লাসে বিপর্যস্ত পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের চেতনাহীন উগ্রতা রোধ করতে হবে। বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের এ সর্বগ্রাসী আনন্দ উল্লাসের ধ্বংসাত্মক সংকীর্ণ কূপমণ্ডূকতা থেকে, উদার ও জীববৈচিত্র্য ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবীতে সবার নিরাপদ ও নিরুপদ্রব বসতির নিশ্চয়তা বিধান করার এখনই সময়।
লালমাটিয়া আবাসিক এলাকার গাছে গাছে প্রতি সন্ধ্যায় সমাবেশ হতো হাজার হাজার চড়ুই পাখিদের। সন্ধ্যায় চড়ুইদের ঝাঁক বেঁধে আগমন, ওড়াউড়ি, কিচিরমিচিরে সরগরম হয়ে উঠতো এলাকাটি। পথচারীসহ নানা বয়সী মানুষ উপভোগ করতেন এ অপার্থিব নান্দনিকতা। গতরাতে শব্দ দূষণ, আলোক দূষণ ও পরিবেশ দূষণের ফলশ্রুতিতে আজ আর একটিও পাখি ফিরে আসেনি সেই গাছে। এ দৃশ্য সমগ্র ঢাকাসহ নাগরিক বাস্তবতায়। গ্রামীণ পরিবেশেও এর অন্যথা হয়নি। সেখানেও চলেছে সর্বগ্রাসী আনন্দ উৎসবের নামে শব্দ দূষণ, আলো ও পরিবেশ দূষণ। সুপ্রিয় পরিবেশকর্মী Rup Kotha জানিয়েছে ভীতসন্ত্রস্ত পাখিদের কথা। বিকট শব্দ ও আলোক দূষণে সন্ত্রস্থ বহু পাখি গভীর রাতে প্রাণভয়ে ঢুকে পড়েছে তার বাসভবনের খোলা জানালা পথে। দিগ্বিদিকশূন্য এইসব পাখিরা আর নিজ আবাসে, সন্তানের সান্নিধ্যে ও ডিমওয়ালা বাসায় ফিরতে পারে না ভয়ে। ফলে তাদের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে।
ধ্বংসাত্মক উগ্রতা কোনো সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না। পশ্চিমা ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছন্নে যাওয়া সাংস্কৃতিকে আমাদের জাতীয় জীবনের আবহমানকালের প্রচলিত প্রথার বিপরীতে দাঁড় করানোর মধ্যে কোনো কল্যাণ আছে বলে মনে হয় না।
সুতরাং উগ্রতা ও জীববৈচিত্র্য বিধ্বংসী উন্মাদনা পরিহার করে আগামীতে সুস্থ আনন্দ, বিনোদনের মাধ্যমে জাতীয় মননের বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে সকলের এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আর এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে ভূমিকা রাখতে হবে নীতি নির্ধারক, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সমাজচিন্তক ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, তরুণ প্রজন্ম ও সামাজিক নেতৃবৃন্দকে। আগামীতে এ রকম পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিধ্বংসী উন্মাদনা ও আনন্দযজ্ঞ রোধ করতে হবে যেকোনো মূল্যে।
লেখক: মোল্যা রেজাউল করিম
বন সংরক্ষক
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল, বন অধিদপ্তর
বন ভবন, আগারগাঁও, ঢাকা
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
মোল্যা রেজাউল করিম | ২ জানুয়ারি, ২০২২ ১৬:০৩

ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে নতুন বছর নিয়ে আসে নতুনের বারতা। বিগত বছরের গ্লানি, ক্লেদ, পঙ্কিলতাকে পেছনে ফেলে নতুনভাবে বিশ্বকে ঢেলে সাজাতে আসে নতুন আরেকটা ক্যালেন্ডার- ২০২২।
নতুন বছর মানে সম্মুখের অনাগত দিনগুলোকে মঙ্গলময়তার পানে অপরিসীম প্রত্যাশার রঙে উপজীব্য করা। সেই প্রত্যাশা শুধু মানুষের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্ব পরিমণ্ডলে সুখের বারতা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রকৃতির অমূল্য অনুষঙ্গসমূহের সামগ্রিক ও সমন্বিত সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লক্ষ্য করলাম- গতকাল রাত ১২টা অতিক্রম করার সময়ে নগরসভ্যতায় ইংরেজি বর্ষবরণ তথা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ রূপান্তরিত হয় এক উন্মাতাল উন্মাদনায়। বিকট শব্দের গগনবিদারী আনন্দ লহরীতে যুক্ত হয় আতশবাজির নানা কারিশমা ও প্রতিযোগিতা। শান্ত নগরীর গহিন রাত্রি প্রহরের নীরবতাকে বিদীর্ণ করে আলোক ঝলমলে উন্মাদনায় শতধাছিন্ন হয় নাগরিক জীবনের সৌম্য-সৌন্দর্য ও শান্তির পরিবেশ।
উন্মাতাল উন্মাদনায় প্রজ্বলিত হাজার হাজার আতশবাজির গগনবিদারী শব্দ ও আলোর ঝলকানিতে সৃষ্টি হয় Localized Abnormal Carbon Density এবং যুদ্ধাবস্থার ন্যায় ভীতিকর পরিস্থিতি। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার গভীরে নিকটস্থ পাখি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য তৈরি করে অসহনীয় পরিবেশ। বাতাসে সৃষ্ট কার্বন ঘনত্বের মাত্রা হঠাৎ করেই প্রায় ২০-২৫ শতাংশ পরিমাণ বৃদ্ধি পায় মর্মে ধারণা করা হয়। আর এ অবস্থা শুধু পাখি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য নয়, হৃদ্রোগে আক্রান্ত, অসুস্থ ও বৃদ্ধ মানুষের জন্যও তা অতিক্রম করেছে সহ্যের সীমা।
দিনান্তের ক্লান্ত পাখিরা দিন শেষে ফিরে আসে নীড়ে। রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গে অকাতরে ঘুমিয়ে পার করে রাতের প্রহরগুলো। এমনই ঘুমন্ত পাখিদের রাতের ঘুমের সময় যুদ্ধাবস্থা পরিস্থিতির ন্যায় আতশবাজির আলো ও বিকট শব্দে হার্ট ফেল করেছে বহু পাখি, ডিমে তা দেওয়া পাখিরা প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে আহত ও নিহত হয়েছে হাজারো পাখি। ভীতবিহ্বল পাখিরা আর ফিরে আসেনি তার আবাসে, ফেরেনি তা দেওয়া ডিমের বাসায়। ফলে পাখি ও জীববৈচিত্র্যের সম্ভারে বিপর্যয় নেমে এসেছে উন্মাদনায় প্লাবিত নববর্ষে।
কুকুর, বিড়াল, বেজি, গুইসাপসহ নগর জীববৈচিত্র্যের উপাদান সমৃদ্ধ স্থিতিশীল ইকোসিস্টেম ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে মারাত্মকভাবে যা জনস্বাস্থ্য ও বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য মানব সৃষ্ট মহাবিপর্যয়। মানুষের অজ্ঞতাপ্রসূত অহংকারী জীবনাচরণে ফলশ্রুতিতে বিপন্ন হচ্ছে মানুষের সভ্যতা ও টিকে থাকার সম্ভাবনা।
নতুন বছরের আনন্দের উল্লাসে বিপর্যস্ত পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের চেতনাহীন উগ্রতা রোধ করতে হবে। বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের এ সর্বগ্রাসী আনন্দ উল্লাসের ধ্বংসাত্মক সংকীর্ণ কূপমণ্ডূকতা থেকে, উদার ও জীববৈচিত্র্য ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবীতে সবার নিরাপদ ও নিরুপদ্রব বসতির নিশ্চয়তা বিধান করার এখনই সময়।
লালমাটিয়া আবাসিক এলাকার গাছে গাছে প্রতি সন্ধ্যায় সমাবেশ হতো হাজার হাজার চড়ুই পাখিদের। সন্ধ্যায় চড়ুইদের ঝাঁক বেঁধে আগমন, ওড়াউড়ি, কিচিরমিচিরে সরগরম হয়ে উঠতো এলাকাটি। পথচারীসহ নানা বয়সী মানুষ উপভোগ করতেন এ অপার্থিব নান্দনিকতা। গতরাতে শব্দ দূষণ, আলোক দূষণ ও পরিবেশ দূষণের ফলশ্রুতিতে আজ আর একটিও পাখি ফিরে আসেনি সেই গাছে। এ দৃশ্য সমগ্র ঢাকাসহ নাগরিক বাস্তবতায়। গ্রামীণ পরিবেশেও এর অন্যথা হয়নি। সেখানেও চলেছে সর্বগ্রাসী আনন্দ উৎসবের নামে শব্দ দূষণ, আলো ও পরিবেশ দূষণ। সুপ্রিয় পরিবেশকর্মী Rup Kotha জানিয়েছে ভীতসন্ত্রস্ত পাখিদের কথা। বিকট শব্দ ও আলোক দূষণে সন্ত্রস্থ বহু পাখি গভীর রাতে প্রাণভয়ে ঢুকে পড়েছে তার বাসভবনের খোলা জানালা পথে। দিগ্বিদিকশূন্য এইসব পাখিরা আর নিজ আবাসে, সন্তানের সান্নিধ্যে ও ডিমওয়ালা বাসায় ফিরতে পারে না ভয়ে। ফলে তাদের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে।
ধ্বংসাত্মক উগ্রতা কোনো সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না। পশ্চিমা ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছন্নে যাওয়া সাংস্কৃতিকে আমাদের জাতীয় জীবনের আবহমানকালের প্রচলিত প্রথার বিপরীতে দাঁড় করানোর মধ্যে কোনো কল্যাণ আছে বলে মনে হয় না।
সুতরাং উগ্রতা ও জীববৈচিত্র্য বিধ্বংসী উন্মাদনা পরিহার করে আগামীতে সুস্থ আনন্দ, বিনোদনের মাধ্যমে জাতীয় মননের বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে সকলের এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আর এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে ভূমিকা রাখতে হবে নীতি নির্ধারক, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সমাজচিন্তক ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, তরুণ প্রজন্ম ও সামাজিক নেতৃবৃন্দকে। আগামীতে এ রকম পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিধ্বংসী উন্মাদনা ও আনন্দযজ্ঞ রোধ করতে হবে যেকোনো মূল্যে।
লেখক: মোল্যা রেজাউল করিম
বন সংরক্ষক
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল, বন অধিদপ্তর
বন ভবন, আগারগাঁও, ঢাকা