‘অসামাজিক কার্যকলাপ’, সংবিধান ও স্বাধীনতা
রিপন দে | ১৮ মার্চ, ২০২২ ১৯:০৩
কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীরা আড্ডা দেবে, খুনসুটি করবে, প্রেম করবে, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা করবে এটা অলিখিত চিরাচরিত নিয়ম। এর বাইরে সেখানে যদি ড্রেস কোডসহ অভ্যন্তরীণ কোনো নিয়ম থাকে সেটা কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীর মতামত নিয়ে কার্যকর করতে পারবে।
কলেজ ক্যাম্পাসের আড্ডাগুলো সহপাঠীদের মধ্যে বন্ধন শক্ত করে। সমাজের মানুষের চিন্তাকে জানতে সহযোগিতা করে। লেখাপড়া যদি পুস্তক রিলেটেড হতো বাড়িতে বসেও শুধু পরীক্ষা দিয়ে পাস করা যেত। কিন্তু পরীক্ষার বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত যাওয়া, রুটিন জীবন, নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে নিজেকে শেয়ার করাটাও বড় একটা শেখা। যা হাতে কলমে না হলেও জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে বর্তমানে তরুণ তরুণীরা আর আগের মত আড্ডা দেয় না, খেলাধুলা করে না সংস্কৃতি চর্চা করে না সবাই ডুবে থাকে স্মার্টফোনের ডিভাইসে এটা প্রায়ই শোনা যায়। এতে ডিপ্রেশনসহ নানা সমস্যার কথা সংবাদের পাতা জুড়ে থাকে। এমনিতেই এই দেশে বিনোদনের বড় অভাব। সুস্থ মন মানসিকতার অভাবে অনেক তরুণ তরুণীকে আমরা উগ্রবাদের জড়িয়ে যেতে দেখেছি।
ঠিক এই সময়ে কিছুদিন পরপর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পার্কে বসে আড্ডা দিলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, প্রেমিক প্রেমিকাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে ঘুরলেও মাঝেমধ্যে কাবিন দেখতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশের সংবিধান যেকারো সঙ্গে আড্ডা, ঘোরাঘুরির সুযোগ দিয়েছে। পুলিশে দায়িত্ব- আমি যেন আমার স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারি সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। কিন্তু এ দেশে ঘটে উল্টোটা। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ রাজারবাগে করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ।
সর্বশেষ পুলিশের একটি ঘটনা পূর্বের সবকিছু ছাপিয়েছে, জাতির পিতার জন্মদিনের প্রস্তুতি যখন নিচ্ছে সারা দেশ ঠিক তখন অর্থাৎ ১৫ তারিখ সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে আড্ডা দেওয়ার সময় ৪ প্রেমিক জুটিসহ ১১ জনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
‘অসামাজিক কার্যকলাপের’ তথাকথিত অভিযোগ এনে ক্যাম্পাস থেকে তাদের আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ধরে নিয়ে গেলেও জানানো হয়নি কলেজের অধ্যক্ষকে। (সূত্র: নিউজ বাংলা)
তাদের অপরাধ তারা কলেজ ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। এই আড্ডা যেকারো ছাত্রজীবনের একটি অংশ। মানসিকভাবে অসুস্থ ছাড়া কেউ এর বিপক্ষে আছে বলে মনে করি না।
সুনামগঞ্জ থানা-পুলিশের এমন কাণ্ড নিয়ে চলছে সমালোচনা। পুলিশের এমন আচরণকে বেআইনিও বলছেন আইনজীবীরা। তরুণ-তরুণীদের হয়রানির জন্য সুনামগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের দাবিও উঠেছে।
প্রকাশিত সংবাদে গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য করেছেন সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান আহমদ সেলিম। তিনি বলেছেন, ‘এই ঘটনা সভ্য সমাজের দাবিদার কেউ করতে পারে না। ক্যাম্পাসে দিনে ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেবে, খুনসুটি করবে- এটাই সৌন্দর্য। প্রেম করার অভিযোগে তাদের থানায় নেয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। পুলিশের উচিত অপরাধ দমনে মনোনিবেশ করা, প্রেম ঠেকানো তাদের কাজ না।’
এর আগেও এমন বিতর্কিত ঘটনা এবং নাগরিকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে দেখা গেছে সুনামগঞ্জের পুলিশসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। চুল কাটা থেকে শুরু করে কে কখন ঘর থেকে বের হবে, ছাত্রছাত্রীরা কোথায় বসে আড্ডা দেবে সবকিছুতেই তাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। কিন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশে- সন্ত্রাস, ছিনতাই, মাদক একটি বড় সমস্যা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণ। লাইসেন্সবিহীন, কাগজপত্রবিহীন লাখ লাখ যানবাহন চলছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে যান চলাচলে সড়কে অবিরত মারা যাচ্ছে মানুষ। সাগর-রুনিসহ বিভিন্ন জটিল মামলার জট খুলতে না পারা পুলিশ এখন আবির্ভূত অপরাধ বিজ্ঞানী হিসেবে।
২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট প্রকাশিত একটি সংবাদের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জে রাত ৯টার মধ্যে সব চায়ের দোকান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার। উদ্দেশ্য ছিল বখাটেদের দৌরাত্ম্য কমাবেন। মাঝেমধ্যে খবর শিরোনাম হয়েছে, পুলিশ চুল কাটার নিয়ম করে দিয়েছে কিছু এলাকায়।
একটি স্বাধীন দেশে ছাত্রছাত্রীরা তার ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিতে পারবে না। প্রেমিক প্রেমিকেরা আড্ডা দিতে পারবে না? পুলিশ ঠিক করে দেবে কে কীভাবে চুল কাটবে, কয়টার পর চায়ের দোকান খোলা থাকবে সেটা কী গণতন্ত্রে পড়ে? সামরিক শাসনে মন স্বেচ্ছাচারী হতেই পারে। যেমন পৃথিবীর বুকে অন্যতম স্বৈরশাসনের দেশ উত্তর কোরিয়ায় পুরুষেরা চুল ৫ সেন্টিমিটারের বেশি লম্বা করতে পারেন না। নারীরা ১৪ ধরনের ‘হেয়ার কাট’ থেকে নিজের পছন্দেরটি বেছে নেন।
নাগরিকের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া সেটাও তো অপরাধ?
বাংলাদেশের সংবিধানে, আইনে, বিধিবিধান কোনো কিছুতেই ব্যক্তির চলাচল, ক্যাম্পাস আড্ডা বা বেশভূষার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়ে কিছু বলা নেই। পুলিশ, প্রশাসন কাউকে এমন অধিকার দেওয়া হয়নি। এটা যার যার স্বাধীনতা। এখানে বাধা দিতে গেলে সেটি হবে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
ইভটিজিং প্রতিরোধে ফ্যাশনেবল চুল-দাড়ি ছাটার ওপর নির্দেশনা প্রথম এসেছিল ২০১৯ এর মার্চে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায়। এরপর সিলেটের কানাইঘাট বাজারের সেলুন ব্যবসায়ীদের নিয়ে এক বৈঠকে একই নির্দেশনা দিয়ে পুলিশ। এ ছাড়া ঝালকাঠি, ঢাকার সাভার এবং মাগুরা জেলা পুলিশও সেলুন মালিকদের ‘বখাটে স্টাইলে’ চুল কাটা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিল প্রশাসন। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে মাগুরায় মাইকিংও করা হয়। বাঘা উপজেলার নির্দেশনাটি ইউএনও-এর পক্ষ থেকে দেওয়া হলেও বাকি সব নির্দেশনা এসেছে পুলিশের থেকে।
যদিও এমন প্রতিটি ঘটনার পরেই পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলেন। কিন্তু কি খতিয়ে দেখিয়েছিল বা কি পেয়েছিলেন অথবা নাগরিকের স্বাধীনতার হস্তক্ষেপের জন্য কারো শাস্তি হয়েছিল কিনা জানা নেই। তবে সর্বশেষ সুনামগঞ্জে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি খুবই ভয়ংকর এবং বড় একটি সংকেত। ‘তালেবানি রাষ্ট্র ব্যবস্থা’ আর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে তফাত তা কি আমরা উপভোগ করব না। যে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ প্রাণ গেলো তার মূল্য আমরা দেব না?
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এই প্রশ্ন করতে হচ্ছে বা কেউ কেউ ভাবছেন এটা কি রাষ্ট্রের জন্য লজ্জার না? মাইক বাজিয়ে বা কেক কেটে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করা যাবে? নাকি যে মহামানব আজন্ম মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে গেলেন, বুকের তারা রক্ষা দিয়ে গেলেন তার সেই আদর্শকে সরকারের বাহিনীর মধ্যে আজও ছড়িয়ে দেওয়া গেলো না এবং স্বাধীন দেশের পুলিশ জানে না স্বাধীনতা কি সে আফসোস নিয়ে আমাদের চলতে হবে?
আমাদের এই স্বাধীনতার বিষয়টি যারা নিশ্চিত করবেন সেই পুলিশের কিছু কর্মকর্তা নিজেই ব্যক্তিস্বাধীনতা অ-নিশ্চিত করছেন। যেহেতু দেশে মশা মারা থেকে আসামি গ্রেপ্তার পর্যন্ত সবকিছুর জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের অপেক্ষা করি- তাই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের শাসন ব্যবস্থাকে স্বৈরশাসনের রূপ দিয়ে যারা পুরো শাসনব্যবস্থাকে বিতর্কিত করতে চায় তাদের ব্যাপারে এখনই সচেতন হওয়া উচিত। তারা ধর্ম নিরপেক্ষ সরকারের শাসন ব্যবস্থাকে তালেবানি শাসন ব্যবস্থায় রূপ দিতে চায় সেই সব প্রেতাত্মাদের শাস্তি দেওয়া উচিত এতে অন্যদের কাছে বার্তা যাবে নয়তো দিন দিন তা বাড়তেই থাকবে।
এদের কারণে তরুণদের মনে গণতান্ত্রিক একটি দেশকে স্বৈরশাসন হিসেবে দাগ কাটবে যা সরকারের বদনাম। কারণ সবকিছুর পর সাধারণের চোখে সব দায় সহজেই যায় সরকারের ওপর।
দেশে সুস্থ বিনোদন নেই, লাইব্রেরি নেই। প্রতি বছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জিপিএ-৫ কিন্তু শিক্ষিত নাই। কারণ লাইব্রেরি কই? যারা টুকটাক পড়েন তারাও শুধু বিসিএস আর চাকরির প্রতিযোগিতায় নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে পড়ছেন।
এই সব ঘটনায় বরং কিছু মানুষের জীবনহানি ঘটতে পারে। যাদের ধরে নিয়ে গেলেন সমাজের কিছু মানুষের চোখে তাদের অপরাধী বানিয়ে দিয়ে গেলেন। পরিবার তাদের মানসিক টর্চার করতে পারে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অপমান অবহেলায় যদি এদের কেউ আত্মহত্যা করে এর দায় কি পুলিশ নেবে?
আত্মহত্যা করা এখনকার তরুণ তরুণীদের মধ্যে কঠিন কিছু না কারণ তারা প্রচণ্ড জেদ রাখে। আর এমন একটি ঘটনা যা সমাজ পরিবার প্রতিষ্ঠান সবকিছুতে থাকে বিতর্কিত করবে নিশ্চয় সেই চাপ নেওয়ার মত শক্তি তাদের এক দুজনের না থাকাও অস্বাভাবিক নয়।
পুলিশ সম্পর্কে তরুণদের মনে ভালো ধারণা নেই। এসব ঘটনা আরো নেতিবাচক চিন্তার জন্ম দেবে। বরং নিজেদের পেশাগত যে বদনাম সাধারণের মাঝে রটিয়ে আছে তা ভাঙার চেষ্টা করুন। পুলিশ জনতার বন্ধু এই কথাটা কাগজে না রেখে বাস্তবে প্রয়োগ করুন। এমন ঘটনাগুলো এখন থামিয়ে দিতে সুনামগঞ্জের ওসি, এসপির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।
লেখক: সাংবাদিক
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
রিপন দে | ১৮ মার্চ, ২০২২ ১৯:০৩

কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীরা আড্ডা দেবে, খুনসুটি করবে, প্রেম করবে, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা করবে এটা অলিখিত চিরাচরিত নিয়ম। এর বাইরে সেখানে যদি ড্রেস কোডসহ অভ্যন্তরীণ কোনো নিয়ম থাকে সেটা কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীর মতামত নিয়ে কার্যকর করতে পারবে।
কলেজ ক্যাম্পাসের আড্ডাগুলো সহপাঠীদের মধ্যে বন্ধন শক্ত করে। সমাজের মানুষের চিন্তাকে জানতে সহযোগিতা করে। লেখাপড়া যদি পুস্তক রিলেটেড হতো বাড়িতে বসেও শুধু পরীক্ষা দিয়ে পাস করা যেত। কিন্তু পরীক্ষার বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত যাওয়া, রুটিন জীবন, নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে নিজেকে শেয়ার করাটাও বড় একটা শেখা। যা হাতে কলমে না হলেও জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে বর্তমানে তরুণ তরুণীরা আর আগের মত আড্ডা দেয় না, খেলাধুলা করে না সংস্কৃতি চর্চা করে না সবাই ডুবে থাকে স্মার্টফোনের ডিভাইসে এটা প্রায়ই শোনা যায়। এতে ডিপ্রেশনসহ নানা সমস্যার কথা সংবাদের পাতা জুড়ে থাকে। এমনিতেই এই দেশে বিনোদনের বড় অভাব। সুস্থ মন মানসিকতার অভাবে অনেক তরুণ তরুণীকে আমরা উগ্রবাদের জড়িয়ে যেতে দেখেছি।
ঠিক এই সময়ে কিছুদিন পরপর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পার্কে বসে আড্ডা দিলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, প্রেমিক প্রেমিকাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে ঘুরলেও মাঝেমধ্যে কাবিন দেখতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশের সংবিধান যেকারো সঙ্গে আড্ডা, ঘোরাঘুরির সুযোগ দিয়েছে। পুলিশে দায়িত্ব- আমি যেন আমার স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারি সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। কিন্তু এ দেশে ঘটে উল্টোটা। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ রাজারবাগে করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ।
সর্বশেষ পুলিশের একটি ঘটনা পূর্বের সবকিছু ছাপিয়েছে, জাতির পিতার জন্মদিনের প্রস্তুতি যখন নিচ্ছে সারা দেশ ঠিক তখন অর্থাৎ ১৫ তারিখ সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে আড্ডা দেওয়ার সময় ৪ প্রেমিক জুটিসহ ১১ জনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
‘অসামাজিক কার্যকলাপের’ তথাকথিত অভিযোগ এনে ক্যাম্পাস থেকে তাদের আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ধরে নিয়ে গেলেও জানানো হয়নি কলেজের অধ্যক্ষকে। (সূত্র: নিউজ বাংলা)
তাদের অপরাধ তারা কলেজ ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। এই আড্ডা যেকারো ছাত্রজীবনের একটি অংশ। মানসিকভাবে অসুস্থ ছাড়া কেউ এর বিপক্ষে আছে বলে মনে করি না।
সুনামগঞ্জ থানা-পুলিশের এমন কাণ্ড নিয়ে চলছে সমালোচনা। পুলিশের এমন আচরণকে বেআইনিও বলছেন আইনজীবীরা। তরুণ-তরুণীদের হয়রানির জন্য সুনামগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের দাবিও উঠেছে।
প্রকাশিত সংবাদে গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য করেছেন সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান আহমদ সেলিম। তিনি বলেছেন, ‘এই ঘটনা সভ্য সমাজের দাবিদার কেউ করতে পারে না। ক্যাম্পাসে দিনে ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেবে, খুনসুটি করবে- এটাই সৌন্দর্য। প্রেম করার অভিযোগে তাদের থানায় নেয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। পুলিশের উচিত অপরাধ দমনে মনোনিবেশ করা, প্রেম ঠেকানো তাদের কাজ না।’
এর আগেও এমন বিতর্কিত ঘটনা এবং নাগরিকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে দেখা গেছে সুনামগঞ্জের পুলিশসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। চুল কাটা থেকে শুরু করে কে কখন ঘর থেকে বের হবে, ছাত্রছাত্রীরা কোথায় বসে আড্ডা দেবে সবকিছুতেই তাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। কিন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশে- সন্ত্রাস, ছিনতাই, মাদক একটি বড় সমস্যা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণ। লাইসেন্সবিহীন, কাগজপত্রবিহীন লাখ লাখ যানবাহন চলছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে যান চলাচলে সড়কে অবিরত মারা যাচ্ছে মানুষ। সাগর-রুনিসহ বিভিন্ন জটিল মামলার জট খুলতে না পারা পুলিশ এখন আবির্ভূত অপরাধ বিজ্ঞানী হিসেবে।
২০১৯ সালের ৩১ আগস্ট প্রকাশিত একটি সংবাদের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জে রাত ৯টার মধ্যে সব চায়ের দোকান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার। উদ্দেশ্য ছিল বখাটেদের দৌরাত্ম্য কমাবেন। মাঝেমধ্যে খবর শিরোনাম হয়েছে, পুলিশ চুল কাটার নিয়ম করে দিয়েছে কিছু এলাকায়।
একটি স্বাধীন দেশে ছাত্রছাত্রীরা তার ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিতে পারবে না। প্রেমিক প্রেমিকেরা আড্ডা দিতে পারবে না? পুলিশ ঠিক করে দেবে কে কীভাবে চুল কাটবে, কয়টার পর চায়ের দোকান খোলা থাকবে সেটা কী গণতন্ত্রে পড়ে? সামরিক শাসনে মন স্বেচ্ছাচারী হতেই পারে। যেমন পৃথিবীর বুকে অন্যতম স্বৈরশাসনের দেশ উত্তর কোরিয়ায় পুরুষেরা চুল ৫ সেন্টিমিটারের বেশি লম্বা করতে পারেন না। নারীরা ১৪ ধরনের ‘হেয়ার কাট’ থেকে নিজের পছন্দেরটি বেছে নেন।
নাগরিকের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া সেটাও তো অপরাধ?
বাংলাদেশের সংবিধানে, আইনে, বিধিবিধান কোনো কিছুতেই ব্যক্তির চলাচল, ক্যাম্পাস আড্ডা বা বেশভূষার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়ে কিছু বলা নেই। পুলিশ, প্রশাসন কাউকে এমন অধিকার দেওয়া হয়নি। এটা যার যার স্বাধীনতা। এখানে বাধা দিতে গেলে সেটি হবে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
ইভটিজিং প্রতিরোধে ফ্যাশনেবল চুল-দাড়ি ছাটার ওপর নির্দেশনা প্রথম এসেছিল ২০১৯ এর মার্চে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায়। এরপর সিলেটের কানাইঘাট বাজারের সেলুন ব্যবসায়ীদের নিয়ে এক বৈঠকে একই নির্দেশনা দিয়ে পুলিশ। এ ছাড়া ঝালকাঠি, ঢাকার সাভার এবং মাগুরা জেলা পুলিশও সেলুন মালিকদের ‘বখাটে স্টাইলে’ চুল কাটা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিল প্রশাসন। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে মাগুরায় মাইকিংও করা হয়। বাঘা উপজেলার নির্দেশনাটি ইউএনও-এর পক্ষ থেকে দেওয়া হলেও বাকি সব নির্দেশনা এসেছে পুলিশের থেকে।
যদিও এমন প্রতিটি ঘটনার পরেই পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলেন। কিন্তু কি খতিয়ে দেখিয়েছিল বা কি পেয়েছিলেন অথবা নাগরিকের স্বাধীনতার হস্তক্ষেপের জন্য কারো শাস্তি হয়েছিল কিনা জানা নেই। তবে সর্বশেষ সুনামগঞ্জে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি খুবই ভয়ংকর এবং বড় একটি সংকেত। ‘তালেবানি রাষ্ট্র ব্যবস্থা’ আর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে তফাত তা কি আমরা উপভোগ করব না। যে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ প্রাণ গেলো তার মূল্য আমরা দেব না?
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এই প্রশ্ন করতে হচ্ছে বা কেউ কেউ ভাবছেন এটা কি রাষ্ট্রের জন্য লজ্জার না? মাইক বাজিয়ে বা কেক কেটে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করা যাবে? নাকি যে মহামানব আজন্ম মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে গেলেন, বুকের তারা রক্ষা দিয়ে গেলেন তার সেই আদর্শকে সরকারের বাহিনীর মধ্যে আজও ছড়িয়ে দেওয়া গেলো না এবং স্বাধীন দেশের পুলিশ জানে না স্বাধীনতা কি সে আফসোস নিয়ে আমাদের চলতে হবে?
আমাদের এই স্বাধীনতার বিষয়টি যারা নিশ্চিত করবেন সেই পুলিশের কিছু কর্মকর্তা নিজেই ব্যক্তিস্বাধীনতা অ-নিশ্চিত করছেন। যেহেতু দেশে মশা মারা থেকে আসামি গ্রেপ্তার পর্যন্ত সবকিছুর জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের অপেক্ষা করি- তাই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের শাসন ব্যবস্থাকে স্বৈরশাসনের রূপ দিয়ে যারা পুরো শাসনব্যবস্থাকে বিতর্কিত করতে চায় তাদের ব্যাপারে এখনই সচেতন হওয়া উচিত। তারা ধর্ম নিরপেক্ষ সরকারের শাসন ব্যবস্থাকে তালেবানি শাসন ব্যবস্থায় রূপ দিতে চায় সেই সব প্রেতাত্মাদের শাস্তি দেওয়া উচিত এতে অন্যদের কাছে বার্তা যাবে নয়তো দিন দিন তা বাড়তেই থাকবে।
এদের কারণে তরুণদের মনে গণতান্ত্রিক একটি দেশকে স্বৈরশাসন হিসেবে দাগ কাটবে যা সরকারের বদনাম। কারণ সবকিছুর পর সাধারণের চোখে সব দায় সহজেই যায় সরকারের ওপর।
দেশে সুস্থ বিনোদন নেই, লাইব্রেরি নেই। প্রতি বছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জিপিএ-৫ কিন্তু শিক্ষিত নাই। কারণ লাইব্রেরি কই? যারা টুকটাক পড়েন তারাও শুধু বিসিএস আর চাকরির প্রতিযোগিতায় নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে পড়ছেন।
এই সব ঘটনায় বরং কিছু মানুষের জীবনহানি ঘটতে পারে। যাদের ধরে নিয়ে গেলেন সমাজের কিছু মানুষের চোখে তাদের অপরাধী বানিয়ে দিয়ে গেলেন। পরিবার তাদের মানসিক টর্চার করতে পারে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অপমান অবহেলায় যদি এদের কেউ আত্মহত্যা করে এর দায় কি পুলিশ নেবে?
আত্মহত্যা করা এখনকার তরুণ তরুণীদের মধ্যে কঠিন কিছু না কারণ তারা প্রচণ্ড জেদ রাখে। আর এমন একটি ঘটনা যা সমাজ পরিবার প্রতিষ্ঠান সবকিছুতে থাকে বিতর্কিত করবে নিশ্চয় সেই চাপ নেওয়ার মত শক্তি তাদের এক দুজনের না থাকাও অস্বাভাবিক নয়।
পুলিশ সম্পর্কে তরুণদের মনে ভালো ধারণা নেই। এসব ঘটনা আরো নেতিবাচক চিন্তার জন্ম দেবে। বরং নিজেদের পেশাগত যে বদনাম সাধারণের মাঝে রটিয়ে আছে তা ভাঙার চেষ্টা করুন। পুলিশ জনতার বন্ধু এই কথাটা কাগজে না রেখে বাস্তবে প্রয়োগ করুন। এমন ঘটনাগুলো এখন থামিয়ে দিতে সুনামগঞ্জের ওসি, এসপির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।
লেখক: সাংবাদিক