
শেখ রাসেলের প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছিল ১১ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই। আরও দুর্ভাগ্য, দশকের পর দশক এ নিষ্ঠুরতার জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করানো যায়নি। কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন জারি করে বন্ধ রাখা হয়েছিল বিচার প্রক্রিয়া। ঘাতকরা বড় গলায় বলত- বিচার করা যাবে না, ইনডেমনিটি আছে যে!
সাধারণত এ বয়সের কোনো শিশুর পক্ষে এমন কোনো মহৎ কীর্তি রেখে যাওয়া সম্ভব হয় না, যা তাকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করতে রাখতে পারে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর প্রায় চার যুগ পরও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র কোটি কোটি মানুষের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। আমরা এটাও বলতে পারি-১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির এ শিক্ষার্থীর বয়স একটি স্থানে স্থির হয়ে থাকলেও তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে এবং অনেক অনেক দেশে।
শেখ রাসেলের সঙ্গে তার স্কুলের আরও দু’জন শিক্ষার্থী বেবি সেরনিয়াবাত ও আরিফ সেরনিয়াবাত ১৫ আগস্টে নিহত হন। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান একটি ওয়ার্কশপে বলেছেন, অনেক পরে জানা গেছে নিহত এ দু’জন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং সে সময়ে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা ও পুত্র। কন্যা পড়তেন নবম শ্রেণিতে, পুত্র চতুর্থ শ্রেণিতে শেখ রাসেলের সহপাঠী। শেখ রাসেলের গৃহশিক্ষক গীতালি দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, ১৪ আগস্ট তার প্রিয় ছাত্র গিয়েছিল আরিফ সেরনিয়াবাতের বাসায়। সেখান থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বরের বাসায় পিতা বঙ্গবন্ধুকে টিএন্ডটি ফোনে জানিয়েছিল-পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাবেন। এ সময় কিছুক্ষণ রাসেলের স্কুলের সামনে দাঁড়াবেন। স্কুলের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরকে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানাবে। এই দলে তাকেও রাখা হয়েছে। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ফুল তুলে দেওয়া হবে সেটা নিয়েই শিক্ষয়িত্রীর কাছে পরামর্শ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু তার পিতা। কিন্তু পুত্র হিসেবে নয়, সে তো অভ্যর্থনা জানাবে বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে। এ অভিজ্ঞতা নেই তার। তাই প্রিয় শিক্ষকের পরামর্শ নিতেই হবে।
বঙ্গবন্ধুও রাসেলের শিক্ষয়িত্রীকে জানালেন, ‘মাস্টর’ (তিনি এভাবেই গীতালি দাশগুপ্তকে সম্বোধন করতেন), তোমার ছুটি হতে দেরি আছে।
রাসেল বেশ রাত করে ফিরে এলো আরিফ সেরনিয়াবাতের বেইলি রোডের বাসা থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায়। পরদিন দু’জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরকে স্বাগত জানাবে। দারুণ রোমাঞ্চিত তারা। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই দু’জনের প্রাণ কেড়ে নিল নিষ্ঠুর ঘাতক দল। তাদের কাছাকাছি বয়সী সুকান্ত বাবুকেও ঘাতকরা হত্যা করেছিল। সে ছিল মা শাহানারা আবদুল্লাহর বুকে। বঙ্গবন্ধুর আরেক বোনের পুত্র শেখ ফজলুল হক মণির স্ত্রী আরজু মণি ছিলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা। তাদের দু’জনকে হত্যা করা হয়। এ সময় আরজু মণি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই ঝরে পড়েছিল একটি প্রাণ!
বেবি, রাসেল, সুকান্ত বাবু ও আরিফের মতো বাংলাদেশের শিশুরা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিনামূল্যে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই পাচ্ছে। আমার নিজের কথা বলতে পারি-এখন থেকে সাড়ে পাঁচ দশকেরও বেশি আগে যখন বিদ্যালয়ে পড়েছি, আমার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থী পাঠ্যবই পেত বিদ্যালয়ের বড় ‘ভাই-বোনদের’ কাছ থেকে। বার্ষিক পরীক্ষার আগেই তাদের কাছে বইয়ের কথা বলে রাখা হতো। নতুন বই কেনার সামর্থ্য অনেক পরিবারের ছিল না। রাসেল-আরিফ-বেবির বড় বোন শেখ হাসিনা দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে এ সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান এনে দিয়েছেন। শিক্ষা বছরের প্রথম দিনেই শ্রেণি-পেশা-আর্থিক অবস্থান নির্বিশেষে সবার হাতে পৌঁছে যাচ্ছে ঝকঝকে নতুন বই।
এভাবেই আমরা ১৫ আগস্ট নিহত বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের স্মরণ করে চলেছি। শেখ রাসেলের নামে এখন একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের যে সুবিধা এখন শহর-গ্রামের শিক্ষার্থীরা হাতের নাগালে পাচ্ছে, তার কয়েকটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে তার নাম। বরিশালের গৈলা গ্রামে আরিফ সেরনিয়াবাতের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিদ্যালয়। গৈলা সরকারি বিদ্যালয়ের একটি ভবনের নামকরণ হয়েছে সুকান্ত বাবুর নামে। বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ে ছাত্রীরা চমৎকার ফুটবল খেলছে। সুস্থ্য-সবল দেহমনে যেন শিশুরা যেন বেড়ে ওঠে সেজন্য এ ধরনের অনেক কাজ আমাদের করে যেতে হবে। কেবল রাষ্ট্রীয়ভাবে নয়, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উদ্যোগও চাই। শিক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দ ক্রমাগত বাড়ছে। বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে চালু হচ্ছে ডিজিটাল ল্যাবরেটরি। করোনাকালে এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে শিক্ষাদান সম্ভব হয়েছে। পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। তবে ডিজিটাল সুবিধার অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে মানসম্পন্ন প্রযুক্তি সরবরাহ। একইসঙ্গে চাই দক্ষ জনবল। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা যায়, কম্পিউটার অচল হয়ে পড়ে আছে। দক্ষ কর্মী না থাকায় মূল্যবান সরঞ্জাম সময়মতো আপডেট করা হয় না। কেবল শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, শিক্ষক এবং ব্যবস্থাপনা কর্মীদের জন্যও এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানী ঢাকা কিংবা দেশের অন্য কোনো প্রান্তে এমনকি দেশের বাইরে থাকা যে কোনো গুণি ব্যক্তি ডিজিটাল সুবিধা কাজে লাগিয়ে একসঙ্গে এমনকি কয়েক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। কিন্তু এ সময়ে যদি বিদ্যালয়ের কম্পিউটার-ল্যাপটপ হ্যাঙ হয়ে পড়ে? ইন্টারনেট সুবিধা কাজ না করে?
বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে খেলাধূলার প্রসার ঘটিয়েও আমরা শেখ রাসেল-সুকান্ত-বেবি-আরিফদের স্মরণ করতে পারি। ১৫ আগস্ট নিহত হয়েছিলেন সুলতানা কামাল। তিনি ছিলেন দৌড়-লাফসহ কয়েক ধরনের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সেরা খেলায়াড়দের সামনের সারিতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত হওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে এমএ শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তার বিয়ে হয়েছিল আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের সঙ্গে। খেলাধূলার বাইরেও নাটক-সঙ্গীতসহ অনেক বিষয়ে অপরিসীম আগ্রহ-উৎসাহ ছিল শেখ কামালের। ছাত্র আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। আমরা একসঙ্গে জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে কাজ করেছি। কিন্তু পদ-পদবীতে তার উৎসাহ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিতা শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা, অপর কন্যা শেখ রেহানা ও কনিষ্ঠ পুত্র রাসেলসহ বন্দী। এ সময়েই ভূমিষ্ট হয় শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। জন্মলগ্ন থেকেই সেও বন্দী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। এমন কঠিন সময়েই বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল শত্রুবাহিনীর নজর এড়িয়ে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করতে। তারা যোগ দিলেন মুক্তিবাহিনীতে। কিশোর-তরুণ-তরুণীদের কাছে কাছে এরাই যে আইডল। নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের কথা জানাতে হবে।
বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের অতুলন সাহস ও বীরত্বের কথা তুলে ধরার জন্য আয়োজন করা যেতে পারে কুইজ ও গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা। আয়োজন এমন হওয়া চাই, যেন অংশ নিতে পারে প্রতিটি শিক্ষার্থী।
নানা ধরনের খেলাধূলার আয়োজন করেও আমরা শেখ রাসেলদের স্মরণ করতে পারি। একদল খেলবে, অন্যরা দেখবে- এমনটি হয়েই থাকে। কিন্তু সুস্থ্য-সবল দেহমনে শিশুরা বেড়ে না উঠলে তারা পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারবে না। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে পারবে না। এভাবে তাদের বেড়ে ওঠার জন্য মাঠে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। সাঁতার, দৌড়, লাফ, হা ডু ডু- এ ধরনের অনেক খেলায় খুব একটা অর্থ ব্যয় হয় না। বিদ্যালয়ে খেলাধূলায় সহায়তার জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় যোগ্য ব্যক্তিরা নিয়োগ পায় না। পর্যাপ্ত শিক্ষক ও সরঞ্জামের অভাব থাকে। এ ধরনের খাতে বিনিয়োগ লাভজনক, সেটা বুঝতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ যাদের আমরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হারিয়েছি তাদের সর্বদা শ্রদ্ধা-ভালবাসায় আমরা স্মরণ করি। শিক্ষা, খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা- এ সবের মাধ্যমেও তাদের আমরা সর্বদা স্মরণে রাখতে পারি। মহৎ আদর্শ রেখে গেছেন তারা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা প্রেরণা হয়ে থাকবেন। সরকার যে কাজে যুক্ত আছে ও থাকবে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়েও এ সব মহৎ কাজে উদ্যোগ চাই। বাংলাদেশের শিশু-কিশোর-কিশোরী যত বেশি জগৎ সেরাদের আসনে স্থান করে নিতে থাকবে, আমাদের মনে পড়বে রাসেল-আরিফ-বেবি-সুকান্তদের কথা। এভাবেই তাদের স্মৃতি আমরা ধারণ করে চলব।
অজয় দাশগুপ্ত: সাংবাদিক।
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে চীনে রপ্তানি হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে এই মন্দাভাব অব্যাহত থাকবে। দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। যে কারণে এশিয়ার অন্য দেশগুলোর অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চিনে করোনা মহামারির প্রভাবে বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন চাহিদা কমছে। আর এ কারণে দেশটিতে আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড বারবেরি জানিয়েছে চীনে তাদের বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
চীনের রপ্তানি বাণিজ্যও সংকুচিত হয়েছে। ভারত চীনা পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চলছে বাণিজ্য-যুদ্ধ। হংকং নিয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক খারাপ। ফলে দ্রুত আর্থিক অবস্থার উন্নতির সম্ভাবনা সামনে নেই। এরই মাঝে করোনার আবার নতুন ঢেউ । অর্থনীতির নিম্নগতি সত্ত্বেও দেশটি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শূন্য কোভিড নীতি অনুসরণ করেছিল। কিন্তু জনরোষের কারণে তার কিছুটা প্রত্যাহার করতে হয়। এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে করোনা প্রতিরোধ ও অর্থনীতির সূচককে ঊর্ধ্বমুখী করতে।-খবর জাপানি সংবাদ সংস্থা এনএইচকে ওয়ার্ল্ড-এর।
প্রতিবেদনে থাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে দেশটিতে ডিসেম্বর মাসে চীনে রপ্তানি ১৪ দশমিক ছয় শতাংশ কমে প্রায় ২১ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এটি পতনের টানা তৃতীয় মাস ছিল। এই তিন মাসে চীনে রপ্তানি কমেছে ২০.৮ শতাংশ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ডিসেম্বরে চীনে-তেল রপ্তানি ২০ দশমিক ছয় শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। গড়ে তিন মাসে চীনে রপ্তানি ৩১ দশমিক আট শতাংশ কমেছে।
যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ টমি উ বলেছেন, "মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে গত বছরের চীনের দ্বিতীয় কোয়ার্টারের জিডিপির হিসাব ছিল সবচেয়ে খারাপ। লকডাউনের কারণে, বিশেষ করে সাংহাইতে করোনা বিস্তারের কারণে এই কোয়ার্টারের শুরুতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।"
চীন সরকার তার কঠোর সংক্রমণ বিরোধী ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার পরও থেকে চীনের অর্থনীতি বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন পশ্চিমা দেশগুলির আর্থিক সংকোচন নীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার ওডর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা এসব কিছু মিলিয়ে চীন থেকে আমদানি রপ্তানি সামনের মাসগুলিতে আরও বাধাগ্রস্ত হবে। ইউরোপভিত্তিক সংবাদ বিশ্লেষক ‘ইনসাইড ওভার’ সম্প্রতি করা এক প্রতিবেদনে বলেছে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া আর মন্দা অর্থনীতি এ দুটি বিষয় নিয়ে চীন উভয়সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চীনের শূন্য কোভিড নীতি হয়তো দেশটির মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে কিন্তু অর্থনীতির ওপর ফেলেছে বিরূপ প্রভাব।
বলা হয়েছে যে বেইজিং যদি "আসন্ন কোভিড তরঙ্গ দ্বারা ক্ষতি সামাল দিতে জিরো কোভিড নীতি পুনর্বহাল করে, তবে তা অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে৷ আর যদি তা না করা হয়, তবে মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।"
গত ৮ জানুয়ারি শূন্য কোভিড নীতি থেকে সরে আসে দেশটি। ঘোষণা আসার পর থেকে বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়ানো নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানও চীনে নতুন করে সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে। ভারত ও জাপান সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। চীন থেকে আসা ব্যক্তিদের ওপর নতুন কোভিড বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
যে হারে করোনা ছড়াচ্ছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে আগামী দিনে এক মিলিয়নেরও বেশি কোভিড সম্পর্কিত মৃত্যুর সাক্ষী হতে পারে চীন। একই সময়ে, দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব কাটাতেও সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই বছর ২ দশমিক আট থেকে-৩ দশমিক দুই শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা হবে গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হবে৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরের শেষের দিকে করোনার কারণে কলকারখানা ও ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এত চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গত নভেম্বরে খুচরা বিক্রি কমেছে ৫ দশমিক নয় শতাংশ। শিল্প ও কলকারখানা থেকে আয় কমেছে ২ দশমিক দুই শতাংশ। আর সম্পদে বিনিয়োগ কমেছে ৫ দশমিক তিন শতাংশ। চীনে বেকারত্বের হার বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যেখানে দেশটির শ্রমের প্রধান শক্তি ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এটি বেড়ে ১৭ দশমিক এক শতাংশে পৌঁছেছে। এ ছাড়া দেশটির আবাসন খাতেও এখন গভীর মন্দা চলছে এবং সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে চীনের সঙ্গে ব্যবসা সম্পর্কযুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতির পরিস্থিতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অন্য দেশগুলোর তুলনায় এসব দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির ঘোড়ায় লাগাম দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। চোখের সামনেই শ্রীলঙ্কা নেপাল এবং পাকিস্তান এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মূল্যস্ফীতির চাপে দেশগুলো দিশেহারা।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৩ সালে জ্বালানি খাত বাদে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। এটি আগের পাঁচ বছরের গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার অতিরিক্ত ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে চলতি বছরেই এরই মধ্যে এ হার গড়ে ২ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে তারা। এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে দ্রুত অর্থনীতি বর্ধনশীল দেশগুলোর জনগণ। যুদ্ধ, বৈরী পররাষ্ট্রনীতি, অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার; এসব বাদ দিয়ে বিশ্বনেতাদের উচিত বৈশ্বিক মন্দা কাটাতে একযোগে কাজ করা। মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত রাষ্ট্রপ্রধানদের। এর সঙ্গে বাড়াতে হবে বিনিয়োগও।
এমন কিছু দৃশ্য থাকে যেগুলো আমাদের সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। ২০১৭ সনের ৮ জুলাই অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন গঠিত হয়, এই তো ঢাকার শাহজাদপুরে। গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় যারা প্রাণ হারান তাদেরই একজন হাস্যোজ্জ্বল অবিন্তা কবির। ফাউন্ডেশন উদ্বোধনের দিন সাংবাদিক হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ যখন কথা বলতে পোডিয়ামে ওঠেন তখন আমিও অনেকের মতো কান্না ধরে রাখতে পারিনি। রুবা আহমেদ কথা বলতে পারছিলেন না, একটি শব্দও না। সেদিন তার অশ্রুই তার ভাষা হয়ে উঠেছিল।
তখন রুবা আহমেদ আদরের সন্তানের স্মৃতি পাথেয় করে শোক মোকাবেলা করছিলেন। তখনো তিনি জানেন না, ভবিষ্যতে তাকে একটি সিনেমা প্রতিহত করার লড়াইয়ে নামতে হবে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে সেই জঙ্গি হামলা নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘ফারাজ’-এর ট্রেলার। ঘোষণা এসেছে সিনেমা আসছে ৩ ফেব্রুয়ারি। ২০১৯ সন থেকে এই সিনেমার বিরোধিতা করে আসছে অবিন্তা পরিবার। প্রথম দিকে হয়তো তারা ভেবেছিলেন একজন মায়ের আবেগকে শ্রদ্ধা জানিয়েই ফারাজ পরিবার এই সিনেমা করা থেকে সরে আসবে। তা হয়নি। রুবা আহমেদকে দিল্লির আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) সাংবাদিকদের সামনে এসেছিলেন রুবা আহমেদ। এ বিষয়ে আগে কখনো তাকে সামনে আসতে দেখা যায়নি। এবার তিনি এসেছেন একজন মা হিসেবে। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা থেকে শুরু করে দিল্লির হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ানো—সবটাই বললেন তিনি। শেষে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ পায় ‘আমি জানি, হয়তো আমি কিছু করতে পারবো না’ বাক্যেটিতে। তার কষ্ট, কেউ তার আবেগকে নূন্যতম সম্মান দেখালো না। একজন মায়ের ভালোবাসাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বাজারে আসছে ‘ফারাজ’। সিনেমাটি দেখার সুযোগ করে দেয়া তো দূরের কথা সিনেমা তৈরিতে তাদের সম্মতিও নেয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন তিনি। এর পাল্টা কোনো বক্তব্য থাকলে ফারাজ পরিবার দিক। না, কখনো এবিষয়ে কথার বলার প্রয়োজন মনে করেনি তারা।
রুবা আহমেদর চান না এই সিনেমায় অবিন্তাকে মূর্ত করা হোক, সে রাতের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পুনরুৎপাদন দেখতে তার আপত্তি। তিনি শঙ্কিত তার কন্যার ও তার প্রাইভেসি নিয়ে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ফারাজ তার কন্যা অবিন্তার জন্য জীবন দিয়েছে তা তিনি বিশ্বাস করেন না। কেননা এই ন্যারেটিভের পেছনে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ নেই। না আছে কোনো সাক্ষী।
রুবা আহমেদর এই কথাটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ফারাজ হিরো, জঙ্গিরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু সে তার দুই বন্ধু—অবিন্তা ও তারিশির জন্য রয়ে যায় এবং প্রাণ হারায়। এই যে ন্যারেটিভ—তার ভিত্তি কি? বলা হচ্ছে ‘ফারাজ’ সিনেমাটির অন্যতম ভিত্তি সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবুর লেখা ‘হোলি আর্টিজান: একটি জার্নালিস্টিক অনুসন্ধান’ শিরোনামের বই।চলুন দেখি ফারাজের ‘বীরত্ব’ সম্পর্কে সেই বই কি বলছে,
‘ফারাজ অবিন্তা ও তারিশি জৈনকে সকালের দিকে হত্যা করা হয় বলে একাধিক গণমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। ফারাজের নিকটাত্মীয় হিশাম হোসাইনের বরাত দিয়ে ২ জুলাই ২০১৬ তারিখে নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে হিশাম হোসাইন বলেন, ফারাজকে জঙ্গিরা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল এবং তিনি দুই বান্ধবীকে ছেড়ে আসতে চাননি বলে তাকে তাকে হত্যা করা হয়। তবে অনুসন্ধানে এরকম কোনো তথ্যের সত্যতা মেলেনি। প্রকৃতপক্ষে রাত সাড়ে ১২টার থেকে ১টার পর কাউকে হত্যার ঘটনা কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বলতে পারেননি। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারাও প্রত্যক্ষদর্শীদের যে জবানবন্দি নিয়েছেন তাতে এমন কোনো ঘটনার কথা উল্লেখ নেই। সিটির (কাউন্টার টেরোরিজম) প্রধান মনিরুল ইসলাম আমাকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত তাদের তদন্তে ফারাজকে জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়ার কোনো ঘটনার কথা কেউ বলতে পারেনি।’
আমি মনে করি, ইতিহাস নির্মোহ। আপনার মনে হতে পারে আপনি ইতিহাস নিয়ে খেলতে পারেন, এই ধারণাটা ভুল। কেননা, আপনি যে খেলছেন একসময় ইতিহাস তাও বলে দেয়।
লেখক: দৃশ্যগল্পকার
গত ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে নেপালের পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পরে গত রোববার ইয়েতি এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয় অবতরণের কয়েক মিনিট আগে। নিহত হয় বিমানের সব যাত্রী। ফ্লাইটটিতে পাইলট কেবিনক্রু ও যাত্রী মিলিয়ে ৭২ জন ছিলেন। এর আগে গত বছর ২৯ মে পোখরা পুরোনো বিমানবন্দর থেকে জমসম যাওয়ার সময় বিধ্বস্ত হয়েছিল তারা এয়ারের একটি অভ্যন্তরীণ বিমান। নিহত হয়েছিল বিমানের ২২ জন যাত্রী পাইলট ও কেবিন ক্রু। এটিও ছিল ইয়তি এয়ারলাইনসের মালিকানাধীন।
হিমালয় পর্বতমালা বেষ্টিত দেশটিতে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা এটি। অ্যাভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের তথ্যমতে ২০১৮ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশের ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের বিমান বিধ্বস্ত হয় কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে। সে ঘটনায় নিহত হন ৫১ জন। সবচেয়ে খারাপ দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৯২সালে। সেসময়ে কাঠমান্ডুতে অবতরণের ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১৬৭ জন নিহত হন। একই বছর, একই বিমানবন্দরের কাছে থাই এয়ারওয়েজের বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১১৩ জন যাত্রী মারা গিয়েছিল। ফ্লাইট সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, ১৯৪৬ সাল থেকে নেপালে ৪২টি মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে। আর ২০০০ সাল থেকে দেশে বিমান বা হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ৩৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
আকাশ পরিবহনে দুর্বল নিরাপত্তা নিয়ে অতীতে অনেকবার সমালোচিত হয়েছে নেপাল। সমন্বিত পরিকল্পনা, বিনিয়োগ স্বল্পতা, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলে ঘাটতি এবং বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের বৈরী ভূগঠন এবং বৈরী আবহাওয়া সবকিছু মিলিয়ে দেশটির বিমান চলাচল ব্যবস্থাকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। ইয়তি এয়ারলাইনসের পর পর দুটি দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে নেপালে আকাশপথে ভ্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি আবারও বিশ্বের বিমান চলাচল ব্যবস্থার সামনে একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উঠে এল।
নেপালে কেন এমনটা বারবার হচ্ছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমান পরিচালনা ও পরিবহনে যে সব জায়গাগুলোতে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া দরকার সেগুলো উপেক্ষা করে আসছে নেপাল। একই অভিযোগ করেছিল ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও)’রও। তাদের নিরাপত্তা উদ্বেগ উত্থাপনের পরপরই ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সমস্ত নেপালি এয়ারলাইনসগুলোকে দুর্বল সুরক্ষা মানদণ্ডের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের ২৭ টি দেশে ওড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যেটি এখনো বলবৎ রয়েছে। অবশ্য আইসিএও ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নেপালের বিমান চলাচলকে কালো তালিকা থেকে সরিয়ে দিলেও, আইসিএওর দিক নির্দেশনা এখনো পুরোপুরি অনুসরণ করেনি দেশটি। আইসিএওর দেওয়া পরামর্শগুলোর দিকে নজর না দিয়ে নেপাল অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেই বেশি জোর দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বের এয়ার সেফটি বিশেষজ্ঞরা। সদ্যনির্মিত পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছেন তারা। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভস যুক্ত হয়ে নেপাল চীন থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে এই বিমান বন্দরটি বানিয়েছে। আকাশ নিরাপত্তায় পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ না করে পোখরায় পুরোনো বিমান বন্দরের কাছেই পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করেছে। যেটি এখন আর্থিকভাবে লাভজনক হবে কিনা সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন তারা।
যদি পোখরা বিমানবন্দর সময়মতো আর্থিকভাবে লাভ করে ঋণ পরিশোধ না করতে পারে তাহলে এর পরিণতি শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দরের মতোই হতে পারে বলে তাদের ধারণা। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে পোখরা বিমানবন্দরটি এর আগে চালু হওয়া নেপালের ভৈরহাওয়ার গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো একই পরিণতিতে পড়তে পারে। কারণ বিদেশি এয়ারলাইন কোম্পানিগুলি দুর্গম ও বৈরী পরিবেশ ও অপ্রতুল আকাশ নিরাপত্তার অভিযোগে বিমানবন্দরটি বাতিল করে দিয়েছিল। গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এখন কোনো আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন ফ্লাইট পরিচালনা করে না।পোখারার পুরোনো বিমানবন্দর গত অর্থবছরে ০.৯ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। করোনা সংক্রমণ কমার পর ফ্লাইট যোগ করায় এটাই সর্বোচ্চ আয়। গত ১ জানুয়ারির পর নতুন পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সব অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন বিমান সংস্থা কার্যক্রম শুরু করেনি। নিকট ভবিষ্যতেও যে বিভিন্ন দেশের বিমান পোখরায় কার্যক্রম শুরু করবে তেমন কোন লক্ষণও নেই। নতুন বিমানবন্দর করে যদি আন্তর্জাতিক বিমান পরিচালনা করা না যায় তবে আয় তেমন একটা বাড়ানো সম্ভব হবে না ‘বলেছেন সিভিল অ্যাভিয়েশন অথোরিটি অফ নেপালের (সিএএএন) এর এক কর্মকর্তা। কেননা নেপালে ক্রমান্বয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো এই ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে আন্তর্জাতিক মহলে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন নতুন বিমানবন্দর না বানিয়ে নেপালের আকাশ নিরাপত্তা উন্নয়নের দিকেই বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। ‘যদিও নেপাল সিভিল অ্যাভিয়েশন আকাশ নিরাপত্তা উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবে বাস্তবতা হলো নিরাপত্তা রেকর্ড এখনো অন্য যে কোন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের স্তরে পৌঁছাতে পারেনি’- বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার রয়েল মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি) অধ্যাপক ক্রিস্টাল ঝাং। তিনি মন্তব্য করেন, ‘যদিও নেপালের মনোরম ল্যান্ডস্কেপ পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে কিন্তু, এটি অ্যাভিয়েশন অপারেটরদের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, নেপালে বিমান ভ্রমণ আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিমানবন্দরের পরিকাঠামো উন্নয়ন বিমান চলাচল বাড়ার তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর ফলে বিমানবন্দরে যানজট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকিও বেড়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলো যেতে চাচ্ছে না নেপালে।
পোখরা বিমানবন্দর প্রকল্পের প্রধান বিনিশি মুনাকার্মির দেওয়া তথ্যমতে, ৩০০ মিলিয়ন ডলারের পোখরা বিমানবন্দর প্রকল্পটি চীনের এক্সিম ব্যাংক (এক্সিম) থেকে ঋণ নিয়ে করা হয়েছে। যার মধ্যে ২০৯ মিলিয়ন ডলার সরল সুদে। চুক্তি অনুযায়ী, এই ঋণের ২৫ শতাংশ সুদমুক্ত এবং অবশিষ্ট ঋণ ২ শতাংশ সুদ হারে, যা অন্যান্য বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এক্সিম ছাড়াও, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নের জন্য ওপেক তহবিলও ঋণ ও অনুদানের আকারে বিমানবন্দর প্রকল্পটিকে লগ্নি করেছে।
এটা আনন্দের যে, পোখরা শেষ পর্যন্ত নিজস্ব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুলছে, তবে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে। নেপালকে এ বছর মার্চ মাস থেকে এক্সিম ব্যাংককে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। বিমানবন্দরের তথ্য কর্মকর্তা জ্ঞানেন্দ্র ভুলের তথ্যমতে, পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাওয়া চীনের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড হলো ৭ বছর। এর অর্থ পোখরা বিমানবন্দর নির্মাণকালীন প্রায় সাত বছর ধরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়নি। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে কর্তৃপক্ষকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এবং চুক্তি অনুযায়ী ১৩ বছরের মধ্যে চীনকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।তবে স্থানীয় এক সূত্রমতে, কীভাবে এ ঋণ পরিশোধ করা হবে সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্টতা নেই। আয়ের প্রধান উৎস হল বিমান ল্যান্ডিং চার্জ এবং ভাড়া। কিন্তু প্রত্যাশিত রাজস্ব আয় এই ঋণ পরিশোধের জন্য খুবই অপর্যাপ্ত। সূত্রমতে বিমানবন্দরটি লাভজনক হতে হলে প্রতিবছর ১১দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করতে হবে যা ভীষণরকম উচ্চাভিলাষী। এ প্রসঙ্গে নেপালের সংস্কৃতি, পর্যটন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ বিবি দেওজার মতে, পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম।এ ছাড়া রাজস্ব আয় ও ঋণ পরিশোধের মধ্যে যে ব্যবধান থাকবে সেটি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, কীভাবে ঋণ পরিশোধ করা হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।এ বিষয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী রামেশ্বর খানাল বলেছিলেন যে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নয় বছরে তার খরচ তুলতে সক্ষম হবে। কিন্তু সেই জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বিদেশি পর্যটকদের পোখারায় প্রবেশ করতে হবে। চালু থাকতে হবে অনেক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। কিন্তু নেপালের নাজুক আকাশ নিরাপত্তা সে আশায় গুড়ে বালি দিয়ে যাচ্ছে।
বিমানবন্দরের তথ্য কর্মকর্তা জ্ঞানেন্দ্র ভুলের মতে, পোখরা বিমানবন্দরে ঋণের কিস্তি শোধ দিতে প্রতিদিন কমপক্ষে এক শটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এবং সপ্তাহে কমপক্ষে ৫০টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে। তিনি ধারণা করেন "পোখরা বিমানবন্দর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালিয়েও টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু তার এই প্রত্যাশা বাস্তবতা থেকে অনেক দুরে। যেখানে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পর লাভের মুখ দেখেছিল সেখানে নতুন বিমান বন্দরের ঋণ ১৩ বছরের মধ্যে চীনকে শোধ দেওয়াটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নেপালের পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি লাভজনক করতে ভারতের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া আশা করছে নেপাল কর্তৃপক্ষ। কেননা এমনিতেই ভূগঠন ও ভৌগোলিক দিক দিয়ে আকাশপথে এই বিমানবন্দরটি পরিচালনা ভারতের সমর্থন ছাড়া অনেকটা জটিল হয়ে উঠবে। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে হলেও এই বিমানবন্দরকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। কারণ নেপালের তিন দিক জুড়েই ভারতের অবস্থান। আর উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা। যা উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য বৈরী ।
পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিয়ে ভারত কি ভাবছে? ১ জানুয়ারি বিমানবন্দরটির উদ্বোধনী দিনেই সেখান থেকে উড্ডয়ন হবে এমন এক ফ্লাইটকে ভারত তার মাটিতে নামতে অনুমতি দেয়নি। বুদ্ধ এয়ারের ওই ফ্লাইটটির পোখরা থেকে ভারতের বানারসী যাওয়ার কথা ছিল। যদিও আগে থেকে কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ভারতের বানারসী সহ আরও কয়েকটি এলাকায় বিমান পরিচালনা করে আসছিল বুদ্ধ এয়ার। কিন্তু পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন হওয়ার কথা থাকায় সেটিকে ভারত নিষেধাজ্ঞা দেয়। শুধু বুদ্ধ এয়ার নয়, পোখরা থেকে উড্ডয়ন করা কোন বিমানকে ভারত তার মাটিতে নামতে অনুমতি দেয়নি। এর আগে ভারত নেপালের ইয়েতি গ্রুপ এবং চীনা বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন হিমালয় এয়ারলাইনসকে ভারতে উড়তে দেয়নি।
বিমানবন্দরটিকে বাণিজ্যিকভাবে সফল করতে হলে নেপালকে ভারতীয় এবং চীনা পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। দুই দেশের প্রধান শহরগুলোতে সরাসরি ফ্লাইট স্থাপন করতে হবে। কিন্তু, পোখরা বিমানবন্দর বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়া এখন একটি দূরবর্তী স্বপ্ন। কারণ এখন পর্যন্ত, চীনের তিব্বত এয়ারলাইনস-এর অর্থায়নে পরিচালিত হিমালয় এয়ারলাইনস এবং কুয়েতের জাজিরা এয়ারওয়েজই একমাত্র আন্তর্জাতিক বাহক যারা পোখারায় ফ্লাইট চালু করতে রাজী হয়েছে। আর বিমানবন্দরটিকে আগামী ১৩ বছরের মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে যা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। নতুন বিমানবন্দরে কীভাবে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আন্তঃসংস্থা সমন্বয় ও যোগাযোগের স্পষ্ট অভাব রয়েছে। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী চীন এখনো পোখরা থেকে বিমান পরিচালনার কোন আভাস দেয়নি। ২০২০ সালে বেইজিংয়ের কাছ থেকে ওয়াই-১২ ও এমএ-৬০ সিরিজের ৬টি বিমান কিনেছিল নেপাল এয়ারলাইনস। পরে রক্ষণাবেক্ষণে অতিরিক্ত খরচের কারণে বিমানগুলো আর চালায়নি নেপাল। এখন সেগুলো পড়ে আছে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায় করা এই বিমানবন্দরে ভারত তার বিমান পরিচালনা করবে কিনা তা নেপাল কর্তৃপক্ষ এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি।
পোখরা বিমানবন্দটি সহজ ও আর্থিকভাবে সফল হওয়ার জন্য ভৈরহওয়া, নেপালগঞ্জ ও মহেন্দ্রনগর রুট দিয়ে নেপালে বিমান প্রবেশ করাটা জরুরি। কিন্তু এই রুটের বাইরেই ভারতের আকাশসীমা। এই রুটটি দিয়ে ভারত সরকার নেপালে বিমান প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। এর ফলে ভৈরহাওয়া এবং পোখরা বিমানবন্দরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সংস্কৃতি, পর্যটন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বুদ্ধি সাগর লামিছনে বলেছেন, বর্তমানে, ভারত নেপালের মহেন্দ্রনগর, নেপালগঞ্জ, ভৈরহাওয়া, বিরাটনগর এবং জনকপুর আকাশপথে নেপাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেও আকাশ পথে প্রবেশের বেলায় শুধু সিমারা রুটটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। সিমারা নেপালের দক্ষিণ দিকে বিহারে ওপর দিয়েই ৭০ ভাগ বিমান নেপালে প্রবেশ করে। গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রধান, গোবিন্দ দাহল বলেছেন যে পশ্চিম নেপালে এয়ার এন্ট্রি পয়েন্ট রুটগুলি পোখরা বিমানবন্দরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লামিচানের মতে ৬০ থেকে ৭০ভাগ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নেপালে প্রবেশের জন্য পশ্চিম রুট ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু, ভারত অনুমতি না দেওয়ায় ওই ৭০ ভাগ বিমানকে ঘুর পথে অনেকক্ষণ উড়ে দক্ষিণে সিমারার ওপর দিয়ে নেপালে প্রবেশ করতে হয়। এর বাইরে অল্প কিছু বিমান ভুটান থেকে পূর্বে ঝাপা হয়ে নেপালে প্রবেশ করে এবং লাসা থেকে আসা বিমানগুলি নুনিম পয়েন্ট হয়ে নেপালে প্রবেশ করে। এসব কৌশলগত কারণে পোখরার এই নতুন বিমানবন্দরটি আর্থিকভাবে লাভজনক হওয়া ভারতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
প্লেনবিহীন একটি বিমানবন্দর, একটি ঘূর্ণমান রেস্তোরাঁ যেখানে কোনো খাবার নেই, একটি ঋণ বোঝাই সমুদ্রবন্দর –২০১৭ সালে নভেম্বর মাসে এ রকমটাই দেখতে ছিল ২০০৮ সালে চালু হওয়া শ্রীলঙ্কার উচ্চাভিলাষী হামবানটোটা বন্দর। পোখরায় লগ্নি করা চীনের সেই এক্সিম ব্যাংক থেকেই তখন ঋণ নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। পরবর্তীতে প্রকল্পটি আর্থিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় চীনের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। যে কারণে বন্দরটিকে নয় বছরের মধ্যে ২০১৭ সালে ৯০ বছরের ইজারায় চীনের কাছে ছেড়ে দিতে হয়েছে। এই চুক্তির ফলে বেইজিং ভারত মহাসাগরে একটি কৌশলগত অঞ্চলে তাদের অবস্থান সুসংহত করলেও এর নেতিবাচক পরিণতির শিকার হতে হয়েছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণকে। চীনের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর কারণে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে। জনজীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ যা এখনো চলমান।
ভারতীয় উপমহাদেশের দুই প্রান্তে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। কিন্তু, তারা একই রকম অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সংগ্রাম করছে। যদিও উভয় দেশের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। কিন্তু দুটো দেশই চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পর্যটন খাতে ধস উভয় দেশকেই সংকটের অতল খাঁদের দিকে নিয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে চরম মূল্য দেওয়া শুরু করেছে। একইভাবে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যদি আর্থিকভাবে লাভবান না হয় এবং সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করতে পারে তাহলে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেও হাম্মান টোটার মত পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। যা নেপালের নাজুক অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর করে তুলবে। আর এর পরবর্তী প্রেক্ষাপট উপমহাদেশের ভূ রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
শেখ কামালকে আমাদের প্রজন্ম খুব ভালোভাবে জানে না। চেনেও না অনেকে। আমাদের থেকে বয়সে অন্তত ৪/৫ বছরের বড় যারা তারাও শেখ কামাল সম্পর্কে সঠিক সুস্পষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারে না। তবে ক্রীড়া সংগঠন ‘আবাহনী’ নাম দিয়েই শেখ কামালকে চেনার জানার বোঝার অনেকটাই সহজ। ঢাকার অভিজাত পাড়া হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এই আবাহনী ক্লাব। স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত বাংলাদেশে এ রকম একটি আধুনিক ক্লাব ঘর নির্মাণের মাধ্যমে শেখ কামালের আধুনিক ক্রীড়া মনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। ৪৭ বছর আগে লাল সিরামিকের ইটের তৈরি সুন্দর নজরকাড়া এক ভবন।
মাত্র ২৬ বছর বয়সেই তিনি সপরিবারে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন তার ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে। স্বাধীনতার ঘোষক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে ছিলেন শেখ কামাল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আধুনিক একটি ক্লাব নির্মাণ করেছেন। সেই ক্লাবের জন্য ইংল্যান্ড থেকে ফুটবল কোচ এনে প্রথম আধুনিক ফুটবলের ধারণা প্রবর্তন করেছেন বাংলাদেশে। সাংগঠনিক সক্ষমতা দিয়ে ওই ক্লাবকে জনপ্রিয় করারও অনেক কৌশল করেছিলেন তিনি। কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন শেখ কামাল দেখতে কেমন ছিলেন তার দূরদর্শিতা কেমন সৃজনশীলতায় তিনি কতটা এগিয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের যেতে হবে তার সহকর্মী তার সহপাঠী এবং ওই সময় তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠজনদের কাছে।
চট্টগ্রামে বসে শেখ কামাল সম্পর্কে সবকিছু জানা একটু কঠিনই বটে। তারপরও আবাহনী ক্লাবের খেলা ও কার্যক্রম দেখে আমরা তার গুণের কিছুটা ছোঁয়া পাই।
আমি তখন স্কুলে পড়ি। চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতাম নিয়মিত। আশির দশকে এই স্টেডিয়ামে উপচেপড়া দর্শকদের ভিড় দেখা গেছে। চট্টগ্রামে তখনো আবাহনী নামে কোনো ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে মোহামেডান ক্লাব ছিল। সেই ক্লাব বরাবরই চট্টগ্রামে শীর্ষস্থানীয় দল। চট্টগ্রামে মোহামেডানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত স্টিল মিল, ওয়াপদা মানে পিডিবি, কাস্টমস, রেলওয়ের মতো শক্তিশালী দলগুলো। মোহামেডান বাদে বাকি ক্লাবগুলোতে খেলতে আসত ঢাকা আবাহনীর সালাউদ্দিন, চুন্নু, অমলেশ, নান্নু, টুটুল। সেকি উত্তেজনা। এসব খেলোয়াড়ের সেই কি স্টাইল! তাদের খেলার স্টাইল দেখার জন্য গ্যালারি উপচেপড়া দর্শকেরা এসে বসতেন মাঠের সাইড লাইনের পাশেও। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে খেলা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত শেষ হতে পারেনি।
বাংলাদেশের বর্তমানে মৃতপ্রায় ফুটবলের অবস্থা চিন্তা করলে আর আশির দশকের সেই সব দৃশ্য মনে ভেসে উঠলে সত্যিই দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে হয়। আমাদের ফুটবল আসলেই এত গৌরবময় ছিল? হ্যাঁ ছিলই। আর এখানেই শেখ কামালের নামটা অবধারিতভাবে চলে আসে। তিনি একটি আধুনিক ক্লাবের জন্ম দিয়েছেন একই সঙ্গে বেশ কিছু ফুটবলারকে স্মার্ট বানিয়েছেন।
শেখ কামালকে নিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা কিংবা অনুসন্ধানী রিপোর্ট হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সামান্য কিছু কাজ হয়েছে হয়তো। চট্টগ্রামেরই ছেলে ক্রীড়া সাংবাদিক সনৎ বাবলা লিখেছেন, ‘শেখ কামাল: ক্রীড়াঙ্গনের ধূমকেতু’ নামে একটি বই যেটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে। অর্থাৎ শেখ কামাল মারা যাওয়ার প্রায় ৪৫ বছর পর। শেখ কামাল একাধারে ক্রিকেটার, খেলতেন বাস্কেটবল, ক্রীড়া সংগঠক, রাষ্ট্রপতির ছেলে - এরকম নানামুখী পরিচয় ছাপিয়ে তিনি ক্রীড়া সংগঠকের পরিচয়ে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল।
সনৎ বাবলার বইতে তিনি শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, একবার এক বড় ব্যবসায়ী এসে তাকে অর্থাৎ শেখ কামালকে একটি চেক দিয়ে যায়। চেক হাতে তুলে দিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, আপনি ক্লাব চালান, ক্লাব চালাতে অনেক টাকা লাগে তাই দিলাম। চেকটি নিজের কাছে রেখেছেন ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই জানতে পারেন যে ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক সুনাম নিয়ে প্রশ্ন আছে। পরদিন শেখ কামাল ওই ব্যবসায়ীকে তার চেক ফেরত দিয়ে দেন।
স্বাধীনতার পরে আবাহনী ক্লাব যখন সংগঠিত হতে থাকে তখন মাঠে নামার সময় দর্শকেরা তাদের ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে চিৎকার করত। এমনকি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করার ঘটনাও ঘটেছে। সমর্থক ছিল না। প্রতিকূল অবস্থা। সেটি সামাল দেওয়ার জন্য অদ্ভুত এক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন শেখ কামাল। বাস্কেটবল খেলার জন্য তখনকার সবচেয়ে নামী দল ওয়ান্ডারার্স এক বাস্কেটবল প্লেয়ারের কাছে গিয়েছিলেন। তার নাম এ কে সরকার। তিনি জাতীয় দলের খেলোয়াড়। শেখ কামাল ওয়ান্ডারার্সে খেলতে আসবেন শুনে কিছুটা বিব্রত ক্লাবের সবাই। তখন ওই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন বীর বিক্রম কাজী কামাল উদ্দিন। শেখ কামাল তার কাছেও গিয়েছিলেন তাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। কৌতূহলী বাস্কেটবল খেলোয়াড় এ কে সরকার একদিন শেখ কামালকে জিজ্ঞেস করে বসলেন কেন আপনি রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়ে ওয়ান্ডারার্সে খেলতে আসলেন। জবাবে শেখ কামাল বলেছিলেন পরে বলব। ঠিকই এক বছর পর শেখ কামাল এ কে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কেন ওয়ান্ডারার্সে বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছিলেন। মূলত ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের তখন প্রচুর সমর্থক ছিল। বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে শেখ কামালের দল আবাহনী কিছুটা সমর্থন পাবে এই ভরসায় তিনি বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছিলেন ওয়ান্ডারার্সে। কতটা মিশনারি হলে কতটা দূরদর্শী হলে একজন মানুষ এভাবে চিন্তা করতে পারে।
আবাহনী ক্লাবকে একটি আধুনিক ক্লাবে পরিণত করতে হবে এর জন্য দরকার প্রচুর টাকা। রাজাকার আলবদররাও ক্লাব গড়বার জন্য টাকা দিতে চেয়েছিল। সে টাকা তিনি গ্রহণ করেননি। টাকা কোত্থেকে আসবে সেই পরিকল্পনাও শেখ কামাল করে রেখেছিলেন। শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নামকরা সার্কাস দলের চৌকস সদস্যদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। সেখান থেকে টাকা সংগ্রহ করেই একটি আধুনিক ক্লাব বানানোর কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সার্কাস শো থেকে তখন আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৪৪ টাকা।
এই ক্লাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবাহনীতে দীর্ঘদিন ধরে খেলে আসা চট্টগ্রামের ছেলে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আশীষ ভদ্র বলেন, আবাহনী এমন একটি ক্লাব যেখানে তখনকার সময়ের সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থাপনা ছিল প্লেয়ারদের জন্য। হাই কমোডের এসি বেডরুম, টয়লেট, কিচেন-ডাইনিং রুম সবকিছুই আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। তখনকার বিখ্যাত সব ক্রিকেটার ও ফুটবলার সবাই ক্লাবের ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভূত হয়ে যেতেন। ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার অরুণ লাল শ্রীলঙ্কার সামারা শেখেরা শ্রীলঙ্কার ফুটবলার পাকির আলীর মতো খেলোয়াড়রা এই ক্লাবে অবস্থান করে এর আধুনিক ব্যবস্থাপনা দেখে প্রশংসা করেছেন। ক্লাবের জার্সি নিয়ে আসা হতো সুদূর ইংল্যান্ড থেকে, মোজাও বাদ যেত না। চিন্তা চেতনায় শেখ কামাল এতটাই আধুনিক আর বিনয়ী ছিলেন যে, ক্লাব বয় যারা ছিলেন তাদের তিনি ‘আপনি’ করেই সম্বোধন করতেন। সবাইকে সুন্দর ড্রেস পরে ফিটফাট থাকার জন্য পরামর্শ দিতেন।তখনকার সময় একজন ফুটবলার কিংবা ক্রিকেটের এর কাছে একটি মোটরসাইকেল স্বপ্নের মতই ছিল। ১৯৭৫ সালে মারা যাওয়ার আগে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধিদপ্তরে যেসব মোটরসাইকেল দেওয়া হতো সেখান থেকে কম নামে ৯টি মোটরসাইকেল কেনার জন্য ৭৫ হাজার টাকা একটি ফান্ড দিয়ে রেখেছিলেন ক্লাবের তৎকালীন ম্যানেজারের কাছে। ৯ জন নামী ফুটবলারকে চুক্তিবদ্ধ করার জন্য এই ফান্ড জোগাড় করে রাখার কথা জানতেন না সেই সময়ের ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদও। ২৬ বছর বয়সী এক যুবকের চিন্তার জগৎ কতটা বিস্তৃত আর বুদ্ধি কৌশলের দিক থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন তিনি তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায়। ভাবা যায়!
এমন প্রশ্ন কেউ তোলেন যে নৃশংসভাবে যদি সপরিবারে শেখ কামাল মারা না যেতেন তাহলে কি হতো বা কি হতে পারত? বাংলাদেশের একজন নামকরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিচিত আশীষ ভদ্র। তিনি বললেন যে, ফুটবল বাংলাদেশ কোন অবস্থানে পৌঁছাতো সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলায় বাংলাদেশ এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যেত এত দিনে। কারণ তার ভেতরে যে দূরদর্শিতা ছিল অর্থাৎ শেখ শেখ কামালের ভেতরে যে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল তার সবকিছুই তিনি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রকাশ করে দেখিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন। তার কল্পনা শক্তি ছিল অসাধারণ।
ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়েই শেষ করব এই লেখা। শেখ কামাল মারা যাওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবাহনী ক্লাব বেশ দুঃসময়ে ছিল। সেই দুঃসময় ক্লাবকে সুসংগঠিত করার কাজে নিবেদিত ছিলেন বেশ কয়েকজন। এঁদেরই একজন হারুনুর রশিদ। শেখ কামাল বেঁচে থাকা অবস্থায় ক্লাবের আর্থিক টানাপোড়েনের সময় হারুনুর রশিদ রাগ করে ক্লাবে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বেশ কয়েক দিন তিনি আসেননি। তখন হারুনুর রশিদকে খুঁজবার জন্য শেখ কামাল তার বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাজির হলেন এবং সেখানে গিয়ে তার ভাবিকে মজা করে বললেন যে, ‘নোয়াখাইল্লাটা’ কই? (হারুনুর রশিদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়, এটি তখন নোয়াখালী ছিল) আর সেই ঘরে বসেই গলায় সুর তুললেন এই গান দিয়ে, ‘ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে’। মান ভাঙিয়ে হারুনুর রশিদকে আবার সঙ্গে নিয়ে ক্লাবে আসেন শেখ কামাল।
ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, সংস্কৃতিমনা, রসবোধসম্পন্ন এই মানুষটিকে আমরা আর কখনোই পাব না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে শেখ কামাল থাকবে চিরঞ্জীব হয়ে। ৫০ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের দশ লাইনের সংক্ষিপ্ত ক্রীড়া ইতিহাস যদি লিখতে হয় সেখানে যৌক্তিকভাবে দুটি লাইন বরাদ্দ রাখতে হবে শেখ কামালের আধুনিক ক্রীড়া ভাবনার জন্য। তাঁকে স্মরণ করার জন্য ‘শেখ কামাল দ্বিতীয় বাংলাদেশ যুব গেমস’ এর যারা উদ্যোক্তা তাদের জন্য এক পঙ্ক্তি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
লেখক: রফিকুল বাহার, আবাসিক সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন, চট্টগ্রাম।
বাউল শব্দের উৎসভূমি পারস্যে। মরুভূমিতে এখানে-সেখানে বিচরণকারী সংসারত্যাগী একশ্রেণির সংগীতাশ্রয়ী সুফি সাধক আল অথবা বউল নামে পরিচিত ছিল। এরা অধ্যাত্মবাদী এবং এদের সাধন পদ্ধতি ছিল গুপ্ত ও যৌনাচারভিত্তিক। আমাদের আলোচ্য বাউল সম্প্রদায় পারস্যের এই আল বা বউল সম্প্রদায়ের উত্তরসূরি। বাউল শব্দের বাংলায় প্রথম ব্যবহার বিষয়েও আমার ভিন্ন মত রয়েছে, চতুর্দশ শতকে শাহ মুহাম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই ধর্মীয় সাধকদের বাউল এবং বাউর নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাউল শব্দের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস যাই হোক সবক্ষেত্রেই এটা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ ব্যাপারে কারও কোন দ্বিমত নেই বলে আমি মনে করছি। অর্থাৎ বাউল বলতে এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টিকে বোঝায় সমাজের চোখে যারা অত্যন্ত নিচ, নিঃস্ব এবং পাগল। তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, বিষয় সম্পত্তি বা সামাজিক প্রতিপত্তি বলতে কোন কিছুই নেই। তাদের কোন স্থায়ী বসতবাড়ি নেই। তারা এক স্থান হতে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং পরান্নে জীবনধারণ করে বেঁচে থাকে। বাউল যে সমাজেরই হোক তার বৈশিষ্ট্য, জীবনযাপন প্রণালি, সমাজে তার সামাজিক অবস্থান একই।
একটা জাতি হিসেবে মননশীল বিষয়সমূহে আগ্রহ ও শৈল্পিক দিকে ঝোঁক কিংবা দর্শনের ক্ষেত্রে আমাদের বাঙালিদের অবদান অতি যৎসামান্য নয়। লালন ফকির ও তার দর্শন এই ক্ষেত্রে এক মস্ত বড় মাইল ফলক এবং স্তম্ভ বলে মনে করি। লালন ফকিরের প্রকৃত নাম ললিত নারায়ণ কর, ডাকনাম লালু। পিতা নাম ছিল মাধব কর, মাতা পদ্মাবতী। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই লালন ফকির দার্শনিক জিজ্ঞাসার কিছু মূল মূল প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কীভাবে সৃষ্টি হলো ? ঈশ্বর কে ? আমি কে ? স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক কি ? অস্তিত্ববাদী ও সৃষ্টির রহস্য সংক্রান্ত এসব প্রশ্ন তোলা, এবং যেভাবে লালন ফকির এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছেন, তা আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসে ব্যতিক্রমী। অতলান্ত গভীরতা, শৈল্পিক সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক সূক্ষ্মতা নিয়ে লালন ফকির ছিলেন সবচেয়ে প্রতিভাবান এবং শীর্ষ এক মহামানবীয় ব্যক্তিত্ব।
বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ বাঙালি সংস্কৃতির এক মহান প্রতিনিধি। বাংলা সংস্কৃতির মূল ধারা লোকসংস্কৃতি। এই ধারাকে যারা পুষ্ট করেছে ফকির লালন তাদেরই একজন। সম্প্রদায় সম্প্রীতি ও ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ফকিরিবাদ বাউলতত্ত্ব মানুষের প্রধান দর্শন। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ বাঙালি সংস্কৃতির এক মহান প্রতিনিধি। লালন ফকির গানে ও সাধনায় তার দর্শনে সেই মানবিক মূল্যবোধে সেই সামাজিক চেতনায় গভীর, লালন ফকির একই সঙ্গে মরমি এবং দ্রোহী, তার গানের ভেতর দিয়ে বাউল সাধনার নানা প্রসঙ্গ অনুসৃত হয়েছে। তার গানের ভেতর দিয়ে সমাজের অসংগতি, কুপ্রথা সকল জাতপাতের ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
তাঁর গানগুলোর মধ্যে আছে দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, ভক্তিতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব, আছে মোহাম্মদ, কৃষ্ণ, যিশু, বেদ, কোরআন, বাইবেল প্রভৃতি বিষয়কে নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত জিজ্ঞাসা, মতামত, উত্তর এবং নির্দেশনা। এ সংগীতনির্ভর চিরন্তন দর্শনই ললিত নারায়ণ কর থেকে মহাত্মা লালন ফকিরে উন্নীত করেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে সুফিবাদী দর্শনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছেন লালন। লালন দর্শনের মূল কথা হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার ওপর মানুষ; এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যিনি স্রষ্টা তিনি বিরাজ করেন মানুষেরই অন্তরে। তাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-কালো-সাদা বৈচিত্র্যে মানুষকে আলাদা না করে মানুষে মানুষে প্রেম ও ভালোবাসার মাধ্যমেই পরম আরাধ্য স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব।
তাঁর বিশ্বাস ছিল মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-জৈন প্রভৃতি আকৃতিতে বিচার করলে সমাজে শান্তি কখনোই আসবে না। শুধু তাঁরই নয়, আধুনিক সভ্যতার সকলেরই বিশ্বাস যে, মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করে ভালোবাসার মধ্যেই বিশ্ব শান্তি নিহিত। তাই প্রায় দেড় শতাব্দী পূর্বে লালন যে ভাব-চিন্তার পত্তন করে গেছেন তা আজও পৃথিবীর প্রেমিক, ভাবুক, রসিক, শিক্ষিত, বিদ্বৎ সমাজকে প্রাণিত করছে এবং করে যাবে আরও সুদীর্ঘকাল। কারণ, হিংসা-বিদ্বেষ-বিভেদমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র তথা পৃথিবী বিনির্মাণে লালন দর্শন এক অনন্য আলোকবর্তিকা।
কে বলে মানুষ মরে/ ও মানুষ মরলে পরে বিচার হবে কার/ আমি বুঝলামনা ব্যাপার/ কে বলে মানুষ মরে...। গানের কলিটা কানে আসলেই কিংবা এ রকম শিরোনাম কোথাও চোখে পড়লেই এক বিশুদ্ধ অনুভূতিতে আধ্যাত্মিক চিন্তায় ও প্রেমে মানুষের হৃদয় পুলকিত হয়। এ রকমের মানুষের মনকে শীতল করার মতো জাগিয়ে তোলার মতো, অনুভূতি প্রবণ করার মতো, দশ হাজারেরও বেশি গান রচনা করে গেছেন মহাত্মা লালন ফকির ১৭৭৪ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত।
লালন পুরোদস্তুর সংসারী লোক ছিলেন। তাঁর পানের বরজ, আমের বাগান, বসতবাড়ি, নগদ টাকা, স্ত্রী, সন্তান (পালক কন্যা) এবং চলাচলের বাহন হিসেবে দুটি ঘোড়া ছিল। সমাজে লালন শাহের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি প্রায় মধ্যবিত্ত পর্যায়ের ছিল। গবেষণার ফলে বেরিয়ে এসেছে লালন ফকির নামটা শুনেই হয়তো অনেকে মনে করে লালন বিষয়হীন ফকির ছিলেন, কিন্তু মোটেও এমনটা নয়, লালন সংসারী ছিলেন। মৃত্যুকালে লালন ফকির প্রায় ২ হাজার নগদ টাকা রেখে গিয়েছিলেন। লালন সাঁই তাঁর পালক পিতা মওলানা মলম শাহ সূত্রে পাঁচ একর বসতবাড়ির ভিটা লাভ করেন, যেখানে লালন শাহ তাঁর আখড়াবাড়ি স্থাপন করেন এবং বর্তমানে যেখানে তাঁর মাজার অবস্থিত। এ ছাড়াও তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পাঁচ বিঘা জমি কিনেছিলেন। ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে শৈলকুপা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে লালন শাহের অনুকূলে দুটি দলিল সম্পাদিত হয়। যাতে তাঁকে মান্যবান ও সম্ভ্রান্ত মনুষ্য বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশিষ্ট লালন গবেষক মুহম্মদ আবু তালিবের নিকট দলিল দুটির নকল কপি রক্ষিত আছে। তাঁর ঘরবাড়ির অবস্থাও গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো ছিল। লালন শাহ সমাজে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সমাজের অনেক গণ্যমান্য ও জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল এবং তারা লালন শাহের সঙ্গে মতবিনিময় করে নিজেদের উৎকর্ষিত করে তুলেছেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন ভারতের ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা ও বিশিষ্ট পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি তার জমিদারিতে লালন ফকিরকে ডেকে নিয়ে ধর্মালাপে তৃপ্ত হতেন। এ প্রসঙ্গে মো. সোলাইমান আলী সরকার তার লালন শাহের মরমি দর্শন বইতে উল্লেখ করেছেন, বঙ্গের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এমনকি ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা, সমাজসংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক, রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁকে নিমন্ত্রণ করে শিলাইদহে নৌকায় নিয়ে ধর্মালাপে পরিতৃপ্ত হন।
ফকির লালনের ধর্মজীবন বিলক্ষণ উন্নত ছিল। মিথ্যা জুয়াচুরিকে লালন ফকির বড়ই ঘৃণা করতেন । লালন শাহের গানেও মিথ্যা ও জুয়াচুরি এবং পর রমণীর প্রতি লোভকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে বলে মনে করি। লালন বলেন, সত্য বল, সুপথে চল ওরে আমার মন/সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন/পরের দ্রব্য পরের নারী/হরণ করো না পারে যেতে পারবা না/যতবার করিবে হরণ/ততবারই হবে জনম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনকে শুধু কবি বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি লালনের কবিতাকে (গান) বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলির কবিতার সমতুল্য বলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি লালনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁকে উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, The village poet evidently agrees with our sage of Upaneshad who says that our mind comes back baffled in its attempt to reach the unknown Being; and yet this poet like the ancient sage does not give up adventure of the infinite thus implying that there is a way to its realisation. (লোককবি লালন-তপন কুমার বিশ্বাস; পৃ:-৪৮)। লালন দর্শনে বিমোহিত কবিগুরু তাই বলছেন-লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
অনেক সাধক সাধনার নামে ঘর ছেড়ে সংসারত্যাগী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। লালন তাদের উদ্দেশ করে বলেন, ঘরে কি হয় না ফকিরী/কেন রে নিমাই হলি দেশান্তরি/বলে এই কথা কান্দে শচী মাতা/লালন বলে লীলের বলিহারি। সাধন-ভজনের পথে অনেকে নারীকে বাধা মনে করে নারীসঙ্গ ত্যাগ করার পক্ষপাতী হয়েও সংসার বিবাগী হয়। তাদের উদ্দেশ করে লালনের প্রতিবাদ, কেউ নারী ছেড়ে জঙ্গলে যায়/স্বপ্নদোষ কি হয় না সেথায়/আপন মনের বাঘে যারে খায়/কে ঠেকায় রে। সুতরাং লালন ব্যক্তি জীবনে ও আদর্শগতভাবে কোন প্রকারেই সংসার বিবাগী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না; বরং তিনি একজন সচেতন সমাজকর্মী ছিলেন। সমাজের উন্নয়নের জন্য, সমাজের মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তাই তাঁর দর্শন জুড়ে কেবলই মানুষের জয়গান, মানবমুক্তির আকুতি। তিনি এই মানুষের বাইরে আর কিছুই বুঝতেন না। তাঁর ধর্মকর্ম, ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল মানুষকেন্দ্রিক। তাঁর মতে ঈশ্বর যদি থেকেই থাকে তবে এই মানুষের মধ্যেই আছে। তাই লালন বলেন, এই মানুষে আছেরে মন/যারে বলে মানুষ রতন।
তিনি যেমন একজন দায়িত্বশীল স্বামী ছিলেন, তেমনি একজন স্নেহপরায়ণ বাবা ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির কিছু অংশ তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকার (পালক কন্যা) পেরিন্নেসার নামে উইল করে যান। এ তো গেল তাঁর সাংসারিক দায়বদ্ধতার কথা।
একজন তীক্ষ্ণ সমাজসচেতন সামাজিক আন্দোলনের প্রতিবাদী নেতাও ছিলেন তিনি। সমাজে কোথাও কারও দ্বারা কোন অন্যায় সংঘটিত হলে লালন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ভাবশিষ্য ও কাঙাল হরিনাথকে বাঁচানোর কথা তো এখন ইতিহাস। এমন সমাজসচেতন, সংসারী, সামাজিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি যাঁকে বিনা দ্বিধায় সমাজসংস্কারক বলা যায়, যাঁর সামাজিক আন্দোলন সমাজে এক অপরিহার্য প্রভাব বিস্তার করে সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
আমার জানামতে লালনকে প্রথমবারের মতো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা সংবাদপত্রের সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ। ১৮৭২ সালের আগস্ট মাসে তার সাপ্তাহিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জাতি নামক এক নিবন্ধে লালন এবং তাঁর প্রচারিত ধর্মমতের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে এভাবেই উল্লেখ করা হয়, লালন শা নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা মাসিক পত্রিকায় ইহার বিশেষ বিবরণ প্রকাশ করিব। ৩/৪ বৎসরের মধ্যে এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে। (যুক্তবঙ্গে লালন চর্চার ক্রমবিকাশ; সৈয়দ মনসুর আহমদ; পৃঃ-৩৩)। কাঙাল হরিনাথের এই বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, লালন তৎকালীন ঘুণেধরা সমাজকাঠামোতে জোর ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তৎকালীন সমাজব্যবস্থা স্বভাবতই লালনের এই সামাজিক আন্দোলন দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। সামাজিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে তৎকালীন সমাজে লালন শাহের একটি অপরিহার্য অবস্থান তৈরি হয়েছিল। লালন প্রভাব তাই ঘুণেধরা সমাজের মৌলবাদী সমাজপতিদের শঙ্কিত করে তুলেছিল।
লালন চর্চার ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর লালন সাঁইজির দেহত্যাগের ১৪ দিন পর মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায়। বর্ণিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক ও এজেন্ট রাইচরণ দাস (মতান্তরে বিশ্বাস) মহাত্মা লালন ফকির নামে এক নিবন্ধে লালন সাঁইজির জীবন ও কর্মের ওপর আলোকপাত করেন। উক্ত নিবন্ধে তিনি লালন সম্পর্কে আমাদের জানান, লালন ফকিরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকি নাই। শুধু এ অঞ্চল কেন, পূর্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রঙ্গপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেকদূর পর্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকিরের শিষ্য। ইহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি। (লোককবি লালন- তপন কুমার বিশ্বাস; পৃঃ-১৩৬)। এরপর লালনের সামাজিক অবস্থান ও সমাজে তাঁর ব্যক্তি প্রভাব এবং সামাজিক প্রতিপত্তি নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। লালন শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিরলস যে সাধনা করে গেছেন তার নিদর্শন হাজারো গানের মধ্যে নিহিত আছে। আমাদের সমাজে উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, নমশূদ্র, সিয়া-সুন্নি প্রভৃতির মধ্যে যে বিভেদ তা দেখে তিনি বলেছেন- জাত গেল জাত গেল বলে/একী আজব কারখানা/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তানা নানা। অন্য আর একটি গানে বলছেন- কেউ মালা কেউ তজবী গলায়/তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়/ যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/ জাতের চিহ্ন রয় কার রে। বহুল পরিচিত জাত বিষয়ক আরেকটি গানে লালন বলছেন- গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়/ লালন বলে জাত কারে কয়/ এ ভ্রম তো গেল না। লালন বলেছেন দিব্যজ্ঞানী না হলে কেউ তার স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যকভাবে জানতে পারে না। মানুষ ভজনা ও মানবসেবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে দিব্যজ্ঞান। কারণ, নিরাকার বিধাতাই যে মানুষের মাঝে সাকার হয়ে ধরা দেয় সাঁইজি তা তুলে ধরলেন এভাবে- সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার/মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/নদী কিংবা বিল বাঁওড় খাল/সর্বস্থলে একই একজন/দিব্যজ্ঞানী হয় তবে জানতে পায়/কলিযুগে হলেন মানুষ অবতার। লালনের এ গান যেন এক অসীম শক্তির আধার, যার কেন্দ্রে আছে শুধুই মানুষ। মানবতাবোধ যার একমাত্র উপজীব্য।
পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতিতে লালনের দর্শন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। ভেদাভেদ নয়, অভেদ দর্শনই পারে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে শান্তিময় পৃথিবী বিনির্মাণ করতে, সেটাই লালন ফকিরের গানে ও বাণীতে ফুটে উঠেছে। তাই নিঃসন্দেহে উচ্চারণ করা যায় শৈল্পিক সৌন্দর্য ও মানবতাবাদে লালন ফকির জ্বলন্ত আলোক শিখ।
লেখক: কবি ও গবেষক
ঝালকাঠির রাজাপুরে ট্রাকচাপায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যসহ দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার ঝালকাঠি-পিরোজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের নৈকাঠি পালেরবাড়ি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত দুই মোটরসাইকেল আরোহী হলেন- উপজেলার সদর ইউনিয়নের পূর্ব রাজাপুর এলাকার মৃত আব্দুল করিম হাওলাদারের ছেলে মো. আলী হায়দার মহারাজ (৫৩) ও একই ইউনিয়নের আংগারিয়া গ্রামের মৃত নাজেম আলী তালুকদারের ছেলে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন শাহিন (৫৬)। নিহতরা একে অপরের মামাতো ও ফুপাতো ভাই।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, মংলা বন্দর থেকে ছেড়ে আসা একটি কাভার্ডভ্যান বরিশালের দিকে যাচ্ছিলো। এসময় রাজাপুর থেকে পিরোজপুরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল মোটরসাইকেল আরোহীরা। পথিমধ্যে নৈকাঠি পালের বাড়ি এলাকায় ট্রাকটি মোটরসাইকেল আরোহীদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে রাজাপুর থানা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে এবং লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।
এ ঘটনার পর চালক ট্রাক নিয়ে পালিয়ে গেলেও রাত ১১টার দিকে রাজাপুর সদর হাসপাতালের সামনে থেকে ট্রাকটি জব্দ করে পুলিশ।
রাজাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুলক চন্দ্র রায় বলেন, চালক পালিয়ে গেলেও ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে। পরিবারের কোন আপত্তি না থাকায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।এ ব্যাপারে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হবে।
আইন অনুযায়ী তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের একক ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হলেও তাদের তা করতে দেওয়া হয় না। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের একক এখতিয়ার কমিশনের থাকলেও সম্প্রতি সেটিও খর্ব হয়েছে।
সরকারের নির্বাহী আদেশ আর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের হস্তক্ষেপের কারণে লাইসেন্সসংক্রান্ত কাজের পাশাপাশি সীমিত পরিসরে বিরোধ মীমাংসা ছাড়া আর কিছুই এককভাবে করতে পারছে না জ্বালানি খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে ভোক্তার মতোই কমিশনও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে কমিশনের মোট জনবল সংখ্যা ৮৪। প্রতি বছর বেতনভাতা ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। দিনে দিনে ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ কী বা এ কমিশনের কোনো প্রয়োজন আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানতে চাইলে বিইআরসির সদস্য মোহাম্মদ মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী গত সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, “এখন শুধু লাইসেন্সসংক্রান্ত কিছু কাজ আর ‘আরবিট্রেশনটা’ (বিরোধ মীমাংসা) কমিশনের হাতে আছে। দরকার হলে দুদিন পর সরকার সেটাও ‘উইথড্র’ (প্রত্যাহার) করবে। যখন দেখবে আরবিট্রেশনগুলো সুবিধাভোগীদের বিপক্ষে যাচ্ছে তখন এটাও উইথড্র হবে। সরকারের নির্বাহী ক্ষমতায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সুযোগ রেখে যে আইন হলো তা করা হয়েছে তাদের মোটাতাজা করার জন্য।” তিনি বলেন, ‘নতুন এ আইন করার ফলে আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের কাছ থেকে দূরে গেল না কাছে এলো সেই বিষয়টা অনুধাবন করা দরকার।’
খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বিইআরসির এ সদস্য বলেন, ‘আমার মেয়াদ আছে আর কয়েক দিন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করিনি। কারণ আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছেন যেটা তোমার পছন্দ হবে না সেই কাজ তুমি করবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছি।’
বিইআরসির কার্যাবলির প্রথমেই জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি, জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত এবং এনার্জি অডিটের মাধ্যমে জ্বালানি ব্যবহারের খরচের হিসাব যাচাইয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এগুলোর বাস্তবায়ন নেই বললে চলে। অন্যদিকে জ্বালানি খাতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করা এবং সরকারকে সুপারিশ করা কমিশনের কার্যাবলির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এর বাস্তবায়ন তেমন একটা চোখে পড়ে না।
উচ্চ আদালতের আদেশে কমিশন প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের মূল্য সমন্বয় শুরু করেছে। কিন্তু বাজারে কখনই বিইআরসি ঘোষিত মূল্যহার অনুযায়ী এলপি গ্যাস পাওয়া যায় না। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গ্যাস বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানির সামান্য সিস্টেম লস কমাতে পারে না কমিশন। সেখানে অন্যান্য কাজ কীভাবে করবে? বিইআরসি নির্দেশ দেয়। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না। এ জন্য কিছু করারও সক্ষমতা নেই কমিশনের।’
সূত্রমতে, অভিযোগের ভিত্তিতে বিইআরসি আইন অনুযায়ী লাইসেন্সি প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তার মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে কমিশন। কিন্তু গত ১০ বছরে কমিশনে ৩৭৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ২১০টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তির হার কম হওয়া এবং জনসচেতনার অভাবে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ কম করা হয় বলে অনেকে মনে করেন।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করতে করতে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা ভোক্তার জন্য এবং বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত তথা সামগ্রিক দেশের জন্য অশনিসংকেত।’ তিনি বলেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত পুরোপুরি কারিগরি। এর সঙ্গে আইনের নানারকম বিষয় জড়িত। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের এসব বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সই করা ছাড়া তারা কিছুই করে না। এভাবে তো সাধারণ মানুষের কল্যাণ সম্ভব নয়। বিইআরসি গণশুনানির মাধ্যমে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত বলে সেখানে কিছুটা হলেও বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহিতা করতে হতো। তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুযোগ ছিল। সেখানে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল বলে কোম্পানিগুলোও যেনতেন হিসাব উপস্থাপন করে মূল্যহার বাড়ানোর ব্যাপারে কঠিন চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন হয়। কিন্তু আইন সংশোধনের কারণে সেই সুযোগ আর থাকল না। তড়িঘড়ি করে করা এ সংশোধন অসাধু ব্যবসাকে সুরক্ষা দেবে বলে তিনি দাবি করেন।
শামসুল আলম মনে করেন, বিইআরসি আইন সংশোধন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে ক্ষমতার সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে সরকার। অন্যদিকে বিইআরসি আইন অনুযায়ী তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের একক ক্ষমতা বিইআরসির হলেও তারা তা করতে পারে না। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ আইন লঙ্ঘন করে অনেক আগে থেকেই অবৈধভাবে তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করে আসছে।
খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) নিজে তরল জ্বালানি ব্যবসায়ী তথা বিইআরসির লাইসেন্সি হওয়া সত্ত্বেও ফার্নেস অয়েলের মূল্য বিপিসিই নির্ধারণ করে। আর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে অন্যসব কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেলের ক্রয়-বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়। এসব ক্ষেত্রে সিস্টেম লসের নামে তেল চুরি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল ও কয়লার ব্যবহার বেশি দেখানো হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন কোম্পানি এবং সংস্থার পরিচালনা বোর্ডে পদাধিকারবলে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্য কর্মকর্তা কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালক। ফলে ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় বিইআরসি এসব প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।
সরকারের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রবল চাপে ২০০৩ সালের মার্চ মাসে বিইআরসি আইন করা হয়। এরপর ২০০৫, ২০১০ ও ২০২০ সালে এ আইন সংশোধন করা হয়। এর মধ্যে আইনের ৩৪ ধারার উপধারা-৫-এ উল্লেখযোগ্য সংশোধনী আনা হয় ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর। এর আগে বছরে সর্বোচ্চ একবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম সমন্বয় বা পুনর্নির্ধারণের সুযোগ থাকলেও নতুন ওই সংশোধনীতে একাধিকবার দাম পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে গ্রাহকের কাঁধে এক বছরেই একাধিকবার দাম বৃদ্ধির খড়গ নেমে আসে।
সম্প্রতি বিইআরসির পাশাপাশি সরকারকে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম পুনর্র্নির্ধারণ ও সমন্বয় করার ক্ষমতা দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এরপরই গণশুনানি ছাড়াই চলতি মাসে এক সপ্তাহের মধ্যে নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
সরকারের ওই আদেশ জারির আগে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদন নিয়ে গত ৮ জানুয়ারি গণশুনানি করেছিল বিইআরসি। চলতি মাসে মূল্যসংক্রান্ত নতুন আদেশ দেবে বলে জানিয়েছিল কমিশন। কিন্তু এর মধ্যেই গত ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে বিইআরসির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
বিইআরসির আইন অনুযায়ী, গণশুনানির মাধ্যমে দাম সমন্বয় হবে। এ ক্ষেত্রে বাড়তেও পারে কমতেও পারে। কিন্তু বিইআরসির দাম কমানোর কোনো নজির নেই। গণশুনানিতে ভোক্তারা দাম কমানোর বিষয়টি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেও তা আমলে না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দাম বাড়ানোর সময় অবশ্য সংস্থাগুলোকে সাশ্রয়ী ও দক্ষ হওয়ার পরামর্শসহ নানারকম শর্ত জুড়ে দেয় কমিশন।
তবে বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানির প্রস্তাব অনুসারে, কখনই দাম বাড়ায়নি বিইআরসি। এর আগে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এলেও বিইআরসি বাড়িয়েছে ২০ শতাংশ। গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এলে বিইআরসি বাড়িয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ।
চলতি বিপিএলে দারুণ খেলছেন পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার ওয়াহাব রিয়াজ। ৬ ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়ে এখনও পর্যন্ত আসরের সর্বাধিক উইকেট শিকারি খুলনা টাইটান্সের এই তারকা। মাঠে দারুণ সময় কাটানো ৩৭ বছর বয়সী এবার মাঠের বাইরে থেকে পেলেন দারুণ এক সুখবর। বিপিএল চলাকালেই মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পেলেন তিনি।
পাকিস্তান জাতীয় দলের সাবেক পেসারকে পাঞ্জাব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রী করা হয়েছে। দেশটির খেলাধুলা বিষয়ক জনপ্রিয় চ্যানেল ‘এ’ স্পোর্টস এক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মহসীন নাকভির অধীনে ক্রীড়া মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ওয়াহাব। সব সংস্করণ মিলিয়ে যিনি দেশের হয়ে ১৫৬ ম্যাচ খেলেছেন। উইকেট নিয়েছেন ২৩৭টি।
২০১৭ সালে পাকিস্তানের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ী দলের সদস্য ছিলেন ওয়াহাব। জাতীয় দলের হয়ে সবশেষ খেলেছেন তিনি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে।
চলতি বিপিএলে বিশ্বের ষষ্ঠ বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে ৪০০ উইকেটের মাইলফলকও ছুঁয়েছেন ওয়াহাব। সব মিলিয়ে মাঠ ও মাঠের বাইরে দারুণ সময় কাটছে তার।
অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের মিক্সড ডাবলসে হেরে গিয়ে গ্র্যান্ড স্ল্যামকে বিদায় জানিয়েছেন সানিয়া মির্জা। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকালে শেষ হয় সেই ম্যাচ। যে ম্যাচের প্রায় দশ ঘণ্টা পর স্ত্রী সানিয়াকে শুভেচ্ছা জানান শোয়েব মালিক। এই মুহূর্তে বিপিএলে ব্যস্ত সময় কাটানো পাকিস্তানের ক্রিকেটার জানিয়েছেন, স্ত্রীর কৃতিত্বে তিনি গর্বিত।
গ্র্যান্ড স্ল্যামে সানিয়া শেষ ম্যাচ খেলার পর থেকেই দেশ-বিদেশ জুড়ে অগণিত বার্তা পেয়েছেন। কিন্তু শোয়েবের বার্তা কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। দু’জনের মধ্যে তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক দূরত্বের জল্পনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল এই নৈঃশব্দ্য। অবশেষে শুক্রবার সন্ধ্যার পর টুইট করেন শোয়েব।
সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক লিখেছেন, ‘খেলাধুলোর জগতে সব নারীদের কাছেই তুমি আশার প্রতীক ছিলে। গোটা টেনিস জীবনে যা যা অর্জন করেছ, তার জন্য অত্যন্ত গর্বিত। তুমি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা। এ ভাবেই শক্তিশালী হয়ে আগামী দিনে এগিয়ে যাও। অবিশ্বাস্য টেনিস জীবনের জন্যে অনেক শুভেচ্ছা।’
আরও পড়ুন
বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে আজও শীর্ষ অবস্থানে রাজধানী ঢাকা। এনিয়ে টানা আটদিন শীর্ষে রয়েছে ঢাকা।
শনিবার (২৮ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) স্কোর ২২১ রেকর্ড করা হয়েছে। যার অর্থ হলো জনবহুল এ শহরের বাতাসের মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে রয়েছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার এ তালিকা প্রকাশ করেছে।
২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোর 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' বলা হয়, যেখানে ৩০১ থেকে ৪০০ এর স্কোর ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
এ তালিকায় ২১৬ একিউআই স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে পাকিস্তানের লাহোর; ১৯০ নিয়ে তৃতীয় ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই। এরপর চতুর্থ স্থানে থাকা মঙ্গোলিয়ার উলানবাটোরের স্কোর ১৮৭ এবং পঞ্চম স্থানে থাকা উজবেকিস্তানের তাসখন্দের স্কোর ১৭১।
মেগাসিটি ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে বায়ুদূষণে। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়।
২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো: ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলা।
বর্তমানে শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণকাজ, রাস্তার ধুলা ও অন্যান্য উৎস থেকে দূষিত কণার ব্যাপক নিঃসরণের কারণে ঢাকা শহরের বাতাসের গুণমান দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।