
প্রায় ৯ বছর পর নতুন একটি এয়ারলাইনস পেখম তুলে বাংলাদেশের আকাশ পরিবহনকে স্বস্তির আবহাওয়ায় ভরিয়ে দিচ্ছে। ১৭ জুলাই ২০১৪ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস এর পর বাংলার আকাশে বিচরণ করতে যাচ্ছে দেশের নবীনতম বিমান সংস্থা এয়ার অ্যাস্ট্রা। বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশনে আসছে ২৪ নভেম্বর ২০২২ তারিখকে স্মরণীয় করে রাখতে এয়ার অ্যাস্ট্রা ঢাকা থেকে কক্সবাজার ফ্লাইট পরিচালনার মধ্য দিয়ে দেশের আকাশপথকে রঙিন করে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশের আকাশ পরিবহন শিল্পের ইতিহাস অম্ল মধুর। নানারকম উচ্ছ্বাস আর আবহ নিয়ে দেশের আকাশপথে বিচরণ করার জন্য বেসরকারি বিমান সংস্থা জিএমজি এয়ারলাইনস, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ সহ ৮/৯ টি এয়ারলাইনস এর শুভাগমণ ঘটেছিল কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ সেসব এয়ারলাইনস ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে।
প্রায় ২৬ বছর যাবৎ বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো নানাভাবে বাংলাদেশ আকাশ পরিবহনকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। বারবার বন্ধুর পথে হোঁচট খেতে হয়েছে। বন্ধ হওয়ার মিছিলকে সমৃদ্ধ করেছে, যা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। এয়ার অ্যাস্ট্রা আগমনে এই বন্ধ হওয়ার মিছিলের পরিবর্তে এগিয়ে যাওয়ার মিছিলে রূপান্তরিত হবে এই প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন।
একটি এয়ারলাইনস এর আবির্ভাবে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা বাংলাদেশের মতো অধিক জনবহুল দেশে বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। একটি দেশের আকাশ পথের গতিশীলতা থাকলেই অন্যান্য সকল শিল্পের গতিশীলতা বজায় থাকে। এয়ার অ্যাস্ট্রা আগমনে প্রত্যাশা অনুযায়ী অন্যান্য সকল শিল্পের গতিশীলতা আরও বেশি বেগবান হবে।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প মূলত দেশীয় পর্যটকদের ওপরই নির্ভরশীল। দেশের পর্যটন শিল্পকে আরও বেশি বিকশিত করার জন্য এয়ার অ্যাস্ট্রা আগমনে যেন এই শিল্পে সুবাতাস বয়ে যাচ্ছে। শীতের প্রারম্ভে সারা বিশ্বের জনপ্রিয় নিউ জেনারেশন এয়ারক্রাফট এটিআর ৭২-৬০০ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা নিয়েছে এয়ার অ্যাস্ট্রা।
কোভিড ১৯ এর কবলে পড়ে সারা বিশ্বের অ্যাভিয়েশন শিল্প চরম দোদুল্যমান অবস্থায় পড়েছিল। অনেক সুখ্যাত সম্পন্ন এয়ারলাইনস করোনা মহামারির করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হয়ে প্রি-কোভিড অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি। সেখানে এয়ার অ্যাস্ট্রার আগমণ বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশন শিল্পের অগ্রগতির পরিচায়ক বহন করছে, সঙ্গে দেশের অর্থনীতি পজিটিভ সূচককে নির্দেশিত করছে।
বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশনে করোনা মহামারিতে বিপরীত চিত্রও দেখতে পাই, প্রায় দশ বছরের অধিক সময় ধরে সেবা দেওয়া এয়ারলাইনস রিজেন্ট এয়ারওয়েজ কোভিড ১৯ এর শুরুতে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল রিজেন্ট এয়ারওয়েজকে। যা আজ অবধি আর ব্যবসায় ফিরে আসতে পারেনি।
বর্তমানের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা দিয়ে ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত রাখা প্রত্যেকটি ব্যবসায় সেই নীতি বহন করা উচিত। শুধুমাত্র বর্তমানকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ভবিষ্যৎ ব্যবসাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে দেখা গেছে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে। অনির্ধারিত মহামারি অ্যাভিয়েশন শিল্প কিংবা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পর্যটন শিল্প কিংবা হোটেল ইন্ডাস্ট্রি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
করোনা মহামারির কারণে হাজার হাজার কর্মক্ষম লোক বেকার হয়ে গেছে। করোনা পরবর্তীতে এয়ার অ্যাস্ট্রা আগমনে প্রায় তিন শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে যা বেকার সমস্যা দূরীকরণে ভূমিকা রাখছে। প্রাথমিকভাবে দু’টি এয়ারক্রাফট দিয়ে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে এয়ার অ্যাস্ট্রা। ঢাকা থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম রুটে ফ্লাইট শিডিউল ঘোষণা করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন নতুন এয়ারক্রাফট, নতুন নতুন রুট, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশন শিল্প পজিটিভিটি নিয়ে এগিয়ে যাবে।
এয়ার অ্যাস্ট্রার আগমনের কারণে দেশের জিডিপিতে অংশীদারত্ব বাড়বে বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন ও পর্যটন শিল্পের। একটি নতুন এয়ারলাইনস কিন্তু প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব ইমরান আসিফ সহ অভিজ্ঞতায় ভরপুর একটি পরিচালনা পর্ষদ এয়ার অ্যাস্ট্রাকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা থাকছে একজন অ্যাভিয়েশন কর্মী হিসেবে।
এয়ার অ্যাস্ট্রা বাংলাদেশের আকাশ পরিবহনে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস, নভোএয়ার সহ জাতীয় বিমান সংস্থার সঙ্গে উন্নত সেবা আর সাশ্রয়ী ভাড়ায় দেশীয় যাত্রীদের আস্থা অর্জন করবে এই প্রত্যাশা সকলের। প্রত্যাশার পারদ ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বগতির কারণে আশা করছি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারে বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে শেয়ার বৃদ্ধি করে দেশীয় অ্যাভিয়েশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এয়ার অ্যাস্ট্রা।
এয়ার অ্যাস্ট্রার আগমনে একজন অ্যাভিয়েশন কর্মী হিসেবে জানাই স্বাগত।
লেখক: মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে চীনে রপ্তানি হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে এই মন্দাভাব অব্যাহত থাকবে। দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। যে কারণে এশিয়ার অন্য দেশগুলোর অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চিনে করোনা মহামারির প্রভাবে বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন চাহিদা কমছে। আর এ কারণে দেশটিতে আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড বারবেরি জানিয়েছে চীনে তাদের বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
চীনের রপ্তানি বাণিজ্যও সংকুচিত হয়েছে। ভারত চীনা পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চলছে বাণিজ্য-যুদ্ধ। হংকং নিয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক খারাপ। ফলে দ্রুত আর্থিক অবস্থার উন্নতির সম্ভাবনা সামনে নেই। এরই মাঝে করোনার আবার নতুন ঢেউ । অর্থনীতির নিম্নগতি সত্ত্বেও দেশটি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শূন্য কোভিড নীতি অনুসরণ করেছিল। কিন্তু জনরোষের কারণে তার কিছুটা প্রত্যাহার করতে হয়। এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে করোনা প্রতিরোধ ও অর্থনীতির সূচককে ঊর্ধ্বমুখী করতে।-খবর জাপানি সংবাদ সংস্থা এনএইচকে ওয়ার্ল্ড-এর।
প্রতিবেদনে থাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে দেশটিতে ডিসেম্বর মাসে চীনে রপ্তানি ১৪ দশমিক ছয় শতাংশ কমে প্রায় ২১ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এটি পতনের টানা তৃতীয় মাস ছিল। এই তিন মাসে চীনে রপ্তানি কমেছে ২০.৮ শতাংশ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ডিসেম্বরে চীনে-তেল রপ্তানি ২০ দশমিক ছয় শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। গড়ে তিন মাসে চীনে রপ্তানি ৩১ দশমিক আট শতাংশ কমেছে।
যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ টমি উ বলেছেন, "মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে গত বছরের চীনের দ্বিতীয় কোয়ার্টারের জিডিপির হিসাব ছিল সবচেয়ে খারাপ। লকডাউনের কারণে, বিশেষ করে সাংহাইতে করোনা বিস্তারের কারণে এই কোয়ার্টারের শুরুতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।"
চীন সরকার তার কঠোর সংক্রমণ বিরোধী ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার পরও থেকে চীনের অর্থনীতি বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন পশ্চিমা দেশগুলির আর্থিক সংকোচন নীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার ওডর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা এসব কিছু মিলিয়ে চীন থেকে আমদানি রপ্তানি সামনের মাসগুলিতে আরও বাধাগ্রস্ত হবে। ইউরোপভিত্তিক সংবাদ বিশ্লেষক ‘ইনসাইড ওভার’ সম্প্রতি করা এক প্রতিবেদনে বলেছে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া আর মন্দা অর্থনীতি এ দুটি বিষয় নিয়ে চীন উভয়সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চীনের শূন্য কোভিড নীতি হয়তো দেশটির মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে কিন্তু অর্থনীতির ওপর ফেলেছে বিরূপ প্রভাব।
বলা হয়েছে যে বেইজিং যদি "আসন্ন কোভিড তরঙ্গ দ্বারা ক্ষতি সামাল দিতে জিরো কোভিড নীতি পুনর্বহাল করে, তবে তা অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে৷ আর যদি তা না করা হয়, তবে মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।"
গত ৮ জানুয়ারি শূন্য কোভিড নীতি থেকে সরে আসে দেশটি। ঘোষণা আসার পর থেকে বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়ানো নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানও চীনে নতুন করে সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে। ভারত ও জাপান সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। চীন থেকে আসা ব্যক্তিদের ওপর নতুন কোভিড বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
যে হারে করোনা ছড়াচ্ছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে আগামী দিনে এক মিলিয়নেরও বেশি কোভিড সম্পর্কিত মৃত্যুর সাক্ষী হতে পারে চীন। একই সময়ে, দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব কাটাতেও সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই বছর ২ দশমিক আট থেকে-৩ দশমিক দুই শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা হবে গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হবে৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরের শেষের দিকে করোনার কারণে কলকারখানা ও ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এত চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গত নভেম্বরে খুচরা বিক্রি কমেছে ৫ দশমিক নয় শতাংশ। শিল্প ও কলকারখানা থেকে আয় কমেছে ২ দশমিক দুই শতাংশ। আর সম্পদে বিনিয়োগ কমেছে ৫ দশমিক তিন শতাংশ। চীনে বেকারত্বের হার বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যেখানে দেশটির শ্রমের প্রধান শক্তি ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এটি বেড়ে ১৭ দশমিক এক শতাংশে পৌঁছেছে। এ ছাড়া দেশটির আবাসন খাতেও এখন গভীর মন্দা চলছে এবং সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে চীনের সঙ্গে ব্যবসা সম্পর্কযুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতির পরিস্থিতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অন্য দেশগুলোর তুলনায় এসব দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির ঘোড়ায় লাগাম দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। চোখের সামনেই শ্রীলঙ্কা নেপাল এবং পাকিস্তান এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মূল্যস্ফীতির চাপে দেশগুলো দিশেহারা।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৩ সালে জ্বালানি খাত বাদে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। এটি আগের পাঁচ বছরের গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার অতিরিক্ত ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে চলতি বছরেই এরই মধ্যে এ হার গড়ে ২ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে তারা। এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে দ্রুত অর্থনীতি বর্ধনশীল দেশগুলোর জনগণ। যুদ্ধ, বৈরী পররাষ্ট্রনীতি, অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার; এসব বাদ দিয়ে বিশ্বনেতাদের উচিত বৈশ্বিক মন্দা কাটাতে একযোগে কাজ করা। মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত রাষ্ট্রপ্রধানদের। এর সঙ্গে বাড়াতে হবে বিনিয়োগও।
এমন কিছু দৃশ্য থাকে যেগুলো আমাদের সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। ২০১৭ সনের ৮ জুলাই অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন গঠিত হয়, এই তো ঢাকার শাহজাদপুরে। গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় যারা প্রাণ হারান তাদেরই একজন হাস্যোজ্জ্বল অবিন্তা কবির। ফাউন্ডেশন উদ্বোধনের দিন সাংবাদিক হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ যখন কথা বলতে পোডিয়ামে ওঠেন তখন আমিও অনেকের মতো কান্না ধরে রাখতে পারিনি। রুবা আহমেদ কথা বলতে পারছিলেন না, একটি শব্দও না। সেদিন তার অশ্রুই তার ভাষা হয়ে উঠেছিল।
তখন রুবা আহমেদ আদরের সন্তানের স্মৃতি পাথেয় করে শোক মোকাবেলা করছিলেন। তখনো তিনি জানেন না, ভবিষ্যতে তাকে একটি সিনেমা প্রতিহত করার লড়াইয়ে নামতে হবে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে সেই জঙ্গি হামলা নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘ফারাজ’-এর ট্রেলার। ঘোষণা এসেছে সিনেমা আসছে ৩ ফেব্রুয়ারি। ২০১৯ সন থেকে এই সিনেমার বিরোধিতা করে আসছে অবিন্তা পরিবার। প্রথম দিকে হয়তো তারা ভেবেছিলেন একজন মায়ের আবেগকে শ্রদ্ধা জানিয়েই ফারাজ পরিবার এই সিনেমা করা থেকে সরে আসবে। তা হয়নি। রুবা আহমেদকে দিল্লির আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) সাংবাদিকদের সামনে এসেছিলেন রুবা আহমেদ। এ বিষয়ে আগে কখনো তাকে সামনে আসতে দেখা যায়নি। এবার তিনি এসেছেন একজন মা হিসেবে। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা থেকে শুরু করে দিল্লির হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ানো—সবটাই বললেন তিনি। শেষে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ পায় ‘আমি জানি, হয়তো আমি কিছু করতে পারবো না’ বাক্যেটিতে। তার কষ্ট, কেউ তার আবেগকে নূন্যতম সম্মান দেখালো না। একজন মায়ের ভালোবাসাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বাজারে আসছে ‘ফারাজ’। সিনেমাটি দেখার সুযোগ করে দেয়া তো দূরের কথা সিনেমা তৈরিতে তাদের সম্মতিও নেয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন তিনি। এর পাল্টা কোনো বক্তব্য থাকলে ফারাজ পরিবার দিক। না, কখনো এবিষয়ে কথার বলার প্রয়োজন মনে করেনি তারা।
রুবা আহমেদর চান না এই সিনেমায় অবিন্তাকে মূর্ত করা হোক, সে রাতের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পুনরুৎপাদন দেখতে তার আপত্তি। তিনি শঙ্কিত তার কন্যার ও তার প্রাইভেসি নিয়ে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ফারাজ তার কন্যা অবিন্তার জন্য জীবন দিয়েছে তা তিনি বিশ্বাস করেন না। কেননা এই ন্যারেটিভের পেছনে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ নেই। না আছে কোনো সাক্ষী।
রুবা আহমেদর এই কথাটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ফারাজ হিরো, জঙ্গিরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু সে তার দুই বন্ধু—অবিন্তা ও তারিশির জন্য রয়ে যায় এবং প্রাণ হারায়। এই যে ন্যারেটিভ—তার ভিত্তি কি? বলা হচ্ছে ‘ফারাজ’ সিনেমাটির অন্যতম ভিত্তি সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবুর লেখা ‘হোলি আর্টিজান: একটি জার্নালিস্টিক অনুসন্ধান’ শিরোনামের বই।চলুন দেখি ফারাজের ‘বীরত্ব’ সম্পর্কে সেই বই কি বলছে,
‘ফারাজ অবিন্তা ও তারিশি জৈনকে সকালের দিকে হত্যা করা হয় বলে একাধিক গণমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। ফারাজের নিকটাত্মীয় হিশাম হোসাইনের বরাত দিয়ে ২ জুলাই ২০১৬ তারিখে নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে হিশাম হোসাইন বলেন, ফারাজকে জঙ্গিরা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল এবং তিনি দুই বান্ধবীকে ছেড়ে আসতে চাননি বলে তাকে তাকে হত্যা করা হয়। তবে অনুসন্ধানে এরকম কোনো তথ্যের সত্যতা মেলেনি। প্রকৃতপক্ষে রাত সাড়ে ১২টার থেকে ১টার পর কাউকে হত্যার ঘটনা কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বলতে পারেননি। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারাও প্রত্যক্ষদর্শীদের যে জবানবন্দি নিয়েছেন তাতে এমন কোনো ঘটনার কথা উল্লেখ নেই। সিটির (কাউন্টার টেরোরিজম) প্রধান মনিরুল ইসলাম আমাকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত তাদের তদন্তে ফারাজকে জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়ার কোনো ঘটনার কথা কেউ বলতে পারেনি।’
আমি মনে করি, ইতিহাস নির্মোহ। আপনার মনে হতে পারে আপনি ইতিহাস নিয়ে খেলতে পারেন, এই ধারণাটা ভুল। কেননা, আপনি যে খেলছেন একসময় ইতিহাস তাও বলে দেয়।
লেখক: দৃশ্যগল্পকার
গত ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে নেপালের পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পরে গত রোববার ইয়েতি এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয় অবতরণের কয়েক মিনিট আগে। নিহত হয় বিমানের সব যাত্রী। ফ্লাইটটিতে পাইলট কেবিনক্রু ও যাত্রী মিলিয়ে ৭২ জন ছিলেন। এর আগে গত বছর ২৯ মে পোখরা পুরোনো বিমানবন্দর থেকে জমসম যাওয়ার সময় বিধ্বস্ত হয়েছিল তারা এয়ারের একটি অভ্যন্তরীণ বিমান। নিহত হয়েছিল বিমানের ২২ জন যাত্রী পাইলট ও কেবিন ক্রু। এটিও ছিল ইয়তি এয়ারলাইনসের মালিকানাধীন।
হিমালয় পর্বতমালা বেষ্টিত দেশটিতে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা এটি। অ্যাভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের তথ্যমতে ২০১৮ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশের ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের বিমান বিধ্বস্ত হয় কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে। সে ঘটনায় নিহত হন ৫১ জন। সবচেয়ে খারাপ দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৯২সালে। সেসময়ে কাঠমান্ডুতে অবতরণের ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১৬৭ জন নিহত হন। একই বছর, একই বিমানবন্দরের কাছে থাই এয়ারওয়েজের বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১১৩ জন যাত্রী মারা গিয়েছিল। ফ্লাইট সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, ১৯৪৬ সাল থেকে নেপালে ৪২টি মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে। আর ২০০০ সাল থেকে দেশে বিমান বা হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ৩৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
আকাশ পরিবহনে দুর্বল নিরাপত্তা নিয়ে অতীতে অনেকবার সমালোচিত হয়েছে নেপাল। সমন্বিত পরিকল্পনা, বিনিয়োগ স্বল্পতা, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলে ঘাটতি এবং বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের বৈরী ভূগঠন এবং বৈরী আবহাওয়া সবকিছু মিলিয়ে দেশটির বিমান চলাচল ব্যবস্থাকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। ইয়তি এয়ারলাইনসের পর পর দুটি দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে নেপালে আকাশপথে ভ্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি আবারও বিশ্বের বিমান চলাচল ব্যবস্থার সামনে একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উঠে এল।
নেপালে কেন এমনটা বারবার হচ্ছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমান পরিচালনা ও পরিবহনে যে সব জায়গাগুলোতে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া দরকার সেগুলো উপেক্ষা করে আসছে নেপাল। একই অভিযোগ করেছিল ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও)’রও। তাদের নিরাপত্তা উদ্বেগ উত্থাপনের পরপরই ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সমস্ত নেপালি এয়ারলাইনসগুলোকে দুর্বল সুরক্ষা মানদণ্ডের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের ২৭ টি দেশে ওড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যেটি এখনো বলবৎ রয়েছে। অবশ্য আইসিএও ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নেপালের বিমান চলাচলকে কালো তালিকা থেকে সরিয়ে দিলেও, আইসিএওর দিক নির্দেশনা এখনো পুরোপুরি অনুসরণ করেনি দেশটি। আইসিএওর দেওয়া পরামর্শগুলোর দিকে নজর না দিয়ে নেপাল অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেই বেশি জোর দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বের এয়ার সেফটি বিশেষজ্ঞরা। সদ্যনির্মিত পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছেন তারা। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভস যুক্ত হয়ে নেপাল চীন থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে এই বিমান বন্দরটি বানিয়েছে। আকাশ নিরাপত্তায় পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ না করে পোখরায় পুরোনো বিমান বন্দরের কাছেই পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করেছে। যেটি এখন আর্থিকভাবে লাভজনক হবে কিনা সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন তারা।
যদি পোখরা বিমানবন্দর সময়মতো আর্থিকভাবে লাভ করে ঋণ পরিশোধ না করতে পারে তাহলে এর পরিণতি শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দরের মতোই হতে পারে বলে তাদের ধারণা। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে পোখরা বিমানবন্দরটি এর আগে চালু হওয়া নেপালের ভৈরহাওয়ার গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো একই পরিণতিতে পড়তে পারে। কারণ বিদেশি এয়ারলাইন কোম্পানিগুলি দুর্গম ও বৈরী পরিবেশ ও অপ্রতুল আকাশ নিরাপত্তার অভিযোগে বিমানবন্দরটি বাতিল করে দিয়েছিল। গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এখন কোনো আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন ফ্লাইট পরিচালনা করে না।পোখারার পুরোনো বিমানবন্দর গত অর্থবছরে ০.৯ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। করোনা সংক্রমণ কমার পর ফ্লাইট যোগ করায় এটাই সর্বোচ্চ আয়। গত ১ জানুয়ারির পর নতুন পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সব অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন বিমান সংস্থা কার্যক্রম শুরু করেনি। নিকট ভবিষ্যতেও যে বিভিন্ন দেশের বিমান পোখরায় কার্যক্রম শুরু করবে তেমন কোন লক্ষণও নেই। নতুন বিমানবন্দর করে যদি আন্তর্জাতিক বিমান পরিচালনা করা না যায় তবে আয় তেমন একটা বাড়ানো সম্ভব হবে না ‘বলেছেন সিভিল অ্যাভিয়েশন অথোরিটি অফ নেপালের (সিএএএন) এর এক কর্মকর্তা। কেননা নেপালে ক্রমান্বয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো এই ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে আন্তর্জাতিক মহলে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন নতুন বিমানবন্দর না বানিয়ে নেপালের আকাশ নিরাপত্তা উন্নয়নের দিকেই বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। ‘যদিও নেপাল সিভিল অ্যাভিয়েশন আকাশ নিরাপত্তা উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবে বাস্তবতা হলো নিরাপত্তা রেকর্ড এখনো অন্য যে কোন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের স্তরে পৌঁছাতে পারেনি’- বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার রয়েল মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি) অধ্যাপক ক্রিস্টাল ঝাং। তিনি মন্তব্য করেন, ‘যদিও নেপালের মনোরম ল্যান্ডস্কেপ পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে কিন্তু, এটি অ্যাভিয়েশন অপারেটরদের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, নেপালে বিমান ভ্রমণ আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিমানবন্দরের পরিকাঠামো উন্নয়ন বিমান চলাচল বাড়ার তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর ফলে বিমানবন্দরে যানজট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকিও বেড়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলো যেতে চাচ্ছে না নেপালে।
পোখরা বিমানবন্দর প্রকল্পের প্রধান বিনিশি মুনাকার্মির দেওয়া তথ্যমতে, ৩০০ মিলিয়ন ডলারের পোখরা বিমানবন্দর প্রকল্পটি চীনের এক্সিম ব্যাংক (এক্সিম) থেকে ঋণ নিয়ে করা হয়েছে। যার মধ্যে ২০৯ মিলিয়ন ডলার সরল সুদে। চুক্তি অনুযায়ী, এই ঋণের ২৫ শতাংশ সুদমুক্ত এবং অবশিষ্ট ঋণ ২ শতাংশ সুদ হারে, যা অন্যান্য বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এক্সিম ছাড়াও, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নের জন্য ওপেক তহবিলও ঋণ ও অনুদানের আকারে বিমানবন্দর প্রকল্পটিকে লগ্নি করেছে।
এটা আনন্দের যে, পোখরা শেষ পর্যন্ত নিজস্ব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুলছে, তবে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে। নেপালকে এ বছর মার্চ মাস থেকে এক্সিম ব্যাংককে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। বিমানবন্দরের তথ্য কর্মকর্তা জ্ঞানেন্দ্র ভুলের তথ্যমতে, পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাওয়া চীনের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড হলো ৭ বছর। এর অর্থ পোখরা বিমানবন্দর নির্মাণকালীন প্রায় সাত বছর ধরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়নি। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে কর্তৃপক্ষকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এবং চুক্তি অনুযায়ী ১৩ বছরের মধ্যে চীনকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।তবে স্থানীয় এক সূত্রমতে, কীভাবে এ ঋণ পরিশোধ করা হবে সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্টতা নেই। আয়ের প্রধান উৎস হল বিমান ল্যান্ডিং চার্জ এবং ভাড়া। কিন্তু প্রত্যাশিত রাজস্ব আয় এই ঋণ পরিশোধের জন্য খুবই অপর্যাপ্ত। সূত্রমতে বিমানবন্দরটি লাভজনক হতে হলে প্রতিবছর ১১দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করতে হবে যা ভীষণরকম উচ্চাভিলাষী। এ প্রসঙ্গে নেপালের সংস্কৃতি, পর্যটন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ বিবি দেওজার মতে, পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম।এ ছাড়া রাজস্ব আয় ও ঋণ পরিশোধের মধ্যে যে ব্যবধান থাকবে সেটি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, কীভাবে ঋণ পরিশোধ করা হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।এ বিষয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী রামেশ্বর খানাল বলেছিলেন যে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নয় বছরে তার খরচ তুলতে সক্ষম হবে। কিন্তু সেই জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বিদেশি পর্যটকদের পোখারায় প্রবেশ করতে হবে। চালু থাকতে হবে অনেক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। কিন্তু নেপালের নাজুক আকাশ নিরাপত্তা সে আশায় গুড়ে বালি দিয়ে যাচ্ছে।
বিমানবন্দরের তথ্য কর্মকর্তা জ্ঞানেন্দ্র ভুলের মতে, পোখরা বিমানবন্দরে ঋণের কিস্তি শোধ দিতে প্রতিদিন কমপক্ষে এক শটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এবং সপ্তাহে কমপক্ষে ৫০টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে। তিনি ধারণা করেন "পোখরা বিমানবন্দর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালিয়েও টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু তার এই প্রত্যাশা বাস্তবতা থেকে অনেক দুরে। যেখানে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পর লাভের মুখ দেখেছিল সেখানে নতুন বিমান বন্দরের ঋণ ১৩ বছরের মধ্যে চীনকে শোধ দেওয়াটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নেপালের পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি লাভজনক করতে ভারতের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া আশা করছে নেপাল কর্তৃপক্ষ। কেননা এমনিতেই ভূগঠন ও ভৌগোলিক দিক দিয়ে আকাশপথে এই বিমানবন্দরটি পরিচালনা ভারতের সমর্থন ছাড়া অনেকটা জটিল হয়ে উঠবে। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে হলেও এই বিমানবন্দরকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। কারণ নেপালের তিন দিক জুড়েই ভারতের অবস্থান। আর উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা। যা উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য বৈরী ।
পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিয়ে ভারত কি ভাবছে? ১ জানুয়ারি বিমানবন্দরটির উদ্বোধনী দিনেই সেখান থেকে উড্ডয়ন হবে এমন এক ফ্লাইটকে ভারত তার মাটিতে নামতে অনুমতি দেয়নি। বুদ্ধ এয়ারের ওই ফ্লাইটটির পোখরা থেকে ভারতের বানারসী যাওয়ার কথা ছিল। যদিও আগে থেকে কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ভারতের বানারসী সহ আরও কয়েকটি এলাকায় বিমান পরিচালনা করে আসছিল বুদ্ধ এয়ার। কিন্তু পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন হওয়ার কথা থাকায় সেটিকে ভারত নিষেধাজ্ঞা দেয়। শুধু বুদ্ধ এয়ার নয়, পোখরা থেকে উড্ডয়ন করা কোন বিমানকে ভারত তার মাটিতে নামতে অনুমতি দেয়নি। এর আগে ভারত নেপালের ইয়েতি গ্রুপ এবং চীনা বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন হিমালয় এয়ারলাইনসকে ভারতে উড়তে দেয়নি।
বিমানবন্দরটিকে বাণিজ্যিকভাবে সফল করতে হলে নেপালকে ভারতীয় এবং চীনা পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। দুই দেশের প্রধান শহরগুলোতে সরাসরি ফ্লাইট স্থাপন করতে হবে। কিন্তু, পোখরা বিমানবন্দর বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়া এখন একটি দূরবর্তী স্বপ্ন। কারণ এখন পর্যন্ত, চীনের তিব্বত এয়ারলাইনস-এর অর্থায়নে পরিচালিত হিমালয় এয়ারলাইনস এবং কুয়েতের জাজিরা এয়ারওয়েজই একমাত্র আন্তর্জাতিক বাহক যারা পোখারায় ফ্লাইট চালু করতে রাজী হয়েছে। আর বিমানবন্দরটিকে আগামী ১৩ বছরের মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে যা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। নতুন বিমানবন্দরে কীভাবে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আন্তঃসংস্থা সমন্বয় ও যোগাযোগের স্পষ্ট অভাব রয়েছে। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী চীন এখনো পোখরা থেকে বিমান পরিচালনার কোন আভাস দেয়নি। ২০২০ সালে বেইজিংয়ের কাছ থেকে ওয়াই-১২ ও এমএ-৬০ সিরিজের ৬টি বিমান কিনেছিল নেপাল এয়ারলাইনস। পরে রক্ষণাবেক্ষণে অতিরিক্ত খরচের কারণে বিমানগুলো আর চালায়নি নেপাল। এখন সেগুলো পড়ে আছে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায় করা এই বিমানবন্দরে ভারত তার বিমান পরিচালনা করবে কিনা তা নেপাল কর্তৃপক্ষ এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি।
পোখরা বিমানবন্দটি সহজ ও আর্থিকভাবে সফল হওয়ার জন্য ভৈরহওয়া, নেপালগঞ্জ ও মহেন্দ্রনগর রুট দিয়ে নেপালে বিমান প্রবেশ করাটা জরুরি। কিন্তু এই রুটের বাইরেই ভারতের আকাশসীমা। এই রুটটি দিয়ে ভারত সরকার নেপালে বিমান প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। এর ফলে ভৈরহাওয়া এবং পোখরা বিমানবন্দরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সংস্কৃতি, পর্যটন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বুদ্ধি সাগর লামিছনে বলেছেন, বর্তমানে, ভারত নেপালের মহেন্দ্রনগর, নেপালগঞ্জ, ভৈরহাওয়া, বিরাটনগর এবং জনকপুর আকাশপথে নেপাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেও আকাশ পথে প্রবেশের বেলায় শুধু সিমারা রুটটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। সিমারা নেপালের দক্ষিণ দিকে বিহারে ওপর দিয়েই ৭০ ভাগ বিমান নেপালে প্রবেশ করে। গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রধান, গোবিন্দ দাহল বলেছেন যে পশ্চিম নেপালে এয়ার এন্ট্রি পয়েন্ট রুটগুলি পোখরা বিমানবন্দরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লামিচানের মতে ৬০ থেকে ৭০ভাগ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নেপালে প্রবেশের জন্য পশ্চিম রুট ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু, ভারত অনুমতি না দেওয়ায় ওই ৭০ ভাগ বিমানকে ঘুর পথে অনেকক্ষণ উড়ে দক্ষিণে সিমারার ওপর দিয়ে নেপালে প্রবেশ করতে হয়। এর বাইরে অল্প কিছু বিমান ভুটান থেকে পূর্বে ঝাপা হয়ে নেপালে প্রবেশ করে এবং লাসা থেকে আসা বিমানগুলি নুনিম পয়েন্ট হয়ে নেপালে প্রবেশ করে। এসব কৌশলগত কারণে পোখরার এই নতুন বিমানবন্দরটি আর্থিকভাবে লাভজনক হওয়া ভারতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
প্লেনবিহীন একটি বিমানবন্দর, একটি ঘূর্ণমান রেস্তোরাঁ যেখানে কোনো খাবার নেই, একটি ঋণ বোঝাই সমুদ্রবন্দর –২০১৭ সালে নভেম্বর মাসে এ রকমটাই দেখতে ছিল ২০০৮ সালে চালু হওয়া শ্রীলঙ্কার উচ্চাভিলাষী হামবানটোটা বন্দর। পোখরায় লগ্নি করা চীনের সেই এক্সিম ব্যাংক থেকেই তখন ঋণ নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। পরবর্তীতে প্রকল্পটি আর্থিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় চীনের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। যে কারণে বন্দরটিকে নয় বছরের মধ্যে ২০১৭ সালে ৯০ বছরের ইজারায় চীনের কাছে ছেড়ে দিতে হয়েছে। এই চুক্তির ফলে বেইজিং ভারত মহাসাগরে একটি কৌশলগত অঞ্চলে তাদের অবস্থান সুসংহত করলেও এর নেতিবাচক পরিণতির শিকার হতে হয়েছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণকে। চীনের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর কারণে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে। জনজীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ যা এখনো চলমান।
ভারতীয় উপমহাদেশের দুই প্রান্তে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। কিন্তু, তারা একই রকম অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সংগ্রাম করছে। যদিও উভয় দেশের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। কিন্তু দুটো দেশই চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পর্যটন খাতে ধস উভয় দেশকেই সংকটের অতল খাঁদের দিকে নিয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে চরম মূল্য দেওয়া শুরু করেছে। একইভাবে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যদি আর্থিকভাবে লাভবান না হয় এবং সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করতে পারে তাহলে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেও হাম্মান টোটার মত পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। যা নেপালের নাজুক অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর করে তুলবে। আর এর পরবর্তী প্রেক্ষাপট উপমহাদেশের ভূ রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
শেখ কামালকে আমাদের প্রজন্ম খুব ভালোভাবে জানে না। চেনেও না অনেকে। আমাদের থেকে বয়সে অন্তত ৪/৫ বছরের বড় যারা তারাও শেখ কামাল সম্পর্কে সঠিক সুস্পষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারে না। তবে ক্রীড়া সংগঠন ‘আবাহনী’ নাম দিয়েই শেখ কামালকে চেনার জানার বোঝার অনেকটাই সহজ। ঢাকার অভিজাত পাড়া হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এই আবাহনী ক্লাব। স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত বাংলাদেশে এ রকম একটি আধুনিক ক্লাব ঘর নির্মাণের মাধ্যমে শেখ কামালের আধুনিক ক্রীড়া মনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। ৪৭ বছর আগে লাল সিরামিকের ইটের তৈরি সুন্দর নজরকাড়া এক ভবন।
মাত্র ২৬ বছর বয়সেই তিনি সপরিবারে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন তার ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে। স্বাধীনতার ঘোষক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে ছিলেন শেখ কামাল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আধুনিক একটি ক্লাব নির্মাণ করেছেন। সেই ক্লাবের জন্য ইংল্যান্ড থেকে ফুটবল কোচ এনে প্রথম আধুনিক ফুটবলের ধারণা প্রবর্তন করেছেন বাংলাদেশে। সাংগঠনিক সক্ষমতা দিয়ে ওই ক্লাবকে জনপ্রিয় করারও অনেক কৌশল করেছিলেন তিনি। কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন শেখ কামাল দেখতে কেমন ছিলেন তার দূরদর্শিতা কেমন সৃজনশীলতায় তিনি কতটা এগিয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের যেতে হবে তার সহকর্মী তার সহপাঠী এবং ওই সময় তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠজনদের কাছে।
চট্টগ্রামে বসে শেখ কামাল সম্পর্কে সবকিছু জানা একটু কঠিনই বটে। তারপরও আবাহনী ক্লাবের খেলা ও কার্যক্রম দেখে আমরা তার গুণের কিছুটা ছোঁয়া পাই।
আমি তখন স্কুলে পড়ি। চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতাম নিয়মিত। আশির দশকে এই স্টেডিয়ামে উপচেপড়া দর্শকদের ভিড় দেখা গেছে। চট্টগ্রামে তখনো আবাহনী নামে কোনো ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে মোহামেডান ক্লাব ছিল। সেই ক্লাব বরাবরই চট্টগ্রামে শীর্ষস্থানীয় দল। চট্টগ্রামে মোহামেডানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত স্টিল মিল, ওয়াপদা মানে পিডিবি, কাস্টমস, রেলওয়ের মতো শক্তিশালী দলগুলো। মোহামেডান বাদে বাকি ক্লাবগুলোতে খেলতে আসত ঢাকা আবাহনীর সালাউদ্দিন, চুন্নু, অমলেশ, নান্নু, টুটুল। সেকি উত্তেজনা। এসব খেলোয়াড়ের সেই কি স্টাইল! তাদের খেলার স্টাইল দেখার জন্য গ্যালারি উপচেপড়া দর্শকেরা এসে বসতেন মাঠের সাইড লাইনের পাশেও। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে খেলা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত শেষ হতে পারেনি।
বাংলাদেশের বর্তমানে মৃতপ্রায় ফুটবলের অবস্থা চিন্তা করলে আর আশির দশকের সেই সব দৃশ্য মনে ভেসে উঠলে সত্যিই দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে হয়। আমাদের ফুটবল আসলেই এত গৌরবময় ছিল? হ্যাঁ ছিলই। আর এখানেই শেখ কামালের নামটা অবধারিতভাবে চলে আসে। তিনি একটি আধুনিক ক্লাবের জন্ম দিয়েছেন একই সঙ্গে বেশ কিছু ফুটবলারকে স্মার্ট বানিয়েছেন।
শেখ কামালকে নিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা কিংবা অনুসন্ধানী রিপোর্ট হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সামান্য কিছু কাজ হয়েছে হয়তো। চট্টগ্রামেরই ছেলে ক্রীড়া সাংবাদিক সনৎ বাবলা লিখেছেন, ‘শেখ কামাল: ক্রীড়াঙ্গনের ধূমকেতু’ নামে একটি বই যেটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে। অর্থাৎ শেখ কামাল মারা যাওয়ার প্রায় ৪৫ বছর পর। শেখ কামাল একাধারে ক্রিকেটার, খেলতেন বাস্কেটবল, ক্রীড়া সংগঠক, রাষ্ট্রপতির ছেলে - এরকম নানামুখী পরিচয় ছাপিয়ে তিনি ক্রীড়া সংগঠকের পরিচয়ে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল।
সনৎ বাবলার বইতে তিনি শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, একবার এক বড় ব্যবসায়ী এসে তাকে অর্থাৎ শেখ কামালকে একটি চেক দিয়ে যায়। চেক হাতে তুলে দিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, আপনি ক্লাব চালান, ক্লাব চালাতে অনেক টাকা লাগে তাই দিলাম। চেকটি নিজের কাছে রেখেছেন ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই জানতে পারেন যে ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক সুনাম নিয়ে প্রশ্ন আছে। পরদিন শেখ কামাল ওই ব্যবসায়ীকে তার চেক ফেরত দিয়ে দেন।
স্বাধীনতার পরে আবাহনী ক্লাব যখন সংগঠিত হতে থাকে তখন মাঠে নামার সময় দর্শকেরা তাদের ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে চিৎকার করত। এমনকি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করার ঘটনাও ঘটেছে। সমর্থক ছিল না। প্রতিকূল অবস্থা। সেটি সামাল দেওয়ার জন্য অদ্ভুত এক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন শেখ কামাল। বাস্কেটবল খেলার জন্য তখনকার সবচেয়ে নামী দল ওয়ান্ডারার্স এক বাস্কেটবল প্লেয়ারের কাছে গিয়েছিলেন। তার নাম এ কে সরকার। তিনি জাতীয় দলের খেলোয়াড়। শেখ কামাল ওয়ান্ডারার্সে খেলতে আসবেন শুনে কিছুটা বিব্রত ক্লাবের সবাই। তখন ওই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন বীর বিক্রম কাজী কামাল উদ্দিন। শেখ কামাল তার কাছেও গিয়েছিলেন তাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। কৌতূহলী বাস্কেটবল খেলোয়াড় এ কে সরকার একদিন শেখ কামালকে জিজ্ঞেস করে বসলেন কেন আপনি রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়ে ওয়ান্ডারার্সে খেলতে আসলেন। জবাবে শেখ কামাল বলেছিলেন পরে বলব। ঠিকই এক বছর পর শেখ কামাল এ কে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কেন ওয়ান্ডারার্সে বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছিলেন। মূলত ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের তখন প্রচুর সমর্থক ছিল। বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে শেখ কামালের দল আবাহনী কিছুটা সমর্থন পাবে এই ভরসায় তিনি বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছিলেন ওয়ান্ডারার্সে। কতটা মিশনারি হলে কতটা দূরদর্শী হলে একজন মানুষ এভাবে চিন্তা করতে পারে।
আবাহনী ক্লাবকে একটি আধুনিক ক্লাবে পরিণত করতে হবে এর জন্য দরকার প্রচুর টাকা। রাজাকার আলবদররাও ক্লাব গড়বার জন্য টাকা দিতে চেয়েছিল। সে টাকা তিনি গ্রহণ করেননি। টাকা কোত্থেকে আসবে সেই পরিকল্পনাও শেখ কামাল করে রেখেছিলেন। শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নামকরা সার্কাস দলের চৌকস সদস্যদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। সেখান থেকে টাকা সংগ্রহ করেই একটি আধুনিক ক্লাব বানানোর কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সার্কাস শো থেকে তখন আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৪৪ টাকা।
এই ক্লাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবাহনীতে দীর্ঘদিন ধরে খেলে আসা চট্টগ্রামের ছেলে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আশীষ ভদ্র বলেন, আবাহনী এমন একটি ক্লাব যেখানে তখনকার সময়ের সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থাপনা ছিল প্লেয়ারদের জন্য। হাই কমোডের এসি বেডরুম, টয়লেট, কিচেন-ডাইনিং রুম সবকিছুই আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। তখনকার বিখ্যাত সব ক্রিকেটার ও ফুটবলার সবাই ক্লাবের ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভূত হয়ে যেতেন। ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার অরুণ লাল শ্রীলঙ্কার সামারা শেখেরা শ্রীলঙ্কার ফুটবলার পাকির আলীর মতো খেলোয়াড়রা এই ক্লাবে অবস্থান করে এর আধুনিক ব্যবস্থাপনা দেখে প্রশংসা করেছেন। ক্লাবের জার্সি নিয়ে আসা হতো সুদূর ইংল্যান্ড থেকে, মোজাও বাদ যেত না। চিন্তা চেতনায় শেখ কামাল এতটাই আধুনিক আর বিনয়ী ছিলেন যে, ক্লাব বয় যারা ছিলেন তাদের তিনি ‘আপনি’ করেই সম্বোধন করতেন। সবাইকে সুন্দর ড্রেস পরে ফিটফাট থাকার জন্য পরামর্শ দিতেন।তখনকার সময় একজন ফুটবলার কিংবা ক্রিকেটের এর কাছে একটি মোটরসাইকেল স্বপ্নের মতই ছিল। ১৯৭৫ সালে মারা যাওয়ার আগে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধিদপ্তরে যেসব মোটরসাইকেল দেওয়া হতো সেখান থেকে কম নামে ৯টি মোটরসাইকেল কেনার জন্য ৭৫ হাজার টাকা একটি ফান্ড দিয়ে রেখেছিলেন ক্লাবের তৎকালীন ম্যানেজারের কাছে। ৯ জন নামী ফুটবলারকে চুক্তিবদ্ধ করার জন্য এই ফান্ড জোগাড় করে রাখার কথা জানতেন না সেই সময়ের ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদও। ২৬ বছর বয়সী এক যুবকের চিন্তার জগৎ কতটা বিস্তৃত আর বুদ্ধি কৌশলের দিক থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন তিনি তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায়। ভাবা যায়!
এমন প্রশ্ন কেউ তোলেন যে নৃশংসভাবে যদি সপরিবারে শেখ কামাল মারা না যেতেন তাহলে কি হতো বা কি হতে পারত? বাংলাদেশের একজন নামকরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিচিত আশীষ ভদ্র। তিনি বললেন যে, ফুটবল বাংলাদেশ কোন অবস্থানে পৌঁছাতো সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলায় বাংলাদেশ এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যেত এত দিনে। কারণ তার ভেতরে যে দূরদর্শিতা ছিল অর্থাৎ শেখ শেখ কামালের ভেতরে যে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল তার সবকিছুই তিনি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রকাশ করে দেখিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন। তার কল্পনা শক্তি ছিল অসাধারণ।
ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়েই শেষ করব এই লেখা। শেখ কামাল মারা যাওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবাহনী ক্লাব বেশ দুঃসময়ে ছিল। সেই দুঃসময় ক্লাবকে সুসংগঠিত করার কাজে নিবেদিত ছিলেন বেশ কয়েকজন। এঁদেরই একজন হারুনুর রশিদ। শেখ কামাল বেঁচে থাকা অবস্থায় ক্লাবের আর্থিক টানাপোড়েনের সময় হারুনুর রশিদ রাগ করে ক্লাবে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বেশ কয়েক দিন তিনি আসেননি। তখন হারুনুর রশিদকে খুঁজবার জন্য শেখ কামাল তার বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাজির হলেন এবং সেখানে গিয়ে তার ভাবিকে মজা করে বললেন যে, ‘নোয়াখাইল্লাটা’ কই? (হারুনুর রশিদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়, এটি তখন নোয়াখালী ছিল) আর সেই ঘরে বসেই গলায় সুর তুললেন এই গান দিয়ে, ‘ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে’। মান ভাঙিয়ে হারুনুর রশিদকে আবার সঙ্গে নিয়ে ক্লাবে আসেন শেখ কামাল।
ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, সংস্কৃতিমনা, রসবোধসম্পন্ন এই মানুষটিকে আমরা আর কখনোই পাব না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে শেখ কামাল থাকবে চিরঞ্জীব হয়ে। ৫০ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের দশ লাইনের সংক্ষিপ্ত ক্রীড়া ইতিহাস যদি লিখতে হয় সেখানে যৌক্তিকভাবে দুটি লাইন বরাদ্দ রাখতে হবে শেখ কামালের আধুনিক ক্রীড়া ভাবনার জন্য। তাঁকে স্মরণ করার জন্য ‘শেখ কামাল দ্বিতীয় বাংলাদেশ যুব গেমস’ এর যারা উদ্যোক্তা তাদের জন্য এক পঙ্ক্তি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
লেখক: রফিকুল বাহার, আবাসিক সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন, চট্টগ্রাম।
বাউল শব্দের উৎসভূমি পারস্যে। মরুভূমিতে এখানে-সেখানে বিচরণকারী সংসারত্যাগী একশ্রেণির সংগীতাশ্রয়ী সুফি সাধক আল অথবা বউল নামে পরিচিত ছিল। এরা অধ্যাত্মবাদী এবং এদের সাধন পদ্ধতি ছিল গুপ্ত ও যৌনাচারভিত্তিক। আমাদের আলোচ্য বাউল সম্প্রদায় পারস্যের এই আল বা বউল সম্প্রদায়ের উত্তরসূরি। বাউল শব্দের বাংলায় প্রথম ব্যবহার বিষয়েও আমার ভিন্ন মত রয়েছে, চতুর্দশ শতকে শাহ মুহাম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই ধর্মীয় সাধকদের বাউল এবং বাউর নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাউল শব্দের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস যাই হোক সবক্ষেত্রেই এটা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ ব্যাপারে কারও কোন দ্বিমত নেই বলে আমি মনে করছি। অর্থাৎ বাউল বলতে এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টিকে বোঝায় সমাজের চোখে যারা অত্যন্ত নিচ, নিঃস্ব এবং পাগল। তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, বিষয় সম্পত্তি বা সামাজিক প্রতিপত্তি বলতে কোন কিছুই নেই। তাদের কোন স্থায়ী বসতবাড়ি নেই। তারা এক স্থান হতে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং পরান্নে জীবনধারণ করে বেঁচে থাকে। বাউল যে সমাজেরই হোক তার বৈশিষ্ট্য, জীবনযাপন প্রণালি, সমাজে তার সামাজিক অবস্থান একই।
একটা জাতি হিসেবে মননশীল বিষয়সমূহে আগ্রহ ও শৈল্পিক দিকে ঝোঁক কিংবা দর্শনের ক্ষেত্রে আমাদের বাঙালিদের অবদান অতি যৎসামান্য নয়। লালন ফকির ও তার দর্শন এই ক্ষেত্রে এক মস্ত বড় মাইল ফলক এবং স্তম্ভ বলে মনে করি। লালন ফকিরের প্রকৃত নাম ললিত নারায়ণ কর, ডাকনাম লালু। পিতা নাম ছিল মাধব কর, মাতা পদ্মাবতী। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই লালন ফকির দার্শনিক জিজ্ঞাসার কিছু মূল মূল প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কীভাবে সৃষ্টি হলো ? ঈশ্বর কে ? আমি কে ? স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক কি ? অস্তিত্ববাদী ও সৃষ্টির রহস্য সংক্রান্ত এসব প্রশ্ন তোলা, এবং যেভাবে লালন ফকির এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছেন, তা আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসে ব্যতিক্রমী। অতলান্ত গভীরতা, শৈল্পিক সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক সূক্ষ্মতা নিয়ে লালন ফকির ছিলেন সবচেয়ে প্রতিভাবান এবং শীর্ষ এক মহামানবীয় ব্যক্তিত্ব।
বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ বাঙালি সংস্কৃতির এক মহান প্রতিনিধি। বাংলা সংস্কৃতির মূল ধারা লোকসংস্কৃতি। এই ধারাকে যারা পুষ্ট করেছে ফকির লালন তাদেরই একজন। সম্প্রদায় সম্প্রীতি ও ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ফকিরিবাদ বাউলতত্ত্ব মানুষের প্রধান দর্শন। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ বাঙালি সংস্কৃতির এক মহান প্রতিনিধি। লালন ফকির গানে ও সাধনায় তার দর্শনে সেই মানবিক মূল্যবোধে সেই সামাজিক চেতনায় গভীর, লালন ফকির একই সঙ্গে মরমি এবং দ্রোহী, তার গানের ভেতর দিয়ে বাউল সাধনার নানা প্রসঙ্গ অনুসৃত হয়েছে। তার গানের ভেতর দিয়ে সমাজের অসংগতি, কুপ্রথা সকল জাতপাতের ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
তাঁর গানগুলোর মধ্যে আছে দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, ভক্তিতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব, আছে মোহাম্মদ, কৃষ্ণ, যিশু, বেদ, কোরআন, বাইবেল প্রভৃতি বিষয়কে নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত জিজ্ঞাসা, মতামত, উত্তর এবং নির্দেশনা। এ সংগীতনির্ভর চিরন্তন দর্শনই ললিত নারায়ণ কর থেকে মহাত্মা লালন ফকিরে উন্নীত করেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে সুফিবাদী দর্শনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছেন লালন। লালন দর্শনের মূল কথা হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার ওপর মানুষ; এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যিনি স্রষ্টা তিনি বিরাজ করেন মানুষেরই অন্তরে। তাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-কালো-সাদা বৈচিত্র্যে মানুষকে আলাদা না করে মানুষে মানুষে প্রেম ও ভালোবাসার মাধ্যমেই পরম আরাধ্য স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব।
তাঁর বিশ্বাস ছিল মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-জৈন প্রভৃতি আকৃতিতে বিচার করলে সমাজে শান্তি কখনোই আসবে না। শুধু তাঁরই নয়, আধুনিক সভ্যতার সকলেরই বিশ্বাস যে, মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করে ভালোবাসার মধ্যেই বিশ্ব শান্তি নিহিত। তাই প্রায় দেড় শতাব্দী পূর্বে লালন যে ভাব-চিন্তার পত্তন করে গেছেন তা আজও পৃথিবীর প্রেমিক, ভাবুক, রসিক, শিক্ষিত, বিদ্বৎ সমাজকে প্রাণিত করছে এবং করে যাবে আরও সুদীর্ঘকাল। কারণ, হিংসা-বিদ্বেষ-বিভেদমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র তথা পৃথিবী বিনির্মাণে লালন দর্শন এক অনন্য আলোকবর্তিকা।
কে বলে মানুষ মরে/ ও মানুষ মরলে পরে বিচার হবে কার/ আমি বুঝলামনা ব্যাপার/ কে বলে মানুষ মরে...। গানের কলিটা কানে আসলেই কিংবা এ রকম শিরোনাম কোথাও চোখে পড়লেই এক বিশুদ্ধ অনুভূতিতে আধ্যাত্মিক চিন্তায় ও প্রেমে মানুষের হৃদয় পুলকিত হয়। এ রকমের মানুষের মনকে শীতল করার মতো জাগিয়ে তোলার মতো, অনুভূতি প্রবণ করার মতো, দশ হাজারেরও বেশি গান রচনা করে গেছেন মহাত্মা লালন ফকির ১৭৭৪ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত।
লালন পুরোদস্তুর সংসারী লোক ছিলেন। তাঁর পানের বরজ, আমের বাগান, বসতবাড়ি, নগদ টাকা, স্ত্রী, সন্তান (পালক কন্যা) এবং চলাচলের বাহন হিসেবে দুটি ঘোড়া ছিল। সমাজে লালন শাহের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি প্রায় মধ্যবিত্ত পর্যায়ের ছিল। গবেষণার ফলে বেরিয়ে এসেছে লালন ফকির নামটা শুনেই হয়তো অনেকে মনে করে লালন বিষয়হীন ফকির ছিলেন, কিন্তু মোটেও এমনটা নয়, লালন সংসারী ছিলেন। মৃত্যুকালে লালন ফকির প্রায় ২ হাজার নগদ টাকা রেখে গিয়েছিলেন। লালন সাঁই তাঁর পালক পিতা মওলানা মলম শাহ সূত্রে পাঁচ একর বসতবাড়ির ভিটা লাভ করেন, যেখানে লালন শাহ তাঁর আখড়াবাড়ি স্থাপন করেন এবং বর্তমানে যেখানে তাঁর মাজার অবস্থিত। এ ছাড়াও তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পাঁচ বিঘা জমি কিনেছিলেন। ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে শৈলকুপা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে লালন শাহের অনুকূলে দুটি দলিল সম্পাদিত হয়। যাতে তাঁকে মান্যবান ও সম্ভ্রান্ত মনুষ্য বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশিষ্ট লালন গবেষক মুহম্মদ আবু তালিবের নিকট দলিল দুটির নকল কপি রক্ষিত আছে। তাঁর ঘরবাড়ির অবস্থাও গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো ছিল। লালন শাহ সমাজে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সমাজের অনেক গণ্যমান্য ও জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল এবং তারা লালন শাহের সঙ্গে মতবিনিময় করে নিজেদের উৎকর্ষিত করে তুলেছেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন ভারতের ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা ও বিশিষ্ট পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি তার জমিদারিতে লালন ফকিরকে ডেকে নিয়ে ধর্মালাপে তৃপ্ত হতেন। এ প্রসঙ্গে মো. সোলাইমান আলী সরকার তার লালন শাহের মরমি দর্শন বইতে উল্লেখ করেছেন, বঙ্গের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এমনকি ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা, সমাজসংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক, রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁকে নিমন্ত্রণ করে শিলাইদহে নৌকায় নিয়ে ধর্মালাপে পরিতৃপ্ত হন।
ফকির লালনের ধর্মজীবন বিলক্ষণ উন্নত ছিল। মিথ্যা জুয়াচুরিকে লালন ফকির বড়ই ঘৃণা করতেন । লালন শাহের গানেও মিথ্যা ও জুয়াচুরি এবং পর রমণীর প্রতি লোভকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে বলে মনে করি। লালন বলেন, সত্য বল, সুপথে চল ওরে আমার মন/সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন/পরের দ্রব্য পরের নারী/হরণ করো না পারে যেতে পারবা না/যতবার করিবে হরণ/ততবারই হবে জনম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনকে শুধু কবি বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি লালনের কবিতাকে (গান) বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলির কবিতার সমতুল্য বলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি লালনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁকে উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, The village poet evidently agrees with our sage of Upaneshad who says that our mind comes back baffled in its attempt to reach the unknown Being; and yet this poet like the ancient sage does not give up adventure of the infinite thus implying that there is a way to its realisation. (লোককবি লালন-তপন কুমার বিশ্বাস; পৃ:-৪৮)। লালন দর্শনে বিমোহিত কবিগুরু তাই বলছেন-লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
অনেক সাধক সাধনার নামে ঘর ছেড়ে সংসারত্যাগী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। লালন তাদের উদ্দেশ করে বলেন, ঘরে কি হয় না ফকিরী/কেন রে নিমাই হলি দেশান্তরি/বলে এই কথা কান্দে শচী মাতা/লালন বলে লীলের বলিহারি। সাধন-ভজনের পথে অনেকে নারীকে বাধা মনে করে নারীসঙ্গ ত্যাগ করার পক্ষপাতী হয়েও সংসার বিবাগী হয়। তাদের উদ্দেশ করে লালনের প্রতিবাদ, কেউ নারী ছেড়ে জঙ্গলে যায়/স্বপ্নদোষ কি হয় না সেথায়/আপন মনের বাঘে যারে খায়/কে ঠেকায় রে। সুতরাং লালন ব্যক্তি জীবনে ও আদর্শগতভাবে কোন প্রকারেই সংসার বিবাগী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না; বরং তিনি একজন সচেতন সমাজকর্মী ছিলেন। সমাজের উন্নয়নের জন্য, সমাজের মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তাই তাঁর দর্শন জুড়ে কেবলই মানুষের জয়গান, মানবমুক্তির আকুতি। তিনি এই মানুষের বাইরে আর কিছুই বুঝতেন না। তাঁর ধর্মকর্ম, ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল মানুষকেন্দ্রিক। তাঁর মতে ঈশ্বর যদি থেকেই থাকে তবে এই মানুষের মধ্যেই আছে। তাই লালন বলেন, এই মানুষে আছেরে মন/যারে বলে মানুষ রতন।
তিনি যেমন একজন দায়িত্বশীল স্বামী ছিলেন, তেমনি একজন স্নেহপরায়ণ বাবা ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির কিছু অংশ তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকার (পালক কন্যা) পেরিন্নেসার নামে উইল করে যান। এ তো গেল তাঁর সাংসারিক দায়বদ্ধতার কথা।
একজন তীক্ষ্ণ সমাজসচেতন সামাজিক আন্দোলনের প্রতিবাদী নেতাও ছিলেন তিনি। সমাজে কোথাও কারও দ্বারা কোন অন্যায় সংঘটিত হলে লালন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ভাবশিষ্য ও কাঙাল হরিনাথকে বাঁচানোর কথা তো এখন ইতিহাস। এমন সমাজসচেতন, সংসারী, সামাজিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি যাঁকে বিনা দ্বিধায় সমাজসংস্কারক বলা যায়, যাঁর সামাজিক আন্দোলন সমাজে এক অপরিহার্য প্রভাব বিস্তার করে সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
আমার জানামতে লালনকে প্রথমবারের মতো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা সংবাদপত্রের সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ। ১৮৭২ সালের আগস্ট মাসে তার সাপ্তাহিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জাতি নামক এক নিবন্ধে লালন এবং তাঁর প্রচারিত ধর্মমতের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে এভাবেই উল্লেখ করা হয়, লালন শা নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা মাসিক পত্রিকায় ইহার বিশেষ বিবরণ প্রকাশ করিব। ৩/৪ বৎসরের মধ্যে এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে। (যুক্তবঙ্গে লালন চর্চার ক্রমবিকাশ; সৈয়দ মনসুর আহমদ; পৃঃ-৩৩)। কাঙাল হরিনাথের এই বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, লালন তৎকালীন ঘুণেধরা সমাজকাঠামোতে জোর ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তৎকালীন সমাজব্যবস্থা স্বভাবতই লালনের এই সামাজিক আন্দোলন দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। সামাজিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে তৎকালীন সমাজে লালন শাহের একটি অপরিহার্য অবস্থান তৈরি হয়েছিল। লালন প্রভাব তাই ঘুণেধরা সমাজের মৌলবাদী সমাজপতিদের শঙ্কিত করে তুলেছিল।
লালন চর্চার ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর লালন সাঁইজির দেহত্যাগের ১৪ দিন পর মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায়। বর্ণিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক ও এজেন্ট রাইচরণ দাস (মতান্তরে বিশ্বাস) মহাত্মা লালন ফকির নামে এক নিবন্ধে লালন সাঁইজির জীবন ও কর্মের ওপর আলোকপাত করেন। উক্ত নিবন্ধে তিনি লালন সম্পর্কে আমাদের জানান, লালন ফকিরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকি নাই। শুধু এ অঞ্চল কেন, পূর্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রঙ্গপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেকদূর পর্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকিরের শিষ্য। ইহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি। (লোককবি লালন- তপন কুমার বিশ্বাস; পৃঃ-১৩৬)। এরপর লালনের সামাজিক অবস্থান ও সমাজে তাঁর ব্যক্তি প্রভাব এবং সামাজিক প্রতিপত্তি নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। লালন শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিরলস যে সাধনা করে গেছেন তার নিদর্শন হাজারো গানের মধ্যে নিহিত আছে। আমাদের সমাজে উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, নমশূদ্র, সিয়া-সুন্নি প্রভৃতির মধ্যে যে বিভেদ তা দেখে তিনি বলেছেন- জাত গেল জাত গেল বলে/একী আজব কারখানা/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তানা নানা। অন্য আর একটি গানে বলছেন- কেউ মালা কেউ তজবী গলায়/তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়/ যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/ জাতের চিহ্ন রয় কার রে। বহুল পরিচিত জাত বিষয়ক আরেকটি গানে লালন বলছেন- গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়/ লালন বলে জাত কারে কয়/ এ ভ্রম তো গেল না। লালন বলেছেন দিব্যজ্ঞানী না হলে কেউ তার স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যকভাবে জানতে পারে না। মানুষ ভজনা ও মানবসেবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে দিব্যজ্ঞান। কারণ, নিরাকার বিধাতাই যে মানুষের মাঝে সাকার হয়ে ধরা দেয় সাঁইজি তা তুলে ধরলেন এভাবে- সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার/মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/নদী কিংবা বিল বাঁওড় খাল/সর্বস্থলে একই একজন/দিব্যজ্ঞানী হয় তবে জানতে পায়/কলিযুগে হলেন মানুষ অবতার। লালনের এ গান যেন এক অসীম শক্তির আধার, যার কেন্দ্রে আছে শুধুই মানুষ। মানবতাবোধ যার একমাত্র উপজীব্য।
পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতিতে লালনের দর্শন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। ভেদাভেদ নয়, অভেদ দর্শনই পারে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে শান্তিময় পৃথিবী বিনির্মাণ করতে, সেটাই লালন ফকিরের গানে ও বাণীতে ফুটে উঠেছে। তাই নিঃসন্দেহে উচ্চারণ করা যায় শৈল্পিক সৌন্দর্য ও মানবতাবাদে লালন ফকির জ্বলন্ত আলোক শিখ।
লেখক: কবি ও গবেষক
আদালতের রায় অমান্য করে বড় মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে পালিয়ে চেষ্টার সময় জাপানি নারী নাকানো এরিকোকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশ।
মঙ্গলবার (৩১ জানুয়ারি) রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ ঘটনা ঘটে।
এর আগেও তিনি তার দুই মেয়েকে নিয়ে জাপানে পালানোর চেষ্টা করলে আদালতের রায়ের কারণে ইমিগ্রেশন পুলিশ ফিরিয়ে দেয় তাদের। তবে এবার সে কোন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তা প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি।
বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদ মর্যাদা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওই জাপানি মা তার বড় মেয়েকে নিয়ে বিদেশে গমনের জন্য আজ বিমানবন্দরে আসেন। এ বিষয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাকে ইমিগ্রেশন থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জাপানি মেয়েদের বাবা ইমরান শরিফের আইনি সহায়তা নেওয়া প্রতিষ্ঠান নাসিমা আক্তার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের কর্মকর্তা মির্জা মো. নাহিদ হাসান বলেন, আমরা সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি জাপানি মা তার বড় মেয়েকে নিয়ে আজ দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন। এই নিয়ে তার বড় মেয়েকে নিয়ে দুইবার পালানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।
সূত্র মতে, গত মাসেও তিনি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করে পালাতে চেষ্টা করলে তার মেজ কন্যা লাইলা বাবাকে হারাবে বলে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে বাবার আশ্রয় নেয়। তাই এবার মেজ কন্যা তার সাথে ছিল না। এবারও প্রথমবারের মতো পালানোর সময় নাসরিন নাহার নামের এক বাংলাদেশি নারী নাকানোকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন। এ ঘটনায় বিমানবন্দরের পরিস্থিতি খারাপ দেখা দিলে সেখান থেকে পালিয়ে যান তিনি।
জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকোর সঙ্গে বাংলাদেশি প্রকৌশলী ইমরান শরীফের বিয়ে হয় ২০০৮ সালে। দাম্পত্য কলহের জেরে ২০২০ সালের শুরুতে বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো। এরপর ইমরান স্কুলপড়ুয়া বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোট মেয়ে জাপানে এরিকোর সঙ্গে থেকে যান। মেয়েদের জিম্মা পেতে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশে আসেন এই জাপানি নারী। তিনি হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে তাদের সমঝোতায় আসতে বলেন বিচারক।
কিন্তু ওই দম্পতি সমঝোতায় না আসায় কয়েক মাস ধরে শুনানির পর হাইকোর্ট দুই সন্তানকে বাবার হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত দেন। পাশাপাশি মা যাতে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বাবাকে খরচ দিতে বলা হয়।
হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন শিশুদের মা নাকানো এরিকো। পরে আপিল বিভাগ এক আদেশে শিশু দুটিকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিলেও বাবা তা না মানায় বিচারকরা উষ্মা প্রকাশ করেন। পরে আদালত শিশু দুটিকে বাবার হেফাজত থেকে এনে তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং পরে মায়ের হেফাজতে দেওয়ার আদেশ দেন। আপিল বিভাগের রায়েও দুই শিশুকে মায়ের কাছে রাখার অনুমতি দেওয়া হলো।
‘ও মোর বানিয়া বন্ধুরে একটা তাবিজ বানাইয়া দে, একটা মাদুলি বানাইয়া দে’। কমবেশি গানটি অনেকেই শুনেছি। ‘বানিয়া’ বা ‘বেনিয়া’ আমাদের পরিচিত শব্দ। মানে যারা ব্যবসা করে। এশিয়ার বড় গ্রাম হবিগঞ্জের বানিয়াচং নামটিও নাকি এসেছে খাসি ভাষা থেকে, বেনিয়াদের ছোনং মানে বেনিয়াদের গ্রাম। খাসি ভাষায় ছোনং মানে গ্রাম। অনেকে আবার বেদেদের ভেতর সান্দারদের ‘বাইন্যা’ হিসেবে চেনেন, মানে যারা ফেরি করে বাণিজ্য করে। কিছুদিন আগেও প্রাচীন গঞ্জ ও মফস্বলগুলোতে ‘বাইন্যাতির দোকান’ ভাষাটি প্রচলিত ছিল। তো এই বেনিয়া, বানিয়া বা বাণিজ্য কারবারিরা নদীতীরের আশপাশে ঘাটের কাছে কোথাও বসতেন। সাধারণত তাদের বসতে হতো বৃহৎ কোনো গাছের তলায়। নদীতীরে গ্রামগঞ্জে এমন বৃহৎ গাছগুলো সাধারণত বট, অশ্বত্থ, তেঁতুল, পাকুড়, ছাতিয়ান, জারুল, শিমুল। হয়তো বটগাছের তলায় বেনিয়া বা বানিয়ারা বসতেন বলে একসময় ইউরোপীয় বণিকরা এই বটগাছকে ‘বানিয়াদের গাছ বা বানিয়ান ট্রি’ বলতে শুরু করেন। আর এভাবেই বাংলা বটের ইংরেজি নাম হয়ে যায় ‘বেনিয়ান ট্রি’। ভাষাবিদ কলিম খান বিষয়টি এভাবেই দেখেন। গাছের নামকরণের উৎস যাই হোক বৃহৎ গাছকে ঘিরেই আমাদের গ্রাম বা বসতি স্থাপনের বহু নামকরণ হয়েছে। বটতলা, পাকুড়তলা, শিমুলতলী, কড়ইতলী, কাঁঠালবাগান, হিজলতলী, বড়ইবাড়ি, ছাতিয়ানতলা, গাবতলী কত কী স্থাননাম জড়িয়ে আছে বহু গাছের স্মৃতি-বিস্মৃতি নিয়ে। সৌরজগতের এই ছোট্ট নীলগ্রহে গাছ সভ্যতার আদিবন্ধু। আজকের হোমো স্যাপিয়েন্স মানবপ্রজাতি থেকে শুরু করে ফ্লোরিয়েনসিস, ডেনিসোভান, নিয়ানডার্থাল কী হোমো ইরেকটাস সব মানবপ্রজাতি গাছেদের কাছে ঋণী। কিন্তু সভ্যতার দীর্ঘ পরিভ্রমণ ঘাঁটলে দেখা যায় মানুষ সবসময় গাছেদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকেনি, নতজানু হয়নি। বরং নৃশংসভাবে গাছেদের হত্যা করেছে, বিনাশ করেছে, রক্তাক্ত করেছে। আর এর পরিণতি হয়েছে বরাবরই ভয়াবহ। দুনিয়ায় যত বেশি গাছের বৈচিত্র্য ও সংখ্যা কমেছে তত বেশি প্রাণের বিলুপ্তি ঘটেছে। মানুষের সমাজে রোগব্যাধি ও নানামুখী অস্থিরতা বেড়েছে। তাপমাত্রা বেড়েছে, জলবায়ু উল্টেপাল্টে গেছে, বাস্তুতন্ত্র ক্ষয় হয়েছে, দুর্যোগ ও সংকট বেড়েছে লাগাতার। প্রতিটি নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছে বহু বৃক্ষপ্রাণের জীবনের বিনিময়ে। ইনকা, মায়া, সরস্বতী, সিন্ধু, মেসোপটেমীয়, মিসরীয় বা গ্রিক সভ্যতার নগর নির্মাণ ও পরিকল্পনা কতটুকু বৃক্ষ সংবেদনশীল ছিল আমরা পুরোটা জানি না। কিন্তু আজকের নগর উন্নয়ন কর্মসূচি ও নগর পরিকল্পনা বৃক্ষসংবেদনশীল হতে হবে। কারণ গত দুশো বছরের প্রবল শিল্পায়ন ও নগরায়ণের চাপ ও ক্ষত আমরা বর্তমানে সামাল দিতে বাধ্য হচ্ছি। পৃথিবীর চারধারে আজ কার্বন বিষের পদচ্ছাপ। উল্টেপাল্টে গেছে জলবায়ু পঞ্জিকা। জলবায়ু সংকটের এই নিদারুণ বিপদের ময়দানে দাঁড়িয়ে আমরা কি আবারও নির্বিচারে গাছ কেটে, জলাভূমি উধাও করে, মাঠ-প্রান্তর গায়েব করে, বুনো প্রাণদের তাড়িয়ে একের পর এক কংক্রিট-প্লাস্টিক-কাচের শহর বানিয়ে যাব? এভাবে কি সবকিছু তাড়িয়ে কেবলমাত্র মানুষ এককভাবে বাঁচতে পারবে? বহু প্রমাণ আছে পারবে না, মানুষ পারছে না। গাছ, পাখি, পতঙ্গ, মানুষ, জলাভূমি, উন্মুক্ত প্রান্তর সব নিয়েই আজ সবার নগর গড়ে তোলার দাবি উঠেছে বিশ্বময়। আমাদের নগর পরিকল্পনাবিদ, রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক, নগর উন্নয়নবিদ সবাইকে এই আওয়াজ বুঝতে হবে। অন্তরে ধারণ করতে হবে। সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা বরাবরই দেখছি ঢাকাসহ যেকোনো শহরে সড়ক বা কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য নির্দয়ভাবে গাছেদের কেটে ফেলা হয়। এসব কর্মসূচির আগে কোনো ধরনের পরিবেশগত, প্রতিবেশগত ও সামাজিক সমীক্ষা ও যাচাই হয় কিনা আমরা জানি না। কিন্তু একটিবারও ভেবে দেখা হয় না, এভাবে একের পর এক গাছ কেটে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কেমন সর্বনাশ তৈরি করছি। এক একটি গাছ কেবলমাত্র একটি একক প্রাণসত্তা নয়, গাছের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে বহু প্রাণ। পতঙ্গ, পাখি, বন্যপ্রাণী, মানুষ। প্রতিটি নগরে বড় হয়ে ওঠা প্রতিটি গাছেদের সঙ্গে কত মানুষের নানা স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। গাছেরা মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক স্মৃতির ধারক।
সম্প্রতি ঢাকার ধানম-ি সাত মসজিদ সড়কের বহু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে এবং আরও গাছ মৃত্যুদ-ের আতঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃক নিয়োগকৃত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সাতমসজিদ সড়কের গাছ কেটে সড়কদ্বীপ উন্নয়নের কাজ করছে। ধানম-ি অঞ্চলটি ঐতিহাসিক ও সামাজিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে শুরু করে বহু ঐতিহাসিক মানুষের স্মৃতিময় স্থল এটি। বর্ডার গার্ড সদর দপ্তর, আবাহনী খেলার মাঠ, ছায়ানট, বেঙ্গল গ্যালারি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও এখানে। এককালের পা-ু নদী আজকের ধানম-ি লেক এখানেই। শিক্ষা, ক্রীড়া, শরীরচর্চা ও সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ সুরক্ষা বিষয়ে আমাদের গভীর মনোযোগ ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি। গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার একটি গাছ কেটে ফেলার আগে এর সামগ্রিক পরিবেশ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিষয়গুলো আন্দাজ করা জরুরি। কারণ এই এলাকার প্রতিটি গাছ এই অঞ্চলের সামগ্রিক প্রতিবেশব্যবস্থার সঙ্গে জটিলভাবে সম্পর্কিত। ইতিমধ্যেই আবাহনী মাঠের বিপরীতে স্টার কাবাব থেকে জিগাতলা পর্যন্ত বহু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। অবশ্যই আমাদের নগর সম্প্রসারণ, সড়ক উন্নয়ন দরকার। কিন্তু একের পর এক গাছ কেটে নিশ্চয়ই নয়। ঢাকার মতো শহরে যেখানে সড়ক ও সড়ক বিভাজকে গাছ আছে সেখানে নতুনভাবে সড়ক সম্প্রসারণ বা সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচি কীভাবে পরিবেশবান্ধব হতে পারে এ বিষয়ে আমাদের নীতিমালা দরকার। এই শহরে আমাদের খুব বেশি গাছ নেই। বিশেষ করে শহরের প্রবীণ গাছেদের বহু আগেই আমরা হত্যা করেছি। তাহলে কার ছায়ায় কার স্মৃতি মমতায় বড় হবে আমাদের আগামীর প্রজন্ম? আমরা আশা করব রাষ্ট্র এ বিষয়ে তৎপর হবে। সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, পরিবেশ-বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় বিষয়টি আমলে নেবেন।
বৃক্ষরোপণে দেশে রাষ্ট্রীয় তৎপরতাগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস ছাড়াও বৃক্ষরোপণে আমরা বছরব্যাপী বেশ জনসম্পৃক্ততা দেখি। ‘আগ্রাসী (ইনভ্যাসিভ বা এলিয়েন স্পিসিস) প্রজাতি’ নিয়ে বহু তর্ক আছে। বিশেষ করে একাশিয়া, ম্যাঞ্জিয়াম, ইপিলইপিল, শিশু, ইউক্যালিপটাস গাছের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বহু নেতিবাচক প্রভাব আছে। ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২’ আগ্রাসী প্রজাতির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা এনেছে। সাত মসজিদ সড়কে আগ্রাসী প্রজাতি খুব একটা নেই। বট, বড়ই, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিরিষ গাছগুলো দেখা যায়। এমনকি কেবল বৃক্ষ নয়, বেশকিছু বছরে কিছু তৃণগুল্ম ও লতা ঝোপও এখানে বিকশিত হয়েছে। এখানে পাখি, পতঙ্গ, সরীসৃপ দেখা গেছে বর্ষাকালে। এক চিলতে ছোট্ট জায়গায় একটা বিশেষ বাস্তুতন্ত্রও তৈরি হয়েছে। এখন সড়ক উন্নয়নের নামে গাছ কেটে আমরা এই বাস্তুতন্ত্র চুরমার করে দিতে পারি কি? কেবল প্রাকৃতিক সম্পর্কই নয়; এই গাছেদের সঙ্গে আমাদের শিশুদের এক ধরনের স্মৃতিময় সামাজিক সম্পর্কও তৈরি হচ্ছে। স্কুলে যাওয়ার পথে, আবাহনী খেলার মাঠে অনুশীলনের যাওয়ার পথে এই গাছগুলো তাদের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। আমরা চাইলেই গাছেদের সঙ্গে শিশুদের গড়ে ওঠা এই সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারি না। গাছেরাও মানুষের মতোই রাষ্ট্রের নাগরিক। আর সব নাগরিকের নিরাপত্তার বিধান সংবিধানে অঙ্গীকার করেছে রাষ্ট্র। সংবিধানের ১৮ (ক) ধারায় উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’। সাতমসজদি রোডে সড়ক উন্নয়নের নামে গাছ কেটে প্রাকৃতিক ও সামাজিক বৈচিত্র্যময় সম্পর্কগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে লঙ্ঘন করে। ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘বৃক্ষ সংরক্ষণ আইন ২০১৬’ নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে যত্রতত্র বৃক্ষসম্পদ আহরণ সীমিত ও প্রাচীন বৃক্ষগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ২৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী দেশের এমন বৃক্ষগুলো সংরক্ষণ করার কথা সরকারের। যেসব ঐতিহ্যবাহী, পুরাতন বয়স্ক, দেশীয় ও শতবর্ষী বৃক্ষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রথাগত মূল্য রয়েছে সেসব বৃক্ষ উক্ত আইন অনুযায়ী ‘স্মারক বৃক্ষ’। সাত মসজিদ সড়কের গাছগুলো হয়তো বয়সে এত প্রবীণ নয়, কিন্তু দীর্ঘ সময়ে পাবলিক পরিসরে অবস্থানের কারণে এসব গাছও নগরের পাবলিক স্মৃতিস্মারক হয়ে উঠেছে।
আমরা কি সড়কের বৃক্ষপ্রাণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছি? নগরায়ণ, সড়ক সম্প্রসারণ আর অবকাঠামো উন্নয়নের নামে বৃক্ষহীন এক প্লাস্টিক মোড়ানো শহর তৈরি করে চলেছি আমরা। এমন বৃক্ষহীন শহরের পরিণতি বারবার ‘দ্য লোরাক্স’ ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। ২০১২ সালে ইউনিভার্সাল স্টুডিও থেকে ড. সিউ্যসের কাহিনী থেকে ক্রিস রিনাউড ‘দ্য লোরাক্স’ নামের একটি কার্টুন অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করেন। গাছেদের মেরে প্লাস্টিকের শহর বানানোর এক তীব্র করুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে ছবিটিতে। ছবিটিতে দেখানো হয়, এক কল্পিত থিনিডভিল শহরের কোথাও কোনো জীবিত গাছ নেই। সব প্লাস্টিক, সব মেশিনে চলে। ও’হেয়ার নামের একটি কোম্পানি মূলত থিনিড শহরটি চালায়। যেহেতু শহরে কোনো গাছ নেই, ও-হেয়ার কোম্পানিটিই বোতলে ভরে অক্সিজেন বিক্রি করে। শহরের এ অবস্থাটি মূলত তৈরি হয়েছে ওয়ান্স-লারের জন্য। গাছ কেটে থিনিড শহর বানানোর পরিকল্পনা করে সে। অরণ্য ও প্রকৃতির দেবতা লোরাক্স এবং বন্যপ্রাণীর কথা কানে তুলে না। তৈরি করে গাছশূন্য এক নতুন শহুর থিনিডভিল। ততদিনে ওয়ান্স-লার থেকে শহরের মালিকানা দখল করে ও-হেয়ার কোম্পানি এবং তার পোষা মাস্তান বাহিনী। তারপর শহরের এক ছোট্ট ছেলে খুব কষ্টে সত্যিকারের গাছের বীজ শহরে এনে বুনে দেয় এবং আবার শহরটি বৃক্ষময় হয়ে ওঠে, প্রাণ ফিরে পায়। আমরা কোনোভাবেই চাই না গাছেদের কেটে কেটে কল্পিত এই থিনিড শহরের মতো প্লাস্টিকের শহর হয়ে উঠুক আমাদের প্রিয় নগর ঢাকা। আমরা চাই গাছে-মানুষে, পাখি-পতঙ্গে, জলাভূমি-উন্মুক্ত মাঠ আর অজস্র প্রাণের মায়ায় গড়ে উঠুক আমাদের সবার শহর। আশা করি নগর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন, ধানমন্ডি সাত মসজিদ সড়কের গাছগুলো কাটা থেকে বিরত থাকবেন। কাটা গাছের স্থানে দেশি প্রজাতির চারা রোপণ করে সড়ক ও সড়ক বিভাজকগুলোকে বৃক্ষবান্ধব করে গড়ে তুলবেন।
লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
বুধবার থেকে শুরু রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি মাস-ভাষা আন্দোলনের মাস শুরু। দেশের সর্বস্তরের জনগণ পুরো মাসজুড়ে ভালোবাসা জানাবে ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের।
ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার উন্মেষ।
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন। পরে ১৯৭১ সালে নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে আছে এর গৌরবোজ্জ্বল দিক। কারণ এ মাসে বাঙালি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল।
নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহর শুরু হবে। কন্দ্রীয় শহীদ মিনার আবার হয়ে উঠবে জমজমাট।
ফেব্রুয়ারি মাসের সবচেয়ে বড় কর্মযঞ্জ মাসব্যাপী বইমেলা শুরু হচ্ছে। বাংলা একাডেমিতে বিকাল ৩টায় এই মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতিপ্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
এ ছাড়া জাতীয় কবিতা উৎসবও শুরু হবে কাল থেকে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খল মুক্তির ডাক দিয়ে ১৯৮৭ সালে শুরু হয় এ ঊৎসবের। বাংলাদেশ পথ-নাটক পরিষদ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজন করেছে এ পথ নাট্যউৎসবের। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ মাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছে।
আজ ১ ফেব্রুয়ারি (বুধবার)। ভাগ্যরেখা অনুযায়ী আপনার আজকের দিনটি কেমন কাটতে পারে? ব্যক্তি, পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে কী বলছে জ্যোতিষশাস্ত্র? এ বিষয়গুলো সম্পর্কে যারা দিনের শুরুতেই কিছুটা ধারণা নিয়ে রাখতে চান তারা একবার পড়ে নিতে পারেন আজকের রাশিফল।
মেষ : ২১ মার্চ-২০ এপ্রিল
“শুক্রে ভানুস্বর্ভানুবীক্ষিতে...” রবিসহ শুক্র দ্বাদশে অবস্থান করায় আপনার কিছু অনর্থক অর্থ ব্যয় হবে। তাই অর্থ সঞ্চয় করা ভালো।
বৃষ : ২১ এপ্রিল-২০ মে
বৃহস্পতি লগ্নারূঢ় পদের সপ্তমে অবস্থান করায় পাপাগ্রহের দৃষ্টি রয়েছে। ফলে যেচে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন না। রাজরোষে পড়বেন।
মিথুন : ২১ মে-২০ জুন
বশ্যকুটের অধ্যয়নে দেখা যায় নক্ষত্রগত অবস্থায় অনূঢ়াদের অবাধ মিলনে শারীরিক সমস্যা হতে পারে। তাই মিলনের আগে জন্মনিরোধক ব্যবহার করুন।
কর্কট : ২১ জুন-২০ জুলাই
অশ্লেষা নক্ষত্রের প্রভাবে রাক্ষস ন্যায় বীভৎসতা আপনাকে প্রলুব্ধ করতে পারে। সাবধান ভুলেও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে দৈহিক দ্বন্দ্বে জড়াবেন না।
সিংহ : ২১ জুলাই-২০ আগস্ট
ইন্দ্রযোগে জন্মের ফলে ধর্মকর্মে জাতক মনোনিবেশ করেন। কিন্তু ইবলিসের প্ররোচনায় নারীর প্রতি আকর্ষণ জন্মাবে। পরকীয়া থেকে সাবধান।
কন্যা : ২১ আগস্ট-২২ সেপ্টেম্বর
“মিত্রোপকারী বিভাবাতিযুক্তো বিনীত মূর্তিঃ” আপনার সঞ্চয়কৃত অর্থ পরোপকারে ব্যয় হবে। এ নিয়ে পারিবারিক অশান্তি দেখা দিতে পারে।
তুলা : ২৩ সেপ্টেম্বর-২২ অক্টোবর
আপনার ইন্দ্রিয়ের ওপর যে কঠোর সংযম রয়েছে তা আপনার পারিবারিক অশান্তির কারণ হতে পারে। সাধু-সন্ত না হয়ে মানুষ হন, শান্তি পাবেন।
বৃশ্চিক : ২৩ অক্টোবর-২০ নভেম্বর
বৈধৃতিযোগে জন্ম হওয়ায় জাতক নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে ভুলের শিকার হয়ে অযথা মানসিক কষ্টে ভুগবেন। পরিবারের প্রবীণের পরামর্শ নিন।
ধনু : ২১ নভেম্বর-২০ ডিসেম্বর
জাতক ব্রহ্মযোগে জন্ম হওয়াতে শাস্ত্রালোচনায় যুক্ত হবেন। তবে শিক্ষক সম্প্রদায় রিপুর তাড়নায় আদিরসাক্রান্ত হয়ে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হবেন।
মকর : ২১ ডিসেম্বর-১৯ জানুয়ারি
ষণœাড়ীস্থ নক্ষত্রের সঞ্চারের ফলে শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হবেন। এ সময়ে কোনো প্রকার চুক্তিসংক্রান্ত দলিল সম্পাদন না করা উত্তম।
কুম্ভ : ২০ জানুয়ারি-১৮ ফেব্রুয়ারি
রবি লগ্নের অষ্টমে অবস্থান করায় গুপ্তরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনুগ্রহ করে বারবনিতা পরিহার করুন ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মীন : ১৯ ফেব্রুয়ারি-২০ মার্চ
সপ্তশূন্য গণনা-প্রকরণে দেখা যায় যে, জাতকের হঠাৎ অযাচিতরূপে অর্থসম্পদ লাভ হতে পারে। তবে চাঁদাবাজের আবির্ভাব ঘটবে। সাবধান থাকবেন।
ভারতের আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্পের সঞ্চালন লাইনের বিরোধিতা করে দেশটির উচ্চ আদালতে মামলা হয়েছে। স্থানীয় চাষীদের করা এ মামলার ফলে চলমান সংকট আরো গভীর হলো আদানির।
ভারতীয় টিভি চ্যানেল কলকাতা টিভি এবং ইটিভি জানায়, ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মাণাধীন আদানি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আগামী মার্চে বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে, সেটিও অনিশ্চয়তায়ে পড়ল।
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ফরাক্কায় আদানির বিদুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর। মঙ্গলবার ফরাক্কায় আদানি পাওয়ারের বিরুদ্ধে ৩০ ফল চাষীকে নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দাখিল করে এ সংগঠন।
এ মামলা গ্রহণ করে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করে প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও বিচারক রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ।
দেশটির সংবাদমাধ্যম জানায়, ঝাড়খন্ডে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে আদানির। সেখান থেকে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। এ জন্য মুর্শিদাবাদের ফরাক্কায় খুঁটি নির্মাণ করে আদানি পাওয়ার। কিন্তু এ খুঁটি তৈরি করতে গিয়ে জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে জমির ওপর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তার স্থাপন নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে এ নিয়ে তাদের বিরোধ চলছিল।
ভারতীয় টিভিগুলো জানায়, স্থানীয়দের অভিযোগ, কৃষি জমির ওপর দিয়ে হাই টেনশন তার যাওয়ায় বিপুল ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছ। ফরাক্কার যে অঞ্চল থেকে এ তার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা জনবসতিপূর্ণ। পাশাপাশি এখানে প্রচুর পরিমাণ আম, লিচুর গাছও রয়েছে। এ গাছের ফলনই স্থানীয়দের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। গত বছর জুলাই মাসে যা নিয়ে আদানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে গ্রামবাসী। গ্রামবাসীদের সরাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ-গ্রামবাসী সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ফরাক্কার বেনিয়া গ্রাম।
আরো জানা যায়, আদানির বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন এক কৃষক। সেই মামলার ভিত্তিতে এ প্রকল্পের জন্য কৃষকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে দেখার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। তারপরও ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় আদানি গোষ্ঠী ও রাজ্য সরকারকে অভিযুক্ত করে হাইকোর্টে যান ফারাক্কার ৩০ চাষী। তাদের পক্ষে মঙ্গলবার মামলা দায়ের করেন সিনিয়র আইনজীবী ঝুমা সেন।
ফারাক্কার চাষীদের পক্ষে এ মামলার আইনজীবী মানবধিকার সংগঠন এপিডিআরের কর্মী রণজিৎ সুর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, গোটা প্রক্রিয়া বেআইনিভাবে করার কারণে জনস্বার্থে মামলা দায়ের হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ওপর থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন যাবে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আদানির কোনো চুক্তি নেই। একইসঙ্গে যাদের জমির ওপর থেকে সঞ্চালন লাইন যাচ্ছে তাদের সঙ্গেও চুক্তি নেই। এমনকি তাদের সম্মতিও নেয়া হয়নি।
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’
তার কলাম মানেই সেদিন বাংলার বাণী অফিস সরগরম। সকাল থেকেই ফোন আসত। বিভিন্ন আড্ডায়ও আলোচনা হতো সেই কলাম নিয়ে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়-আশয় এবং দেশের সমসাময়িক বিষয়গুলো আকর্ষণীয় এবং সহজ করে পাঠকের কাছে তুলে ধরতেন এই সাংবাদিক। এর বাইরে প্রকৃতি, পাহাড়, নদী ও দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে লিখতেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের লাল পাহাড়ের মানুষের জীবনের গল্পও তুলে আনতেন। প্রায় দেড় দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। লিখেছেন অসংখ্য কলাম।
যখন সাংবাদিকতা করতেন তখন তার কাজের জায়গাটিতে তিনি ছিলেন সেরা। ছাত্ররাজনীতির জন্য যেমন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, ছাত্রনেতা হিসেবেও পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়। সফল হয়েছেন প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রী হিসেবে। দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও তিনি সফল। তৃতীয়বারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রাজনীতির বাইরে তার আরও অনেক পরিচয়ের মধ্যে সাংবাদিক পরিচয়টাও অনেক বেশি উজ্জ্বল।
ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন স্পষ্টবাদী, সাহসী ও দেশপ্রেমিক। পাকিস্তান আমলে ছাত্র ও গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা এ নেতা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং কোম্পানীগঞ্জ থানা মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) অধিনায়ক ছিলেন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ওই ভয়াল রাতে নিহত হন তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি। তিনি তখন দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক। ফলে পত্রিকাটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৮১ সালে পত্রিকাটি আবার ছাপার অনুমতি পায়। ওই সময় ওবায়দুল কাদের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। সেই সঙ্গে লেখালেখি। দ্বিতীয়বার শেখ ফজলুল করিম সেলিমের (বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য) সম্পাদনায় বাংলার বাণী পত্রিকার ছাপা শুরু হওয়ার পর যুক্ত হন ওবায়দুল কাদের। তিনি পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য ও পরে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের আগপর্যন্ত তিনি সাংবাদিকতা করেছেন।
টানা ১৫ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে ওবায়দুল কাদের অসংখ্য কলাম লিখেছেন বাংলার বাণীতে। ‘ও কাদের’ নামে তিনি কলাম লিখতেন। প্রতিদিন সকালে অফিসে আসতেন। সম্পাদকীয় বিভাগ ও অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে মিটিং করতেন। সম্পাদকীয় বিভাগের বাইরে সেই সময় তিনি বাংলার বাণীর আন্তর্জাতিক পাতাটি নিজের দায়িত্বে বের করতেন। আন্তর্জাতিক বিষয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ে তিনি খুব বেশি সচেতন ও আগ্রহী ছিলেন।
ওবায়দুল কাদেরের সেই সময়কার সহকর্মীরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সহকর্মী হিসেবে তিনি চমৎকার ছিলেন। তাছাড়া সাংবাদিক হিসেবেও খুব পেশাদার ছিলেন। তিনি যদি রাজনীতি না করে সাংবাদিক থাকতেন, তার অনেক লেখা এবং অসংখ্য বই আমরা পেতাম। যদিও তিনি এখন রাজনীতিতে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু আমরা যারা তাকে পেয়েছি, তারা তার লেখা মিস করছি। তার লেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। যেহেতু বাংলার বাণী ছিল বিরোধী ঘরানার পত্রিকা, তাই সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ থাকত।
ওবায়দুল কাদেরের লেখালেখি ও তার কলাম সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত কবীর চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘যখনি সংকট, যখনই এক অপয়া অন্ধকার ওঁৎ পেতে আসে, যখনই সমাজ ধূসরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, যখনই মিথ্যা ও ইতিহাস বিকৃতির গোলকধাঁধায় নয়া প্রজন্মকে দিগভ্রান্ত করার অপচেষ্টা, যখনই রাজনীতির গৌরব কলুষতায় ঢেকে দেওয়ার অপপ্রয়াস তখনই ওবায়দুল কাদেরের এই জীবন ঘনিষ্ঠ, সত্য ও সুন্দরের আরাধনাময় সাহসী রচনা সমাজকে আলোর ইতিহাস শোনাতে পারে।’
ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকতা জীবনে সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়, রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন অসংখ্য। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাংলার বাণী পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে আমার সহকর্মী ছিলেন, কলাম লেখক হিসেবেও জনপ্রিয় হয়েছিলেন।... আমি তার অলংকৃত কাব্যিক ভাষায় বক্তৃতার একজন ভক্তশ্রোতা।’
প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মূল্যায়ন ছিল, ‘ওবায়দুল কাদের শুধু রাজনীতিক নন, তিনি সাংবাদিক, তিনি বাগ্মী, তিনি লেখক। বক্তৃতায় বাংলা শব্দ উচ্চারণ, ছন্দের ব্যবহারে চারণকবি তিনি। নিবন্ধ লেখক হিসেবে যুক্তি ও বিশ্লেষণে তীব্র লক্ষ্যভেদী তিনি।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন বাংলার বাণীতে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৯৮৯ সালে বাংলার বাণীতে যখন জয়েন করি তখন সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাদের ভাইকে পাই। আমরা বার্তাকক্ষে বসতাম আর তিনি তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরদের রুমে বসতেন। ওনাদের আলাদা রুম ছিল। তিনি রুম থেকে বের হয়ে সবসময় আমাদের খোঁজখবর নিতেন। মাঝেমধ্যে আমাদের এখানে এসে গল্প করতেন। তিনি সহকর্মী হিসেবে খুবই আন্তরিক ও সহকর্মীবান্ধব ছিলেন।’
সেই সময়ে বাংলার বাণীতে ওবায়দুল কাদেরের আরেক সহকর্মী ও পাক্ষিক ক্রীড়াজগৎ পত্রিকার সম্পাদক দুলাল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি তাকে ১৯৮৫ সালে পেয়েছি। আমি তখন সহ-সম্পাদক হিসেবে জয়েন করেছি বাংলার বাণীতে। ওবায়দুল কাদের তখন সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তিনি কলাম লিখতেন। তার কলাম পাঠকের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। তার লেখার মধ্যে সাহিত্য ছিল। লেখা খুব আকর্ষণীয় ছিল। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জায়গায় যেতেন, সেসব বিষয় নিয়েও লিখতেন। তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ছিল চট্টগ্রাম, পাহাড়-সমুদ্র খুব পছন্দ করতেন এবং এসব নিয়েও তিনি লেখালেখি করতেন। তিনি খুব আবেগী লোক ছিলেন এবং লেখার মধ্যে সেটা ফুটে উঠত। তার লেখা পাঠক পড়তে বাধ্য হতেন।’
তিনি বলেন, ‘রাজনীতির মানুষ হলেও অফিসে ঢুকলে একজন সংবাদকর্মী হিসেবেই থাকতেন ওবায়দুল কাদের। রাজনীতির বিষয়টা বাইরে রাখতেন। বরাবরই তিনি শৌখিন টাইপের লোক ছিলেন। ভালো কাগজ-কলম ব্যবহার করতেন লেখার সময়। লেখার সময় আলাদা একটা মেজাজে থাকতেন। তখন খুব জরুরি না হলে কোনো বিষয় অ্যালাউ করতেন না। লেখা শেষ করলে বেশ ফুরফুরে থাকতেন। তখন আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, গল্প করতেন। পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে তার মনোভাব আমরা দেখতে পেয়েছি।’
সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাংবাদিক সুভাষ চন্দ বাদল বাংলার বাণী পত্রিকায় ওবায়দুল কাদেরের সহকর্মী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘কাদের ভাইকে ছাত্ররাজনীতি থেকেই চিনতাম। ১৯৭৫ সালের পর যখন তিনি কারাগারে যান তখন আমিও কারাগারে। তাকে কারাগারে দেখেছি বই নিয়ে ডুবে থাকতে। বাংলার বাণীতে এসে তাকে নতুন করে পেয়েছি। সেই সময় আজিজ মিসির ও তার কলাম ছিল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তিনি সাংবাদিকবান্ধব। বাংলার বাণী অফিসেও সহকর্মীদের সবসময় সহযোগিতা করতেন। আমি রিপোর্টার হিসেবে যদি কখনো কোথাও আটকে যেতাম তিনি সহযোগিতা করতেন। কাদের ভাই সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন মেধাবী ও জ্ঞানী। তার সাহসের ঘাটতি ছিল না। তার কলামেও এর প্রভাব দেখেছি।’
ওবায়দুল কাদের ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার বড় রাজাপুর গ্রামে জন্ম নেন। বাবা মোশারফ হোসেন সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা শুরু করেন। মা ফজিলাতুন্নেছা। ওবায়দুল কাদের বসুরহাট সরকারি এএইচসি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি ও নোয়াখালী কলেজ থেকে মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কলেজজীবন থেকে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন।
১৯৭৫-এর পর একনাগাড়ে দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং পরপর দুবার সভাপতি ছিলেন।
তার সেই সময়ের সহকর্মীরা বলেন, সাংবাদিক ওবায়দুল কাদের তথা কাদের ভাই মানেই অন্যরকম। তিনি ছিলেন খুব সংবেদনশীল। সবাইকে মেনে নেওয়ার একটা ক্ষমতা ছিল। তিনি যে এত বড় একজন রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধা, এত বড় ছাত্রনেতা, তা কখনই সাংবাদিকদের কাছে মনে হতো না। মনে হতো, কাদের ভাই যেন সাংবাদিকতার মধ্যেই ডুবে আছেন। কোনো রিপোর্টার বা সাব-এডিটর অনুবাদ করতে সমস্যায় পড়েছেÑ কাদের ভাইয়ের কাছে গেলেই সমাধান। নিজের রুমে, ডেস্কে বসিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। আর তার টেবিলে ছিল সবসময়ই গাদা গাদা বই।
বাংলার বাণীর সেই সময়ের একাধিক সাংবাদিক ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে দেশ রূপান্তরকে বলেন, কাদের ভাই ছিলেন সাংবাদিকতার প্রতি পুরো নিষ্ঠাবান। তার কাছে অনেক কিছু শিখেছি। তিনি দীর্ঘক্ষণ কোথাও বসে থাকতেন না। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি রুম থেকে বেরিয়ে অন্য সহকর্মীদের টেবিলে টেবিলে আড্ডা দিতেন। সেখানে হয়তো আমরা চায়ের অর্ডার দিয়েছি। চা আসতে না আসতেই তিনি উঠে যেতেন। তারপর আবার তাকে চায়ের কাপ নিয়ে খুঁজতে হতো কাদের ভাই কই...।
আজ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের উদ্যোগে শান্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট তারানা হালিম। আর অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন যুবলীগ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিল।
সভাপতির বক্তব্যে যুবলীগ চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপির মুখে গণতন্ত্রের কথা, মানবাধিকারের কথা মানায় না। আপনাদের হিংসাত্মক রাজনীতি আর সন্ত্রাসের কারণে নতুন প্রজন্ম রাজনীতি করতে চায় না। যারা একুশে আগস্ট ঘটিয়েছে, নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, কৃষকের বুকে গুলি চালিয়েছে, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়েছে, তাদের সকল অপকর্মের মেডেল আছে। আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির প্রধান শত্রু এ দেশের সাধারণ জনগণ। যারা একাত্তরে হাতিয়ার তুলে নিয়েছিল দেশকে স্বাধীন করার জন্য, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আপনারা বার বার তাদেরকেই আক্রমণ করেন। আওয়ামী লীগ আপনাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে আসে বলেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপনাদের বিরোধ ঘটে। সব সময় এ দেশের সাধারণ মানুষকে আপনাদের ষড়যন্ত্রের শিকার বানান, হত্যার শিকার বানান এবং আপনাদের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের শিকার বানান।
পরশ আরও বলেন, এ বছরটা নির্বাচনের বছর। আমাদের রাজপথে থাকতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু নেতাকর্মী দ্বারা আবর্ত থাকলে চলবে না, আমাদের চলে যেতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। গত ১৪ বছরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অর্জনের কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যদি সাধারণ মানুষ উন্নয়নের সুফল না পায় তাহলে সেই উন্নয়নের কোনো মূল্য থাকে না। যখন আমাদের সকল উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারব তখনই জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।
তিনি যুবলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, যুবলীগের ভাই ও বোনেরা- আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন, আপনারা ধৈর্যশীল থাকবেন। ওদের কৌশল আমাদের সন্ত্রাসী হিসাবে উপস্থাপন করা। ওরা পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে চাইবে। আপনারা ওদের ফাঁদে পা দেবেন না। কিন্তু রাজপথ আমরা ছেড়ে দেব না। ভুলে যাবেন না, ওরা কিন্তু দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানাতে পারদর্শী। মিথ্যার ওপরই দলটার সৃষ্টি। ওরা জাতির পিতার নাম মুছে ফেলেছিল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছিল। সুতরাং মিথ্যা চর্চার ক্ষেত্রে এই দলকে দুর্বল ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, যখন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যখন বাংলাদেশের জিডিপি সিংগাপুর, মালয়েশিয়ার উপরে, যখন বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে পেছনের দিকে নেওয়ার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তারা সবাই ভবিষ্যদ্বণী করছে, বাংলাদেশ যেভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যদি এভাবে এগিয়ে যায় তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৭তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। আর এটা সম্ভব শুধুমাত্র রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে।
তিনি যুবলীগের উদ্দেশে বলেন, বিএনপি-জামায়াত আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা নানা মিথ্যা প্রচারণা ও গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এবং ইউনিটে জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। বলতে হবে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়নি, বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা শেখ হাসিনার পাশে থাকুন, নৌকার পাশে থাকুন, নৌকায় ভোট দিন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট তারানা হালিম বলেন, যারা স্যাংশন নিয়ে কথা বলেন তাদের দলের প্রধান খালেদা জিয়া তৎকালীন আমেরিকার পরারাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্যাংশন চেয়েছেন। যাতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়ে, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়, খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়, মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। এটাই হলো বিএনপির আসল চেহারা। তারা কখনোই এ দেশের মানুষের ভালো চায় না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা আছে কিভাবে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে তোলা যায়। সামনের যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কথা বলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ তা কাটিয়ে উঠতে পারবে। আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা তার দূরদর্শী নেতৃত্বে একটি উন্নত-সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে।
সঞ্চালকের বক্তব্যে যুবলীগ সম্পাদক নিখিল বলেন, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঢাকার রাজপথে আপনারা পোস্টার হয়েছেন। নুর হোসেন, ফাত্তাহ বাবুল হয়েছেন। তারপরেও দেশের স্বার্থে সংগঠনের স্বার্থে, বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার প্রশ্নে যুবলীগ আপস করেনি, যুবলীগ আপস করতে জানে না। তিনি যুবলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেমনি করে বিগত দিনে কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথ আগলে রেখে প্রিয় নেত্রীর নির্দেশিত পথে মানুষের কল্যাণে, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আপনারা সব সময় কাজ করেছেন। আগামী নির্বাচনেও সেই সাহসিকতা আর বীরত্বের সাথে রাজপথে থাকবেন। বিএনপি-জামায়াতের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আবারও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে ঘরে ফিরবেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. হাবিবুর রহমান পবন, মো. নবী নেওয়াজ প্রমুখ।
আইন অনুযায়ী তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের একক ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হলেও তাদের তা করতে দেওয়া হয় না। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের একক এখতিয়ার কমিশনের থাকলেও সম্প্রতি সেটিও খর্ব হয়েছে।
সরকারের নির্বাহী আদেশ আর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের হস্তক্ষেপের কারণে লাইসেন্সসংক্রান্ত কাজের পাশাপাশি সীমিত পরিসরে বিরোধ মীমাংসা ছাড়া আর কিছুই এককভাবে করতে পারছে না জ্বালানি খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে ভোক্তার মতোই কমিশনও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে কমিশনের মোট জনবল সংখ্যা ৮৪। প্রতি বছর বেতনভাতা ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। দিনে দিনে ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ কী বা এ কমিশনের কোনো প্রয়োজন আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানতে চাইলে বিইআরসির সদস্য মোহাম্মদ মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী গত সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, “এখন শুধু লাইসেন্সসংক্রান্ত কিছু কাজ আর ‘আরবিট্রেশনটা’ (বিরোধ মীমাংসা) কমিশনের হাতে আছে। দরকার হলে দুদিন পর সরকার সেটাও ‘উইথড্র’ (প্রত্যাহার) করবে। যখন দেখবে আরবিট্রেশনগুলো সুবিধাভোগীদের বিপক্ষে যাচ্ছে তখন এটাও উইথড্র হবে। সরকারের নির্বাহী ক্ষমতায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সুযোগ রেখে যে আইন হলো তা করা হয়েছে তাদের মোটাতাজা করার জন্য।” তিনি বলেন, ‘নতুন এ আইন করার ফলে আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের কাছ থেকে দূরে গেল না কাছে এলো সেই বিষয়টা অনুধাবন করা দরকার।’
খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বিইআরসির এ সদস্য বলেন, ‘আমার মেয়াদ আছে আর কয়েক দিন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করিনি। কারণ আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছেন যেটা তোমার পছন্দ হবে না সেই কাজ তুমি করবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছি।’
বিইআরসির কার্যাবলির প্রথমেই জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি, জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত এবং এনার্জি অডিটের মাধ্যমে জ্বালানি ব্যবহারের খরচের হিসাব যাচাইয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এগুলোর বাস্তবায়ন নেই বললে চলে। অন্যদিকে জ্বালানি খাতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করা এবং সরকারকে সুপারিশ করা কমিশনের কার্যাবলির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এর বাস্তবায়ন তেমন একটা চোখে পড়ে না।
উচ্চ আদালতের আদেশে কমিশন প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের মূল্য সমন্বয় শুরু করেছে। কিন্তু বাজারে কখনই বিইআরসি ঘোষিত মূল্যহার অনুযায়ী এলপি গ্যাস পাওয়া যায় না। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গ্যাস বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানির সামান্য সিস্টেম লস কমাতে পারে না কমিশন। সেখানে অন্যান্য কাজ কীভাবে করবে? বিইআরসি নির্দেশ দেয়। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না। এ জন্য কিছু করারও সক্ষমতা নেই কমিশনের।’
সূত্রমতে, অভিযোগের ভিত্তিতে বিইআরসি আইন অনুযায়ী লাইসেন্সি প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তার মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে কমিশন। কিন্তু গত ১০ বছরে কমিশনে ৩৭৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ২১০টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তির হার কম হওয়া এবং জনসচেতনার অভাবে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ কম করা হয় বলে অনেকে মনে করেন।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করতে করতে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা ভোক্তার জন্য এবং বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত তথা সামগ্রিক দেশের জন্য অশনিসংকেত।’ তিনি বলেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত পুরোপুরি কারিগরি। এর সঙ্গে আইনের নানারকম বিষয় জড়িত। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের এসব বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সই করা ছাড়া তারা কিছুই করে না। এভাবে তো সাধারণ মানুষের কল্যাণ সম্ভব নয়। বিইআরসি গণশুনানির মাধ্যমে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত বলে সেখানে কিছুটা হলেও বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহিতা করতে হতো। তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুযোগ ছিল। সেখানে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল বলে কোম্পানিগুলোও যেনতেন হিসাব উপস্থাপন করে মূল্যহার বাড়ানোর ব্যাপারে কঠিন চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন হয়। কিন্তু আইন সংশোধনের কারণে সেই সুযোগ আর থাকল না। তড়িঘড়ি করে করা এ সংশোধন অসাধু ব্যবসাকে সুরক্ষা দেবে বলে তিনি দাবি করেন।
শামসুল আলম মনে করেন, বিইআরসি আইন সংশোধন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে ক্ষমতার সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে সরকার। অন্যদিকে বিইআরসি আইন অনুযায়ী তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের একক ক্ষমতা বিইআরসির হলেও তারা তা করতে পারে না। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ আইন লঙ্ঘন করে অনেক আগে থেকেই অবৈধভাবে তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করে আসছে।
খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) নিজে তরল জ্বালানি ব্যবসায়ী তথা বিইআরসির লাইসেন্সি হওয়া সত্ত্বেও ফার্নেস অয়েলের মূল্য বিপিসিই নির্ধারণ করে। আর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে অন্যসব কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেলের ক্রয়-বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়। এসব ক্ষেত্রে সিস্টেম লসের নামে তেল চুরি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল ও কয়লার ব্যবহার বেশি দেখানো হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন কোম্পানি এবং সংস্থার পরিচালনা বোর্ডে পদাধিকারবলে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্য কর্মকর্তা কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালক। ফলে ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় বিইআরসি এসব প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।
সরকারের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রবল চাপে ২০০৩ সালের মার্চ মাসে বিইআরসি আইন করা হয়। এরপর ২০০৫, ২০১০ ও ২০২০ সালে এ আইন সংশোধন করা হয়। এর মধ্যে আইনের ৩৪ ধারার উপধারা-৫-এ উল্লেখযোগ্য সংশোধনী আনা হয় ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর। এর আগে বছরে সর্বোচ্চ একবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম সমন্বয় বা পুনর্নির্ধারণের সুযোগ থাকলেও নতুন ওই সংশোধনীতে একাধিকবার দাম পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে গ্রাহকের কাঁধে এক বছরেই একাধিকবার দাম বৃদ্ধির খড়গ নেমে আসে।
সম্প্রতি বিইআরসির পাশাপাশি সরকারকে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম পুনর্র্নির্ধারণ ও সমন্বয় করার ক্ষমতা দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এরপরই গণশুনানি ছাড়াই চলতি মাসে এক সপ্তাহের মধ্যে নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
সরকারের ওই আদেশ জারির আগে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদন নিয়ে গত ৮ জানুয়ারি গণশুনানি করেছিল বিইআরসি। চলতি মাসে মূল্যসংক্রান্ত নতুন আদেশ দেবে বলে জানিয়েছিল কমিশন। কিন্তু এর মধ্যেই গত ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে বিইআরসির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
বিইআরসির আইন অনুযায়ী, গণশুনানির মাধ্যমে দাম সমন্বয় হবে। এ ক্ষেত্রে বাড়তেও পারে কমতেও পারে। কিন্তু বিইআরসির দাম কমানোর কোনো নজির নেই। গণশুনানিতে ভোক্তারা দাম কমানোর বিষয়টি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেও তা আমলে না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দাম বাড়ানোর সময় অবশ্য সংস্থাগুলোকে সাশ্রয়ী ও দক্ষ হওয়ার পরামর্শসহ নানারকম শর্ত জুড়ে দেয় কমিশন।
তবে বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানির প্রস্তাব অনুসারে, কখনই দাম বাড়ায়নি বিইআরসি। এর আগে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এলেও বিইআরসি বাড়িয়েছে ২০ শতাংশ। গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এলে বিইআরসি বাড়িয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ।
যশরাজ ফিল্মসের হাত ধরে বড় পর্দায় শাহরুখ খানের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী বলিউড। তার 'পাঠান' বক্স অফিসে নজির গড়ছে। ভারতীয় ছবির সাফল্য পাড়ি দিয়েছে আমেরিকাতেও।
৪ বছর পর বড় পর্দায় ফিরেছেন শাহরুখ। 'পাঠান'-এ তার অ্যাকশন দেখতে দলে দলে হলে যাচ্ছেন অনুরাগীরা। মুক্তির পর প্রথম কয়েক দিনেই বিপুল টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে এই ছবি। গড়েছে একাধিক নজির। গত বুধবার, ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পায় 'পাঠান'। রবিবার পঞ্চম দিনে ছবিটি বিশ্বজুড়ে ৫০০ কোটির বেশি টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে দাবি, পঞ্চম দিনের শেষে 'পাঠান'-এর আয় সাড়ে ৫০০ কোটি। মুক্তির প্রথম ৪ দিনই দেশের বাজারে হাফ সেঞ্চুরি করেছিল 'পাঠান'। রবিবারও তার অন্যথা হয়নি। ৫০ কোটির গণ্ডি পেরিয়ে এই ছবি রবিবার দেশে প্রায় ৭০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। ভারতে এখন পর্যন্ত 'পাঠান'-এর মোট আয় ২৮২ কোটি টাকা। শনি ও রবিবার সপ্তাহান্তেই আরও বেশি করে এই ছবি দেখতে হলে যান মানুষ। চতুর্থ দিনে দেশের বক্স অফিসে শাহরুখের ছবির আয় ছিল ৫১ কোটি টাকা। সারা বিশ্বে এ ছবির মোট রোজগার শনিবার পর্যন্ত ছিল ৪২৯ কোটি টাকা। রবিবার এক লাফে ৫০০ কোটির গণ্ডি ছাড়িয়েছে 'পাঠান'।
দেশের বাইরে 'পাঠান' মোট ১০০টি দেশে মুক্তি পেয়েছে। বিদেশে ২৫০০টি পর্দায় এই ছবি দেখানো হচ্ছে। ভারতে এই ছবি চলছে সাড়ে ৫ হাজার পর্দায়। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ৬৯৪টি সিনেমা হলে 'পাঠান' মুক্তি পেয়েছে। সেখানে রমরমিয়ে চলছে শাহরুখ, দীপিকা পাডুকোন এবং জন আব্রাহাম অভিনীত ছবিটি। নজির গড়েছে। উত্তর আমেরিকার বক্স অফিসে হিন্দি ছবি হিসাবে 'পাঠান'-এর প্রথম দিনের আয় সর্বোচ্চ। ছবিটি মুক্তির দিন ১৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১৫ কোটি টাকা) আয় করেছে আমেরিকায়। উত্তর আমেরিকার ৬৯৪টি সিনেমা হলে সাম্প্রতিককালে মুক্তিপ্রাপ্ত যেকোনো ছবির তুলনায় 'পাঠান'-এর গড় সবচেয়ে বেশি।
আয়ের গড় হিসাবে হলিউডকেও টেক্কা দিচ্ছেন শাহরুখ। এই নিরিখে হলিউডের ৩টি ছবি কেবল 'পাঠান'-এর সামনে রয়েছে। সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সেরা গড়ের তালিকায় তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে শেষ করতে পারে 'পাঠান'। তালিকায় 'পাঠান'-এর আগে রয়েছে 'অ্যাভাটার : দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’, 'পুস ইন দ্য বুটস : দ্য লাস্ট উইশ' এবং 'এ ম্যান কলড ওটো'।