
এমন কিছু দৃশ্য থাকে যেগুলো আমাদের সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। ২০১৭ সনের ৮ জুলাই অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন গঠিত হয়, এই তো ঢাকার শাহজাদপুরে। গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় যারা প্রাণ হারান তাদেরই একজন হাস্যোজ্জ্বল অবিন্তা কবির। ফাউন্ডেশন উদ্বোধনের দিন সাংবাদিক হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ যখন কথা বলতে পোডিয়ামে ওঠেন তখন আমিও অনেকের মতো কান্না ধরে রাখতে পারিনি। রুবা আহমেদ কথা বলতে পারছিলেন না, একটি শব্দও না। সেদিন তার অশ্রুই তার ভাষা হয়ে উঠেছিল।
তখন রুবা আহমেদ আদরের সন্তানের স্মৃতি পাথেয় করে শোক মোকাবেলা করছিলেন। তখনো তিনি জানেন না, ভবিষ্যতে তাকে একটি সিনেমা প্রতিহত করার লড়াইয়ে নামতে হবে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে সেই জঙ্গি হামলা নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘ফারাজ’-এর ট্রেলার। ঘোষণা এসেছে সিনেমা আসছে ৩ ফেব্রুয়ারি। ২০১৯ সন থেকে এই সিনেমার বিরোধিতা করে আসছে অবিন্তা পরিবার। প্রথম দিকে হয়তো তারা ভেবেছিলেন একজন মায়ের আবেগকে শ্রদ্ধা জানিয়েই ফারাজ পরিবার এই সিনেমা করা থেকে সরে আসবে। তা হয়নি। রুবা আহমেদকে দিল্লির আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) সাংবাদিকদের সামনে এসেছিলেন রুবা আহমেদ। এ বিষয়ে আগে কখনো তাকে সামনে আসতে দেখা যায়নি। এবার তিনি এসেছেন একজন মা হিসেবে। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা থেকে শুরু করে দিল্লির হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ানো—সবটাই বললেন তিনি। শেষে তার অসহায়ত্ব প্রকাশ পায় ‘আমি জানি, হয়তো আমি কিছু করতে পারবো না’ বাক্যেটিতে। তার কষ্ট, কেউ তার আবেগকে নূন্যতম সম্মান দেখালো না। একজন মায়ের ভালোবাসাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বাজারে আসছে ‘ফারাজ’। সিনেমাটি দেখার সুযোগ করে দেয়া তো দূরের কথা সিনেমা তৈরিতে তাদের সম্মতিও নেয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন তিনি। এর পাল্টা কোনো বক্তব্য থাকলে ফারাজ পরিবার দিক। না, কখনো এবিষয়ে কথার বলার প্রয়োজন মনে করেনি তারা।
রুবা আহমেদর চান না এই সিনেমায় অবিন্তাকে মূর্ত করা হোক, সে রাতের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পুনরুৎপাদন দেখতে তার আপত্তি। তিনি শঙ্কিত তার কন্যার ও তার প্রাইভেসি নিয়ে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ফারাজ তার কন্যা অবিন্তার জন্য জীবন দিয়েছে তা তিনি বিশ্বাস করেন না। কেননা এই ন্যারেটিভের পেছনে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ নেই। না আছে কোনো সাক্ষী।
রুবা আহমেদর এই কথাটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ফারাজ হিরো, জঙ্গিরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু সে তার দুই বন্ধু—অবিন্তা ও তারিশির জন্য রয়ে যায় এবং প্রাণ হারায়। এই যে ন্যারেটিভ—তার ভিত্তি কি? বলা হচ্ছে ‘ফারাজ’ সিনেমাটির অন্যতম ভিত্তি সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবুর লেখা ‘হোলি আর্টিজান: একটি জার্নালিস্টিক অনুসন্ধান’ শিরোনামের বই।চলুন দেখি ফারাজের ‘বীরত্ব’ সম্পর্কে সেই বই কি বলছে,
‘ফারাজ অবিন্তা ও তারিশি জৈনকে সকালের দিকে হত্যা করা হয় বলে একাধিক গণমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। ফারাজের নিকটাত্মীয় হিশাম হোসাইনের বরাত দিয়ে ২ জুলাই ২০১৬ তারিখে নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে হিশাম হোসাইন বলেন, ফারাজকে জঙ্গিরা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল এবং তিনি দুই বান্ধবীকে ছেড়ে আসতে চাননি বলে তাকে তাকে হত্যা করা হয়। তবে অনুসন্ধানে এরকম কোনো তথ্যের সত্যতা মেলেনি। প্রকৃতপক্ষে রাত সাড়ে ১২টার থেকে ১টার পর কাউকে হত্যার ঘটনা কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বলতে পারেননি। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারাও প্রত্যক্ষদর্শীদের যে জবানবন্দি নিয়েছেন তাতে এমন কোনো ঘটনার কথা উল্লেখ নেই। সিটির (কাউন্টার টেরোরিজম) প্রধান মনিরুল ইসলাম আমাকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত তাদের তদন্তে ফারাজকে জঙ্গিদের ছেড়ে দেওয়ার কোনো ঘটনার কথা কেউ বলতে পারেনি।’
আমি মনে করি, ইতিহাস নির্মোহ। আপনার মনে হতে পারে আপনি ইতিহাস নিয়ে খেলতে পারেন, এই ধারণাটা ভুল। কেননা, আপনি যে খেলছেন একসময় ইতিহাস তাও বলে দেয়।
লেখক: দৃশ্যগল্পকার
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে চীনে রপ্তানি হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে এই মন্দাভাব অব্যাহত থাকবে। দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। যে কারণে এশিয়ার অন্য দেশগুলোর অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চিনে করোনা মহামারির প্রভাবে বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন চাহিদা কমছে। আর এ কারণে দেশটিতে আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড বারবেরি জানিয়েছে চীনে তাদের বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
চীনের রপ্তানি বাণিজ্যও সংকুচিত হয়েছে। ভারত চীনা পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চলছে বাণিজ্য-যুদ্ধ। হংকং নিয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক খারাপ। ফলে দ্রুত আর্থিক অবস্থার উন্নতির সম্ভাবনা সামনে নেই। এরই মাঝে করোনার আবার নতুন ঢেউ । অর্থনীতির নিম্নগতি সত্ত্বেও দেশটি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শূন্য কোভিড নীতি অনুসরণ করেছিল। কিন্তু জনরোষের কারণে তার কিছুটা প্রত্যাহার করতে হয়। এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে করোনা প্রতিরোধ ও অর্থনীতির সূচককে ঊর্ধ্বমুখী করতে।-খবর জাপানি সংবাদ সংস্থা এনএইচকে ওয়ার্ল্ড-এর।
প্রতিবেদনে থাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে দেশটিতে ডিসেম্বর মাসে চীনে রপ্তানি ১৪ দশমিক ছয় শতাংশ কমে প্রায় ২১ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এটি পতনের টানা তৃতীয় মাস ছিল। এই তিন মাসে চীনে রপ্তানি কমেছে ২০.৮ শতাংশ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ডিসেম্বরে চীনে-তেল রপ্তানি ২০ দশমিক ছয় শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। গড়ে তিন মাসে চীনে রপ্তানি ৩১ দশমিক আট শতাংশ কমেছে।
যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ টমি উ বলেছেন, "মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে গত বছরের চীনের দ্বিতীয় কোয়ার্টারের জিডিপির হিসাব ছিল সবচেয়ে খারাপ। লকডাউনের কারণে, বিশেষ করে সাংহাইতে করোনা বিস্তারের কারণে এই কোয়ার্টারের শুরুতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।"
চীন সরকার তার কঠোর সংক্রমণ বিরোধী ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার পরও থেকে চীনের অর্থনীতি বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন পশ্চিমা দেশগুলির আর্থিক সংকোচন নীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়ার ওডর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা এসব কিছু মিলিয়ে চীন থেকে আমদানি রপ্তানি সামনের মাসগুলিতে আরও বাধাগ্রস্ত হবে। ইউরোপভিত্তিক সংবাদ বিশ্লেষক ‘ইনসাইড ওভার’ সম্প্রতি করা এক প্রতিবেদনে বলেছে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া আর মন্দা অর্থনীতি এ দুটি বিষয় নিয়ে চীন উভয়সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চীনের শূন্য কোভিড নীতি হয়তো দেশটির মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে কিন্তু অর্থনীতির ওপর ফেলেছে বিরূপ প্রভাব।
বলা হয়েছে যে বেইজিং যদি "আসন্ন কোভিড তরঙ্গ দ্বারা ক্ষতি সামাল দিতে জিরো কোভিড নীতি পুনর্বহাল করে, তবে তা অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে৷ আর যদি তা না করা হয়, তবে মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।"
গত ৮ জানুয়ারি শূন্য কোভিড নীতি থেকে সরে আসে দেশটি। ঘোষণা আসার পর থেকে বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়ানো নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানও চীনে নতুন করে সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে। ভারত ও জাপান সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। চীন থেকে আসা ব্যক্তিদের ওপর নতুন কোভিড বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
যে হারে করোনা ছড়াচ্ছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে আগামী দিনে এক মিলিয়নেরও বেশি কোভিড সম্পর্কিত মৃত্যুর সাক্ষী হতে পারে চীন। একই সময়ে, দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব কাটাতেও সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই বছর ২ দশমিক আট থেকে-৩ দশমিক দুই শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা হবে গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হবে৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরের শেষের দিকে করোনার কারণে কলকারখানা ও ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এত চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
গত নভেম্বরে খুচরা বিক্রি কমেছে ৫ দশমিক নয় শতাংশ। শিল্প ও কলকারখানা থেকে আয় কমেছে ২ দশমিক দুই শতাংশ। আর সম্পদে বিনিয়োগ কমেছে ৫ দশমিক তিন শতাংশ। চীনে বেকারত্বের হার বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যেখানে দেশটির শ্রমের প্রধান শক্তি ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এটি বেড়ে ১৭ দশমিক এক শতাংশে পৌঁছেছে। এ ছাড়া দেশটির আবাসন খাতেও এখন গভীর মন্দা চলছে এবং সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে চীনের সঙ্গে ব্যবসা সম্পর্কযুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতির পরিস্থিতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অন্য দেশগুলোর তুলনায় এসব দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির ঘোড়ায় লাগাম দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। চোখের সামনেই শ্রীলঙ্কা নেপাল এবং পাকিস্তান এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মূল্যস্ফীতির চাপে দেশগুলো দিশেহারা।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৩ সালে জ্বালানি খাত বাদে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। এটি আগের পাঁচ বছরের গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার অতিরিক্ত ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে চলতি বছরেই এরই মধ্যে এ হার গড়ে ২ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে তারা। এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে দ্রুত অর্থনীতি বর্ধনশীল দেশগুলোর জনগণ। যুদ্ধ, বৈরী পররাষ্ট্রনীতি, অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার; এসব বাদ দিয়ে বিশ্বনেতাদের উচিত বৈশ্বিক মন্দা কাটাতে একযোগে কাজ করা। মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত রাষ্ট্রপ্রধানদের। এর সঙ্গে বাড়াতে হবে বিনিয়োগও।
গত ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে নেপালের পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পরে গত রোববার ইয়েতি এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয় অবতরণের কয়েক মিনিট আগে। নিহত হয় বিমানের সব যাত্রী। ফ্লাইটটিতে পাইলট কেবিনক্রু ও যাত্রী মিলিয়ে ৭২ জন ছিলেন। এর আগে গত বছর ২৯ মে পোখরা পুরোনো বিমানবন্দর থেকে জমসম যাওয়ার সময় বিধ্বস্ত হয়েছিল তারা এয়ারের একটি অভ্যন্তরীণ বিমান। নিহত হয়েছিল বিমানের ২২ জন যাত্রী পাইলট ও কেবিন ক্রু। এটিও ছিল ইয়তি এয়ারলাইনসের মালিকানাধীন।
হিমালয় পর্বতমালা বেষ্টিত দেশটিতে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা এটি। অ্যাভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের তথ্যমতে ২০১৮ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশের ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের বিমান বিধ্বস্ত হয় কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে। সে ঘটনায় নিহত হন ৫১ জন। সবচেয়ে খারাপ দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৯২সালে। সেসময়ে কাঠমান্ডুতে অবতরণের ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১৬৭ জন নিহত হন। একই বছর, একই বিমানবন্দরের কাছে থাই এয়ারওয়েজের বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ১১৩ জন যাত্রী মারা গিয়েছিল। ফ্লাইট সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, ১৯৪৬ সাল থেকে নেপালে ৪২টি মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে। আর ২০০০ সাল থেকে দেশে বিমান বা হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ৩৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
আকাশ পরিবহনে দুর্বল নিরাপত্তা নিয়ে অতীতে অনেকবার সমালোচিত হয়েছে নেপাল। সমন্বিত পরিকল্পনা, বিনিয়োগ স্বল্পতা, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলে ঘাটতি এবং বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের বৈরী ভূগঠন এবং বৈরী আবহাওয়া সবকিছু মিলিয়ে দেশটির বিমান চলাচল ব্যবস্থাকে নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। ইয়তি এয়ারলাইনসের পর পর দুটি দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে নেপালে আকাশপথে ভ্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি আবারও বিশ্বের বিমান চলাচল ব্যবস্থার সামনে একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উঠে এল।
নেপালে কেন এমনটা বারবার হচ্ছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমান পরিচালনা ও পরিবহনে যে সব জায়গাগুলোতে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া দরকার সেগুলো উপেক্ষা করে আসছে নেপাল। একই অভিযোগ করেছিল ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও)’রও। তাদের নিরাপত্তা উদ্বেগ উত্থাপনের পরপরই ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সমস্ত নেপালি এয়ারলাইনসগুলোকে দুর্বল সুরক্ষা মানদণ্ডের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের ২৭ টি দেশে ওড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যেটি এখনো বলবৎ রয়েছে। অবশ্য আইসিএও ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নেপালের বিমান চলাচলকে কালো তালিকা থেকে সরিয়ে দিলেও, আইসিএওর দিক নির্দেশনা এখনো পুরোপুরি অনুসরণ করেনি দেশটি। আইসিএওর দেওয়া পরামর্শগুলোর দিকে নজর না দিয়ে নেপাল অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেই বেশি জোর দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বের এয়ার সেফটি বিশেষজ্ঞরা। সদ্যনির্মিত পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছেন তারা। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভস যুক্ত হয়ে নেপাল চীন থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে এই বিমান বন্দরটি বানিয়েছে। আকাশ নিরাপত্তায় পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ না করে পোখরায় পুরোনো বিমান বন্দরের কাছেই পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করেছে। যেটি এখন আর্থিকভাবে লাভজনক হবে কিনা সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন তারা।
যদি পোখরা বিমানবন্দর সময়মতো আর্থিকভাবে লাভ করে ঋণ পরিশোধ না করতে পারে তাহলে এর পরিণতি শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা বন্দরের মতোই হতে পারে বলে তাদের ধারণা। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে পোখরা বিমানবন্দরটি এর আগে চালু হওয়া নেপালের ভৈরহাওয়ার গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো একই পরিণতিতে পড়তে পারে। কারণ বিদেশি এয়ারলাইন কোম্পানিগুলি দুর্গম ও বৈরী পরিবেশ ও অপ্রতুল আকাশ নিরাপত্তার অভিযোগে বিমানবন্দরটি বাতিল করে দিয়েছিল। গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এখন কোনো আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন ফ্লাইট পরিচালনা করে না।পোখারার পুরোনো বিমানবন্দর গত অর্থবছরে ০.৯ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। করোনা সংক্রমণ কমার পর ফ্লাইট যোগ করায় এটাই সর্বোচ্চ আয়। গত ১ জানুয়ারির পর নতুন পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সব অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন বিমান সংস্থা কার্যক্রম শুরু করেনি। নিকট ভবিষ্যতেও যে বিভিন্ন দেশের বিমান পোখরায় কার্যক্রম শুরু করবে তেমন কোন লক্ষণও নেই। নতুন বিমানবন্দর করে যদি আন্তর্জাতিক বিমান পরিচালনা করা না যায় তবে আয় তেমন একটা বাড়ানো সম্ভব হবে না ‘বলেছেন সিভিল অ্যাভিয়েশন অথোরিটি অফ নেপালের (সিএএএন) এর এক কর্মকর্তা। কেননা নেপালে ক্রমান্বয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো এই ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে আন্তর্জাতিক মহলে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন নতুন বিমানবন্দর না বানিয়ে নেপালের আকাশ নিরাপত্তা উন্নয়নের দিকেই বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। ‘যদিও নেপাল সিভিল অ্যাভিয়েশন আকাশ নিরাপত্তা উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবে বাস্তবতা হলো নিরাপত্তা রেকর্ড এখনো অন্য যে কোন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের স্তরে পৌঁছাতে পারেনি’- বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার রয়েল মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি) অধ্যাপক ক্রিস্টাল ঝাং। তিনি মন্তব্য করেন, ‘যদিও নেপালের মনোরম ল্যান্ডস্কেপ পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে কিন্তু, এটি অ্যাভিয়েশন অপারেটরদের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, নেপালে বিমান ভ্রমণ আরও সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিমানবন্দরের পরিকাঠামো উন্নয়ন বিমান চলাচল বাড়ার তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর ফলে বিমানবন্দরে যানজট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকিও বেড়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলো যেতে চাচ্ছে না নেপালে।
পোখরা বিমানবন্দর প্রকল্পের প্রধান বিনিশি মুনাকার্মির দেওয়া তথ্যমতে, ৩০০ মিলিয়ন ডলারের পোখরা বিমানবন্দর প্রকল্পটি চীনের এক্সিম ব্যাংক (এক্সিম) থেকে ঋণ নিয়ে করা হয়েছে। যার মধ্যে ২০৯ মিলিয়ন ডলার সরল সুদে। চুক্তি অনুযায়ী, এই ঋণের ২৫ শতাংশ সুদমুক্ত এবং অবশিষ্ট ঋণ ২ শতাংশ সুদ হারে, যা অন্যান্য বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এক্সিম ছাড়াও, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নের জন্য ওপেক তহবিলও ঋণ ও অনুদানের আকারে বিমানবন্দর প্রকল্পটিকে লগ্নি করেছে।
এটা আনন্দের যে, পোখরা শেষ পর্যন্ত নিজস্ব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুলছে, তবে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে। নেপালকে এ বছর মার্চ মাস থেকে এক্সিম ব্যাংককে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। বিমানবন্দরের তথ্য কর্মকর্তা জ্ঞানেন্দ্র ভুলের তথ্যমতে, পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাওয়া চীনের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড হলো ৭ বছর। এর অর্থ পোখরা বিমানবন্দর নির্মাণকালীন প্রায় সাত বছর ধরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়নি। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে কর্তৃপক্ষকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এবং চুক্তি অনুযায়ী ১৩ বছরের মধ্যে চীনকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।তবে স্থানীয় এক সূত্রমতে, কীভাবে এ ঋণ পরিশোধ করা হবে সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্টতা নেই। আয়ের প্রধান উৎস হল বিমান ল্যান্ডিং চার্জ এবং ভাড়া। কিন্তু প্রত্যাশিত রাজস্ব আয় এই ঋণ পরিশোধের জন্য খুবই অপর্যাপ্ত। সূত্রমতে বিমানবন্দরটি লাভজনক হতে হলে প্রতিবছর ১১দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করতে হবে যা ভীষণরকম উচ্চাভিলাষী। এ প্রসঙ্গে নেপালের সংস্কৃতি, পর্যটন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ বিবি দেওজার মতে, পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম।এ ছাড়া রাজস্ব আয় ও ঋণ পরিশোধের মধ্যে যে ব্যবধান থাকবে সেটি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, কীভাবে ঋণ পরিশোধ করা হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।এ বিষয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী রামেশ্বর খানাল বলেছিলেন যে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নয় বছরে তার খরচ তুলতে সক্ষম হবে। কিন্তু সেই জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বিদেশি পর্যটকদের পোখারায় প্রবেশ করতে হবে। চালু থাকতে হবে অনেক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। কিন্তু নেপালের নাজুক আকাশ নিরাপত্তা সে আশায় গুড়ে বালি দিয়ে যাচ্ছে।
বিমানবন্দরের তথ্য কর্মকর্তা জ্ঞানেন্দ্র ভুলের মতে, পোখরা বিমানবন্দরে ঋণের কিস্তি শোধ দিতে প্রতিদিন কমপক্ষে এক শটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এবং সপ্তাহে কমপক্ষে ৫০টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে। তিনি ধারণা করেন "পোখরা বিমানবন্দর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালিয়েও টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু তার এই প্রত্যাশা বাস্তবতা থেকে অনেক দুরে। যেখানে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পর লাভের মুখ দেখেছিল সেখানে নতুন বিমান বন্দরের ঋণ ১৩ বছরের মধ্যে চীনকে শোধ দেওয়াটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নেপালের পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি লাভজনক করতে ভারতের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া আশা করছে নেপাল কর্তৃপক্ষ। কেননা এমনিতেই ভূগঠন ও ভৌগোলিক দিক দিয়ে আকাশপথে এই বিমানবন্দরটি পরিচালনা ভারতের সমর্থন ছাড়া অনেকটা জটিল হয়ে উঠবে। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে হলেও এই বিমানবন্দরকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। কারণ নেপালের তিন দিক জুড়েই ভারতের অবস্থান। আর উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা। যা উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য বৈরী ।
পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিয়ে ভারত কি ভাবছে? ১ জানুয়ারি বিমানবন্দরটির উদ্বোধনী দিনেই সেখান থেকে উড্ডয়ন হবে এমন এক ফ্লাইটকে ভারত তার মাটিতে নামতে অনুমতি দেয়নি। বুদ্ধ এয়ারের ওই ফ্লাইটটির পোখরা থেকে ভারতের বানারসী যাওয়ার কথা ছিল। যদিও আগে থেকে কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ভারতের বানারসী সহ আরও কয়েকটি এলাকায় বিমান পরিচালনা করে আসছিল বুদ্ধ এয়ার। কিন্তু পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন হওয়ার কথা থাকায় সেটিকে ভারত নিষেধাজ্ঞা দেয়। শুধু বুদ্ধ এয়ার নয়, পোখরা থেকে উড্ডয়ন করা কোন বিমানকে ভারত তার মাটিতে নামতে অনুমতি দেয়নি। এর আগে ভারত নেপালের ইয়েতি গ্রুপ এবং চীনা বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন হিমালয় এয়ারলাইনসকে ভারতে উড়তে দেয়নি।
বিমানবন্দরটিকে বাণিজ্যিকভাবে সফল করতে হলে নেপালকে ভারতীয় এবং চীনা পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। দুই দেশের প্রধান শহরগুলোতে সরাসরি ফ্লাইট স্থাপন করতে হবে। কিন্তু, পোখরা বিমানবন্দর বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়া এখন একটি দূরবর্তী স্বপ্ন। কারণ এখন পর্যন্ত, চীনের তিব্বত এয়ারলাইনস-এর অর্থায়নে পরিচালিত হিমালয় এয়ারলাইনস এবং কুয়েতের জাজিরা এয়ারওয়েজই একমাত্র আন্তর্জাতিক বাহক যারা পোখারায় ফ্লাইট চালু করতে রাজী হয়েছে। আর বিমানবন্দরটিকে আগামী ১৩ বছরের মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে যা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। নতুন বিমানবন্দরে কীভাবে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আন্তঃসংস্থা সমন্বয় ও যোগাযোগের স্পষ্ট অভাব রয়েছে। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী চীন এখনো পোখরা থেকে বিমান পরিচালনার কোন আভাস দেয়নি। ২০২০ সালে বেইজিংয়ের কাছ থেকে ওয়াই-১২ ও এমএ-৬০ সিরিজের ৬টি বিমান কিনেছিল নেপাল এয়ারলাইনস। পরে রক্ষণাবেক্ষণে অতিরিক্ত খরচের কারণে বিমানগুলো আর চালায়নি নেপাল। এখন সেগুলো পড়ে আছে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায় করা এই বিমানবন্দরে ভারত তার বিমান পরিচালনা করবে কিনা তা নেপাল কর্তৃপক্ষ এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি।
পোখরা বিমানবন্দটি সহজ ও আর্থিকভাবে সফল হওয়ার জন্য ভৈরহওয়া, নেপালগঞ্জ ও মহেন্দ্রনগর রুট দিয়ে নেপালে বিমান প্রবেশ করাটা জরুরি। কিন্তু এই রুটের বাইরেই ভারতের আকাশসীমা। এই রুটটি দিয়ে ভারত সরকার নেপালে বিমান প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। এর ফলে ভৈরহাওয়া এবং পোখরা বিমানবন্দরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সংস্কৃতি, পর্যটন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বুদ্ধি সাগর লামিছনে বলেছেন, বর্তমানে, ভারত নেপালের মহেন্দ্রনগর, নেপালগঞ্জ, ভৈরহাওয়া, বিরাটনগর এবং জনকপুর আকাশপথে নেপাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেও আকাশ পথে প্রবেশের বেলায় শুধু সিমারা রুটটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। সিমারা নেপালের দক্ষিণ দিকে বিহারে ওপর দিয়েই ৭০ ভাগ বিমান নেপালে প্রবেশ করে। গৌতম বুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রধান, গোবিন্দ দাহল বলেছেন যে পশ্চিম নেপালে এয়ার এন্ট্রি পয়েন্ট রুটগুলি পোখরা বিমানবন্দরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লামিচানের মতে ৬০ থেকে ৭০ভাগ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নেপালে প্রবেশের জন্য পশ্চিম রুট ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু, ভারত অনুমতি না দেওয়ায় ওই ৭০ ভাগ বিমানকে ঘুর পথে অনেকক্ষণ উড়ে দক্ষিণে সিমারার ওপর দিয়ে নেপালে প্রবেশ করতে হয়। এর বাইরে অল্প কিছু বিমান ভুটান থেকে পূর্বে ঝাপা হয়ে নেপালে প্রবেশ করে এবং লাসা থেকে আসা বিমানগুলি নুনিম পয়েন্ট হয়ে নেপালে প্রবেশ করে। এসব কৌশলগত কারণে পোখরার এই নতুন বিমানবন্দরটি আর্থিকভাবে লাভজনক হওয়া ভারতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
প্লেনবিহীন একটি বিমানবন্দর, একটি ঘূর্ণমান রেস্তোরাঁ যেখানে কোনো খাবার নেই, একটি ঋণ বোঝাই সমুদ্রবন্দর –২০১৭ সালে নভেম্বর মাসে এ রকমটাই দেখতে ছিল ২০০৮ সালে চালু হওয়া শ্রীলঙ্কার উচ্চাভিলাষী হামবানটোটা বন্দর। পোখরায় লগ্নি করা চীনের সেই এক্সিম ব্যাংক থেকেই তখন ঋণ নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। পরবর্তীতে প্রকল্পটি আর্থিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় চীনের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। যে কারণে বন্দরটিকে নয় বছরের মধ্যে ২০১৭ সালে ৯০ বছরের ইজারায় চীনের কাছে ছেড়ে দিতে হয়েছে। এই চুক্তির ফলে বেইজিং ভারত মহাসাগরে একটি কৌশলগত অঞ্চলে তাদের অবস্থান সুসংহত করলেও এর নেতিবাচক পরিণতির শিকার হতে হয়েছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণকে। চীনের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর কারণে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে। জনজীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ যা এখনো চলমান।
ভারতীয় উপমহাদেশের দুই প্রান্তে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। কিন্তু, তারা একই রকম অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সংগ্রাম করছে। যদিও উভয় দেশের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। কিন্তু দুটো দেশই চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পর্যটন খাতে ধস উভয় দেশকেই সংকটের অতল খাঁদের দিকে নিয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে চরম মূল্য দেওয়া শুরু করেছে। একইভাবে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যদি আর্থিকভাবে লাভবান না হয় এবং সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করতে পারে তাহলে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেও হাম্মান টোটার মত পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। যা নেপালের নাজুক অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর করে তুলবে। আর এর পরবর্তী প্রেক্ষাপট উপমহাদেশের ভূ রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
শেখ কামালকে আমাদের প্রজন্ম খুব ভালোভাবে জানে না। চেনেও না অনেকে। আমাদের থেকে বয়সে অন্তত ৪/৫ বছরের বড় যারা তারাও শেখ কামাল সম্পর্কে সঠিক সুস্পষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারে না। তবে ক্রীড়া সংগঠন ‘আবাহনী’ নাম দিয়েই শেখ কামালকে চেনার জানার বোঝার অনেকটাই সহজ। ঢাকার অভিজাত পাড়া হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এই আবাহনী ক্লাব। স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত বাংলাদেশে এ রকম একটি আধুনিক ক্লাব ঘর নির্মাণের মাধ্যমে শেখ কামালের আধুনিক ক্রীড়া মনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। ৪৭ বছর আগে লাল সিরামিকের ইটের তৈরি সুন্দর নজরকাড়া এক ভবন।
মাত্র ২৬ বছর বয়সেই তিনি সপরিবারে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন তার ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে। স্বাধীনতার ঘোষক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে ছিলেন শেখ কামাল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আধুনিক একটি ক্লাব নির্মাণ করেছেন। সেই ক্লাবের জন্য ইংল্যান্ড থেকে ফুটবল কোচ এনে প্রথম আধুনিক ফুটবলের ধারণা প্রবর্তন করেছেন বাংলাদেশে। সাংগঠনিক সক্ষমতা দিয়ে ওই ক্লাবকে জনপ্রিয় করারও অনেক কৌশল করেছিলেন তিনি। কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন শেখ কামাল দেখতে কেমন ছিলেন তার দূরদর্শিতা কেমন সৃজনশীলতায় তিনি কতটা এগিয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের যেতে হবে তার সহকর্মী তার সহপাঠী এবং ওই সময় তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠজনদের কাছে।
চট্টগ্রামে বসে শেখ কামাল সম্পর্কে সবকিছু জানা একটু কঠিনই বটে। তারপরও আবাহনী ক্লাবের খেলা ও কার্যক্রম দেখে আমরা তার গুণের কিছুটা ছোঁয়া পাই।
আমি তখন স্কুলে পড়ি। চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতাম নিয়মিত। আশির দশকে এই স্টেডিয়ামে উপচেপড়া দর্শকদের ভিড় দেখা গেছে। চট্টগ্রামে তখনো আবাহনী নামে কোনো ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে মোহামেডান ক্লাব ছিল। সেই ক্লাব বরাবরই চট্টগ্রামে শীর্ষস্থানীয় দল। চট্টগ্রামে মোহামেডানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত স্টিল মিল, ওয়াপদা মানে পিডিবি, কাস্টমস, রেলওয়ের মতো শক্তিশালী দলগুলো। মোহামেডান বাদে বাকি ক্লাবগুলোতে খেলতে আসত ঢাকা আবাহনীর সালাউদ্দিন, চুন্নু, অমলেশ, নান্নু, টুটুল। সেকি উত্তেজনা। এসব খেলোয়াড়ের সেই কি স্টাইল! তাদের খেলার স্টাইল দেখার জন্য গ্যালারি উপচেপড়া দর্শকেরা এসে বসতেন মাঠের সাইড লাইনের পাশেও। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে খেলা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত শেষ হতে পারেনি।
বাংলাদেশের বর্তমানে মৃতপ্রায় ফুটবলের অবস্থা চিন্তা করলে আর আশির দশকের সেই সব দৃশ্য মনে ভেসে উঠলে সত্যিই দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে হয়। আমাদের ফুটবল আসলেই এত গৌরবময় ছিল? হ্যাঁ ছিলই। আর এখানেই শেখ কামালের নামটা অবধারিতভাবে চলে আসে। তিনি একটি আধুনিক ক্লাবের জন্ম দিয়েছেন একই সঙ্গে বেশ কিছু ফুটবলারকে স্মার্ট বানিয়েছেন।
শেখ কামালকে নিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা কিংবা অনুসন্ধানী রিপোর্ট হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সামান্য কিছু কাজ হয়েছে হয়তো। চট্টগ্রামেরই ছেলে ক্রীড়া সাংবাদিক সনৎ বাবলা লিখেছেন, ‘শেখ কামাল: ক্রীড়াঙ্গনের ধূমকেতু’ নামে একটি বই যেটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে। অর্থাৎ শেখ কামাল মারা যাওয়ার প্রায় ৪৫ বছর পর। শেখ কামাল একাধারে ক্রিকেটার, খেলতেন বাস্কেটবল, ক্রীড়া সংগঠক, রাষ্ট্রপতির ছেলে - এরকম নানামুখী পরিচয় ছাপিয়ে তিনি ক্রীড়া সংগঠকের পরিচয়ে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল।
সনৎ বাবলার বইতে তিনি শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, একবার এক বড় ব্যবসায়ী এসে তাকে অর্থাৎ শেখ কামালকে একটি চেক দিয়ে যায়। চেক হাতে তুলে দিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, আপনি ক্লাব চালান, ক্লাব চালাতে অনেক টাকা লাগে তাই দিলাম। চেকটি নিজের কাছে রেখেছেন ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই জানতে পারেন যে ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক সুনাম নিয়ে প্রশ্ন আছে। পরদিন শেখ কামাল ওই ব্যবসায়ীকে তার চেক ফেরত দিয়ে দেন।
স্বাধীনতার পরে আবাহনী ক্লাব যখন সংগঠিত হতে থাকে তখন মাঠে নামার সময় দর্শকেরা তাদের ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে চিৎকার করত। এমনকি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করার ঘটনাও ঘটেছে। সমর্থক ছিল না। প্রতিকূল অবস্থা। সেটি সামাল দেওয়ার জন্য অদ্ভুত এক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন শেখ কামাল। বাস্কেটবল খেলার জন্য তখনকার সবচেয়ে নামী দল ওয়ান্ডারার্স এক বাস্কেটবল প্লেয়ারের কাছে গিয়েছিলেন। তার নাম এ কে সরকার। তিনি জাতীয় দলের খেলোয়াড়। শেখ কামাল ওয়ান্ডারার্সে খেলতে আসবেন শুনে কিছুটা বিব্রত ক্লাবের সবাই। তখন ওই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন বীর বিক্রম কাজী কামাল উদ্দিন। শেখ কামাল তার কাছেও গিয়েছিলেন তাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। কৌতূহলী বাস্কেটবল খেলোয়াড় এ কে সরকার একদিন শেখ কামালকে জিজ্ঞেস করে বসলেন কেন আপনি রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়ে ওয়ান্ডারার্সে খেলতে আসলেন। জবাবে শেখ কামাল বলেছিলেন পরে বলব। ঠিকই এক বছর পর শেখ কামাল এ কে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কেন ওয়ান্ডারার্সে বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছিলেন। মূলত ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের তখন প্রচুর সমর্থক ছিল। বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে শেখ কামালের দল আবাহনী কিছুটা সমর্থন পাবে এই ভরসায় তিনি বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছিলেন ওয়ান্ডারার্সে। কতটা মিশনারি হলে কতটা দূরদর্শী হলে একজন মানুষ এভাবে চিন্তা করতে পারে।
আবাহনী ক্লাবকে একটি আধুনিক ক্লাবে পরিণত করতে হবে এর জন্য দরকার প্রচুর টাকা। রাজাকার আলবদররাও ক্লাব গড়বার জন্য টাকা দিতে চেয়েছিল। সে টাকা তিনি গ্রহণ করেননি। টাকা কোত্থেকে আসবে সেই পরিকল্পনাও শেখ কামাল করে রেখেছিলেন। শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নামকরা সার্কাস দলের চৌকস সদস্যদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। সেখান থেকে টাকা সংগ্রহ করেই একটি আধুনিক ক্লাব বানানোর কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সার্কাস শো থেকে তখন আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৪৪ টাকা।
এই ক্লাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবাহনীতে দীর্ঘদিন ধরে খেলে আসা চট্টগ্রামের ছেলে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আশীষ ভদ্র বলেন, আবাহনী এমন একটি ক্লাব যেখানে তখনকার সময়ের সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থাপনা ছিল প্লেয়ারদের জন্য। হাই কমোডের এসি বেডরুম, টয়লেট, কিচেন-ডাইনিং রুম সবকিছুই আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। তখনকার বিখ্যাত সব ক্রিকেটার ও ফুটবলার সবাই ক্লাবের ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভূত হয়ে যেতেন। ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার অরুণ লাল শ্রীলঙ্কার সামারা শেখেরা শ্রীলঙ্কার ফুটবলার পাকির আলীর মতো খেলোয়াড়রা এই ক্লাবে অবস্থান করে এর আধুনিক ব্যবস্থাপনা দেখে প্রশংসা করেছেন। ক্লাবের জার্সি নিয়ে আসা হতো সুদূর ইংল্যান্ড থেকে, মোজাও বাদ যেত না। চিন্তা চেতনায় শেখ কামাল এতটাই আধুনিক আর বিনয়ী ছিলেন যে, ক্লাব বয় যারা ছিলেন তাদের তিনি ‘আপনি’ করেই সম্বোধন করতেন। সবাইকে সুন্দর ড্রেস পরে ফিটফাট থাকার জন্য পরামর্শ দিতেন।তখনকার সময় একজন ফুটবলার কিংবা ক্রিকেটের এর কাছে একটি মোটরসাইকেল স্বপ্নের মতই ছিল। ১৯৭৫ সালে মারা যাওয়ার আগে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধিদপ্তরে যেসব মোটরসাইকেল দেওয়া হতো সেখান থেকে কম নামে ৯টি মোটরসাইকেল কেনার জন্য ৭৫ হাজার টাকা একটি ফান্ড দিয়ে রেখেছিলেন ক্লাবের তৎকালীন ম্যানেজারের কাছে। ৯ জন নামী ফুটবলারকে চুক্তিবদ্ধ করার জন্য এই ফান্ড জোগাড় করে রাখার কথা জানতেন না সেই সময়ের ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদও। ২৬ বছর বয়সী এক যুবকের চিন্তার জগৎ কতটা বিস্তৃত আর বুদ্ধি কৌশলের দিক থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন তিনি তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায়। ভাবা যায়!
এমন প্রশ্ন কেউ তোলেন যে নৃশংসভাবে যদি সপরিবারে শেখ কামাল মারা না যেতেন তাহলে কি হতো বা কি হতে পারত? বাংলাদেশের একজন নামকরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিচিত আশীষ ভদ্র। তিনি বললেন যে, ফুটবল বাংলাদেশ কোন অবস্থানে পৌঁছাতো সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলায় বাংলাদেশ এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যেত এত দিনে। কারণ তার ভেতরে যে দূরদর্শিতা ছিল অর্থাৎ শেখ শেখ কামালের ভেতরে যে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল তার সবকিছুই তিনি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রকাশ করে দেখিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন। তার কল্পনা শক্তি ছিল অসাধারণ।
ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়েই শেষ করব এই লেখা। শেখ কামাল মারা যাওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবাহনী ক্লাব বেশ দুঃসময়ে ছিল। সেই দুঃসময় ক্লাবকে সুসংগঠিত করার কাজে নিবেদিত ছিলেন বেশ কয়েকজন। এঁদেরই একজন হারুনুর রশিদ। শেখ কামাল বেঁচে থাকা অবস্থায় ক্লাবের আর্থিক টানাপোড়েনের সময় হারুনুর রশিদ রাগ করে ক্লাবে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বেশ কয়েক দিন তিনি আসেননি। তখন হারুনুর রশিদকে খুঁজবার জন্য শেখ কামাল তার বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাজির হলেন এবং সেখানে গিয়ে তার ভাবিকে মজা করে বললেন যে, ‘নোয়াখাইল্লাটা’ কই? (হারুনুর রশিদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়, এটি তখন নোয়াখালী ছিল) আর সেই ঘরে বসেই গলায় সুর তুললেন এই গান দিয়ে, ‘ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে’। মান ভাঙিয়ে হারুনুর রশিদকে আবার সঙ্গে নিয়ে ক্লাবে আসেন শেখ কামাল।
ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, সংস্কৃতিমনা, রসবোধসম্পন্ন এই মানুষটিকে আমরা আর কখনোই পাব না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে শেখ কামাল থাকবে চিরঞ্জীব হয়ে। ৫০ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের দশ লাইনের সংক্ষিপ্ত ক্রীড়া ইতিহাস যদি লিখতে হয় সেখানে যৌক্তিকভাবে দুটি লাইন বরাদ্দ রাখতে হবে শেখ কামালের আধুনিক ক্রীড়া ভাবনার জন্য। তাঁকে স্মরণ করার জন্য ‘শেখ কামাল দ্বিতীয় বাংলাদেশ যুব গেমস’ এর যারা উদ্যোক্তা তাদের জন্য এক পঙ্ক্তি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
লেখক: রফিকুল বাহার, আবাসিক সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন, চট্টগ্রাম।
বাউল শব্দের উৎসভূমি পারস্যে। মরুভূমিতে এখানে-সেখানে বিচরণকারী সংসারত্যাগী একশ্রেণির সংগীতাশ্রয়ী সুফি সাধক আল অথবা বউল নামে পরিচিত ছিল। এরা অধ্যাত্মবাদী এবং এদের সাধন পদ্ধতি ছিল গুপ্ত ও যৌনাচারভিত্তিক। আমাদের আলোচ্য বাউল সম্প্রদায় পারস্যের এই আল বা বউল সম্প্রদায়ের উত্তরসূরি। বাউল শব্দের বাংলায় প্রথম ব্যবহার বিষয়েও আমার ভিন্ন মত রয়েছে, চতুর্দশ শতকে শাহ মুহাম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই ধর্মীয় সাধকদের বাউল এবং বাউর নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাউল শব্দের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস যাই হোক সবক্ষেত্রেই এটা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ ব্যাপারে কারও কোন দ্বিমত নেই বলে আমি মনে করছি। অর্থাৎ বাউল বলতে এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টিকে বোঝায় সমাজের চোখে যারা অত্যন্ত নিচ, নিঃস্ব এবং পাগল। তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, বিষয় সম্পত্তি বা সামাজিক প্রতিপত্তি বলতে কোন কিছুই নেই। তাদের কোন স্থায়ী বসতবাড়ি নেই। তারা এক স্থান হতে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং পরান্নে জীবনধারণ করে বেঁচে থাকে। বাউল যে সমাজেরই হোক তার বৈশিষ্ট্য, জীবনযাপন প্রণালি, সমাজে তার সামাজিক অবস্থান একই।
একটা জাতি হিসেবে মননশীল বিষয়সমূহে আগ্রহ ও শৈল্পিক দিকে ঝোঁক কিংবা দর্শনের ক্ষেত্রে আমাদের বাঙালিদের অবদান অতি যৎসামান্য নয়। লালন ফকির ও তার দর্শন এই ক্ষেত্রে এক মস্ত বড় মাইল ফলক এবং স্তম্ভ বলে মনে করি। লালন ফকিরের প্রকৃত নাম ললিত নারায়ণ কর, ডাকনাম লালু। পিতা নাম ছিল মাধব কর, মাতা পদ্মাবতী। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই লালন ফকির দার্শনিক জিজ্ঞাসার কিছু মূল মূল প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কীভাবে সৃষ্টি হলো ? ঈশ্বর কে ? আমি কে ? স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক কি ? অস্তিত্ববাদী ও সৃষ্টির রহস্য সংক্রান্ত এসব প্রশ্ন তোলা, এবং যেভাবে লালন ফকির এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছেন, তা আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসে ব্যতিক্রমী। অতলান্ত গভীরতা, শৈল্পিক সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক সূক্ষ্মতা নিয়ে লালন ফকির ছিলেন সবচেয়ে প্রতিভাবান এবং শীর্ষ এক মহামানবীয় ব্যক্তিত্ব।
বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ বাঙালি সংস্কৃতির এক মহান প্রতিনিধি। বাংলা সংস্কৃতির মূল ধারা লোকসংস্কৃতি। এই ধারাকে যারা পুষ্ট করেছে ফকির লালন তাদেরই একজন। সম্প্রদায় সম্প্রীতি ও ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ফকিরিবাদ বাউলতত্ত্ব মানুষের প্রধান দর্শন। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ বাঙালি সংস্কৃতির এক মহান প্রতিনিধি। লালন ফকির গানে ও সাধনায় তার দর্শনে সেই মানবিক মূল্যবোধে সেই সামাজিক চেতনায় গভীর, লালন ফকির একই সঙ্গে মরমি এবং দ্রোহী, তার গানের ভেতর দিয়ে বাউল সাধনার নানা প্রসঙ্গ অনুসৃত হয়েছে। তার গানের ভেতর দিয়ে সমাজের অসংগতি, কুপ্রথা সকল জাতপাতের ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
তাঁর গানগুলোর মধ্যে আছে দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, ভক্তিতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব, আছে মোহাম্মদ, কৃষ্ণ, যিশু, বেদ, কোরআন, বাইবেল প্রভৃতি বিষয়কে নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত জিজ্ঞাসা, মতামত, উত্তর এবং নির্দেশনা। এ সংগীতনির্ভর চিরন্তন দর্শনই ললিত নারায়ণ কর থেকে মহাত্মা লালন ফকিরে উন্নীত করেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে সুফিবাদী দর্শনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছেন লালন। লালন দর্শনের মূল কথা হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার ওপর মানুষ; এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যিনি স্রষ্টা তিনি বিরাজ করেন মানুষেরই অন্তরে। তাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-কালো-সাদা বৈচিত্র্যে মানুষকে আলাদা না করে মানুষে মানুষে প্রেম ও ভালোবাসার মাধ্যমেই পরম আরাধ্য স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব।
তাঁর বিশ্বাস ছিল মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-জৈন প্রভৃতি আকৃতিতে বিচার করলে সমাজে শান্তি কখনোই আসবে না। শুধু তাঁরই নয়, আধুনিক সভ্যতার সকলেরই বিশ্বাস যে, মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করে ভালোবাসার মধ্যেই বিশ্ব শান্তি নিহিত। তাই প্রায় দেড় শতাব্দী পূর্বে লালন যে ভাব-চিন্তার পত্তন করে গেছেন তা আজও পৃথিবীর প্রেমিক, ভাবুক, রসিক, শিক্ষিত, বিদ্বৎ সমাজকে প্রাণিত করছে এবং করে যাবে আরও সুদীর্ঘকাল। কারণ, হিংসা-বিদ্বেষ-বিভেদমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র তথা পৃথিবী বিনির্মাণে লালন দর্শন এক অনন্য আলোকবর্তিকা।
কে বলে মানুষ মরে/ ও মানুষ মরলে পরে বিচার হবে কার/ আমি বুঝলামনা ব্যাপার/ কে বলে মানুষ মরে...। গানের কলিটা কানে আসলেই কিংবা এ রকম শিরোনাম কোথাও চোখে পড়লেই এক বিশুদ্ধ অনুভূতিতে আধ্যাত্মিক চিন্তায় ও প্রেমে মানুষের হৃদয় পুলকিত হয়। এ রকমের মানুষের মনকে শীতল করার মতো জাগিয়ে তোলার মতো, অনুভূতি প্রবণ করার মতো, দশ হাজারেরও বেশি গান রচনা করে গেছেন মহাত্মা লালন ফকির ১৭৭৪ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত।
লালন পুরোদস্তুর সংসারী লোক ছিলেন। তাঁর পানের বরজ, আমের বাগান, বসতবাড়ি, নগদ টাকা, স্ত্রী, সন্তান (পালক কন্যা) এবং চলাচলের বাহন হিসেবে দুটি ঘোড়া ছিল। সমাজে লালন শাহের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি প্রায় মধ্যবিত্ত পর্যায়ের ছিল। গবেষণার ফলে বেরিয়ে এসেছে লালন ফকির নামটা শুনেই হয়তো অনেকে মনে করে লালন বিষয়হীন ফকির ছিলেন, কিন্তু মোটেও এমনটা নয়, লালন সংসারী ছিলেন। মৃত্যুকালে লালন ফকির প্রায় ২ হাজার নগদ টাকা রেখে গিয়েছিলেন। লালন সাঁই তাঁর পালক পিতা মওলানা মলম শাহ সূত্রে পাঁচ একর বসতবাড়ির ভিটা লাভ করেন, যেখানে লালন শাহ তাঁর আখড়াবাড়ি স্থাপন করেন এবং বর্তমানে যেখানে তাঁর মাজার অবস্থিত। এ ছাড়াও তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পাঁচ বিঘা জমি কিনেছিলেন। ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে শৈলকুপা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে লালন শাহের অনুকূলে দুটি দলিল সম্পাদিত হয়। যাতে তাঁকে মান্যবান ও সম্ভ্রান্ত মনুষ্য বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশিষ্ট লালন গবেষক মুহম্মদ আবু তালিবের নিকট দলিল দুটির নকল কপি রক্ষিত আছে। তাঁর ঘরবাড়ির অবস্থাও গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো ছিল। লালন শাহ সমাজে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সমাজের অনেক গণ্যমান্য ও জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল এবং তারা লালন শাহের সঙ্গে মতবিনিময় করে নিজেদের উৎকর্ষিত করে তুলেছেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন ভারতের ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা ও বিশিষ্ট পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি তার জমিদারিতে লালন ফকিরকে ডেকে নিয়ে ধর্মালাপে তৃপ্ত হতেন। এ প্রসঙ্গে মো. সোলাইমান আলী সরকার তার লালন শাহের মরমি দর্শন বইতে উল্লেখ করেছেন, বঙ্গের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এমনকি ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা, সমাজসংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক, রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁকে নিমন্ত্রণ করে শিলাইদহে নৌকায় নিয়ে ধর্মালাপে পরিতৃপ্ত হন।
ফকির লালনের ধর্মজীবন বিলক্ষণ উন্নত ছিল। মিথ্যা জুয়াচুরিকে লালন ফকির বড়ই ঘৃণা করতেন । লালন শাহের গানেও মিথ্যা ও জুয়াচুরি এবং পর রমণীর প্রতি লোভকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে বলে মনে করি। লালন বলেন, সত্য বল, সুপথে চল ওরে আমার মন/সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন/পরের দ্রব্য পরের নারী/হরণ করো না পারে যেতে পারবা না/যতবার করিবে হরণ/ততবারই হবে জনম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনকে শুধু কবি বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি লালনের কবিতাকে (গান) বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলির কবিতার সমতুল্য বলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি লালনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁকে উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, The village poet evidently agrees with our sage of Upaneshad who says that our mind comes back baffled in its attempt to reach the unknown Being; and yet this poet like the ancient sage does not give up adventure of the infinite thus implying that there is a way to its realisation. (লোককবি লালন-তপন কুমার বিশ্বাস; পৃ:-৪৮)। লালন দর্শনে বিমোহিত কবিগুরু তাই বলছেন-লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
অনেক সাধক সাধনার নামে ঘর ছেড়ে সংসারত্যাগী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। লালন তাদের উদ্দেশ করে বলেন, ঘরে কি হয় না ফকিরী/কেন রে নিমাই হলি দেশান্তরি/বলে এই কথা কান্দে শচী মাতা/লালন বলে লীলের বলিহারি। সাধন-ভজনের পথে অনেকে নারীকে বাধা মনে করে নারীসঙ্গ ত্যাগ করার পক্ষপাতী হয়েও সংসার বিবাগী হয়। তাদের উদ্দেশ করে লালনের প্রতিবাদ, কেউ নারী ছেড়ে জঙ্গলে যায়/স্বপ্নদোষ কি হয় না সেথায়/আপন মনের বাঘে যারে খায়/কে ঠেকায় রে। সুতরাং লালন ব্যক্তি জীবনে ও আদর্শগতভাবে কোন প্রকারেই সংসার বিবাগী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না; বরং তিনি একজন সচেতন সমাজকর্মী ছিলেন। সমাজের উন্নয়নের জন্য, সমাজের মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তাই তাঁর দর্শন জুড়ে কেবলই মানুষের জয়গান, মানবমুক্তির আকুতি। তিনি এই মানুষের বাইরে আর কিছুই বুঝতেন না। তাঁর ধর্মকর্ম, ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল মানুষকেন্দ্রিক। তাঁর মতে ঈশ্বর যদি থেকেই থাকে তবে এই মানুষের মধ্যেই আছে। তাই লালন বলেন, এই মানুষে আছেরে মন/যারে বলে মানুষ রতন।
তিনি যেমন একজন দায়িত্বশীল স্বামী ছিলেন, তেমনি একজন স্নেহপরায়ণ বাবা ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির কিছু অংশ তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকার (পালক কন্যা) পেরিন্নেসার নামে উইল করে যান। এ তো গেল তাঁর সাংসারিক দায়বদ্ধতার কথা।
একজন তীক্ষ্ণ সমাজসচেতন সামাজিক আন্দোলনের প্রতিবাদী নেতাও ছিলেন তিনি। সমাজে কোথাও কারও দ্বারা কোন অন্যায় সংঘটিত হলে লালন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ভাবশিষ্য ও কাঙাল হরিনাথকে বাঁচানোর কথা তো এখন ইতিহাস। এমন সমাজসচেতন, সংসারী, সামাজিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি যাঁকে বিনা দ্বিধায় সমাজসংস্কারক বলা যায়, যাঁর সামাজিক আন্দোলন সমাজে এক অপরিহার্য প্রভাব বিস্তার করে সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
আমার জানামতে লালনকে প্রথমবারের মতো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা সংবাদপত্রের সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ। ১৮৭২ সালের আগস্ট মাসে তার সাপ্তাহিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় জাতি নামক এক নিবন্ধে লালন এবং তাঁর প্রচারিত ধর্মমতের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে এভাবেই উল্লেখ করা হয়, লালন শা নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা মাসিক পত্রিকায় ইহার বিশেষ বিবরণ প্রকাশ করিব। ৩/৪ বৎসরের মধ্যে এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে। (যুক্তবঙ্গে লালন চর্চার ক্রমবিকাশ; সৈয়দ মনসুর আহমদ; পৃঃ-৩৩)। কাঙাল হরিনাথের এই বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, লালন তৎকালীন ঘুণেধরা সমাজকাঠামোতে জোর ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তৎকালীন সমাজব্যবস্থা স্বভাবতই লালনের এই সামাজিক আন্দোলন দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। সামাজিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে তৎকালীন সমাজে লালন শাহের একটি অপরিহার্য অবস্থান তৈরি হয়েছিল। লালন প্রভাব তাই ঘুণেধরা সমাজের মৌলবাদী সমাজপতিদের শঙ্কিত করে তুলেছিল।
লালন চর্চার ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর লালন সাঁইজির দেহত্যাগের ১৪ দিন পর মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায়। বর্ণিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক ও এজেন্ট রাইচরণ দাস (মতান্তরে বিশ্বাস) মহাত্মা লালন ফকির নামে এক নিবন্ধে লালন সাঁইজির জীবন ও কর্মের ওপর আলোকপাত করেন। উক্ত নিবন্ধে তিনি লালন সম্পর্কে আমাদের জানান, লালন ফকিরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকি নাই। শুধু এ অঞ্চল কেন, পূর্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রঙ্গপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেকদূর পর্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকিরের শিষ্য। ইহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি। (লোককবি লালন- তপন কুমার বিশ্বাস; পৃঃ-১৩৬)। এরপর লালনের সামাজিক অবস্থান ও সমাজে তাঁর ব্যক্তি প্রভাব এবং সামাজিক প্রতিপত্তি নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। লালন শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিরলস যে সাধনা করে গেছেন তার নিদর্শন হাজারো গানের মধ্যে নিহিত আছে। আমাদের সমাজে উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, নমশূদ্র, সিয়া-সুন্নি প্রভৃতির মধ্যে যে বিভেদ তা দেখে তিনি বলেছেন- জাত গেল জাত গেল বলে/একী আজব কারখানা/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তানা নানা। অন্য আর একটি গানে বলছেন- কেউ মালা কেউ তজবী গলায়/তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়/ যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/ জাতের চিহ্ন রয় কার রে। বহুল পরিচিত জাত বিষয়ক আরেকটি গানে লালন বলছেন- গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়/ লালন বলে জাত কারে কয়/ এ ভ্রম তো গেল না। লালন বলেছেন দিব্যজ্ঞানী না হলে কেউ তার স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যকভাবে জানতে পারে না। মানুষ ভজনা ও মানবসেবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে দিব্যজ্ঞান। কারণ, নিরাকার বিধাতাই যে মানুষের মাঝে সাকার হয়ে ধরা দেয় সাঁইজি তা তুলে ধরলেন এভাবে- সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার/মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/নদী কিংবা বিল বাঁওড় খাল/সর্বস্থলে একই একজন/দিব্যজ্ঞানী হয় তবে জানতে পায়/কলিযুগে হলেন মানুষ অবতার। লালনের এ গান যেন এক অসীম শক্তির আধার, যার কেন্দ্রে আছে শুধুই মানুষ। মানবতাবোধ যার একমাত্র উপজীব্য।
পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতিতে লালনের দর্শন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। ভেদাভেদ নয়, অভেদ দর্শনই পারে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে শান্তিময় পৃথিবী বিনির্মাণ করতে, সেটাই লালন ফকিরের গানে ও বাণীতে ফুটে উঠেছে। তাই নিঃসন্দেহে উচ্চারণ করা যায় শৈল্পিক সৌন্দর্য ও মানবতাবাদে লালন ফকির জ্বলন্ত আলোক শিখ।
লেখক: কবি ও গবেষক
যশরাজ ফিল্মসের হাত ধরে বড় পর্দায় শাহরুখ খানের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী বলিউড। তার 'পাঠান' বক্স অফিসে নজির গড়ছে। ভারতীয় ছবির সাফল্য পাড়ি দিয়েছে আমেরিকাতেও।
৪ বছর পর বড় পর্দায় ফিরেছেন শাহরুখ। 'পাঠান'-এ তার অ্যাকশন দেখতে দলে দলে হলে যাচ্ছেন অনুরাগীরা। মুক্তির পর প্রথম কয়েক দিনেই বিপুল টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে এই ছবি। গড়েছে একাধিক নজির। গত বুধবার, ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পায় 'পাঠান'। রবিবার পঞ্চম দিনে ছবিটি বিশ্বজুড়ে ৫০০ কোটির বেশি টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে দাবি, পঞ্চম দিনের শেষে 'পাঠান'-এর আয় সাড়ে ৫০০ কোটি। মুক্তির প্রথম ৪ দিনই দেশের বাজারে হাফ সেঞ্চুরি করেছিল 'পাঠান'। রবিবারও তার অন্যথা হয়নি। ৫০ কোটির গণ্ডি পেরিয়ে এই ছবি রবিবার দেশে প্রায় ৭০ কোটি টাকার ব্যবসা করে। ভারতে এখন পর্যন্ত 'পাঠান'-এর মোট আয় ২৮২ কোটি টাকা। শনি ও রবিবার সপ্তাহান্তেই আরও বেশি করে এই ছবি দেখতে হলে যান মানুষ। চতুর্থ দিনে দেশের বক্স অফিসে শাহরুখের ছবির আয় ছিল ৫১ কোটি টাকা। সারা বিশ্বে এ ছবির মোট রোজগার শনিবার পর্যন্ত ছিল ৪২৯ কোটি টাকা। রবিবার এক লাফে ৫০০ কোটির গণ্ডি ছাড়িয়েছে 'পাঠান'।
দেশের বাইরে 'পাঠান' মোট ১০০টি দেশে মুক্তি পেয়েছে। বিদেশে ২৫০০টি পর্দায় এই ছবি দেখানো হচ্ছে। ভারতে এই ছবি চলছে সাড়ে ৫ হাজার পর্দায়। শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ৬৯৪টি সিনেমা হলে 'পাঠান' মুক্তি পেয়েছে। সেখানে রমরমিয়ে চলছে শাহরুখ, দীপিকা পাডুকোন এবং জন আব্রাহাম অভিনীত ছবিটি। নজির গড়েছে। উত্তর আমেরিকার বক্স অফিসে হিন্দি ছবি হিসাবে 'পাঠান'-এর প্রথম দিনের আয় সর্বোচ্চ। ছবিটি মুক্তির দিন ১৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১৫ কোটি টাকা) আয় করেছে আমেরিকায়। উত্তর আমেরিকার ৬৯৪টি সিনেমা হলে সাম্প্রতিককালে মুক্তিপ্রাপ্ত যেকোনো ছবির তুলনায় 'পাঠান'-এর গড় সবচেয়ে বেশি।
আয়ের গড় হিসাবে হলিউডকেও টেক্কা দিচ্ছেন শাহরুখ। এই নিরিখে হলিউডের ৩টি ছবি কেবল 'পাঠান'-এর সামনে রয়েছে। সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সেরা গড়ের তালিকায় তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্থানে শেষ করতে পারে 'পাঠান'। তালিকায় 'পাঠান'-এর আগে রয়েছে 'অ্যাভাটার : দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’, 'পুস ইন দ্য বুটস : দ্য লাস্ট উইশ' এবং 'এ ম্যান কলড ওটো'।
কাস্টমস লাইসেন্সিং বিধিমালা বাতিলের দাবিতে আজ থেকে দুই দিন দেশের সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন।
রোববার (২৯ জানুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. সুলতান হোসেন খান।
লিখিত বক্তব্যে সুলতান হোসেন খান জানান, কাস্টমস এজেন্টস লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০১৬ তে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বিধি সন্নিবেশিত থাকায় বিধিমালা জারির পর ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বিধি সংশোধনের দাবি জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হলেও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ বিধিমালা সংশোধনের কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
‘উপরন্তু ২০২০-২০২১ সালের বাজেট প্রস্তাবনার সঙ্গে আরও কঠিন শর্ত যুক্ত করে লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০২০ জারি করা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে উত্থাপিত লাইসেন্সিং রুলের কয়েকটি বিধি ও উপবিধি সংশোধনীর প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু গত বাজেটেও কোনোরূপ সংশোধনী আনা হয়নি।’
তিনি আরও জানান, দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় গত বছরের জুনে সারা দেশে একদিনের কর্মবিরতি পালন করে সিঅ্যান্ডএফ সংশ্লিষ্টরা। জুন মাসের শেষে আবারও দুই দিনের কর্মবিরতি ঘোষণা দিলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হতে লাইসেন্সিং রুলসহ অন্যান্য বিধিসমূহ সংশোধনের জন্য কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। এ বিষয়ে ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেও কার্যকর কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে লাইসেন্সিং বিধিমালা-২০২০ এর আইন ও বিধি পরিবর্তন ও সংশোধনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আগামী ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি সোম ও মঙ্গলবার দেশের সকল কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ফেডারেশন যে সকল বিধিবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আমদানিকারকের কাছে শুল্ক করাদি পাওনা থাকলে সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের লাইসেন্স নবায়ন না করার বিধান বাতিল করা, উত্তরাধিকারের অনুকূলে লাইসেন্স হস্তান্তর সংশ্লিষ্ট শর্ত শিথিল করা, শুল্ককর পরিশোধ না করলে লাইসেন্স বাতিল ও অর্থদণ্ড আরোপের বিধান বাতিল করা, মূল লাইসেন্স বাতিল হলে রেফারেন্স লাইসেন্স বাতিলের বিধি বাদ দেওয়া, দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিকে লাইসেন্স প্রদান না করা, শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা-২০০০ এর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং ভুলের অজুহাতে ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ জরিমানার আদেশ বাতিলের দাবি উল্লেখযোগ্য।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলহাজ্ব শামছুর রহমান, সহসভাপতি জনাব শেখ মো. মোখলেছুর রহমান (লাভলু), অর্থ সচিব এ কে এম আকতার হোসেন, বন্দর বিষয়ক সচিব জনাব মো. খায়রুল বাশার প্রমুখ।
প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে দিনব্যাপী শীতকালীন পিঠা উৎসব-২০২৩। রবিবার সকাল ১১টায় বনানীস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচবিআর টাওয়ারের নীচতলায় ফিতা কেটে পিঠা উৎসব ২০২৩ এর উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নুরুন্নবী মোল্লা ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ইফ্ফাত জাহান।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কাজী এ এস এম আরিফ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোফাজ্জেল মাওলা, ফার্মেসি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শেখ ফিরোজ উদ্দীন আহমেদ, ফাইন্যান্স ডিরেক্টর শিপার আহমেদ, ডেপুটি রেজিষ্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ও সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা বেগমসহ অন্যরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসবের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাড়ি থেকে হরেক রকম পিঠা তৈরি করে এনে স্টল সাঁজিয়েছেন। আটটি স্টলে ছিলো নানা রকম পিঠার সমাহার।
এর মধ্যে ছিলো- ভাজাপুলি, দুধপুলি, নারিকেল পাকন, ছেই পিঠা, পাটি সাপটা, ফুলঝুরি, নকশি পিঠা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, ঝালপুলি, দুধপিঠা, মিষ্টান্নের মধ্যে ছিলো- কুনাফা, কাস্টার্ড, পুডিং, বালুশাই ও পায়েস। নানা অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় পিঠার পসরা সাজিয়ে উৎসবে আগতদের মনোযোগ কেড়েছে আয়োজকরা।
বাহারি নামের এসব পিঠা খেতে শিক্ষার্থীদের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়েছে এসব পিঠা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইলেকট্রিক্যাল ও মেশিনারি পণ্য নিয়ে রাশিয়া থেকে আসা বিদেশি জাহাজ ‘এম,ভি আনকা সান’ ও ‘এম,ভি সাপোডিলা’ মোংলা বন্দরে ভিড়েছে। রবিবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভিড়ে আনকা সান ও সন্ধ্যা ৭টায় ৮ নম্বর জেটিতে ভিড়ে সাপোডিলা।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন শাহীন মজিদ জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইলেকট্রিক্যাল মালামাল নিয়ে ভেনুটা পতাকাবাহী জাহাজ এম,ভি আনকা সান রবিবার বিকেল পৌনে ৫টায় মোংলা বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভিড়েছে। ১ হাজার ৯৭৯ প্যাকেজের ১ হাজার ৪শ মেট্রিক টন ইলেকট্রিক্যাল পণ্য নিয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর রাশিয়ার নভরস্কি বন্দর থেকে ছেড়ে আসে এ জাহাজটি। এ ছাড়া রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর থেকে ৪৩৬ প্যাকেজের ৫১৮ মেট্রিক টন মেশিনারি পণ্য নিয়ে সন্ধ্যা ৭টায় বন্দরের ৮ নম্বর জেটিতে ভিড়ে বিদেশি জাহাজ এম,ভি সাপোডিলা।
বিদেশি জাহাজ আনকা সান’র স্থানীয় শিপিং এজেন্ট কনভেয়ার শিপিং লাইনসের খুলনার ম্যানেজার (অপারেশন শিপিং) সাধন কুমার চক্রবর্তী ও সাপোডিলা’র স্থানীয় শিপিং এজেন্ট ইন্টারপোর্ট’র খুলনার ম্যানেজার অসিম মন্ডল জানান, বন্দর জেটিতে অবস্থান নেয়া এ জাহাজ দুটি থেকে রবিবার সন্ধ্যার পর অর্থাৎ রাত থেকে পণ্য খালাস শুরু হবে। এরপর জাহাজের এ পণ্য খালাস করে জেটিতে রাখা হবে। তারপর সোম বা মঙ্গলবার থেকে তা সড়ক পথে নেয়া হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
এর আগে গত ২২ জানুয়ারি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল নিয়ে মোংলা বন্দরে এসেছিল বিদেশি জাহাজ এম,ভি কামিল্লা। এ জাহাজগুলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত।
উল্লেখ্যে, সম্প্রতি ৭টি জাহাজ কোম্পানির ৬৯টি জাহাজে রূপপুরের মালামাল পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রেক্ষিতে রূপপুরের মালামাল নিয়ে রাশিয়া থেকে মোংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা এম,ভি উসরা মেজরকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তখন। ওই জাহাজটির ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে ভেড়ার শিডিউল ছিল। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় তা আর সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য ওই জাহাজটি পণ্য খালাসে ভারতে গেলে সেখানেও পণ্য খালাস করতে না পারায় ফেরত যায় উসরা মেজর। যা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বাংলাদেশ ও ভারতসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
চলছে শীত মৌসুম। এই সময় ফুলকপি খাবেন না, তা কি হয়? ফুলকপি খুবই পুষ্টিকর একটি সবজি; যা রান্না কিংবা কাঁচা যে কোন প্রকারে খাওয়া যায়। তবে ফুলকপির পাতাও কম উপকারী নয়। অনেকেই ফুলকপির পাতা ফেলে দেন। কিন্তু এর গুণ জানলে এমন করার আগে দু’বার ভাববেন।
ফুলকপিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, প্রোটিন, খনিজ পদার্থ, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি রয়েছে। যা দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন রোগের হাত থেকে মানবদেহকে রক্ষা করে।
ওজন কমাতে
মেদ ঝরাতে পরিশ্রম কম করেন না কেউই। অথচ হাতের সামনে এমন উপকারী জিনিস থাকতেও, অপ্রয়োজনীয় ভেবে ফেলে দিচ্ছি। ফুলকপির পাতায় রয়েছে ভরপুর পরিমাণে ফাইবার। ওজন কমাতে চাইলে অতি অবশ্যই রোজের ডায়েটে রাখতে পারেন এই পাতা। শুধু লেটুস নয়, সালাদেও এই পাতা রাখতে পারেন।
দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে
গবেষণা বলছে, ফুলকপির পাতায় রয়েছে ভিটামিন এ। যা দৃষ্টিশক্তি বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি, চোখ সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান করে। চোখের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে চোখ বন্ধ করে ভরসা রাখতে পারেন ফুলকপির পাতার উপর। রাতকানা রোগের আশঙ্কা দূর করতে এই পাতা কার্যকর।
হাড়ের যত্নে
শীতকালে হাড়ের বাড়তি খেয়াল রাখার দরকার পড়ে। তাই চিকিৎসকরা ক্যালশিয়ামে সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার কথা বলে থাকেন। ফুলকপির পাতা হল ক্যালশিয়ামের সমৃদ্ধ উৎস। এমনকি, ঋতুবন্ধের পরেও অনেক শারীরিক সমস্যা এড়াতে খেতে পারেন ফুলকপির পাতা।
সন্তানের বেড়ে ওঠায়
ফুলকপির পাতায় রয়েছে ভরপুর পরিমাণে প্রোটিন এবং খনিজ পদার্থ, যা শিশুর বেড়ে ওঠায় সাহায্য করবে। পুষ্টিবিদরা শিশুর বা়ড়ন্ত বয়সে এমন কিছু খাবার খাওয়ার কথা বলে থাকেন, যেগুলো তাদের উচ্চতা, ওজন এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করবে। ফুলকপির পাতা সেই খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’