
১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহী শহরে ‘স্টার’ নামে একটা স্টুডিও স্থাপন করেন মোতাহার হোসেন। এই স্টুডিও স্থাপনের মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলে তিনি একটা সাংস্কৃতিক মনন তৈরি করেন। তিনি যখন স্টুডিও স্থাপন করেন তখন বেশির ভাগ মানুষ ছবি তোলা গর্হিত কাজ মনে করতো। কিছু কিছু হিন্দু ব্যক্তি তখন পাসপোর্ট সাইজ ছবি তুলতে স্টুডিওতে যেতেন। মুসলমানরা লোকলজ্জার ভয়ে প্রকাশ্যে স্টুডিওতে যেতে চাইতেন না। স্টুডিও স্থাপনের শুরুতে মোতাহার হোসেন তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার রোষানলে পড়েন। ছবি তোলার প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা বদলে দিতে তিনি স্কুল ও কলেজের ছাত্রদের ছবি তুলে বিনা পয়সায় উপহার দিতেন। ওই সময়ই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জোরালো হয়ে উঠে। শহরে প্রায় সভা-সমাবেশ হয়। সেসবের ছবি তোলার জন্য তার ডাক পড়ে। ছবি তুলতে গিয়েই তিনি ছাত্রদের কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠেন। ফলে তার ওপর গোড়া সমাজের যে চোখ রাঙানি; তা ক্রমে স্তিমিত হতে থাকে।
বাংলাদেশের প্রায় সব আন্দোলন-সংগ্রামে মোতাহার হোসেনকে সরব থাকতে দেখা গেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ধারণ করে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজশাহী কলেজ ও রাজশাহী মেডিকেল স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন মিছিল-মিটিং করতেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি স্বাধিকার আন্দোলনে প্রাণ হারান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। মোতাহার হোসেনের ক্যামেরায় ধরা সেইসব উত্তাল মুহূর্তগুলো আজ ইতিহাস হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক সফরে চার বার রাজশাহীতে যান। প্রতিবারই তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলেন। মোতাহারের এই ছবিগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব উপাদান ধ্বংস করতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদাররা তার স্টুডিও পুড়িয়ে দেয়। মে মাসে বর্বর দখলদার বাহিনী রাজশাহী শহরে অনুপ্রবেশ করে প্রথম দিনই ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ও স্টার স্টুডিওতে আগুন দেয়। এতে স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে ধারণ করা অনেক দুর্লভ নেগেটিভ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে হানাদাররা তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। আমেরিকান ইউসিস লাইব্রেরির কর্মকর্তা আবদুল গনির মুচলেকার বিনিময়ে তিনি প্রাণে রক্ষা পান। মোতাহার হেসেনের এসব অবদানের কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ নেই।
আলোকচিত্রের এই কিংবদন্তিকে জানতে আমি বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করি। কিন্তু কোথাও তার সম্পর্কে নূন্যতম তথ্য নেই। ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে একটি বাক্যও পাওয়া গেল না। শেষে রাজশাহীর স্থানীয় মানুষ বন্ধুপ্রতীম আলোকচিত্রী ও চিত্রশিল্পী হাসান ইমাম রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি মোতাহার হোসেনের ছোট ভাই নজরুল ইসলামের ফোন নম্বর জোগাড় করে আমাকে পাঠান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি রেজিস্টার নজরুল ইসলাম আমাকে মোতাহার হোসেনের বিস্তারিত জানান। নজরুল ইসলাম বলেন, স্টার স্টুডিও ছিল তৎকালীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক স্টুডিও। শহরের সাহেব বাজার এলাকায় ২০ কাটা আয়তনের এক বিজনবাড়িতে ছিল এই স্টুডিওর অবস্থান। বাড়িটির ভেতরে বিশাল এক অট্টালিকা। সুরম্য এই অট্টালিকায় ছিল ১৪টি কক্ষ। মাঝখানে ছিল বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা। স্টার স্টুডিওর সুনামের কারণে অনেক বছর আগে ফেলে যাওয়া এই হিন্দুবাড়িটি ১৯৬২ সালে মোতাহার হোসেনকে ৯৯ বছরের বন্দোবস্ত দেয় সরকার। পুরনো ভবনটি সংস্কার করে বিশাল পরিসরে তিনি স্টুডিওর কার্যক্রম শুরু করেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্টুডিওটিকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ স্টুডিও হিসেবে খবর প্রচার করে বিবিসি। খবরটি বিবিসিতে পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশ অবজারভারের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা আনজুম ফেরদৌস। এমন একটি তথ্য আছে জাহাঙ্গীর সেলিম রচিত ‘আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ ও সমকালীন আলোকচিত্রের বিবর্তন’ বইয়েও। বইটির ৮৭ ও ৮৮ নম্বর পৃষ্ঠায় জাহাঙ্গীর সেলিম লিখেছেন, ‘এ স্টুডিও দেশ বিভাগের কিছু পর প্রতিষ্ঠিত হয়ে ধীরে ধীরে এক বিশাল স্টুডিওতে পরিণত হয়। একটি বড় ভবনের পুরো অংশ স্টুডিওর কাজে ব্যবহৃত হতো। ছোট বড় কয়েকটা ঘরে ছবি তোলার ব্যবস্থা ও একাধিক ডার্করুম ছিল। বিগত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ স্টুডিও হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।’
নজরুল ইসলামের তথ্য অনুযায়ী, মোতাহার হোসেনের জন্ম ১৯২৯ সালে, অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার কাহারপাড়া মানিকচক গ্রামে। ২২ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার পিতা আব্দুল খলিল পন্ডিত স্থানীয় হাইমাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন; যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ডেও। মা মরিয়ম খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ছেলেবেলায় ছবি তোলার প্রতি তার ঝোঁক ছিল। কাঠকয়লা দিয়ে মাটির দেয়ালে ছবি আঁকার কারণে তাকে প্রায় বকা শুনতে হতো। ১৯৩৫ সালে রাজনৈতিক গ্রেপ্তার এড়াতে মোতাহারের পিতা পরিবার নিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ী এসে ধামিলা সেখেরমানি গ্রামে বসবাস শুরু করেন। ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন পবা উপজেলার দামকুড়া রামরঞ্জন মাইনর ইংরেজি স্কুলে (বর্তমানে দামকুড়া হাইস্কুল)। পরের বছর মোতাহারকে ওই স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করেন। ১৯৩৯ সালে দুই দিনের ব্যবধানে খলিল পন্ডিতের দুই ছেলে মারা যায়। পুত্রবিয়োগের বিষয়টি অশুভ ভেবে তিনি এখানকার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে মুর্শিদাবাদে চলে যান। কিন্তু স্বদেশী হওয়ায় তার পক্ষে সেখানে থাকাও সম্ভব হলো না। ১৯৪০ সালের শেষের দিকে তিনি আবারও রাজশাহীর রামপুর বোয়ালিয়ায় আসেন।
মোতাহার ভর্তি হন লোকনাথ হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে। এ সময় মোতাহারের বাবা প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। তার অবস্থানের কথা কেউ জানতে পারতো না। বেশির ভাগ সময় তিনি খুলনা ও বাগেরহাটে আত্মগোপনে থাকতেন। এ অবস্থায় মোতাহারের মায়ের পক্ষে সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। একদিন তার মা বাঁশের খুটি ভেঙে জমানো পয়সা ছেলের হাতে তুলে দেন। মোতাহার সেই টাকা দিয়ে পাইকারি বাজার থেকে ছিটকাপড়, লুঙ্গি ও গামছা ফেরি করতে শুরু করেন। ফলে মোতাহারের পক্ষে আর স্কুলে যাওয়া সম্ভব হলো না। পাঁচ বছর পর তার হাতে কিছু টাকা জমলো। মাকে জানালেন ফটোগ্রাফির প্রতি তার প্রবল আগ্রহের কথা। এরমধ্যে দেশভাগ হয়ে গেল। তার বাবাও বাড়ি ফিরে এলেন। মায়ের অনুমতি নিয়ে মোতাহার কলকাতায় যান। সেখানকার একটি নামী স্টুডিওতে যোগ দিয়ে ওস্তাদের অধীনে কাজ শেখেন। শান্ত-স্বভাব আর সময়নিষ্ঠতার কারণে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি মালিকের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। সেখানে তিনি দাগুয়ে টাইপ, ট্যালবট টাইপ, কলোডিয়ান ও গ্লাস প্লেট নেগেটিভ প্রসেস শিখেন। আড়াই বছর প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার সময় স্টুডিও মালিক তাকে একটি প্লেট ক্যামেরা, কিছু পেপার ও কেমিক্যাল উপহার দেন।
রাজশাহীতে ফিরে মোতাহার কুমারপাড়ার বাসুনিয়া পট্টিতে ঠাকুরবাড়ির চিলেকোঠা ভাড়া নেন। সামান্য পরিসরে স্টার স্টুডিও চালু করেন। শুরুতে তিনি প্লেট ক্যামেরা ব্যবহার করেন। ওই সময় রাজশাহী শহরে আরও দুটি স্টুডিও ছিল। শহরের ফুদকিপাড়ায় কালীমন্দিরের কাছে একটি দোকানে সুরেন্দ্রনাথ নামের একজন মিনিট ক্যামেরায় ছবি তুলতেন। এছাড়া সাহেব বাজারে মাজেদিয়া স্টোর বলে একটি দোকান ছিল। সেই দোকানের খোলা বারান্দায় পাসপোর্ট সাইজ ছবি তোলা হতো। তখন সূর্যের আলোতে ছবি তুলতে হতো। রাতের বেলা ছবি তোলা কঠিন ব্যাপার ছিল। দিনে ছবি তোলার জন্য সাবজেক্টের পেছনে কালো কাপড় ধরার জন্য দুইজন বাড়তি লোকের দরকার হতো। তখন প্লেট ক্যামেরার ফিল্মের সাইজ অনুযায়ী ফটো পেপার পাওয়া যেত। ছবির প্রিন্টও হতো নেগেটিভের মাপে।
ওই সময় মোতাহার মাঝে মাঝে স্টুডিওর বাইরে গিয়ে ছবি তুলতেন। প্লেট ক্যামেরা বহন করা তখন কষ্টসাধ্য ছিল। তাই তিনি ঢাকায় এসে ১২৭ রোলিকর্ড ক্যামেরা কেনেন। কিন্তু তিনি তখন এই ক্যামেরার ব্যবহার জানতেন না। ফলে তিনি আবারও কলকাতা যান। দুই মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজশাহীতে ফেরেন। রাজশাহী শহরে তখন একটি মাত্র পাকা রাস্তা, কিছু ইটের রাস্তা, বাকি সব কাঁচা রাস্তা। সেই সময় মোতাহার হোসেন রোলিকর্ড ক্যামেরা কাধে ঝুলিয়ে বাইসাইকেলে চড়ে জেলার দুর্গম গ্রাম ঘুরে বিভিন্ন ব্যক্তির পাসপোর্ট সাইজ ছবি, পারিবারিক ছবি ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের ছবি তুলতেন। ফলে মোতাহার হোসেন আর স্টার স্টুডিওর নাম রাজশাহীর প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। দিনে দিনে স্টুডিওটির পরিধি বাড়ার কারণে স্টুডিওর স্থানও পরিবর্তন হয়। ১৯৫৩ সালে স্টুডিওটি বাসুনিয়া পট্টি থেকে গনকপাড়ায় হোমিও চিকিৎসক জালালউদ্দিনের দোতলা বাড়িতে স্থানন্তরিত হয়। ১৯৬৩ সালে স্টুডিওটি আসে সাহেব বাজারের পুরনো বাড়িতে। এর আগের বছর রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয় নিউ মার্কেট। সেখানে স্টার স্টুডিওর দ্বিতীয় শাখা খোলা হয়।
বাংলাদেশের অনেক গুণী আলোকচিত্রীর হাতেখড়ি হয় মোতাহারের কাছে। কিংবদন্তি ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদার শিশু বয়সে স্টার স্টুডিওতে তার কাছে ফটোগ্রাফি শেখেন। ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে ১২ বছর বয়সী রশীদ তালুকদার স্টার স্টুডিওতে সহযোগী হিসেবে যোগ দেন। মোতাহার হোসেন একদিন দুপুরে কল্পনা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে স্টুডিওতে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন সিনেমার টিকেট কালোবাজারির কারণে ১৫-১৬ বছর বয়সী এক ছেলেকে পুলিশ থানায় নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটি মোতাহার হোসেনকে করুণভাবে বললেন, ভালো কোনও কাজ পেলে সে আর এ কাজ করবে না। ছেলেটির প্রতি তার মায়া হলো। থানা থেকে ছেলেটিকে ছাড়িয়ে এনে স্টুডিওতে কাজ দিলেন। রবিউল ইসলাম নামের এই ছেলেটি পরবর্তী সময়ে ফটোগ্রাফি পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়। রশীদ তালুকদার ছাড়াও বাংলাদেশ বেতারের সাবেক প্রধান ফটোগ্রাফার লুৎফর রহমান লুতু, রাজশাহীর স্টাইল আর্ট গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা আজিজার রহমান, রূপায়ণ স্টুডিওর মালিক আবু নইম, নাটোরের শক্তি স্টুডিওর স্বত্ত্বাধিকারী প্রশান্ত সাহা, রাজশাহীর হায়দার আলী, গোলাম মোস্তফা, পাকিস্তানের মাহবুব-উর-রহমানসহ অসংখ্য তরুণ মোতাহার হোসেনের সান্নিধ্যে থেকে কাজ শেখেন।
মোতাহার হোসেন ছিলেন এক নিভৃতচারী মানুষ। দাম্পত্য কলহের কারণে শেষের দিকে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। এ সময়ে তার পরিবারে অপ্রত্যাশিত ঘটনাও ঘটে। ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্ট রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান মোতাহার হোসেন। রাজশাহী শহরের কাদিরগঞ্জ গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর পর তার অনুজ সিরাজুল ইসলাম সেলিম ও নজরুল ইসলাম স্টুডিওটির হাল ধরেন। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তারা স্টুডিওটি চালান। এরপর মোতাহার হোসেনের স্ত্রী নাজমীন জাহান ও তার চার মেয়ে— ইলোরা, ইরা, নিপু ও পিংকি স্টুডিওটির দায়িত্ব নেন। ২০০৮ সালের পর তাদের পক্ষে স্টুডিওটি আর চালানো সম্ভব হয়নি।
লেখক: দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
[email protected]
ডভ এইচ লেভিন হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও লোকপ্রশাসন বিভাগে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়ান। লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়ে কার্নেগি-মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিতে পোস্ট ডক ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার গবেষণার মূল মনোযোগে ছিল বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর পক্ষপাতমূলক হস্তক্ষেপ। এসব নিয়ে তিনি একটি বই লেখেন। ‘মেডলিং ইন দ্য ব্যালট বক্স : দ্য কজেস অ্যান্ড এফেক্টস অব পার্টিজান ইলেক্টরাল ইন্টারভেনশনস’ নামের বইটি ২০২০ সালে প্রকাশ করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। পরের বছর তা জার্ভিস-শ্রোয়েডার বেস্ট বুক অ্যাওয়ার্ড পায়।
বইটার শুরু হয়েছে ২০১৩ সালের গোড়ার দিকের একটি ঘটনা দিয়ে। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনকয়েক আগের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকাবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি অব স্টেট জনি কারসন এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে সতর্ক করেন যে, উহুরু কেনিয়াত্তা বিজয়ী হলে তার জন্য কেনিয়ানদের ‘গুরুতর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে। কেনিয়াত্তার বিরুদ্ধে তখন আন্তর্জাতিক আদালতের একটি তদন্ত চলছিল। একজন প্রার্থীকে হারিয়ে আরেকজনকে জেতানোর এই যে মার্কিন প্রচেষ্টা, তা ওই নির্বাচনে সফল হয়নি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে নির্বাচনে জেতার পর যখন কেনিয়াত্তা ইউএস-আফ্রিকা সামিটে অংশ নেন, তখন থেকে বেশ কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেই তিক্ততার আর দেখা মেলেনি তার।
এমন দৃষ্টান্ত যে দুনিয়ায় কত, তার একটা সংখ্যা বের করে আনার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন লেভিন। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশে^র স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে মোট ৯৩৭টি জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে লেভিন ১১৭টি পক্ষপাতমূলক নির্বাচনী হস্তক্ষেপের ঘটনা তার বইতে তুলে এনেছেন। তার হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১১.৩ শতাংশ নির্বাচনে পক্ষপাতমূলক হস্তক্ষেপ করা হয়েছে কিংবা বলা যায় এই সময়কালে প্রতি ৯টি নির্বাচনের একটি এই হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। লেভিন বলছেন, এর মধ্যে ৮১টি ঘটনা ঘটিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, শতকরা হিসাবে যা ৬৯ ভাগ। একই সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়া ঘটিয়েছে ৩৬টি ঘটনা, যা মোট ঘটনার ৩১ শতাংশ। তিনি দেখিয়েছেন, ৬০টি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে এই হস্তক্ষেপগুলো ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব থেকে বেশি হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ইতালির নির্বাচনে, সংখ্যায় যা দাঁড়ায় ৮ বার। এর বাইরে জাপানে ৫ বার, ইসরায়েল, লাওস ও শ্রীলঙ্কায় ৪ বার করে হস্তক্ষেপ প্রচেষ্টা হয়েছে।
ভিনদেশের নির্বাচনে নাক গলানোর এই প্রবণতা নিয়ে লেভিনের আলোচনা নতুন কিছু নয়। দীর্ঘ সময় ধরে তা চলে আসছে। লেভিনের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট যে, এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব থেকে বেশি তৎপর। একটা সময় ছিল, যখন এসব কাজে গোপনে টাকা ঢালত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। সেগুলো ছিল কভারড বা গোপনীয় অপারেশনের আদলে। সামরিক অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে শ্রমসংস্থাকে কাজে লাগিয়ে এসব কাজ করা হয়। এমনকি নির্বাচিত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানকে হত্যার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে আছে বেশ শক্তভাবে। এসব তথ্য আজ আর কারও অজানা নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তাতে কিছুই আসে-যায়নি। কারণ, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের ক্ষমতা বদলের দোকানদারির নতুন নতুন আধুনিক সংস্করণ হাজির হয়েছে বাজারে। আর বিশ্বজুড়ে তার খদ্দেরও কম নেই!
প্রধানত ষাটের দশকের শেষভাগে বেশ কিছু মার্কিন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে বিদেশি রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপের জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সিআইএ অর্থ তহবিল দিচ্ছে বলে তথ্য প্রকাশিত হয়। সেই সময় লিন্ডন বি জনসন প্রশাসন এ ধরনের তহবিল বন্ধ করে একটি পাবলিক-প্রাইভেট মেকানিজমভিত্তিক তহবিল গঠনের মাধ্যমে একটি সংস্থা স্থাপনের সুপারিশ করে, যাদের কাজ হবে বিদেশি কার্যক্রমে অর্থায়ন। ১৯৭৪ সালে প্রাক্তন সিআইএ বিশেষজ্ঞ ভিক্টর মার্চেটি সংস্থাটির গোপন সব অপারেশনের ফিরিস্তি প্রকাশ করেন।
একই বছর নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক শেমুর হার্স দেশে দেশে সরকার বদলে সিআইএর গোপন মিশন নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পরের বছর প্রাক্তন সিআইএ এজেন্ট ফিলিপ এগি লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে সিআইএর হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে একটি বই লিখলে বিষয়টি আরও খোলাসা হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে মার্কিনদের এই ক্ষমতা বদলের দোকানদারির শিকার হয়ে বসে আছে চিলি থেকে শুরু করে ছোট্ট দ্বীপ ব্রিটিশ গায়ানাও। শেষে পুরনো পদ্ধতি বদলের সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন প্রশাসন। ১৯৮১ সালে ওয়েস্টমিনিস্টার প্রাসাদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে বৈদেশিক নীতি নিয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে তৎকালীন ইউএস প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান একটি নতুন মার্কিন সংস্থা তৈরির ঘোষণা দেন, যা উদার আদর্শ, বাজার অর্থনীতি ও মার্কিন আদলের গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করবে।
এরপর ইউএসএআইডি থেকে অর্থ নিয়ে একটি আধা বেসরকারি অলাভজনক করপোরেশন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় ন্যাশনাল এন্ডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (এনইডি)। যে সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা অ্যালেন ওয়েনস্টেইন ১৯৯১ সালে বলেছিলেন, ‘আজকাল আমরা যা (প্রকাশ্যে) করি, তার অনেকগুলোই ২৫ বছর আগে সিআইএ গোপনে করত।’ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পৃথিবীর নানা দেশে এনইডির পরিকল্পিত অর্থায়নের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক আছে। এই সংস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ রয়েছে আমার ‘সিআইএ থেকে এনইডি : গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা নাকি মার্কিন মেডলিং মেশিন’ নামের বইতে। সেখানে আলোচনা করা হয়েছে, কীভাবে এনইডিকে কাজে লাগিয়ে চোখের সামনে গণতন্ত্রের নামে ভিনদেশে নাক গলিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সাম্পªতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পর থেকে বিশ্ব শক্তিগুলোর নানা তৎপরতা চোখে পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের দোকানদারিও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চলতি বছরের ২৪ মে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে বাগে আনতে একটি ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। যদিও তারা বলছেন, বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিরুদ্ধে যারা কাজ করবেন, তাদের জন্য এই ঘোষণা। অতি সম্প্রতি সেই ঘোষণা আবার দফায় দফায় কার্পেটের ভাঁজ খোলার মতো নতুন নতুন তথ্য নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। এগুলোর ব্যাখ্যা বিশেস্নষণও চলছে। মার্কিন অ্যাম্বাসি সামাজিক মাধ্যমে পেইড স্পন্সরশিপ দিয়ে এই তথ্য বেশি বেশি প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। ভিসানীতি ওদের নিজস্ব ব্যাপার। কাকে দেবে, কাকে দেবে না– সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রই বুঝবে ভালো। কিন্তু ভাঙা ক্যাসেটের এই রেকর্ড বারবার ব্যবহারের প্রবণতা থেকে কিছু প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমুন্নত রাখতে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এটিও সত্যি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ শক্তিগুলো ভিনদেশে হস্তক্ষেপের জন্য সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অংশকে ব্যবহার করে থাকে। কাজেই সেই পরিবেশ দূর করে আস্থা ফেরানোর চ্যালেঞ্জ নিজ নিজ রাষ্ট্রকে নিতে হবে। কিন্তু মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে দেখা যাচ্ছে, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারী’দের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনছে দেশটি। বলা হচ্ছে, এতে ওই ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত হবেন। যদি তাদের ‘অপরাধী’ও ধরে নিই, তাহলেও প্রশ্ন ওঠা সংগত যে, পৃথিবীর তাবৎ গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত রাষ্ট্রটি তাহলে ‘কিন পানিশমেন্ট’ ধারণার পক্ষে? তাহলে এতদিন ধরে তারা যে এ ধরনের ব্যবস্থার জন্য স্বৈরতন্ত্রকে দায়ী করে আসছিলেন, তার কী হবে? কারণ, আধুনিক আইনের খুব সাধারণ ব্যাপার হলো, একের অপরাধের সাজা অন্যকে দেওয়া ন্যায়বিচার নয়। যদিও মার্কিন মুলুকেই গ্রানাইট সিটির মতো কিছু শহরে ‘নিরাপদ আবাসের’ নামে একজনের অপরাধের সাজা পুরো পরিবারসমেত দেওয়া হয়! আবার মাত্র দুদিন আগে এক টেলিভিশন চ্যানেলে মার্কিন অ্যাম্বাসেডর পিটার হাস বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় গণমাধ্যমও আসবে! মনে রাখা জরুরি, কয়েক বছর আগে ভিসার জন্য দেশটি আবেদনকারীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হদিস চেয়েছিল। যাতে ওসব দেখে-টেখে তারা ভিসা দেওয়া-না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার রক্ষক দাবিকারীদের এসব সিদ্ধান্ত কোন স্বাধীনতা সমুন্নত করে কে জানে! লেখার শুরুতে যে বইটির কথা বলা হয়েছে, শেষে আবারও ফিরতে হবে তার কাছে। লেভিনের গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসা একটি চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ এই বইয়ে স্থান পেয়েছে, যা এ বিষয়ে আমাদের একটি পুরনো দৃষ্টিভঙ্গিকে নাড়িয়ে দিতে পারে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি না পেলে সেসব রাষ্ট্রে এমন বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে বলে সচরাচর বলা হয়ে থাক। কিন্তু লেভিন দেখিয়েছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুরুর কিংবা রাষ্ট্রের প্রথম নির্বাচনে পক্ষপাতমূলক হস্তক্ষেপের ঘটনা মাত্র ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ হস্তক্ষেপ একই রাষ্ট্রে একাধিকবার ঘটেছে। আর একই রাষ্ট্রে পর পর নির্বাচনে ধারাবাহিক হস্তক্ষেপের হার ৭১ শতাংশ।
অঞ্চলভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোতে হস্তক্ষেপের সংখ্যা ও সময়কাল বিশেস্নষণ করে লেভিন জানান, বৃহৎ রাষ্ট্রের এই হস্তক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হয়। যদিও বেশির ভাগ ড়্গেত্রেই বিষয়টিকে নানা রকম আকর্ষণীয় প্রপঞ্চ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। উপস্থাপন যত আকর্ষণীয় নামেই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন কৌশলের মূল লক্ষ্য, তাদের নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভীতি প্রদর্শন, যেখানে প্রয়োজনে তারা মধ্যযুগীয় ‘কিন পানিশমেন্ট’ ধারণা প্রয়োগ করতেও মরিয়া। কাজেই বিশ্ব সম্প্রদায়কে এই বার্তাটি নেওয়া উচিত যে, সিআইএ থেকে এনইডি হয়ে এখন ভিসানীতি মার্কিন হস্তক্ষেপ কৌশলের নতুন সংযোজন।
লেখক: সংবাদকর্মী, লেখক ও চলচ্চিত্রকর্মী
যুক্তরাষ্ট্র গত মে মাসে ভিসানীতি আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় তারা ভিসানীতি ঘোষণার কার্যকারিতার কথা জানালো। এই ভিসানীতি কার্যকারিতার কথা তারা তখন জানালো যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার এক বৈঠকে আবারও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।
ওই বৈঠকের পর আজরা জেয়া নিজেই এক্সে (সাবেক টুইটার) সচিত্র একটি পোস্ট দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি সাইড ইভেন্টের আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আবারও যুক্ত হতে পেরে সম্মানিতবোধ করছি। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, অংশীদারত্বের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি এবং ৯ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উদারতার সঙ্গে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছি।’
বৈঠকে আজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তারা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য ১১৬ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেয়া রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবিকা নিশ্চিত করতে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন।
জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা উচিত, অন্যথায় এই অঞ্চল নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ রোহিঙ্গারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে হত্যা, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান এবং মাদক কারবার। রোহিঙ্গারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কারণ তাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে এবং তারা সেখানে কোনো ভবিষ্যৎ অনুভব করছে না।
একটা বিষয় খেয়াল করলে বুঝা যাবে, উজারা জেয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর পরই বাংলাদেশের উপর যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে বুঝা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। তাদের দাবি ছিলো, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, তাদেরকে নিজ দেশ ফিরিয়ে নিতে যত তাড়াতাড়ি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।এ থেকে বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে, রোহিঙ্গাদের কর্মসংসস্থানের প্রস্তাব সরাসরি ফিরিয়ে দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হয়েছে। এই প্রস্তাব ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আর কী কী প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিল তা আমরা জানি না। মনে হচ্ছে, এমন কিছু প্রস্তাব হয়তো প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছিল যেগুলো তিনি নাকচ করে দিয়েছেন।এবার আসা যাক বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। অনেকদিন ধরে তারা সেটি বলে আসছে। বাংলাদেশের তরফ থেকেও বার বার জানানো হয়েছে যে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হবে। তারপরও তারা ভিসানীতি আরোপ করে সেটি কার্যকর করতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- নির্বাচন তো এখনও হয়নি। তার আগেই কেন ভিসানীতি আরোপ ও কার্যকর করা হলো?
এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই এসব ভিসানীতি, নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। গণতন্ত্র, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট শুধুমাত্র ইস্যু। নিজের দেশেই আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতে নানান কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। নিজের দেশেই যেখানে বাইডেন প্রশাসন প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে অন্যদেশের গণতন্ত্র নিয়ে তাদের এতো মাথা ব্যাথা কেন?
বাংলাদেশেই যে তারা প্রথম ভিসানীতি আরোপ বা নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিক অতীত ঘাটলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র আরও বহু দেশের সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদদের উপর একইভাবে ভিসানীতি এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এটা নতুন কিছু নয়। যেখানেই তাদের স্বার্থ জড়িত সেখানেই তারা একই পথে হেঁটেছে। কিন্তু কোথাও তারা সফল হতে পারেনি। সব জায়গা থেকেই ফিরেছে শূন্য হাতে। আমরা যদি ভেনিজুয়েলা থেকে শুরু করে সিরিয়া, ইরান, মিশর, তুরস্ক, রাশিয়া, বেলারুশের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এদের সবার উপরই নিষেধাজ্ঞা জারি কিংবা ভিসানীতি আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু খুব একটা ফল হয়নি।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই সেদেশে সামরিক অভ্যূত্থান হয়েছিল। সেই অভ্যূত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ইন্ধন দিয়েছিল। ২০২১ সালে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সৌলু যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনের বিষয়টি স্পষ্ট করেন। ভেনিজুয়েলায় নিজেদের পছন্দের লোক গুইদুকে প্রেসিডেন্ট করতে না পেরে মাদুরোকে বার বার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।পাঠকদেরকে হালের একটা তথ্য দিয়ে রাখি। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ভারতের মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের উপরও। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। বারাক ওবামা ভারত সফরের পর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তার সফরের বেশ কিছু দিন পর ভারত নাসার সঙ্গে চুক্তি করল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। গুজরাট দাঙ্গার কারণে তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। পরবর্তিতে নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, কারা সরকার পরিচালনা করবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক শুধুই বাংলাদেশের জনগণ। এখানে বাইরের রাষ্ট্র সে যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ হোক কারোরই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, কারা সরকার পরিচালনা করবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক শুধুই বাংলাদেশের জনগণ। এখানে বাইরের রাষ্ট্র সে যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ হোক কারোরই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। যখনই বাইরের কোনো রাষ্ট্র কোনো অজুহাতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবে তখনই বুঝতে হবে ওই দেশের বৃহত্তর স্বার্থ আছে। আর এসব নিষেধাজ্ঞা, ভিসানীতি আরোপে এদেশের সাধারণ মানুষের কিছুই যায় আসে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্ত করেছে এবং করছে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী নিজামুল হক বিপুল
বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আত্মদানকারী প্রথম নারী। ২৪ সেপ্টেম্বর এ বীরকন্যার আত্মাহুতি দিবস। এ বছর প্রীতিলতার ৯১তম আত্মাহুতি দিবস। ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে এ বীরকন্যা জন্মগ্রহণ। তার বাবার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার।
তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল অফিস কর্মকর্তা ছিলেন। তার মায়ের নাম প্রতিভা ওয়াদ্দেদার। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে প্রীতিলতা দ্বিতীয় সন্তান। তার পারিবারিক ডাকনাম ছিল ‘রাণী’। ছদ্মনাম ছিল 'ফুলতার'।
১৯১৮ সালে প্রীতিলতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রীতিলতা অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুই হয়েছিল তৃতীয় শ্রেণি থেকে। ১৯২৬ সালে তিনি মেধা তালিকায় বৃত্তি লাভ করেন। তিনি ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে লেটার মার্কসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন ইডেন মহিলা কলেজে। ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন প্রীতিলতা।
এরপর প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে তিনি দর্শনে স্নাতক পাস করেন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামে ফিরে এসে তিনি নন্দনকানন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (যা বর্তমানে অপর্ণা চরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত) প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন।
স্বদেশি আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রীতিলতাই প্রথম নারী বিপ্লবী। প্রীতিলতা যখন বিপ্লবী দলের সদস্য হতে চাইছিলেন তখন মাস্টার দা সূর্য সেন ছিলেন পলাতক। প্রীতিলতার ভীষণ ইচ্ছা ছিল মাস্টারদার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহে এবং বহু চেষ্টার পর ১৯৩২ সালের মে মাসে মাস্টার দা সূর্য সেনের সঙ্গে তার দেখা হয়। পরবর্তীতে স্বদেশি আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক মাস্টার দা সূর্য সেন প্রীতিলতার দায়িত্ববোধ, সাহসিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ অভিযানের নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন।
দলের প্রস্তুতিপর্ব শুরু করে দেওয়া হল। অভিযান সফল করার লক্ষ্যে তাদের অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আট সদস্য বিশিষ্ট এই দলের দলপতি ছিলেন প্রীতিলতা। তিনি ছাড়াও এ দলের বাকি সাতজন হলেন—বিপ্লবী কালিকিংকর দে, শান্তি চক্রবর্তী, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে, মহেন্দ্র চৌধুরী এবং পান্না সেন। প্রীতিলতার নেতৃত্বে এই অভিযান শুরু করা হয় ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায়। সেদিনের বিপ্লবীদের এই অভিযান সফল হয়েছিল। নিয়মে আছে, সামরিক কায়দায় আক্রমণের সময় নেতা থাকবে সবার আগে এবং ফেরার পথে সাথীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে নেতা ফিরবে সবার পরে। এই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন প্রীতিলতা। অভিযান সফল হওয়ার পর হুইসেল বাজিয়ে সদস্যদের ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি। পরবর্তীতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রীতিলতা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আত্মগোপনকারী এক ইংরেজ সৈনিকের গুলিতে বিদ্ধ হন প্রীতিলতা। ইতোমধ্যে দলের অন্যান্য সকল সদস্য নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
দলের সকল সদস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরই প্রীতিলতা তার সঙ্গে বহন করা ‘পটাশিয়াম সায়ানাইড’ পান করে আত্মাহুতির পথ বেছে নেন। যাতে ইংরেজ সৈন্যরা তাকে জীবিত অবস্থায় মারতে না পারে। এখানে উল্লেখ্য, পূর্বেই নির্দেশ ছিল যেকোনো অবস্থাতেই শত্রুর হাতে জীবিত অবস্থায় ধরা দেওয়া যাবে না। আহত অবস্থায় যাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীশক্তি তাকে জীবিত ধরে ফেলতে না পারে সে জন্য তিনি পূর্বনির্দেশের প্রতি অবিচল থেকে সায়ানাইড বিষপান করে আত্মাহুতি দেন। প্রীতিলতা প্রমাণ করেছেন মাস্টার দা সূর্য সেনের সিদ্ধান্ত একদম সঠিক ছিল, প্রীতিলতা এই অভিযানের যোগ্য নেতৃত্বদানকারী ছিলেন। পরদিন ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে ব্রিটিশ পুলিশ প্রীতিলতার মৃতদেহ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। একজন নারীকে আক্রমণকারী হিসেবে শনাক্ত করে তারা হতভম্ব হয়ে যায়।
৮০ বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দুই প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও বীণা দাসকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, বিপ্লবীদের প্রতি সম্মান জানাতেই এই মরণোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। ২০১২ সালের ২২ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এই ডিগ্রি দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষে এই ডিগ্রির সনদ গ্রহণ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং তিনি তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। এই সনদ বিশ্ববিদ্যালয়েই সংরক্ষণ করা হয়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও বীণা দাস এই দুইজনেরই স্নাতক ডিগ্রী পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর পূর্বেই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুঠ করে ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইতে যোগ দেন ও পরে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। ফলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও সেদিন এই দুইজনের কারোরই স্নাতক ডিগ্রি নেওয়া হয়নি।
পরবর্তীতে ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রশংসাপত্র দিতে হাজির হওয়া তৎকালীন গভর্নর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য স্ট্যানলি জ্যাকসন। হঠাৎ জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে গুলি করেন ২০-২১ বছরের এক তরুণী। এই তরুণীই বীণা দাস। তিনি চেয়েছিলেন চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও উপাচার্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ধরে ফেললেন সে তরুণীকে। তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে সে। সেদিনের সেই তরুণীই ছিলেন বীণা দাস। ইতিহাসের একটি সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরযোদ্ধা বীণা দাস চুলের খোঁপার মধ্যে রিভলবার লুকিয়ে সমাবর্তন কক্ষে ঢুকেছিলেন সেদিন। স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে পরপর পাঁচটি গুলি চালিয়েছিল বীণা। তবে স্ট্যানলি জ্যাকসন সম্পূর্ণ অক্ষত ছিলেন কারণ সবকটি গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল এবং চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যাওয়ায় সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় বীণা দাসকে।
চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলিতে তৎকালীন ইউরোপিয়ান ক্লাব বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়। এই ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনেই স্থাপিত হয়েছে 'বীরকন্যা প্রীতিলতা' স্মারক ভাস্কর্য। এটি উদ্বোধন করা হয়েছে ২০১২ সালের ২ অক্টোবর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, 'বীরকন্যা প্রীতিলতা' স্মারক ভাস্কর্য স্থাপনের পূর্বে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়ে পাহাড়তলি রেলওয়ে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সমিতির দেওয়া একটি 'স্মৃতি ফলক' এবং ইউরোপিয়ান ক্লাবসংলগ্ন পাহাড়তলি সাবপোস্ট অফিসের সামনের সড়ক দ্বীপে একটি স্মৃতিস্মারক ছাড়া আর কোনো কিছু নেই এই বীরকন্যার স্মরণে। তবে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাটে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নিজগ্রামে তার একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রীতিলতার নামে রয়েছে আবাসিক হল।
সামপ্রতিককালের কথা, প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবসে একটি প্রতিবেদন দেখানো হচ্ছিল একটি টেলিভিশন চ্যানেলে। সেখানে দেখা যায়, এ প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বিপ্লবী প্রীতিলতার নাম জানেন না! কেউ নাম শুনলেও তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানেন না। আরও অবাক করার ব্যাপার এই যে, তার নিজের জেলার মানুষের কাছেও তিনি প্রায় অপরিচিত। দুঃখজনক হলেও এটি সত্য যে, প্রীতিলতা যেসব স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন সেখানকার শিক্ষার্থীরাও ঠিকভাবে জানেন না প্রীতিলতার বীরত্বের কথা।
বর্তমান প্রজন্ম প্রীতিলতা সম্পর্কে জানে না—এটি একটি লজ্জাকর ব্যাপার। এটি প্রজন্মের জন্য, দেশের জন্য অশনিসংকেত! বর্তমান প্রজন্ম কীভাবে বেড়ে ওঠছে—তা এ দৃশ্যগুলো থেকে সহজেই প্রতীয়মান। তারা বইপড়ায়, ইতিহাসচর্চায়, জ্ঞানচর্চায় নেই। তাই দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তারা জানেন না। দেশপ্রেমিক বিপ্লবী এই মানুষগুলোর নামও এখন তাদের কাছে দুর্বোধ্য। বাধ্য হয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার আশায় তাদের ইতিহাস সম্পর্কে একটু জানতে হয়, এগুলো আবার তারা পরের বছর নতুন বই আর নতুন পড়ার ভিড়ে ভুলে যান। তবুও এখনও অনেকে আছেন, যারা ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ইতিহাস সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক। তারা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার বাইরে বইপড়ায়, ইতিহাসচর্চায়, জ্ঞানচর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। কিন্তু সে সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। দিনদিন প্রজন্মের মাঝে বইপড়ার অভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে। তারা শুধু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাইরের জীবন-জগৎ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। শুধু পরীক্ষায় ভালো করার জন্যই বাধ্য হয়ে তারা এখন পড়াশোনা করেন।
বর্তমান প্রজন্মকে সৃজনশীল কোনো কাজে জড়িত থাকতে কিংবা সৃজনশীলতা চর্চা করতে তেমনভাবে দেখা যায় না। কিন্তু এভাবে একটি প্রজন্ম বেড়ে ওঠতে পারে না। প্রজন্মকে হতে হবে জ্ঞানে-গুণে-মানে সবদিক থেকে সমৃদ্ধ। তাদের হতে হবে ইতিহাস ও অধিকার সচেতন। তরুণ প্রজন্ম একটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। তাদেরকে সঠিকভাবে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে একটা রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়।
প্রীতিলতাসহ অন্যান্য সকল বিপ্লবীদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস আমাদের জানতে হবে। আর এ জন্য ইতিহাস পড়তে হবে, চর্চা করতে হবে, গবেষণা করতে হবে।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আত্মদানকারী প্রথম নারী বীরকন্যা প্রীতিলতার এ বছর ৯১তম আত্মাহুতি দিবস। প্রীতিলতার মতো এমন বিপ্লবী দেশপ্রেমিক ফিরে আসুক যুগে যুগে শতবার। জাতির ক্রান্তিকালে প্রীতিলতার মতো বীরকন্যাদের বড়োই প্রয়োজন। বীরকন্যা প্রীতিলতার দুঃসাহসী মনোভাব, সংগ্রামীজীবন ও দেশপ্রেমিক চেতনা সংকটে সংগ্রামে প্রজন্মের জন্য প্রেরণার প্রতীক।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক; ফিচার সম্পাদক, দৈনিক ফেনী।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)’র ৩৬তম পুলিশ কমিশনার হিসেবে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)। জনবান্ধব, আধুনিক ও পজিটিভ পুলিশিংয়ের রোল মডেল হিসেবে যার জুড়ি মেলা ভার।
ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধানের পদ থেকে ব্যস্ততম ও জনবহুল ঢাকা মহানগরীর পুলিশ কমিশনার হিসেবে তার আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে জনমনে খুশির জোয়ার বইছে।
হাবিবুর রহমান এমনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা - যিনি তার মেধা, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা ও সততার গুণে পৌঁছে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। পুলিশ বিভাগে ধারাবাহিক সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পর্যন্ত তিনি তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। এছাড়া তিনি দুইবার সাফল্যেরসহিত বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন কর্মঠ ও নিবেদিত উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার বাইরে তিনি একজন সফল ক্রীড়া সংগঠক, লেখক, গবেষক, সমাজ সংস্কারক, সমাজ সেবক এবং বাংলাদেশ পুলিশ প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘ডিটেকটিভ’ এর সম্পাদকও। তার চেয়েও বড় কথা বহুমাত্রিক প্রতিভাসম্পন্ন হাবিবুর রহমানের বড়গুণ তিনি একজন আদর্শ ও মানবিক ব্যক্তিত্ব যা তাকে সবকিছু থেকে এগিয়ে রেখেছে।
হাবিবুর রহমান ছাত্রজীবনে পড়াশুনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন, কিন্তু সেটা নিজের জন্য নয় সেটি ছিল সমাজের উন্নয়নের জন্য। তার ছোট ছোট প্রতিবেদনে স্থান পেতো সমাজের বিভিন্ন জরাজীর্ণতা ও সাধারণ মানুষের কষ্টগুলো। সাংবদিকতার পেশা থেকে তিনি কোনদিন কোনো সুবিধা নেননি। তিনি শিখেছেন কোনো পরিবর্তন করতে হলে কোনো বিনিময় দিয়ে নয় বরং নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে করতে হয়। বলা যায়, এই সাংবাদিকতা পেশা থেকেই হাবিবুর রহমানের লেখালেখির হাতে খড়ি এবং এই অনন্য গুণটি পেশাগত জীবনে তাকে দিন দিন উচ্চতর স্থানে প্রতিষ্ঠিত করছে।
হাবিবুর রহমান ১৭তম বিসিএস ক্যাডার হিসেবে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। সারদাতে পুলিশিং প্রশিক্ষণকালে সকল সহকর্মীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। নিজের নেতৃত্ব ও সৃজনশীলতা দিয়ে প্রশিক্ষণ স্যুভেনির ‘আমার হলো শুরু’র সম্পাদক নির্বাচিত হন যেখানে নিজের গবেষণালব্দ লেখনিতে স্থান পায় বাংলাদেশ পুলিশের শেকড়সন্ধানী ইতিহাস, ঐতিহ্য ও করণীয় নির্ধারণ সম্পর্কিত নানান দিক। সাংবাদিকতার পর পুলিশ হিসেবে সেই যে লেখালেখি শুরু করলেন এরপর আর কখনো পিছু হটেননি। পুলিশে ঐহিত্যবাহী মাসিক ম্যাগাজিন ‘ডিটেকটিভ’ এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক পরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে এটির গুণগত, ভাষাগত ও প্রকাশনাগত আমূল পরিবর্তন এনে ডিটেকটিভকে পুরো পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি সমৃদ্ধ মুখপাত্র হিসেবে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন তিনি।
২০০৯ সালে ডিএমপি’র উপ-পুলিশ কমিশনার(সদর দপ্তর) পদে থাকাকালীন তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন যার মাধ্যমে সর্বপ্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশের অগ্রণী ভূমিকা প্রকাশ্যে আসে বেশ বড় পরিসরে। একই সময়ে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন ‘পুলিশ ব্ল্যাড ব্যাংক’ যা দেশের যে কোনো আধুনিক প্রাইভেট ব্ল্যাড ব্যাংকের মতোই উন্নত সেবাদানে সক্ষম। পুলিশ ব্ল্যাড ব্যাংক’ বর্তমান শুধু পুলিশ সদস্যদেরই রক্ত সরবরাহ করে না, যে কোনো প্রয়োজনে অসহায় ও মুমূর্ষু রোগীর পাশে দাঁড়াচ্ছে। পুলিশ ব্ল্যাড ব্যাংকের পথযাত্রা ছিল হাবিবুর রহমান এর অনন্য অবদান।
২০১২ সালে হাবিবুর রহমান ঐতিহ্যবাহী ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ঢাকা জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অভিনব সব কলা-কৌশল অবলম্বন করে ব্যপক প্রশংসিত হন। এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমগ্র জাতির সম্মূখে চিরস্মরণীয় কর রাখতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থিত টেলিকম ভবনের পাশে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এটি ২০১৩ সালে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং ২০১৭ সালের জাতীয় পুলিশ সপ্তাহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। জাদুঘরটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ, ইউনিফর্ম, বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট, র্যাংক ব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়ি, এমএম রাইফেলসহ অনেক কিছু সংরক্ষণ আছে। ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ গ্রন্থ সম্পদনা করে হাবিবুর রহমান কাগজে-কলমে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকাকে ইতিহাসে স্থান করে দেওয়ার জন্য অবদান রাখেন আর ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করে পুলিশের সেইসব অকুতোভয় অবদানসমূহকে প্রমাণ সাপেক্ষে বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই বিরল কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে হাবিবুর রহমান এর নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন তিনি সাভারে বসবাসরত ২০ হাজারেরও বেশি বেদে জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে বিভিন্ন কর্মমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বেদে জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে প্রাথমিকভাবে ১০৫ জন বেদে নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে পোড়াবাড়িতে কর্মসংস্থানের জন্য মিনি গার্মন্টস প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
সাপ খেলা দেখানোর পেশা থেকে ফিরিয়ে এনে ৩৫ জন বেদে যুবককে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রত্যেকের জন্য চাকুরীর ব্যবস্থা করা, কোচিং সেন্টার ও কম্পিউটার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে বেদে ছেলে-মেয়েদের পড়া লেখার অতিরিক্ত সুযোগ তৈরি করা, সরকারি সহযোগিতায় ১৮টি জরাজীর্ণ রাস্তা মেরামত করা, একটি মসজিদ নির্মাণ করা এবং স্থানীয় বেদে জনসাধারণের জন্য একটি পাকা ইদগাহ নির্মাণ করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন।
তিনি উত্তরণ ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যার মাধ্যমে সাভারের বেদে পল্লীর বাসিন্দাদের জন্য প্রায় ৩০০ টি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সাভারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মুন্সীগন্জের বেদে শিশুদের জন্যও গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল ও কম্পিউটার সেন্টার।
গত বছর মুন্সীগঞ্জের ১৯টি বেদে পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে যার ফলে তাদের মনে এখন স্বস্তির হাওয়া। বর্তমানে ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ ছাড়াও গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নাটোরের সিংড়া এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনমূখী কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া, ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জের বেদেদের জন্য ৫৯ টি ঘর নির্মাণ করে হাসি ফুটিয়েছে ভাসমান মানুষের মুখে। বলতে গেলে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৩৬ লাখ বেদে ও মান্তা সম্প্রদায়ের কাছে তিনি যেমন হয়ে উঠেছেন আশার বাতিঘর তেমনি তিনি এই জনগোষ্ঠীর সাড়ে চারশো বছরের অস্পৃশ্য ও গ্লানিময় জীবনের মুক্তিদূতও।
বেদে জনগোষ্ঠীদের উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেন তারা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় একটি আলাদা ভাষা ব্যবহার করেন। বেশ কিছুদিন যাবৎ এটি প্রত্যক্ষ করতে থাকেন এবং এই দুর্বোধ্য ভাষাটির প্রতি কৌতুহলী হন। তিনি বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে পরিচিত কয়েকজনকে ডেকে জানতে পারলেন যে এটি বেদে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা যার নাম ‘ঠার’। তিনি ভাষাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করেন এবং বেশকিছু শব্দ ও বাক্য নিজের নোট বুকে লিখে রাখেন। এরপর খোঁজ করতে থাকেন এই ভাষাটি আসলে কীভাবে এলো, কারা ব্যবহার করছে এবং বাংলাদেশের কোন কোন প্রান্তে এই ভাষাটি ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি তিনি এটি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি উপলব্দি করলেন যে ‘ঠার’ ভাষাটি বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর মধ্যে একটি এবং এই ভাষাটি সংগ্রহ বা সংরক্ষণে তেমন কোন কাজও হয়নি।
তিনি আরো জানতে পারেন, এই ভাষাটির আসলে কোনো লেখ্য রূপ নেই এবং এটি একটি কথ্য ভাষা। তাই বলে সাড়ে চারশো বছর যাবৎ বসবাস করে আসা একটি জনগোষ্ঠীর ভাষাটি অযত্নে বা অবহেলায় এভাবে হারিয়ে যাবে এই ভাবনা তাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। তিনি বিভিন্নভাবে ভাষাটি সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট অনেকের মাধ্যমে চেষ্টা করে দেখলেন যে আসলে যথাযথ তথ্য উপাত্তের অভাবে কেউই এটির গভীরে প্রবেশ করতে পারছেন না। ফলে নিজেই শুরু করলেন বিস্তর গবেষণা। ভাষা বিজ্ঞানের উপর দক্ষতা না থাকায় প্রথমে তাকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরের নিকট কিছুদিন প্রাইভেটও পড়েছেন যার ফলে ভাষা বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রপ্ত করতে সক্ষম হন তিনি। বিলুপ্তপ্রায় ঠার ভাষাটির আদ্যপান্ত উদ্ধার করে এটির পূর্ণ গঠন, পঠন ও ব্যবহারিক রূপ দিতে প্রায় আট বছর সময় লেগে যায়।
এই আট বছরের ব্যবধানে কর্মজীবনে হাবিবুর রহমান ঢাকা পুলিশ সুপার থেকে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ হেড কোয়াটার্সের অতিরিক্ত ডিআইজি (পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট -১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ হেড কোয়াটার্সের ডিআইজি (অ্যাডমিন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান পদে আসীন হবার আগে ২০১৯ সালের ১৬ মে থেকে তিনি ঢাকার রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা রেঞ্জের ১৩টি জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি পুলিশ হেড কোয়াটার্সের এক বিজ্ঞপ্তি মারফত রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।
অবশেষে গবেষণাগ্রন্থ ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ নামক এই অসাধ্য সাধনের কাজটি শেষ করেন বিশিষ্ট গবেষক ও ঋদ্ধ লেখক বাংলাদেশ পুলিশের তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ (মঙ্গলবার) বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে দেশবরেণ্য গুণীজনদের উপস্থিতিতে এক জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে বইটির মোড়ক উন্মোচিত হয়। বাংলা ভাষায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে হাবিবুর রহমানই প্রথম এমন কোন গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটির প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন আয়োজিত এই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।
দীর্ঘ ৮ বছরের নিরন্তর গবেষণার ফসল বেদে জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তপ্রায় ভাষা ‘ঠার’ নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। এরই ফলশ্রুতিতে এই গ্রন্থটি মাতৃভাষা সুরক্ষা, উন্নয়ন ও পুনরুজ্জীবনে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদকে ভূষিত হন হাবিবুর রহমান।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের অডিটরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইটির লেখক হাবিবুর রহমানকে এই বিরল সম্মাননা পদক তুলে দেন। ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ গ্রন্থটি রচনার জন্য এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ গত ২ মে ২০২৩ মালয়েশিতে ‘জো জো ইন্টারন্যাশনাল আইকোনিক স্টার অ্যাওয়ার্ড-২০২৩’ পদকে ভূষিত হয়েছেন হাবিবুর রহমান যেটি তার ব্যক্তি জীবন, কর্ম জীবন ও দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের।
শুধু বেদে জনগোষ্ঠী নয় হাবিবুর রহমান সমাজের পিছিয়ে পড়া হিজড়া বা তৃতীয়লিঙ্গের সদস্যদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে নানামূখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাদের জন্য বিউটি পার্লার, মিনি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী, গরুর খামার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনসহ ফুড ভ্যানের মাধ্যমে অনেকেই স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন। সম্প্রতি বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের মাঝে এই স্বাবলম্বী হওয়া হিজড়াদের পক্ষ থেকে ২২ লক্ষ টাকা অনুদানের বিষয়টি অসংখ্য মানুষের হৃদয় ছুয়ে গেছে। বেদে জনগোষ্ঠী ও তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের কল্যাণ ছাড়াও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার ১৩৪০ জন যৌন কর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছে তিনি। পল্লীর বাসিন্দাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের জন্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি তাদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছেন হাবিবুর রহমান।
করোনাকালীণ প্রথম কোন মৃত যৌনকর্মীকে ইসলামিক শরীয়া মোতাবেক দাফনকার্য সম্পাদন করে এবং প্রথম কোন যৌনকর্মীর কুলখানির আয়োজন করে তিনি সর্বমহলের প্রসংশা কুড়িয়েছিলেন। ইতিপুর্ব যৌনকর্মীরা মারা গেলে রাতের অন্ধকারে বা সকলের অগচরে মৃতদেহকে পদ্মা নদীর চরে বালুর মধ্যে গুঁজে রাখা হতো বা ইট/বালু ভর্তি বস্তা বেধে দিয়ে লাশ পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। হাবিবুর রহমানের উদ্যোগে যৌন পল্লীর বাসিন্দাদের জন্য বর্তমানে একটি স্থায়ী কবরস্থান তৈরি করা হয়েছে।
অনেক যৌনকর্মী ইতোমধ্যে নিজের পেশা বদল করে স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে। তিনি যৌনকর্মী ও তাদের কোলে জন্ম নেওয়া পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের সামাজিক পরিচয় রক্ষার জন্য দৌলতদিয়া পতিতা পল্লীর নাম পরিবর্তন করে ‘দৌলতদিয়া বাজার পূর্বপাড়া’ নাম রেখেছেন। যৌনকর্মীদের মানবাধিকার ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় হাবিবুর রহমানের এই বিরল কর্মকাণ্ডগুলো তুলে ধরা হয়েছে পুলিশ পরিদর্শক মো. জাহিদুর রহমানের রচনা ও নির্দেশনায় উপস্থাপিত ‘অচলায়তনের অপ্সরী’ মঞ্চ নাটকে।
ঢাকা রেন্জ ডিআইজি’র দায়িত্ব থাকাকালীন হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকার কেরানিগন্জে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (ওয়েসিস)। ওয়েসিস খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি শক্তপোক্ত প্রাতিষ্ঠানির কাঠামোর উপর দাড়িয়ে প্রায় ২০০ জন রুগীকে সেবাসশ্রুসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সহায়তা করেছে।
ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন হাবিবুর রহমান। তিনি ক্রীড়াঙ্গনে থিতিয়ে যাওয়া জাতীয় খেলা কাবাডিকে মূলধারায় তুলে এনেছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুনাম কুড়িয়ে চলেছেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে এখন তিনি বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক কাবাডি ফেডারেশনের সহ-সভাপতির দায়িত্বও সামলাচ্ছেন কার্যকরভাবে ।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারের নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনাটি নিয়ে বেশ কয়েক বছর গবেষণা করেন হাবিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পুর্নাঙ্গ রায় অ্যানালাইসিস করে নির্মম সত্য ঘটনাটিকে সমগ্র জাতির কাছে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন তিনি। অবশেষে এই জঘণ্য হত্যাজজ্ঞের পূর্ণাঙ্গ ঘটনার উপর ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নামে একটি মঞ্চ নাটক তৈরি করেন যা এক বছরেই ১০০ বারেরও বেশি মঞ্চস্থ হয়েছে, এমনকি এটি এখন বিশ্ব রেকর্ড করতে চলেছে। কারণ ইতিহাসে আর কোন মঞ্চ নাটক এক বছরে ১০০ বারের বেশি মঞ্চস্থ হয়নি। এছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক কিছু ছবি ও ছবির অন্তরালের গল্প নিয়ে ‘পিতা তুমি বাংলাদেশ’ নামে একটি ফটো অ্যালবাম প্রকাশ করেন। অন্যদিকে পুলিশকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন উক্তি ও বক্তব্য নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর কথা ও কলমে পুলিশ’ শিরোনামে প্রকাশনাধীন একটি বইয়ের সংকলন ও সম্পাদনা করছেন তিনি। যার ভূমিকা লিখেছেন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উল্লেখ্য, গত ৩ জানুয়ারী ২০২৩ এ, রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩' এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর লিখিত পত্রাবলী নিয়ে হাবিবুর রহমান সম্পাদিত 'চিঠিপত্র: শেখ মুজিবুর রহমান' এবং এর ইংরেজী সংস্করণ 'Letters of Sheikh Mujibur Rahman' শীর্ষক দু'টি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য দুটি বইতেই কো-এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন তারই সহকর্মী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. এনায়েত করিম ।
গোপালগঞ্জের পবিত্র ও উর্বর মাঠি ফুড়ে জন্ম নেওযা হাবিবুর রহমান এই দেশের ১৮ কোটি মানুষের অতি ক্ষুদ্রাংশের বৃহত্তর সমস্যাগুলো নিয়ে নিরন্তর লড়ে যাচ্ছেন - যে সমস্যাগুলোও ঠিক মানুষের তৈরি। হাবিবুর রহমান এই ধরিত্রীর একজন সুর্য সন্তান হিসেবে বাংলাদেশের মনুষ্যসৃষ্ট চলমান বৈষম্যগুলো দূর করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সফল হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ ব্যক্তি ও কর্মজীবনে হাবিবুর রহমান নিজের পুরোটাই সপে দিয়েছেন দেশের কল্যাণে, দেশের মানুষের কল্যাণে।
লেখক: এম এম মাহবুব হাসান
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটির যে চারজন সদস্য এখনও জীবিত, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। জীবিত বাকি তিন সদস্য হলেন ড. কামাল হোসেন (কমিটির সভাপতি), ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। মুন্তাকীম চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন অস্ট্রেলিয়ায়। শুধু বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখাই নয়, বরং তাকে বলা হয় বাংলাদেশ-জাপান বন্ধুত্ব তথা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্থপতি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে যেসব উন্নত দেশ বাংলাদেশের সূচনালগ্নেই স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং পাশে দাঁড়িয়েছিল, জাপান তার একটি। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় জাপান। এর এক মাসের মধ্যে ঢাকায় শুরু হয় জাপানি দূতাবাসের কার্যক্রম। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে জাপান হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশকে যত দেশ উন্নয়ন সাহায্য দেয়, জাপান সেই তালিকায় সবার ওপরে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ১৯৭২ সালের ১৩-১৪ মার্চ জাপানের সংসদ সদস্য তাকাশি হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। দেশে ফিরে হায়াকাওয়া বাংলাদেশকে অনতিবিলম্বে ১০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি অনুদান এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের হিস্যা আদায়ে জাপানের মধ্যস্থতা করার বিষয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব রাখেন। প্রধানমন্ত্রী সাতোর নির্দেশে ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ জাপান বাংলাদেশে প্রথম অর্থনৈতিক সার্ভে মিশন পাঠায়। (তথ্যসূত্র) ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, বণিকবার্তা, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।
এর পরের বছর ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাপানে শীর্ষ পর্যায়ের প্রথম সফরে বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। ওই বছরের ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় টোকিওতে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্কের পটভূমি তুলে ধরেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সহায়তা ও সমর্থনের জন্য জাপান সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
অবকাঠামো ছাড়াও বাংলাদেশের যোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য খাতে জাপানের সহায়তা অবিস্মরণীয়। আর বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের এই বন্ধুত্বের নেপথ্য নায়ক ব্যারিস্টার আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী; জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত।
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু তাকে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির সদস্য নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি
সিলেটের কানিহাটি জমিদার পরিবারের সন্তান মুন্তাকীম চৌধুরীর পুরো নাম আবু তাহের আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। জন্ম ২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯।মুন্তাকীম চৌধুরীর বাবা খান বাহাদুর তজম্মুল আলি চৌধুরী ছিলেন সিলেটের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম দিকের গ্র্যাজুয়েটদের অন্যতম। ১৯০০ সালের দিকে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসি ভাষায় অনার্সসহ বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের অধীনে আসাম সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি ১৯১৯ সালে আসামের বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি শহরের এসডিও ছিলেন। সারা জীবন তিনি ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি গোয়ালপাড়া জেলার ডেপুটি কমিশনার হিসেবে অবসরে যান।
মুন্তাকীম চৌধুরী আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আই.এ পাস করেন। তাঁর আত্মীয় জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার, প্রখ্যাত কূটনীতিক হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে একই রুমে থাকতেন। তিনি শান্তিনিকেতন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে লন্ডনের লিংকনস ইনে পড়াশোনা করেন। লিংকনস ইনেও তাঁর সহপাঠি ছিলেন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী।
পেশাগত জীবন
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৫৫ সালে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করার পর ১৯৫৬ সালে আইন পেশায় যোগ দেন। তিনি ঢাকা সিটি ল কলেজেরও খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। ১৯৮৭-৯০ সাল পর্যন্ত তিনি আইন বিষয়ক জার্নাল ডিএলআর-এর প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও পরে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবন
ভাসানী ন্যাপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিরোধী দলের চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনে অংশ নেন।
১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার অনেকবার সাক্ষাৎ হয়। আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর জামাতা প্রখ্যাত জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী জানান, ১৯৬২ সালে মুন্তাকীম চৌধুরী যখন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য, তখন বঙ্গবন্ধুকে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হলে মুন্তাকীম চৌধুরীকে যেন আওয়ামী লীগে যুক্ত করা হয়।
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ১৯৬২ সালে ১০ই নভেম্বর। এদিন ট্রেনযোগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের নেতারা সিলেটে যান। সিলেট রেলস্টেশনে তাদের বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। পরদিন ১১ই নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়, ট্রেনটি স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই সিলেটের রাজনীতিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সুধী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার মানুষ অধীর আগ্রহে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। ট্রেনটি সিলেট স্টেশনে পৌঁছালে উপস্থিত জনতার ‘গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কায়েম করো, শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ, দমন নীতি চলবে না’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। এই সফরে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, আবু হোসেন সরকার, পীর মোহসেন উদ্দীন, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, হোসেন মনসুর প্রমুখ। খবরে বলা হয়, একই ট্রেনে জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীও সিলেটে আসেন এবং সংবর্ধনাকারীদের সঙ্গে যোগ দেন।
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর কাছ থেকে ড. আবেদ চৌধুরী শুনেছেন, ট্রেনের কামরায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার অনেক কথাবার্তা হয়। বিশেষ করে তার আওয়ামী লীগের যোগদানের বিষয়ে।
এরপর ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকের একটি খবরের শিরোনাম: ‘অদ্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সিলেট যাত্রা।’ খবরে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান, জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরী এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ৫ দিনব্যাপী সিলেট জেলা সফরের জন্য আজ রাতে সিলেট যাত্রা করবেন। তারা রবিবার সুনামগঞ্জে, সোমবার সিলেটে, মঙ্গলবার বিয়ানী বাজারে, বুধবার হবিগঞ্জে এবং বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারে জনসভায় বক্তৃতা করবেন।
এর দুদিন পরে, অর্থাৎ ৩১ আগস্ট প্রকাশিত খবরের শিরোনাম: ‘মোসাহেবদের দ্বারা পুর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব নহে।’ অর্থাৎ ওইদিন সুনামগঞ্জ টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তৃতা দেন, সেখান থেকে একটি বাক্য উদ্ধৃত করে শিরোনামটি করা হয়। খবরে বলা হয়, এই জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরীও বক্তব্য দেন।
তার মানে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সালের আগস্টের মধ্যে কোনো এক সময় আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আবেদ চৌধুরী জানান, সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে একদিন রাতে তাজউদ্দিন আহমদকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে মুন্তাকীম চৌধুরীর বাসভবনে আসেন এবং তাকে আওয়ামী লীগে যোগদানের পরামর্শ দেন।
মুন্তাকীম চৌধুরী সম্ভবত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। এরপর থেকে তিনি জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে পরিচিত হন। ইত্তেফাকের সংবাদেও তাকে ‘জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যখন মুন্তাকীম চৌধুরী আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন, তখন তাঁকে এই কাজে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেন ড. আবেদ চৌধুরীর বড় ভাই আব্দুল মুক্তাদির জুবেদ চৌধুরী।
মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিলেট-৫ আসন থেকে জাতীয় পরিষদ (জাতীয় পরিষদ ১২৪) সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের পরে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটিতে তাঁকে যুক্ত করা হয় মূলত আইন ও সংবিধান বিষয়ে তার পাণ্ডিত্যের জন্য। পরবর্তীতে দেখা যাবে যে খসড়া সংবিধান নিয়ে গণপরিষদে যে বিতর্ক হয়েছে, সেখানে জনাব চৌধুরী অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। এমনকি কমিটির যে ছয় জন সদস্য সংবিধানের ওপর নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম।
গণপরিষদে ভূমিকা
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম বৈঠকে আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী গণপরিষদ পরিচালনার জন্য কার্যপ্রণালিবিধির ১৫ নম্বর ধারার ২ উপধারার বিষয়ে বৈধতার প্রশ্ন তোলেন। অর্থাৎ গণপরিষদ পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতি যে অস্থায়ী কার্যপ্রণালিবিধি দিয়েছিলেন, সেটি যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে এই পরিষদের এখতিয়ার ক্ষুণ্ন হয় কি না, তিনি সেই প্রশ্ন তোলেন। কেননা ১৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে, কার্যপ্রণালিবিধি তৈরি করবে পরিষদ। এ নিয়ে আরও একাধিক সদস্য প্রশ্ন তুললে তখন বঙ্গবন্ধু বক্তব্য দেন এবং বলেন যে, এই গণপরিষদে বসার জন্য একটি কার্যপ্রণালিবিধি দরকার। না হলে তারা কীসের ভিত্তিতে বসবেন? সেজন্যই রাষ্ট্রপতি একটি অস্থায়ী বিধি দিয়েছেন। অর্থাৎ এটি আপৎকালীন বিধি। এরপর আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের প্রস্তাব্তি বিধিটি পাসের জন্য পরিষদের সভাপতি ভোটে দিলে সেটি পাস হয়। (ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম, গণপরিষদ বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২১)।
গণপরিষদের দ্বিতীয় বৈঠকে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল কার্যপ্রণালিবিধির ৪৮ ধারা নিয়ে বিতর্ক উঠলে সে বিষয়েও বক্তব্য দেন মুন্তাকীম চৌধুরী।
পরিষদের দ্বাদশ বৈঠকে ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর সংবিধান বিলের ওপর আলোচনা করেন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। যেখানে তিনি বলেন, ‘এই সংবিধান বিবেচনা করতে গিয়ে সর্বপ্রথম আমাদের দেখতে হয় যে, এই সংবিধান-বিলে এ দেশের মেহনতী মানুষের, এ দেশের কৃষক- শ্রমিকের, এ দেশের নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে কি না। তা দেখতে গিয়ে সর্বপ্রথম বিবেচনা করতে হয় যে, আমাদের জনগণকে শোষণমুক্ত করার, আমাদের জনসাধারণের শোষণ-মুক্তির যে দাবি, সেটা এই সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছে কি না।’
মেহনতী মানুষের, কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি এবং শোষণমুক্তির ব্যবস্থা এই সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সংবিধানে এ দেশের জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ যারা সেই কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষ- তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই সংবিধানের ১৫ নম্বর ও ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদের মাধ্যমে তাদের সর্ববিধ উন্নয়নের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
সংবিধানে ২২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার-বিভাগকে পৃথক করার কথা তুলে ধরে আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ২৩৫ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এটা করতে চেয়েছে; কিন্তু সুনির্দিষ্ট ভাব তা করতে পারেনি। শুধু ভবিষ্যতের জন্য একটা ব্যবস্থা রেখেছে। কিন্তু আমরা আজকে এটাকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করে দিয়েছি।’
এই সংবিধান জনসাধারণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেকোনো দেশে যেকোনো অধিকারই দেওয়া হোক না কেন, সে অধিকার অবাধভাবে দেওয়া হয় না। রাইটের সঙ্গে অবলিগেশনের প্রশ্ন রয়েছে। সেটার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইনের মাধ্যমে এটা আনা হয়। তা না হলে কনফ্লিক্ট সৃষ্টি হতে পারে। আমরা শুধু আইনের মাধ্যমে এর ব্যবস্থা করেছি। সেই আইন যুক্তিযুক্ত কি না, জনসাধারণের নৈতিক স্বার্থে সে সব করা হয়েছে কি না, সেটা দেখার এখতিয়ার আদালতের আছে। অবাধ স্বাধীনতা নাই। সুতরাং, আমরা এখানে এ ব্যবস্থা করেছি।’
বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে যা বলেছিলেন
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট সম্পর্কে সাধারণভাবে একমত পোষণ করলেও এমপিদের সংসদ সদস্যপদ বাতিল সম্পর্কিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং চতুর্থ তফসিলের ১, ২ এবং ৩ নং দফা সম্পর্কে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিপত্র দেন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী।
৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানে এ রকম অনুচ্ছেদ যুক্ত করা একরকম অনিবার্য ব্যাপার। এটি আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কুফল থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। এর ফলে দলকে ভেঙে সংসদে আরেকটি দল গঠন ও ব্যক্তিগত বিবেচনায় দলীয় আনুগত্য পরিবর্তন করা রোধ হবে এবং এটি এই দেশে সঠিক সংসদীয় অনুশীলন ও প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। তবে এ দেশে সংসদীয় রাজনীতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন জনমত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড গাইড করবে এবং কোনো সদস্য জনমতকে উপেক্ষা করে দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না, তখন এ ধরনের বিধানের কোনো প্রয়োজন হবে বলে আমি মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা এ ধরনের বিধান ছাড়াই খুব ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু আমরা এ দেশে প্রথমবারের মতো সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করতে যাচ্ছি, সেহেতু আমাদের উচিত প্রাথমিক পর্যায়ে এর ওপর সম্ভাব্য যেকোনো আক্রমণের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। তাই অন্তত ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সংসদ সদস্যদের ওপর এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। কিন্তু এই বিধিনিষেধটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না কি একটি সাধারণ আইন দ্বারা আরোপিত হবে, তা বিবেচনার বিষয়। আমার মতে, বিদ্যমান রাজনৈতিক ধ্যানধারণার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি সাধারণ আইন দ্বারা আরোপ করা যেতে পারে। এ ধরনের একটি আইন বর্তমানে ভারতীয় লোকসভায় বিবেচনাধীন রয়েছে। আমি মনে করি, সাংবিধানিক বিধান ছাড়াই একই লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে ভালো হবে।’
তবে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি সংবিধানে যুক্ত করতেই হয়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের পরামর্শ দেন মুন্তাকীম চৌধুরী। এ জন্য তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হলেই কারো সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে, এই বিধান নিয়ে আরও আলোচনার প্রস্তাব দেন। কেননা তার মতে, এই বিধানটি অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির জন্ম দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটি এমনও হতে পারে যে একটি রাজনৈতিক দল দুই বা ততোধিক ভাগে বিভক্ত এবং দলের সম্পাদক যদি সংখ্যালঘু অংশের অন্তর্ভুক্ত হন, তবে তিনি সম্পাদক হিসেবে তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যার ফলস্বরূপ যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অন্তর্ভুক্ত, তাদের সংসদের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে।
এর পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক দলের সম্পাদক তার প্রভাব বলয়ের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে দলের অধিকতর প্রভাবশালী সদস্যদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করতে পারেন। এর একটি চরম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে একটি রাজনৈতিক দলের সম্পাদক যদি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হন, তবে তিনি তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যাতে সংসদে দলীয় প্রধানেরও সদস্য পদ বাতিল হতে পারে এবং ফলে তিনিই কার্যত সংসদীয় দলের নেতায় পরিণত হবেন।
এ রকম বাস্তবতায় ৭০ অনুচ্ছেদের এই বিধানটি বাতিল করে তিনি একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। সেটি হলো, কোনো সংসদ সদস্য যে দলের টিকিটে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যদি ভোট দেন, তবে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে এবং এই ক্ষেত্রে দলের আস্থা রয়েছে এমন সংসদীয় দলের নেতা কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে স্পিকারকে কাজ করতে হবে। তিনি মনে করেন, ৭০ অনুচ্ছেদের মতো একটি বিধান গ্রহণ করতে হলে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্লিখন জরুরি।
সংবিধান কার্যকরের এক বছরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তাব
সংবিধানের চতুর্থ তফসিল (অনুচ্ছেদ ১৫৩ ক) ক্রান্তিকালীন বিধানাবলির অধীনে দফা ১, ১ক এবং ১খ সম্পর্কে মুন্তাকীম চৌধুরী যে পরামর্শ দেন তা হলো: সংবিধান প্রবর্তনের পরপরই নির্বাচন হতে হবে এবং সম্ভব হলে প্রথম নির্বাচনের তারিখ সংবিধানেই উল্লেখ থাকতে হবে। নির্বাচন সাপেক্ষে অন্তর্বর্তী সময়ে দেশ পরিচালনার জন্য সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান থাকা উচিত বলে তিনি মত দেন।
তার প্রস্তাব, খসড়া সংবিধানে বিধান করা হয়েছে যে সাধারণ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের শাসন সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যেভাবে ছিল সেভাবেই চলবে। এই ধারার অর্থ খুব স্পষ্ট নয় এবং এটি নিশ্চিতভাবেই বিভ্রান্তির জন্ম দেবে। এখানে স্পষ্টভাবে বর্তমান গণপরিষদ ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অতএব আরও স্পষ্টীকরণসহ উপরিউক্ত ধারা যুক্ত করা আবশ্যক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কোনো পরিবর্তন করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর থাকবে কি না? ক্রান্তিকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে যাবে, এমন অবস্থার বিষয়ে বিধান সৃষ্টি করা প্রয়োজন। গণপরিষদ ভেঙে যাওয়ার পর যিনি গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা অর্জন করতে পারেন এমন ব্যক্তিকে নির্বাচন করা সম্ভব হবে কি না। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিকল্প বিধান সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
এরকম বাস্তবতায় (ক) সংবিধান অনুযায়ী প্রথম নির্বাচনের শেষ তারিখ সংবিধানে উল্লেখ থাকতে হবে। (খ) সংবিধানের সূচনা থেকেই গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে স্পিকার আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বহাল থাকবেন। (গ) নির্বাচনের পর সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সরকার (মন্ত্রিপরিষদ) সংবিধান প্রদত্ত মন্ত্রিসভার সব ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা প্রয়োগ ও ভোগ করতে পারবে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় যেকোনো পরিবর্তন, সংযোজন বা সমন্বয় করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর থাকবে—এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিকল্প বিধান সৃষ্টি করা প্রয়োজন । তদুপরি, প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতিকে ক্রান্তিকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে একজনকে নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হবে। (ঘ) যদি ওপরের (ক) তে প্রস্তাবিত প্রথম নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব না হয় অথবা যদি প্রথম নির্বাচনের শেষ তারিখটি সংবিধান প্রণয়নের সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে নির্ধারণ করা না যায়, তবে বর্তমান গণপরিষদকে সংবিধান দ্বারা প্রদত্ত সমস্ত ক্ষমতাসহ ক্রান্তিকালীন সংসদ হিসেবে পরিচালিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত। তবে শর্ত থাকে যে এই জাতীয় সংসদের মেয়াদ কোনো অবস্থাতেই এক বছরের বেশি হবে না এবং এটি নির্বাচনের অন্তত ৩০ দিন আগে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে সংবিধান কার্যকরের এক বছরের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। যেটি বিশেষভাবে বিবেচ্য, দেশকে কোনোভাবেই শূন্য অবস্থায় রাখা বাঞ্ছনীয় নয় এবং ওপরের (ক) অথবা (খ)-তে প্রস্তাবিত বিধান প্রণয়ন করা একান্ত অপরিহার্য।
ড. আবেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর বড় মেয়ে টিউলিপ চৌধুরীর স্বামী অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। তার বাবা আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর চাচাতো ভাই। অর্থাৎ মুন্তাকীম চৌধুরীর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে থেকেই তারা পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। ১৯৮৩ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আবেদ চৌধুরী ও টিউলিপ চৌধুরী।
আবেদ চৌধুরী জানান, তার শ্বশুর দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। এ মুহূর্তে রয়েছেন মেলবোর্ন শহরে। বয়স যেহেতু ৯০ পেরিয়েছে, ফলে শারীরিক অবস্থা খুব ভালো নয়। কিছুটা স্মৃতিভ্রমও হয়েছে। সবকিছু মনে করতে পারেন না।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন জাপানে যান, মুন্তাকীম চৌধুরী তখন জাপানের রাষ্ট্রদূত। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, জাপানে মুন্তাকীম চৌধুরীর বাসায় বঙ্গবন্ধুর দুই পাশে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন টিউলিপ চৌধুরী এবং এবং তার ছোট বোন পিওনী চৌধুরী। পিওনী চৌধুরী তার মেয়ে সামারা চৌধুরীকে নিয়ে বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।
আবেদ চৌধুরী জানান, মুন্তাকীম চৌধুরী ছিলেন জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত। প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন মনোরঞ্জন ধর। জাপানের সঙ্গে এখন বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, তার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন মুন্তাকীম চৌধুরী।
বাহাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। এরপর তাঁকে জাপানের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়া ও পূর্ব জার্মানিতেও দায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সিলেটের আওয়ামী রাজনীতির টানাপোড়ের কারণে স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু তাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। এ নিয়ে তার (বঙ্গবন্ধু) মনে আক্ষেপ ছিল। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও সুদর্শন মুন্তাকীম চৌধুরীর জন্য রাষ্ট্রদূতের কাজ অবধারিত ছিল এবং তিনি এই দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি মুন্তাকীম চৌধুরী। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন। পরবর্তীতে মেয়ের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান।
আবেদ চৌধুরী জানাচ্ছেন, জাপানের সংসদ সদস্য হায়াকাওয়ার সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরীর সুসম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন। মুন্তাকীম চৌধুরীর কাছ থেকে আবেদ চৌধুরী ঘটনাটি শুনেছেন। সেটি হলো, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার সংবাদ শোনার পরে মি. হায়াকাওয়া ভীষণ মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করে একটি হাইকু (একধরনের জাপানি কবিতা) লিখে সেটি পড়েন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। আবেদ চৌধুরীর ভাষায়, তার শ্বশুর মুন্তাকীম চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে জাপান ও কোরিয়ার বন্ধুত্ব স্থাপনের ‘আর্কিটেক্ট’। রাজধানী ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁও তৈরি হয় হাওয়াকাওয়ার উদ্যোগে, যেখানে বড় ভূমিকা রাখেন মুন্তাকীম চৌধুরী। বাংলাদেশে পোশাক খাতেরও অন্যতম উদ্যোক্তা মুন্তাকীম চৌধুরী।
মুন্তাকীম চৌধুরীকে ‘প্রচারবিমুখ’ মানুষ উল্লেখ করে আবেদ চৌধুরী বলছেন, তিনি যখন শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন, তখনও খুব বেশি জনসমক্ষে আসতেন না। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয় এড়িয়ে চলতেন। রাজনীতিতে গিয়ে নিজের প্রচারে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর দুই সন্তানও রাজনীতিতে যুক্ত হননি।
লেখক: কারেন্ট এফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির পাল্টাপাল্টি আলটিমেটামের কারণে চলমান রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে নতুন করে উত্তাপ তৈরি হয়েছে। দুই দলের এ পাল্টাপাল্টি আলটিমেটামের মূল টার্গেট ঢাকা দখলে নেওয়া। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন অসুস্থ খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসা নিতে বিদেশ পাঠাতে রবিবার বিএনপি ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে। পাল্টা জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও একই পথে হেঁটেছে। বিএনপিকে ‘আগুন সন্ত্রাস, অপরাজনীতি ও নাশকতার রাজনীতি’ ছাড়ার জন্য সোমবার ৩৬ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। এরপর পাল্টা ৩৬ ঘণ্টার হুঁশিয়ারি এসেছে বিএনপির কাছ থেকে।
তার আগে গত শনিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে আবেদন করলে অনুমতির বিষয়টি দেখা যাবে। তবে তার কাছে এরকম কোনো কাগজপত্র আসেনি। ওইদিনই খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার বলেছেন, সরকারের মনোভাব ইতিবাচক হলে তারা আবারও আবেদন করবেন।
পরদিন রবিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আলটিমেটাম দেন। ওইদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে বিএনপি বলছে, সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারে।
দুই দলের রাজনীতি ও ঘোষিত আলটিমেটাম মাঠের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে কি না, সে সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। বিএনপির আলটিমেটামের ফল কী হবে আর আওয়ামী লীগেরও দীর্ঘ ৩৬ দিনের আলটিমেটাম কেন এ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতর বেশ কৌতূহল দেখা দিয়েছে।
দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত রাজধানী ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এমন পাল্টাপাল্টি আলটিমেটাম। ঢাকায় বিএনপির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার কৌশলের অংশ হিসেবেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ইস্যুতে দলটি আলটিমেটাম দিয়েছে। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতেই তার পাল্টা জবাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
দুই দলের ওই নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে ঢাকা শহর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা। ঢাকার রাজনীতি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে আনতে না পারলে রাজনীতিতে জুতসই অবস্থান সৃষ্টি করতে পারবে না বিএনপি।
সারা দেশের নিয়ন্ত্রণে রাখা ও নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেয়ে ঢাকা শহর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাজনৈতিক জয়-পরাজয় নির্ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিএনপির ওই শীর্ষসারির নেতারা। তাই বিএনপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসাকে ইস্যু করে নেতাকর্মীদের ঢাকায় ডেকে পাঠানোর কৌশল গ্রহণ করেছে। পর্যাপ্ত নেতাকর্মী ঢাকায় ঢুকে গেলে অবস্থা বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তাই ইস্যু খালেদার চিকিৎসা, কিন্তু লক্ষ্য ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ৩৬ দিনের আলটিমেটামের পেছনে রয়েছে নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার আগপর্যন্ত ঢাকায় নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখা। সেই সঙ্গে নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে নির্দেশনা দিয়ে রাখা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, বিএনপি নির্বাচন বানচাল করতে ততই ষড়যন্ত্রের নীল নকশা আঁকছে।’ তিনি বলেন, ‘জনগণের শান্তি যেন বিঘিœত না হয়, সেজন্যই আমরা বিএনপির কর্মসূচির দিন মাঠে থাকি। বিএনপিকে জনগণ বিশ্বাস করে না। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশে সত্যিই নিতে চাইলে আলটিমেটাম কেন দেবে বিএনপি? আইনি জটিলতা নিরসন করে বিদেশ নেওয়ার চেষ্টা করবে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘বিএনপি সন্ত্রাস-সহিংসতানির্ভর রাজনীতি করে, বিশ্বাস করে। তারা পাকিস্তানের প্রেতাত্মা।’ তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করাতে চাইলে কেন বিএনপি আইনি প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে না? তার কিছু হলে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দায় নিতে হবে।’
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দুই দলের ঘোষিত আলটিমেটামকে কথার বাকযুদ্ধ হিসেবে নিয়েছেন। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এগুলো হচ্ছে। আওয়ামী লীগের অবস্থান ধরে নেওয়া যায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে তাদের কোনো গা নেই। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিভিন্ন বক্তব্যে সেটাই স্পষ্ট করেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিতে হলে আইনগতভাবে যেতে হবে। নির্বাহী কোনো সিদ্ধান্তে এ সুযোগ দেওয়া হবে না। ফলে আলটিমেটাম মূলত নিষ্ফল হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দাবি আদায় করার জন্য জনগণ থেকে দাবি উঠতে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণকে রাস্তায় নামাতে পারবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারবে না।’ তিনি বলেন, ‘এখন যেসব বক্তব্য এগুলো মঞ্চের বাকযুদ্ধ।’
বিএনপির আলটিমেটাম নিয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি (গতকাল মঙ্গলবার) সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষ করে এসেছি।’ আলটিমেটামের পেছনে ঢাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় তো আমরা সভা-সমাবেশ করছিই।’
জানতে চাইলে বিএনপির আরেক নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘আলটিমেটাম সম্পর্কে ক্লিয়ার কিছু জানি না।’
বিএনপিকে ‘অপরাজনীতি’ ছাড়তে ৩৬ দিন সময় বেঁধে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ সময়ের মধ্যে ‘সঠিক পথে’ না এলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির ‘অপরাজনীতির কালো হাত’ গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে আলটিমেটাম দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এটি বিএনপির জন্য শেষ বার্তা।’ গত সোমবার রাজধানীর উত্তরায় এবং যাত্রাবাড়ীতে পৃথক সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। উত্তরার সমাবেশে ওবায়দুল কাদের এ আলটিমেটাম দেন।
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপি দুই সপ্তাহের কর্মসূচি নিয়ে এখন রাজপথে আছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও ২১ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকায় গত সোমবার দুটি সমাবেশ হয়।
এর আগে থেকেই ঢাকায় বিএনপির কর্মসূচির দিন শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনরা বিএনপির সভা-সমাবেশের বিষয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করলেও মাঠের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েনি।
ভারতের বিপক্ষেই খেলেছিলেন বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ। এবার বিশ্বকাপটাই ভারতে, যে ধর্মশালা দিয়ে শুরু হবে বিশ্বকাপ অভিযান, সেখানেই আছে বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরির কৃতিত্ব। হিমালয়ের কোলে, ছবির মতো সুন্দর সেই মাঠে আবারও খেলবে বাংলাদেশ, কিন্তু খেলবেন না তামিম ইকবাল।
অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। বরাবরের মতো সংবাদ সম্মেলনে নিরাবেগ কণ্ঠে একের পর এক নাম পড়ে শোনাননি প্রধান নির্বাচক, গভীর রাতে কোনো ইমেইলেও আসেনি খেলোয়াড় তালিকা। বিশ্বকাপগামী ১৫ ক্রিকেটারের প্রত্যেকের হাতে হাতে সুন্দর করে বাক্সবন্দি বিশ্বকাপ জার্সি তুলে দেওয়ার ভিডিও নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে ২০২৩ বিশ্বকাপের জন্য নির্বাচিতদের পরিচিত করেছে বিসিবি। এজন্য বিসিবির সংশ্লিষ্টরা বাহবা পেতেই পারেন, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড যেমনটা হৃদয় জিতে নিয়েছে ক্রিকেটারদের পরিবারের আপনজনদের দিয়ে বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করিয়ে।
কারা থাকছেন আর কারা থাকছেন না, তা নিয়ে খুব বড় কোনো চমক ছিল না বিশ্বকাপ দলে। সবাই শুধু একটাই কোটি টাকার প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন। তামিম ইকবাল শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ দলে আছেন নাকি নেই। অবসর, প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে প্রত্যাবর্তন, ব্যক্তিগত কাজে দুবাই ভ্রমণ, ইংল্যান্ডে ইনজেকশন, দেশে অনুশীলন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক ইনিংসে ব্যাট করে ৪৪ রান এবং পরে নিজেকে আবারও পুরোপুরি ফিট নয় বলে পরের ম্যাচে বিশ্রাম। স্বভাবতই এই তামিম ইকবালকে বিশ্বকাপে দেখতে চাইবেন না কোনো কোচ এবং অধিনায়ক। সোমবার গভীর রাতে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বাসায় সাকিবের ছুটে যাওয়া এবং সিডনি থেকে নেমে তড়িঘড়ি করে বোর্ড সভাপতির বাসায় কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পা রাখাই প্রমাণ করে, বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করতেই তাদের এ তৎপরতা।
তামিমের মতো ক্রিকেটারকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা সহজ নয়। নিঃসন্দেহে দেশের সফলতম ব্যাটসম্যান, ওয়ানডেতে ১৪টা সেঞ্চুরি। হুট করে অবসর নিলে যাকে ফিরিয়ে আনেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী। সাক্ষাৎকারেও তামিম বলেছেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগের কথাও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেশাদারির কাছে হার মেনেছে আবেগ, যুক্তির কাছে হেরে গেছে অতীত। তামিম নামটা আছে বিশ্বকাপ দলে, তবে পদবিটা ইকবাল নয়। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের বাঁহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তানজিদ হাসান তামিমকে নিয়েই বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান, যার বয়স আর তামিম ইকবালের ক্যারিয়ারের বয়স প্রায় কাছাকাছি।
২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরম্যান্স ছিল অতিমানবীয়। ৬০৬ রান আর ১১ উইকেট। তবু দল হলো অষ্টম। গোটা আসর চোটজর্জর অধিনায়ককে বইল দল। প্রতিটি সকাল শুরু হতো এক অনিশ্চয়তা নিয়ে, খেলতে পারবেন তো মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা? শুরুর দিকে নতুন বলে কোনো উইকেট ফেলতে পারেনি বাংলাদেশ, প্রতিপক্ষ গড়েছে রানের পাহাড়। সেই অভিজ্ঞতা কী করে ভুলবেন সাকিব। অস্ট্রেলিয়ান জেমি সিডন্স আর অধিনায়ক সাকিব এজন্যই ২০১১ সালের বিশ্বকাপে দলে রাখেননি চোটগ্রস্ত মাশরাফীকে। হাথুরুসিংহে জাতীয়তায় শ্রীলঙ্কান হলেও অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে থাকতে হয়ে গেছেন তাদের মতোই পেশাদার। তাই তো কঠিন সিদ্ধান্তটা নেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন।
কাল বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডের পর সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন জাতীয় নির্বাচকরা। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন এবং দুই নির্বাচক হাবিবুল বাশার ও আবদুর রাজ্জাক। তামিমকে বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে মিনহাজুল শুনিয়েছেন মুখস্থ কথাই, ‘আপনারা তো এবারের বিশ্বকাপের দলটা এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন। তামিম ইকবালের তো অনেক দিন ধরেই ইনজুরি নিয়ে চিন্তা আছে। নিউজিল্যান্ড সিরিজের পর... সবকিছু বিবেচনা করেই, সবাই আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিশ্বকাপে অনেক দিনের ব্যাপার। অনেক ম্যাচ আছে।’
তামিমের চোটটা তো নতুন নয়। অনেক দিন ধরেই এ চোট নিয়ে তিনি ভুগছেন, নিজের ইচ্ছামতো ভারতের বিপক্ষে সিরিজ, আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ এসব থেকে নিজেকে সরিয়েও রেখেছিলেন। চিকিৎসাও করিয়ে আনা হয়েছে। সবকিছু জেনেশুনে কেন তাকে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে সুযোগ দেওয়া এবং ম্যাচ খেলিয়ে বাদ দেওয়া এ প্রসঙ্গে মিনহাজুলের উত্তর, ‘দেখুন, কিছু কিছু ইনজুরি আছে আপনি ঝুঁকি নিতে পারেন না। টিম ম্যানেজমেন্ট কিন্তু বেকায়দায় পড়বে। আপনি দেখুন, নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রথম ম্যাচ খেলার পর দ্বিতীয় ম্যাচে... প্রথম ম্যাচ খেলেছে, দ্বিতীয় ম্যাচটা খেলেছে... এরপর কিন্তু শেষ ম্যাচে বিশ্রাম দিতে হয়েছে।’
‘তামিম অন্যতম সেরা। কিন্তু চোটের দুশ্চিন্তা থাকলে নিজেকে মেলে ধরা কঠিন। মেডিকেলের সঙ্গে আলোচনা করেছি, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। এটা আগেই বলেছি, এখন দল ঘোষণা করা হয়েছে’বলছিলেন প্রধান নির্বাচক। বিসিবি সভাপতি বা সাকিব ও কোচের সঙ্গে আলাপ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কী আলাপ হয়েছে সেটা তো এখানে প্রকাশ করব না।’
১০ দলের বিশ্বকাপে দশম দল হিসেবে বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। কেন এত দেরি, ফ্লাইটে ওঠার ২৪ ঘণ্টারও কম সময় আগে বিশ্বকাপের দল দেওয়া হলো কেন এ নিয়ে হাবিবুল বাশারের ব্যাখ্যা, ‘আমাদের সঙ্গে কী হয়েছে সেটা তো আমাদের সঙ্গের ব্যাপার। দল নির্বাচন করতে যখন বসি... খেলোয়াড় হিসেবে তামিমের... আমরা সুস্থ-সবল তামিমকে পেতে... এটা নিয়ে আমাদের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত ভাবতে হয়েছে। তাই দেরি হয়েছে।’
তামিমের বাদ পড়ার ডামাডোলে হারিয়ে গেছে মাহমুদউল্লাহর ফেরাটাও। সেই ইংল্যান্ড সিরিজের পর বিশ্রামের মোড়কে বাদ পড়েছিলেন। তার বদলে অনেক বিকল্প খুঁজেও শেষ পর্যন্ত ঘুরেফিরে আবার তার কাছেই ফিরলেন নির্বাচকরা। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ৪৯ আর ২১ রানের দুটো ইনিংসেই হয়ে গেছে বিশ্বকাপের টিকিট। প্রধান নির্বাচক বললেন, ‘আগেই বলেছি, বিশ্বকাপের আগে যেকোনো খেলোয়াড়কে যেকোনো সিরিজে দেখব। ও পরিকল্পনাতেই ছিল। নিউজিল্যান্ড সিরিজে দেখেছি।’
২০১৫ সালের বিশ্বকাপের আগে, মাত্র দুই ম্যাচ দেখে সৌম্য সরকারকে দলে নিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। তানজিদ তামিম আর তানজিম সাকিব নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। যথাক্রমে মাত্র পাঁচ আর দুই ম্যাচ খেলে তারা বিশ্বকাপ যাত্রার সঙ্গী হয়েছেন। এমন নয় যে, এ স্বল্প সময়ে দারুণ কিছু করে দেখিয়েছেন, প্রধান কারণ বিকল্পের অভাব।
শুধু তামিম ইকবালই নয়, দলের লজিস্টিক ম্যানেজারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তার বড় ভাই ও সাবেক খেলোয়াড় নাফিস ইকবালকেও। তামিমের অবসর-কা-ে তিনি বিসিবি সভাপতির মেসেজের জবাব দেননি, যা পাপন নিজে বলেছেন গণমাধ্যমে। হয়তো তারই প্রতিশোধ, সেই সঙ্গে ড্রেসিংরুমের সঙ্গে তামিমের সব সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।
অবসর ভেঙে ফিরেছিলেন তামিম, দুটি ম্যাচ খেললেন। কিন্তু যেভাবে বাদ পড়লেন, তাতে মনে হতে পারে অবসরের সিদ্ধান্তটাই ছিল সঠিক। বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগামীতেও তামিমের দলে ফেরাটা বোধহয় অনিশ্চিতই হয়ে গেল।
তামিম প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে দলটা কেমন হয়েছে দেখা যাক। পাঁচ পেসার, দুই অফ স্পিনার, দুই বাঁহাতি স্পিনার মিলিয়ে বোলিং আক্রমণটা নেহায়েত খারাপ নয়। লিটন দাসের সঙ্গে তানজিদ তামিম অথবা মেকশিফট ওপেনার মিরাজ। সহঅধিনায়কের পদ থেকে বাদ পড়েছেন লিটন, সেটা করা হয়েছে নাজমুল হোসেন শান্তকে। সাকিব, মুশফিক, তাওহীদ হৃদয়দের নিয়ে মিডল অর্ডারের পর ফিনিশার রোলে মাহমুদউল্লাহ। এ নিয়েই ধর্মশালায় আফগানদের বিপক্ষে লড়াইয়ের শুরু। প্রত্যাশা অনেক বড়, প্রস্তুতি গোলমেলে। ভরসা একটাই, শুরুর আগে পরিস্থিতি এমন গোলমেলে হলেই কেন যেন ভালো করে বাংলাদেশ!
বিশ্বকাপ দল : সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক), মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, নাজমুল হোসেন (সহঅধিনায়ক), তাওহীদ হৃদয়, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, হাসান মাহমুদ, শরীফুল ইসলাম, নাসুম আহমেদ, মেহেদি হাসান, তানজিদ হাসান, তানজিম হাসান ও মাহমুদউল্লাহ।
তামিম ইকবাল দলে না থাকাতে যেন অনেকেরই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে! আবার বিশ্বকাপের দলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অন্তর্ভুক্তিতেও অনেকের চোখ কপালে! দল ঘোষণার পর যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকরা এলেন সংবাদ সম্মেলনে, তখন আলোচনায় শুধু ছিলেন এই দুজনেই। তাদের এই বিরহ বেদনায় চাপা পড়ে যায় অনেক প্রশ্ন। লিটন দাসকে বাদ দিয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত কেন সহ-অধিনায়ক! বাড়তি কোনো ওপেনার ছাড়া কিংবা পাঁচ পেসারকে নিয়ে কেন দল গড়া?
প্রায় মিনিট পনেরোর সংবাদ সম্মেলনে ঘুরে ফিরে এসেছে একই প্রশ্ন। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও ঘুরেফিরে বন্দী ছিলেন একই কথার বৃত্তে। প্রশ্নোত্তর শেষে বেরিয়ে যান তিন নির্বাচক। যেতে যেতে কথা হয় তাদেরই একজন হাবিবুল বাশারের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল চাপা পড়া সেইসব প্রশ্নের উত্তর।
শুরুতেই জানতে চাওয়া হয় লিটনকে বাদ দিয়ে শান্তকে কেন সহ-অধিনায়ক করা হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যৎ একটা কারণ। আর লিটনের অনাগ্রহও তাকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর একটি কারণ। লিটন নিজেও চায় না নেতৃত্বের চাপ নিতে। সে একটু ব্যাটিংয়ে বেশি মনোযোগ দিতে চায়।’
বিশ্বকাপ দলে বিকল্প ওপেনার না থাকার কারণও জানা গেল এই নির্বাচকের কথায়। তিনি জানালেন, ‘আমরা ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে মিরাজকে ভাবছি।’
বিকল্প ওপেনার হিসেবে বিশেষজ্ঞ কাউকে না নেওয়ায় একজন বাড়তি বোলার দলে রাখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে শেখ মেহেদি হাসান সুযোগ পেয়েছেন সে কারণে। পাশাপাশি জায়গা হয়েছে পাঁচ পেসারেরও। এর পেছনে বাশার ভারতের কন্ডিশনের কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভারতে এখন আর্লি সিজন। উইকেট সতেজ থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই পাঁচজন পেসার দরকার হবে।’
যেতে যেতে আরও বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক মুখোমুখি হলেন, এই দলটা বিশ্বকাপে কেমন করবে? এই প্রশ্নটা শুনেই ঘুরে দাঁড়ালেন হাবিবুল। উত্তরে মজা করে বললেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হবে এই দল।’ এরপর একটু গাম্ভীর্য ফিরিয়ে এনে যোগ করলেন, ‘আমি এদের অনেক দিন ধরে দেখছি। ওরা কয়টা ম্যাচ জিতবে জানি না। তবে বিশ্বকাপে প্রতিটি দলকে ভোগাবে, এটা জানি।’
জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগলের ২৫তম জন্মদিন আজ। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর স্ট্যানফোর্ডের দুই পিএইচডির ছাত্রের হাত ধরে যাত্রা শুরু। ভাড়া করা গ্যারেজে জন্ম নেওয়া সেই গুগল আজ বিশ্বের বৃহত্তম সার্চ ইঞ্জিন; পরিণত হয়েছে ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে। কীভাবে দরজা আটকাবেন বা কীভাবে কাটবেন আনারস— গুগলে উত্তর পাবেন না এমন প্রশ্ন খুঁজে মেলা ভার। তাইতো মানুষের কাছে এত জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে গুগল।
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর গুগল ২৫তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বিশেষ ডুডল তৈরি করে বর্ণাঢ্য আকারে উদ্যাপন করেছে দিবসটি। এবারের ডুডলটি তৈরি করা হয়েছে এর বিবর্তনের থিম ধরে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গুগলের লোগোর পরিবর্তন উঠে এসেছে ডুডলে।
কম্পিউটার বিজ্ঞানের দুই শিক্ষার্থী ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিনের প্রকল্প হিসেবে শুরু করেছিল এ সার্চ ইঞ্জিন। নিজেরদের ছাত্রাবাসে বসেই কাজ শুরু করেন দুজন। বড় আকারের সার্চ ইঞ্জিনের প্রোটোটাইপ তৈরি করার পর একটি ভাড়া করা গ্যারেজে অফিস স্থাপন করেন তারা। এখন সারা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন ও ইন্টারনেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে গুগল।
চলুন গুগল নিয়ে একটা মজার তথ্য জানাই আপনাদের। আমাদের সবার পরিচিত নাম গুগল নামটি কিন্তু ইচ্ছা করে দেননি ল্যারি ও ব্রিন। গুগল নামটি আসলে এসেছে গাণিতিক হিসাবের গোগল (googol) ভুল করে লেখার মাধ্যমে, যার মানে হলো ১ এর পর ১০০টি শূন্য। এ নিয়ে এখন গল্প প্রচলিত আছে যে, একজন প্রকৌশলী বা ছাত্র আসল নামের বদলে এই ভুল বানানটি লিখেছিলেন। সেই ভুল নামই পুরো দুনিয়ার সামনে চলে আসে। কেন এই নাম বেছে নিয়েছিলেন ল্যারি আর সের্গেই? তাদের ওয়েবসাইট যে বিপুল পরিমাণ উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি, অনুসন্ধান করবে, সেটা এই নাম দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন তারা। সেই ভুল নামই গুগল!
স্থায়ীভাবে ঢাকা বসবাসের আমার ষাট বছর পূর্ণ হলো। এই ষাট বছরে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ঢাকার উত্থান-পতন, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, আন্দোলন-অভ্যুত্থানসহ অনেক কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি। যখন ঢাকায় প্রথম এসেছিলাম তখন মনে হতো ঢাকা একটি বড় গ্রাম। এখানে গ্রামের মতোই বৃষ্টি হয়, অমাবস্যা পূর্ণিমা হয়, শীত-গ্রীষ্ম হয়। ভারী থেকে লঘু বর্ষণ হয়। ঢাকার চারদিক বর্ষার পানিতে প্লাবিত হয়। সদরঘাট, চকবাজার, সোয়ারীঘাট, ইসলামপুর এসব ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের এলাকা। গুলিস্তানকে ঘিরে বিপণি কেন্দ্রগুলো বিকশিত হতে শুরু করে। মতিঝিল গড়ে উঠছে। ঢাকার উন্নয়নের জন্য ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট সংক্ষেপে (ডিআইটি)’র কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তখনো ধোলাইখাল অতিক্রম করে কোর্টকাচারি, জগন্নাথ কলেজ, সদরঘাটের দিকে যেতে হতো। ঢাকা শহরের আবর্জনা নিষ্কাশনের জন্য আর্মেনিয়ানদের উদ্যোগে ধোলাইখাল চালু হয়েছিল।
ঢাকা শহরের ১৬১০ সালের আগে ও পরের মানচিত্র দেখলে বোঝা যায় যে শহরটা কী রকম খাল-বিল-নালা দিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। যে কারণে শহরটি কখনোই ডুবে যাওয়ার কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। সেই সময়ে একমাত্র যাতায়াতের উপায় ছিল নৌকা। এর মধ্যেই ১৬১০ সালে ইসলাম খাঁ রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। বহুকষ্টে ঘোড়া, হাতি এবং পদাতিক বাহিনীকে রাজমহল থেকে বাংলায় আসতে হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধীনে ঢাকার পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। স্থানিক বিবেচনাকে অগ্রাহ্য করে যখন বিদেশিরা নানা ধরনের শহর উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় তার পরিণতি যে কত ভয়াবহ হয় তার প্রমাণ ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ধোলাইখাল বন্ধ করে সেখানে মাটির নিচে বড় বড় পাইপ বসিয়ে নারিন্দাতে একটি পাম্প মেশিন বসিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়।
বিদেশিদের পরামর্শে এই ব্যবস্থার ফলে ঢাকায় গুরুতরভাবে পানি নিষ্কাশনের সংকট দেখা দেয়। একই পদ্ধতিতে বিভিন্ন জায়গায় পাইপ বসানো হয় এবং পানি নিষ্কাশনের গুরুতর সংকট দেখা দেয়। এরপর ঢাকা রাজধানী হলো, বিপুল পরিমাণ মানুষের আগমন ঘটল এই শহরে। বিভিন্ন জলাভূমি, ফাঁকা জায়গা যে যেখানে পারে বাড়িঘর তৈরি করতে শুরু করল। সরকারও প্রথমে ডিআইটি এবং পরে রাজউকের মাধ্যমে নানা জায়গায় আবাসনের ব্যবস্থা করতে শুরু করল। সেই ব্যবস্থা শুরু করতে গিয়ে ধানম-ি, গুলশান, বনানী, উত্তরা এসব জায়গায়ও জলাভূমিগুলো ভরাট করে শহরের আবাসিক এলাকা বৃদ্ধির কার্যক্রম শুরু করা হয়। এখন বৃষ্টিপাত মানেই সর্বত্রই জলাবদ্ধতা এবং মানুষের অন্তহীন দুর্ভোগ।
আশির দশকের পর থেকে গত চল্লিশ বছরে শহরটি কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। সেই ষাটের দশকের গাছপালাগুলো নেই, ফাঁকা জায়গা নেই, বৈচিত্র্যহীন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে শহরটি কিছু ম্যাচ বাক্সের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা আবর্জনার স্তূপ মনে হয়। শহরটায় এত পরিমাণ গাড়ি, বিশেষ করে প্রাইভেট গাড়ি একেবারেই পরিকল্পনাহীন নগরীতে চেপে বসেছে। মাত্র গত দশ পনের বছরে কিছু ফ্লাইওভার এবং সম্প্রতি মেট্রোরেলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বটে কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশ পরিকল্পনাহীন হওয়ায় যানজট কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে সেবা সংস্থাসমূহ একজন আরেকজনের প্রতি দোষ চাপিয়ে আপাতত নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলছে।
আমার এই ষাট বছরের ঢাকা বসবাসের ইতিহাসে গত তিনদিন আগে যখন আমি মগবাজার থেকে ধানম-ির বাসায় এসেছি তখন সময় লেগেছে চার ঘণ্টা! এই চার ঘণ্টার মধ্যে সাড়ে তিন ঘণ্টাই ছিলাম আমি পানির মধ্যে। কিন্তু চলাচলের কোনো উপায় ছিল না। এক জায়গাতেই এক থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেছি। সামনে পেছনে গাড়ির চাপ, কোনো কোনো গাড়ি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। তার সামনে বা পেছনে যাওয়ারও কোনো উপায় ছিল না। শহরে কোনো ট্রাফিক পুলিশ দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো ধরনের সরকারি উদ্যোগ দেখা যায়নি। খবরে প্রায়ই দেখে থাকি কোনো দেশে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের বাহিনীগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে মানুষের সাহায্যে সরকারের প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। যা ভেবেছিলাম তাই, এই দুর্যোগের মধ্যে কিছু প্রাণ যাবে, কিছু লোক আহত হবে এবং সত্যিই দেখলাম যে ওই রাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন মারা গেছে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত এক শিশুকে নিয়ে উদ্ধারকারীরা বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসার জন্য গিয়েছে কিন্তু চিকিৎসা পায়নি। এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় না এই কারণে যে, একবার আমার ছেলে স্কুল থেকে ফেরার সময়ে বেবিট্যাক্সিতে দুর্ঘটনায় পড়ে তার শরীর রক্তাক্ত হয়। সেই সময়ে তার কাছে পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না, চিকিৎসার জন্য কাছের একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে গেলে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। রক্তাক্ত অবস্থাতেই সে ঘরে ফিরে আসে।
আমার কাছে প্রশ্নটি অন্য জায়গায়, আমরা নিয়তিতে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। দ্রব্যমূল্য বাড়বে, বেকারত্বের সৃষ্টি হবে, মানুষ চিকিৎসা পাবে না এটাই যেন স্বাভাবিক। আর এর বিনিময়ে কোটি কোটি ডিমের দাম পাঁচ টাকা করে বাড়িয়ে একদিনে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কোটিপতি হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় অমাত্যরা এর সমাধানে বিনিদ্র রজনী পার করবেন না, আমলারা নিজের সন্তানদের পৃথিবীর নিরাপদ কোনো জায়গায় পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকবেন। সাংসদ-ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আরও কোটি কোটি টাকার মালিক হবে। আমরা কি এমনটি দেখতে পাব কোনোদিন দেশ যারা চালায় তাদের ঘুম নেই, সারা রাত পথে পথে ঘুরছেন কোথায় কী হলো সেসব দেখে পরদিনই মানুষকে জানানো যে এই ব্যবস্থা এইভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব। সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! রাজনীতিবিদরা শুধুই বোঝেন ক্ষমতা। মার্কিন ভিসা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, কিন্তু পাঁচজন মানুষ যে অতিবর্ষণের ফলে পানিতে তলিয়ে যাওয়া রাস্তায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অকালে মারা গেল তাতে তাদের কপালে একটুও ভাঁজ পড়ে না।
ক’দিন পরে পরে রাস্তার পাশে বিরাট বিরাট কংক্রিটের পাইপ দেখা যায়। বহুদিন মানুষকে ভুগিয়ে একদিন সেই পাইপগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে। কিন্তু এই পাইপের কাজগুলো কী? তারা কি পানি নিষ্কাশনের কাজ করে? নাকি মাটির নিচে গিয়ে নানা রকম ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ হয়ে নিচের দিকের পানিকে ওপরের দিকে ঠেলে দেয়? আমাদের এক নাট্যকর্মীর বা অভিনেতা বন্ধু উবারে করে তার কল্যাণপুরের বাসায় যাচ্ছিলেন। কল্যাণপুর যাওয়ার পর উবারের ড্রাইভার আর যেতে রাজি হলেন না। বুক সমান পানি ভেঙে সেই বন্ধু বাড়ি যাওয়ার পথে ম্যানহোলের মধ্যে পড়ে যান। তার একটি পা ক্ষতবিক্ষত হয় এবং মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এখনো ট্রমায় ভুগছেন।
এটা সত্য, বাংলাদেশ বানভাসি ও ঝড়-ঝঞ্ঝার দেশ। মানুষ এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করে বহু শতাব্দী ধরে বেঁচে আছেন। মানুষের কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কিছুতেই নেবে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গৃহে কিছু অনভিজ্ঞ লোক নকশাঁ বানাবে এবং বিপুল পরিমাণে অর্থ ব্যয়ে একটি প্রকল্প সাজাবে, তার মধ্য থেকে কোটি কোটি টাকা চলে যাবে ক্ষমতাসীনদের পকেটে। আজই পত্রিকায় দেখলাম প্রমাণসহ একজন লিখেছেন ভাঙ্গা থেকে খুলনার রেললাইন আপাতত এখন প্রয়োজন নেই। এতে বিশাল অর্থের অপচয় হবে। কিন্তু দেখা যাবে প্রকল্পটি হলো ঠিকই, কিন্তু এটা কারও কাজে লাগছে না। এমনি অনেক অকেজো প্রকল্প হরহামেশাই হয়। আমাদের সংস্কৃতিতে ষাটের দশক পর্যন্ত দেশপ্রেমের বিষয়টি বড়ই প্রবল ছিল। হয়তো সেটা পরাধীনতার কারণে। সবাই যার যার মতো দেশের জন্য কাজ করতে ছুটত। সত্তরের দশকের পর যে চায়নি তা নয়। কিন্তু সম্পূর্ণ বিষয়টি চলে গেছে শাসকের হাতে। জনগণের মেধাকে কখনোই গ্রহণ করার চেষ্টা করা হয়নি। গত ষাট বছরে এবং আমার এই বয়সে আমাদের কাজে লাগানোর রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়নি। সব কিছু সরকারি বেতনভুক্ত লোকদের কাছে এবং রাজনীতিবিদদের হাতে। তারা যাই করবেন তাই হবে। তবে সবচেয়ে বেদনার বিষয় এই পরিস্থিতির কোনো উন্নতিরও আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। একমাত্র গণজাগরণ এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবই সমাজকে আবার কর্মময় করে তুলতে পারে। অন্যথায় খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় নির্বাচন আর ভিসার খবরই আমরা দেখতে পাব। ওই পাঁচজন হতভাগ্য মানুষ যে রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলার শিকার তার সত্যতা কখনোই ভুলবার নয়। এসব ভেবেই হয়তো আলেকজান্ডার পাঞ্জাব থেকে ফিরে গিয়েছিলেন এবং সেনাপতিকে বলেছিলেন ‘সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ’।
লেখক: অভিনেতা, নাট্যকার ও কলামিস্ট
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার ঘোষণা পর তিনি এ তথ্য জানান। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তিনি জানাননি ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের আজকের পদক্ষেপগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।’
মে মাসে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ওই ঘোষণা দেন।
বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। রাতটা পোহালেই বাংলাদেশ দল উড়াল দেবে ভারতের গোয়াহাটিতে। তবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি দল। বিসিবি জানিয়েছে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চলমান তৃতীয় ওয়ানডের ম্যাচ শেষেই জানানো হবে বিশ্বকাপের দল।
প্রচুর আলোচনা ও জল্পনা–কল্পনার পর আজ বিশ্বকাপে নিজেদের স্কোয়াড ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির ফেসবুক পেজে আজ দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে দেখা যায় বিসিবির লোগোসংবলিত বক্সে করে গুরুত্বপুর্ণ কিছু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিডিও–র শেষে প্রশ্ন করা হয়েছে, বলুন তো ভেতরে কি?
বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় সন্ধ্যা পৌণে ৬টায় ঘোষণা করা হবে দল। কিন্তু ৫টা ৪০ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় তৃতীয় ওয়ানডের শেষেই দল ঘোষনা করা হবে।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।