
২৮ আগস্ট দেশের দৈনিক সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিন প্রচারমাধ্যম থেকে জানতে পারলাম, সেদিন মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পলাতক তারেক জিয়ার বক্তব্য-ভাষণ প্রচার বন্ধ করা এবং সরিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষকে (বিটিআরসি) নির্দেশনা দেওয়ার পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা উক্ত বেঞ্চে ঘৃণ্য ধরনের হট্টগোল শুরু করে, মাননীয় বিচারপতিদ্বয়ের প্রতি ফাইল এবং কাগজের ঢিল নিক্ষেপ করে, যে অবস্থায় বিচারপতিদ্বয় আদালত ছেড়ে খাস কামরায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আদালতে বিএনপি-জামায়াতিদের এ ধরনের গুন্ডামি এটিই প্রথম নয়। ২৮ আগস্টের ঘটনা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল ২০১১ সালের একই ধরনের মাস্তানির কথা। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আমাদের পবিত্র সংবিধান সম্পর্কে আপত্তিকর কথা বলার অভিযোগে আমার নেতৃত্বে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে শুনানি চলাকালে বেশ কিছু বিএনপি সদস্য আইনজীবী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল।
ঢিল, বোতল, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছিল। আমি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিলে, তিনি চিহ্নিত কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
২০১১-এর ঘটনা ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত সদস্য আইনজীবীগণ প্রতিনিয়ত এ ধরনের মাস্তানি করে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এবং এমনকি আদালতের ভেতরেও।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা সারা দিন আদালত কক্ষ দখলে রেখেছিলেন যে কারণে, সেই আদালতে বাকি দিন কোনো কাজ হতে পারেনি। ফলে বহু বিচার প্রার্থীকে বিচারবঞ্চিত হতে হয়েছে। অথচ এই বিএনপি-জামায়াতি আইনজীবীরাই সর্বদা গলা উঁচু করে গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর আইনের শাসনের কথা বলে শান্ত সমুদ্রে ঝড় তুলতে ভুল করেন না, ভোলেন না তাদের বিদেশি প্রভুদের কাছে নালিশ করতে।
মামলাটি করা হয়েছে খুনের অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক জিয়ার বক্তব্য গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচার বন্ধের আদেশ প্রার্থনা করে। গত কয়েক বছর ধরে এই পলাতক আসামির বক্তব্য বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে বলে এই মামলার প্রয়োজন হয়েছে কেননা পলাতক আসামির বক্তব্য প্রচার করা শুধু বেআইনিই নয়, দণ্ডনীয় অপরাধও বটে।
আইনের ভাষায় একজন পলাতক আসামিকে বলা হয় ‘আউট ল’। জগৎ শ্রেষ্ঠ ব্ল্যাক ল ডিকশনারিতে দেওয়া সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, আউট ল ‘সেই ব্যক্তি যে আইনে প্রদত্ত সুবিধা এবং সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত, সে ব্যক্তি একজন অভ্যাসগত অপরাধী, বিশেষ করে একজন পলাতক আসামি (fugitive)।’ ব্ল্যাক ল ডিকশনারির সংজ্ঞা থেকে এটি পরিষ্কার যে, ফেরারি আসামি আইনের সুরক্ষা বা সুবিধা কোনোটিই পেতে পারে না। এ বিধান পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই প্রচলিত, যার কারণে পলাতক থাকাকালে তার পক্ষে প্রতিনিধি বা আইনজীবী কোনো আদালতে বা কর্তৃপক্ষের কাছে হাজির হতে পারে না। সোজা কথায় সে আইনের দৃষ্টিতে একজন অদৃশ্য ব্যক্তি।
অদৃশ্য ব্যক্তি বিধায় তার ভাষণ প্রচার হতে পারে না। এ মামলায় তারেক জিয়া এবং কয়েকজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ছাড়া কেউ পক্ষভুক্ত নয়। তারেক জিয়া পলাতক বিধায় তার পক্ষে আদালতে কেউ হাজির হতে পারে না। তা সত্ত্বেও বিএনপির কিছু আইনজীবী তারেক জিয়ার পক্ষে কথা বলতে আদালতে অন্যায় এবং বেআইনিভাবে হাজির হয়েছেন শুধু আদালতের কার্যক্রম ব্যাহত করতে। তারা সংশ্লিষ্ট মামলায় কোনো পক্ষের আইনজীবী নয় বিধায়, আদালত তাদের কথা বলার সুযোগ দিতে পারে না।
কেউ কেউ বলছেন, তারেক জিয়ার ভাষণ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া নাকি তার মানবাধিকার লঙ্ঘন। আইনে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, পলাতক থাকা অবস্থায় কোনো আসামি কোনো ধরনের অধিকারই ভোগ করতে পারে না, যে কথা ব্ল্যাক ল ডিকশনারিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তদুপরি আমাদের সংবিধানের ৩৯ক অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের যে অধিকার প্রদান করা হয়েছে, সেটি নিশ্চিতভাবে এমন মানুষের জন্য যে একজন প্রকাশ্য, দৃশ্যমান ব্যক্তি, কোনো পলাতক বা অদৃশ্য ব্যক্তিকে এই স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। একজন ফেরারিকে এই স্বাধীনতা দেওয়ার অর্থ তাকে ফেরারি আসামি হিসেবে বিরাজ করতে সহায়তা করা। ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত অধিকার অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা বা আদালত অবমাননার জন্য ভোগ করা যায় না। একজন পলাতক আসামির ক্ষেত্রে দুটি নিষেধাজ্ঞাই বিরাজমান, কেননা, তার ভাষণ প্রচার করার অধিকার মানে পলাতক থাকার এবং আদালত অবমাননার অপরাধ চালিয়ে যাওয়া। তার ওপর আদালতের নির্দেশ রয়েছে আত্মসমর্পণ করার।
তা ছাড়াও ৩৯ অনুচ্ছেদের দেওয়া অধিকার কেবল বাংলাদেশের নাগরিকরাই ভোগ করতে পারেন। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই জানিয়েছে যে, বিদেশে পালিয়ে থাকা সাজাপ্রাপ্ত আসামি তারেক জিয়া অনেক আগেই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
আমাদের দণ্ডবিধির ৫২ক ধারায় কোনো পলাতক আসামিকে সহায়তা করা মারাত্মক অপরাধ। তারেক জিয়াকে পালিয়ে থাকতে সহায়তা করার অপরাধে সহায়তাকারীরও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারায় বলা হয়েছে, ‘আশ্রয় দেওয়া মানে পলাতকের জন্য আবাসের ব্যবস্থা করা, খাবার, পানীয়, অর্থ প্রদান, পরিধেয় বস্ত্র প্রদান, অস্ত্র প্রদান, চলাচলের ব্যবস্থা করা, অথবা এই ধারায় নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নাই এমন অন্য যে কোনো উপায়ে সহায়তা প্রদান করা।’
সুতরাং আশ্রয় শব্দটির ব্যাখ্যা অনেক ব্যাপক, অর্থাৎ এমন কাজও ‘আশ্রয় প্রদানের’ ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত, যার কথা উক্ত ধারায় বিশেষ করে উল্লেখিত নয়। সেই অর্থে তারেক জিয়ার ভাষণ প্রচারকারীরাও দণ্ডবিধির ৫২ক ধারার দায়ে অপরাধী। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য তারা সাংবাদিকদের বলেছে যে, তারা মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে এই মর্মে দরখাস্ত করেছে যে, এই বেঞ্চের ওপর তাদের আস্থা নেই। এ কথা এতই হাস্যকর যে, কোনো আইনজীবীর মুখে এ ধরনের অবান্তর কথা শোভা পায় না। মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে এ ধরনের দরখাস্ত সে ব্যক্তিই করতে পারেন, যে সংশ্লিষ্ট মামলায় একজন পক্ষ। কোনো আগন্তুক এ ধরনের দরখাস্ত করতে পারেন না। জানা গেছে, একজন আইনজীবী তার এক অনির্দিষ্ট মক্কেলকে পক্ষভুক্ত করার জন্য দরখাস্ত করেছিলেন, যেই আবেদন সংশ্লিষ্ট আদালত অত্যন্ত যৌক্তিক এবং আইনসংগত কারণেই নাকচ করে দিয়েছেন।
এ মামলার বিষয়বস্তু এমন কিছু নয়, যাকে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বলা যায়। এখানে বিষয় একটিই, তা হলো তারেক জিয়া পলাতক আসামি বিধায় তার ভাষণ প্রচার করা যায় কিনা। সুতরাং এ বিষয়ে অন্য ব্যক্তির কোনো স্বার্থ, যাকে আইনের ভাষায়, লোকাস স্টেন্ডাই, বলে, থাকতে পারে না। এ ধরনের দরখাস্ত করার মানে হচ্ছে আদালতের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করা, যার জন্য এসব আইনজীবীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
তা ছাড়াও মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দরখাস্ত করতে হয়। পক্ষভুক্তির দরখাস্ত নাকচ হওয়ার পর তারা আপিল বিভাগে দরখাস্ত করতে পারত, কিন্তু সেটি তারা করে নাই, সম্ভবত এই জেনে যে, এ ধরনের অমূলক দরখাস্ত, যার পেছনে কোনো যুক্তি, হেতু বা বিষয়বস্তু নেই, নিয়ে গেলে আপিল বিভাগ ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারেন। তাই তারা ধূম্রজাল সৃষ্টির জন্য পরে সংশ্লিষ্ট আদালতের ওপর অনাস্থার দাবি করেছে। আদালত এমন কোনো আদেশই দেয়নি যার জন্য অনাস্থা প্রকাশ করা যায়। একটি সম্পূর্ণ মেধাহীন দরখাস্ত নাকচ করে আদালত আইনের নির্দেশকেই মান্য করেছেন। এই মাস্তানি কাণ্ডের সময় আদালত যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে, তা অভূতপূর্ব।
২০১১ সালে আমার বেঞ্চে মাস্তানি করার সময় আমি সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ডেকে সব মাস্তানকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম আদালতের মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রক্ষার স্বার্থে। এ ধরনের মাস্তানিকে প্রশ্রয় দিলে শুধু বিচার বিভাগের স্বাধীনতাই নয়, ধূলিসাৎ হবে আইনের শাসন, সংবিধানের সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র। তাই এসব মাস্তানের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। তারা শুধু আদালত অবমাননাই করেনি, আরও কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। তাদের ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হবে বিচারহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। বার কাউন্সিলকেও তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আদালতের মর্যাদা এবং কর্তৃত্ব নষ্ট হলে কিছুই বাকি থাকবে না, যেসব আইনজীবী মাস্তানি করছেন তাদেরও পথে বসতে হবে।
লেখক: আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
যুক্তরাষ্ট্র গত মে মাসে ভিসানীতি আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় তারা ভিসানীতি ঘোষণার কার্যকারিতার কথা জানালো। এই ভিসানীতি কার্যকারিতার কথা তারা তখন জানালো যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার এক বৈঠকে আবারও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।
ওই বৈঠকের পর আজরা জেয়া নিজেই এক্সে (সাবেক টুইটার) সচিত্র একটি পোস্ট দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি সাইড ইভেন্টের আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আবারও যুক্ত হতে পেরে সম্মানিতবোধ করছি। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, অংশীদারত্বের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি এবং ৯ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উদারতার সঙ্গে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছি।’
বৈঠকে আজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তারা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য ১১৬ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেয়া রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবিকা নিশ্চিত করতে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন।
জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা উচিত, অন্যথায় এই অঞ্চল নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ রোহিঙ্গারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে হত্যা, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান এবং মাদক কারবার। রোহিঙ্গারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কারণ তাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে এবং তারা সেখানে কোনো ভবিষ্যৎ অনুভব করছে না।
একটা বিষয় খেয়াল করলে বুঝা যাবে, উজারা জেয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর পরই বাংলাদেশের উপর যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে বুঝা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। তাদের দাবি ছিলো, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, তাদেরকে নিজ দেশ ফিরিয়ে নিতে যত তাড়াতাড়ি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।এ থেকে বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে, রোহিঙ্গাদের কর্মসংসস্থানের প্রস্তাব সরাসরি ফিরিয়ে দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হয়েছে। এই প্রস্তাব ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আর কী কী প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিল তা আমরা জানি না। মনে হচ্ছে, এমন কিছু প্রস্তাব হয়তো প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছিল যেগুলো তিনি নাকচ করে দিয়েছেন।এবার আসা যাক বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। অনেকদিন ধরে তারা সেটি বলে আসছে। বাংলাদেশের তরফ থেকেও বার বার জানানো হয়েছে যে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হবে। তারপরও তারা ভিসানীতি আরোপ করে সেটি কার্যকর করতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- নির্বাচন তো এখনও হয়নি। তার আগেই কেন ভিসানীতি আরোপ ও কার্যকর করা হলো?
এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই এসব ভিসানীতি, নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। গণতন্ত্র, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট শুধুমাত্র ইস্যু। নিজের দেশেই আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতে নানান কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। নিজের দেশেই যেখানে বাইডেন প্রশাসন প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে অন্যদেশের গণতন্ত্র নিয়ে তাদের এতো মাথা ব্যাথা কেন?
বাংলাদেশেই যে তারা প্রথম ভিসানীতি আরোপ বা নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিক অতীত ঘাটলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র আরও বহু দেশের সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদদের উপর একইভাবে ভিসানীতি এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এটা নতুন কিছু নয়। যেখানেই তাদের স্বার্থ জড়িত সেখানেই তারা একই পথে হেঁটেছে। কিন্তু কোথাও তারা সফল হতে পারেনি। সব জায়গা থেকেই ফিরেছে শূন্য হাতে। আমরা যদি ভেনিজুয়েলা থেকে শুরু করে সিরিয়া, ইরান, মিশর, তুরস্ক, রাশিয়া, বেলারুশের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এদের সবার উপরই নিষেধাজ্ঞা জারি কিংবা ভিসানীতি আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু খুব একটা ফল হয়নি।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই সেদেশে সামরিক অভ্যূত্থান হয়েছিল। সেই অভ্যূত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ইন্ধন দিয়েছিল। ২০২১ সালে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সৌলু যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনের বিষয়টি স্পষ্ট করেন। ভেনিজুয়েলায় নিজেদের পছন্দের লোক গুইদুকে প্রেসিডেন্ট করতে না পেরে মাদুরোকে বার বার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।পাঠকদেরকে হালের একটা তথ্য দিয়ে রাখি। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ভারতের মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের উপরও। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। বারাক ওবামা ভারত সফরের পর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তার সফরের বেশ কিছু দিন পর ভারত নাসার সঙ্গে চুক্তি করল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। গুজরাট দাঙ্গার কারণে তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। পরবর্তিতে নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, কারা সরকার পরিচালনা করবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক শুধুই বাংলাদেশের জনগণ। এখানে বাইরের রাষ্ট্র সে যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ হোক কারোরই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, কারা সরকার পরিচালনা করবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক শুধুই বাংলাদেশের জনগণ। এখানে বাইরের রাষ্ট্র সে যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ হোক কারোরই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। যখনই বাইরের কোনো রাষ্ট্র কোনো অজুহাতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবে তখনই বুঝতে হবে ওই দেশের বৃহত্তর স্বার্থ আছে। আর এসব নিষেধাজ্ঞা, ভিসানীতি আরোপে এদেশের সাধারণ মানুষের কিছুই যায় আসে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্ত করেছে এবং করছে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী নিজামুল হক বিপুল
বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আত্মদানকারী প্রথম নারী। ২৪ সেপ্টেম্বর এ বীরকন্যার আত্মাহুতি দিবস। এ বছর প্রীতিলতার ৯১তম আত্মাহুতি দিবস। ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে এ বীরকন্যা জন্মগ্রহণ। তার বাবার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার।
তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল অফিস কর্মকর্তা ছিলেন। তার মায়ের নাম প্রতিভা ওয়াদ্দেদার। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে প্রীতিলতা দ্বিতীয় সন্তান। তার পারিবারিক ডাকনাম ছিল ‘রাণী’। ছদ্মনাম ছিল 'ফুলতার'।
১৯১৮ সালে প্রীতিলতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রীতিলতা অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুই হয়েছিল তৃতীয় শ্রেণি থেকে। ১৯২৬ সালে তিনি মেধা তালিকায় বৃত্তি লাভ করেন। তিনি ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে লেটার মার্কসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন ইডেন মহিলা কলেজে। ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন প্রীতিলতা।
এরপর প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে তিনি দর্শনে স্নাতক পাস করেন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামে ফিরে এসে তিনি নন্দনকানন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (যা বর্তমানে অপর্ণা চরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত) প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন।
স্বদেশি আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রীতিলতাই প্রথম নারী বিপ্লবী। প্রীতিলতা যখন বিপ্লবী দলের সদস্য হতে চাইছিলেন তখন মাস্টার দা সূর্য সেন ছিলেন পলাতক। প্রীতিলতার ভীষণ ইচ্ছা ছিল মাস্টারদার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহে এবং বহু চেষ্টার পর ১৯৩২ সালের মে মাসে মাস্টার দা সূর্য সেনের সঙ্গে তার দেখা হয়। পরবর্তীতে স্বদেশি আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক মাস্টার দা সূর্য সেন প্রীতিলতার দায়িত্ববোধ, সাহসিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ অভিযানের নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন।
দলের প্রস্তুতিপর্ব শুরু করে দেওয়া হল। অভিযান সফল করার লক্ষ্যে তাদের অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আট সদস্য বিশিষ্ট এই দলের দলপতি ছিলেন প্রীতিলতা। তিনি ছাড়াও এ দলের বাকি সাতজন হলেন—বিপ্লবী কালিকিংকর দে, শান্তি চক্রবর্তী, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে, মহেন্দ্র চৌধুরী এবং পান্না সেন। প্রীতিলতার নেতৃত্বে এই অভিযান শুরু করা হয় ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায়। সেদিনের বিপ্লবীদের এই অভিযান সফল হয়েছিল। নিয়মে আছে, সামরিক কায়দায় আক্রমণের সময় নেতা থাকবে সবার আগে এবং ফেরার পথে সাথীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে নেতা ফিরবে সবার পরে। এই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন প্রীতিলতা। অভিযান সফল হওয়ার পর হুইসেল বাজিয়ে সদস্যদের ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি। পরবর্তীতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রীতিলতা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আত্মগোপনকারী এক ইংরেজ সৈনিকের গুলিতে বিদ্ধ হন প্রীতিলতা। ইতোমধ্যে দলের অন্যান্য সকল সদস্য নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
দলের সকল সদস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরই প্রীতিলতা তার সঙ্গে বহন করা ‘পটাশিয়াম সায়ানাইড’ পান করে আত্মাহুতির পথ বেছে নেন। যাতে ইংরেজ সৈন্যরা তাকে জীবিত অবস্থায় মারতে না পারে। এখানে উল্লেখ্য, পূর্বেই নির্দেশ ছিল যেকোনো অবস্থাতেই শত্রুর হাতে জীবিত অবস্থায় ধরা দেওয়া যাবে না। আহত অবস্থায় যাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীশক্তি তাকে জীবিত ধরে ফেলতে না পারে সে জন্য তিনি পূর্বনির্দেশের প্রতি অবিচল থেকে সায়ানাইড বিষপান করে আত্মাহুতি দেন। প্রীতিলতা প্রমাণ করেছেন মাস্টার দা সূর্য সেনের সিদ্ধান্ত একদম সঠিক ছিল, প্রীতিলতা এই অভিযানের যোগ্য নেতৃত্বদানকারী ছিলেন। পরদিন ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে ব্রিটিশ পুলিশ প্রীতিলতার মৃতদেহ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। একজন নারীকে আক্রমণকারী হিসেবে শনাক্ত করে তারা হতভম্ব হয়ে যায়।
৮০ বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দুই প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও বীণা দাসকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, বিপ্লবীদের প্রতি সম্মান জানাতেই এই মরণোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। ২০১২ সালের ২২ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এই ডিগ্রি দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষে এই ডিগ্রির সনদ গ্রহণ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং তিনি তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। এই সনদ বিশ্ববিদ্যালয়েই সংরক্ষণ করা হয়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও বীণা দাস এই দুইজনেরই স্নাতক ডিগ্রী পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর পূর্বেই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুঠ করে ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইতে যোগ দেন ও পরে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। ফলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও সেদিন এই দুইজনের কারোরই স্নাতক ডিগ্রি নেওয়া হয়নি।
পরবর্তীতে ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রশংসাপত্র দিতে হাজির হওয়া তৎকালীন গভর্নর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য স্ট্যানলি জ্যাকসন। হঠাৎ জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে গুলি করেন ২০-২১ বছরের এক তরুণী। এই তরুণীই বীণা দাস। তিনি চেয়েছিলেন চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও উপাচার্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ধরে ফেললেন সে তরুণীকে। তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে সে। সেদিনের সেই তরুণীই ছিলেন বীণা দাস। ইতিহাসের একটি সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরযোদ্ধা বীণা দাস চুলের খোঁপার মধ্যে রিভলবার লুকিয়ে সমাবর্তন কক্ষে ঢুকেছিলেন সেদিন। স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে পরপর পাঁচটি গুলি চালিয়েছিল বীণা। তবে স্ট্যানলি জ্যাকসন সম্পূর্ণ অক্ষত ছিলেন কারণ সবকটি গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল এবং চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যাওয়ায় সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় বীণা দাসকে।
চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলিতে তৎকালীন ইউরোপিয়ান ক্লাব বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়। এই ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনেই স্থাপিত হয়েছে 'বীরকন্যা প্রীতিলতা' স্মারক ভাস্কর্য। এটি উদ্বোধন করা হয়েছে ২০১২ সালের ২ অক্টোবর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, 'বীরকন্যা প্রীতিলতা' স্মারক ভাস্কর্য স্থাপনের পূর্বে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়ে পাহাড়তলি রেলওয়ে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সমিতির দেওয়া একটি 'স্মৃতি ফলক' এবং ইউরোপিয়ান ক্লাবসংলগ্ন পাহাড়তলি সাবপোস্ট অফিসের সামনের সড়ক দ্বীপে একটি স্মৃতিস্মারক ছাড়া আর কোনো কিছু নেই এই বীরকন্যার স্মরণে। তবে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাটে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নিজগ্রামে তার একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রীতিলতার নামে রয়েছে আবাসিক হল।
সামপ্রতিককালের কথা, প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবসে একটি প্রতিবেদন দেখানো হচ্ছিল একটি টেলিভিশন চ্যানেলে। সেখানে দেখা যায়, এ প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বিপ্লবী প্রীতিলতার নাম জানেন না! কেউ নাম শুনলেও তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানেন না। আরও অবাক করার ব্যাপার এই যে, তার নিজের জেলার মানুষের কাছেও তিনি প্রায় অপরিচিত। দুঃখজনক হলেও এটি সত্য যে, প্রীতিলতা যেসব স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন সেখানকার শিক্ষার্থীরাও ঠিকভাবে জানেন না প্রীতিলতার বীরত্বের কথা।
বর্তমান প্রজন্ম প্রীতিলতা সম্পর্কে জানে না—এটি একটি লজ্জাকর ব্যাপার। এটি প্রজন্মের জন্য, দেশের জন্য অশনিসংকেত! বর্তমান প্রজন্ম কীভাবে বেড়ে ওঠছে—তা এ দৃশ্যগুলো থেকে সহজেই প্রতীয়মান। তারা বইপড়ায়, ইতিহাসচর্চায়, জ্ঞানচর্চায় নেই। তাই দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তারা জানেন না। দেশপ্রেমিক বিপ্লবী এই মানুষগুলোর নামও এখন তাদের কাছে দুর্বোধ্য। বাধ্য হয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার আশায় তাদের ইতিহাস সম্পর্কে একটু জানতে হয়, এগুলো আবার তারা পরের বছর নতুন বই আর নতুন পড়ার ভিড়ে ভুলে যান। তবুও এখনও অনেকে আছেন, যারা ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ইতিহাস সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক। তারা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার বাইরে বইপড়ায়, ইতিহাসচর্চায়, জ্ঞানচর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। কিন্তু সে সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। দিনদিন প্রজন্মের মাঝে বইপড়ার অভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে। তারা শুধু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাইরের জীবন-জগৎ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। শুধু পরীক্ষায় ভালো করার জন্যই বাধ্য হয়ে তারা এখন পড়াশোনা করেন।
বর্তমান প্রজন্মকে সৃজনশীল কোনো কাজে জড়িত থাকতে কিংবা সৃজনশীলতা চর্চা করতে তেমনভাবে দেখা যায় না। কিন্তু এভাবে একটি প্রজন্ম বেড়ে ওঠতে পারে না। প্রজন্মকে হতে হবে জ্ঞানে-গুণে-মানে সবদিক থেকে সমৃদ্ধ। তাদের হতে হবে ইতিহাস ও অধিকার সচেতন। তরুণ প্রজন্ম একটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। তাদেরকে সঠিকভাবে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে একটা রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়।
প্রীতিলতাসহ অন্যান্য সকল বিপ্লবীদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস আমাদের জানতে হবে। আর এ জন্য ইতিহাস পড়তে হবে, চর্চা করতে হবে, গবেষণা করতে হবে।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আত্মদানকারী প্রথম নারী বীরকন্যা প্রীতিলতার এ বছর ৯১তম আত্মাহুতি দিবস। প্রীতিলতার মতো এমন বিপ্লবী দেশপ্রেমিক ফিরে আসুক যুগে যুগে শতবার। জাতির ক্রান্তিকালে প্রীতিলতার মতো বীরকন্যাদের বড়োই প্রয়োজন। বীরকন্যা প্রীতিলতার দুঃসাহসী মনোভাব, সংগ্রামীজীবন ও দেশপ্রেমিক চেতনা সংকটে সংগ্রামে প্রজন্মের জন্য প্রেরণার প্রতীক।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক; ফিচার সম্পাদক, দৈনিক ফেনী।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)’র ৩৬তম পুলিশ কমিশনার হিসেবে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)। জনবান্ধব, আধুনিক ও পজিটিভ পুলিশিংয়ের রোল মডেল হিসেবে যার জুড়ি মেলা ভার।
ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধানের পদ থেকে ব্যস্ততম ও জনবহুল ঢাকা মহানগরীর পুলিশ কমিশনার হিসেবে তার আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে জনমনে খুশির জোয়ার বইছে।
হাবিবুর রহমান এমনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা - যিনি তার মেধা, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা ও সততার গুণে পৌঁছে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। পুলিশ বিভাগে ধারাবাহিক সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পর্যন্ত তিনি তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। এছাড়া তিনি দুইবার সাফল্যেরসহিত বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন কর্মঠ ও নিবেদিত উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার বাইরে তিনি একজন সফল ক্রীড়া সংগঠক, লেখক, গবেষক, সমাজ সংস্কারক, সমাজ সেবক এবং বাংলাদেশ পুলিশ প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘ডিটেকটিভ’ এর সম্পাদকও। তার চেয়েও বড় কথা বহুমাত্রিক প্রতিভাসম্পন্ন হাবিবুর রহমানের বড়গুণ তিনি একজন আদর্শ ও মানবিক ব্যক্তিত্ব যা তাকে সবকিছু থেকে এগিয়ে রেখেছে।
হাবিবুর রহমান ছাত্রজীবনে পড়াশুনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন, কিন্তু সেটা নিজের জন্য নয় সেটি ছিল সমাজের উন্নয়নের জন্য। তার ছোট ছোট প্রতিবেদনে স্থান পেতো সমাজের বিভিন্ন জরাজীর্ণতা ও সাধারণ মানুষের কষ্টগুলো। সাংবদিকতার পেশা থেকে তিনি কোনদিন কোনো সুবিধা নেননি। তিনি শিখেছেন কোনো পরিবর্তন করতে হলে কোনো বিনিময় দিয়ে নয় বরং নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে করতে হয়। বলা যায়, এই সাংবাদিকতা পেশা থেকেই হাবিবুর রহমানের লেখালেখির হাতে খড়ি এবং এই অনন্য গুণটি পেশাগত জীবনে তাকে দিন দিন উচ্চতর স্থানে প্রতিষ্ঠিত করছে।
হাবিবুর রহমান ১৭তম বিসিএস ক্যাডার হিসেবে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। সারদাতে পুলিশিং প্রশিক্ষণকালে সকল সহকর্মীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। নিজের নেতৃত্ব ও সৃজনশীলতা দিয়ে প্রশিক্ষণ স্যুভেনির ‘আমার হলো শুরু’র সম্পাদক নির্বাচিত হন যেখানে নিজের গবেষণালব্দ লেখনিতে স্থান পায় বাংলাদেশ পুলিশের শেকড়সন্ধানী ইতিহাস, ঐতিহ্য ও করণীয় নির্ধারণ সম্পর্কিত নানান দিক। সাংবাদিকতার পর পুলিশ হিসেবে সেই যে লেখালেখি শুরু করলেন এরপর আর কখনো পিছু হটেননি। পুলিশে ঐহিত্যবাহী মাসিক ম্যাগাজিন ‘ডিটেকটিভ’ এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক পরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে এটির গুণগত, ভাষাগত ও প্রকাশনাগত আমূল পরিবর্তন এনে ডিটেকটিভকে পুরো পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি সমৃদ্ধ মুখপাত্র হিসেবে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন তিনি।
২০০৯ সালে ডিএমপি’র উপ-পুলিশ কমিশনার(সদর দপ্তর) পদে থাকাকালীন তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন যার মাধ্যমে সর্বপ্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশের অগ্রণী ভূমিকা প্রকাশ্যে আসে বেশ বড় পরিসরে। একই সময়ে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন ‘পুলিশ ব্ল্যাড ব্যাংক’ যা দেশের যে কোনো আধুনিক প্রাইভেট ব্ল্যাড ব্যাংকের মতোই উন্নত সেবাদানে সক্ষম। পুলিশ ব্ল্যাড ব্যাংক’ বর্তমান শুধু পুলিশ সদস্যদেরই রক্ত সরবরাহ করে না, যে কোনো প্রয়োজনে অসহায় ও মুমূর্ষু রোগীর পাশে দাঁড়াচ্ছে। পুলিশ ব্ল্যাড ব্যাংকের পথযাত্রা ছিল হাবিবুর রহমান এর অনন্য অবদান।
২০১২ সালে হাবিবুর রহমান ঐতিহ্যবাহী ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ঢাকা জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অভিনব সব কলা-কৌশল অবলম্বন করে ব্যপক প্রশংসিত হন। এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমগ্র জাতির সম্মূখে চিরস্মরণীয় কর রাখতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থিত টেলিকম ভবনের পাশে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এটি ২০১৩ সালে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং ২০১৭ সালের জাতীয় পুলিশ সপ্তাহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। জাদুঘরটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ, ইউনিফর্ম, বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট, র্যাংক ব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়ি, এমএম রাইফেলসহ অনেক কিছু সংরক্ষণ আছে। ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ গ্রন্থ সম্পদনা করে হাবিবুর রহমান কাগজে-কলমে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকাকে ইতিহাসে স্থান করে দেওয়ার জন্য অবদান রাখেন আর ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করে পুলিশের সেইসব অকুতোভয় অবদানসমূহকে প্রমাণ সাপেক্ষে বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই বিরল কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে হাবিবুর রহমান এর নাম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন তিনি সাভারে বসবাসরত ২০ হাজারেরও বেশি বেদে জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে বিভিন্ন কর্মমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বেদে জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে প্রাথমিকভাবে ১০৫ জন বেদে নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে পোড়াবাড়িতে কর্মসংস্থানের জন্য মিনি গার্মন্টস প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
সাপ খেলা দেখানোর পেশা থেকে ফিরিয়ে এনে ৩৫ জন বেদে যুবককে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রত্যেকের জন্য চাকুরীর ব্যবস্থা করা, কোচিং সেন্টার ও কম্পিউটার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে বেদে ছেলে-মেয়েদের পড়া লেখার অতিরিক্ত সুযোগ তৈরি করা, সরকারি সহযোগিতায় ১৮টি জরাজীর্ণ রাস্তা মেরামত করা, একটি মসজিদ নির্মাণ করা এবং স্থানীয় বেদে জনসাধারণের জন্য একটি পাকা ইদগাহ নির্মাণ করাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন।
তিনি উত্তরণ ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যার মাধ্যমে সাভারের বেদে পল্লীর বাসিন্দাদের জন্য প্রায় ৩০০ টি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সাভারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মুন্সীগন্জের বেদে শিশুদের জন্যও গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল ও কম্পিউটার সেন্টার।
গত বছর মুন্সীগঞ্জের ১৯টি বেদে পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে যার ফলে তাদের মনে এখন স্বস্তির হাওয়া। বর্তমানে ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ ছাড়াও গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নাটোরের সিংড়া এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনমূখী কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া, ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জের বেদেদের জন্য ৫৯ টি ঘর নির্মাণ করে হাসি ফুটিয়েছে ভাসমান মানুষের মুখে। বলতে গেলে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৩৬ লাখ বেদে ও মান্তা সম্প্রদায়ের কাছে তিনি যেমন হয়ে উঠেছেন আশার বাতিঘর তেমনি তিনি এই জনগোষ্ঠীর সাড়ে চারশো বছরের অস্পৃশ্য ও গ্লানিময় জীবনের মুক্তিদূতও।
বেদে জনগোষ্ঠীদের উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেন তারা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় একটি আলাদা ভাষা ব্যবহার করেন। বেশ কিছুদিন যাবৎ এটি প্রত্যক্ষ করতে থাকেন এবং এই দুর্বোধ্য ভাষাটির প্রতি কৌতুহলী হন। তিনি বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে পরিচিত কয়েকজনকে ডেকে জানতে পারলেন যে এটি বেদে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা যার নাম ‘ঠার’। তিনি ভাষাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করেন এবং বেশকিছু শব্দ ও বাক্য নিজের নোট বুকে লিখে রাখেন। এরপর খোঁজ করতে থাকেন এই ভাষাটি আসলে কীভাবে এলো, কারা ব্যবহার করছে এবং বাংলাদেশের কোন কোন প্রান্তে এই ভাষাটি ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি তিনি এটি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি উপলব্দি করলেন যে ‘ঠার’ ভাষাটি বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর মধ্যে একটি এবং এই ভাষাটি সংগ্রহ বা সংরক্ষণে তেমন কোন কাজও হয়নি।
তিনি আরো জানতে পারেন, এই ভাষাটির আসলে কোনো লেখ্য রূপ নেই এবং এটি একটি কথ্য ভাষা। তাই বলে সাড়ে চারশো বছর যাবৎ বসবাস করে আসা একটি জনগোষ্ঠীর ভাষাটি অযত্নে বা অবহেলায় এভাবে হারিয়ে যাবে এই ভাবনা তাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। তিনি বিভিন্নভাবে ভাষাটি সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট অনেকের মাধ্যমে চেষ্টা করে দেখলেন যে আসলে যথাযথ তথ্য উপাত্তের অভাবে কেউই এটির গভীরে প্রবেশ করতে পারছেন না। ফলে নিজেই শুরু করলেন বিস্তর গবেষণা। ভাষা বিজ্ঞানের উপর দক্ষতা না থাকায় প্রথমে তাকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরের নিকট কিছুদিন প্রাইভেটও পড়েছেন যার ফলে ভাষা বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রপ্ত করতে সক্ষম হন তিনি। বিলুপ্তপ্রায় ঠার ভাষাটির আদ্যপান্ত উদ্ধার করে এটির পূর্ণ গঠন, পঠন ও ব্যবহারিক রূপ দিতে প্রায় আট বছর সময় লেগে যায়।
এই আট বছরের ব্যবধানে কর্মজীবনে হাবিবুর রহমান ঢাকা পুলিশ সুপার থেকে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ হেড কোয়াটার্সের অতিরিক্ত ডিআইজি (পারসোনাল ম্যানেজমেন্ট -১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ হেড কোয়াটার্সের ডিআইজি (অ্যাডমিন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান পদে আসীন হবার আগে ২০১৯ সালের ১৬ মে থেকে তিনি ঢাকার রেঞ্জ ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা রেঞ্জের ১৩টি জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি পুলিশ হেড কোয়াটার্সের এক বিজ্ঞপ্তি মারফত রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।
অবশেষে গবেষণাগ্রন্থ ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ নামক এই অসাধ্য সাধনের কাজটি শেষ করেন বিশিষ্ট গবেষক ও ঋদ্ধ লেখক বাংলাদেশ পুলিশের তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ (মঙ্গলবার) বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে দেশবরেণ্য গুণীজনদের উপস্থিতিতে এক জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে বইটির মোড়ক উন্মোচিত হয়। বাংলা ভাষায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে হাবিবুর রহমানই প্রথম এমন কোন গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটির প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন আয়োজিত এই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।
দীর্ঘ ৮ বছরের নিরন্তর গবেষণার ফসল বেদে জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তপ্রায় ভাষা ‘ঠার’ নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। এরই ফলশ্রুতিতে এই গ্রন্থটি মাতৃভাষা সুরক্ষা, উন্নয়ন ও পুনরুজ্জীবনে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদকে ভূষিত হন হাবিবুর রহমান।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের অডিটরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইটির লেখক হাবিবুর রহমানকে এই বিরল সম্মাননা পদক তুলে দেন। ‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ গ্রন্থটি রচনার জন্য এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ গত ২ মে ২০২৩ মালয়েশিতে ‘জো জো ইন্টারন্যাশনাল আইকোনিক স্টার অ্যাওয়ার্ড-২০২৩’ পদকে ভূষিত হয়েছেন হাবিবুর রহমান যেটি তার ব্যক্তি জীবন, কর্ম জীবন ও দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের।
শুধু বেদে জনগোষ্ঠী নয় হাবিবুর রহমান সমাজের পিছিয়ে পড়া হিজড়া বা তৃতীয়লিঙ্গের সদস্যদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে নানামূখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাদের জন্য বিউটি পার্লার, মিনি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী, গরুর খামার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনসহ ফুড ভ্যানের মাধ্যমে অনেকেই স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন। সম্প্রতি বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের মাঝে এই স্বাবলম্বী হওয়া হিজড়াদের পক্ষ থেকে ২২ লক্ষ টাকা অনুদানের বিষয়টি অসংখ্য মানুষের হৃদয় ছুয়ে গেছে। বেদে জনগোষ্ঠী ও তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের কল্যাণ ছাড়াও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার ১৩৪০ জন যৌন কর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছে তিনি। পল্লীর বাসিন্দাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের জন্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি তাদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছেন হাবিবুর রহমান।
করোনাকালীণ প্রথম কোন মৃত যৌনকর্মীকে ইসলামিক শরীয়া মোতাবেক দাফনকার্য সম্পাদন করে এবং প্রথম কোন যৌনকর্মীর কুলখানির আয়োজন করে তিনি সর্বমহলের প্রসংশা কুড়িয়েছিলেন। ইতিপুর্ব যৌনকর্মীরা মারা গেলে রাতের অন্ধকারে বা সকলের অগচরে মৃতদেহকে পদ্মা নদীর চরে বালুর মধ্যে গুঁজে রাখা হতো বা ইট/বালু ভর্তি বস্তা বেধে দিয়ে লাশ পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। হাবিবুর রহমানের উদ্যোগে যৌন পল্লীর বাসিন্দাদের জন্য বর্তমানে একটি স্থায়ী কবরস্থান তৈরি করা হয়েছে।
অনেক যৌনকর্মী ইতোমধ্যে নিজের পেশা বদল করে স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে। তিনি যৌনকর্মী ও তাদের কোলে জন্ম নেওয়া পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের সামাজিক পরিচয় রক্ষার জন্য দৌলতদিয়া পতিতা পল্লীর নাম পরিবর্তন করে ‘দৌলতদিয়া বাজার পূর্বপাড়া’ নাম রেখেছেন। যৌনকর্মীদের মানবাধিকার ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় হাবিবুর রহমানের এই বিরল কর্মকাণ্ডগুলো তুলে ধরা হয়েছে পুলিশ পরিদর্শক মো. জাহিদুর রহমানের রচনা ও নির্দেশনায় উপস্থাপিত ‘অচলায়তনের অপ্সরী’ মঞ্চ নাটকে।
ঢাকা রেন্জ ডিআইজি’র দায়িত্ব থাকাকালীন হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকার কেরানিগন্জে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (ওয়েসিস)। ওয়েসিস খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি শক্তপোক্ত প্রাতিষ্ঠানির কাঠামোর উপর দাড়িয়ে প্রায় ২০০ জন রুগীকে সেবাসশ্রুসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সহায়তা করেছে।
ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন হাবিবুর রহমান। তিনি ক্রীড়াঙ্গনে থিতিয়ে যাওয়া জাতীয় খেলা কাবাডিকে মূলধারায় তুলে এনেছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুনাম কুড়িয়ে চলেছেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে এখন তিনি বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক কাবাডি ফেডারেশনের সহ-সভাপতির দায়িত্বও সামলাচ্ছেন কার্যকরভাবে ।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারের নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনাটি নিয়ে বেশ কয়েক বছর গবেষণা করেন হাবিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পুর্নাঙ্গ রায় অ্যানালাইসিস করে নির্মম সত্য ঘটনাটিকে সমগ্র জাতির কাছে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন তিনি। অবশেষে এই জঘণ্য হত্যাজজ্ঞের পূর্ণাঙ্গ ঘটনার উপর ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নামে একটি মঞ্চ নাটক তৈরি করেন যা এক বছরেই ১০০ বারেরও বেশি মঞ্চস্থ হয়েছে, এমনকি এটি এখন বিশ্ব রেকর্ড করতে চলেছে। কারণ ইতিহাসে আর কোন মঞ্চ নাটক এক বছরে ১০০ বারের বেশি মঞ্চস্থ হয়নি। এছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক কিছু ছবি ও ছবির অন্তরালের গল্প নিয়ে ‘পিতা তুমি বাংলাদেশ’ নামে একটি ফটো অ্যালবাম প্রকাশ করেন। অন্যদিকে পুলিশকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন উক্তি ও বক্তব্য নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর কথা ও কলমে পুলিশ’ শিরোনামে প্রকাশনাধীন একটি বইয়ের সংকলন ও সম্পাদনা করছেন তিনি। যার ভূমিকা লিখেছেন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উল্লেখ্য, গত ৩ জানুয়ারী ২০২৩ এ, রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩' এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর লিখিত পত্রাবলী নিয়ে হাবিবুর রহমান সম্পাদিত 'চিঠিপত্র: শেখ মুজিবুর রহমান' এবং এর ইংরেজী সংস্করণ 'Letters of Sheikh Mujibur Rahman' শীর্ষক দু'টি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য দুটি বইতেই কো-এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন তারই সহকর্মী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. এনায়েত করিম ।
গোপালগঞ্জের পবিত্র ও উর্বর মাঠি ফুড়ে জন্ম নেওযা হাবিবুর রহমান এই দেশের ১৮ কোটি মানুষের অতি ক্ষুদ্রাংশের বৃহত্তর সমস্যাগুলো নিয়ে নিরন্তর লড়ে যাচ্ছেন - যে সমস্যাগুলোও ঠিক মানুষের তৈরি। হাবিবুর রহমান এই ধরিত্রীর একজন সুর্য সন্তান হিসেবে বাংলাদেশের মনুষ্যসৃষ্ট চলমান বৈষম্যগুলো দূর করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সফল হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ ব্যক্তি ও কর্মজীবনে হাবিবুর রহমান নিজের পুরোটাই সপে দিয়েছেন দেশের কল্যাণে, দেশের মানুষের কল্যাণে।
লেখক: এম এম মাহবুব হাসান
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটির যে চারজন সদস্য এখনও জীবিত, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। জীবিত বাকি তিন সদস্য হলেন ড. কামাল হোসেন (কমিটির সভাপতি), ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। মুন্তাকীম চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন অস্ট্রেলিয়ায়। শুধু বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখাই নয়, বরং তাকে বলা হয় বাংলাদেশ-জাপান বন্ধুত্ব তথা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্থপতি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে যেসব উন্নত দেশ বাংলাদেশের সূচনালগ্নেই স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং পাশে দাঁড়িয়েছিল, জাপান তার একটি। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় জাপান। এর এক মাসের মধ্যে ঢাকায় শুরু হয় জাপানি দূতাবাসের কার্যক্রম। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে জাপান হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশকে যত দেশ উন্নয়ন সাহায্য দেয়, জাপান সেই তালিকায় সবার ওপরে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ১৯৭২ সালের ১৩-১৪ মার্চ জাপানের সংসদ সদস্য তাকাশি হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। দেশে ফিরে হায়াকাওয়া বাংলাদেশকে অনতিবিলম্বে ১০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি অনুদান এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের হিস্যা আদায়ে জাপানের মধ্যস্থতা করার বিষয়ে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব রাখেন। প্রধানমন্ত্রী সাতোর নির্দেশে ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ জাপান বাংলাদেশে প্রথম অর্থনৈতিক সার্ভে মিশন পাঠায়। (তথ্যসূত্র) ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, বণিকবার্তা, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।
এর পরের বছর ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাপানে শীর্ষ পর্যায়ের প্রথম সফরে বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। ওই বছরের ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় টোকিওতে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্কের পটভূমি তুলে ধরেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সহায়তা ও সমর্থনের জন্য জাপান সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
অবকাঠামো ছাড়াও বাংলাদেশের যোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য খাতে জাপানের সহায়তা অবিস্মরণীয়। আর বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের এই বন্ধুত্বের নেপথ্য নায়ক ব্যারিস্টার আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী; জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত।
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু তাকে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির সদস্য নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি
সিলেটের কানিহাটি জমিদার পরিবারের সন্তান মুন্তাকীম চৌধুরীর পুরো নাম আবু তাহের আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। জন্ম ২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯।মুন্তাকীম চৌধুরীর বাবা খান বাহাদুর তজম্মুল আলি চৌধুরী ছিলেন সিলেটের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম দিকের গ্র্যাজুয়েটদের অন্যতম। ১৯০০ সালের দিকে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসি ভাষায় অনার্সসহ বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের অধীনে আসাম সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি ১৯১৯ সালে আসামের বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি শহরের এসডিও ছিলেন। সারা জীবন তিনি ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি গোয়ালপাড়া জেলার ডেপুটি কমিশনার হিসেবে অবসরে যান।
মুন্তাকীম চৌধুরী আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আই.এ পাস করেন। তাঁর আত্মীয় জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার, প্রখ্যাত কূটনীতিক হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে একই রুমে থাকতেন। তিনি শান্তিনিকেতন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে লন্ডনের লিংকনস ইনে পড়াশোনা করেন। লিংকনস ইনেও তাঁর সহপাঠি ছিলেন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী।
পেশাগত জীবন
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৫৫ সালে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করার পর ১৯৫৬ সালে আইন পেশায় যোগ দেন। তিনি ঢাকা সিটি ল কলেজেরও খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। ১৯৮৭-৯০ সাল পর্যন্ত তিনি আইন বিষয়ক জার্নাল ডিএলআর-এর প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও পরে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবন
ভাসানী ন্যাপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিরোধী দলের চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনে অংশ নেন।
১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার অনেকবার সাক্ষাৎ হয়। আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর জামাতা প্রখ্যাত জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী জানান, ১৯৬২ সালে মুন্তাকীম চৌধুরী যখন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য, তখন বঙ্গবন্ধুকে সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হলে মুন্তাকীম চৌধুরীকে যেন আওয়ামী লীগে যুক্ত করা হয়।
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ১৯৬২ সালে ১০ই নভেম্বর। এদিন ট্রেনযোগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের নেতারা সিলেটে যান। সিলেট রেলস্টেশনে তাদের বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। পরদিন ১১ই নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়, ট্রেনটি স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই সিলেটের রাজনীতিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সুধী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার মানুষ অধীর আগ্রহে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। ট্রেনটি সিলেট স্টেশনে পৌঁছালে উপস্থিত জনতার ‘গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কায়েম করো, শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ, দমন নীতি চলবে না’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। এই সফরে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, আবু হোসেন সরকার, পীর মোহসেন উদ্দীন, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, হোসেন মনসুর প্রমুখ। খবরে বলা হয়, একই ট্রেনে জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীও সিলেটে আসেন এবং সংবর্ধনাকারীদের সঙ্গে যোগ দেন।
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর কাছ থেকে ড. আবেদ চৌধুরী শুনেছেন, ট্রেনের কামরায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার অনেক কথাবার্তা হয়। বিশেষ করে তার আওয়ামী লীগের যোগদানের বিষয়ে।
এরপর ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকের একটি খবরের শিরোনাম: ‘অদ্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সিলেট যাত্রা।’ খবরে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান, জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরী এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ৫ দিনব্যাপী সিলেট জেলা সফরের জন্য আজ রাতে সিলেট যাত্রা করবেন। তারা রবিবার সুনামগঞ্জে, সোমবার সিলেটে, মঙ্গলবার বিয়ানী বাজারে, বুধবার হবিগঞ্জে এবং বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারে জনসভায় বক্তৃতা করবেন।
এর দুদিন পরে, অর্থাৎ ৩১ আগস্ট প্রকাশিত খবরের শিরোনাম: ‘মোসাহেবদের দ্বারা পুর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব নহে।’ অর্থাৎ ওইদিন সুনামগঞ্জ টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তৃতা দেন, সেখান থেকে একটি বাক্য উদ্ধৃত করে শিরোনামটি করা হয়। খবরে বলা হয়, এই জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরীও বক্তব্য দেন।
তার মানে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সালের আগস্টের মধ্যে কোনো এক সময় আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আবেদ চৌধুরী জানান, সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে একদিন রাতে তাজউদ্দিন আহমদকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে মুন্তাকীম চৌধুরীর বাসভবনে আসেন এবং তাকে আওয়ামী লীগে যোগদানের পরামর্শ দেন।
মুন্তাকীম চৌধুরী সম্ভবত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। এরপর থেকে তিনি জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে পরিচিত হন। ইত্তেফাকের সংবাদেও তাকে ‘জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যখন মুন্তাকীম চৌধুরী আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন, তখন তাঁকে এই কাজে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেন ড. আবেদ চৌধুরীর বড় ভাই আব্দুল মুক্তাদির জুবেদ চৌধুরী।
মুন্তাকীম চৌধুরী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিলেট-৫ আসন থেকে জাতীয় পরিষদ (জাতীয় পরিষদ ১২৪) সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের পরে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটিতে তাঁকে যুক্ত করা হয় মূলত আইন ও সংবিধান বিষয়ে তার পাণ্ডিত্যের জন্য। পরবর্তীতে দেখা যাবে যে খসড়া সংবিধান নিয়ে গণপরিষদে যে বিতর্ক হয়েছে, সেখানে জনাব চৌধুরী অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। এমনকি কমিটির যে ছয় জন সদস্য সংবিধানের ওপর নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম।
গণপরিষদে ভূমিকা
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম বৈঠকে আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী গণপরিষদ পরিচালনার জন্য কার্যপ্রণালিবিধির ১৫ নম্বর ধারার ২ উপধারার বিষয়ে বৈধতার প্রশ্ন তোলেন। অর্থাৎ গণপরিষদ পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতি যে অস্থায়ী কার্যপ্রণালিবিধি দিয়েছিলেন, সেটি যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে এই পরিষদের এখতিয়ার ক্ষুণ্ন হয় কি না, তিনি সেই প্রশ্ন তোলেন। কেননা ১৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে, কার্যপ্রণালিবিধি তৈরি করবে পরিষদ। এ নিয়ে আরও একাধিক সদস্য প্রশ্ন তুললে তখন বঙ্গবন্ধু বক্তব্য দেন এবং বলেন যে, এই গণপরিষদে বসার জন্য একটি কার্যপ্রণালিবিধি দরকার। না হলে তারা কীসের ভিত্তিতে বসবেন? সেজন্যই রাষ্ট্রপতি একটি অস্থায়ী বিধি দিয়েছেন। অর্থাৎ এটি আপৎকালীন বিধি। এরপর আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের প্রস্তাব্তি বিধিটি পাসের জন্য পরিষদের সভাপতি ভোটে দিলে সেটি পাস হয়। (ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম, গণপরিষদ বিতর্ক, পৃষ্ঠা ২১)।
গণপরিষদের দ্বিতীয় বৈঠকে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল কার্যপ্রণালিবিধির ৪৮ ধারা নিয়ে বিতর্ক উঠলে সে বিষয়েও বক্তব্য দেন মুন্তাকীম চৌধুরী।
পরিষদের দ্বাদশ বৈঠকে ১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর সংবিধান বিলের ওপর আলোচনা করেন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। যেখানে তিনি বলেন, ‘এই সংবিধান বিবেচনা করতে গিয়ে সর্বপ্রথম আমাদের দেখতে হয় যে, এই সংবিধান-বিলে এ দেশের মেহনতী মানুষের, এ দেশের কৃষক- শ্রমিকের, এ দেশের নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে কি না। তা দেখতে গিয়ে সর্বপ্রথম বিবেচনা করতে হয় যে, আমাদের জনগণকে শোষণমুক্ত করার, আমাদের জনসাধারণের শোষণ-মুক্তির যে দাবি, সেটা এই সংবিধানে স্বীকৃত হয়েছে কি না।’
মেহনতী মানুষের, কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি এবং শোষণমুক্তির ব্যবস্থা এই সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই সংবিধানে এ দেশের জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ যারা সেই কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষ- তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই সংবিধানের ১৫ নম্বর ও ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদের মাধ্যমে তাদের সর্ববিধ উন্নয়নের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
সংবিধানে ২২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার-বিভাগকে পৃথক করার কথা তুলে ধরে আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ২৩৫ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এটা করতে চেয়েছে; কিন্তু সুনির্দিষ্ট ভাব তা করতে পারেনি। শুধু ভবিষ্যতের জন্য একটা ব্যবস্থা রেখেছে। কিন্তু আমরা আজকে এটাকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করে দিয়েছি।’
এই সংবিধান জনসাধারণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেকোনো দেশে যেকোনো অধিকারই দেওয়া হোক না কেন, সে অধিকার অবাধভাবে দেওয়া হয় না। রাইটের সঙ্গে অবলিগেশনের প্রশ্ন রয়েছে। সেটার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইনের মাধ্যমে এটা আনা হয়। তা না হলে কনফ্লিক্ট সৃষ্টি হতে পারে। আমরা শুধু আইনের মাধ্যমে এর ব্যবস্থা করেছি। সেই আইন যুক্তিযুক্ত কি না, জনসাধারণের নৈতিক স্বার্থে সে সব করা হয়েছে কি না, সেটা দেখার এখতিয়ার আদালতের আছে। অবাধ স্বাধীনতা নাই। সুতরাং, আমরা এখানে এ ব্যবস্থা করেছি।’
বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে যা বলেছিলেন
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট সম্পর্কে সাধারণভাবে একমত পোষণ করলেও এমপিদের সংসদ সদস্যপদ বাতিল সম্পর্কিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং চতুর্থ তফসিলের ১, ২ এবং ৩ নং দফা সম্পর্কে নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তিপত্র দেন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী।
৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানে এ রকম অনুচ্ছেদ যুক্ত করা একরকম অনিবার্য ব্যাপার। এটি আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কুফল থেকে নিজেদের রক্ষা করবে। এর ফলে দলকে ভেঙে সংসদে আরেকটি দল গঠন ও ব্যক্তিগত বিবেচনায় দলীয় আনুগত্য পরিবর্তন করা রোধ হবে এবং এটি এই দেশে সঠিক সংসদীয় অনুশীলন ও প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। তবে এ দেশে সংসদীয় রাজনীতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন জনমত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড গাইড করবে এবং কোনো সদস্য জনমতকে উপেক্ষা করে দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না, তখন এ ধরনের বিধানের কোনো প্রয়োজন হবে বলে আমি মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা এ ধরনের বিধান ছাড়াই খুব ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু আমরা এ দেশে প্রথমবারের মতো সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করতে যাচ্ছি, সেহেতু আমাদের উচিত প্রাথমিক পর্যায়ে এর ওপর সম্ভাব্য যেকোনো আক্রমণের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। তাই অন্তত ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সংসদ সদস্যদের ওপর এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। কিন্তু এই বিধিনিষেধটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না কি একটি সাধারণ আইন দ্বারা আরোপিত হবে, তা বিবেচনার বিষয়। আমার মতে, বিদ্যমান রাজনৈতিক ধ্যানধারণার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি সাধারণ আইন দ্বারা আরোপ করা যেতে পারে। এ ধরনের একটি আইন বর্তমানে ভারতীয় লোকসভায় বিবেচনাধীন রয়েছে। আমি মনে করি, সাংবিধানিক বিধান ছাড়াই একই লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে ভালো হবে।’
তবে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি সংবিধানে যুক্ত করতেই হয়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের পরামর্শ দেন মুন্তাকীম চৌধুরী। এ জন্য তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হলেই কারো সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে, এই বিধান নিয়ে আরও আলোচনার প্রস্তাব দেন। কেননা তার মতে, এই বিধানটি অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির জন্ম দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটি এমনও হতে পারে যে একটি রাজনৈতিক দল দুই বা ততোধিক ভাগে বিভক্ত এবং দলের সম্পাদক যদি সংখ্যালঘু অংশের অন্তর্ভুক্ত হন, তবে তিনি সম্পাদক হিসেবে তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যার ফলস্বরূপ যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অন্তর্ভুক্ত, তাদের সংসদের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে।
এর পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক দলের সম্পাদক তার প্রভাব বলয়ের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে দলের অধিকতর প্রভাবশালী সদস্যদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করতে পারেন। এর একটি চরম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে একটি রাজনৈতিক দলের সম্পাদক যদি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী হন, তবে তিনি তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন, যাতে সংসদে দলীয় প্রধানেরও সদস্য পদ বাতিল হতে পারে এবং ফলে তিনিই কার্যত সংসদীয় দলের নেতায় পরিণত হবেন।
এ রকম বাস্তবতায় ৭০ অনুচ্ছেদের এই বিধানটি বাতিল করে তিনি একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। সেটি হলো, কোনো সংসদ সদস্য যে দলের টিকিটে সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যদি ভোট দেন, তবে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে এবং এই ক্ষেত্রে দলের আস্থা রয়েছে এমন সংসদীয় দলের নেতা কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে স্পিকারকে কাজ করতে হবে। তিনি মনে করেন, ৭০ অনুচ্ছেদের মতো একটি বিধান গ্রহণ করতে হলে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্লিখন জরুরি।
সংবিধান কার্যকরের এক বছরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তাব
সংবিধানের চতুর্থ তফসিল (অনুচ্ছেদ ১৫৩ ক) ক্রান্তিকালীন বিধানাবলির অধীনে দফা ১, ১ক এবং ১খ সম্পর্কে মুন্তাকীম চৌধুরী যে পরামর্শ দেন তা হলো: সংবিধান প্রবর্তনের পরপরই নির্বাচন হতে হবে এবং সম্ভব হলে প্রথম নির্বাচনের তারিখ সংবিধানেই উল্লেখ থাকতে হবে। নির্বাচন সাপেক্ষে অন্তর্বর্তী সময়ে দেশ পরিচালনার জন্য সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান থাকা উচিত বলে তিনি মত দেন।
তার প্রস্তাব, খসড়া সংবিধানে বিধান করা হয়েছে যে সাধারণ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের শাসন সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যেভাবে ছিল সেভাবেই চলবে। এই ধারার অর্থ খুব স্পষ্ট নয় এবং এটি নিশ্চিতভাবেই বিভ্রান্তির জন্ম দেবে। এখানে স্পষ্টভাবে বর্তমান গণপরিষদ ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অতএব আরও স্পষ্টীকরণসহ উপরিউক্ত ধারা যুক্ত করা আবশ্যক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কোনো পরিবর্তন করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর থাকবে কি না? ক্রান্তিকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে যাবে, এমন অবস্থার বিষয়ে বিধান সৃষ্টি করা প্রয়োজন। গণপরিষদ ভেঙে যাওয়ার পর যিনি গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা অর্জন করতে পারেন এমন ব্যক্তিকে নির্বাচন করা সম্ভব হবে কি না। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিকল্প বিধান সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
এরকম বাস্তবতায় (ক) সংবিধান অনুযায়ী প্রথম নির্বাচনের শেষ তারিখ সংবিধানে উল্লেখ থাকতে হবে। (খ) সংবিধানের সূচনা থেকেই গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে স্পিকার আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বহাল থাকবেন। (গ) নির্বাচনের পর সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সরকার (মন্ত্রিপরিষদ) সংবিধান প্রদত্ত মন্ত্রিসভার সব ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা প্রয়োগ ও ভোগ করতে পারবে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় যেকোনো পরিবর্তন, সংযোজন বা সমন্বয় করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর থাকবে—এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিকল্প বিধান সৃষ্টি করা প্রয়োজন । তদুপরি, প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতিকে ক্রান্তিকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে একজনকে নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হবে। (ঘ) যদি ওপরের (ক) তে প্রস্তাবিত প্রথম নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব না হয় অথবা যদি প্রথম নির্বাচনের শেষ তারিখটি সংবিধান প্রণয়নের সর্বোচ্চ ৩ মাসের মধ্যে নির্ধারণ করা না যায়, তবে বর্তমান গণপরিষদকে সংবিধান দ্বারা প্রদত্ত সমস্ত ক্ষমতাসহ ক্রান্তিকালীন সংসদ হিসেবে পরিচালিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত। তবে শর্ত থাকে যে এই জাতীয় সংসদের মেয়াদ কোনো অবস্থাতেই এক বছরের বেশি হবে না এবং এটি নির্বাচনের অন্তত ৩০ দিন আগে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে সংবিধান কার্যকরের এক বছরের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। যেটি বিশেষভাবে বিবেচ্য, দেশকে কোনোভাবেই শূন্য অবস্থায় রাখা বাঞ্ছনীয় নয় এবং ওপরের (ক) অথবা (খ)-তে প্রস্তাবিত বিধান প্রণয়ন করা একান্ত অপরিহার্য।
ড. আবেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর বড় মেয়ে টিউলিপ চৌধুরীর স্বামী অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী। তার বাবা আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীর চাচাতো ভাই। অর্থাৎ মুন্তাকীম চৌধুরীর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে থেকেই তারা পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। ১৯৮৩ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আবেদ চৌধুরী ও টিউলিপ চৌধুরী।
আবেদ চৌধুরী জানান, তার শ্বশুর দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। এ মুহূর্তে রয়েছেন মেলবোর্ন শহরে। বয়স যেহেতু ৯০ পেরিয়েছে, ফলে শারীরিক অবস্থা খুব ভালো নয়। কিছুটা স্মৃতিভ্রমও হয়েছে। সবকিছু মনে করতে পারেন না।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন জাপানে যান, মুন্তাকীম চৌধুরী তখন জাপানের রাষ্ট্রদূত। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, জাপানে মুন্তাকীম চৌধুরীর বাসায় বঙ্গবন্ধুর দুই পাশে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন টিউলিপ চৌধুরী এবং এবং তার ছোট বোন পিওনী চৌধুরী। পিওনী চৌধুরী তার মেয়ে সামারা চৌধুরীকে নিয়ে বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।
আবেদ চৌধুরী জানান, মুন্তাকীম চৌধুরী ছিলেন জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত। প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন মনোরঞ্জন ধর। জাপানের সঙ্গে এখন বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, তার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন মুন্তাকীম চৌধুরী।
বাহাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। এরপর তাঁকে জাপানের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়া ও পূর্ব জার্মানিতেও দায়িত্ব পালন করেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সিলেটের আওয়ামী রাজনীতির টানাপোড়ের কারণে স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু তাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। এ নিয়ে তার (বঙ্গবন্ধু) মনে আক্ষেপ ছিল। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও সুদর্শন মুন্তাকীম চৌধুরীর জন্য রাষ্ট্রদূতের কাজ অবধারিত ছিল এবং তিনি এই দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি মুন্তাকীম চৌধুরী। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন। পরবর্তীতে মেয়ের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান।
আবেদ চৌধুরী জানাচ্ছেন, জাপানের সংসদ সদস্য হায়াকাওয়ার সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরীর সুসম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন। মুন্তাকীম চৌধুরীর কাছ থেকে আবেদ চৌধুরী ঘটনাটি শুনেছেন। সেটি হলো, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার সংবাদ শোনার পরে মি. হায়াকাওয়া ভীষণ মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করে একটি হাইকু (একধরনের জাপানি কবিতা) লিখে সেটি পড়েন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। আবেদ চৌধুরীর ভাষায়, তার শ্বশুর মুন্তাকীম চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে জাপান ও কোরিয়ার বন্ধুত্ব স্থাপনের ‘আর্কিটেক্ট’। রাজধানী ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁও তৈরি হয় হাওয়াকাওয়ার উদ্যোগে, যেখানে বড় ভূমিকা রাখেন মুন্তাকীম চৌধুরী। বাংলাদেশে পোশাক খাতেরও অন্যতম উদ্যোক্তা মুন্তাকীম চৌধুরী।
মুন্তাকীম চৌধুরীকে ‘প্রচারবিমুখ’ মানুষ উল্লেখ করে আবেদ চৌধুরী বলছেন, তিনি যখন শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন, তখনও খুব বেশি জনসমক্ষে আসতেন না। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিষয় এড়িয়ে চলতেন। রাজনীতিতে গিয়ে নিজের প্রচারে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর দুই সন্তানও রাজনীতিতে যুক্ত হননি।
লেখক: কারেন্ট এফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
শ্রেণিবিভাজিত রাষ্ট্রে সর্বজনীন শিক্ষা! | আর রাজী
আমরা একটা শ্রেণিবিভাজিত রাষ্ট্র করতে চাচ্ছি। যেখানে কে্বু কেউ ইংরেজি মাধ্যম বা বিদেশি ভালো স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে আমাদের মাথার ওপরে বসবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তারাই মূল ভূমিকা পালন করবে। আমরা শুধু প্রচুর শ্রমিক সরবরাহ করব
জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার যে উদ্দেশ্য, সেটা বাস্তবায়নের যে প্রক্রিয়া, আমরা কিন্তু দেশের সব মানুষকে প্রকৃতভাবেই শিক্ষিত করতে চাই। মানুষ এমনভাবে শিক্ষিত হবে যাতে সেই ব্যক্তি তার মর্যাদাবোধ, আত্মসম্মান রক্ষা করতে পারে এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে। বড় কথা হচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় সে যেন থাকতে পারে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক জীবনযাপন করতে পারে। এটাই তো প্রকৃত শিক্ষা। আমাদের শিক্ষার মূল ধারণা ছিল, যেটা আমাদের সংবিধানেরও মূল কথা সর্বক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমতা থাকতে হবে। সর্বোপরি মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্যই আমরা চাইছিলাম, শিক্ষাগ্রহণের শুরুতেই লেখাপড়া এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেন কোনো ধরনের বৈষম্য তৈরি না হয়। কিন্তু সেটা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। অনেক আগেই শিক্ষায় বৈষম্য তৈরি হয়ে গেছে। শহরে আবার কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম, সরকারি-বেসরকারি, বিদেশি নিয়ন্ত্রিত স্কুল অসংখ্য।
বিস্তারিত পড়ুন এখানে
শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে শিক্ষাব্যবস্থায় | আবদুল্লাহ আল মোহন
বর্তমান সরকারের শাসনামলে দেশের শিক্ষার বহুমাত্রিক সাফল্য অস্বীকার করা যাবে না। তবে যে কোনো বিষয়ের মতোই, শিক্ষা নিয়েও সমালোচনা থাকতে পারে। এক্ষেত্রে বাস্তব প্রেক্ষাপটকেও বিবেচনায় নিতে হবে
‘শিক্ষাই সব শক্তির মূল’ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের বাণীটি আমাদের প্রায় সবারই জানা। প্রবাদ বাক্যটি চারশো বছর পরেও সমান প্রাসঙ্গিক, একই মূল্য বহন করে। শিক্ষা ছাড়া কোনো ধরনের অগ্রগতি কল্পনাও করা যায় না। ফলে শিক্ষাকে আখ্যায়িত করা হয়, একটি জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে। সরকার শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছে নানা কার্যকরী পদক্ষেপ। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য প্রশংসার দাবি রাখে। শিক্ষার উন্নয়ন কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ আলোচনায় নজর দিতে হয়, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে। যেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এগিয়েছে। আগের তুলনায় বাংলাদেশের সূচকের মূল্যমান বেড়েছে দশমিক ০০০৬। ইউএনডিপির প্রকাশ করা ‘মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২১-২২’-এ এই চিত্র উঠে এসেছে। সর্বশেষ সূচকে বাংলাদেশ অবস্থান ১২৯।
বিস্তারিত পড়ুন এখানে
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে চলতি বছর মে মাসে। গত শুক্রবার ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে দেশটি। নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করার ঘোষণার তিন দিন পার হলেও কারও নাম প্রকাশ হয়নি। তবে বিভিন্ন মহলে নানা দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের নামে আলোচনা এখন সর্বত্র।
কারা যুক্তরাষ্ট্রের এ ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন বা পড়তে যাচ্ছেন তা নিয়ে রাজনৈতিক, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, যেহেতু নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে এর লক্ষ্য নির্বাচনী ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারাই। তারাই ভিসানীতির আওতায় পড়বেন, এটাই স্পষ্ট।
তারা আরও বলেন, ভিসানীতি প্রয়োগের কথা জানালেও যুক্তরাষ্ট্র কারও নাম প্রকাশ করেনি। তবুও বলা যেতে পারে, কাদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করবে পশ্চিমা এ প্রভাবশালী দেশটি।
এ ব্যক্তিরা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই একটা তালিকার বেশিরভাগ নামই চূড়ান্ত করে ফেলেছে। অল্পসংখ্যক বাকি থাকতে পারে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সেগুলোরও চূড়ান্ত করা হবে। যেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িত প্রতিষ্ঠান, দপ্তর, অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা থাকতে পারেন।
বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে ধারণা পাওয়া গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির উদ্দেশ্যই যেহেতু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে, ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা যারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকবেন তারাই ভিসানীতির আওতায় আসবেন। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও থাকতে পারেন। থাকতে পারেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, তারা যেকোনো দলের হতে পারেন। অল্পসংখ্যক ব্যবসায়ীও থাকতে পারেন।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন,‘ভিসানীতির বিষয়টি আমেরিকা প্রশাসন পরিষ্কার করে ঘোষণা না করলেও বুঝিয়ে দিয়েছে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারেন, এমন যে কেউ এ ভিসানীতির আওতায় পড়তে পারেন। যেমন রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাহী প্রশাসন, জুডিশিয়ারি অর্থাৎ যারাই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট থাকবেন, অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যাহত করবেন তারাই এর আওতায় আসবেন।’ তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের এর আওতায় পড়ার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, নির্বাচন ব্যাহত করার ছোট্ট সুযোগ তাদের হাতেও থাকে, তারা যদি জড়িত হন, ভিসানীতির আওতায় পড়বেন।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ভিসানীতির চেয়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে নেগোশিয়েশন জরুরি। কে ভিসানীতির আওতায় পড়ল, কে পড়ল না এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঐক্য।’ তিনি বলেন, ‘ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়ায় কারা রয়েছেন সেটা আমেরিকা প্রশাসন ঘোষণা না করলেও বোঝা খুব জটিল কিছু নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আমেরিকা যেহেতু ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে তাদের ভিসানীতি, ফলে পরিষ্কার হয়ে গেছে কারা পড়তে পারেন এর আওতায়। যারা নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, নিশ্চয়ই তারাই এর আওতায়।’
বিভিন্ন পর্যায়ের ও পেশার নিয়োজিত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক নেতারা ভিসানীতিকে তেমন আমলে না নিলেও বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা ও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভেতরে আমেরিকার ভিসানীতি ভীষণ ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে এর নানা কারণ জানা গেছে। এর মধ্যে বিদেশে টাকা পাচার, ব্যবসাবাণিজ্য, পরিবারের সদস্যদের বিদেশে থাকা এসব কারণে বেশি ভীতিতে ফেলেছে তাদের। আবার একটা অংশ বিদেশে কিছু না থাকলেও ভিসানীতির আওতায় পড়লে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার ভয় পাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করায় যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারেন এমন দুুশ্চিন্তা যেমন কারও কারও মনে ভর করেছে, তেমনি ভিসানীতিতে পড়ার সুযোগ নেই তারাও দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। কারণ এই শ্রেণির লোকজন মনে করছেন, কখনো যদি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান, তখন যদি ভিসা না হয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন এমন নামের তালিকাও চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। আরও অগ্রসর হয়ে কোনো কোনো মহল লম্বা তালিকা হাতে নিয়ে ঘুরছে। তবে এসব নামের তালিকার উৎস বা সূত্র নিশ্চিত নয় বলে কেউ কেউ বিষয়টি গুজব মনে করছেন। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের বাইরে প্রায় সবাই ভিসানীতি আতঙ্কে ভুগছেন।
একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভিসানীতিকে জয়-পরাজয় হিসেবে প্রচার করে এলেও ভেতরে ভীতি সবারই রয়েছে। কারণ পশ্চিমা দেশে তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। ফলে রাজনীতির বাইরেও ব্যক্তিজীবনের প্রয়োজনে ভিসানীতি তাদের ওপর যদি প্রভাব ফেলে, সে আশঙ্কা তো আছেই।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব বিষয়ে আমি কথা বলি না। আমি একটাই কথা বলব, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ সে কাজই করছে।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘ভিসানীতি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।’ তিনি বলেন, গণতন্ত্রের বিষয়ে বলতে হলে আরও অনেক বিষয় রয়েছে। এ ভিসানীতি কারা লক্ষ্যবস্তু জানতে চাইলে ইনু বলেন, ‘এটি নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমাদের। তারাই বলতে পারবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারও পরামর্শে সরকার কোনো প্রতিষ্ঠান অদলবদল করবে না, পরিবর্তনও আনবে না।’
আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর আন্দামান সাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সংস্থাটি বলছে, আজ রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। এ ছাড়া বর্ধিত পাঁচ দিনে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আজ সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সকাল ৯টা থেকে আজ রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায়; ঢাকা ও খুলনা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুই এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া সারা দেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত) দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে সৈয়দপুরে ২৫৯ মিলিমিটার। এ ছাড়া দেশের উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাতের মধ্যে দিনাজপুরে ১৯১, রংপুর ১৩৮, ডিমলায় ৯৯, তেঁতুলিয়ায় ৮৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে সীতাকুণ্ডে ৩৫.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর আজকের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়া ও রাজারহাটে ২৩.০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের উদ্যোগে আজ রাজধানীর উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীতে দুটি শান্তি সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটায় সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে যাত্রাবাড়ী মোড়সংলগ্ন শহীদ ফারুক সড়কে শান্তি সমাবেশ শুরু হবে।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুরুল আমিন রুহুল এমপির সভাপতিত্বে সমাবেশে কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা উপস্থিত থাকবেন।
বিকেল ৩টায় উত্তরা আজমপুর আমির কমপ্লেক্সের সামনে শুরু হবে আরেকটি শান্তি সমাবেশ। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের এ সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন।
এতে সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। সঞ্চালনা করবেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি।
রাজধানীর মুগদায় পৃথক ঘটনায় মিথিলা আক্তার মেঘলা (১৭) নামে এক কিশোরীসহ দুজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ময়নাতদন্তের জন্য আজ সোমবার সকালে মরদেহ দুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।
জানা গেছে সবুজবাগের বেগুনবাড়ি দক্ষিণগাঁও এলাকার আক্কাস আলী ও সুমি বেগম দম্পতির মেয়ে মিথিলা। তার মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে মুগদা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আঙ্গুরা আক্তার সীমা উল্লেখ করেন, রোববার দিবাগত রাত সাড়ে দশটার দিকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মিথিলা লাশ উদ্ধার করেন তিনি। মিথিলার শরীরে কোথাও কোন রকমের চিহ্ন না থাকলেও তার গলায় অর্ধচন্দ্রাকৃতির কালো দাগ রয়েছে
তিনি আরও উল্লেখ করেন, গত ৪-৫ মাস আগে প্রেমের সম্পর্কে বিয়ে করেন মিথিলা। তবে বিয়ের বিষয়টি তাদের দুই পরিবারেই কেউই মেনে নিচ্ছিল না। এ নিয়ে পারিবারিক মনোমালিন্য চলছিল। সেই অভিমানে মিথিলা গতকাল রোববার বাথরুমে গলায় ফাঁস দেন। বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
এদিকে উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাহিদ হাসান জানান, গতকাল রোববার সাড়ে দশটার দিকে একই হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা হয় অজ্ঞাতনামা (৩৪) এক ব্যক্তির মরদেহ। তিনি ভবঘুরে প্রকৃতির। গত ২১ তারিখ রাতে এক পথচারী তাকে উদ্ধার করে মুগদা মেডিকেলে ভর্তি করেন। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়। তার পরিচয় সনাক্তের চেষ্টা চলছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’