বিচ্ছেদের ৭২ বছর পর অনন্য এক মিলনে স্বামী-স্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ২১:২৮
কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার/ তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার! কুড়ি বছর পরেও প্রেয়সীকে দেখার কী আকুলতা 'কুড়ি বছর পরে' কবিতায়। শুধু কী কুড়ি বছর, জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও প্রিয়জনকে ভুলতে পারে না সহজে মানুষ। প্রেমে, স্নেহে কিংবা সামান্য স্মৃতিতে বেঁচে থাকে, আঁকড়ে রাখে।
ভারতের কেরালার নারায়ণান নাম্বিয়ার কয়েক যুগ ধরে তেমনি আঁকড়ে রেখেছিলেন কিশোরী স্ত্রীর স্মৃতি। একইভাবে স্ত্রী সারদারও নয় কি। ৭২ বছর পরে দেখা হলো এ দম্পতির, মাঝখানে গড়িয়ে গেছে কত বিচিত্র সময় আর জীবনের ভাঙাগড়া।
২৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিতে ওঠে এসেছে এ দুই দম্পতির ঘটনাবহুল জীবন, সম্পর্ক এবং পরিণতি। ১৯৪৬ সালে পরস্পরকে হারিয়ে ফেলার পর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ২০১৮ সালে দুজনের আবার মুখোমুখি হওয়ার গল্পও। ১৮ ডিসেম্বরে স্বামী-স্ত্রী মধ্যে ঘটে অনন্য এ মিলন!
দেশবিভাগের আগে কেরালার কাভুম্বাইয়ের গ্রামে কৃষক আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নারায়ণান নাম্বিয়ার। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার বাবা থালিয়ান রমন নাম্বিয়ার। গ্রেপ্তার এড়াতে বাবার সঙ্গে নারায়ণান আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই মাস পরেই সহিংস আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অভিযোগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তারা ।
নারায়ণান যখন আত্মগোপনে যান, তখন তার বিয়ের ১০ মাস। বিয়ের সময় তার বয়স ছিল ১৭ বছর আর স্ত্রী সারদার ছিল ১৩।
নারায়ণনের ভাগনে মধু কুমার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাবা-ছেলের সন্ধানে যখন-তখন সারদার ঘরে ঢুকে পড়ত মালাবার স্পেশাল পুলিশ। তাই নাবালিকা বউকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাপের বাড়িতে। সেসময় তাদের ঘর ভাঙচুর করে আগুনে পুড়িয়েও দেওয়া হয়।’
এদিকে জেলজীবনে নারায়ণান ঘুরতে থাকেন এক জেল থেকে আরেক জেলে। তার বাবাকেও গুলি করে হত্যা করা হয় জেলেই। স্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে সারদাকে অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয় তার পরিবার।
আট বছরের জন্য নারায়ণানকে কারাগারে পাঠানো হয়। কন্নুর, ভিয়য়ুর ও সালেমে তিনটি কারাগারে তিনি দফায় দফায় থাকেন।
মধু কুমার বলেন, ‘সালেমের কারাগারেই ১৯৫০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গুলি করে হত্যা করা হয় তার বাবা থালিয়ান রমনকে। নারায়ণানের শরীরেও ২২টি বুলেট শেল ঢুকে গিয়েছিল, এরপরেও তিনি বেঁচেছিলেন। এখনো তিনটি শেল বের করা যায়নি তার শরীর থেকে।’
১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়ার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন নারায়ণান। দীর্ঘ জেল জুলুমের জীবনে স্ত্রীকে হারালেও আবার বিয়ে করেন তিনি।
এদিকে অনেক বছর পর নারায়ণানের আত্মীয়দের সঙ্গে কোনো কারণে যোগাযোগ হয়ে যায় সারদার পুত্র ভার্গবনের, পেশায় যিনি একজন কৃষক। তাদের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে পারিবারিক ইতিহাস ওঠে আসে। এতে তিনি বুঝতে পারেন, দুই পরিবারের মধ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক আছে। তখন বের হয়ে আসে নারায়ণান-সারদার গল্প।
দুই পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, এই দম্পতির মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেবেন। এর মধ্যে অনেক আগেই মারা গেছেন নারায়ণানের স্ত্রী, এদিকে ৩০ বছর আগে বিধবা হন সারদাও। তার ছয় সন্তানের মধ্যে দুজন মারাও গেছে।
দুই পরিবারের প্রচেষ্টায় ভার্গবনের বাড়িতেই দুজনের সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো। বিপত্নীক নারায়ণান কয়েক আত্মীয়কে নিয়ে পারসীনিকাদাভুতে ভার্গবনের বাড়িতে সারদাকে দেখতে আসেন। প্রথমে সারদা তার সঙ্গে দেখা না করতে চাইলেও কিছুক্ষণ পর রাজি হন।
শেষপর্যন্ত দেখা হয় তাদের। মুখোমুখি বসেন একে অপরের। স্বাভাবিকভাবেই কারও মুখে কথা নেই তাদের। দীর্ঘ সময় পর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একে অপরের দেখা পেয়ে নিশ্চুপ তারা। অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছিল চোখ দুজনেরই। শান্তভাবে বসে চোখের জল মোছা ছাড়া ৮৯ বছরের সারদা আর ৯৩ বছরের নারায়ণানের আর কীই বা করার আছে? এভাবেই প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের এ দৃশ্যের কথা বর্ণনা করেন।
এত দিন পর দেখা হওয়ার পর কী কথা হয়েছিল দুজনের মধ্যে। প্রথম স্বামীর সামনে চুপ করে বসেছিলেন সারদা। কারও বিরুদ্ধে রাগ পুষে আছেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কারও ওপর তো রেগে নেই!’ তখন নারায়ণান বলেন, ‘তাহলে চুপ কেন? কিছু বলছ না কেন তবে?’ এরপরেও কিছুই বলতে পারেননি সারদা।
বেশ কিছুক্ষণ একসঙ্গে কাটালেও বেশি কিছু বলতে পারেননি পরস্পরকে। কিবা বলার থাকতে পেরে এত বছর পর হয়তো সেই ৭২ বছর আগের মাত্র ১০ মাসের সংসারে স্মৃতিই দখল করে নিয়েছিল পুরো মুহূর্তটিকে।
এনডিটিভি জানায়, ভার্গবনের পরিবার নারায়ণনের জন্য একটি ‘সাদ্য’ (দুপুরের খাবার) আয়োজন করেন এবং দুই পরিবার শিগগিরই ফের দেখা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে কাভুম্বাই গ্রামের সেই কৃষি আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন পাঁচজন কৃষক। ‘ডিসেম্বর ৩০’ নামে এ আন্দোলনের ওপরে একটি উপন্যাসও লিখেছেন নারায়ণানের কন্যা শান্তা কাভুম্বাই।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ২১:২৮

কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার/ তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার! কুড়ি বছর পরেও প্রেয়সীকে দেখার কী আকুলতা 'কুড়ি বছর পরে' কবিতায়। শুধু কী কুড়ি বছর, জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও প্রিয়জনকে ভুলতে পারে না সহজে মানুষ। প্রেমে, স্নেহে কিংবা সামান্য স্মৃতিতে বেঁচে থাকে, আঁকড়ে রাখে।
ভারতের কেরালার নারায়ণান নাম্বিয়ার কয়েক যুগ ধরে তেমনি আঁকড়ে রেখেছিলেন কিশোরী স্ত্রীর স্মৃতি। একইভাবে স্ত্রী সারদারও নয় কি। ৭২ বছর পরে দেখা হলো এ দম্পতির, মাঝখানে গড়িয়ে গেছে কত বিচিত্র সময় আর জীবনের ভাঙাগড়া।
২৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিতে ওঠে এসেছে এ দুই দম্পতির ঘটনাবহুল জীবন, সম্পর্ক এবং পরিণতি। ১৯৪৬ সালে পরস্পরকে হারিয়ে ফেলার পর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ২০১৮ সালে দুজনের আবার মুখোমুখি হওয়ার গল্পও। ১৮ ডিসেম্বরে স্বামী-স্ত্রী মধ্যে ঘটে অনন্য এ মিলন!
দেশবিভাগের আগে কেরালার কাভুম্বাইয়ের গ্রামে কৃষক আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নারায়ণান নাম্বিয়ার। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার বাবা থালিয়ান রমন নাম্বিয়ার। গ্রেপ্তার এড়াতে বাবার সঙ্গে নারায়ণান আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই মাস পরেই সহিংস আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অভিযোগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তারা ।
নারায়ণান যখন আত্মগোপনে যান, তখন তার বিয়ের ১০ মাস। বিয়ের সময় তার বয়স ছিল ১৭ বছর আর স্ত্রী সারদার ছিল ১৩।
নারায়ণনের ভাগনে মধু কুমার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাবা-ছেলের সন্ধানে যখন-তখন সারদার ঘরে ঢুকে পড়ত মালাবার স্পেশাল পুলিশ। তাই নাবালিকা বউকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাপের বাড়িতে। সেসময় তাদের ঘর ভাঙচুর করে আগুনে পুড়িয়েও দেওয়া হয়।’
এদিকে জেলজীবনে নারায়ণান ঘুরতে থাকেন এক জেল থেকে আরেক জেলে। তার বাবাকেও গুলি করে হত্যা করা হয় জেলেই। স্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে সারদাকে অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয় তার পরিবার।
আট বছরের জন্য নারায়ণানকে কারাগারে পাঠানো হয়। কন্নুর, ভিয়য়ুর ও সালেমে তিনটি কারাগারে তিনি দফায় দফায় থাকেন।
মধু কুমার বলেন, ‘সালেমের কারাগারেই ১৯৫০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গুলি করে হত্যা করা হয় তার বাবা থালিয়ান রমনকে। নারায়ণানের শরীরেও ২২টি বুলেট শেল ঢুকে গিয়েছিল, এরপরেও তিনি বেঁচেছিলেন। এখনো তিনটি শেল বের করা যায়নি তার শরীর থেকে।’
১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়ার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন নারায়ণান। দীর্ঘ জেল জুলুমের জীবনে স্ত্রীকে হারালেও আবার বিয়ে করেন তিনি।
এদিকে অনেক বছর পর নারায়ণানের আত্মীয়দের সঙ্গে কোনো কারণে যোগাযোগ হয়ে যায় সারদার পুত্র ভার্গবনের, পেশায় যিনি একজন কৃষক। তাদের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে পারিবারিক ইতিহাস ওঠে আসে। এতে তিনি বুঝতে পারেন, দুই পরিবারের মধ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক আছে। তখন বের হয়ে আসে নারায়ণান-সারদার গল্প।
দুই পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, এই দম্পতির মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেবেন। এর মধ্যে অনেক আগেই মারা গেছেন নারায়ণানের স্ত্রী, এদিকে ৩০ বছর আগে বিধবা হন সারদাও। তার ছয় সন্তানের মধ্যে দুজন মারাও গেছে।
দুই পরিবারের প্রচেষ্টায় ভার্গবনের বাড়িতেই দুজনের সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো। বিপত্নীক নারায়ণান কয়েক আত্মীয়কে নিয়ে পারসীনিকাদাভুতে ভার্গবনের বাড়িতে সারদাকে দেখতে আসেন। প্রথমে সারদা তার সঙ্গে দেখা না করতে চাইলেও কিছুক্ষণ পর রাজি হন।
শেষপর্যন্ত দেখা হয় তাদের। মুখোমুখি বসেন একে অপরের। স্বাভাবিকভাবেই কারও মুখে কথা নেই তাদের। দীর্ঘ সময় পর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একে অপরের দেখা পেয়ে নিশ্চুপ তারা। অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছিল চোখ দুজনেরই। শান্তভাবে বসে চোখের জল মোছা ছাড়া ৮৯ বছরের সারদা আর ৯৩ বছরের নারায়ণানের আর কীই বা করার আছে? এভাবেই প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের এ দৃশ্যের কথা বর্ণনা করেন।
এত দিন পর দেখা হওয়ার পর কী কথা হয়েছিল দুজনের মধ্যে। প্রথম স্বামীর সামনে চুপ করে বসেছিলেন সারদা। কারও বিরুদ্ধে রাগ পুষে আছেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কারও ওপর তো রেগে নেই!’ তখন নারায়ণান বলেন, ‘তাহলে চুপ কেন? কিছু বলছ না কেন তবে?’ এরপরেও কিছুই বলতে পারেননি সারদা।
বেশ কিছুক্ষণ একসঙ্গে কাটালেও বেশি কিছু বলতে পারেননি পরস্পরকে। কিবা বলার থাকতে পেরে এত বছর পর হয়তো সেই ৭২ বছর আগের মাত্র ১০ মাসের সংসারে স্মৃতিই দখল করে নিয়েছিল পুরো মুহূর্তটিকে।
এনডিটিভি জানায়, ভার্গবনের পরিবার নারায়ণনের জন্য একটি ‘সাদ্য’ (দুপুরের খাবার) আয়োজন করেন এবং দুই পরিবার শিগগিরই ফের দেখা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে কাভুম্বাই গ্রামের সেই কৃষি আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন পাঁচজন কৃষক। ‘ডিসেম্বর ৩০’ নামে এ আন্দোলনের ওপরে একটি উপন্যাসও লিখেছেন নারায়ণানের কন্যা শান্তা কাভুম্বাই।