শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতা
মুফতি এনায়েতুল্লাহ | ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
প্রত্যেক যুগে এমন কিছু অনন্য ব্যক্তিত্ব থাকেন, যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মানুষের কাছে তাকে মহিমান্বিত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় করে তোলে। আল্লামা শাহ আহমদ শফী ছিলেন সেই ধরনের এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। তার বহুমুখী কর্মময় জীবন সত্যিই ঈর্ষার যোগ্য। জীবনের পুরোটা সময় তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন বহুবিদ কর্মকান্ডের সঙ্গে। এ যেন সময়ের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহারের অনন্ত প্রচেষ্টা। তার অসাধারণ কর্মকান্ড শুধুমাত্র বর্তমানকে নিয়ে সীমাবদ্ধ নয় বরং তার নেওয়া উদ্যোগ-কর্মপন্থা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও উপকার পৌঁছাবে, কওমি শিক্ষাধারাকে তার আপন গতিপথে বহাল রাখতে ভূমিকা রাখবে।
দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসরণে পরিচালিত বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সনদের সরকারি কোনো স্বীকৃতি ছিল না। কওমি মাদ্রাসার স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে সরাসরি সনদের স্বীকৃতির বিরোধিতা করেছেন, কেউ আবার যুগ চাহিদা পূরণে সিলেবাস সংস্কারসহ সনদের স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন। স্বীকৃতি কার অধীনে হবে, কারা নেতৃত্ব দেবেন, কোন নামে হবে, এর পরে কী হবে এমন জটিল ও চটুল কতগুলো বিষয় নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এমতাবস্থায় আল্লামা শফীর নেতৃত্বে আলেম সমাজ সরকারি কর্তৃত্বাধীনে না গিয়ে শুধুমাত্র সনদের স্বীকৃতি নেন।
বহুল আলোচিত ও আকাক্সিক্ষত কওমি সনদ নিয়ে দীর্ঘদিনের সৃষ্ট জটিলতার অবসান হয় আল্লামা শফির হাত ধরে। আলাদা আলাদা বোর্ডগুলো একটা সংস্থার অধীনে আসে, এটা এক বিরল অর্জন।
দলমত নির্বিশেষে আল্লামা শফির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ দাবির ফলে সরকার দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান ঘোষণা করে। জাতীয় সংসদে ‘আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীনে এ সংক্রান্ত বিল পাস হয়। পাসকৃত বিলেও আল্লামা শফির মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বলা হয়, কওমি মাদ্রাসাগুলো দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি-আদর্শ ও নেসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসারে পরিচালিত হবে, সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়নি আইনে।
সমকালীন সময়ে নেতৃত্বদানের এই জায়গায় আল্লামা শফি ব্যতিক্রম ছিলেন। অসাধারণ দায়িত্ববোধ, গভীর জীবন দর্শন ও নিরলস শ্রমের ফলে তিনি অবিস্মরণীয় সাফল্যও অর্জন করেছেন। যে সময় আর প্রেক্ষাপটে আল্লামা শফি ইস্যুভিত্তিক বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জনআকাক্সক্ষার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছেন- সেটাও অবাক করার মতো। শতবর্ষী এই আলেম রাজনৈতিকভাবে প্রসিদ্ধি ও আলোচনায় এসেছেন জীবনের ৮০টি বছর নীরবে-নিভৃতে কাটিয়ে, আর সাফল্য পেয়েছেন বয়স নব্বইয়ের কোটা পার করে। যে বয়সে মানুষ অবসর সময় কাটান, সেই সময়টাতে তিনি নেতৃত্বের আসনে ছিলেন, শক্ত হাতে সংগঠন ও দায়িত্ব সামলেছেন। আল্লামা শফীর কর্মজীবন শুরু হয় হাটহাজারী মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে। পরে তিনি এ মাদ্রাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন। মহাপরিচালকের পাশাপাশি শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও পালন করেছেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি নিজের মেধা, শ্রম, কর্মচিন্তা আর সৃষ্টিশীল সুকুমারবৃত্তির চর্চায় নিজেকে তৈরি করেছেন।
ব্যক্তিজীবনে আল্লামা শফি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে জড়াননি। তবে ইসলাম ও মুসলমানদের যেকোনো সংকটে আল্লামা শফীর আহ্বানে পারস্পরিক মতভেদ ভুলে সবাই ছুটে যেতেন তার কাছে। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রয়োজনে সাড়া দিতে তিনিও কুণ্ঠাবোধ করতেন না।
আলেমরা চিরকালই শান্তিপ্রিয়। তারা ক্ষমতা দখলের জন্য কোনো আন্দোলন করেন না, ইমান-আকিদা সংরক্ষণ ও দেশরক্ষার তাগিদে তারা মাঠে নামেন। আল্লামা শফীর কর্মপন্থা ও আন্দোলন-সংগ্রামে বিষয়টি বারবার প্রকাশ পেয়েছে। দীর্ঘ জীবনে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিল, শানে রিসালাত সম্মেলনসহ নানা সভা-সেমিনারে যোগ দিয়েছেন। এসব সভায় তিনি ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করে আলোচনা করেছেন। প্রতিটি নাগরিককে দ্বীনি ইলম শিক্ষার পাশাপাশি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। গোনাহমুক্ত জীবন-যাপনের কথা বলেছেন। আমল ও সংশোধনীমূলক বক্তব্যই বেশি দিয়েছেন। দাবি-দাওয়ার বিষয়ে কঠিন কথাগুলোও তিনি সহজ-সরলভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেননি কখনো।
২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। দেশ ও সমাজকে আলোকিত করতে তার মতো মানুষ দরকার। তার মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সমাজে বিরল।
শেয়ার করুন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ | ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

প্রত্যেক যুগে এমন কিছু অনন্য ব্যক্তিত্ব থাকেন, যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মানুষের কাছে তাকে মহিমান্বিত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় করে তোলে। আল্লামা শাহ আহমদ শফী ছিলেন সেই ধরনের এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। তার বহুমুখী কর্মময় জীবন সত্যিই ঈর্ষার যোগ্য। জীবনের পুরোটা সময় তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন বহুবিদ কর্মকান্ডের সঙ্গে। এ যেন সময়ের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহারের অনন্ত প্রচেষ্টা। তার অসাধারণ কর্মকান্ড শুধুমাত্র বর্তমানকে নিয়ে সীমাবদ্ধ নয় বরং তার নেওয়া উদ্যোগ-কর্মপন্থা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও উপকার পৌঁছাবে, কওমি শিক্ষাধারাকে তার আপন গতিপথে বহাল রাখতে ভূমিকা রাখবে।
দারুল উলুম দেওবন্দের অনুসরণে পরিচালিত বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সনদের সরকারি কোনো স্বীকৃতি ছিল না। কওমি মাদ্রাসার স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে সরাসরি সনদের স্বীকৃতির বিরোধিতা করেছেন, কেউ আবার যুগ চাহিদা পূরণে সিলেবাস সংস্কারসহ সনদের স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন। স্বীকৃতি কার অধীনে হবে, কারা নেতৃত্ব দেবেন, কোন নামে হবে, এর পরে কী হবে এমন জটিল ও চটুল কতগুলো বিষয় নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এমতাবস্থায় আল্লামা শফীর নেতৃত্বে আলেম সমাজ সরকারি কর্তৃত্বাধীনে না গিয়ে শুধুমাত্র সনদের স্বীকৃতি নেন।
বহুল আলোচিত ও আকাক্সিক্ষত কওমি সনদ নিয়ে দীর্ঘদিনের সৃষ্ট জটিলতার অবসান হয় আল্লামা শফির হাত ধরে। আলাদা আলাদা বোর্ডগুলো একটা সংস্থার অধীনে আসে, এটা এক বিরল অর্জন।
দলমত নির্বিশেষে আল্লামা শফির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ দাবির ফলে সরকার দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান ঘোষণা করে। জাতীয় সংসদে ‘আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীনে এ সংক্রান্ত বিল পাস হয়। পাসকৃত বিলেও আল্লামা শফির মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বলা হয়, কওমি মাদ্রাসাগুলো দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি-আদর্শ ও নেসাব (পাঠ্যসূচি) অনুসারে পরিচালিত হবে, সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়নি আইনে।
সমকালীন সময়ে নেতৃত্বদানের এই জায়গায় আল্লামা শফি ব্যতিক্রম ছিলেন। অসাধারণ দায়িত্ববোধ, গভীর জীবন দর্শন ও নিরলস শ্রমের ফলে তিনি অবিস্মরণীয় সাফল্যও অর্জন করেছেন। যে সময় আর প্রেক্ষাপটে আল্লামা শফি ইস্যুভিত্তিক বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জনআকাক্সক্ষার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে অতুলনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছেন- সেটাও অবাক করার মতো। শতবর্ষী এই আলেম রাজনৈতিকভাবে প্রসিদ্ধি ও আলোচনায় এসেছেন জীবনের ৮০টি বছর নীরবে-নিভৃতে কাটিয়ে, আর সাফল্য পেয়েছেন বয়স নব্বইয়ের কোটা পার করে। যে বয়সে মানুষ অবসর সময় কাটান, সেই সময়টাতে তিনি নেতৃত্বের আসনে ছিলেন, শক্ত হাতে সংগঠন ও দায়িত্ব সামলেছেন। আল্লামা শফীর কর্মজীবন শুরু হয় হাটহাজারী মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে। পরে তিনি এ মাদ্রাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন। মহাপরিচালকের পাশাপাশি শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও পালন করেছেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি নিজের মেধা, শ্রম, কর্মচিন্তা আর সৃষ্টিশীল সুকুমারবৃত্তির চর্চায় নিজেকে তৈরি করেছেন।
ব্যক্তিজীবনে আল্লামা শফি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে জড়াননি। তবে ইসলাম ও মুসলমানদের যেকোনো সংকটে আল্লামা শফীর আহ্বানে পারস্পরিক মতভেদ ভুলে সবাই ছুটে যেতেন তার কাছে। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রয়োজনে সাড়া দিতে তিনিও কুণ্ঠাবোধ করতেন না।
আলেমরা চিরকালই শান্তিপ্রিয়। তারা ক্ষমতা দখলের জন্য কোনো আন্দোলন করেন না, ইমান-আকিদা সংরক্ষণ ও দেশরক্ষার তাগিদে তারা মাঠে নামেন। আল্লামা শফীর কর্মপন্থা ও আন্দোলন-সংগ্রামে বিষয়টি বারবার প্রকাশ পেয়েছে। দীর্ঘ জীবনে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিল, শানে রিসালাত সম্মেলনসহ নানা সভা-সেমিনারে যোগ দিয়েছেন। এসব সভায় তিনি ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করে আলোচনা করেছেন। প্রতিটি নাগরিককে দ্বীনি ইলম শিক্ষার পাশাপাশি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। গোনাহমুক্ত জীবন-যাপনের কথা বলেছেন। আমল ও সংশোধনীমূলক বক্তব্যই বেশি দিয়েছেন। দাবি-দাওয়ার বিষয়ে কঠিন কথাগুলোও তিনি সহজ-সরলভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেননি কখনো।
২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। দেশ ও সমাজকে আলোকিত করতে তার মতো মানুষ দরকার। তার মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সমাজে বিরল।