নুসরাত আমাদের জোয়ান অব আর্ক
আবু সাঈদ আহমেদ | ১১ এপ্রিল, ২০১৯ ১৫:২৮
নুসরাত, প্রিয় নুসরাত আর নেই। শরীরের সব যন্ত্রণা সয়ে সে আত্মসমর্পণ করেছে মৃত্যুর কাছে। চিকিৎসকদের শত চেষ্টা ব্যর্থ করে, কোটি মানুষের প্রার্থনা তুচ্ছ করে, শরীরের সব যন্ত্রণা সয়ে মাত্র দু’ফোঁটা পানি চুরি করে খাওয়ার জন্য বাবার কাছে আবদার করেছিল যে নুসরাত, সে নুসরাত আজ পরাজিত হয়েছে অমোঘ মৃত্যুর কাছ।
ফেনীর সোনাগাজীর অচেনা-অজানা এক নুসরাত গত পাঁচ দিনে পরিণত হয়েছিল দেশের মানুষের আপনজনে। হয়ে উঠেছিল কারো বোন, কারো কন্যা, কারো সমবয়সী বন্ধু। নুসরাতের জীবন সংকটাপন্ন জানার পরও সবার আশা ছিল ফের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে নুসরাত। যারা তাকে আগুনে পুড়িয়েছে, যারা তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে একটা জীবন বেঁচে থাকার মাধ্যমেই নুসরাত জবাব দেবে।
বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় সে চলে গেছে। যে যাওয়ার আর কোনো ফেরা নেই। যাওয়ার আগে সে জেনে গেছে, এ পৃথিবীতে মানুষের মুখোশে ঢাকা দানবের বাস। পোড়া শরীরের জ্বলনে জ্বলতে জ্বলতে সে আরো জেনে গেছে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার পরই মানুষ দাঁড়ায় মানুষের পাশে, তার আগে নয়। শরীরের ৮৫ ভাগ পুড়ে যাওয়ার পরও যে মেয়েটি তার ‘ডেথ ডিক্লারেশনে’ দৃঢ়ভাবে লড়াইয়ের কথা জানায় তাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না, ভালো না বেসে থাকা যায় না।
মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে ৬ এপ্রিল। শনিবার ছিল আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা। ওই দিন সকাল ৯টায় নুসরাত পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যায়। ওখানে তাকে কৌশলে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে যায় দুষ্কৃতকারীরা। ছাদে গেলে তাকে মামলা তুলে নিতে বলে চারজন বোরকা পরিহিত ব্যক্তি। উল্লেখ্য, এই বছরের ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে এই যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেছিলেন নুসরাতে মা। নুসরাত মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানালে তার হাত বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
আগুনে পুড়তে পুড়তে ছাদ থেকে নেমে আসে নুসরাত। আত্নীয়-স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। শরীরের প্রায় ৮৫ ভাগ দগ্ধ নুসরাতকে তাৎক্ষণিক ফেনী সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে প্রেরণ করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাতের চিকিৎসার ভার নেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর প্রেরণের নির্দেশনা দেন। কিন্তু নুসরাতের শারীরিক অবস্থা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানোর মতো ছিল না।
নুসরাত যে ‘ডেথ ডিক্লারেশন’ বা মৃত্যুপথযাত্রীর জবানবন্দি দিয়েছে তার সারাংশ ভয়ংকর। বোরকা পরা চারজন তার গায়ে আগুন দিয়েছে। আগুন দেওয়ার আগে তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে নির্দেশ দিয়েছে। আগুন দাতাদের একজনের নাম শম্পা, শম্পার নাম ধরে যে ডেকেছে সেও নারী। অর্থাৎ আগুনদাতাদের অন্তত দু'জন নারী, বাকি দু'জন বোরকা পরে থাকায় চেনা যায়নি।
নুসরাতের 'ডেথ ডিক্লারেশন' পড়ে যে প্রশ্নগুলো ভাবাচ্ছে-
১. নুসরাতের মতো ওই মেয়েগুলোও কি যৌন হয়রানির শিকার?
২. মেয়েগুলো কি ব্ল্যাক মেলিংয়ের শিকার?
৩. নুসরাতের সাহসী অবস্থানের এবং মামলার ফলে নির্যাতিত অনেকের নামের সঙ্গে তাদের নামও বেরিয়ে আসতে পারে, সামাজিকভাবে তারা হেয় হতে পারে- এই ভয়ে কি এমন ঘটনা ঘটিয়েছে?
৪. ওই মাদ্রাসা ঘিরে মাদ্রাসা কমিটি-অধ্যক্ষ-শিক্ষক ও ছাত্র মিলে কি যৌন হয়রানিকারীদের একটি চক্র গড়ে উঠেছে?
এ ছাড়া সার্বিক ঘটনা পর্যবেক্ষণে আরো দু’টি প্রশ্ন খুব পীড়া দিচ্ছে-
১. যৌন হয়রানিকারীদের রক্ষাকর্তা কে বা কারা?
২. সোনাগাজী থানা মামলা তদন্তের আগেই আত্মহত্যা বলে চিহ্নিত করার সম্ভাবনা দাঁড় করাল কেন?
৩. নুসরাতকে আগুনে পোড়ানোর বিচারের দাবিতে যখন সারা দেশ তৎপর তখন মূল অভিযুক্ত মাদ্রাসা অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মিছিল হয় কার/কাদের প্রশ্রয়ে।
প্রসঙ্গত, যৌন হয়রানির নির্যাতনের মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ঘটনার আগে থেকেই কারাগারে আছে। পুলিশ ইতিমধ্যে আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনা উদ্ঘাটিত হোক, সত্য সামনে আসুক, ধর্মের লেবাসে অধর্ম রুখে দেওয়া হোক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে আধিপত্য বিস্তার ও রক্ষার রাজনীতি বহুদিন ধরেই চলে আসছে। মাদ্রাসাগুলো এর বাইরে নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো মাদ্রাসাগুলোকেও কঠোর নজরদারিতে আনা প্রয়োজন।
নুসরাত, প্রিয় নুসরাত ক্ষমা করো, এই পৃথিবী তোমাকে ধারণের যোগ্য নয়। একদিন এই পৃথিবী সবার জন্য নিরাপদ হবে, মানুষের মুখোশ পরে অমানুষের দল কোনো নুসরাতের গায়ে আগুনের লেলিহান শিখার বর্বরতা সৃষ্টির সুযোগ পাবে না। এই পৃথিবীর সব নুসরাত যাপন করবে স্বস্তির জীবন। ওই একদিন এনে দিতে কাজ করছে অসংখ্য মানুষ।
ওই একদিন আসার পথে পথে অমানুষের থাবায় প্রিয় বোন আমার, তোমার মতো পুড়ে পুড়ে যাবে একজন নুসরাত, একজন জোয়ান অব আর্ক।
আবু সাঈদ আহমেদ: লেখক, ব্লগার
শেয়ার করুন
আবু সাঈদ আহমেদ | ১১ এপ্রিল, ২০১৯ ১৫:২৮

নুসরাত, প্রিয় নুসরাত আর নেই। শরীরের সব যন্ত্রণা সয়ে সে আত্মসমর্পণ করেছে মৃত্যুর কাছে। চিকিৎসকদের শত চেষ্টা ব্যর্থ করে, কোটি মানুষের প্রার্থনা তুচ্ছ করে, শরীরের সব যন্ত্রণা সয়ে মাত্র দু’ফোঁটা পানি চুরি করে খাওয়ার জন্য বাবার কাছে আবদার করেছিল যে নুসরাত, সে নুসরাত আজ পরাজিত হয়েছে অমোঘ মৃত্যুর কাছ।
ফেনীর সোনাগাজীর অচেনা-অজানা এক নুসরাত গত পাঁচ দিনে পরিণত হয়েছিল দেশের মানুষের আপনজনে। হয়ে উঠেছিল কারো বোন, কারো কন্যা, কারো সমবয়সী বন্ধু। নুসরাতের জীবন সংকটাপন্ন জানার পরও সবার আশা ছিল ফের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে নুসরাত। যারা তাকে আগুনে পুড়িয়েছে, যারা তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে একটা জীবন বেঁচে থাকার মাধ্যমেই নুসরাত জবাব দেবে।
বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় সে চলে গেছে। যে যাওয়ার আর কোনো ফেরা নেই। যাওয়ার আগে সে জেনে গেছে, এ পৃথিবীতে মানুষের মুখোশে ঢাকা দানবের বাস। পোড়া শরীরের জ্বলনে জ্বলতে জ্বলতে সে আরো জেনে গেছে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার পরই মানুষ দাঁড়ায় মানুষের পাশে, তার আগে নয়। শরীরের ৮৫ ভাগ পুড়ে যাওয়ার পরও যে মেয়েটি তার ‘ডেথ ডিক্লারেশনে’ দৃঢ়ভাবে লড়াইয়ের কথা জানায় তাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না, ভালো না বেসে থাকা যায় না।
মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে ৬ এপ্রিল। শনিবার ছিল আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা। ওই দিন সকাল ৯টায় নুসরাত পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যায়। ওখানে তাকে কৌশলে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে যায় দুষ্কৃতকারীরা। ছাদে গেলে তাকে মামলা তুলে নিতে বলে চারজন বোরকা পরিহিত ব্যক্তি। উল্লেখ্য, এই বছরের ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে এই যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেছিলেন নুসরাতে মা। নুসরাত মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানালে তার হাত বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
আগুনে পুড়তে পুড়তে ছাদ থেকে নেমে আসে নুসরাত। আত্নীয়-স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। শরীরের প্রায় ৮৫ ভাগ দগ্ধ নুসরাতকে তাৎক্ষণিক ফেনী সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে প্রেরণ করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাতের চিকিৎসার ভার নেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর প্রেরণের নির্দেশনা দেন। কিন্তু নুসরাতের শারীরিক অবস্থা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানোর মতো ছিল না।
নুসরাত যে ‘ডেথ ডিক্লারেশন’ বা মৃত্যুপথযাত্রীর জবানবন্দি দিয়েছে তার সারাংশ ভয়ংকর। বোরকা পরা চারজন তার গায়ে আগুন দিয়েছে। আগুন দেওয়ার আগে তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে নির্দেশ দিয়েছে। আগুন দাতাদের একজনের নাম শম্পা, শম্পার নাম ধরে যে ডেকেছে সেও নারী। অর্থাৎ আগুনদাতাদের অন্তত দু'জন নারী, বাকি দু'জন বোরকা পরে থাকায় চেনা যায়নি।
নুসরাতের 'ডেথ ডিক্লারেশন' পড়ে যে প্রশ্নগুলো ভাবাচ্ছে-
১. নুসরাতের মতো ওই মেয়েগুলোও কি যৌন হয়রানির শিকার?
২. মেয়েগুলো কি ব্ল্যাক মেলিংয়ের শিকার?
৩. নুসরাতের সাহসী অবস্থানের এবং মামলার ফলে নির্যাতিত অনেকের নামের সঙ্গে তাদের নামও বেরিয়ে আসতে পারে, সামাজিকভাবে তারা হেয় হতে পারে- এই ভয়ে কি এমন ঘটনা ঘটিয়েছে?
৪. ওই মাদ্রাসা ঘিরে মাদ্রাসা কমিটি-অধ্যক্ষ-শিক্ষক ও ছাত্র মিলে কি যৌন হয়রানিকারীদের একটি চক্র গড়ে উঠেছে?
এ ছাড়া সার্বিক ঘটনা পর্যবেক্ষণে আরো দু’টি প্রশ্ন খুব পীড়া দিচ্ছে-
১. যৌন হয়রানিকারীদের রক্ষাকর্তা কে বা কারা?
২. সোনাগাজী থানা মামলা তদন্তের আগেই আত্মহত্যা বলে চিহ্নিত করার সম্ভাবনা দাঁড় করাল কেন?
৩. নুসরাতকে আগুনে পোড়ানোর বিচারের দাবিতে যখন সারা দেশ তৎপর তখন মূল অভিযুক্ত মাদ্রাসা অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মিছিল হয় কার/কাদের প্রশ্রয়ে।
প্রসঙ্গত, যৌন হয়রানির নির্যাতনের মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ঘটনার আগে থেকেই কারাগারে আছে। পুলিশ ইতিমধ্যে আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনা উদ্ঘাটিত হোক, সত্য সামনে আসুক, ধর্মের লেবাসে অধর্ম রুখে দেওয়া হোক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে আধিপত্য বিস্তার ও রক্ষার রাজনীতি বহুদিন ধরেই চলে আসছে। মাদ্রাসাগুলো এর বাইরে নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো মাদ্রাসাগুলোকেও কঠোর নজরদারিতে আনা প্রয়োজন।
নুসরাত, প্রিয় নুসরাত ক্ষমা করো, এই পৃথিবী তোমাকে ধারণের যোগ্য নয়। একদিন এই পৃথিবী সবার জন্য নিরাপদ হবে, মানুষের মুখোশ পরে অমানুষের দল কোনো নুসরাতের গায়ে আগুনের লেলিহান শিখার বর্বরতা সৃষ্টির সুযোগ পাবে না। এই পৃথিবীর সব নুসরাত যাপন করবে স্বস্তির জীবন। ওই একদিন এনে দিতে কাজ করছে অসংখ্য মানুষ।
ওই একদিন আসার পথে পথে অমানুষের থাবায় প্রিয় বোন আমার, তোমার মতো পুড়ে পুড়ে যাবে একজন নুসরাত, একজন জোয়ান অব আর্ক।
আবু সাঈদ আহমেদ: লেখক, ব্লগার