প্রবারণা পূর্ণিমা: জীবনবোধ তৈরির সর্বোত্তম শিক্ষা
ভদন্ত বোধিরত্ন ভিক্ষু | ২০ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:৩২
শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা বিশ্ব বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। এটি বৌদ্ধদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বিশ্বের সব বৌদ্ধ আজ এ শুভ তিথিটি যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উদযাপন করবে।
প্রবারণা বৌদ্ধ ধর্মীয় বিধানে বিনয়ভিত্তিক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্রতকর্ম ও অনুষ্ঠান। এর অপর নাম আশ্বিনী পূর্ণিমা। প্রবারণার এ আবেদন বৌদ্ধ ভিক্ষু জীবনে অধিক গুরুত্ব পেলেও বৌদ্ধ নর-নারী, উপাসক-উপাসিকাদের জীবনেও এর গুরুত্ব কম নয়। শুধু ধ্যানের দিক থেকে নয়, আত্মশুদ্ধিতা, রিপু সংযম এবং আত্মোপলব্ধিতে এর অর্থবহ দিক আমাদের পূর্ণ মনুষ্যত্ব বিকাশে অনেক অবদান রাখে।
এ উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান তো আছেই, তার সঙ্গে আছে আমাদের আত্মশাসন ও আত্মবোধের মূল শিক্ষা। এ যেন এক জীবনবোধ তৈরির সর্বোত্তম শিক্ষা। কারণ শাস্ত্রে প্রবারণার অর্থে বলা হয়েছে যে, প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা এবং নিষেধ করা। বরণ করা অর্থ হল, বিশুদ্ধ বিনয়াচারে জীবনকে পরিচালিত করার উত্তম আদর্শ গ্রহণ করা। আর নিষেধ করা অর্থ হল, আদর্শবান ও ধর্মাচারের পরিপন্থী কর্মগুলো থেকে বিরত থাকা অথবা ওইসব কর্ম পরিহার করা। অতএব অর্থের দিক থেকে প্রবারণার গুরুত্ব ও মর্যাদা অতীব মহান ও তাৎপর্যমণ্ডিত। তাই বৌদ্ধ প্রবারণা উদযাপনে বলা হয়, পাপ ও অশুভকর্ম থেকে মুক্ত থাকার জন্যই সৎ এ ব্রতকর্মের সাধনা। সুন্দর জীবন গঠনের ক্ষেত্রে এবং সত্যনিষ্ঠ ধ্যান সমাধির ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। অতএব শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাসাধনার পাশাপাশি আত্মসংযম ও ত্যাগ শিক্ষা বৌদ্ধ প্রবারণার একটি অপরিহার্য বিধান বলে বিবেচিত হয়েছে।
অন্যদিকে, ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুসংঘ আপন আপন দোষত্রুটি স্বীকারপূর্বক অপর ভিক্ষুসংঘের কাছে প্রকাশ করে এবং তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহ্বান জানায়। অর্থাৎ, ভিক্ষুরা জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে যে কোনো অপরাধ করে থাকলে সেই অপরাধ স্বীকারপূর্বক প্রবারণা দিবসে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কারণ দৈনন্দিন জীবনাচারে চিত্ত নানা রকম অকুশলে আবিষ্ট হয়। তাই প্রতিটি মুহূর্তে চিত্ত জাগ্রত রেখে গুণের প্রতি আকৃষ্ট থাকার জন্যই এ প্রবারণার প্রবর্তন করা হয়।
বুদ্ধের জীবদ্দশায় শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থানকালে তিনি ভিক্ষুসংঘের পালনীয় কর্তব্য হিসেবে এ প্রবারণার প্রবর্তন করেন। বৌদ্ধ ধর্মীয় মতে, ভিক্ষু-শ্রামণ ও উপাসক-উপাসিকারা আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা- এই তিন মাস শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা সাধনার অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। এই তিন মাসে অষ্টমী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা এবং ধ্যান, উপবাস ও সংযম শিক্ষার মধ্য দিয়েই তারা তাদের ব্রত অধিষ্ঠান সমাপন করেন। তাই ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসব্রত অধিষ্ঠানের শেষ দিবসটিকেই বলা হয় বৌদ্ধ আভিধানিক শব্দে ‘প্রবারণা’। এটিকে বৌদ্ধ পরিভাষায় আশার তৃপ্তি বা অভিলাষ পূরণও বলা হয়। প্রবারণা দিবসে বৌদ্ধরা সব ভেদাভেদ ভুলে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পারস্পরিক একতা, মৈত্রী, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ভাব নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। হৃদয়কে অনেক বড় করে, চিত্তকে বিলিয়ে দেন। এর মাধ্যমে মনের মলিনতা দূর হয়, ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হয়। এতে চিত্তের সংকীর্ণতাও দূরীভূত হয়। বৌদ্ধরা সব মানুষের, বিশ্বের সব জীবের সুখ ও কল্যাণ এবং সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করেন।
প্রবারণা আগমনের এক সপ্তাহ বা দু’সপ্তাহ আগে থেকেই সব বৌদ্ধ নানা ধরনের প্রস্তুতি ও আয়োজন সম্পন্ন করেন। নিজগৃহ ও বিহারকে পরিমার্জনপূর্বক সাজিয়ে নেন। পতাকা, ব্যানার ও ফেস্টুন দিয়ে বিহার এবং বিহারের চারপাশ বর্ণাঢ্যভাবে সজ্জিত করে রাখেন। বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী এবং বৃদ্ধ-প্রৌঢ় বিভিন্ন স্থরের মানুষ সেদিন আনন্দে মেতে ওঠেন। ছেলেমেয়েরা বাগান থেকে পত্র-পুষ্পাদি এনে এবং নানা উপকরণে গ্রাম ও রাস্তাঘাটকে সাজিয়ে নেয়। রঙিন কাগজ দিয়ে নানা ধরনের ফানুস তৈরি করে। আগে থেকেই বাড়িতে তৈরি করে রাখে নানা রকমের মিষ্টি, সুস্বাদু খাদ্যভোজ এবং নানা ধরনের আহারাদি। প্রবারণার সকাল থেকেই বৌদ্ধ নর-নারীরা নতুন ও পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরিধান করে শোভাযাত্রায় বের হয় এবং পুজার অর্ঘ্য আর দানীয় সামগ্রী হাতে নিয়ে বিহারে উপস্থিত হয়। তারা সেদিন পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করেন, পুজা দেন এবং ধর্ম শ্রবণ করেন। সাধুবাদ ও ধর্মীয় আবেশে সেদিন বিহার প্রাঙ্গণ মুখর হয়। দানের জন্য বিহারে সুদৃশ্য কল্পতরু তৈরি করা হয়। সেদিনের ওই কল্পতরু হয় ধর্মীয় আবেশের একটি বিশেষ আকর্ষণ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই তাদের সামর্থ্যানুযায়ী ওই কল্পতরু বৃক্ষে নানা ধরনের দানীয় সামগ্রী বেঁধে দেন। এ কল্পতরু হচ্ছে জন্মচক্রের গতিধারায় উচ্চদিকে যাওয়ার চিত্তের একটি অবলম্বন। জীবের জীবনগতি যে বহু দীর্ঘ এবং বহু স্তরের মাধ্যমে এ জীবনচক্র অতিবাহিত বা প্রবাহিত হয় তারই নিদর্শনস্বরূপ এই কল্পতরু। এটিকে কল্পবৃক্ষও বলা হয়। পালিতে বলা হয়- কল্পরুবৃক্ষ। বৌদ্ধমতে কল্পতরু হল জন্ম-জন্মান্তরের সুকৃতি সাধনার এক প্রতীক। তাই বৌদ্ধরা এ প্রবারণা দিবসে পুণ্য বা সুকৃতি অর্জনের জন্য কল্পতরুর পূজা করেন। প্রবারণা পূর্ণিমার আরেকটি উৎসবময় দিক হল ফানুস উড্ডয়ন করা।
বৌদ্ধশাস্ত্রমতে, বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর তার মাতৃদেবীকে ধর্মদেশনার জন্য তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন। সেখানে তিনি তিন মাস মাতৃদেবীকে ধর্মদেশনা করেন। প্রবারণা দিবসেই তিনি ওই স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করেন। এ কারণেই বৌদ্ধরা প্রবারণা পূর্ণিমা তিথিতে ওই প্রতীকরূপে আকাশে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন এবং ফানুস উত্তোলন করেন। শাস্ত্রে আবার এ-ও বর্ণিত হয়েছে, কুমার সিদ্ধার্থ যখন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গৃহত্যাগ করেন, তখন তিনি তার মাথার একগুচ্ছ চুলকে কর্তন করে সংকল্প গ্রহণ করেন যে, তিনি যদি বুদ্ধত্ব লাভ করেন তাহলে তার এ কর্তিত চুল নিুদিকে পতিত না হয়ে ঊর্ধ্বদিকেই গমন করবে। তার ইচ্ছানুযায়ী সেদিন এই চুলগুচ্ছ আকাশে উত্থিত হয়েছিল। তাই বুদ্ধের এ কেশধাতুকে পূজার উদ্দেশ্যেই বৌদ্ধরা আকাশে প্রদীপ পূজা করেন এবং ফানুস উড্ডয়ন করেন। এ কারণেই বৌদ্ধ প্রবারণা হল এক আত্মবিশ্লেষণের শিক্ষা, মাতৃকর্তব্য পালন এবং বিনয় বিধানানুযায়ী শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা অনুশীলনের মাধ্যমে ত্রৈমাসিক ব্রতশিক্ষা সমাপন। মূলত বৌদ্ধধর্ম হল শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা নির্ভরশীল ধর্ম। তাই বৌদ্ধমতে জীবনের সব ক্ষেত্রে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা অপরিহার্য। কারণ অজ্ঞানতা, মূর্খতা ও অসৎকর্ম মানবজীবনে কখনও সুখ আনয়ন করতে পারে না, কখনও মানুষকে মহীয়ান করতে পারে না। এমনকি দেশ ও সমাজকেও সমৃদ্ধ করতে পারে না। কারণ, অন্ধকার দিয়ে যেমন আলোকে আহ্বান করা যায় না, তেমনি অকুশল ও মন্দকর্ম দিয়ে কখনও সৎ, শুভ ও কল্যাণকে সম্ভাষণ করা যায় না। তাই বৌদ্ধরা তিন মাস প্রবারণা শিক্ষায় জীবনকে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করেন এবং অন্তর্মুখী শিক্ষায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন। তারা সর্ববিধ মঙ্গল ও কল্যাণময়তাকে আহ্বান জানান। তারা অশুভ শক্তির বিনাশ করেন এবং শুভ শক্তির আরাধনা করেন। এটাই হল প্রবারণার মূলশিক্ষা।
প্রবারণা দিবসের সন্ধ্যায় নর-নারী সবাই একত্রে মিলিত হয়ে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় এবং বিশ্ব শান্তি প্রার্থনায় সমবেত প্রার্থনা করেন। ভিক্ষুসংঘ সীমাঘর কিংবা বুদ্ধের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রবারণার মন্ত্র উচ্চারণ করেন এবং বিনয়কর্ম সম্পাদন করেন। তারা এ বিনয়কর্মের মাধ্যমে ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান ভঙ্গ এবং সমাপ্ত করেন। তার পরদিন থেকেই শুরু হয় শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের তিন মাস অধিত ধ্যান ও জ্ঞান লাভের এ শিক্ষা গ্রামেগঞ্জে গিয়ে জনসাধারণের কাছে প্রচার করেন। অতএব বৌদ্ধ এ প্রবারণার আবেদন সার্বজনীন, সর্বকল্যাণকর। ধর্মীয় ও সামাজিক একতা এবং সঙ্ঘশক্তি বৃদ্ধিতেও এটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহন করে। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে- সুখ সঙ্ঘস্স সামগ্গি সামগ্গনং তপো সুখো। অর্থাৎ একত্রে বসবাস করা সুখকর, একত্রে মিলন সুখকর এবং একসঙ্গে তপস্যাজনিত সর্বতো কল্যাণসাধনও সুখকর। অতএব, বৌদ্ধ এ প্রবারণা আমাদের আত্মসংযমের পথ শেখায়, কল্যাণের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে এবং সামাজিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে উজ্জীবিত করে। বাংলা বর্ষপঞ্জীতে আশ্বিনী পূর্নিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রবারণা পূর্নিমা নামে পরিচিত। প্রবারণা বলতে বুঝায় 'আমন্ত্রণ'। খুব খোলামেলা মন নিয়ে অন্যকে নিজের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো এবং. আসলেই ভুল বলে মনে হলে সংশোধনের প্রত্যয় ব্যক্ত করা, এটাই বৌদ্ধ প্রবারণার মূল বাণী। বুদ্ধ প্রবারণার মতো এমন একটি নিয়ম সংঘের মধ্যে চালু করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন এই কারণে যে, বৌদ্ধভিক্ষুরা সাধারণত একেকটি বিহারে বা সংঘারামে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই একজনের কাছে অন্যজনের ভালো-মন্দ, ভুল ও দোষ-গুণ ধরা পড়ে। অনেক সময় বিভিন্ন কারণে সেগুলো বলার বা তুলে ধরার সুযোগ হয়ে ওঠে না। অতএব একসঙ্গে তিন মাস ধরে অবস্থান করার পর ধর্মপ্রচারের জন্য ভ্রমণে বের হওয়ার আগে বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে পারস্পরিক প্রবারণা তথা আমন্ত্রণকর্ম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই প্রবারণা তথা আমন্ত্রণকর্মটি করতে বলেছিলেন এভাবে : ‘অহং ভন্তে/আবুসো, আয়স্মন্তং পবারেমি দিট্ঠেন বা সুতেন বা পরিসঙ্কায় বা বদতু মং আয়স্মা অনুকম্পং উপাদায় পস্সন্তো পটিকরিস্সামি।’ এর বাংলা অনুবাদ এ রকম: ‘ভন্তে/বন্ধু, আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। (আমার কোনো দোষ-ত্রুটি) দেখে থাকলে, শুনে থাকলে অথবা সন্দেহ পোষণ করে থাকলে অনুকম্পাপূর্বক আমাকে খুলে বলুন। আসলেই যদি আমার কোনো দোষ হয়ে থাকে তাহলে আমি অবশ্যই এর সংশোধন করব।’ প্রবারণার এ আবেদন বৌদ্ধ ভিক্ষু জীবনে অধিক গুরুত্ব পেলেও বৌদ্ধ নর-নারী, উপাসক-উপাসিকাদের জীবনেও এর গুরুত্ব কম নয়। শুধু ধ্যানের দিক থেকে নয়, আত্মশুদ্ধিতা, রিপু সংযম এবং আত্মোপলব্ধিতে এর অর্থবহ দিক আমাদের পূর্ণ মনুষ্যত্ব বিকাশে অনেক অবদান রাখে। বৌদ্ধ প্রবারণা উদযাপনকে বলা হয়, পাপ ও অশুভকর্ম থেকে মুক্ত থাকার জন্যই সৎ এ ব্রতকর্মের সাধনা। সুন্দর জীবন গঠনের ক্ষেত্রে এবং সত্যনিষ্ঠ ধ্যান সমাধির ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। অতএব শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাসাধনার পাশাপাশি আত্মসংযম ও ত্যাগশিক্ষা বৌদ্ধ প্রবারণার একটি অপরিহার্য বিধান বলে বিবেচিত হয়েছে।প্রবারণা দিবসে বৌদ্ধরা সব ভেদাভেদ ভুলে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পারস্পরিক একতা, মৈত্রী, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ভাব নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। হৃদয়কে অনেক বড় করে, চিত্তকে বিলিয়ে দেন। এর মাধ্যমে মনের মলিনতা দূর হয়, ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হয়। এতে চিত্তের সংকীর্ণতাও দূরীভূত হয়। প্রবারণা শব্দটি পালি সাহিত্যে ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য। এটির অন্য অর্থ প্রকৃৃষ্টরূপে বরণ করা, অভীষ্ট দান, বারণ বা নিবারণ করা বোঝায়। বৌদ্ধ বিনয় বিধান মতে প্রবারণ বা প্রবারণা অর্থে ত্রুটি বা নৈতিক স্খলন নির্দেশ করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জ্ঞাপন বোঝায়। অতএব, প্রবারণা বলতে অসত্য, অন্যায়, অপরাধমূলক কর্ম বর্জন করে সত্য, ন্যায় এবং কুশল কর্মকে বরণ নির্দেশ করে। প্রবারণা পারস্পরিক মিলন উৎসবও বটে। পূর্বকৃত সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে পারস্পরিক মিলন ঘটে প্রবারণার মাধ্যমে। মূলত প্রবারণা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য অবশ্য করণীয় একটি বিনয়িক বিধান।
কথিত আছে, তথাগত বুদ্ধ শ্রাবস্তির জেতবনে অনাথপিণ্ডিকের আরামে অবস্থানকালে পারস্পরিক প্রগাাঢ় মিত্রভাবসম্পন্ন বহুসংখ্যক ভিক্ষু কোশল জনপদের এক আবাসে বর্ষাবাস করেছিলেন। বর্ষাবাস উদযাপনের সময় তিনমাস কোনো ভিক্ষু অপর কোনো ভিক্ষুর সঙ্গে বাক্যালাপে বিরত ছিলেন। বর্ষাবাস শেষে তাঁরা শ্রাবস্তিতে বুদ্ধের কাছে উপনীত হয়ে অভিবাদনান্তে একান্তে উপবেশন করলে বুদ্ধ তাঁদের বর্ষাবাস নিরুপদ্রবে সম্পাদিত হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন। উত্তরে ভিক্ষুগণ জানালেন যে, তাঁরা পরস্পর বাক্যালাপে বিরত থেকে নিরুদ্বেগে, নির্বিবাদে, নির্বিঘ্নে অতি আনন্দে বর্ষাবাস সম্পন্ন করেছেন। বুদ্ধ তাঁদের কথায় তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বললেন, কোনো ভিক্ষু তীর্থিকগণের ন্যায় মৌন ব্রত পালন করতে পারবে না। অনন্তরর তিনি আদেশ (অনুজ্ঞা) প্রদান করলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, আমি অনুজ্ঞা প্রদান করছি- বর্ষাবাসিক ভিক্ষুগণ দৃষ্ট, শ্রুত অথবা আশঙ্কিত ত্রুটি বিষয়ে প্রবারণা করবে। তা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে অনুকূলতা অপরাধ হতে উদ্ধার পাবার উপায় ও নিয়মানুবর্তিতা।’প্রবারণা চতুর্দশী অথবা পঞ্চদশী তিথিতে করতে হয়। প্রবারণা কর্ম চার প্রকার। যথা (১) ধর্ম বিরুদ্ধে বর্গের (সংঘের একাংশ) প্রবারণা, (২) ধর্ম বিরুদ্ধে সমগ্র সংঘের প্রবারণা, (৩) ধর্মানুকূল বর্গের প্রবারণা এবং (৪) ধর্মানুকূল সমগ্র সংঘের প্রবারণা। তন্মধ্যে শেষোক্ত প্রবারণা কর্ম করাই বিধেয়। প্রবারণা নিম্নরূপে সম্পাদন করতে হয়: দক্ষ ও সমর্থ কোনো ভিক্ষু সংঘকে এরূপ প্রস্তাাব জ্ঞাপন করবেন, ‘মাননীয় সংঘ! আমার প্রস্তাব শ্রবণ করুন। অদ্য প্রবারণা। যদি সংঘ উচিত মনে করেন তাহলে সংঘ প্রবাারণা করতে পারেন।’ অনন্তর স্থবির ভিক্ষু উত্তরাসংঘ দ্বারা দেহের একাংশ আবৃত করে, পদের অগ্রভাগে ভর দিয়ে বসে কৃতাঞ্জলি হয়ে বলবেন, ‘দৃষ্ট, শ্রুত অথবা আশঙ্কিত ত্রুটি সম্বন্ধে সংঘকে প্রবারণা করছি। আয়ুষ্মানগণ, দৃষ্ট, শ্রুত অথবা আশঙ্কিত আমার এরূপ কোনো ত্রুটি থাকলে তা আপনারা অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন। নিজের মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকলে আমি তার প্রতিকার করব।’ দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার বলবেন। অনুরূপভাবে উপস্থিত ভিক্ষুগণও প্রবারণা করবেন। প্রবারণা একজন ভিক্ষু হলেও করা বাধ্যতামূলক। প্রবারণার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে ভিক্ষুদের মধ্যে সংঘটিত ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র অপরাধ স্বীকার করে ভবিষ্যতে ত্রুটিমুক্ত থাকার অঙ্গীকার করা।
কাজেই প্রবারণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কে সংক্ষেপে বলা যায়, অন্যায় বা অকুশলকে বর্জন এবং ন্যায় বা কুশলকে বরণ করার শপথ। মূলত এটি ভিক্ষুসংঘের একটি বিনয়িক অবশ্যই আচরণীয় বিধান। এ পূর্ণিমা তিথি বৌদ্ধদের একটি অন্যতম ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব হিসেবে বিবেচিত। প্রথম বর্ষাবাস শেষে আশ্বিনী পূর্ণিমার অন্তে সারনাথের মৃগদাবে তথাগত বুদ্ধ ষাটজন অর্হৎ ভিক্ষুকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘ভিক্ষুগণ আত্মহিত ও পরহিতের জন্য, বহুজনের হিতের এবং বহুজনের সুখের জন্য আদি-মধ্য-অন্তে কল্যাণকর ধর্ম দিকে দিকে প্রচার কর।’এই নির্দেশনা দিয়ে স্বয়ং বুদ্ধ এবং ভিক্ষুগণ বুদ্ধের বিমুক্তিমূলক ধর্ম প্রচারে বের হয়েছিলেন। এবং দশম বর্ষা তাবতিংশ স্বর্গে অবস্থান করে তাঁর প্রয়াত মাতৃদেবীকে (যিনি তাবতিংশ স্বর্গে অবস্থান করছিলেন) সদ্ধর্ম দেশনা করে আশি^নী পূর্ণিমা তিথিতে সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেছিলেন।
এ পূর্ণিমার পরদিন হতে পরবর্তী কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত এক মাসব্যাপী কঠিন চীবর দান সম্পন্ন হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বর্ষাবাসক ভিক্ষুই কঠিন চীবর দান গ্রহণ করতে পারেন। প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা আকাশ প্রদীপ প্রজ্বলন (ফানুস বাতি ওড়ানো) করে থাকে। কথিত আছে, সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহত্যাগ করে অনোমা নদীর পরপারে উপনীত হয়ে সারথী ছন্নকে অশ্ব কন্থক ও শরীরের আভরণাদি প্রদান করে বিদায় দেন। অতঃপর তিনি ভাবলেন, ‘আমার মস্তকে সুবিন্যস্ত কেশকলাপ প্রব্রজিতের পক্ষে শোভনীয় নহে।’ তিনি দক্ষিণ হস্তে অসি এবং বাম হস্তে রাজমুকুটসহ কেশকলাপ ধারণ করে কেটে ঊর্ধ্বদিকে নিক্ষেপ করে সত্যক্রিয়া করেছিলেন, ‘যদি সত্যিই আমি ইহজন্মে মহাজ্ঞান (বুদ্ধত্ব) লাভে সমর্থ হই তাহলে এই মুকুটসহ কেশরাশি ঊর্ধ্বাকাশে উত্থিত হবে।’ তাঁর কেশরাশি আকাশে উত্থিত হলো। তাবতিংশ স্বর্গের দেবগণ কেশরাশি নিয়ে গিয়ে চুলমনি চৈত্য প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে লাগলেন। বৌদ্ধরা বুদ্ধের সেই কেশরাশির প্রতি পূজা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য আশ্বিনী পূর্ণিমায় আকাশ প্রদীপ বা ফানুস বাতি উড়িয়ে থাকে। বৌদ্ধরা প্রবারণা উৎসব অত্যন্ত সাড়ম্বরে পালন করে থাকে। প্রতিটি পরিবারে আয়োজন করা হয় নানান প্রকার উপাদেয় খাদ্য-ভোজ্যের; তৈরি করা হয় বিভিন্ন প্রকার পিঠা, পায়েস ইত্যাদি। সকালবেলায় আবালবৃদ্ধবনিতা নববস্ত্র পরিধান করে খাদ্য-ভোজ্য, ফুল, বাতি ইত্যাদিসহ স্থানীয় বিহারে উপগত হয়ে বুদ্ধ পূজা ও ভিক্ষু-শ্রামণদের আহার্যাদি দান করে, সমবেত উপাসনা করে। পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণসহ ধর্মীয় ব্রতাদি পালন করে। বিকেলবেলায় ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যার সময় কীর্তন সহকারে অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে ওড়ানো হয় আকাশ প্রদীপ বা ফানুস বাতি। এ সময় জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ সমবেত হয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। এটি একটি অসম্প্রদায়িক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। এ উৎসব একদিকে বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের মধ্যে পারস্পরিক মৈত্রী, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করে অপরদিকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে বন্ধুত্ব ও অসম্প্রদায়িক ভাবধারা সুদৃঢ় করে। এ উৎসবের সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মের বড় দিনের উৎসব, সনাতন ধর্মের দুর্গোৎসব এবং অন্যান্য ধর্মের উৎসবের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এ উৎসবের ধর্মীয় দিকের পাশাপাশি সামাজিক দিকটিও নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ। সব বাদ-বিসংবাদ ভুলে গিয়ে শাশ্বত সত্যকে গ্রহণ করে পারস্পরিক সহাবস্থানই প্রবারণার মূল আদর্শ। এ আদর্শকে ধারণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে উঠবে। বিশ্বের সকল জীব সুখি হোক।
[লেখক: এম.ফিল গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ। আবাসিক ভিক্ষু, আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার, ঢাকা।]
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
ভদন্ত বোধিরত্ন ভিক্ষু | ২০ অক্টোবর, ২০২১ ১৩:৩২

শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা বিশ্ব বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। এটি বৌদ্ধদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বিশ্বের সব বৌদ্ধ আজ এ শুভ তিথিটি যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উদযাপন করবে।
প্রবারণা বৌদ্ধ ধর্মীয় বিধানে বিনয়ভিত্তিক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্রতকর্ম ও অনুষ্ঠান। এর অপর নাম আশ্বিনী পূর্ণিমা। প্রবারণার এ আবেদন বৌদ্ধ ভিক্ষু জীবনে অধিক গুরুত্ব পেলেও বৌদ্ধ নর-নারী, উপাসক-উপাসিকাদের জীবনেও এর গুরুত্ব কম নয়। শুধু ধ্যানের দিক থেকে নয়, আত্মশুদ্ধিতা, রিপু সংযম এবং আত্মোপলব্ধিতে এর অর্থবহ দিক আমাদের পূর্ণ মনুষ্যত্ব বিকাশে অনেক অবদান রাখে।
এ উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান তো আছেই, তার সঙ্গে আছে আমাদের আত্মশাসন ও আত্মবোধের মূল শিক্ষা। এ যেন এক জীবনবোধ তৈরির সর্বোত্তম শিক্ষা। কারণ শাস্ত্রে প্রবারণার অর্থে বলা হয়েছে যে, প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা এবং নিষেধ করা। বরণ করা অর্থ হল, বিশুদ্ধ বিনয়াচারে জীবনকে পরিচালিত করার উত্তম আদর্শ গ্রহণ করা। আর নিষেধ করা অর্থ হল, আদর্শবান ও ধর্মাচারের পরিপন্থী কর্মগুলো থেকে বিরত থাকা অথবা ওইসব কর্ম পরিহার করা। অতএব অর্থের দিক থেকে প্রবারণার গুরুত্ব ও মর্যাদা অতীব মহান ও তাৎপর্যমণ্ডিত। তাই বৌদ্ধ প্রবারণা উদযাপনে বলা হয়, পাপ ও অশুভকর্ম থেকে মুক্ত থাকার জন্যই সৎ এ ব্রতকর্মের সাধনা। সুন্দর জীবন গঠনের ক্ষেত্রে এবং সত্যনিষ্ঠ ধ্যান সমাধির ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। অতএব শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাসাধনার পাশাপাশি আত্মসংযম ও ত্যাগ শিক্ষা বৌদ্ধ প্রবারণার একটি অপরিহার্য বিধান বলে বিবেচিত হয়েছে।
অন্যদিকে, ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুসংঘ আপন আপন দোষত্রুটি স্বীকারপূর্বক অপর ভিক্ষুসংঘের কাছে প্রকাশ করে এবং তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহ্বান জানায়। অর্থাৎ, ভিক্ষুরা জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে যে কোনো অপরাধ করে থাকলে সেই অপরাধ স্বীকারপূর্বক প্রবারণা দিবসে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কারণ দৈনন্দিন জীবনাচারে চিত্ত নানা রকম অকুশলে আবিষ্ট হয়। তাই প্রতিটি মুহূর্তে চিত্ত জাগ্রত রেখে গুণের প্রতি আকৃষ্ট থাকার জন্যই এ প্রবারণার প্রবর্তন করা হয়।
বুদ্ধের জীবদ্দশায় শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থানকালে তিনি ভিক্ষুসংঘের পালনীয় কর্তব্য হিসেবে এ প্রবারণার প্রবর্তন করেন। বৌদ্ধ ধর্মীয় মতে, ভিক্ষু-শ্রামণ ও উপাসক-উপাসিকারা আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা- এই তিন মাস শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা সাধনার অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। এই তিন মাসে অষ্টমী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা এবং ধ্যান, উপবাস ও সংযম শিক্ষার মধ্য দিয়েই তারা তাদের ব্রত অধিষ্ঠান সমাপন করেন। তাই ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসব্রত অধিষ্ঠানের শেষ দিবসটিকেই বলা হয় বৌদ্ধ আভিধানিক শব্দে ‘প্রবারণা’। এটিকে বৌদ্ধ পরিভাষায় আশার তৃপ্তি বা অভিলাষ পূরণও বলা হয়। প্রবারণা দিবসে বৌদ্ধরা সব ভেদাভেদ ভুলে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পারস্পরিক একতা, মৈত্রী, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ভাব নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। হৃদয়কে অনেক বড় করে, চিত্তকে বিলিয়ে দেন। এর মাধ্যমে মনের মলিনতা দূর হয়, ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হয়। এতে চিত্তের সংকীর্ণতাও দূরীভূত হয়। বৌদ্ধরা সব মানুষের, বিশ্বের সব জীবের সুখ ও কল্যাণ এবং সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করেন।
প্রবারণা আগমনের এক সপ্তাহ বা দু’সপ্তাহ আগে থেকেই সব বৌদ্ধ নানা ধরনের প্রস্তুতি ও আয়োজন সম্পন্ন করেন। নিজগৃহ ও বিহারকে পরিমার্জনপূর্বক সাজিয়ে নেন। পতাকা, ব্যানার ও ফেস্টুন দিয়ে বিহার এবং বিহারের চারপাশ বর্ণাঢ্যভাবে সজ্জিত করে রাখেন। বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী এবং বৃদ্ধ-প্রৌঢ় বিভিন্ন স্থরের মানুষ সেদিন আনন্দে মেতে ওঠেন। ছেলেমেয়েরা বাগান থেকে পত্র-পুষ্পাদি এনে এবং নানা উপকরণে গ্রাম ও রাস্তাঘাটকে সাজিয়ে নেয়। রঙিন কাগজ দিয়ে নানা ধরনের ফানুস তৈরি করে। আগে থেকেই বাড়িতে তৈরি করে রাখে নানা রকমের মিষ্টি, সুস্বাদু খাদ্যভোজ এবং নানা ধরনের আহারাদি। প্রবারণার সকাল থেকেই বৌদ্ধ নর-নারীরা নতুন ও পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরিধান করে শোভাযাত্রায় বের হয় এবং পুজার অর্ঘ্য আর দানীয় সামগ্রী হাতে নিয়ে বিহারে উপস্থিত হয়। তারা সেদিন পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করেন, পুজা দেন এবং ধর্ম শ্রবণ করেন। সাধুবাদ ও ধর্মীয় আবেশে সেদিন বিহার প্রাঙ্গণ মুখর হয়। দানের জন্য বিহারে সুদৃশ্য কল্পতরু তৈরি করা হয়। সেদিনের ওই কল্পতরু হয় ধর্মীয় আবেশের একটি বিশেষ আকর্ষণ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই তাদের সামর্থ্যানুযায়ী ওই কল্পতরু বৃক্ষে নানা ধরনের দানীয় সামগ্রী বেঁধে দেন। এ কল্পতরু হচ্ছে জন্মচক্রের গতিধারায় উচ্চদিকে যাওয়ার চিত্তের একটি অবলম্বন। জীবের জীবনগতি যে বহু দীর্ঘ এবং বহু স্তরের মাধ্যমে এ জীবনচক্র অতিবাহিত বা প্রবাহিত হয় তারই নিদর্শনস্বরূপ এই কল্পতরু। এটিকে কল্পবৃক্ষও বলা হয়। পালিতে বলা হয়- কল্পরুবৃক্ষ। বৌদ্ধমতে কল্পতরু হল জন্ম-জন্মান্তরের সুকৃতি সাধনার এক প্রতীক। তাই বৌদ্ধরা এ প্রবারণা দিবসে পুণ্য বা সুকৃতি অর্জনের জন্য কল্পতরুর পূজা করেন। প্রবারণা পূর্ণিমার আরেকটি উৎসবময় দিক হল ফানুস উড্ডয়ন করা।
বৌদ্ধশাস্ত্রমতে, বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর তার মাতৃদেবীকে ধর্মদেশনার জন্য তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন। সেখানে তিনি তিন মাস মাতৃদেবীকে ধর্মদেশনা করেন। প্রবারণা দিবসেই তিনি ওই স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করেন। এ কারণেই বৌদ্ধরা প্রবারণা পূর্ণিমা তিথিতে ওই প্রতীকরূপে আকাশে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন এবং ফানুস উত্তোলন করেন। শাস্ত্রে আবার এ-ও বর্ণিত হয়েছে, কুমার সিদ্ধার্থ যখন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গৃহত্যাগ করেন, তখন তিনি তার মাথার একগুচ্ছ চুলকে কর্তন করে সংকল্প গ্রহণ করেন যে, তিনি যদি বুদ্ধত্ব লাভ করেন তাহলে তার এ কর্তিত চুল নিুদিকে পতিত না হয়ে ঊর্ধ্বদিকেই গমন করবে। তার ইচ্ছানুযায়ী সেদিন এই চুলগুচ্ছ আকাশে উত্থিত হয়েছিল। তাই বুদ্ধের এ কেশধাতুকে পূজার উদ্দেশ্যেই বৌদ্ধরা আকাশে প্রদীপ পূজা করেন এবং ফানুস উড্ডয়ন করেন। এ কারণেই বৌদ্ধ প্রবারণা হল এক আত্মবিশ্লেষণের শিক্ষা, মাতৃকর্তব্য পালন এবং বিনয় বিধানানুযায়ী শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা অনুশীলনের মাধ্যমে ত্রৈমাসিক ব্রতশিক্ষা সমাপন। মূলত বৌদ্ধধর্ম হল শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা নির্ভরশীল ধর্ম। তাই বৌদ্ধমতে জীবনের সব ক্ষেত্রে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা অপরিহার্য। কারণ অজ্ঞানতা, মূর্খতা ও অসৎকর্ম মানবজীবনে কখনও সুখ আনয়ন করতে পারে না, কখনও মানুষকে মহীয়ান করতে পারে না। এমনকি দেশ ও সমাজকেও সমৃদ্ধ করতে পারে না। কারণ, অন্ধকার দিয়ে যেমন আলোকে আহ্বান করা যায় না, তেমনি অকুশল ও মন্দকর্ম দিয়ে কখনও সৎ, শুভ ও কল্যাণকে সম্ভাষণ করা যায় না। তাই বৌদ্ধরা তিন মাস প্রবারণা শিক্ষায় জীবনকে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করেন এবং অন্তর্মুখী শিক্ষায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন। তারা সর্ববিধ মঙ্গল ও কল্যাণময়তাকে আহ্বান জানান। তারা অশুভ শক্তির বিনাশ করেন এবং শুভ শক্তির আরাধনা করেন। এটাই হল প্রবারণার মূলশিক্ষা।
প্রবারণা দিবসের সন্ধ্যায় নর-নারী সবাই একত্রে মিলিত হয়ে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় এবং বিশ্ব শান্তি প্রার্থনায় সমবেত প্রার্থনা করেন। ভিক্ষুসংঘ সীমাঘর কিংবা বুদ্ধের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রবারণার মন্ত্র উচ্চারণ করেন এবং বিনয়কর্ম সম্পাদন করেন। তারা এ বিনয়কর্মের মাধ্যমে ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান ভঙ্গ এবং সমাপ্ত করেন। তার পরদিন থেকেই শুরু হয় শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের তিন মাস অধিত ধ্যান ও জ্ঞান লাভের এ শিক্ষা গ্রামেগঞ্জে গিয়ে জনসাধারণের কাছে প্রচার করেন। অতএব বৌদ্ধ এ প্রবারণার আবেদন সার্বজনীন, সর্বকল্যাণকর। ধর্মীয় ও সামাজিক একতা এবং সঙ্ঘশক্তি বৃদ্ধিতেও এটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহন করে। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে- সুখ সঙ্ঘস্স সামগ্গি সামগ্গনং তপো সুখো। অর্থাৎ একত্রে বসবাস করা সুখকর, একত্রে মিলন সুখকর এবং একসঙ্গে তপস্যাজনিত সর্বতো কল্যাণসাধনও সুখকর। অতএব, বৌদ্ধ এ প্রবারণা আমাদের আত্মসংযমের পথ শেখায়, কল্যাণের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে এবং সামাজিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে উজ্জীবিত করে। বাংলা বর্ষপঞ্জীতে আশ্বিনী পূর্নিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রবারণা পূর্নিমা নামে পরিচিত। প্রবারণা বলতে বুঝায় 'আমন্ত্রণ'। খুব খোলামেলা মন নিয়ে অন্যকে নিজের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো এবং. আসলেই ভুল বলে মনে হলে সংশোধনের প্রত্যয় ব্যক্ত করা, এটাই বৌদ্ধ প্রবারণার মূল বাণী। বুদ্ধ প্রবারণার মতো এমন একটি নিয়ম সংঘের মধ্যে চালু করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন এই কারণে যে, বৌদ্ধভিক্ষুরা সাধারণত একেকটি বিহারে বা সংঘারামে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই একজনের কাছে অন্যজনের ভালো-মন্দ, ভুল ও দোষ-গুণ ধরা পড়ে। অনেক সময় বিভিন্ন কারণে সেগুলো বলার বা তুলে ধরার সুযোগ হয়ে ওঠে না। অতএব একসঙ্গে তিন মাস ধরে অবস্থান করার পর ধর্মপ্রচারের জন্য ভ্রমণে বের হওয়ার আগে বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে পারস্পরিক প্রবারণা তথা আমন্ত্রণকর্ম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই প্রবারণা তথা আমন্ত্রণকর্মটি করতে বলেছিলেন এভাবে : ‘অহং ভন্তে/আবুসো, আয়স্মন্তং পবারেমি দিট্ঠেন বা সুতেন বা পরিসঙ্কায় বা বদতু মং আয়স্মা অনুকম্পং উপাদায় পস্সন্তো পটিকরিস্সামি।’ এর বাংলা অনুবাদ এ রকম: ‘ভন্তে/বন্ধু, আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। (আমার কোনো দোষ-ত্রুটি) দেখে থাকলে, শুনে থাকলে অথবা সন্দেহ পোষণ করে থাকলে অনুকম্পাপূর্বক আমাকে খুলে বলুন। আসলেই যদি আমার কোনো দোষ হয়ে থাকে তাহলে আমি অবশ্যই এর সংশোধন করব।’ প্রবারণার এ আবেদন বৌদ্ধ ভিক্ষু জীবনে অধিক গুরুত্ব পেলেও বৌদ্ধ নর-নারী, উপাসক-উপাসিকাদের জীবনেও এর গুরুত্ব কম নয়। শুধু ধ্যানের দিক থেকে নয়, আত্মশুদ্ধিতা, রিপু সংযম এবং আত্মোপলব্ধিতে এর অর্থবহ দিক আমাদের পূর্ণ মনুষ্যত্ব বিকাশে অনেক অবদান রাখে। বৌদ্ধ প্রবারণা উদযাপনকে বলা হয়, পাপ ও অশুভকর্ম থেকে মুক্ত থাকার জন্যই সৎ এ ব্রতকর্মের সাধনা। সুন্দর জীবন গঠনের ক্ষেত্রে এবং সত্যনিষ্ঠ ধ্যান সমাধির ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। অতএব শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাসাধনার পাশাপাশি আত্মসংযম ও ত্যাগশিক্ষা বৌদ্ধ প্রবারণার একটি অপরিহার্য বিধান বলে বিবেচিত হয়েছে।প্রবারণা দিবসে বৌদ্ধরা সব ভেদাভেদ ভুলে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পারস্পরিক একতা, মৈত্রী, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ভাব নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। হৃদয়কে অনেক বড় করে, চিত্তকে বিলিয়ে দেন। এর মাধ্যমে মনের মলিনতা দূর হয়, ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হয়। এতে চিত্তের সংকীর্ণতাও দূরীভূত হয়। প্রবারণা শব্দটি পালি সাহিত্যে ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য। এটির অন্য অর্থ প্রকৃৃষ্টরূপে বরণ করা, অভীষ্ট দান, বারণ বা নিবারণ করা বোঝায়। বৌদ্ধ বিনয় বিধান মতে প্রবারণ বা প্রবারণা অর্থে ত্রুটি বা নৈতিক স্খলন নির্দেশ করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জ্ঞাপন বোঝায়। অতএব, প্রবারণা বলতে অসত্য, অন্যায়, অপরাধমূলক কর্ম বর্জন করে সত্য, ন্যায় এবং কুশল কর্মকে বরণ নির্দেশ করে। প্রবারণা পারস্পরিক মিলন উৎসবও বটে। পূর্বকৃত সব ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে পারস্পরিক মিলন ঘটে প্রবারণার মাধ্যমে। মূলত প্রবারণা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য অবশ্য করণীয় একটি বিনয়িক বিধান।
কথিত আছে, তথাগত বুদ্ধ শ্রাবস্তির জেতবনে অনাথপিণ্ডিকের আরামে অবস্থানকালে পারস্পরিক প্রগাাঢ় মিত্রভাবসম্পন্ন বহুসংখ্যক ভিক্ষু কোশল জনপদের এক আবাসে বর্ষাবাস করেছিলেন। বর্ষাবাস উদযাপনের সময় তিনমাস কোনো ভিক্ষু অপর কোনো ভিক্ষুর সঙ্গে বাক্যালাপে বিরত ছিলেন। বর্ষাবাস শেষে তাঁরা শ্রাবস্তিতে বুদ্ধের কাছে উপনীত হয়ে অভিবাদনান্তে একান্তে উপবেশন করলে বুদ্ধ তাঁদের বর্ষাবাস নিরুপদ্রবে সম্পাদিত হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন। উত্তরে ভিক্ষুগণ জানালেন যে, তাঁরা পরস্পর বাক্যালাপে বিরত থেকে নিরুদ্বেগে, নির্বিবাদে, নির্বিঘ্নে অতি আনন্দে বর্ষাবাস সম্পন্ন করেছেন। বুদ্ধ তাঁদের কথায় তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বললেন, কোনো ভিক্ষু তীর্থিকগণের ন্যায় মৌন ব্রত পালন করতে পারবে না। অনন্তরর তিনি আদেশ (অনুজ্ঞা) প্রদান করলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, আমি অনুজ্ঞা প্রদান করছি- বর্ষাবাসিক ভিক্ষুগণ দৃষ্ট, শ্রুত অথবা আশঙ্কিত ত্রুটি বিষয়ে প্রবারণা করবে। তা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে অনুকূলতা অপরাধ হতে উদ্ধার পাবার উপায় ও নিয়মানুবর্তিতা।’প্রবারণা চতুর্দশী অথবা পঞ্চদশী তিথিতে করতে হয়। প্রবারণা কর্ম চার প্রকার। যথা (১) ধর্ম বিরুদ্ধে বর্গের (সংঘের একাংশ) প্রবারণা, (২) ধর্ম বিরুদ্ধে সমগ্র সংঘের প্রবারণা, (৩) ধর্মানুকূল বর্গের প্রবারণা এবং (৪) ধর্মানুকূল সমগ্র সংঘের প্রবারণা। তন্মধ্যে শেষোক্ত প্রবারণা কর্ম করাই বিধেয়। প্রবারণা নিম্নরূপে সম্পাদন করতে হয়: দক্ষ ও সমর্থ কোনো ভিক্ষু সংঘকে এরূপ প্রস্তাাব জ্ঞাপন করবেন, ‘মাননীয় সংঘ! আমার প্রস্তাব শ্রবণ করুন। অদ্য প্রবারণা। যদি সংঘ উচিত মনে করেন তাহলে সংঘ প্রবাারণা করতে পারেন।’ অনন্তর স্থবির ভিক্ষু উত্তরাসংঘ দ্বারা দেহের একাংশ আবৃত করে, পদের অগ্রভাগে ভর দিয়ে বসে কৃতাঞ্জলি হয়ে বলবেন, ‘দৃষ্ট, শ্রুত অথবা আশঙ্কিত ত্রুটি সম্বন্ধে সংঘকে প্রবারণা করছি। আয়ুষ্মানগণ, দৃষ্ট, শ্রুত অথবা আশঙ্কিত আমার এরূপ কোনো ত্রুটি থাকলে তা আপনারা অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন। নিজের মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকলে আমি তার প্রতিকার করব।’ দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার বলবেন। অনুরূপভাবে উপস্থিত ভিক্ষুগণও প্রবারণা করবেন। প্রবারণা একজন ভিক্ষু হলেও করা বাধ্যতামূলক। প্রবারণার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে ভিক্ষুদের মধ্যে সংঘটিত ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র অপরাধ স্বীকার করে ভবিষ্যতে ত্রুটিমুক্ত থাকার অঙ্গীকার করা।
কাজেই প্রবারণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়কে সংক্ষেপে বলা যায়, অন্যায় বা অকুশলকে বর্জন এবং ন্যায় বা কুশলকে বরণ করার শপথ। মূলত এটি ভিক্ষুসংঘের একটি বিনয়িক অবশ্যই আচরণীয় বিধান। এ পূর্ণিমা তিথি বৌদ্ধদের একটি অন্যতম ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব হিসেবে বিবেচিত। প্রথম বর্ষাবাস শেষে আশ্বিনী পূর্ণিমার অন্তে সারনাথের মৃগদাবে তথাগত বুদ্ধ ষাটজন অর্হৎ ভিক্ষুকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘ভিক্ষুগণ আত্মহিত ও পরহিতের জন্য, বহুজনের হিতের এবং বহুজনের সুখের জন্য আদি-মধ্য-অন্তে কল্যাণকর ধর্ম দিকে দিকে প্রচার কর।’এই নির্দেশনা দিয়ে স্বয়ং বুদ্ধ এবং ভিক্ষুগণ বুদ্ধের বিমুক্তিমূলক ধর্ম প্রচারে বের হয়েছিলেন। এবং দশম বর্ষা তাবতিংশ স্বর্গে অবস্থান করে তাঁর প্রয়াত মাতৃদেবীকে (যিনি তাবতিংশ স্বর্গে অবস্থান করছিলেন) সদ্ধর্ম দেশনা করে আশি^নী পূর্ণিমা তিথিতে সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেছিলেন।
এ পূর্ণিমার পরদিন হতে পরবর্তী কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত এক মাসব্যাপী কঠিন চীবর দান সম্পন্ন হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বর্ষাবাসক ভিক্ষুই কঠিন চীবর দান গ্রহণ করতে পারেন। প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা আকাশ প্রদীপ প্রজ্বলন (ফানুস বাতি ওড়ানো) করে থাকে। কথিত আছে, সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহত্যাগ করে অনোমা নদীর পরপারে উপনীত হয়ে সারথী ছন্নকে অশ্ব কন্থক ও শরীরের আভরণাদি প্রদান করে বিদায় দেন। অতঃপর তিনি ভাবলেন, ‘আমার মস্তকে সুবিন্যস্ত কেশকলাপ প্রব্রজিতের পক্ষে শোভনীয় নহে।’ তিনি দক্ষিণ হস্তে অসি এবং বাম হস্তে রাজমুকুটসহ কেশকলাপ ধারণ করে কেটে ঊর্ধ্বদিকে নিক্ষেপ করে সত্যক্রিয়া করেছিলেন, ‘যদি সত্যিই আমি ইহজন্মে মহাজ্ঞান (বুদ্ধত্ব) লাভে সমর্থ হই তাহলে এই মুকুটসহ কেশরাশি ঊর্ধ্বাকাশে উত্থিত হবে।’ তাঁর কেশরাশি আকাশে উত্থিত হলো। তাবতিংশ স্বর্গের দেবগণ কেশরাশি নিয়ে গিয়ে চুলমনি চৈত্য প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে লাগলেন। বৌদ্ধরা বুদ্ধের সেই কেশরাশির প্রতি পূজা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য আশ্বিনী পূর্ণিমায় আকাশ প্রদীপ বা ফানুস বাতি উড়িয়ে থাকে। বৌদ্ধরা প্রবারণা উৎসব অত্যন্ত সাড়ম্বরে পালন করে থাকে। প্রতিটি পরিবারে আয়োজন করা হয় নানান প্রকার উপাদেয় খাদ্য-ভোজ্যের; তৈরি করা হয় বিভিন্ন প্রকার পিঠা, পায়েস ইত্যাদি। সকালবেলায় আবালবৃদ্ধবনিতা নববস্ত্র পরিধান করে খাদ্য-ভোজ্য, ফুল, বাতি ইত্যাদিসহ স্থানীয় বিহারে উপগত হয়ে বুদ্ধ পূজা ও ভিক্ষু-শ্রামণদের আহার্যাদি দান করে, সমবেত উপাসনা করে। পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণসহ ধর্মীয় ব্রতাদি পালন করে। বিকেলবেলায় ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যার সময় কীর্তন সহকারে অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে ওড়ানো হয় আকাশ প্রদীপ বা ফানুস বাতি। এ সময় জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ সমবেত হয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। এটি একটি অসম্প্রদায়িক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। এ উৎসব একদিকে বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের মধ্যে পারস্পরিক মৈত্রী, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করে অপরদিকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে বন্ধুত্ব ও অসম্প্রদায়িক ভাবধারা সুদৃঢ় করে। এ উৎসবের সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মের বড় দিনের উৎসব, সনাতন ধর্মের দুর্গোৎসব এবং অন্যান্য ধর্মের উৎসবের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এ উৎসবের ধর্মীয় দিকের পাশাপাশি সামাজিক দিকটিও নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ। সব বাদ-বিসংবাদ ভুলে গিয়ে শাশ্বত সত্যকে গ্রহণ করে পারস্পরিক সহাবস্থানই প্রবারণার মূল আদর্শ। এ আদর্শকে ধারণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে উঠবে। বিশ্বের সকল জীব সুখি হোক।
[লেখক: এম.ফিল গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ। আবাসিক ভিক্ষু, আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার, ঢাকা।]