একজন শহিদুল আলম
| ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ এই তিন-চার বছর আলোকচিত্রের ওপর প্রায় ৮০০ বই পড়লেন শহিদুল আলম। কারণ ফটোগ্রাফি নিয়ে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবে বই পড়ে, প্রচুর ছবি তুলতে তুলতে এবং ডার্করুমে কাজ করে ছবি তোলা ও প্রিন্ট করা শিখে ফেললেন। এর মধ্যে একটি বিদেশি সংস্থায় ছবি তোলার কাজও পেলেন। ১৯৮৪ সালে দেশে ফেরেন শহিদুল আলম। সে সময় এলিফ্যান্ট রোডে খান মোহাম্মদ আমির নামের একজনের সঙ্গে দেখা করলেন। তার পুঁজিতে পরিচালক হিসেবে শহিদুল আলম ‘ফটো ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করলেন। কারিগরি দিকে দক্ষতা থাকায় উন্নত মানের ফটো স্টুডিও তৈরি করলেন। অনেক নামিদামি মানুষ আসতেন সেখানে। ফলে শহিদুল আলমের পরিচিতির গণ্ডি কিছুটা বাড়ল। এরপর তিনি স্টুডিও ছেড়ে শুরু করলেন ফ্রি-ল্যান্স আলোকচিত্রী। তখন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি কোম্পানির কাজে। এই কোম্পানি ইলেকট্রনিক সার্কিট বোর্ড নিয়ে কাজ করত। সেসব সার্কিটের ছবি তুললেন। সার্কিট বোর্ডের ছবিগুলো দেখে মনে হলো যেন নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের দিগন্তরেখা, উঁচু দালানের মধ্যে থাকা ভাসমান রাস্তা। এ ধরনের কাজ তখন বাংলাদেশে হতো না। এগুলো খুব প্রশংসা পেয়েছিল। সেটিই হয়ে গেল শহিদুল আলমের ভিজিটিং কার্ড। এভাবে নিত্যনতুন ধারণা ও উন্নত কাজ দিয়ে একের পর এক কাজ পেতে থাকলেন। বাংলাদেশে প্রথম পোলারয়েড ব্যাক দিয়ে ছবি তুলতেন তিনি। ১৯৯৩ সালে ধানমণ্ডিতে প্রতিষ্ঠা করলেন দৃক গ্যালারি। প্রথম প্রদর্শনী ছিল ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর আলোকচিত্র নিয়ে। শহিদুল আলমের উদ্যোগ ও আরও কয়েকজনের সাহস নিয়ে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় আজকের পাঠশালা। তবে শুরুতে অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। আবার পাঠশালা নামটিও অনেকের পছন্দ হয়নি। তখন তো কেউ কেউ বলেছিলেন, এটা ‘গেঁয়ো’ নাম।
শহিদুল আলম বলেন, প্রত্যেকে মানুষের চেষ্টা থাকতে হবে তার কাজের শেষ প্রান্তের বাইরে গিয়ে দেখা। ওই শেষ প্রান্তে নতুন দরজা খোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যেমন, আমি আমি যখন প্রদর্শনী করি, আমার প্রতিটি প্রদর্শনীই আলাদা হয়। আমি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের অপহৃত নেত্রী কল্পনা চাকমার ওপর তিনটি প্রদর্শনী করেছি। প্রতিটি ভিন্ন ছিল। আমার পদচারণ যদি পৃথিবীকে আলাদা ও নতুন কিছু দিতে না পারে, তাহলে মানুষ হয়ে জন্মানোর মানে হয় না।
শহিদুল আলম আরও বলেন, আমি সব সময় নিজেকে এই বিশ্বের একজন নাগরিক মনে করি। যখন নতুন প্রদর্শনীর আয়োজন করি তার প্রথমটা বাংলাদেশে করি। পরে দেশের বাইরে। একসময় আমার বিদেশি বন্ধুরা এসে পড়িয়ে যেতেন পাঠশালায়। এখন আমাদের কাছে পড়তে আসে বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েরা। বাংলাদেশে দৃক, পাঠশালা ও ছবিমেলা করেছি। আন্তর্জাতিকভাবে সেরা হতে হবে এদের। আমার যেমন স্বপ্ন, পাঠশালার নতুন ভবনে হবে পৃথিবীসেরা আলোকচিত্রের প্রশিক্ষণ। আমি না থাকলেও আমার ছাত্ররা নিশ্চয়ই পারবে।
শুধু দৃক বা পাঠশালা নয়, এশিয়ার সর্ববৃহৎ আলোকচিত্র উৎসব ছবি মেলার পরিচালকও শহিদুল আলম। প্রতি দুই বছর পরপর ঢাকায় এ আয়োজন করা হয়। এতে বিশ্বের সেরা আলোকচিত্রীরা অংশ নেন।
আপনি দৃক ও পাঠশালার মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, এটা নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে শহিদুল আলম বলেন, শুরুতে আমি ছিলাম একমাত্র দেশি মাস্টার। আমি যা খেয়েছি, আমার বিদেশি বন্ধুরা এসে তা-ই খেয়েছেন, আমার সঙ্গে মেঝেতে ঘুমিয়েছেন। তারা আসলে উদার। তাদের কারণে এই পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কোনো মানে নেই। সবার সহযোগিতার মাধ্যমেই আজকের পাঠশালা। এছাড়া বর্তমানে পাঠশালার বেশিরভাগ শিক্ষকই বাংলাদেশি। একটা আন্তর্জাতিক মানের স্কুলের শিক্ষকেরা বাংলাদেশি এটা আমার কাছে বড় পাওয়া।
উল্লেখ্য, পাঠশালার শিক্ষার্থীরা ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো, জুপ সোয়ার্ট মাস্টার ক্লাস, মাদার জনস অ্যাওয়ার্ড, অ্যালেক্সিয়া ফাউন্ডেশন গ্র্যান্টস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অল রোডস প্রজেক্ট, সামদানি আর্ট অ্যাওয়ার্ড, পিডিএন ফটো কনটেস্টসহ আলোকচিত্রের প্রায় সব আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউ ইয়র্কার, টাইম ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাঠশালার শিক্ষার্থীদের কাজ প্রকাশিত হয়েছে। সারা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাঠশালার যৌথ কর্মসূচি চালু আছে।
শেয়ার করুন
| ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ এই তিন-চার বছর আলোকচিত্রের ওপর প্রায় ৮০০ বই পড়লেন শহিদুল আলম। কারণ ফটোগ্রাফি নিয়ে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবে বই পড়ে, প্রচুর ছবি তুলতে তুলতে এবং ডার্করুমে কাজ করে ছবি তোলা ও প্রিন্ট করা শিখে ফেললেন। এর মধ্যে একটি বিদেশি সংস্থায় ছবি তোলার কাজও পেলেন। ১৯৮৪ সালে দেশে ফেরেন শহিদুল আলম। সে সময় এলিফ্যান্ট রোডে খান মোহাম্মদ আমির নামের একজনের সঙ্গে দেখা করলেন। তার পুঁজিতে পরিচালক হিসেবে শহিদুল আলম ‘ফটো ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করলেন। কারিগরি দিকে দক্ষতা থাকায় উন্নত মানের ফটো স্টুডিও তৈরি করলেন। অনেক নামিদামি মানুষ আসতেন সেখানে। ফলে শহিদুল আলমের পরিচিতির গণ্ডি কিছুটা বাড়ল। এরপর তিনি স্টুডিও ছেড়ে শুরু করলেন ফ্রি-ল্যান্স আলোকচিত্রী। তখন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি কোম্পানির কাজে। এই কোম্পানি ইলেকট্রনিক সার্কিট বোর্ড নিয়ে কাজ করত। সেসব সার্কিটের ছবি তুললেন। সার্কিট বোর্ডের ছবিগুলো দেখে মনে হলো যেন নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের দিগন্তরেখা, উঁচু দালানের মধ্যে থাকা ভাসমান রাস্তা। এ ধরনের কাজ তখন বাংলাদেশে হতো না। এগুলো খুব প্রশংসা পেয়েছিল। সেটিই হয়ে গেল শহিদুল আলমের ভিজিটিং কার্ড। এভাবে নিত্যনতুন ধারণা ও উন্নত কাজ দিয়ে একের পর এক কাজ পেতে থাকলেন। বাংলাদেশে প্রথম পোলারয়েড ব্যাক দিয়ে ছবি তুলতেন তিনি। ১৯৯৩ সালে ধানমণ্ডিতে প্রতিষ্ঠা করলেন দৃক গ্যালারি। প্রথম প্রদর্শনী ছিল ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর আলোকচিত্র নিয়ে। শহিদুল আলমের উদ্যোগ ও আরও কয়েকজনের সাহস নিয়ে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় আজকের পাঠশালা। তবে শুরুতে অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। আবার পাঠশালা নামটিও অনেকের পছন্দ হয়নি। তখন তো কেউ কেউ বলেছিলেন, এটা ‘গেঁয়ো’ নাম।
শহিদুল আলম বলেন, প্রত্যেকে মানুষের চেষ্টা থাকতে হবে তার কাজের শেষ প্রান্তের বাইরে গিয়ে দেখা। ওই শেষ প্রান্তে নতুন দরজা খোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যেমন, আমি আমি যখন প্রদর্শনী করি, আমার প্রতিটি প্রদর্শনীই আলাদা হয়। আমি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের অপহৃত নেত্রী কল্পনা চাকমার ওপর তিনটি প্রদর্শনী করেছি। প্রতিটি ভিন্ন ছিল। আমার পদচারণ যদি পৃথিবীকে আলাদা ও নতুন কিছু দিতে না পারে, তাহলে মানুষ হয়ে জন্মানোর মানে হয় না।
শহিদুল আলম আরও বলেন, আমি সব সময় নিজেকে এই বিশ্বের একজন নাগরিক মনে করি। যখন নতুন প্রদর্শনীর আয়োজন করি তার প্রথমটা বাংলাদেশে করি। পরে দেশের বাইরে। একসময় আমার বিদেশি বন্ধুরা এসে পড়িয়ে যেতেন পাঠশালায়। এখন আমাদের কাছে পড়তে আসে বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েরা। বাংলাদেশে দৃক, পাঠশালা ও ছবিমেলা করেছি। আন্তর্জাতিকভাবে সেরা হতে হবে এদের। আমার যেমন স্বপ্ন, পাঠশালার নতুন ভবনে হবে পৃথিবীসেরা আলোকচিত্রের প্রশিক্ষণ। আমি না থাকলেও আমার ছাত্ররা নিশ্চয়ই পারবে।
শুধু দৃক বা পাঠশালা নয়, এশিয়ার সর্ববৃহৎ আলোকচিত্র উৎসব ছবি মেলার পরিচালকও শহিদুল আলম। প্রতি দুই বছর পরপর ঢাকায় এ আয়োজন করা হয়। এতে বিশ্বের সেরা আলোকচিত্রীরা অংশ নেন।
আপনি দৃক ও পাঠশালার মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, এটা নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে শহিদুল আলম বলেন, শুরুতে আমি ছিলাম একমাত্র দেশি মাস্টার। আমি যা খেয়েছি, আমার বিদেশি বন্ধুরা এসে তা-ই খেয়েছেন, আমার সঙ্গে মেঝেতে ঘুমিয়েছেন। তারা আসলে উদার। তাদের কারণে এই পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কোনো মানে নেই। সবার সহযোগিতার মাধ্যমেই আজকের পাঠশালা। এছাড়া বর্তমানে পাঠশালার বেশিরভাগ শিক্ষকই বাংলাদেশি। একটা আন্তর্জাতিক মানের স্কুলের শিক্ষকেরা বাংলাদেশি এটা আমার কাছে বড় পাওয়া।
উল্লেখ্য, পাঠশালার শিক্ষার্থীরা ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো, জুপ সোয়ার্ট মাস্টার ক্লাস, মাদার জনস অ্যাওয়ার্ড, অ্যালেক্সিয়া ফাউন্ডেশন গ্র্যান্টস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অল রোডস প্রজেক্ট, সামদানি আর্ট অ্যাওয়ার্ড, পিডিএন ফটো কনটেস্টসহ আলোকচিত্রের প্রায় সব আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউ ইয়র্কার, টাইম ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাঠশালার শিক্ষার্থীদের কাজ প্রকাশিত হয়েছে। সারা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাঠশালার যৌথ কর্মসূচি চালু আছে।