আমার সেবা প্রকাশনী
লোপামূদ্রা রহমান | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
আসলে শিরোনামটা খুব আবদার করে লিখলাম। তখনই মনে হলো, শিরোনামটা হবে, ‘সেবা প্রকাশনীর আমি’। আমি তো সেবা প্রকাশনীকে গড়ে তুলিনি, বরং সেবা প্রকাশনীই আমাকে গড়ে তুলেছে। সেবা প্রকাশনীর মালিকানা আমার নয়, কিন্তু আমার অনেকটুকুর মালিকানাই সেবা প্রকাশনীর। তবু খুব আদর করে বলতে মন চায়, ‘আমার সেবা প্রকাশনী’। আমার মতো নিশ্চয়ই আরও অনেকেই এমন আদর করে বলবেন ‘আমার সেবা প্রকাশনী’। আমি অন্তত জানি, আমার মতো অসংখ্য মানুষের কৈশোর, যৌবনটা তৈরি করে দিয়েছে সেবা প্রকাশনী। আমার বেড়ে ওঠা, আমি যতটুকু আমি আছি তার অনেকটাই হয়ে ওঠা সেবা প্রকাশনীর কারণেই।
আমি বই কেনা শিখেছি সেবা প্রকাশনীর বই দিয়ে, বই চুরি করা শিখেছি সেবা প্রকাশনীর বই দিয়ে, বই পড়াও আয়ত্ত করেছি সেবা প্রকাশনীর হাত ধরেই। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনো বাংলাদেশের মানুষের হাতে হাতে হুমায়ূন আহমেদ চলে আসেননি। এটা অনেকেই বলে থাকেন, হুমায়ূন আহমেদ পাঠক তৈরি করেছেন। তথ্য তো তাই বলে। কিন্তু একটু তথ্য-বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন আছে। হুমায়ূন আহমেদের বই যারা পড়েছেন, কিনেছেন, তারা অন্যদিকে ধাবিত হয়েছেন কম। অথচ সেবা প্রকাশনীর পাঠক ক্রমশ পরিণত হয়েছেন, হাত বাড়িয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের দিকেও। এটা ঠিক, যে তীব্র জনপ্রিয়তা হুমায়ূন এককভাবে উপভোগ করেছেন তার ধারে-কাছে অন্য কোনো লেখক ছিলেন না কখনো। অন্যদিকে যে তীব্র জনপ্রিয়তা একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেবা প্রকাশনী উপভোগ করেছে তার কাছাকাছি জনপ্রিয়তাও অন্য কোনো প্রকাশনীর নেই। উল্লেখ করা দরকার উইলিয়াম পিটার ব্লাটি’র লেখা ‘দি একসরসিস্ট’ উপন্যাসটিকে হুমায়ূন আহমেদ সেবা প্রকাশনীর জন্য অনুবাদ করেছিলেন। অনুবাদ নয়, বরং রূপান্তর বলা যায় সে উপন্যাসটিকে। এ বই প্রকাশের স্মৃতিচারণ হুমায়ূন নিজে করেছেন, ‘আমার লেখক জীবনের শুরুটা নিদারুণ অর্থকষ্টে কেটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনে সংসার চলত না। বেতনের সিংহভাগ চলে যেত বাড়ি ভাড়ায়। তখন একজন বুদ্ধি দিল কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব সেবা প্রকাশনী থেকে বিদেশি বইয়ের অনুবাদ বের করেন এবং তার জন্য টাকা দেন। আমি অনুবাদে লেগে গেলাম। বিদেশি সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে এই কাজ করা হয়নি। আর্থিক সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে না পেয়ে অনুবাদে গিয়েছি।’ এ বক্তব্যের কয়েকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ। দেশের নামকরা সব প্রকাশনীও লেখক বা অনুবাদককে টাকা দিতে পারত না। কিন্তু সেবা প্রকাশনী সেই নিশ্চয়তা দিতে পারত। অন্যদিকে বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেবা প্রকাশনী।
আমরা যারা কিশোর ছিলাম আশির দশকে তখন বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের হাতেখড়ি হয়েছিল সেবা প্রকাশনীর অনুবাদগুলোর হাত ধরেই। জিম করবেট, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, টমাস হার্ডি, মার্ক টোয়েন, এইচ জি ওয়েলস, জুলভার্ন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, মেরি শেলি, এরিখ মারিয়া রেমার্কের মতো বিশ্বসেরা ও জনপ্রিয় লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি সেবার অনুবাদের মাধ্যমে। বলার অপেক্ষা রাখে না সেবা প্রকাশনী মূলত অনুবাদকেন্দ্রিক একটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বসাহিত্যের বাছাই গল্প-উপন্যাসকে কখনো সরাসরি অনুবাদ আকারে, কখনো রূপান্তর করে, কখনো কিশোর উপযোগী করে প্রকাশ করেছে সেবা প্রকাশনী। রবিনসন ক্রুসোর অ্যাডভেঞ্চারের কথা জেনেছি সেবা প্রকাশনীর হাত ধরেই। ভয়ংকর ড্রাকুলা, দুর্ধর্ষ তিন মাস্কেটিয়ার, গোয়েন্দা শার্লক হোমসকে আমরা চিনেছি সেবা প্রকাশনীর হাত দিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন, রকিব হাসান, শামসুদ্দীন নওয়াব, শেখ আব্দুল হাকিম, খসরু চৌধুরী, নিয়াজ মোর্শেদের মতো অনুবাদকরা একনিষ্ঠতায় আমাদের পাতে তুলে দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের এইসব সেরা চরিত্র আর কাহিনীগুলোর সঙ্গে।
শুধু বিশ্বসাহিত্য নয়, বাংলা সাহিত্যকেও ধারণ করে সেবা প্রকাশনী। যতদূর মনে পড়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ এবং ‘কপালকু-লা’র সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল সেবা প্রকাশনীর ‘কিশোর ক্লাসিক’ সিরিজের মাধ্যমেই। ‘কিশোর ক্লাসিক’ সিরিজ শুধু যে জনপ্রিয় ছিল তা নয়, ভীষণ রকমের প্রয়োজনীয়ও ছিল। চার্লস ডিকেন্স, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, ভিক্টর হুগো, ড্যানিয়েল ডিফো, আলেকজান্ডার দ্যুমা, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, ব্রাম স্টোকার প্রমুখ লেখকের সেরা লেখাগুলোর সঙ্গে প্রথম প্রণয় হয় সেবা প্রকাশনীর হাত ধরেই। প্রায় শ’দুয়েক ‘কিশোর ক্লাসিক’র সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। ‘কিশোর ক্লাসিক’ তো আর কিছু নয়, আদতে বিশ্বসেরা ক্লাসিকগুলোর কিশোর উপযোগী সংস্করণ। এই সিরিজ আসলে পরবর্তীকালের অনেক পাঠক, সমালোচক, এমনকি লেখকের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের অনেক সেরা লেখার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল কিশোর ক্লাসিকের মাধ্যমে।
‘কিশোর কøাসিক’-এর মতো আরেকটি জনপ্রিয় সিরিজ ছিল কিশোর থ্রিলার ‘তিন গোয়েন্দা’। রকিব হাসানের রূপান্তরে ‘তিন গোয়েন্দা’র প্রতিটিই কাহিনীই ছিল আমাদের জন্য সরস বিস্ময়। ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করেছি সিরিজের পরবর্তী বইটির জন্য। কিশোর পাশা, রবিন মিলফোর্ড আর মুসা আমানের গোয়েন্দাগিরিতে আমরাও অনুপ্রাণিত হতাম রহস্য রোমাঞ্চ খুঁজে বের করতে। ক্যালিফোর্নিয়াতে বাস করা কিশোর সমস্যা সমাধান করত তীক্ষè বুদ্ধির জোরে। এখনো চোখে দেখতে পাই কিশোর পাশা তার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে গভীর চিন্তায়। তার বন্ধু রবিন জাতে আইরিশ আর মুসা কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম। মূলত রবার্ট আর্থার জুনিয়রের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটর’ অবলম্বনে এই কিশোর সিরিজ লিখতেন রকিব হাসান। সত্যিকার অর্থে রকিব হাসান অনুবাদক এবং কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হন এই সিরিজ দিয়েই। পরবর্তীকালে ‘দ্য ফেমাস ফাইভ’, ‘দ্য হার্ডি বয়েজ’-এর মতো নামকরা বিদেশি সিরিজ থেকে ‘তিন গোয়েন্দার কাহিনীর রসদ জোগাড় করা হয়েছে। কিন্তু জাদুকরী দিকটি হলো, ‘তিন গোয়েন্দা’কে কখনো আমাদের অচেনা আগন্তুক মনে হয়নি। কোত্থেকে কোন কাহিনী নেওয়া হয়েছে সেইসব গবেষণা তো আমরা বড় হয়ে বা বুড়ো হয়ে করেছি। কিন্তু আমাদের কৈশোরে বরাবরই মনে হয়েছে কিশোর, মুসা আর রবিন আমাদেরই বন্ধু। একসঙ্গেই আমরা সমাধান করেছি নানান রহস্য। মুসার কৌতুকগুলো মনে করে এখনো একা একা হাসি। মনে রাখতে হবে, তখন এত টিভি চ্যানেল নেই, নেই ফেইসবুক, ইউটিউব, এমনকি ইন্টারনেট। ফলে আমাদের কৈশোর মুখরিত ছিল ‘তিন গোয়েন্দা’র কাহিনীতেই।
সিরিজ প্রকাশনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ‘সেবা প্রকাশনী’ অগ্রগণ্য এবং এখন পর্যন্ত অগ্রগামী। বলা দরকার ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘কুয়াশা’ সিরিজ দিয়ে। এই গোয়েন্দা কাহিনীর ৭৮টি সিরিজ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘দস্যু বাহারাম’, ‘দস্যু বনহুর’-এর যুগকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল গোয়েন্দা কুয়াশা। তবে এখন পর্যন্ত সেবা প্রকাশনীর সবচেয়ে বড় অবদান বলা যায় ‘মাসুদ রানা’।
সিরিজ উপন্যাস হলেও মাসুদ রানার প্রতিটি শিরোনামই আলাদা। কাজেই সিরিজের অন্য উপন্যাস না পড়লেও পাঠকের অসুবিধা হয় না। তবে মাসুদ রানা উপন্যাসের প্রতিটির সূচনাতে একটি পরিচিতি কথন থাকে। এই পরিচিতি কথন মাসুদ রানা পাঠের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করে। পরিচিতি কথনটি হলো:
‘‘মাসুদ রানা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই। গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভুত রহস্যময় তার গতিবিধি। কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর, সুন্দর এক অন্তর। টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। কোথাও অন্যায়-অবিচার অত্যাচার দেখলে রুখে দাঁড়ায়। পদে পদে তার বিপদ-শিহরণ-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি। আসুন, এই দুর্ধর্ষ, চিরনবীন যুবকটির সঙ্গে পরিচিত হই। সীমিত গ-িবদ্ধ জীবনের একঘেয়েমি থেকে একটানে তুলে নিয়ে যাবে ও আমাদের স্বপ্নের এক আশ্চর্য মায়াবী জগতে। আপনি আমন্ত্রিত।’’
এই পরিচিতি কথনেই মাসুদ রানার জনপ্রিয়তার আসল রহস্য লুকিয়ে আছে। আমরা অধিকাংশ বাঙালি খুব ঘরোয়া আটপৌরে একঘেয়ে জীবনযাপন করি। মাসুদ রানার বিচিত্র জীবন যথার্থই আমাদের স্বপ্নের মায়াবী জগতে নিয়ে যায়। কম-বেশি সবাই আমরা দেশকে ভালোবাসি, দুঃসাহসী হতে চাই, দুরন্ত-দুঃসাহসী হতে চাই। আমাদের সেই সব চাওয়া পূর্ণ করেই সৃষ্টি হয়েছে মাসুদ রানা চরিত্র। মাসুদ রানার বিচিত্র জীবন আর অদ্ভুত রহস্যময় গতিবিধি আমাদের আকৃষ্ট করে। দেশপ্রেমী এই স্পাই আমাদের স্বপ্নের পুরুষ হয়ে ওঠে। একটা কথা মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে কমিকসের চর্চাটা সে অর্থে নেই, নেই কোনো সুপারম্যান। স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, আয়রনম্যানসহ পাশ্চাত্যে অনেক সুপার হিরো আছে যাদের রয়েছে নানা রকম বিশেষ দক্ষতা, অলৌকিক ক্ষমতা। আমাদের ইংরেজি পড়–য়া ছেলেমেয়েরা বিদেশি এই সব হিরোদের ব্র্যান্ডিংয়ে মাতোয়ারা হয়। অন্যদিকে এই প্রাচ্য দেশীয় বেতাল কিংবা রাম, অর্জুন, কৃষ্ণদেরও আমাদের মুসলিম শাসিত এই দেশের মানুষকে অত টানে না। তারা সমকালীনও নয়। ফলে মাসুদ রানা সে অর্থে সুপার না হয়েও বাঙালি তরুণের কাছে অবশ্যই আইডলÑহিরো। বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হলেও মাসুদ রানার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য সে বাঙালি। ‘কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর, সুন্দর এক অন্তর’ কেবল বাঙালি বীরেরই থাকে। মাসুদ রানা তাই আমাদের বাঙালি তরুণদের হিরো। এত দীর্ঘ সময় ধরে এতটা প্রভাব বাংলা ভাষায় আর কোনো চরিত্র রাখতে পারেনি। মাসুদ রানার নাম শোনেননি এমন কোনো শিক্ষিত বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে কি না তাতে সন্দেহ আছে। কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত ‘মাসুদ রানা’ বাংলার এক অনবদ্য সৃষ্টি। পাকিস্তান আমলে সৃষ্টি হওয়া এই গুপ্তচর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বের নানা দেশে গেছেন নানা মিশন নিয়ে। একটু শ্লাঘা করেই বলা যায়, ব্রিটিশদের আছে ‘জেমস বন্ড’ আর আমাদের আছে ‘মাসুদ রানা’।
সাহিত্যের অনেকগুলো শ্রেণিকরণ আছে। ‘গোয়েন্দা কাহিনী’, ‘ভৌতিক গল্প’, ‘বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী’, ‘রহস্য’, ‘রোমাঞ্চ’, ‘অভিযান’ ইত্যকার শ্রেণির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমেই। একটি শ্রেণির কথা না-বললেই নয়, সেটি হলো ‘ওয়েস্টার্ন কাহিনী’। বুনো পশ্চিমের দুর্ধর্ষ জীবন, কাউবয়দের লড়াই, বিপজ্জনক আউটলদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘর্ষ উঠে এসেছে সেবা’র ‘ওয়েস্টার্ন’ কাহিনীর মাধ্যমে। ১৯৮৩ সালে ‘আলেয়ার পিছে’ দিয়ে যাত্রা শুরু হয় এই সিরিজের। রওশন জামিল, শওকত হোসেন, কাজী মাহবুব হোসেন প্রমুখের হাত ধরে সম্পূর্ণ অচেনা এক জগতে প্রবেশ করেছিলাম এই সিরিজের মাধ্যমে। লুই ল’ আমুরের মতো বিশ্বসেরা ওয়েস্টার্ন লেখকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি সেবা প্রকাশনীর কল্যাণেই।
আদতে বইকে সুলভ আর গ্রহণযোগ্য করেছিল সেবা প্রকাশনী। পাঠের আনন্দ পাই সেবা প্রকাশনীর বই থেকে। এ প্রসঙ্গে আর এল স্ট্রংয়ের কথা বলতে চাই, ‘আপনি একটা ভালো বইকে একটা ওষুধের মতো করে গ্রহণ করতে পারবেন না। এটা বইটার প্রতি খুব কঠোর আচরণ হবে এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা খুবই বোকামি হবে। এভাবে এগুলো আমি নিশ্চিত থাকুন যে বইটা আপনাকে যা দিতে পারত আপনি তা নিতে পারছেন না। আপনি তখনই একটি বই থেকে ভালো কিছু পাবেন যখন আপনার আত্মা ও বইয়ের আত্মার মিলন হবে। একটা বই জীবিত ব্যক্তির মতোই। আপনার অবশ্যই তার সঙ্গে বন্ধুর মতো দেখা করতে হবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে ভালো লাগতে হবে, যদি সত্যিই আপনাদের মধ্যে ভালো কিছু প্রবাহিত করতে চান।’ আমাদের স্কুলজীবন স্বতঃস্ফূর্ত আর বন্ধুময় হয়েছিল সেবা প্রকাশনীর বই পড়েই। পড়ার আনন্দের ফাঁকেই আমরা বোনাস হিসেবে পেয়েছি বিশ্বসাহিত্যের সেরা গল্প-উপন্যাসগুলোকে।
হালকা ওজনের পেপারব্যাক বইয়ের প্রকাশনাটা সেবা প্রকাশনীই শুরু করে। পেপারব্যাক হওয়ায় বইয়ের দামও যায় কমে। ফলে একটা বই কিনতে খুব বেশি ভাবতে হয়নি। আর বইটি ছিল সহজলভ্য। সেবা প্রকাশনীর বই যে কোনো পত্রিকা স্ট্যান্ড, বাসস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা রেলস্টেশনে পাওয়া যেত। ফলে ভ্রমণের সঙ্গী হতো এই বই। সহজে বহনযোগ্য, দামে কম হওয়া এবং সরল উপস্থাপনের কারণেই সেবা প্রকাশনীর বই আমাদের বই ভীতি দূর করেছিল। বই পড়া যে একটা আনন্দের ব্যাপার আগে আমরা সেটা জেনেছিলাম। সেবা প্রকাশনী আমাদের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে ছিল অনেক বিচিত্র বিষয় আর চোখের সামনে খুলে দিয়েছিল ইতিহাস আর ভূগোলকেও। এইসব বিবিধ কারণেই আজও সেবা প্রকাশনীকে মনে হয় ‘আমার সেবা প্রকাশনী।’
শেয়ার করুন
লোপামূদ্রা রহমান | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

আসলে শিরোনামটা খুব আবদার করে লিখলাম। তখনই মনে হলো, শিরোনামটা হবে, ‘সেবা প্রকাশনীর আমি’। আমি তো সেবা প্রকাশনীকে গড়ে তুলিনি, বরং সেবা প্রকাশনীই আমাকে গড়ে তুলেছে। সেবা প্রকাশনীর মালিকানা আমার নয়, কিন্তু আমার অনেকটুকুর মালিকানাই সেবা প্রকাশনীর। তবু খুব আদর করে বলতে মন চায়, ‘আমার সেবা প্রকাশনী’। আমার মতো নিশ্চয়ই আরও অনেকেই এমন আদর করে বলবেন ‘আমার সেবা প্রকাশনী’। আমি অন্তত জানি, আমার মতো অসংখ্য মানুষের কৈশোর, যৌবনটা তৈরি করে দিয়েছে সেবা প্রকাশনী। আমার বেড়ে ওঠা, আমি যতটুকু আমি আছি তার অনেকটাই হয়ে ওঠা সেবা প্রকাশনীর কারণেই।
আমি বই কেনা শিখেছি সেবা প্রকাশনীর বই দিয়ে, বই চুরি করা শিখেছি সেবা প্রকাশনীর বই দিয়ে, বই পড়াও আয়ত্ত করেছি সেবা প্রকাশনীর হাত ধরেই। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনো বাংলাদেশের মানুষের হাতে হাতে হুমায়ূন আহমেদ চলে আসেননি। এটা অনেকেই বলে থাকেন, হুমায়ূন আহমেদ পাঠক তৈরি করেছেন। তথ্য তো তাই বলে। কিন্তু একটু তথ্য-বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন আছে। হুমায়ূন আহমেদের বই যারা পড়েছেন, কিনেছেন, তারা অন্যদিকে ধাবিত হয়েছেন কম। অথচ সেবা প্রকাশনীর পাঠক ক্রমশ পরিণত হয়েছেন, হাত বাড়িয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের দিকেও। এটা ঠিক, যে তীব্র জনপ্রিয়তা হুমায়ূন এককভাবে উপভোগ করেছেন তার ধারে-কাছে অন্য কোনো লেখক ছিলেন না কখনো। অন্যদিকে যে তীব্র জনপ্রিয়তা একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেবা প্রকাশনী উপভোগ করেছে তার কাছাকাছি জনপ্রিয়তাও অন্য কোনো প্রকাশনীর নেই। উল্লেখ করা দরকার উইলিয়াম পিটার ব্লাটি’র লেখা ‘দি একসরসিস্ট’ উপন্যাসটিকে হুমায়ূন আহমেদ সেবা প্রকাশনীর জন্য অনুবাদ করেছিলেন। অনুবাদ নয়, বরং রূপান্তর বলা যায় সে উপন্যাসটিকে। এ বই প্রকাশের স্মৃতিচারণ হুমায়ূন নিজে করেছেন, ‘আমার লেখক জীবনের শুরুটা নিদারুণ অর্থকষ্টে কেটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনে সংসার চলত না। বেতনের সিংহভাগ চলে যেত বাড়ি ভাড়ায়। তখন একজন বুদ্ধি দিল কাজী আনোয়ার হোসেন সাহেব সেবা প্রকাশনী থেকে বিদেশি বইয়ের অনুবাদ বের করেন এবং তার জন্য টাকা দেন। আমি অনুবাদে লেগে গেলাম। বিদেশি সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে এই কাজ করা হয়নি। আর্থিক সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে না পেয়ে অনুবাদে গিয়েছি।’ এ বক্তব্যের কয়েকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ। দেশের নামকরা সব প্রকাশনীও লেখক বা অনুবাদককে টাকা দিতে পারত না। কিন্তু সেবা প্রকাশনী সেই নিশ্চয়তা দিতে পারত। অন্যদিকে বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেবা প্রকাশনী।
আমরা যারা কিশোর ছিলাম আশির দশকে তখন বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের হাতেখড়ি হয়েছিল সেবা প্রকাশনীর অনুবাদগুলোর হাত ধরেই। জিম করবেট, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, টমাস হার্ডি, মার্ক টোয়েন, এইচ জি ওয়েলস, জুলভার্ন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, মেরি শেলি, এরিখ মারিয়া রেমার্কের মতো বিশ্বসেরা ও জনপ্রিয় লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি সেবার অনুবাদের মাধ্যমে। বলার অপেক্ষা রাখে না সেবা প্রকাশনী মূলত অনুবাদকেন্দ্রিক একটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বসাহিত্যের বাছাই গল্প-উপন্যাসকে কখনো সরাসরি অনুবাদ আকারে, কখনো রূপান্তর করে, কখনো কিশোর উপযোগী করে প্রকাশ করেছে সেবা প্রকাশনী। রবিনসন ক্রুসোর অ্যাডভেঞ্চারের কথা জেনেছি সেবা প্রকাশনীর হাত ধরেই। ভয়ংকর ড্রাকুলা, দুর্ধর্ষ তিন মাস্কেটিয়ার, গোয়েন্দা শার্লক হোমসকে আমরা চিনেছি সেবা প্রকাশনীর হাত দিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন, রকিব হাসান, শামসুদ্দীন নওয়াব, শেখ আব্দুল হাকিম, খসরু চৌধুরী, নিয়াজ মোর্শেদের মতো অনুবাদকরা একনিষ্ঠতায় আমাদের পাতে তুলে দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের এইসব সেরা চরিত্র আর কাহিনীগুলোর সঙ্গে।
শুধু বিশ্বসাহিত্য নয়, বাংলা সাহিত্যকেও ধারণ করে সেবা প্রকাশনী। যতদূর মনে পড়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ এবং ‘কপালকু-লা’র সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল সেবা প্রকাশনীর ‘কিশোর ক্লাসিক’ সিরিজের মাধ্যমেই। ‘কিশোর ক্লাসিক’ সিরিজ শুধু যে জনপ্রিয় ছিল তা নয়, ভীষণ রকমের প্রয়োজনীয়ও ছিল। চার্লস ডিকেন্স, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, ভিক্টর হুগো, ড্যানিয়েল ডিফো, আলেকজান্ডার দ্যুমা, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, ব্রাম স্টোকার প্রমুখ লেখকের সেরা লেখাগুলোর সঙ্গে প্রথম প্রণয় হয় সেবা প্রকাশনীর হাত ধরেই। প্রায় শ’দুয়েক ‘কিশোর ক্লাসিক’র সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। ‘কিশোর ক্লাসিক’ তো আর কিছু নয়, আদতে বিশ্বসেরা ক্লাসিকগুলোর কিশোর উপযোগী সংস্করণ। এই সিরিজ আসলে পরবর্তীকালের অনেক পাঠক, সমালোচক, এমনকি লেখকের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের অনেক সেরা লেখার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল কিশোর ক্লাসিকের মাধ্যমে।
‘কিশোর কøাসিক’-এর মতো আরেকটি জনপ্রিয় সিরিজ ছিল কিশোর থ্রিলার ‘তিন গোয়েন্দা’। রকিব হাসানের রূপান্তরে ‘তিন গোয়েন্দা’র প্রতিটিই কাহিনীই ছিল আমাদের জন্য সরস বিস্ময়। ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করেছি সিরিজের পরবর্তী বইটির জন্য। কিশোর পাশা, রবিন মিলফোর্ড আর মুসা আমানের গোয়েন্দাগিরিতে আমরাও অনুপ্রাণিত হতাম রহস্য রোমাঞ্চ খুঁজে বের করতে। ক্যালিফোর্নিয়াতে বাস করা কিশোর সমস্যা সমাধান করত তীক্ষè বুদ্ধির জোরে। এখনো চোখে দেখতে পাই কিশোর পাশা তার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে গভীর চিন্তায়। তার বন্ধু রবিন জাতে আইরিশ আর মুসা কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম। মূলত রবার্ট আর্থার জুনিয়রের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটর’ অবলম্বনে এই কিশোর সিরিজ লিখতেন রকিব হাসান। সত্যিকার অর্থে রকিব হাসান অনুবাদক এবং কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হন এই সিরিজ দিয়েই। পরবর্তীকালে ‘দ্য ফেমাস ফাইভ’, ‘দ্য হার্ডি বয়েজ’-এর মতো নামকরা বিদেশি সিরিজ থেকে ‘তিন গোয়েন্দার কাহিনীর রসদ জোগাড় করা হয়েছে। কিন্তু জাদুকরী দিকটি হলো, ‘তিন গোয়েন্দা’কে কখনো আমাদের অচেনা আগন্তুক মনে হয়নি। কোত্থেকে কোন কাহিনী নেওয়া হয়েছে সেইসব গবেষণা তো আমরা বড় হয়ে বা বুড়ো হয়ে করেছি। কিন্তু আমাদের কৈশোরে বরাবরই মনে হয়েছে কিশোর, মুসা আর রবিন আমাদেরই বন্ধু। একসঙ্গেই আমরা সমাধান করেছি নানান রহস্য। মুসার কৌতুকগুলো মনে করে এখনো একা একা হাসি। মনে রাখতে হবে, তখন এত টিভি চ্যানেল নেই, নেই ফেইসবুক, ইউটিউব, এমনকি ইন্টারনেট। ফলে আমাদের কৈশোর মুখরিত ছিল ‘তিন গোয়েন্দা’র কাহিনীতেই।
সিরিজ প্রকাশনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ‘সেবা প্রকাশনী’ অগ্রগণ্য এবং এখন পর্যন্ত অগ্রগামী। বলা দরকার ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘কুয়াশা’ সিরিজ দিয়ে। এই গোয়েন্দা কাহিনীর ৭৮টি সিরিজ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘দস্যু বাহারাম’, ‘দস্যু বনহুর’-এর যুগকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল গোয়েন্দা কুয়াশা। তবে এখন পর্যন্ত সেবা প্রকাশনীর সবচেয়ে বড় অবদান বলা যায় ‘মাসুদ রানা’।
সিরিজ উপন্যাস হলেও মাসুদ রানার প্রতিটি শিরোনামই আলাদা। কাজেই সিরিজের অন্য উপন্যাস না পড়লেও পাঠকের অসুবিধা হয় না। তবে মাসুদ রানা উপন্যাসের প্রতিটির সূচনাতে একটি পরিচিতি কথন থাকে। এই পরিচিতি কথন মাসুদ রানা পাঠের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করে। পরিচিতি কথনটি হলো:
‘‘মাসুদ রানা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই। গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভুত রহস্যময় তার গতিবিধি। কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর, সুন্দর এক অন্তর। টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। কোথাও অন্যায়-অবিচার অত্যাচার দেখলে রুখে দাঁড়ায়। পদে পদে তার বিপদ-শিহরণ-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি। আসুন, এই দুর্ধর্ষ, চিরনবীন যুবকটির সঙ্গে পরিচিত হই। সীমিত গ-িবদ্ধ জীবনের একঘেয়েমি থেকে একটানে তুলে নিয়ে যাবে ও আমাদের স্বপ্নের এক আশ্চর্য মায়াবী জগতে। আপনি আমন্ত্রিত।’’
এই পরিচিতি কথনেই মাসুদ রানার জনপ্রিয়তার আসল রহস্য লুকিয়ে আছে। আমরা অধিকাংশ বাঙালি খুব ঘরোয়া আটপৌরে একঘেয়ে জীবনযাপন করি। মাসুদ রানার বিচিত্র জীবন যথার্থই আমাদের স্বপ্নের মায়াবী জগতে নিয়ে যায়। কম-বেশি সবাই আমরা দেশকে ভালোবাসি, দুঃসাহসী হতে চাই, দুরন্ত-দুঃসাহসী হতে চাই। আমাদের সেই সব চাওয়া পূর্ণ করেই সৃষ্টি হয়েছে মাসুদ রানা চরিত্র। মাসুদ রানার বিচিত্র জীবন আর অদ্ভুত রহস্যময় গতিবিধি আমাদের আকৃষ্ট করে। দেশপ্রেমী এই স্পাই আমাদের স্বপ্নের পুরুষ হয়ে ওঠে। একটা কথা মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে কমিকসের চর্চাটা সে অর্থে নেই, নেই কোনো সুপারম্যান। স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, আয়রনম্যানসহ পাশ্চাত্যে অনেক সুপার হিরো আছে যাদের রয়েছে নানা রকম বিশেষ দক্ষতা, অলৌকিক ক্ষমতা। আমাদের ইংরেজি পড়–য়া ছেলেমেয়েরা বিদেশি এই সব হিরোদের ব্র্যান্ডিংয়ে মাতোয়ারা হয়। অন্যদিকে এই প্রাচ্য দেশীয় বেতাল কিংবা রাম, অর্জুন, কৃষ্ণদেরও আমাদের মুসলিম শাসিত এই দেশের মানুষকে অত টানে না। তারা সমকালীনও নয়। ফলে মাসুদ রানা সে অর্থে সুপার না হয়েও বাঙালি তরুণের কাছে অবশ্যই আইডলÑহিরো। বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হলেও মাসুদ রানার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য সে বাঙালি। ‘কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর, সুন্দর এক অন্তর’ কেবল বাঙালি বীরেরই থাকে। মাসুদ রানা তাই আমাদের বাঙালি তরুণদের হিরো। এত দীর্ঘ সময় ধরে এতটা প্রভাব বাংলা ভাষায় আর কোনো চরিত্র রাখতে পারেনি। মাসুদ রানার নাম শোনেননি এমন কোনো শিক্ষিত বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে কি না তাতে সন্দেহ আছে। কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত ‘মাসুদ রানা’ বাংলার এক অনবদ্য সৃষ্টি। পাকিস্তান আমলে সৃষ্টি হওয়া এই গুপ্তচর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বের নানা দেশে গেছেন নানা মিশন নিয়ে। একটু শ্লাঘা করেই বলা যায়, ব্রিটিশদের আছে ‘জেমস বন্ড’ আর আমাদের আছে ‘মাসুদ রানা’।
সাহিত্যের অনেকগুলো শ্রেণিকরণ আছে। ‘গোয়েন্দা কাহিনী’, ‘ভৌতিক গল্প’, ‘বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী’, ‘রহস্য’, ‘রোমাঞ্চ’, ‘অভিযান’ ইত্যকার শ্রেণির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমেই। একটি শ্রেণির কথা না-বললেই নয়, সেটি হলো ‘ওয়েস্টার্ন কাহিনী’। বুনো পশ্চিমের দুর্ধর্ষ জীবন, কাউবয়দের লড়াই, বিপজ্জনক আউটলদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘর্ষ উঠে এসেছে সেবা’র ‘ওয়েস্টার্ন’ কাহিনীর মাধ্যমে। ১৯৮৩ সালে ‘আলেয়ার পিছে’ দিয়ে যাত্রা শুরু হয় এই সিরিজের। রওশন জামিল, শওকত হোসেন, কাজী মাহবুব হোসেন প্রমুখের হাত ধরে সম্পূর্ণ অচেনা এক জগতে প্রবেশ করেছিলাম এই সিরিজের মাধ্যমে। লুই ল’ আমুরের মতো বিশ্বসেরা ওয়েস্টার্ন লেখকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি সেবা প্রকাশনীর কল্যাণেই।
আদতে বইকে সুলভ আর গ্রহণযোগ্য করেছিল সেবা প্রকাশনী। পাঠের আনন্দ পাই সেবা প্রকাশনীর বই থেকে। এ প্রসঙ্গে আর এল স্ট্রংয়ের কথা বলতে চাই, ‘আপনি একটা ভালো বইকে একটা ওষুধের মতো করে গ্রহণ করতে পারবেন না। এটা বইটার প্রতি খুব কঠোর আচরণ হবে এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা খুবই বোকামি হবে। এভাবে এগুলো আমি নিশ্চিত থাকুন যে বইটা আপনাকে যা দিতে পারত আপনি তা নিতে পারছেন না। আপনি তখনই একটি বই থেকে ভালো কিছু পাবেন যখন আপনার আত্মা ও বইয়ের আত্মার মিলন হবে। একটা বই জীবিত ব্যক্তির মতোই। আপনার অবশ্যই তার সঙ্গে বন্ধুর মতো দেখা করতে হবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে ভালো লাগতে হবে, যদি সত্যিই আপনাদের মধ্যে ভালো কিছু প্রবাহিত করতে চান।’ আমাদের স্কুলজীবন স্বতঃস্ফূর্ত আর বন্ধুময় হয়েছিল সেবা প্রকাশনীর বই পড়েই। পড়ার আনন্দের ফাঁকেই আমরা বোনাস হিসেবে পেয়েছি বিশ্বসাহিত্যের সেরা গল্প-উপন্যাসগুলোকে।
হালকা ওজনের পেপারব্যাক বইয়ের প্রকাশনাটা সেবা প্রকাশনীই শুরু করে। পেপারব্যাক হওয়ায় বইয়ের দামও যায় কমে। ফলে একটা বই কিনতে খুব বেশি ভাবতে হয়নি। আর বইটি ছিল সহজলভ্য। সেবা প্রকাশনীর বই যে কোনো পত্রিকা স্ট্যান্ড, বাসস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা রেলস্টেশনে পাওয়া যেত। ফলে ভ্রমণের সঙ্গী হতো এই বই। সহজে বহনযোগ্য, দামে কম হওয়া এবং সরল উপস্থাপনের কারণেই সেবা প্রকাশনীর বই আমাদের বই ভীতি দূর করেছিল। বই পড়া যে একটা আনন্দের ব্যাপার আগে আমরা সেটা জেনেছিলাম। সেবা প্রকাশনী আমাদের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে ছিল অনেক বিচিত্র বিষয় আর চোখের সামনে খুলে দিয়েছিল ইতিহাস আর ভূগোলকেও। এইসব বিবিধ কারণেই আজও সেবা প্রকাশনীকে মনে হয় ‘আমার সেবা প্রকাশনী।’