বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বড় স্বপ্ন
কাজী ইফতেখার রহমান | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
১৯৭৮ সাল। তৎকালীন শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্র মিলনায়তনে জড়ো হতেন ১০ থেকে ১৫ জন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। তারা ঠিক করলেন প্রত্যেক সপ্তাহে একটি করে বই নিয়ে আলোচনা করবেন। কিন্তু বই কেনার টাকা? হাত বাড়িয়ে দিলেন এক ব্যক্তি। তার দেওয়া ৩৪ টাকায় কেনা হলো বেশ কটি বই। সদস্যরা আগ্রহের সঙ্গে শেষ করতে লাগলেন এক-একটি বই।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বপ্নদ্রষ্টা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখন ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষক। পড়ার প্রতি নতুন প্রজন্মের এমন আগ্রহ দেখে নতুন চিন্তা চেপে বসল তার মাথায়। সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকা কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার। শ্রেণিকক্ষের চার দেয়ালের পরিবর্তে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেবেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আলোকিত মানুষের খোঁজে মূলত তখন থেকেই শুরু হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম।
নায়েম অডিটোরিয়ামে ক্রমেই বাড়ছিল বই পড়ার সদস্য সংখ্যা। কিছুদিন বাদে ইন্দিরা রোডের একটি ভাড়া বাসায় স্থানান্তরিত হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত হতে থাকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক বছর।
এরপর সরকার থেকে বাংলা মোটরে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ পায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। সেই বাড়িতে শুরু হয় কেন্দ্রের কার্যক্রম। অধ্যাপক আবু সায়ীদের স্বপ্নের সারথি হতে থাকেন নতুন নতুন মুখ। নানাভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন কেন্দ্রের সঙ্গে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দীর্ঘ পথচলায় যুক্ত হয়েছেন বহু ব্যক্তিত্ব। নানাভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন আলোকিত মানুষ গড়ার সঙ্গে। এমনই একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর। ঢাকা কলেজের আগে আবদুল্লাহ সায়ীদ তেজগাঁও টেকনিক্যাল কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তখন তিনি আমাদের স্কুলের ভেতর থেকেই আসা-যাওয়া করতেন। তার হাতে সব সময় বই থাকত। স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা হলেই তিনি বিভিন্ন বই দেখিয়ে জানতে চাইতেন, বইগুলো তাদের পড়া হয়েছে কি-না। ঠিক কখন থেকেই সায়ীদ স্যারের সঙ্গে পরিচয় সাগরের।
এরপর যখন ইন্দিরা রোডে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়, তখন সেখানে যাওয়া শুরু করেন ফরিদুর রেজা সাগর। তার ভাষায়, ‘প্রথম দিকে ভিন্ন একটা কারণ ছিল। সেখানে একটা বড় হেডফোন ছিল। সেটা দিয়ে গান শোনা যেত, তখনকার সময়ে যা ছিল খুবই দুর্লভ। সে সময় বই পড়ার থেকেও এ বিষয়টা মাথায় বেশি কাজ করত।’
তবে গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে বই পড়ার প্রতিও আগ্রহ জন্মায় তার। বাসায় অনেক বই থাকা সত্ত্বেও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইয়ের প্রতি আলাদা একটা টান কাজ করত বলে জানান ফরিদুর রেজা সাগর। তখন তিনি নটর ডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে লেখাপড়া করেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার মাধ্যমেই বইয়ের প্রতি আলাদা আকর্ষণ জন্মানো শুরু করে। এরপর মাসুদ রানার বই বাইরে থেকে ভাড়া করেও পড়তেন তিনি। মূলত তখনকার প্রজন্মের বইয়ের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখেই আরও বেশি আশাবাদী হতে থাকেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তার স্বপ্ন ছিল সাহিত্য কেন্দ্র এক দিন বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবেই। ফরিদুর রেজা সাগরের ভাষায়, সায়ীদ স্যারের সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। বর্তমানে শিল্প, সাহিত্য, মিডিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে যারা নিজের প্রতিভার মাধ্যমে আলো ছড়াচ্ছেন, তাদের একটা বড় অংশ কোনো না কোনোভাবে সাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
পথচলার শুরু থেকে আজও পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত আছেন উপস্থাপক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষার। সাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে তার যুক্ত হওয়ার গল্পটা বেশ মজার। ১৯৮৪ সালের দিকের কথা। তখন মাত্র এসএসসি পাস করেছেন তিনি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র একটা বই পড়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন তুষার। প্রথমে যাবেন না বলেই ঠিক করেছিলেন। কিন্তু বন্ধুর কথায় এক ধরনের জেদের বশেই সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। পুরস্কারও পেয়েছিলেন খুব পছন্দের জিনিস। সে সময়ের এক হাজার টাকার বই, যা দিয়ে রীতিমতো একটি শোকেস পূর্ণ করা যেত।
কিন্তু তার সেই জেদই একসময় পরিণত হয়েছিল নেশায়। সেই নেশা জ্ঞানের আলো ছড়ানোর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার। কেবল একটি পুরস্কারের আশায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চৌকাঠে পা রাখা তুষার আজও আছেন আলোকিত মানুষ গড়ার নির্মাতাদের একজন হয়ে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে একরকম বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তার। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ শুরু করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে। পরে কেন্দ্রের প্রতিটি কর্মসূচিতেই নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন তিনি। জানালেন, জীবনের অনেক বড় একটি পুরস্কার পেয়েছেন কেন্দ্র থেকে। কী সেই পুরস্কার? ‘সায়ীদ স্যার এক দিন তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, যদি ওনার কোনো ছেলে থাকত তাহলে তাদের মধ্যে আমি একজন। সেদিন স্যার তিনজনের নাম বলেছিলেন, কায়েস ভাই, আনিস ভাই (আনিসুল হক), আর আমি।’
১৯৮৫ সালের দিকে তখনকার স্কুল-কলেজ কর্মসূচিতে উপস্থাপনা করতেন। সেই সঙ্গে অংশ নেওয়াদের সনদ লেখার দায়িত্বও পড়েছিল তার কাঁধে। মাত্র তিন বছরেই নিজ হাতে লিখেছিলেন ৩৭ হাজারের মতো সনদ। তখন শুরু করে আজও তিনি আছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে। আলোর দিশারি অধ্যাপক আবু সায়ীদের সঙ্গে ঘুরেছেন সারা দেশ। নিজেকে সঁপে দিয়েছেন আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার কাজে। এত বড় একটি উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে কতটুকু তৃপ্ত? এমন প্রশ্নে তুষারের উত্তর, ‘সায়ীদ স্যার প্রতিনিয়ত নতুন কিছু করতে ভালোবাসেন। তাই একটা কাজ শুরুর পর তার ঢালপালা বাড়তে থাকে। সেটা শেষ হতেই আবার নতুন আর একটা। তাই কোনো কাজ শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা হয়নি আজও। তবে সমাজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজে সত্যিই তৃপ্ত। কারণ বিভিন্ন স্থানে উদাহরণ হিসেবে কেন্দ্রে নাম উচ্চারিত হয়। সত্যিই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ একটা উদাহরণ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ উৎকর্ষ সাধনের উর্বর ভূমি।
আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে শুরু হওয়া সাহিত্য কেন্দ্র আজ দেশের অনেক দূর বিস্তার লাভ করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলপড়য়া কিশোরও আজ বই পড়ার ভেতর আনন্দ খুঁজে পায়। দেশের এমন কিছু অঞ্চল খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানকার শিক্ষার্থীরা প্রকৃত পাঠাগারের স্বাদ পেয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মাধ্যমে। বই মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে, জাতীয়ভিত্তিক লাইব্রেরি কার্যক্রমের আওতায় শুরু হয় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কার্যক্রম। যা আজ পরিণত হয়েছে উৎকৃষ্ট উদাহরণে। দেশের প্রতিটি জেলা শহরসহ উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও দেখা মিলবে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির। আজ এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজারে। সাহিত্য কেন্দ্রে দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১৯৮৪ সালে শুরু হয় স্কুল-কলেজ কর্মসূচি।
শিক্ষার্থীদের মনের উৎকর্ষ সাধনে কেন্দ্রের এটির সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। দেশের বিভিন্ন স্থানে দুটি বা তিনটি স্কুল-কলেজের সমন্বয়ে কার্যক্রমের এক একটি শাখা গড়ে তোলা হয়েছিল। সেখান থেকে আগ্রহী ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের কিছু বই পড়তে দেওয়া হতো এবং পরে তার ওপর পরীক্ষা নেওয়া হতো। অংশগ্রহণকারীদের উৎসাহিত করতে দেওয়া হতো সনদ ও পুরস্কার।
২০০৪ সালে এই কার্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-অভিভাবকের সমন্বয়ে এবং এবং একজন যোগ্য ও সংস্কৃতিমনা শিক্ষকের নেতৃত্বে কর্মসূচিতে পরিচালিত হতে শুরু করে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানের ১৬০০ বিদ্যালয় এবং ৫০০ কলেজে এই কার্যক্রমটি চলছে। এতে সদস্য আছেন প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার।
২০১০ সালে পাঠাভ্যাস উন্নয়নে নতুন কার্যক্রম শুরু করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এখানেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশের ২৫০ উপজেলার ১২০০ স্কুল এবং মাদ্রাসায় এই কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া ছয় বছর ধরে বাংলা মোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যালয়ে পরিচালিত হচ্ছে আলোর ইশকুল। উৎকর্ষময় ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার জন্য এই কার্যক্রম শুরু করা হয়। এর আওতায় আলোর ইশকুলের সদস্যদের শিল্প-সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, দর্শন, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারেন। এর অন্যতম আকর্ষণীয় একটি কার্যক্রম হলো পাঠচক্র। যেখানে সদস্যরা সম্মিলিতভাবে বই পড়ার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে পাঠাভ্যাস সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন ধরনের বইও প্রকাশ করে থাকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এখন পর্যন্ত কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫০০ বই প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৫০০টি বই অনুবাদের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
মূলত ৩৪ টাকার বই আর ১৫ জন সদস্যের কার্যক্রমটিই আজ ২৮ লাখ সদস্যের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বাংলা মোটরের নয়তলা ভবনের প্রতিটি লাল ইট থেকেও যেন আজ আলো ছড়াচ্ছে। সে আলো ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
শেয়ার করুন
কাজী ইফতেখার রহমান | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

১৯৭৮ সাল। তৎকালীন শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্র মিলনায়তনে জড়ো হতেন ১০ থেকে ১৫ জন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। তারা ঠিক করলেন প্রত্যেক সপ্তাহে একটি করে বই নিয়ে আলোচনা করবেন। কিন্তু বই কেনার টাকা? হাত বাড়িয়ে দিলেন এক ব্যক্তি। তার দেওয়া ৩৪ টাকায় কেনা হলো বেশ কটি বই। সদস্যরা আগ্রহের সঙ্গে শেষ করতে লাগলেন এক-একটি বই।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্বপ্নদ্রষ্টা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখন ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষক। পড়ার প্রতি নতুন প্রজন্মের এমন আগ্রহ দেখে নতুন চিন্তা চেপে বসল তার মাথায়। সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকা কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার। শ্রেণিকক্ষের চার দেয়ালের পরিবর্তে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেবেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আলোকিত মানুষের খোঁজে মূলত তখন থেকেই শুরু হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম।
নায়েম অডিটোরিয়ামে ক্রমেই বাড়ছিল বই পড়ার সদস্য সংখ্যা। কিছুদিন বাদে ইন্দিরা রোডের একটি ভাড়া বাসায় স্থানান্তরিত হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত হতে থাকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক বছর।
এরপর সরকার থেকে বাংলা মোটরে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ পায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। সেই বাড়িতে শুরু হয় কেন্দ্রের কার্যক্রম। অধ্যাপক আবু সায়ীদের স্বপ্নের সারথি হতে থাকেন নতুন নতুন মুখ। নানাভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন কেন্দ্রের সঙ্গে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দীর্ঘ পথচলায় যুক্ত হয়েছেন বহু ব্যক্তিত্ব। নানাভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন আলোকিত মানুষ গড়ার সঙ্গে। এমনই একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর। ঢাকা কলেজের আগে আবদুল্লাহ সায়ীদ তেজগাঁও টেকনিক্যাল কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তখন তিনি আমাদের স্কুলের ভেতর থেকেই আসা-যাওয়া করতেন। তার হাতে সব সময় বই থাকত। স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা হলেই তিনি বিভিন্ন বই দেখিয়ে জানতে চাইতেন, বইগুলো তাদের পড়া হয়েছে কি-না। ঠিক কখন থেকেই সায়ীদ স্যারের সঙ্গে পরিচয় সাগরের।
এরপর যখন ইন্দিরা রোডে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়, তখন সেখানে যাওয়া শুরু করেন ফরিদুর রেজা সাগর। তার ভাষায়, ‘প্রথম দিকে ভিন্ন একটা কারণ ছিল। সেখানে একটা বড় হেডফোন ছিল। সেটা দিয়ে গান শোনা যেত, তখনকার সময়ে যা ছিল খুবই দুর্লভ। সে সময় বই পড়ার থেকেও এ বিষয়টা মাথায় বেশি কাজ করত।’
তবে গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে বই পড়ার প্রতিও আগ্রহ জন্মায় তার। বাসায় অনেক বই থাকা সত্ত্বেও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইয়ের প্রতি আলাদা একটা টান কাজ করত বলে জানান ফরিদুর রেজা সাগর। তখন তিনি নটর ডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে লেখাপড়া করেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার মাধ্যমেই বইয়ের প্রতি আলাদা আকর্ষণ জন্মানো শুরু করে। এরপর মাসুদ রানার বই বাইরে থেকে ভাড়া করেও পড়তেন তিনি। মূলত তখনকার প্রজন্মের বইয়ের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখেই আরও বেশি আশাবাদী হতে থাকেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তার স্বপ্ন ছিল সাহিত্য কেন্দ্র এক দিন বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবেই। ফরিদুর রেজা সাগরের ভাষায়, সায়ীদ স্যারের সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। বর্তমানে শিল্প, সাহিত্য, মিডিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে যারা নিজের প্রতিভার মাধ্যমে আলো ছড়াচ্ছেন, তাদের একটা বড় অংশ কোনো না কোনোভাবে সাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
পথচলার শুরু থেকে আজও পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত আছেন উপস্থাপক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষার। সাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে তার যুক্ত হওয়ার গল্পটা বেশ মজার। ১৯৮৪ সালের দিকের কথা। তখন মাত্র এসএসসি পাস করেছেন তিনি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র একটা বই পড়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন তুষার। প্রথমে যাবেন না বলেই ঠিক করেছিলেন। কিন্তু বন্ধুর কথায় এক ধরনের জেদের বশেই সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। পুরস্কারও পেয়েছিলেন খুব পছন্দের জিনিস। সে সময়ের এক হাজার টাকার বই, যা দিয়ে রীতিমতো একটি শোকেস পূর্ণ করা যেত।
কিন্তু তার সেই জেদই একসময় পরিণত হয়েছিল নেশায়। সেই নেশা জ্ঞানের আলো ছড়ানোর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার। কেবল একটি পুরস্কারের আশায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চৌকাঠে পা রাখা তুষার আজও আছেন আলোকিত মানুষ গড়ার নির্মাতাদের একজন হয়ে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে একরকম বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তার। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ শুরু করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে। পরে কেন্দ্রের প্রতিটি কর্মসূচিতেই নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন তিনি। জানালেন, জীবনের অনেক বড় একটি পুরস্কার পেয়েছেন কেন্দ্র থেকে। কী সেই পুরস্কার? ‘সায়ীদ স্যার এক দিন তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, যদি ওনার কোনো ছেলে থাকত তাহলে তাদের মধ্যে আমি একজন। সেদিন স্যার তিনজনের নাম বলেছিলেন, কায়েস ভাই, আনিস ভাই (আনিসুল হক), আর আমি।’
১৯৮৫ সালের দিকে তখনকার স্কুল-কলেজ কর্মসূচিতে উপস্থাপনা করতেন। সেই সঙ্গে অংশ নেওয়াদের সনদ লেখার দায়িত্বও পড়েছিল তার কাঁধে। মাত্র তিন বছরেই নিজ হাতে লিখেছিলেন ৩৭ হাজারের মতো সনদ। তখন শুরু করে আজও তিনি আছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে। আলোর দিশারি অধ্যাপক আবু সায়ীদের সঙ্গে ঘুরেছেন সারা দেশ। নিজেকে সঁপে দিয়েছেন আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার কাজে। এত বড় একটি উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে কতটুকু তৃপ্ত? এমন প্রশ্নে তুষারের উত্তর, ‘সায়ীদ স্যার প্রতিনিয়ত নতুন কিছু করতে ভালোবাসেন। তাই একটা কাজ শুরুর পর তার ঢালপালা বাড়তে থাকে। সেটা শেষ হতেই আবার নতুন আর একটা। তাই কোনো কাজ শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা হয়নি আজও। তবে সমাজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজে সত্যিই তৃপ্ত। কারণ বিভিন্ন স্থানে উদাহরণ হিসেবে কেন্দ্রে নাম উচ্চারিত হয়। সত্যিই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ একটা উদাহরণ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ উৎকর্ষ সাধনের উর্বর ভূমি।
আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে শুরু হওয়া সাহিত্য কেন্দ্র আজ দেশের অনেক দূর বিস্তার লাভ করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলপড়য়া কিশোরও আজ বই পড়ার ভেতর আনন্দ খুঁজে পায়। দেশের এমন কিছু অঞ্চল খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানকার শিক্ষার্থীরা প্রকৃত পাঠাগারের স্বাদ পেয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মাধ্যমে। বই মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে, জাতীয়ভিত্তিক লাইব্রেরি কার্যক্রমের আওতায় শুরু হয় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কার্যক্রম। যা আজ পরিণত হয়েছে উৎকৃষ্ট উদাহরণে। দেশের প্রতিটি জেলা শহরসহ উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও দেখা মিলবে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির। আজ এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজারে। সাহিত্য কেন্দ্রে দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১৯৮৪ সালে শুরু হয় স্কুল-কলেজ কর্মসূচি।
শিক্ষার্থীদের মনের উৎকর্ষ সাধনে কেন্দ্রের এটির সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। দেশের বিভিন্ন স্থানে দুটি বা তিনটি স্কুল-কলেজের সমন্বয়ে কার্যক্রমের এক একটি শাখা গড়ে তোলা হয়েছিল। সেখান থেকে আগ্রহী ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের কিছু বই পড়তে দেওয়া হতো এবং পরে তার ওপর পরীক্ষা নেওয়া হতো। অংশগ্রহণকারীদের উৎসাহিত করতে দেওয়া হতো সনদ ও পুরস্কার।
২০০৪ সালে এই কার্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-অভিভাবকের সমন্বয়ে এবং এবং একজন যোগ্য ও সংস্কৃতিমনা শিক্ষকের নেতৃত্বে কর্মসূচিতে পরিচালিত হতে শুরু করে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানের ১৬০০ বিদ্যালয় এবং ৫০০ কলেজে এই কার্যক্রমটি চলছে। এতে সদস্য আছেন প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার।
২০১০ সালে পাঠাভ্যাস উন্নয়নে নতুন কার্যক্রম শুরু করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এখানেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশের ২৫০ উপজেলার ১২০০ স্কুল এবং মাদ্রাসায় এই কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া ছয় বছর ধরে বাংলা মোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যালয়ে পরিচালিত হচ্ছে আলোর ইশকুল। উৎকর্ষময় ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার জন্য এই কার্যক্রম শুরু করা হয়। এর আওতায় আলোর ইশকুলের সদস্যদের শিল্প-সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, দর্শন, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারেন। এর অন্যতম আকর্ষণীয় একটি কার্যক্রম হলো পাঠচক্র। যেখানে সদস্যরা সম্মিলিতভাবে বই পড়ার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে পাঠাভ্যাস সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন ধরনের বইও প্রকাশ করে থাকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এখন পর্যন্ত কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫০০ বই প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৫০০টি বই অনুবাদের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
মূলত ৩৪ টাকার বই আর ১৫ জন সদস্যের কার্যক্রমটিই আজ ২৮ লাখ সদস্যের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বাংলা মোটরের নয়তলা ভবনের প্রতিটি লাল ইট থেকেও যেন আজ আলো ছড়াচ্ছে। সে আলো ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।