নারীর অনিঃশেষ সংগ্রামে মহিলা পরিষদ
আইরীন নিয়াজী মান্না | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন নারী সংগঠন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের আগে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ নামে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল নারীনেত্রী কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে এবং মালেকা বেগমকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু।
নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক দেশ ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে একসূত্রে গেঁথে এই সংগঠনের পথচলা শুরু। ভাষাআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক সংস্কারসহ সব প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রাথমিক প্রস্তুতি পর্বের এক অনন্য সফল সংযোজন মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠা।
বাংলাদেশের নারীর বহুমাত্রিক সংগ্রামের বড় সংগঠন মহিলা পরিষদ। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ছিল মহিলা পরিষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। নারীর অধিকারভিত্তিক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংগঠন হিসেবে মহিলা পরিষদের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, প্রায় ৫০ বছরে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সংগঠনের হাজার হাজার সদস্য ও কর্মীর মেধা, শ্রম ও স্বেচ্ছাসেবা। সংগঠন বিস্তৃতি লাভ করেছে ৫৮টি জেলায়, রয়েছে ২ হাজার ৩২৫টি তৃণমূল শাখা। স্বেচ্ছাসেবী সদস্যের সংখ্যা দেড় লাখ। দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ছাত্রী তরুণীদের এক অংশ এবং দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সচেতন নারী সমাজের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমের অঙ্গীকার নিয়ে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গঠিত হয় আন্দোলনমুখী জাতীয়ভিত্তিক, অরাজনৈতিক এই স্বেচ্ছাসেবী গণ-নারী সংগঠন। অসাম্প্রদায়িক, গণতন্ত্র ও নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে মহিলা পরিষদ। নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বিভিন্নমুখী পরিবেশ ও পরিস্থিতি মোকাবিলা করে গড়ে উঠেছে মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক ভিত্তির গ্রহণযোগ্যতা।
নারীর অধিকার মানবাধিকার এ স্লোগান নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ পরিচালনায় নারীর সমঅংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা, নারীর ব্যক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সামগ্রিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে চার দশকের অধিক সময় ধরে নারীসমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করে আন্দোলন পরিচালনা করছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। নারীর অধিকার বিষয়ে মহিলা পরিষদের রয়েছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর অধিকার বিষয়ে মহিলা পরিষদের রয়েছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ১২টি পৃথক উপপরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সংগঠনের বহুমুখী কার্যক্রম।
সংগঠন উপপরিষদ : সংগঠন উপপরিষদ দেশের নারী সমাজকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে সারা দেশে বিস্তৃত করেছে শক্তিশালী সংগঠন। গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, স্বেচ্ছাসেবায় আগ্রহী ১৬ বছরের ঊর্ধ্বে নারীদের সংগঠনের সদস্য করা হয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বর্তমানে ৬১টি সাংগঠনিক জেলা শাখা রয়েছে। কর্মী সংগঠকদের দক্ষতাবৃদ্ধি গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ ও পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত।
লিগ্যাল এইড উপপরিষদ : তৃণমূল পর্যন্ত বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে নির্যাতনের শিকার নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূলের আন্দোলন পরিচালনা করছে। লিগ্যাল এইড উপপরিষদ নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে দাঁড়িয়ে আইন সহায়তা, চিকিৎসাসেবা ও আশ্রয় প্রদানসহ সেবামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি এবং আইন সংস্কার ও আইন প্রণয়নের জন্য অ্যাডভোকেসি/লবি ও রাজপথে আন্দোলনসহ আন্দোলনমুখী কার্যক্রম। সমাজে, রাষ্ট্রে পরিবারে নারী নির্যাতনবিরোধী সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে তরুণ ও পুরুষ সমাজকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা হচ্ছে নারী নির্যাতনবিরোধী সংগ্রামে এবং গ্রহণ করা হচ্ছে জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি। আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ নাগরিক সমাজকে নিয়ে সামাজিকভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে প্রতিরোধের আন্দোলন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে আইন সংস্কারের বিভিন্ন সুপারিশমালা পেশ করছে, নতুন আইন প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রামের আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। এর মাধ্যমে ঢাকা, রাঙ্গামাটি, রাজশাহী, সিলেট, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে মহিলা পরিষদ কাজ করছে। এছাড়া ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সঙ্গে মহিলা পরিষদ সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে নির্যাতনের শিকার নারীদের আইনগত পরামর্শ, তদন্ত, কাউন্সেলিং, সালিশি কার্যক্রম ছাড়াও মামলা পরিচালনা এবং মামলার রায় কার্যকর করার জন্য আন্দোলন করছে। এছাড়াও জনস্বার্থে মহিলা পরিষদ মামলা করে থাকে। উল্লেখ্য, এ বছরে সালিশির মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য ৮৯ লাখ ৮২ হাজার ৬০১ টাকা দেনমোহর আদায় করা সম্ভব হয়েছে।
আন্দোলন উপপরিষদ : বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় সমঅংশীদারিত্বের লক্ষ্যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অধিকার ও সুযোগ আরও কার্যকর, ব্যাপক ও প্রসারিত করার দাবিতে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আন্দোলন করে আসছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবিতে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সভানেত্রী সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে স্মারকলিপি জমা দেয়।
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবিতে চতুর্দশ সংশোধনী বিল ২০০০ সালে এবং ২০১৩ সালে ষোড়শ সংশোধনী হিসাবে সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়। সুস্থ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনীতিতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধের দাবিতে মহিলা পরিষদ পরিচালনা করে ধারাবাহিক আন্দোলন। জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ার দাবিতে নির্বাচন কমিশনের কাঠামো সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়ার মৌলিক সংস্কার, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করার দাবিতে জনমত গঠন ও আন্দোলন পরিচালনা করে। পাশাপাশি গণতন্ত্র ও সুশাসনের লক্ষ্যে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অব্যাহত আন্দোলন এবং অ্যাডভোকেসি-লবি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
আশির দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জাতিসংঘ সনদ “নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ” (সিডও)-এর পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়নের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করার পাশাপাশি নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্যে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়নের দাবিতে মহিলা পরিষদ আন্দোলন করে চলছে।
প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপপরিষদ : মহিলা পরিষদ বহুমাত্রিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে থাকে।
মহিলা পরিষদ তিন ধরনের প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে। সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তত্ত্বগত প্রশিক্ষণ, সাংগঠনিক কাজ পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার লক্ষ্যে বাস্তব কাজের ধারা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও আইন বিষয়ক প্যারালিগ্যাল প্রশিক্ষণ। এছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে নারী আন্দোলন ও জাতিসংঘ সিডও সনদ নিয়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হয়।
২০১১ থেকে প্রশিক্ষণে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। চালু হয়েছে জেন্ডার উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক ত্রৈমাসিক সার্টিফিকেট কোর্স। বিভিন্ন উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংগঠন, গবেষক, ছাত্রছাত্রী এই সার্টিফিকেট কোর্সে অংশগ্রহণ করে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সিপিডি ও বিআইডিএসের গবেষকরা এবং নারী আন্দোলনের নেতারা এ কোর্সের ক্লাস পরিচালনা করেন। এ কোর্স পরিচালনার মধ্য দিয়ে মহিলা পরিষদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
মহিলা পরিষদ সংবাদপত্রের আধেয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে নারী নির্যাতন পরিস্থিতি নিয়ে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। বিষয়ভিত্তিক গবেষণাও পরিচালিত হয়। মহিলা পরিষদ একটি গ্রন্থাগার পরিচালনা করে। যেখানে নারী আন্দোলন ও গবেষণা, সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, মানবাধিকার আন্দোলন, সাহিত্য, প্রবন্ধ, জীবনী, স্মৃতিকথা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ রয়েছে। মহিলা পরিষদ গ্রন্থাগার রেফারেন্স উপকরণে সমৃদ্ধ। গবেষক, ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবীসহ অনেকেই এ রেফারেন্স সেবা গ্রহণ করে থাকেন।
রোকেয়া সদন উপপরিষদ : নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূল কাজের অবিচ্ছেদ্য কার্যক্রম হিসাবে ১৯৮৩ সাল থেকে পরিচালনা করা হয় রোকেয়া সদন। রোকেয়া সদনের কাজ হলো, নির্যাতনের শিকার নারীর শারীরিক ও মানসিক আঘাত নিরূপণ ও নিরাময়ের ব্যবস্থা করা। নির্যাতনের শিকার নারীর মনে সাহস সঞ্চার করে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা সৃষ্টি করা। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সব ধরনের সহায়তা প্রদান। পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান এবং ছবি আঁকা ও সংগীত প্রশিক্ষণ। বসবাসকারীদের জন্য স্বচ্ছন্দময়, সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও আনন্দময় পরিবেশ গড়ে তোলা।
প্রচার ও গণমাধ্যম উপপরিষদ : প্রচার ও গণমাধ্যম উপপরিষদের মাধ্যমে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গণমাধ্যমের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং সংগঠনের বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে তুলে ধরার পাশাপাশি সর্বক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণমাধ্যমের বর্ধিত কার্যকর ভূমিকা মনিটরিং করছে। নারীবিষয়ক ইস্যুতে মহিলা পরিষদসহ বৃহত্তর নারী সমাজের দাবি গণমাধ্যমে প্রতিফলিত করা, গণমাধ্যমে কর্মরত নারীর অবস্থা ও অবস্থান শক্তিশালী করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে গণমাধ্যম উপপরিষদ কাজ করে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা কর্মরত আছেন তাদের সঙ্গে নারীবিষয়ক বিভিন্ন ইস্যু, সমাজে নারীর ইতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরার জন্য মতবিনিময় ও আলোচনা সভা করে থাকে। গণমাধ্যম উপপরিষদ রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে গণমাধ্যমকে জেন্ডার সংবেদনশীল করে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছে। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী চেতনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় আলোচনা সভা করে।
প্রকাশনা উপপরিষদ : বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ত্রৈমাসিক মুখপত্র মহিলা সমাচার ১৯৭২ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানমের সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে মহিলা পরিষদ জার্নাল। জার্নালে নারী আন্দোলনের বৈশ্বিক, জাতীয়, আঞ্চলিক, ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যিক ও চলমান যাবতীয় প্রসঙ্গ, সম্ভাবনা, সমস্যা, প্রশ্ন ও প্রত্যাশাসমূহ সম্পর্কে তাত্ত্বিক, তথ্যগত ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। মহিলা সমাচার ও মহিলা পরিষদ জার্নাল ছাড়া প্রকাশনা উপপরিষদ প্রকাশ করে থাকে সংগঠনের নানা প্রকাশনা।
আন্তর্জাতিক উপপরিষদ : বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাউন্সিলের (ঊঈঙঝঙঈ) এনজিও পদমর্যাদাভুক্ত সংগঠন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্মসূচি, জাতিসংঘের মর্যাদাবিষয়ক কমিশনের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ও তথ্য আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সংগঠনের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। সংগঠনের অভ্যন্তরে নারীর মানবাধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন বৈশ্বিক উদ্যোগ এবং সাম্প্রতিক তথ্য সম্পর্কে সংগঠক, কর্মীদের জানার পরিধি বিস্তৃত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উপপরিষদ বৈশ্বিক নারীর মানবাধিকার ও ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার বৈশ্বিক উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রথম জাতিসংঘের সিডও সনদের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে এ দেশে সিডও বাস্তবায়ন আন্দোলনের সূচনা করে। জাতিসংঘ সিডো পলিসিতে নিয়মিত সিডও অবস্থার বিষয়ে ছায়া প্রতিবেদক/বিকল্প প্রতিবেদন প্রেরণ করে। এ প্রতিবেদন কখনো এককভাবে, কখনো যৌথভাবে প্রেরণ করা হয়।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপপরিষদ : সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষা উপপরিষদের উদ্যোগে নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে অবৈতনিক বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করা হতো। পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপপরিষদের উদ্যোগে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা এবং নিজস্ব সাংগঠনিক উদ্যোগে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা দাবিতে মহিলা পরিষদ শিক্ষা এবং পাঠ্যক্রমে ও পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ে ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে স্মারকলিপি প্রদান করে থাকে। প্রদত্ত শিক্ষানীতি বিষয়ে মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে সুপারিশমালা প্রদান করা হয়। এছাড়া স্বাস্থ্য উপপরিষদ, সমাজকল্যাণ উপপরিষদ ও পরিবেশ উপপরিষদ রয়েছে।
শেয়ার করুন
আইরীন নিয়াজী মান্না | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন নারী সংগঠন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের আগে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ নামে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল নারীনেত্রী কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে এবং মালেকা বেগমকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক দেশ ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে একসূত্রে গেঁথে এই সংগঠনের পথচলা শুরু। ভাষাআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক সংস্কারসহ সব প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রাথমিক প্রস্তুতি পর্বের এক অনন্য সফল সংযোজন মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের নারীর বহুমাত্রিক সংগ্রামের বড় সংগঠন মহিলা পরিষদ। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ছিল মহিলা পরিষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। নারীর অধিকারভিত্তিক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংগঠন হিসেবে মহিলা পরিষদের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, প্রায় ৫০ বছরে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সংগঠনের হাজার হাজার সদস্য ও কর্মীর মেধা, শ্রম ও স্বেচ্ছাসেবা। সংগঠন বিস্তৃতি লাভ করেছে ৫৮টি জেলায়, রয়েছে ২ হাজার ৩২৫টি তৃণমূল শাখা। স্বেচ্ছাসেবী সদস্যের সংখ্যা দেড় লাখ। দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ছাত্রী তরুণীদের এক অংশ এবং দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সচেতন নারী সমাজের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমের অঙ্গীকার নিয়ে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গঠিত হয় আন্দোলনমুখী জাতীয়ভিত্তিক, অরাজনৈতিক এই স্বেচ্ছাসেবী গণ-নারী সংগঠন। অসাম্প্রদায়িক, গণতন্ত্র ও নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে মহিলা পরিষদ। নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বিভিন্নমুখী পরিবেশ ও পরিস্থিতি মোকাবিলা করে গড়ে উঠেছে মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক ভিত্তির গ্রহণযোগ্যতা। নারীর অধিকার মানবাধিকার এ স্লোগান নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ পরিচালনায় নারীর সমঅংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা, নারীর ব্যক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা সামগ্রিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে চার দশকের অধিক সময় ধরে নারীসমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করে আন্দোলন পরিচালনা করছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। নারীর অধিকার বিষয়ে মহিলা পরিষদের রয়েছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর অধিকার বিষয়ে মহিলা পরিষদের রয়েছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ১২টি পৃথক উপপরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সংগঠনের বহুমুখী কার্যক্রম। সংগঠন উপপরিষদ : সংগঠন উপপরিষদ দেশের নারী সমাজকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে সারা দেশে বিস্তৃত করেছে শক্তিশালী সংগঠন। গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, স্বেচ্ছাসেবায় আগ্রহী ১৬ বছরের ঊর্ধ্বে নারীদের সংগঠনের সদস্য করা হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বর্তমানে ৬১টি সাংগঠনিক জেলা শাখা রয়েছে। কর্মী সংগঠকদের দক্ষতাবৃদ্ধি গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ ও পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত। লিগ্যাল এইড উপপরিষদ : তৃণমূল পর্যন্ত বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে নির্যাতনের শিকার নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূলের আন্দোলন পরিচালনা করছে। লিগ্যাল এইড উপপরিষদ নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে দাঁড়িয়ে আইন সহায়তা, চিকিৎসাসেবা ও আশ্রয় প্রদানসহ সেবামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি এবং আইন সংস্কার ও আইন প্রণয়নের জন্য অ্যাডভোকেসি/লবি ও রাজপথে আন্দোলনসহ আন্দোলনমুখী কার্যক্রম। সমাজে, রাষ্ট্রে পরিবারে নারী নির্যাতনবিরোধী সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে তরুণ ও পুরুষ সমাজকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা হচ্ছে নারী নির্যাতনবিরোধী সংগ্রামে এবং গ্রহণ করা হচ্ছে জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি। আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ নাগরিক সমাজকে নিয়ে সামাজিকভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে প্রতিরোধের আন্দোলন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে আইন সংস্কারের বিভিন্ন সুপারিশমালা পেশ করছে, নতুন আইন প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রামের আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। এর মাধ্যমে ঢাকা, রাঙ্গামাটি, রাজশাহী, সিলেট, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে মহিলা পরিষদ কাজ করছে। এছাড়া ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সঙ্গে মহিলা পরিষদ সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্যে নির্যাতনের শিকার নারীদের আইনগত পরামর্শ, তদন্ত, কাউন্সেলিং, সালিশি কার্যক্রম ছাড়াও মামলা পরিচালনা এবং মামলার রায় কার্যকর করার জন্য আন্দোলন করছে। এছাড়াও জনস্বার্থে মহিলা পরিষদ মামলা করে থাকে। উল্লেখ্য, এ বছরে সালিশির মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য ৮৯ লাখ ৮২ হাজার ৬০১ টাকা দেনমোহর আদায় করা সম্ভব হয়েছে। আন্দোলন উপপরিষদ : বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় সমঅংশীদারিত্বের লক্ষ্যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অধিকার ও সুযোগ আরও কার্যকর, ব্যাপক ও প্রসারিত করার দাবিতে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আন্দোলন করে আসছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবিতে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সভানেত্রী সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে স্মারকলিপি জমা দেয়। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবিতে চতুর্দশ সংশোধনী বিল ২০০০ সালে এবং ২০১৩ সালে ষোড়শ সংশোধনী হিসাবে সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়। সুস্থ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনীতিতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধের দাবিতে মহিলা পরিষদ পরিচালনা করে ধারাবাহিক আন্দোলন। জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ার দাবিতে নির্বাচন কমিশনের কাঠামো সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়ার মৌলিক সংস্কার, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করার দাবিতে জনমত গঠন ও আন্দোলন পরিচালনা করে। পাশাপাশি গণতন্ত্র ও সুশাসনের লক্ষ্যে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অব্যাহত আন্দোলন এবং অ্যাডভোকেসি-লবি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
আশির দশকের শুরু থেকেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জাতিসংঘ সনদ “নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ” (সিডও)-এর পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়নের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করার পাশাপাশি নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্যে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়নের দাবিতে মহিলা পরিষদ আন্দোলন করে চলছে। প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার উপপরিষদ : মহিলা পরিষদ বহুমাত্রিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে থাকে। মহিলা পরিষদ তিন ধরনের প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে। সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তত্ত্বগত প্রশিক্ষণ, সাংগঠনিক কাজ পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার লক্ষ্যে বাস্তব কাজের ধারা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও আইন বিষয়ক প্যারালিগ্যাল প্রশিক্ষণ। এছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে নারী আন্দোলন ও জাতিসংঘ সিডও সনদ নিয়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হয়।
২০১১ থেকে প্রশিক্ষণে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। চালু হয়েছে জেন্ডার উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক ত্রৈমাসিক সার্টিফিকেট কোর্স। বিভিন্ন উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংগঠন, গবেষক, ছাত্রছাত্রী এই সার্টিফিকেট কোর্সে অংশগ্রহণ করে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সিপিডি ও বিআইডিএসের গবেষকরা এবং নারী আন্দোলনের নেতারা এ কোর্সের ক্লাস পরিচালনা করেন। এ কোর্স পরিচালনার মধ্য দিয়ে মহিলা পরিষদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
মহিলা পরিষদ সংবাদপত্রের আধেয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে নারী নির্যাতন পরিস্থিতি নিয়ে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। বিষয়ভিত্তিক গবেষণাও পরিচালিত হয়। মহিলা পরিষদ একটি গ্রন্থাগার পরিচালনা করে। যেখানে নারী আন্দোলন ও গবেষণা, সামাজিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, মানবাধিকার আন্দোলন, সাহিত্য, প্রবন্ধ, জীবনী, স্মৃতিকথা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ রয়েছে। মহিলা পরিষদ গ্রন্থাগার রেফারেন্স উপকরণে সমৃদ্ধ। গবেষক, ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবীসহ অনেকেই এ রেফারেন্স সেবা গ্রহণ করে থাকেন।
রোকেয়া সদন উপপরিষদ : নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূল কাজের অবিচ্ছেদ্য কার্যক্রম হিসাবে ১৯৮৩ সাল থেকে পরিচালনা করা হয় রোকেয়া সদন। রোকেয়া সদনের কাজ হলো, নির্যাতনের শিকার নারীর শারীরিক ও মানসিক আঘাত নিরূপণ ও নিরাময়ের ব্যবস্থা করা। নির্যাতনের শিকার নারীর মনে সাহস সঞ্চার করে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা সৃষ্টি করা। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সব ধরনের সহায়তা প্রদান। পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান এবং ছবি আঁকা ও সংগীত প্রশিক্ষণ। বসবাসকারীদের জন্য স্বচ্ছন্দময়, সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও আনন্দময় পরিবেশ গড়ে তোলা।
প্রচার ও গণমাধ্যম উপপরিষদ : প্রচার ও গণমাধ্যম উপপরিষদের মাধ্যমে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গণমাধ্যমের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং সংগঠনের বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে তুলে ধরার পাশাপাশি সর্বক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণমাধ্যমের বর্ধিত কার্যকর ভূমিকা মনিটরিং করছে। নারীবিষয়ক ইস্যুতে মহিলা পরিষদসহ বৃহত্তর নারী সমাজের দাবি গণমাধ্যমে প্রতিফলিত করা, গণমাধ্যমে কর্মরত নারীর অবস্থা ও অবস্থান শক্তিশালী করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে গণমাধ্যম উপপরিষদ কাজ করে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা কর্মরত আছেন তাদের সঙ্গে নারীবিষয়ক বিভিন্ন ইস্যু, সমাজে নারীর ইতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরার জন্য মতবিনিময় ও আলোচনা সভা করে থাকে। গণমাধ্যম উপপরিষদ রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লক্ষ্যে গণমাধ্যমকে জেন্ডার সংবেদনশীল করে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছে। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী চেতনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় আলোচনা সভা করে। প্রকাশনা উপপরিষদ : বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ত্রৈমাসিক মুখপত্র মহিলা সমাচার ১৯৭২ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানমের সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে মহিলা পরিষদ জার্নাল। জার্নালে নারী আন্দোলনের বৈশ্বিক, জাতীয়, আঞ্চলিক, ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যিক ও চলমান যাবতীয় প্রসঙ্গ, সম্ভাবনা, সমস্যা, প্রশ্ন ও প্রত্যাশাসমূহ সম্পর্কে তাত্ত্বিক, তথ্যগত ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। মহিলা সমাচার ও মহিলা পরিষদ জার্নাল ছাড়া প্রকাশনা উপপরিষদ প্রকাশ করে থাকে সংগঠনের নানা প্রকাশনা। আন্তর্জাতিক উপপরিষদ : বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাউন্সিলের (ঊঈঙঝঙঈ) এনজিও পদমর্যাদাভুক্ত সংগঠন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্মসূচি, জাতিসংঘের মর্যাদাবিষয়ক কমিশনের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ও তথ্য আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সংগঠনের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। সংগঠনের অভ্যন্তরে নারীর মানবাধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন বৈশ্বিক উদ্যোগ এবং সাম্প্রতিক তথ্য সম্পর্কে সংগঠক, কর্মীদের জানার পরিধি বিস্তৃত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উপপরিষদ বৈশ্বিক নারীর মানবাধিকার ও ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার বৈশ্বিক উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রথম জাতিসংঘের সিডও সনদের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে এ দেশে সিডও বাস্তবায়ন আন্দোলনের সূচনা করে। জাতিসংঘ সিডো পলিসিতে নিয়মিত সিডও অবস্থার বিষয়ে ছায়া প্রতিবেদক/বিকল্প প্রতিবেদন প্রেরণ করে। এ প্রতিবেদন কখনো এককভাবে, কখনো যৌথভাবে প্রেরণ করা হয়।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপপরিষদ : সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষা উপপরিষদের উদ্যোগে নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে অবৈতনিক বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করা হতো। পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপপরিষদের উদ্যোগে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা এবং নিজস্ব সাংগঠনিক উদ্যোগে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা দাবিতে মহিলা পরিষদ শিক্ষা এবং পাঠ্যক্রমে ও পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ে ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে স্মারকলিপি প্রদান করে থাকে। প্রদত্ত শিক্ষানীতি বিষয়ে মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে সুপারিশমালা প্রদান করা হয়। এছাড়া স্বাস্থ্য উপপরিষদ, সমাজকল্যাণ উপপরিষদ ও পরিবেশ উপপরিষদ রয়েছে।