গবেষণা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়
আবদুল্লা আল মাসুদ | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)। উদ্ভাবন, গবেষণা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলছে শাবিপ্রবি। দেশের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তৈরি করেছে অনন্য অবস্থান।
১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সিলেটবাসীর আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে প্রায় ৭০ বছর। পরের বছর ২৫ আগস্ট শাবিপ্রবির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। শাবিপ্রবি প্রতিষ্ঠায় যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন সিলেটের কৃতী সন্তান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।
২৮ বছরের ইতিবৃত্তের সংক্ষেপণ : সিলেট শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে কুমারগাঁওয়ে ৩২০ একর জমির ওপর অবস্থিত শাবিপ্রবি। ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩টি বিভাগ, ১৩ জন শিক্ষক ও ২০৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়টি। অবকাঠামোগত দিক দিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুটি প্রশাসনিক ভবন, ছয়টি অ্যাকাডেমিক ভবন, তিনটি ছাত্র হল, দুটি ছাত্রী হল, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ইউনিভার্সিটি ক্লাব, ইউনিভার্সিটি সেন্টারসহ কয়েকটি ভবন রয়েছে। বর্তমানে ছয়টি অনুষদের অধীনে ২৮টি বিভাগে সাড়ে পাঁচশ শিক্ষক এবং ১০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া আরেকটি অনুষদে রয়েছে পাঁচটি অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজ, যেখানে পাঁচ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যয়ন করছেন। প্রতিষ্ঠার পর পেরিয়েছে ২৮টি বসন্ত, চলছে ২৯তম বসন্ত। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আলোকোজ্জ্বল দীপ্তি ছড়াচ্ছে দেশ-বিদেশে। উদ্ভাবন, গবেষণা ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুক্ত সংস্কৃতির বাঁধনে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচিতি লাভ করেছে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে।
পথচলায় হাল ধরেছিলেন প্রথম উপাচার্য ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী যিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী, ভাষাসৈনিক, গবেষক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, দক্ষ প্রশাসক ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন। ১৯৮৯ সালের ১ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকতা ছেড়ে শাবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন। কর্মরত ছিলেন ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। যোগ দেওয়ার পর তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যান। মাত্র দেড় বছরের মধ্যে তার অক্লান্ত পরিশ্রম, সুদৃঢ় নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতার কারণে শাবিপ্রবি একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনকার সময়ে কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম চালু হয়। অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো স্বনামধন্য শিক্ষকদের সমাবেশ ঘটিয়ে শাবিপ্রবিকে আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে নানা পদক্ষেপ নেন। ফলে শুরু থেকেই শাবিপ্রবি দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে। এর ধারাবাহিকতায় উদ্ভাবন, গবেষণা ও সাফল্যে ইতিমধ্যে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে শাবিপ্রবি।
শাবিপ্রবির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যার নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়, তিনি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। একাধারে তিনি লেখক, পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ। এ ধরনের অনেক বিশেষণে তাকে আমরা জানি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে নিজেকে শাবিপ্রবির শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের পথচলা ১৯৯৩ সালে। প্রথম উপাচার্য সিদ্ধান্ত নিলেন বিভাগটিকে সমৃদ্ধ করতে। বেছে নেন ড. জাফর ইকবালকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে তাকে বিশেষ অনুরোধ করেন উপাচার্য। তাতে সাড়া দিলেন ড. জাফর ইকবাল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাকরি ছেড়ে ১৯৯৪ সালের ৪ ডিসেম্বর এখানে যোগ দেন। উপাচার্য দায়িত্ব দেন সিএসই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। জেলা শহরে স্থাপিত নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত একটি বিভাগকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজতর ছিল না। শুধু ড. জাফর ইকবালের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছে। তিনি শিক্ষকস্বল্পতা, অবকাঠামোগত-স্বল্পতা, অর্থের অভাবসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে সিএসই বিভাগকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে সিএসই দেশের একটি উল্লেখযোগ্য বিভাগে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য সেমিস্টার সিস্টেম চালু করাসহ কম্পিউটারের ওপর কমপক্ষে দুটি কোর্স বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ গ্রহণ উল্লেখযোগ্য।
সিএসই বিভাগের পাশাপাশি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবট, ড্রোন, সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা, মোবাইল ফোনে ভর্তিপ্রক্রিয়া, ই-পেমেন্টসহ তথ্যপ্রযুক্তির শাখায় নানা উদ্ভাবনে তার অবদান অনস্বীকার্য। ২৫ বছরের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতার জীবন শেষে ২০১৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
নয়নাভিরাম সবুজ ক্যাম্পাস : চারদিকে টিলাবেষ্টিত সুশোভিত, শ্যামলিয়া ঘেরা নয়নাভিরাম সবুজ ক্যাম্পাস। প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চারদিকে তাকালে ক্যাম্পাসের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সবার দৃষ্টি কাড়ে। মূল ফটকে প্রবেশের পরই দীর্ঘ এক কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিলোরোডের দুদিকে রয়েছে স্বচ্ছ পানির লেক। এক কিলোমিটার রাস্তা পার হলেই দেখা যায় গোল চত্বরের বিশাল ফুলবাগান। রয়েছে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার। টিলার ওপরে নির্মিত দেশের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত এই শহীদ মিনারে উঠতে প্রায় ১০০ সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। এ ছাড়া প্রায় সব কটি আবাসিক হলের পাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন উঁচু-নিচু টিলা ও পাহাড়। চায়ের দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে চা বাগান থাকবে না তা কি হয়? ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের প্রচেষ্টায় সৈয়দ মুজতবা আলী হলের পেছনের টিলায় একখণ্ড চা বাগান গড়ে উঠেছে, যা পূর্ণতা দিয়েছে ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে।
উদ্ভাবন ও গবেষণায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা : প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন জটিল বিষয়কে সহজ করে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইতিমধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বল্পসময়ের ব্যবধানে দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গনে তার দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
ক্যাম্পাসভিত্তিক ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক : দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৯৯৯ সালে শাবিপ্রবিতে প্রথম ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়। ২০১০ সাল থেকে ছাত্রীদের আবাসিক হল এবং পরে ছাত্রদের তিনটি আবাসিক হলে ওয়াইফাই ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়। বর্তমানে শিক্ষাভবন, লাইব্রেরি ভবন, কেন্দ্রীয় মিলনায়তন, আবাসিক হলসহ পুরো ক্যাম্পাস রয়েছে এর আওতায়।
মুঠোফোনে ভর্তি প্রক্রিয়া : একটা সময় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভর্তির আবেদন ফরম সংগ্রহ করতেন। এই আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে আবার লাইনে দাঁড়াতে হতো। সেই ভোগান্তি রোধে ২০০৯ সালে দেশে শাবিপ্রবিই প্রথম মুঠোফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করে। মূলত শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমাতে এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে।
বিশ্বের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ : শুরুটা ২০০৯ সালে, সিএসই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী একটি গবেষণা প্রকল্পের প্রজেক্ট পরিকল্পনা হাতে নেন। পরিকল্পনায় পিপীলিকা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারা। তারপর ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল, ১১ জন ডেভেলপার সক্ষম হন বিশ্বের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা তৈরি করতে। গ্রামীণফোন আইটি বিভাগের সহযোগিতায় পিপীলিকার প্রকল্প পরিচালনায় ছিলেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মুখ্য গবেষক ও টিম লিডার হিসেবে কাজ করেছেন মো. রুহুল আমীন সজীব। ‘পিপীলিকা’ সার্চ ইঞ্জিন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তথ্য অনুসন্ধান করতে পারে। বর্তমানে সংবাদ পাঠ, লাইব্রেরি, কেনাকাটা, জব সার্চ, বাংলা বানান সংশোধনী ও শব্দকল্প ইত্যাদি যুক্ত করে পিপীলিকাকে আরও সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এখন গবেষক ও ডেভেলপার হিসেবে কাজ করছেন ছয়জন। বাংলাদেশের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা ডটকম অনলাইনে বাংলা ভাষার প্ল্যাটফর্ম মজবুত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলায় কথা বলতে পারে রোবট ‘রিবো’ : সময়টা ২০১১ সাল। অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও শিক্ষার্থী নওশাদ সজীব উদ্যোগ নিলেন একটি সংগঠন চালুর। যার উদ্দেশ্য থাকবে রোবট নিয়ে গবেষণা। তারপর ১১ জনের একটি দল রোবট নিয়ে ছোট ছোট বিভিন্ন কাজ শুরু করে। ২০১৩ সালে রোবোটিকস নিয়ে কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি ২০১৫ সালে তাদের বার্ষিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে একটি মানবসদৃশ রোবট বানানোর অনুরোধ করে রোবো সাস্টকে। এ জন্য এক লাখ টাকার অনুদান দেয় তারা। তারপর শুরু হলো রোবট ‘রিবো’ তৈরির কাজ। শেষ হয় ২০১৫ সালে। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সায়েন্স ফিকশন ফেস্টিভ্যালে প্রথম জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হয় ‘রিবো’।
নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণেই অন্যান্য রোবট থেকে এটি ব্যতিক্রম। এটি মানুষের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পারে, বাংলায় লিখতেও সক্ষম। চোখ, চোখের পাতা ও ঠোঁট নাড়াতে পারে। বিভিন্ন ধরনের মুখভঙ্গি করতে পারে। বিশেষ দিক হচ্ছে, এটি মানুষের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করা এবং নাচতেও পারে।
হাঁটতে শিখেছে ‘রিবো’র উত্তরসূরি ‘লি’ ‘লি’র আগমন ‘রিবো’র উত্তরসূরি হিসেবে। ‘লি’ কথা বলে বাংলায়, হাঁটতে পারে মানুষের মতোই। হাত-পা নাড়ানোসহ নানা অঙ্গভঙ্গিও করতে পারে। বাংলাদেশ ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে সে। রোবটটিতে ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শেখানো হয়েছে গান, কবিতা ইত্যাদি। সাধারণত বাসা, বাড়ি-অফিসে ব্যবহার করা হয় এমন সব ভাষাও শেখানো হচ্ছে ‘লি’কে। ফেস রিকগনিশনের মাধ্যমে মানুষকে মনে রাখতে পারে সে। হ্যান্ডশেক, নাচসহ বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভঙ্গিও করতে পারে। মুখে মানুষের মতো চোখ, চোখের পাতা, ঠোঁট প্রভৃতির মাধ্যমে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনও করতে পারে। হারিয়ে যাওয়া একটি বাংলা স্বরবর্ণ হলো ‘লি’, যা দেখতে ৯-এর মতো ছিল। ওই অক্ষরটির নামানুসারেই রোবটটির নামকরণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্রাইডে ল্যাব’ নামে তরুণ গবেষক দল ২০১৯ সালে এই রোববটি তৈরি করে। ওই বছরের ২০ এপ্রিল রোবটটি সবার সামনে উন্মুক্ত করা হয়। এদিন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক রোবটটি উদ্বোধন করেন। চার ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতা ও ৩০ কেজি ওজনের এই রোবটটি তৈরি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম, আর্কিটেকচার বিভাগের মেহেদী হাসান রূপক, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মোহাম্মদ সামিউল হাসান ও জিনিয়া সুলতানা জ্যোতি। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সিএসই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রভাষক নওশাদ সজীব।
নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে বিশ্বসেরা : ‘নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-২০১৮’-এ ‘বেস্ট ইউজ অব ডেটা’ ক্যাটাগরিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে শাবিপ্রবির ‘টিম অলিক’। নাসার কোনো প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি টিম হিসেবে এ অর্জন এটাই প্রথম। বিশ্বের ৭৯টি দেশের বাছাই করা ২ হাজার ৭২৯টি টিমের সঙ্গে লড়াই করে চ্যাম্পিয়ন হয় ‘টিম অলিক’।
‘সাস্ট ভার্চুয়াল ট্যুর’ নামের একটি অ্যাপসের সাহায্যে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির মাধ্যমে কেউ শাবিপ্রবিতে না এসেও বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা নিতে পারেন।
২০১৮ সালের ১৯-২১ অক্টোবর, প্রতিযোগিতার মূল পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় পৃথিবী ও মহাকাশবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতায় ছয়টি ক্যাটাগরির মধ্যে ‘বেস্ট ইউজ অব ডেটা’ ক্যাটাগরিতে অংশগ্রহণ করে ‘টিম অলিক’। এই ক্যাটাগরিতে অংশ নেয় বিশ্বের সর্বমোট ৭৯টি দেশ থেকে বাছাই করা ২ হাজার ৭২৯টি টিম। নাসা প্রদত্ত ডেটা ব্যবহার করে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি অ্যাপ ‘লুনার ভিআর’ তৈরি করতে বলা হয়। এতে শীর্ষ চারে স্থান করে নেয় ‘টিম অলিক’। সেখান থেকে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী রাউন্ডে চ্যাম্পিয়ন হয় ‘টিম অলিক’।
বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বকারী দল ‘টিম অলিক’র সদস্যরা হলেন শাবির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (মেন্টর), বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী এস এম রাফি আদনান, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী কাজী মাইনুল ইসলাম, একই বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী আবু সাদিক মাহদি ও একই বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান।
দ্রুত ক্যানসার শনাক্তের সম্ভাবনার নতুন দ্বার : রক্তের নমুনা পরীক্ষা করার মাধ্যমে ক্যানসার শনাক্তকরণ পদ্ধতি উদ্ভাবনেও রয়েছে শাবিপ্রবির সাফল্য। এর ফলে দ্রুত ক্যানসার শনাক্তের সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। অল্প খরচে ও কম সময়ে ‘ননলিনিয়ার অপটিকস’ নামের উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিতে রক্তের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে মাত্র ১০ থেকে ২০ মিনিটেই ক্যানসার শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এই পদ্ধতিতে ক্যানসার শনাক্তের জন্য সংগ্রহ করা রক্তের নমুনার (সেরাম) মধ্যে উচ্চক্ষমতার লেজার-রশ্মি ফেলে রক্তে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না তা দেখা হবে। রক্তে পরিবর্তনের বিষয়টি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ধরা পড়বে এবং ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে ফলাফল পাওয়া যাবে। এ পরীক্ষার জন্য সময় লাগবে ৫ থেকে ১০ মিনিট। খরচ হবে ৫০০ টাকারও কম। রক্ত থেকে লাল অংশ বাদ দিয়ে কেবল সেরাম ডিভাইসে দিলে প্যারামিটারে এর মান জানা যাবে। আর সেটা থেকেই বোঝা যাবে শরীরে ক্যানসার আছে কী নেই।
হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের (হেকেপ) আওতায় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকের নেতৃত্বে একদল গবেষক ক্যানসার শনাক্তকরণের এ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। গবেষক দলের অন্য সদস্যরা হলেন প্রফেসর ড. শরীফ মো. শরাফ উদ্দিন, মনজ কান্তি বিশ্বাস ও এনামুল হক।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একুশে বাংলা কিবোর্ড : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ‘একুশে বাংলা কিবোর্ড’ নিজেই বুঝে ফেলবে গ্রাহক কী লিখতে চাইছেন। এটাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজনের পাশাপাশি দ্রুত টাইপিং ও স্পর্শ করে লেখার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে টাইপ না জানলেও যে কেউ সহজেই বাংলা টাইপিং শিখতে পারা যায় এর মাধ্যমে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বাংলা কিবোর্ডের উদ্ভাবন করে শাবিপ্রবির একদল গবেষক। ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী এবং ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী উ খ্যই নু ও রণিত দেবনাথ আকাশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংবলিত বাংলা কিবোর্ড তৈরির প্রকল্প শুরু করেন। বর্তমানে কিবোর্ডে প্রায় ১২০টি ইমোজি রয়েছে এবং পরবর্তী সময় আরও ইমোজি বাড়াতে কাজ চলছে। উদ্ভাবক টিমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে কিবোর্ডে ভয়েস সার্চ, বিভিন্ন ধরনের ইমোজি এবং স্টিকার, আইওএস ভার্সন রিলিজ ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে সাজেশনযুক্ত করার কাজ চলছে।
ট্র্যাকিং ডিভাইসে জানা যাবে যানবাহনের অবস্থান : ২০১৩ সালে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে ট্র্যাকিং ডিভাইস তৈরি করে শাবিপ্রবির একদল গবেষক। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই ট্র্যাকিং ডিভাইস তৈরির ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই ডিভাইস সংযোজনের ফলে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে নৌযানের অবস্থান জানা যাবে খুব সহজেই। আমাদের দেশে প্রায় সময়ই দুর্ঘটনার পর নৌযানের অবস্থান শনাক্ত করতে বিলম্ব হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্ঘটনাকবলিত নৌযানের সঠিক অবস্থান দ্রুত জানা যাবে। আবার এই ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করা যায় যানবাহনেও। গবেষক দলের অন্য সদ্যরা হলেন সিএসই বিভাগের বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমিন সজীব, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিল ও সিএসই বিভাগের নওশাদ।
নিজেদের ড্রোন দিয়ে পাখির চোখে ক্যাম্পাস দেখা : ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি, ড. জাফর ইকবালের তত্ত্বাবধানে একদল গবেষক প্রথম বাংলাদেশে মানুষবিহীন বিমান (ড্রোন) তৈরি করে। সফলভাবে এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নও সম্পন্ন করেন তারা। ওই দিন দুপুরে ক্যাম্পাসের আকাশে এই দৃশ্য উপভোগ করে পুরো ক্যাম্পাস। ড্রোনটি মূলত দেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কাজে ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। গবেষক দলটির প্রধান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিল। দলে আরও রয়েছেন নাবিল ছাড়াও একই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রবি কর্মকার এবং মারুফ হোসেন রাহাত। এ ছাড়া নিজস্ব ডোমেইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ই-মেইল সার্ভিস চালু, অনলাইনে ট্রান্সক্রিপ্ট উত্তোলনের সুবিধা, ডিজিটাল উপস্থিতি পদ্ধতি চালু প্রভৃতিতে শাবিপ্রবিই প্রথম। দেশের তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে সাফল্যে অবদানস্বরূপ ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর আইসিটি অ্যাওয়ার্ড অর্জন উল্লেখযোগ্য সাফল্য। সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে প্রথমবারের মতো দেশসেরা ‘ডিজিটাল ক্যাম্পাস অ্যাওয়ার্ড’ অর্জনও উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
ভিনদেশে আলো ছড়াচ্ছেন গ্র্যাজুয়েটরা : বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা। গুগল-মাইক্রোসফটসহ বিখ্যাত বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষকতা ও গবেষণা করছেন আরও অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। সিএসই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মারুফ মনিরুজ্জামান ও শাহাদাত হোসাইন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছেন মাইক্রোসফটে। গুগলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন সৈয়দ শাহরিয়ার মঞ্জুর, ফরহাদ আহমেদ প্রমুখ। ই-কমার্স সাইট আমাজনের সঙ্গে আছেন শাবিপ্রবির সাবেক ছাত্র দিবাকর সামন্তসহ অনেকেই।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ব্রান্সউইকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন অর্থনীতি পঞ্চম ব্যাচের মুর্শেদ চৌধুরী। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও ক্যানসার কোষ নিয়ে গবেষণা করছেন রসায়ন বিভাগের স্নাতক মুহম্মদ জহুরুল আলম সিদ্দিকী। তিনি বিশ্বে প্রথম ক্যানসার শনাক্তকরণের যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন সিএসই বিভাগের স্নাতক আলাউদ্দিন ভূঁইয়া। নর্থ ক্যারোলিনার উইন্সটন-সালেম স্টেট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক সিএসই বিভাগের প্রথম ব্যাচের মোহাম্মদ মুজতবা ফুয়াদ। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন দেবযানী দেব। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে সিএসই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাবিপ্রবির সাবেক ছাত্র এম শাহরিয়ার হোসাইন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্নাতক আয়েশা আরেফিন টুম্পা যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম ফুসফুস তৈরির গবেষণা দলে কাজ করছেন। সিএসই স্নাতক ওমর শেহাব সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আছেন ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড বাল্টিমোর কাউন্টিতে। সমাজবিজ্ঞানের স্নাতক আমিনুল ইসলাম সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা করছেন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন সিএসই বিভাগের স্নাতক খন্দকার ইন্তেনাম উনায়েছ আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হেভেনে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আছেন সিএসই স্নাতক ইফতেখার ইবনে বাসিত। ইউনাইটেড আরব এমিরেটস ইউনিভার্সিটিতে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন শাবিপ্রবির সাবেক ছাত্র রেজাউল চৌধুরীসহ অনেক শিক্ষার্থী। এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কাজের মাধ্যমে মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন শাবিপ্রবির গ্র্যাজুয়েটরা।
বিশ্বের দীর্ঘতম পথচিত্র : ২০১৩ সালের মার্চে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাবিপ্রবিতে উন্মোচিত হয় বিশ্বের দীর্ঘতম পথচিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে শাহপরান হল পর্যন্ত দীর্ঘ দুই কিলোমিটারব্যাপী রাস্তায় অঙ্কিত আল্পনায় উঠে আসে ভাষা আন্দোলন থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাঙালির বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
সর্বত্র ছড়িয়ে আছে চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের চিহ্ন শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চিহ্ন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘চেতনা ৭১’ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার মনে করিয়ে দেয় মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলো।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিকে সংরক্ষণ ও তার আদর্শের প্রতীককে ধারণ করার জন্য শাবিপ্রবিতে নির্মাণ করা হয়েছে তার প্রতিকৃতি। প্রকৃতির অরণ্যে ঘেরা ক্যাম্পাসের গোলচত্বর ও প্রশাসনিক ভবন-২-এর মধ্যে নির্মিত এ প্রতিকৃতির চারদিকে ঘিরে রেখেছে কদম, কৃষ্ণচূড়া, কড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট এ প্রতিকৃতি উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান।
চেতনা-৭১ : মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এবং চেতনাকে ধারণ করতে ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয়েছে ভাস্কর্য ‘চেতনা ৭১’। ভাস্কর্যটিতে একই সঙ্গে ধারণ করা হয়েছে বর্তমান প্রজন্মের মডেল আর দেশপ্রেম। ভাস্কর্যটিতে একটি ছেলে এক হাতে উঁচু করে ধরেছে বাংলাদেশের পতাকা। আর তারই পাশে সহাবস্থানে একটি মেয়ের হাতে একটি বই, যা নির্দেশ করে বাংলাদেশের সংবিধান। ‘চেতনা ৭১’ দেখতে যেমন আধুনিক, তেমনি বর্তমান প্রজন্মের দেশপ্রেমকে উপস্থাপন করে প্রতীকীরূপে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে এবং প্রথম ব্যাচের (১৯৯০-৯১) শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তায় ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। ভাস্কর্যটির নকশা করেন স্থপতি মোবারক হোসেন নৃপল।
শহীদ মিনার : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম স্থাপত্যশৈলী শহীদ মিনার। ২০০১ সালের তৎকালীন স্পিকার প্রয়াত হুমায়ুন রশীদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ৫৮ ফুট উচ্চতার একটি টিলায় ৬ হাজার ৮৮৬ বর্গফুট জায়গা জুড়ে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ৭৮ ফুট। অতিক্রম করতে হয় শতাধিক সিঁড়ি। শহীদ মিনার থেকেই দেখা যায় পুরো ক্যাম্পাসকে।
মুক্তিযুদ্ধ কর্নার : তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের চতুর্থতলায় নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই, ভিডিওসিডি, তথ্যচিত্র, দলিল, আলোকচিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে লেখা চিঠিপত্র, দেশি-বিদেশি লেখক ও সাংবাদিকদের লেখা দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে এখানে।
বছরব্যাপী চলে সহ-শিক্ষামূলক কার্যক্রম : অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক,
সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী, বিতর্ক, ক্যারিয়ার, বিজ্ঞান ও ক্রীড়াভিত্তিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রক্টর অফিস কর্তৃক অনুমোদিত সংগঠনের সংখ্যা ৫৫টি।
থিয়েটার সাস্ট : ‘নাটক নির্মাণ করে যৌবন, নাটক আনবেই অবিনাশী প্লাবন’ সেøাগানকে সামনে রেখে ১৯৯৭ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে গতিশীল রাখতে সংগঠনটি এ পর্যন্ত এই ৩৪টি প্রযোজনার মধ্য দিয়ে ১২৪টি প্রদর্শনী সম্পন্ন করেছে।
দিক থিয়েটার : ‘নাটকে সাম্যের আন্দোলন, জীবনের ভাষায় মুক্তির অন্বেষণ’ সেøাগানে ১৯৯৯ সালের ১৮ আগস্ট ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে নাট্যসংগঠন দিক থিয়েটার। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে নাটকের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছে সংগঠনটি।
মাভৈ আবৃত্তি সংসদ : ‘শেকল ভাঙার ছন্দ মোরা, দেয়াল ভাঙার উচ্চারণ’ সেøাগানে ১৯৯৮ সালের ১৫ নভেম্বর ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে আবৃত্তিবিষয়ক এই সংগঠনটি। ক্যাম্পাসে প্রতিটি জাতীয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব, চৈত্রসংক্রান্তির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট বিভাগে আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন এর সদস্যরা।
আজ মুক্তমঞ্চ : একমাত্র মূকাভিনয় সংগঠন আজ মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালে। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে মূকাভিনয়ের পাশাপাশি আয়োজন করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবের।
শাহজালাল ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি : ‘যুক্তির স্পন্দনে ভাঙ্গুক বা গড়–ক এই বিশ্ব’ স্লোগানে ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিতর্কের বিকাশে সফলতার সঙ্গে সংগঠনটি জাতীয় বিতর্ক, আন্তঃবিভাগ বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সিলেট বিভাগীয় বিতর্ক, ছাত্র-শিক্ষক বিতর্ক, আঞ্চলিক রম্য বিতর্ক, স্কুল বিতর্ক, কলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে।
সাস্ট স্কুল অব ডিবেট : ‘তবু উড়বে ফিনিক্সি যুক্তির দ্রোহী আকাশে’ স্লোগানে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে জাতীয়, আন্তঃবিভাগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আয়োজন ও অংশগ্রহণ করছে সংগঠনটি।
স্বপ্নোত্থান : দ্বীপ শিখা হাতে স্বপ্নের পথে’ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১০ সালের ১ আগস্ট পথচলা শুরু করে সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বপ্নোত্থান সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং দুঃখী ও অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে আসছে। এ ছাড়া একঝাঁক মেধাবীর সমন্বয়ে ভোলানন্দে নৈশ বিদ্যালয় পরিচালনা করে স্বপ্নবান।
শাহজালাল ইউনিভার্সিটি স্পিকার ক্লাব : কাম হেয়ার, স্পিক বেটার’ সেøাগান নিয়ে ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিকশিত ক্যারিয়ার গঠনে দিকনির্দেশনা দিতে কাজ করছে সংগঠনটি।
গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি : ‘মানবতার জন্য শেখা’ স্লোগান নিয়ে ১১ জানুয়ারি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে জনসচেতনতার জন্য সেমিনার, কর্মশালা, পরিবেশবিষয়ক গবেষণা, পরিবেশবিষয়ক পাঠচক্র, পাখি দেখা, বৃক্ষরোপণ, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গায় বেড়াতে যাওয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত এ সংগঠনের সদস্যরা।
স্পোর্টস সাস্ট : ‘জীবন গঠনের জন্য প্রতিযোগিতা’ স্লোগানে ২০০৫ সালের এপ্রিলে ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। বছরব্যাপী ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ফুটবল চ্যাম্পিয়নস লিগসহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার করে সংগঠনের সদস্যরা। এ ছাড়া রিম, নোঙর, কিন, সাস্ট সাহিত্য সংসদ, শিকড়, বাইনারি, বিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসা, রোবো সাস্ট, সাস্ট সায়েন্স অ্যারেনা, বিএনসিসি প্রভৃতি সংগঠনের কার্যক্রমে বছরব্যাপী মুখর থাকে ক্যাম্পাস। সংকট আর সমস্যার বৃত্তায়ন এত অর্জনের মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। ক্লাসরুম সংকট, পরিবহন সংকট এর মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিশ^বিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধা অনেক সীমিত। দশ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র পাঁচটি আবাসিক হল, যার আসনসংখ্যা মাত্র দুই হাজার। তবু এসব সংকট কাটিয়ে খুব দ্রুত বিশবর প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে শাবিপ্রবি এমনটাই প্রত্যাশা সবার। উপাচার্যের স্বপ্ন আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ স্বপ্ন দেখছেন শাবিপ্রবিকে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় শাবিপ্রবি। এখানের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়ান্ট কোম্পানিগুলোতে কর্মরত আছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তিনি বলেন, শিক্ষা, গবেষণা ও অবকাঠামোগত দিক দিয়ে শাবিপ্রবিকে প্রথম সারির এবং আন্তর্জাতিক মানের বিশববিদ্যালয়ে পরিণত করতে আমরা কাজ করছি এবং করে দেখাব।
এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এবং অ্যাকাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণসহ ১৭টি প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যে ৯৫০ কোটি টাকার বাজেট পাস করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। আশা করি কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা পরিবর্তন করে দিতে পারব।
শেয়ার করুন
আবদুল্লা আল মাসুদ | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)। উদ্ভাবন, গবেষণা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলছে শাবিপ্রবি। দেশের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তৈরি করেছে অনন্য অবস্থান। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সিলেটবাসীর আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে প্রায় ৭০ বছর। পরের বছর ২৫ আগস্ট শাবিপ্রবির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। শাবিপ্রবি প্রতিষ্ঠায় যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন সিলেটের কৃতী সন্তান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। ২৮ বছরের ইতিবৃত্তের সংক্ষেপণ : সিলেট শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে কুমারগাঁওয়ে ৩২০ একর জমির ওপর অবস্থিত শাবিপ্রবি। ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩টি বিভাগ, ১৩ জন শিক্ষক ও ২০৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়টি। অবকাঠামোগত দিক দিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুটি প্রশাসনিক ভবন, ছয়টি অ্যাকাডেমিক ভবন, তিনটি ছাত্র হল, দুটি ছাত্রী হল, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ইউনিভার্সিটি ক্লাব, ইউনিভার্সিটি সেন্টারসহ কয়েকটি ভবন রয়েছে। বর্তমানে ছয়টি অনুষদের অধীনে ২৮টি বিভাগে সাড়ে পাঁচশ শিক্ষক এবং ১০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া আরেকটি অনুষদে রয়েছে পাঁচটি অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজ, যেখানে পাঁচ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যয়ন করছেন। প্রতিষ্ঠার পর পেরিয়েছে ২৮টি বসন্ত, চলছে ২৯তম বসন্ত। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আলোকোজ্জ্বল দীপ্তি ছড়াচ্ছে দেশ-বিদেশে। উদ্ভাবন, গবেষণা ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুক্ত সংস্কৃতির বাঁধনে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচিতি লাভ করেছে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। পথচলায় হাল ধরেছিলেন প্রথম উপাচার্য ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী যিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী, ভাষাসৈনিক, গবেষক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, দক্ষ প্রশাসক ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন। ১৯৮৯ সালের ১ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকতা ছেড়ে শাবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন। কর্মরত ছিলেন ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। যোগ দেওয়ার পর তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যান। মাত্র দেড় বছরের মধ্যে তার অক্লান্ত পরিশ্রম, সুদৃঢ় নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতার কারণে শাবিপ্রবি একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনকার সময়ে কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম চালু হয়। অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো স্বনামধন্য শিক্ষকদের সমাবেশ ঘটিয়ে শাবিপ্রবিকে আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে নানা পদক্ষেপ নেন। ফলে শুরু থেকেই শাবিপ্রবি দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে। এর ধারাবাহিকতায় উদ্ভাবন, গবেষণা ও সাফল্যে ইতিমধ্যে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে শাবিপ্রবি। শাবিপ্রবির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যার নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়, তিনি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। একাধারে তিনি লেখক, পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ। এ ধরনের অনেক বিশেষণে তাকে আমরা জানি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে নিজেকে শাবিপ্রবির শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের পথচলা ১৯৯৩ সালে। প্রথম উপাচার্য সিদ্ধান্ত নিলেন বিভাগটিকে সমৃদ্ধ করতে। বেছে নেন ড. জাফর ইকবালকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে তাকে বিশেষ অনুরোধ করেন উপাচার্য। তাতে সাড়া দিলেন ড. জাফর ইকবাল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাকরি ছেড়ে ১৯৯৪ সালের ৪ ডিসেম্বর এখানে যোগ দেন। উপাচার্য দায়িত্ব দেন সিএসই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। জেলা শহরে স্থাপিত নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত একটি বিভাগকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজতর ছিল না। শুধু ড. জাফর ইকবালের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছে। তিনি শিক্ষকস্বল্পতা, অবকাঠামোগত-স্বল্পতা, অর্থের অভাবসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে সিএসই বিভাগকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে সিএসই দেশের একটি উল্লেখযোগ্য বিভাগে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য সেমিস্টার সিস্টেম চালু করাসহ কম্পিউটারের ওপর কমপক্ষে দুটি কোর্স বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ গ্রহণ উল্লেখযোগ্য। সিএসই বিভাগের পাশাপাশি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবট, ড্রোন, সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা, মোবাইল ফোনে ভর্তিপ্রক্রিয়া, ই-পেমেন্টসহ তথ্যপ্রযুক্তির শাখায় নানা উদ্ভাবনে তার অবদান অনস্বীকার্য। ২৫ বছরের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতার জীবন শেষে ২০১৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। নয়নাভিরাম সবুজ ক্যাম্পাস : চারদিকে টিলাবেষ্টিত সুশোভিত, শ্যামলিয়া ঘেরা নয়নাভিরাম সবুজ ক্যাম্পাস। প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চারদিকে তাকালে ক্যাম্পাসের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সবার দৃষ্টি কাড়ে। মূল ফটকে প্রবেশের পরই দীর্ঘ এক কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিলোরোডের দুদিকে রয়েছে স্বচ্ছ পানির লেক। এক কিলোমিটার রাস্তা পার হলেই দেখা যায় গোল চত্বরের বিশাল ফুলবাগান। রয়েছে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার। টিলার ওপরে নির্মিত দেশের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত এই শহীদ মিনারে উঠতে প্রায় ১০০ সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। এ ছাড়া প্রায় সব কটি আবাসিক হলের পাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন উঁচু-নিচু টিলা ও পাহাড়। চায়ের দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে চা বাগান থাকবে না তা কি হয়? ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের প্রচেষ্টায় সৈয়দ মুজতবা আলী হলের পেছনের টিলায় একখণ্ড চা বাগান গড়ে উঠেছে, যা পূর্ণতা দিয়েছে ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। উদ্ভাবন ও গবেষণায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা : প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন জটিল বিষয়কে সহজ করে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইতিমধ্যে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বল্পসময়ের ব্যবধানে দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গনে তার দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ক্যাম্পাসভিত্তিক ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক : দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৯৯৯ সালে শাবিপ্রবিতে প্রথম ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়। ২০১০ সাল থেকে ছাত্রীদের আবাসিক হল এবং পরে ছাত্রদের তিনটি আবাসিক হলে ওয়াইফাই ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়। বর্তমানে শিক্ষাভবন, লাইব্রেরি ভবন, কেন্দ্রীয় মিলনায়তন, আবাসিক হলসহ পুরো ক্যাম্পাস রয়েছে এর আওতায়। মুঠোফোনে ভর্তি প্রক্রিয়া : একটা সময় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভর্তির আবেদন ফরম সংগ্রহ করতেন। এই আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে আবার লাইনে দাঁড়াতে হতো। সেই ভোগান্তি রোধে ২০০৯ সালে দেশে শাবিপ্রবিই প্রথম মুঠোফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করে। মূলত শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমাতে এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। বিশ্বের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ : শুরুটা ২০০৯ সালে, সিএসই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী একটি গবেষণা প্রকল্পের প্রজেক্ট পরিকল্পনা হাতে নেন। পরিকল্পনায় পিপীলিকা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারা। তারপর ২০১৩ সালের ১৩ এপ্রিল, ১১ জন ডেভেলপার সক্ষম হন বিশ্বের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা তৈরি করতে। গ্রামীণফোন আইটি বিভাগের সহযোগিতায় পিপীলিকার প্রকল্প পরিচালনায় ছিলেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মুখ্য গবেষক ও টিম লিডার হিসেবে কাজ করেছেন মো. রুহুল আমীন সজীব। ‘পিপীলিকা’ সার্চ ইঞ্জিন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তথ্য অনুসন্ধান করতে পারে। বর্তমানে সংবাদ পাঠ, লাইব্রেরি, কেনাকাটা, জব সার্চ, বাংলা বানান সংশোধনী ও শব্দকল্প ইত্যাদি যুক্ত করে পিপীলিকাকে আরও সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এখন গবেষক ও ডেভেলপার হিসেবে কাজ করছেন ছয়জন। বাংলাদেশের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা ডটকম অনলাইনে বাংলা ভাষার প্ল্যাটফর্ম মজবুত করতে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলায় কথা বলতে পারে রোবট ‘রিবো’ : সময়টা ২০১১ সাল। অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও শিক্ষার্থী নওশাদ সজীব উদ্যোগ নিলেন একটি সংগঠন চালুর। যার উদ্দেশ্য থাকবে রোবট নিয়ে গবেষণা। তারপর ১১ জনের একটি দল রোবট নিয়ে ছোট ছোট বিভিন্ন কাজ শুরু করে। ২০১৩ সালে রোবোটিকস নিয়ে কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি ২০১৫ সালে তাদের বার্ষিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে একটি মানবসদৃশ রোবট বানানোর অনুরোধ করে রোবো সাস্টকে। এ জন্য এক লাখ টাকার অনুদান দেয় তারা। তারপর শুরু হলো রোবট ‘রিবো’ তৈরির কাজ। শেষ হয় ২০১৫ সালে। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সায়েন্স ফিকশন ফেস্টিভ্যালে প্রথম জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হয় ‘রিবো’।
নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণেই অন্যান্য রোবট থেকে এটি ব্যতিক্রম। এটি মানুষের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পারে, বাংলায় লিখতেও সক্ষম। চোখ, চোখের পাতা ও ঠোঁট নাড়াতে পারে। বিভিন্ন ধরনের মুখভঙ্গি করতে পারে। বিশেষ দিক হচ্ছে, এটি মানুষের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করা এবং নাচতেও পারে। হাঁটতে শিখেছে ‘রিবো’র উত্তরসূরি ‘লি’ ‘লি’র আগমন ‘রিবো’র উত্তরসূরি হিসেবে। ‘লি’ কথা বলে বাংলায়, হাঁটতে পারে মানুষের মতোই। হাত-পা নাড়ানোসহ নানা অঙ্গভঙ্গিও করতে পারে। বাংলাদেশ ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে সে। রোবটটিতে ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শেখানো হয়েছে গান, কবিতা ইত্যাদি। সাধারণত বাসা, বাড়ি-অফিসে ব্যবহার করা হয় এমন সব ভাষাও শেখানো হচ্ছে ‘লি’কে। ফেস রিকগনিশনের মাধ্যমে মানুষকে মনে রাখতে পারে সে। হ্যান্ডশেক, নাচসহ বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভঙ্গিও করতে পারে। মুখে মানুষের মতো চোখ, চোখের পাতা, ঠোঁট প্রভৃতির মাধ্যমে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনও করতে পারে। হারিয়ে যাওয়া একটি বাংলা স্বরবর্ণ হলো ‘লি’, যা দেখতে ৯-এর মতো ছিল। ওই অক্ষরটির নামানুসারেই রোবটটির নামকরণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্রাইডে ল্যাব’ নামে তরুণ গবেষক দল ২০১৯ সালে এই রোববটি তৈরি করে। ওই বছরের ২০ এপ্রিল রোবটটি সবার সামনে উন্মুক্ত করা হয়। এদিন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক রোবটটি উদ্বোধন করেন। চার ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতা ও ৩০ কেজি ওজনের এই রোবটটি তৈরি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম, আর্কিটেকচার বিভাগের মেহেদী হাসান রূপক, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মোহাম্মদ সামিউল হাসান ও জিনিয়া সুলতানা জ্যোতি। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সিএসই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রভাষক নওশাদ সজীব। নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে বিশ্বসেরা : ‘নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-২০১৮’-এ ‘বেস্ট ইউজ অব ডেটা’ ক্যাটাগরিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে শাবিপ্রবির ‘টিম অলিক’। নাসার কোনো প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি টিম হিসেবে এ অর্জন এটাই প্রথম। বিশ্বের ৭৯টি দেশের বাছাই করা ২ হাজার ৭২৯টি টিমের সঙ্গে লড়াই করে চ্যাম্পিয়ন হয় ‘টিম অলিক’। ‘সাস্ট ভার্চুয়াল ট্যুর’ নামের একটি অ্যাপসের সাহায্যে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির মাধ্যমে কেউ শাবিপ্রবিতে না এসেও বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। ২০১৮ সালের ১৯-২১ অক্টোবর, প্রতিযোগিতার মূল পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় পৃথিবী ও মহাকাশবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতায় ছয়টি ক্যাটাগরির মধ্যে ‘বেস্ট ইউজ অব ডেটা’ ক্যাটাগরিতে অংশগ্রহণ করে ‘টিম অলিক’। এই ক্যাটাগরিতে অংশ নেয় বিশ্বের সর্বমোট ৭৯টি দেশ থেকে বাছাই করা ২ হাজার ৭২৯টি টিম। নাসা প্রদত্ত ডেটা ব্যবহার করে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি অ্যাপ ‘লুনার ভিআর’ তৈরি করতে বলা হয়। এতে শীর্ষ চারে স্থান করে নেয় ‘টিম অলিক’। সেখান থেকে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী রাউন্ডে চ্যাম্পিয়ন হয় ‘টিম অলিক’।
বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বকারী দল ‘টিম অলিক’র সদস্যরা হলেন শাবির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক (মেন্টর), বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী এস এম রাফি আদনান, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী কাজী মাইনুল ইসলাম, একই বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী আবু সাদিক মাহদি ও একই বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান।
দ্রুত ক্যানসার শনাক্তের সম্ভাবনার নতুন দ্বার : রক্তের নমুনা পরীক্ষা করার মাধ্যমে ক্যানসার শনাক্তকরণ পদ্ধতি উদ্ভাবনেও রয়েছে শাবিপ্রবির সাফল্য। এর ফলে দ্রুত ক্যানসার শনাক্তের সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। অল্প খরচে ও কম সময়ে ‘ননলিনিয়ার অপটিকস’ নামের উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিতে রক্তের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে মাত্র ১০ থেকে ২০ মিনিটেই ক্যানসার শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এই পদ্ধতিতে ক্যানসার শনাক্তের জন্য সংগ্রহ করা রক্তের নমুনার (সেরাম) মধ্যে উচ্চক্ষমতার লেজার-রশ্মি ফেলে রক্তে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না তা দেখা হবে। রক্তে পরিবর্তনের বিষয়টি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ধরা পড়বে এবং ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে ফলাফল পাওয়া যাবে। এ পরীক্ষার জন্য সময় লাগবে ৫ থেকে ১০ মিনিট। খরচ হবে ৫০০ টাকারও কম। রক্ত থেকে লাল অংশ বাদ দিয়ে কেবল সেরাম ডিভাইসে দিলে প্যারামিটারে এর মান জানা যাবে। আর সেটা থেকেই বোঝা যাবে শরীরে ক্যানসার আছে কী নেই। হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের (হেকেপ) আওতায় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকের নেতৃত্বে একদল গবেষক ক্যানসার শনাক্তকরণের এ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। গবেষক দলের অন্য সদস্যরা হলেন প্রফেসর ড. শরীফ মো. শরাফ উদ্দিন, মনজ কান্তি বিশ্বাস ও এনামুল হক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একুশে বাংলা কিবোর্ড : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ‘একুশে বাংলা কিবোর্ড’ নিজেই বুঝে ফেলবে গ্রাহক কী লিখতে চাইছেন। এটাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজনের পাশাপাশি দ্রুত টাইপিং ও স্পর্শ করে লেখার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে টাইপ না জানলেও যে কেউ সহজেই বাংলা টাইপিং শিখতে পারা যায় এর মাধ্যমে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে বাংলা কিবোর্ডের উদ্ভাবন করে শাবিপ্রবির একদল গবেষক। ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী এবং ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী উ খ্যই নু ও রণিত দেবনাথ আকাশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সংবলিত বাংলা কিবোর্ড তৈরির প্রকল্প শুরু করেন। বর্তমানে কিবোর্ডে প্রায় ১২০টি ইমোজি রয়েছে এবং পরবর্তী সময় আরও ইমোজি বাড়াতে কাজ চলছে। উদ্ভাবক টিমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে কিবোর্ডে ভয়েস সার্চ, বিভিন্ন ধরনের ইমোজি এবং স্টিকার, আইওএস ভার্সন রিলিজ ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে সাজেশনযুক্ত করার কাজ চলছে। ট্র্যাকিং ডিভাইসে জানা যাবে যানবাহনের অবস্থান : ২০১৩ সালে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে ট্র্যাকিং ডিভাইস তৈরি করে শাবিপ্রবির একদল গবেষক। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই ট্র্যাকিং ডিভাইস তৈরির ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই ডিভাইস সংযোজনের ফলে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে নৌযানের অবস্থান জানা যাবে খুব সহজেই। আমাদের দেশে প্রায় সময়ই দুর্ঘটনার পর নৌযানের অবস্থান শনাক্ত করতে বিলম্ব হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্ঘটনাকবলিত নৌযানের সঠিক অবস্থান দ্রুত জানা যাবে। আবার এই ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করা যায় যানবাহনেও। গবেষক দলের অন্য সদ্যরা হলেন সিএসই বিভাগের বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমিন সজীব, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিল ও সিএসই বিভাগের নওশাদ।
নিজেদের ড্রোন দিয়ে পাখির চোখে ক্যাম্পাস দেখা : ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি, ড. জাফর ইকবালের তত্ত্বাবধানে একদল গবেষক প্রথম বাংলাদেশে মানুষবিহীন বিমান (ড্রোন) তৈরি করে। সফলভাবে এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নও সম্পন্ন করেন তারা। ওই দিন দুপুরে ক্যাম্পাসের আকাশে এই দৃশ্য উপভোগ করে পুরো ক্যাম্পাস। ড্রোনটি মূলত দেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কাজে ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। গবেষক দলটির প্রধান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিল। দলে আরও রয়েছেন নাবিল ছাড়াও একই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রবি কর্মকার এবং মারুফ হোসেন রাহাত। এ ছাড়া নিজস্ব ডোমেইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ই-মেইল সার্ভিস চালু, অনলাইনে ট্রান্সক্রিপ্ট উত্তোলনের সুবিধা, ডিজিটাল উপস্থিতি পদ্ধতি চালু প্রভৃতিতে শাবিপ্রবিই প্রথম। দেশের তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে সাফল্যে অবদানস্বরূপ ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর আইসিটি অ্যাওয়ার্ড অর্জন উল্লেখযোগ্য সাফল্য। সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে প্রথমবারের মতো দেশসেরা ‘ডিজিটাল ক্যাম্পাস অ্যাওয়ার্ড’ অর্জনও উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ভিনদেশে আলো ছড়াচ্ছেন গ্র্যাজুয়েটরা : বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা। গুগল-মাইক্রোসফটসহ বিখ্যাত বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষকতা ও গবেষণা করছেন আরও অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। সিএসই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মারুফ মনিরুজ্জামান ও শাহাদাত হোসাইন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছেন মাইক্রোসফটে। গুগলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন সৈয়দ শাহরিয়ার মঞ্জুর, ফরহাদ আহমেদ প্রমুখ। ই-কমার্স সাইট আমাজনের সঙ্গে আছেন শাবিপ্রবির সাবেক ছাত্র দিবাকর সামন্তসহ অনেকেই।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ব্রান্সউইকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন অর্থনীতি পঞ্চম ব্যাচের মুর্শেদ চৌধুরী। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও ক্যানসার কোষ নিয়ে গবেষণা করছেন রসায়ন বিভাগের স্নাতক মুহম্মদ জহুরুল আলম সিদ্দিকী। তিনি বিশ্বে প্রথম ক্যানসার শনাক্তকরণের যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন সিএসই বিভাগের স্নাতক আলাউদ্দিন ভূঁইয়া। নর্থ ক্যারোলিনার উইন্সটন-সালেম স্টেট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক সিএসই বিভাগের প্রথম ব্যাচের মোহাম্মদ মুজতবা ফুয়াদ। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন দেবযানী দেব। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে সিএসই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাবিপ্রবির সাবেক ছাত্র এম শাহরিয়ার হোসাইন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের স্নাতক আয়েশা আরেফিন টুম্পা যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম ফুসফুস তৈরির গবেষণা দলে কাজ করছেন। সিএসই স্নাতক ওমর শেহাব সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আছেন ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড বাল্টিমোর কাউন্টিতে। সমাজবিজ্ঞানের স্নাতক আমিনুল ইসলাম সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা করছেন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন সিএসই বিভাগের স্নাতক খন্দকার ইন্তেনাম উনায়েছ আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হেভেনে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে আছেন সিএসই স্নাতক ইফতেখার ইবনে বাসিত। ইউনাইটেড আরব এমিরেটস ইউনিভার্সিটিতে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন শাবিপ্রবির সাবেক ছাত্র রেজাউল চৌধুরীসহ অনেক শিক্ষার্থী। এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কাজের মাধ্যমে মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন শাবিপ্রবির গ্র্যাজুয়েটরা। বিশ্বের দীর্ঘতম পথচিত্র : ২০১৩ সালের মার্চে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাবিপ্রবিতে উন্মোচিত হয় বিশ্বের দীর্ঘতম পথচিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে শাহপরান হল পর্যন্ত দীর্ঘ দুই কিলোমিটারব্যাপী রাস্তায় অঙ্কিত আল্পনায় উঠে আসে ভাষা আন্দোলন থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাঙালির বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সর্বত্র ছড়িয়ে আছে চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের চিহ্ন শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চিহ্ন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘চেতনা ৭১’ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার মনে করিয়ে দেয় মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলো। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিকে সংরক্ষণ ও তার আদর্শের প্রতীককে ধারণ করার জন্য শাবিপ্রবিতে নির্মাণ করা হয়েছে তার প্রতিকৃতি। প্রকৃতির অরণ্যে ঘেরা ক্যাম্পাসের গোলচত্বর ও প্রশাসনিক ভবন-২-এর মধ্যে নির্মিত এ প্রতিকৃতির চারদিকে ঘিরে রেখেছে কদম, কৃষ্ণচূড়া, কড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট এ প্রতিকৃতি উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। চেতনা-৭১ : মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এবং চেতনাকে ধারণ করতে ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয়েছে ভাস্কর্য ‘চেতনা ৭১’। ভাস্কর্যটিতে একই সঙ্গে ধারণ করা হয়েছে বর্তমান প্রজন্মের মডেল আর দেশপ্রেম। ভাস্কর্যটিতে একটি ছেলে এক হাতে উঁচু করে ধরেছে বাংলাদেশের পতাকা। আর তারই পাশে সহাবস্থানে একটি মেয়ের হাতে একটি বই, যা নির্দেশ করে বাংলাদেশের সংবিধান। ‘চেতনা ৭১’ দেখতে যেমন আধুনিক, তেমনি বর্তমান প্রজন্মের দেশপ্রেমকে উপস্থাপন করে প্রতীকীরূপে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে এবং প্রথম ব্যাচের (১৯৯০-৯১) শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তায় ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। ভাস্কর্যটির নকশা করেন স্থপতি মোবারক হোসেন নৃপল। শহীদ মিনার : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম স্থাপত্যশৈলী শহীদ মিনার। ২০০১ সালের তৎকালীন স্পিকার প্রয়াত হুমায়ুন রশীদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ৫৮ ফুট উচ্চতার একটি টিলায় ৬ হাজার ৮৮৬ বর্গফুট জায়গা জুড়ে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ৭৮ ফুট। অতিক্রম করতে হয় শতাধিক সিঁড়ি। শহীদ মিনার থেকেই দেখা যায় পুরো ক্যাম্পাসকে। মুক্তিযুদ্ধ কর্নার : তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের চতুর্থতলায় নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই, ভিডিওসিডি, তথ্যচিত্র, দলিল, আলোকচিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে লেখা চিঠিপত্র, দেশি-বিদেশি লেখক ও সাংবাদিকদের লেখা দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে এখানে। বছরব্যাপী চলে সহ-শিক্ষামূলক কার্যক্রম : অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী, বিতর্ক, ক্যারিয়ার, বিজ্ঞান ও ক্রীড়াভিত্তিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রক্টর অফিস কর্তৃক অনুমোদিত সংগঠনের সংখ্যা ৫৫টি। থিয়েটার সাস্ট : ‘নাটক নির্মাণ করে যৌবন, নাটক আনবেই অবিনাশী প্লাবন’ সেøাগানকে সামনে রেখে ১৯৯৭ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে গতিশীল রাখতে সংগঠনটি এ পর্যন্ত এই ৩৪টি প্রযোজনার মধ্য দিয়ে ১২৪টি প্রদর্শনী সম্পন্ন করেছে। দিক থিয়েটার : ‘নাটকে সাম্যের আন্দোলন, জীবনের ভাষায় মুক্তির অন্বেষণ’ সেøাগানে ১৯৯৯ সালের ১৮ আগস্ট ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে নাট্যসংগঠন দিক থিয়েটার। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে নাটকের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছে সংগঠনটি। মাভৈ আবৃত্তি সংসদ : ‘শেকল ভাঙার ছন্দ মোরা, দেয়াল ভাঙার উচ্চারণ’ সেøাগানে ১৯৯৮ সালের ১৫ নভেম্বর ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে আবৃত্তিবিষয়ক এই সংগঠনটি। ক্যাম্পাসে প্রতিটি জাতীয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব, চৈত্রসংক্রান্তির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট বিভাগে আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন এর সদস্যরা। আজ মুক্তমঞ্চ : একমাত্র মূকাভিনয় সংগঠন আজ মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালে। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে মূকাভিনয়ের পাশাপাশি আয়োজন করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবের। শাহজালাল ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি : ‘যুক্তির স্পন্দনে ভাঙ্গুক বা গড়–ক এই বিশ্ব’ স্লোগানে ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিতর্কের বিকাশে সফলতার সঙ্গে সংগঠনটি জাতীয় বিতর্ক, আন্তঃবিভাগ বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সিলেট বিভাগীয় বিতর্ক, ছাত্র-শিক্ষক বিতর্ক, আঞ্চলিক রম্য বিতর্ক, স্কুল বিতর্ক, কলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। সাস্ট স্কুল অব ডিবেট : ‘তবু উড়বে ফিনিক্সি যুক্তির দ্রোহী আকাশে’ স্লোগানে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে জাতীয়, আন্তঃবিভাগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আয়োজন ও অংশগ্রহণ করছে সংগঠনটি। স্বপ্নোত্থান : দ্বীপ শিখা হাতে স্বপ্নের পথে’ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১০ সালের ১ আগস্ট পথচলা শুরু করে সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বপ্নোত্থান সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং দুঃখী ও অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে আসছে। এ ছাড়া একঝাঁক মেধাবীর সমন্বয়ে ভোলানন্দে নৈশ বিদ্যালয় পরিচালনা করে স্বপ্নবান। শাহজালাল ইউনিভার্সিটি স্পিকার ক্লাব : কাম হেয়ার, স্পিক বেটার’ সেøাগান নিয়ে ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিকশিত ক্যারিয়ার গঠনে দিকনির্দেশনা দিতে কাজ করছে সংগঠনটি। গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি : ‘মানবতার জন্য শেখা’ স্লোগান নিয়ে ১১ জানুয়ারি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে জনসচেতনতার জন্য সেমিনার, কর্মশালা, পরিবেশবিষয়ক গবেষণা, পরিবেশবিষয়ক পাঠচক্র, পাখি দেখা, বৃক্ষরোপণ, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গায় বেড়াতে যাওয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত এ সংগঠনের সদস্যরা। স্পোর্টস সাস্ট : ‘জীবন গঠনের জন্য প্রতিযোগিতা’ স্লোগানে ২০০৫ সালের এপ্রিলে ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। বছরব্যাপী ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ফুটবল চ্যাম্পিয়নস লিগসহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার করে সংগঠনের সদস্যরা। এ ছাড়া রিম, নোঙর, কিন, সাস্ট সাহিত্য সংসদ, শিকড়, বাইনারি, বিজ্ঞানের জন্য ভালোবাসা, রোবো সাস্ট, সাস্ট সায়েন্স অ্যারেনা, বিএনসিসি প্রভৃতি সংগঠনের কার্যক্রমে বছরব্যাপী মুখর থাকে ক্যাম্পাস। সংকট আর সমস্যার বৃত্তায়ন এত অর্জনের মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। ক্লাসরুম সংকট, পরিবহন সংকট এর মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিশ^বিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধা অনেক সীমিত। দশ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র পাঁচটি আবাসিক হল, যার আসনসংখ্যা মাত্র দুই হাজার। তবু এসব সংকট কাটিয়ে খুব দ্রুত বিশবর প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে শাবিপ্রবি এমনটাই প্রত্যাশা সবার। উপাচার্যের স্বপ্ন আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ স্বপ্ন দেখছেন শাবিপ্রবিকে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় শাবিপ্রবি। এখানের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়ান্ট কোম্পানিগুলোতে কর্মরত আছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তিনি বলেন, শিক্ষা, গবেষণা ও অবকাঠামোগত দিক দিয়ে শাবিপ্রবিকে প্রথম সারির এবং আন্তর্জাতিক মানের বিশববিদ্যালয়ে পরিণত করতে আমরা কাজ করছি এবং করে দেখাব। এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এবং অ্যাকাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণসহ ১৭টি প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যে ৯৫০ কোটি টাকার বাজেট পাস করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। আশা করি কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা পরিবর্তন করে দিতে পারব।