অসামান্য আলমগীর কবির
ওয়াহিদ সুজন | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
আলমগীর কবির নামটা শোনার পর অনেক ছবি মনে ঘুরপাক খেতে পারে। অনেক অনেক চিত্র-শব্দের আতশবাজি ফোটার পরও মনে হবে- কী কী যেন বাদ পড়ে যাচ্ছে। নামটার সঙ্গে অতি বা অল্পপরিচিত কারও কাছে একটু অতিরিক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু একদমই না!
তবে শুধু ‘চলচ্চিত্রকার’ হিসেবে আলমগিীর কবিরের মশহুর হওয়া আচানক কোনো ঘটনা নয়। মানে সাধারণ যে পরিচয়ে আমরা আমজনতা কিছু একটা বুঝি। কী অর্থবহভাবেই বুঝি। কবিরের দুই বা তিনটি ছবি দেখার অভিজ্ঞতা থাকলে পরের আরেকটা ছবিতে তাকে চিনতে ভুল হবে না। আর এই ‘চেনাজানা’কে প্রথাগত বাংলা সিনেমা আকারে ভাবলে ভুল হবে। বিলকুল! সেটা এফডিসি বা তার বাইরের- সমস্যা নেই।
এই জায়গায় তানভীর মোকাম্মেল থেকে একটা শব্দ আমার ধার নিতে পারি। তিনি কবিরকে সুনির্দিষ্ট করেছেন ‘অঁতর’ নির্মাতা হিসেবে। আর সেই আলজেরিয়া থেকে কিউবা চষে বেড়ানো কবির অবশ্যই বাংলার প্রথম অঁতর নির্মাতা।
একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে একক বা যৌথ বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন আলমগীর কবির। আর তার প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাহিনীচিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩)।
তানভীর ‘অঁতর’ শব্দটির দারুণ একটা ব্যাখ্যাও দিলেন। নইলে আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে যেত বৈকি! তানভীর মোকাম্মেল বেশ গুছিয়ে বললেন, “আলমগীর কবিরের ছয়টি পূর্ণদৈর্ঘ্য (পরিণীতা ও মহানায়ক বাদে) ও ডজন খানেক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির বিষয়বস্তু ও প্রেক্ষাপটে অনেক বৈচিত্র্য থাকলেও, ওর চলচ্চিত্রগুলোর টাইটেল কার্ডে একটা সাধারণ সাযুজ্য রয়েই গেছে, তা’ হচ্ছে প্রায় সব ছবিরই ‘রচনা, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও চলচ্চিত্রায়নে’- আলমগীর কবির। অর্থাৎ শুধু পরিচালনা নয়, গোটা চলচ্চিত্রটাকে, চিত্রনাট্যসহ, নিজের মধ্যে ধারণ করা ও নির্মাণ করা। লেখক যেমনটি তার বইয়ের ক্ষেত্রে করে থাকেন। এবং একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু ছড়িয়ে থাকে ওর একটির পর একটি চলচ্চিত্রের মধ্যে। ওর ব্যক্তিগত বিশ্বাস। আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে একজন অঁতর পরিচালক।” কবিরের ভোক্তামাত্রই বুঝেবেন কথাগুলোর মর্মার্থ কতটা গভীর।
আসলে আলমগীর কবির যে একজন যোদ্ধা বা বিপ্লবী সেই কথা আমরা কোনোভাবেই মাথা থেকে ফেলতে পারি না। বিপ্লবীদের ফ্যান্টাসি থাকে বিস্তর, আর বাঙালি অর্থে সেক্যুলারিজমের অসাম্প্রদায়িক প্রত্যয় ধারণÑ সব মিলিয়ে কিছু বিষয় থাকে, যা আসলে তার কালের পর অর্থ হারিয়ে ফেলেছে বা বিস্তৃতি-সংকীর্ণ হয়েছে। বাংলার মান ভাষা নিয়ে ব্যাপক ভাঙাগড়া ঘটে গেছে। কিন্তু তার শুরু তো দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধকালে জহির রায়হানসহ অন্যদের সঙ্গে চলচ্চিত্রিক অভিযাত্রা শুরু করেন। তখন তো রীতিমতো ইশতেহার লিখে ফেলেন তারা- কেমন হবে নতুন দেশের সিনেমা, তার ভাষা, কৃৎকৌশল বা বাজার ব্যবস্থা।
‘সিনেমা ইন বাংলাদেশ’ (১৯৭৯, অনু. ২০১৯) বইয়ে আলমগীর কবিরের ভাষ্যে, ‘যুদ্ধের সময় ম্ুিক্তবাহিনীর ব্যূহের ভেতরে থাকা কিছু মানুষ স্বাধীন হতে যাওয়া দেশের চলচ্চিত্রশিল্পে বৈপ্লবিক ধারার পরিবর্তন আনার ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। শৈল্পিক বা ব্যবহারিক দিক থেকে আসন্ন নতুন যুগের কথা মাথায় রেখে জহির রায়হানের নেতৃত্বে একদিন চলচ্চিত্র-নির্মাতা চলচ্চিত্রশিল্পের পূর্ণ জাতীয়করণের পরিকল্পনা তৈরি করেন।’ পরে বলছেন, ‘জাতীয়করণের পরিকল্পনা শিকেয় ওঠায় বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের দ্রুত মানোন্নয়নের আশা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।’ আসলেই কী?
জাতীয়করণ সফল হওয়া না হওয়া আরও গভীর বিষয় হয়তো। আমরা তো প্রায়শ আনন্দ অনুভব করি যে, কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্টোর সঙ্গে দেখা হওয়া অল্প কয়েকজন বাঙালির একজন আলমগীর কবির, ব্রিটিশ বামধারার পত্রিকার জন্য ক্যাস্টোর সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন। কবিরের জীবনে এই বিষয়গুলো নিশ্চয় প্রভাব ফেলে। আজকের ভিন্ন পরিস্থিতিতে এই সমীকরণগুলো অন্যরকমভাবে ভাবাবে নিশ্চয়। কিন্তু মানুষ, মানবিকতা অ্যাখ্যান তো চিরকালীন। তিনি যেমন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ছিলেন। বা যেমনটা তার সিনেমার পরতে পরতে বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ব্যয়বহুল মাধ্যম হিসেবে সিনেমার পুঁজি ফেরত না আসার কোনো বিকল্প নেই। অন্তত কবিরের শেষ দুই ছবি (পরিণীতা ও মহানায়ক) সেই ধাক্কা প্রমাণ করে। একই সঙ্গে জনচৈতন্যের সঙ্গে সম্পর্কের সুতো আলগাও কি মনে হয় না! একটা রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে দেখতে গিয়ে স্থান-কালকে এড়িয়ে গেছেন। আলমগীর কবির আরও কিছুকাল থাকলে সেই কথা হয়তো অন্যভাবে বলা হতো। তবে যা ‘হয়তো’, তা তো ‘হয়তো’!
এই সবের বাইরে সবচেয়ে বড় যে দিকটি ঢাকাই চলচ্চিত্রে ফুলে-ফলে-সৌরভে তার নিজস্ব অবস্থান। ব্রিটেন থেকে ঢাকায় চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে পরিচিতি পান! পরে সিনে জার্নাল করলেন। সমালোচনা করে তো তাবড় লোকদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলেন। ফলে তার মতো মানুষ (তার ওপর কলকাতা ও মুম্বাইয়ের রদ্দি মালের দেশীয় নকলের বিরোধী ছিলেন) আর কোথাও থেকে না হোক- সিনেমা পাড়ার মানুষদের কাছ থেকে প্রত্যাঘাত পাবেন- অনুমান করাই যায়। এমনকি গুরু জহির রায়হারের অন্য দুই শিষ্য খান আতাউর রহমান ও আমজাদ হোসেনের সঙ্গে পত্রিকায় চিঠি চালাচালি করে চলত তর্ক। সেই তর্ক আজও কোথাও কোথাও চলছে না এমন না। মানে মূল আর বিকল্প ধরে যে রাজনীতি ঢাকাই সিনেমায় মেঘ তৈরি করেছে তার শেকড় কতদূর। সেই জায়গায় বোধহয় আলমগীর কবির এগিয়ে গেছেন। জনগণের ভাবভাষা বোঝার ধারাবাহিক কোনো প্রক্রিয়া সেখানে ছিল না। আলমগীর কবিরের পরম্পরা এখনো আছে চলচ্চিত্র আন্দোলন ও প্রশিক্ষণে। সে প্রসঙ্গে সামান্য পরে আসছি।
‘জাতীয়করণের ইশতেহার’ প্রসঙ্গে বোঝা যায় আলমগীর কবিরের লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী। তার সিনেমা প্রচলিত অর্থে সিনেমা নয়। তার জবানিতে এমন উত্তরও মেলে, ‘মানুষের মন এবং মিডিয়ামের মধ্যে একটা সার্থক সংযোগ স্থাপন করতে হবে, সৎ হতে হবে, বাস্তব হতে হবে এবং সবচেয়ে বড় কথা রুচি এবং শিক্ষার পরিচয় বহন করতে হবে। শুধু বিকৃতিবর্জিত ছবিই ভালো [ছবি] নয়, যার সামাজিক মূল্য থাকবে, সেটাই ভালো ছবি।’ (জাতীয় মুক্তি ও চলচ্চিত্র, পৃ. ২২৩)।
বর্ণনা পাওয়া যাবে ‘সিনেমা ইন বাংলাদেশ’ বইয়ে। যেখানে ইতিহাস পরম্পরা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র সম্পর্কিত নিজস্ব সংজ্ঞায় হাজির হন। তথ্যচিত্র ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ফারাকই ঘুচিয়ে দেন। যে সব চিন্তা বারবার ঢাকায় আলোচিত হয়েছে, তবে তেমন আলো পড়েনি। আলমগীর কবির বলছেন, “পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের উত্থান মানেই এতকাল ধরে কাহিনী-সৃজনে অত্যাবশ্যক হয়ে থাকা কল্পনাশক্তির অবসান নয়। কল্পনাকে এখানে সূক্ষ্মভাবে একটি ভূমিকায় নিযুক্ত করা হবে; নির্বাচন এবং আয়োজনের কাজে। পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য হয় সত্যকে তুলে ধরা, তাহলে বোধ এবং কল্পনার দায়িত্ব হবে বাস্তবের আবর্তের ধাঁধাময় বিশৃঙ্খলা থেকে সত্যকে ছেঁকে বের করা; কারণ সত্যমাত্রই বাস্তব কিন্তু বাস্তবতার গোটাটাই সত্য নয়। প্রমাণিত হয় যে নির্মাতা অর্থাৎ যিনি সৃষ্টি করেন তার ভূমিকা আগের চেয়ে মহান ছাড়বে না। মানুষের কোনো উদ্যোগই স্ববিরোধমুক্ত হতে পারে না। মানুষের চিন্তা এবং সৃজনশীলতা ক্রমাগত সামনে এগিয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রও এগিয়ে যাবে।”(পৃ. ১১৬)
এখন কথা হলো- শুধু সিনেমা বানালে তো চলে না, দরকার- সেই অনুযায়ী দর্শক। আলমগীর কবিরের অর্থে সিনেমাবুঝদার মানুষ। তেমনই উচ্চাভিলাষ ছিল তার। নির্মাণের সমান্তরালে সংগঠিত করার কাজটিও নেন নিজের কাঁধে। ব্রিটেন থেকে ফিরে চলচ্চিত্র সংসদ পাকিস্তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। দু’বছরের মধ্যেই বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ঢাকা সিনে ক্লাব। যা পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র সংসদ। ১৯৬৯ সালে তার সক্রিয় উদ্যোগে চালু হলো ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট, এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রথম পদক্ষেপ বলা চলে একে।
আলমগীর কবিরের স্বাধীনতা-পরবর্তী কর্মযজ্ঞের সাক্ষী প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকার তারেক আহমেদ। তার কথা থেকে জানা যায়, কবিরের পথ অনুসরণ করেই ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সতীশ বাহাদুরকে নিয়ে প্রথমবারের মতো ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স আয়োজন করে। এই সতীশ বাহাদুরই পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে তার দ্বিতীয়বারের সফরে এলে বাংলাদেশে ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার মূল রূপরেখা দিয়ে যান। পরের বছর আর্কাইভের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও মূলত দেশের চলচ্চিত্রমনস্ক তরুণদের সঙ্গে আর্কাইভের কর্মকাণ্ডের সংযোগ ঘটে- যখন পুনরায় আলমগীর কবিরই সেখানে চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ কর্মশালার কার্যক্রম শুরু করলেন। বাংলাদেশে পরবর্তী স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সুপরিচিত কয়েকজনেরই যাত্রা শুরু আলমগীর কবিরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ফিল্ম আর্কাইভের এই কোর্সগুলো থেকে। চলচ্চিত্র বিষয়ক নীতিমালার খসড়াও আসে তার হাত ধরে।
এত গেল বিশাল কর্মযজ্ঞের সামান্য ফিরিস্তি। আলমগীর কবিরের উদ্দেশ্যটা ছিল কী?
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, “এখানে সংসদ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যিকারের চলচ্চিত্রের ভাষায় চলচ্চিত্রকে তুলে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে গড়ে তোলা। সংসদ আন্দোলনের প্রথম দিকের উদ্দেশ্য ছিল কিছুসংখ্যক ভালো দর্শক তৈরি করা। তারপর তারা ছবি বোঝে কি না তার জন্য কথোপকথন, সেমিনার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা হয়ে যাওয়ার পর এ দেশের চলচ্চিত্রের ভাষা, আঙ্গিক ইত্যাদিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চলচ্চিত্র সংসদগুলোকে এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম করতে হবে। আমি এভাবেই দেখি।” (চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি, পৃ. ২৫৫) এটা ১৯৭৮ সালের কথা। তারপর কী ঘটেছিল? ততদিনে সরকার ভারতের অনুকরণে চলচ্চিত্রের অনুদান প্রথা চালু করে। মোটামুটি নতুন ও প্রতিশ্রুতিশীল নির্মাতারা অনুদান পেয়েছিলেন। একে কবিরদের এক ধরনের অর্জন তো বলা-ই যায়।
তবে কবিরের ভালো ছবির দর্শক নির্মাণের কী হলো? শুনুন এক দশক পরের কথা। বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ আয়োজিত প্রথম জাতীয় কর্মী সমাবেশে আলমগীর কবির বলেন, “ঘটনাপঞ্জির হিসেবে সেদিন এ দেশে চলচ্চিত্র সংসদ বা সিনেক্লাব আন্দোলনের পঁচিশ বছর পার হলো। আরোহণ-অবরোহণের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আন্দোলন যে বর্তমানে একটি মোটামুটি চরম অবরোহণের পর্যায়ে আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। নির্বাচিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মতো প্রাথমিক কার্যক্রমও এখন ভীষণভাবে সংকুচিত। এটা নিশ্চয়ই উদ্বেগের কারণ।” (চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি, পৃ. ২৬৫) এই উদ্যোগ একালে এসে কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে সেটা বিশদ গবেষণার দাবি রাখে। সিনেমা নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া উৎসব দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো স্থান করে নিতে পেরেছে কি না প্রশ্ন! এর অন্যতম কারণ হতে পারে- কলম ও ক্যামেরা দুটি তাক করলেও আলমগীর কবির তার সমকালে সমমাপের সহযাত্রী খুব একটা পাননি। প্রতিভাধর অনেকে ছিলেন না- তা নয়। তেমন লড়াকু আর কি কেউ ছিল? এমন ও হতে পারে খোদ সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে দর্শক তৈরির চিন্তা সবটা শিক্ষকসুলভ ততটা সৃজনীমূলক নয়। আলমগীর কবির ঠেকে ঠেকে শেখেননি এমননি। তার মতো সিনেমা নিয়ে লড়াইটা কে করেছে?
এক সাক্ষাৎকারে তারেক মাসুদ বলেছিলেন, “সাংগঠনিক কাজে যে বিরাট সময় গেছে তাতে ব্যক্তি সৃজনশীলতা তো কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছে। তিনি চলচ্চিত্র শিল্পে শুধু যে প্রতিভাবান বা সৃজনশীল ছিলেন সেটা নয়। কতগুলো কম্বিনেশন ছিল তার মধ্যে। আমি বলব বাংলাদেশের আধুনিক চলচ্চিত্রের প্রথম নির্মাতা আলমগীর কবির যিনি এদেশে আধুনিক ধারা প্রবর্তন করেছেন। সেটা করতে পেরেছেন আন্তর্জাতিকভাবে তার ফিল্মিক এক্সপোজার ছিল বলে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে সোসিও-পলিটিক্যাল কনসাসনেস, সেই লেভেলটা বাংলাদেশে তার আগে বা পরে তার মতো করে এসেছে কি না সন্দেহ। আমার মনে হয় না সমাজ তাত্ত্বিকতা এবং চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকতায় আমরা কেউ তাকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছি।” (চলচ্চিত্রকথা/তারেক মাসুদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার, পৃ. ৩৭)
কথা বলতে বলতে অনেক পথ পেরিয়ে কাদামাখা ভূমিতেই ফিরি যেখানে ধীরে বহে মেঘনা মোহনার অপেক্ষায়। তার অনেকদিন পর তারেকের ‘মাটির ময়না’ ধরে বাংলা ছবি আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে- অনেকেরই মিলিত একটু একটু চেষ্টার ফল একটা বড় ভাঙন। হয়তো অনেকটা সময়ের পর প্রাপ্তি সুখকর নয়। কিন্তু আমরা তো বলতে পারি না- পথ চলায় আমাদের কোনো নির্দেশ ছিল না, যাকে ভুল বলেও শুদ্ধ পথে চলা যায়। বলা যায় আলমগীর কবিরের নাম। যিনি অসামান্য। আর, বাংলাদেশের সিনেমা মানুষের কাছেই ফিরুক। হ্যাঁ, সে চিহ্ন আমরা সমকালে দেখতে পাই। বাংলাদেশের নিজের ভাষার চলচ্চিত্র।
শেয়ার করুন
ওয়াহিদ সুজন | ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

আলমগীর কবির নামটা শোনার পর অনেক ছবি মনে ঘুরপাক খেতে পারে। অনেক অনেক চিত্র-শব্দের আতশবাজি ফোটার পরও মনে হবে- কী কী যেন বাদ পড়ে যাচ্ছে। নামটার সঙ্গে অতি বা অল্পপরিচিত কারও কাছে একটু অতিরিক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু একদমই না! তবে শুধু ‘চলচ্চিত্রকার’ হিসেবে আলমগিীর কবিরের মশহুর হওয়া আচানক কোনো ঘটনা নয়। মানে সাধারণ যে পরিচয়ে আমরা আমজনতা কিছু একটা বুঝি। কী অর্থবহভাবেই বুঝি। কবিরের দুই বা তিনটি ছবি দেখার অভিজ্ঞতা থাকলে পরের আরেকটা ছবিতে তাকে চিনতে ভুল হবে না। আর এই ‘চেনাজানা’কে প্রথাগত বাংলা সিনেমা আকারে ভাবলে ভুল হবে। বিলকুল! সেটা এফডিসি বা তার বাইরের- সমস্যা নেই। এই জায়গায় তানভীর মোকাম্মেল থেকে একটা শব্দ আমার ধার নিতে পারি। তিনি কবিরকে সুনির্দিষ্ট করেছেন ‘অঁতর’ নির্মাতা হিসেবে। আর সেই আলজেরিয়া থেকে কিউবা চষে বেড়ানো কবির অবশ্যই বাংলার প্রথম অঁতর নির্মাতা। একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে একক বা যৌথ বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন আলমগীর কবির। আর তার প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাহিনীচিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩)। তানভীর ‘অঁতর’ শব্দটির দারুণ একটা ব্যাখ্যাও দিলেন। নইলে আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে যেত বৈকি! তানভীর মোকাম্মেল বেশ গুছিয়ে বললেন, “আলমগীর কবিরের ছয়টি পূর্ণদৈর্ঘ্য (পরিণীতা ও মহানায়ক বাদে) ও ডজন খানেক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির বিষয়বস্তু ও প্রেক্ষাপটে অনেক বৈচিত্র্য থাকলেও, ওর চলচ্চিত্রগুলোর টাইটেল কার্ডে একটা সাধারণ সাযুজ্য রয়েই গেছে, তা’ হচ্ছে প্রায় সব ছবিরই ‘রচনা, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও চলচ্চিত্রায়নে’- আলমগীর কবির। অর্থাৎ শুধু পরিচালনা নয়, গোটা চলচ্চিত্রটাকে, চিত্রনাট্যসহ, নিজের মধ্যে ধারণ করা ও নির্মাণ করা। লেখক যেমনটি তার বইয়ের ক্ষেত্রে করে থাকেন। এবং একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু ছড়িয়ে থাকে ওর একটির পর একটি চলচ্চিত্রের মধ্যে। ওর ব্যক্তিগত বিশ্বাস। আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে একজন অঁতর পরিচালক।” কবিরের ভোক্তামাত্রই বুঝেবেন কথাগুলোর মর্মার্থ কতটা গভীর। আসলে আলমগীর কবির যে একজন যোদ্ধা বা বিপ্লবী সেই কথা আমরা কোনোভাবেই মাথা থেকে ফেলতে পারি না। বিপ্লবীদের ফ্যান্টাসি থাকে বিস্তর, আর বাঙালি অর্থে সেক্যুলারিজমের অসাম্প্রদায়িক প্রত্যয় ধারণÑ সব মিলিয়ে কিছু বিষয় থাকে, যা আসলে তার কালের পর অর্থ হারিয়ে ফেলেছে বা বিস্তৃতি-সংকীর্ণ হয়েছে। বাংলার মান ভাষা নিয়ে ব্যাপক ভাঙাগড়া ঘটে গেছে। কিন্তু তার শুরু তো দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধকালে জহির রায়হানসহ অন্যদের সঙ্গে চলচ্চিত্রিক অভিযাত্রা শুরু করেন। তখন তো রীতিমতো ইশতেহার লিখে ফেলেন তারা- কেমন হবে নতুন দেশের সিনেমা, তার ভাষা, কৃৎকৌশল বা বাজার ব্যবস্থা। ‘সিনেমা ইন বাংলাদেশ’ (১৯৭৯, অনু. ২০১৯) বইয়ে আলমগীর কবিরের ভাষ্যে, ‘যুদ্ধের সময় ম্ুিক্তবাহিনীর ব্যূহের ভেতরে থাকা কিছু মানুষ স্বাধীন হতে যাওয়া দেশের চলচ্চিত্রশিল্পে বৈপ্লবিক ধারার পরিবর্তন আনার ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। শৈল্পিক বা ব্যবহারিক দিক থেকে আসন্ন নতুন যুগের কথা মাথায় রেখে জহির রায়হানের নেতৃত্বে একদিন চলচ্চিত্র-নির্মাতা চলচ্চিত্রশিল্পের পূর্ণ জাতীয়করণের পরিকল্পনা তৈরি করেন।’ পরে বলছেন, ‘জাতীয়করণের পরিকল্পনা শিকেয় ওঠায় বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের দ্রুত মানোন্নয়নের আশা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।’ আসলেই কী? জাতীয়করণ সফল হওয়া না হওয়া আরও গভীর বিষয় হয়তো। আমরা তো প্রায়শ আনন্দ অনুভব করি যে, কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্টোর সঙ্গে দেখা হওয়া অল্প কয়েকজন বাঙালির একজন আলমগীর কবির, ব্রিটিশ বামধারার পত্রিকার জন্য ক্যাস্টোর সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন। কবিরের জীবনে এই বিষয়গুলো নিশ্চয় প্রভাব ফেলে। আজকের ভিন্ন পরিস্থিতিতে এই সমীকরণগুলো অন্যরকমভাবে ভাবাবে নিশ্চয়। কিন্তু মানুষ, মানবিকতা অ্যাখ্যান তো চিরকালীন। তিনি যেমন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ছিলেন। বা যেমনটা তার সিনেমার পরতে পরতে বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ব্যয়বহুল মাধ্যম হিসেবে সিনেমার পুঁজি ফেরত না আসার কোনো বিকল্প নেই। অন্তত কবিরের শেষ দুই ছবি (পরিণীতা ও মহানায়ক) সেই ধাক্কা প্রমাণ করে। একই সঙ্গে জনচৈতন্যের সঙ্গে সম্পর্কের সুতো আলগাও কি মনে হয় না! একটা রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে দেখতে গিয়ে স্থান-কালকে এড়িয়ে গেছেন। আলমগীর কবির আরও কিছুকাল থাকলে সেই কথা হয়তো অন্যভাবে বলা হতো। তবে যা ‘হয়তো’, তা তো ‘হয়তো’! এই সবের বাইরে সবচেয়ে বড় যে দিকটি ঢাকাই চলচ্চিত্রে ফুলে-ফলে-সৌরভে তার নিজস্ব অবস্থান। ব্রিটেন থেকে ঢাকায় চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে পরিচিতি পান! পরে সিনে জার্নাল করলেন। সমালোচনা করে তো তাবড় লোকদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলেন। ফলে তার মতো মানুষ (তার ওপর কলকাতা ও মুম্বাইয়ের রদ্দি মালের দেশীয় নকলের বিরোধী ছিলেন) আর কোথাও থেকে না হোক- সিনেমা পাড়ার মানুষদের কাছ থেকে প্রত্যাঘাত পাবেন- অনুমান করাই যায়। এমনকি গুরু জহির রায়হারের অন্য দুই শিষ্য খান আতাউর রহমান ও আমজাদ হোসেনের সঙ্গে পত্রিকায় চিঠি চালাচালি করে চলত তর্ক। সেই তর্ক আজও কোথাও কোথাও চলছে না এমন না। মানে মূল আর বিকল্প ধরে যে রাজনীতি ঢাকাই সিনেমায় মেঘ তৈরি করেছে তার শেকড় কতদূর। সেই জায়গায় বোধহয় আলমগীর কবির এগিয়ে গেছেন। জনগণের ভাবভাষা বোঝার ধারাবাহিক কোনো প্রক্রিয়া সেখানে ছিল না। আলমগীর কবিরের পরম্পরা এখনো আছে চলচ্চিত্র আন্দোলন ও প্রশিক্ষণে। সে প্রসঙ্গে সামান্য পরে আসছি। ‘জাতীয়করণের ইশতেহার’ প্রসঙ্গে বোঝা যায় আলমগীর কবিরের লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী। তার সিনেমা প্রচলিত অর্থে সিনেমা নয়। তার জবানিতে এমন উত্তরও মেলে, ‘মানুষের মন এবং মিডিয়ামের মধ্যে একটা সার্থক সংযোগ স্থাপন করতে হবে, সৎ হতে হবে, বাস্তব হতে হবে এবং সবচেয়ে বড় কথা রুচি এবং শিক্ষার পরিচয় বহন করতে হবে। শুধু বিকৃতিবর্জিত ছবিই ভালো [ছবি] নয়, যার সামাজিক মূল্য থাকবে, সেটাই ভালো ছবি।’ (জাতীয় মুক্তি ও চলচ্চিত্র, পৃ. ২২৩)। বর্ণনা পাওয়া যাবে ‘সিনেমা ইন বাংলাদেশ’ বইয়ে। যেখানে ইতিহাস পরম্পরা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র সম্পর্কিত নিজস্ব সংজ্ঞায় হাজির হন। তথ্যচিত্র ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ফারাকই ঘুচিয়ে দেন। যে সব চিন্তা বারবার ঢাকায় আলোচিত হয়েছে, তবে তেমন আলো পড়েনি। আলমগীর কবির বলছেন, “পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের উত্থান মানেই এতকাল ধরে কাহিনী-সৃজনে অত্যাবশ্যক হয়ে থাকা কল্পনাশক্তির অবসান নয়। কল্পনাকে এখানে সূক্ষ্মভাবে একটি ভূমিকায় নিযুক্ত করা হবে; নির্বাচন এবং আয়োজনের কাজে। পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য হয় সত্যকে তুলে ধরা, তাহলে বোধ এবং কল্পনার দায়িত্ব হবে বাস্তবের আবর্তের ধাঁধাময় বিশৃঙ্খলা থেকে সত্যকে ছেঁকে বের করা; কারণ সত্যমাত্রই বাস্তব কিন্তু বাস্তবতার গোটাটাই সত্য নয়। প্রমাণিত হয় যে নির্মাতা অর্থাৎ যিনি সৃষ্টি করেন তার ভূমিকা আগের চেয়ে মহান ছাড়বে না। মানুষের কোনো উদ্যোগই স্ববিরোধমুক্ত হতে পারে না। মানুষের চিন্তা এবং সৃজনশীলতা ক্রমাগত সামনে এগিয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রও এগিয়ে যাবে।”(পৃ. ১১৬) এখন কথা হলো- শুধু সিনেমা বানালে তো চলে না, দরকার- সেই অনুযায়ী দর্শক। আলমগীর কবিরের অর্থে সিনেমাবুঝদার মানুষ। তেমনই উচ্চাভিলাষ ছিল তার। নির্মাণের সমান্তরালে সংগঠিত করার কাজটিও নেন নিজের কাঁধে। ব্রিটেন থেকে ফিরে চলচ্চিত্র সংসদ পাকিস্তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। দু’বছরের মধ্যেই বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ঢাকা সিনে ক্লাব। যা পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র সংসদ। ১৯৬৯ সালে তার সক্রিয় উদ্যোগে চালু হলো ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট, এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রথম পদক্ষেপ বলা চলে একে।
আলমগীর কবিরের স্বাধীনতা-পরবর্তী কর্মযজ্ঞের সাক্ষী প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকার তারেক আহমেদ। তার কথা থেকে জানা যায়, কবিরের পথ অনুসরণ করেই ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সতীশ বাহাদুরকে নিয়ে প্রথমবারের মতো ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স আয়োজন করে। এই সতীশ বাহাদুরই পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে তার দ্বিতীয়বারের সফরে এলে বাংলাদেশে ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার মূল রূপরেখা দিয়ে যান। পরের বছর আর্কাইভের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও মূলত দেশের চলচ্চিত্রমনস্ক তরুণদের সঙ্গে আর্কাইভের কর্মকাণ্ডের সংযোগ ঘটে- যখন পুনরায় আলমগীর কবিরই সেখানে চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ কর্মশালার কার্যক্রম শুরু করলেন। বাংলাদেশে পরবর্তী স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সুপরিচিত কয়েকজনেরই যাত্রা শুরু আলমগীর কবিরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ফিল্ম আর্কাইভের এই কোর্সগুলো থেকে। চলচ্চিত্র বিষয়ক নীতিমালার খসড়াও আসে তার হাত ধরে। এত গেল বিশাল কর্মযজ্ঞের সামান্য ফিরিস্তি। আলমগীর কবিরের উদ্দেশ্যটা ছিল কী?
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, “এখানে সংসদ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যিকারের চলচ্চিত্রের ভাষায় চলচ্চিত্রকে তুলে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে গড়ে তোলা। সংসদ আন্দোলনের প্রথম দিকের উদ্দেশ্য ছিল কিছুসংখ্যক ভালো দর্শক তৈরি করা। তারপর তারা ছবি বোঝে কি না তার জন্য কথোপকথন, সেমিনার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা হয়ে যাওয়ার পর এ দেশের চলচ্চিত্রের ভাষা, আঙ্গিক ইত্যাদিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চলচ্চিত্র সংসদগুলোকে এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম করতে হবে। আমি এভাবেই দেখি।” (চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি, পৃ. ২৫৫) এটা ১৯৭৮ সালের কথা। তারপর কী ঘটেছিল? ততদিনে সরকার ভারতের অনুকরণে চলচ্চিত্রের অনুদান প্রথা চালু করে। মোটামুটি নতুন ও প্রতিশ্রুতিশীল নির্মাতারা অনুদান পেয়েছিলেন। একে কবিরদের এক ধরনের অর্জন তো বলা-ই যায়। তবে কবিরের ভালো ছবির দর্শক নির্মাণের কী হলো? শুনুন এক দশক পরের কথা। বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ আয়োজিত প্রথম জাতীয় কর্মী সমাবেশে আলমগীর কবির বলেন, “ঘটনাপঞ্জির হিসেবে সেদিন এ দেশে চলচ্চিত্র সংসদ বা সিনেক্লাব আন্দোলনের পঁচিশ বছর পার হলো। আরোহণ-অবরোহণের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আন্দোলন যে বর্তমানে একটি মোটামুটি চরম অবরোহণের পর্যায়ে আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। নির্বাচিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মতো প্রাথমিক কার্যক্রমও এখন ভীষণভাবে সংকুচিত। এটা নিশ্চয়ই উদ্বেগের কারণ।” (চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি, পৃ. ২৬৫) এই উদ্যোগ একালে এসে কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে সেটা বিশদ গবেষণার দাবি রাখে। সিনেমা নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া উৎসব দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো স্থান করে নিতে পেরেছে কি না প্রশ্ন! এর অন্যতম কারণ হতে পারে- কলম ও ক্যামেরা দুটি তাক করলেও আলমগীর কবির তার সমকালে সমমাপের সহযাত্রী খুব একটা পাননি। প্রতিভাধর অনেকে ছিলেন না- তা নয়। তেমন লড়াকু আর কি কেউ ছিল? এমন ও হতে পারে খোদ সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে দর্শক তৈরির চিন্তা সবটা শিক্ষকসুলভ ততটা সৃজনীমূলক নয়। আলমগীর কবির ঠেকে ঠেকে শেখেননি এমননি। তার মতো সিনেমা নিয়ে লড়াইটা কে করেছে? এক সাক্ষাৎকারে তারেক মাসুদ বলেছিলেন, “সাংগঠনিক কাজে যে বিরাট সময় গেছে তাতে ব্যক্তি সৃজনশীলতা তো কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছে। তিনি চলচ্চিত্র শিল্পে শুধু যে প্রতিভাবান বা সৃজনশীল ছিলেন সেটা নয়। কতগুলো কম্বিনেশন ছিল তার মধ্যে। আমি বলব বাংলাদেশের আধুনিক চলচ্চিত্রের প্রথম নির্মাতা আলমগীর কবির যিনি এদেশে আধুনিক ধারা প্রবর্তন করেছেন। সেটা করতে পেরেছেন আন্তর্জাতিকভাবে তার ফিল্মিক এক্সপোজার ছিল বলে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে সোসিও-পলিটিক্যাল কনসাসনেস, সেই লেভেলটা বাংলাদেশে তার আগে বা পরে তার মতো করে এসেছে কি না সন্দেহ। আমার মনে হয় না সমাজ তাত্ত্বিকতা এবং চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকতায় আমরা কেউ তাকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছি।” (চলচ্চিত্রকথা/তারেক মাসুদের বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার, পৃ. ৩৭) কথা বলতে বলতে অনেক পথ পেরিয়ে কাদামাখা ভূমিতেই ফিরি যেখানে ধীরে বহে মেঘনা মোহনার অপেক্ষায়। তার অনেকদিন পর তারেকের ‘মাটির ময়না’ ধরে বাংলা ছবি আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে- অনেকেরই মিলিত একটু একটু চেষ্টার ফল একটা বড় ভাঙন। হয়তো অনেকটা সময়ের পর প্রাপ্তি সুখকর নয়। কিন্তু আমরা তো বলতে পারি না- পথ চলায় আমাদের কোনো নির্দেশ ছিল না, যাকে ভুল বলেও শুদ্ধ পথে চলা যায়। বলা যায় আলমগীর কবিরের নাম। যিনি অসামান্য। আর, বাংলাদেশের সিনেমা মানুষের কাছেই ফিরুক। হ্যাঁ, সে চিহ্ন আমরা সমকালে দেখতে পাই। বাংলাদেশের নিজের ভাষার চলচ্চিত্র।