রিদমিকের নিভৃতচারী নির্মাতা
অমৃত মলঙ্গী | ২৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
মুখের ভাষা কাগজে। কাগজ থেকে অন্তর্জালে। দুই লাইনের এই পথ পাড়ি দিতে বয়ে গেছে ইতিহাসের কত অধ্যায়। যার নেপথ্য কারিগর শত শত রথী-মহারথী। বাংলা ভাষাকে কাগজ থেকে কিবোর্ডে আনতে, শহর থেকে গ্রামের তরুণের বুকপকেটে ছড়িয়ে দিতে অনেক বাঙালির অবদান আছে। ফোনে বাংলা ভাষা লেখার মাধ্যমকে জনপ্রিয় করেছেন এমনই একজন, এমন এক বয়সে, যখন তিনি কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে সবে পা রেখেছেন! শামীম হাসনাত। রিদমিকের নির্মাতা। ময়মনসিংহের চরনিলক্ষিয়া গ্রাম থেকে উঠে আসা এই তরুণ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করে বুয়েটে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষে থাকার সময় বানিয়ে ফেলেন ফোনে বাংলা লেখার অ্যাপ রিদমিক কিবোর্ড। অথচ ওই সময় তার অ্যান্ড্রয়েড ফোনই ছিল না!
‘তখন ২০১২ সাল। আমাদের জাভা পড়ানো শুরু হয় ভার্সিটিতে,’ জানুয়ারির শীতের সকালে শামীম হাসনাত তার রিদমিক ল্যাবসে বসে ক্ষণিকের জন্য ফিরে যান সেই পুরনো দিনে, ‘আমাদের সিনিয়র এক ভাই, তিনি একটি সেশন নিয়েছিলেন অ্যান্ড্রয়েডের ওপর। প্রথম দিন ওখানে গেলাম। তিনি দেখালেন কীভাবে কোড লেখে, সেটা কীভাবে ইনস্টল করতে হয়, কীভাবে কনফিগারেশন করতে হয়।’
এরপর লম্বা একটা ছুটিতে বাড়ি গিয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন শামীম, ‘ওই সেশনটার পর আমার আর যাওয়া হয়নি। ক্লাসসহ নানা ব্যস্ততার কারণে সেশনে যোগ দিতে ইচ্ছা করেনি। তখনো আসলে কিবোর্ড তৈরির চিন্তাও আসেনি। এরপর চলে যায় আরও প্রায় তিন মাস।’
‘ছুটিতে বাড়ি যাই। তখন ওই সেশনটার ভিডিও আমার কাছে ছিল। বাড়িতেই জাভা প্র্যাকটিস করছিলাম। প্র্যাকটিসের সঙ্গে দেখার চেষ্টা করলাম কীভাবে ইংলিশ থেকে বাংলায় কনভার্ট করা যায়। এটা কয়েক দিনের ভেতর হয়ে গেল। কোড দিয়ে কীভাবে বাংলা লেখা যায়, আমার জানা ছিল না। তখন খুবই সাধারণত একটা কনভার্টার তৈরি করলাম। ইংলিশ থেকে বাংলা হয়। খুবই সিম্পল ছিল। কঠিন শব্দগুলো সংযুক্ত করা যেত না। এটুকু করার পর মনে হলো কিবোর্ড তৈরি করা যায় কি না। সংযুক্ত বা যেসব বিশেষ শব্দ আছে, যেমন রেফ, য-ফলা সেগুলো পরে করার চিন্তা ছিল।’
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সেই দিনগুলোতে শামীমের নিজের অ্যান্ড্রয়েড ফোন ছিল না। কিন্তু কৌতূহল ছিল তুমুল। কম্পিউটারে সহজে অভ্র দিয়ে বাংলা লেখার ব্যাপারটি তাকে অভিভূত করেছিল। অ্যান্ড্রয়েডের ব্যাপারে আগ্রহ থাকায় কীভাবে অ্যান্ড্রয়েড বাংলা লেখে সে ব্যাপারেও কৌতূহল কাজ করত। এক দিন গুগলে সার্চ দিয়ে মায়াবী নামে একটা কিবোর্ড পেলেন। এটি সেই সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল।
‘আমার ইচ্ছা ছিল ফোন কিনে আমি ওটা ইনস্টল করব। তখন দেখলাম আরও কয়েকজনের ফোনে ওটা আছে। কিন্তু ব্যবহার করার সময় নিচে বিজ্ঞাপন আসে। এভাবে ব্যবহার করতে ভালো লাগে না।’
নিজে অ্যাপ তৈরি করে সেটি প্লে-স্টোরে ছাড়ার চিন্তা মাথায় আসেনি শুরুতে শামীমের। তৈরি করার পর নিজের বড় ভাইকে দেন। তিনি ব্যবহার করার পর বলেন, ‘এটা তো খুবই ভালো হয়েছে। প্লে-স্টোরে দেওয়া যায়।’ পরে তিনিই প্লে-স্টোরে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেন।
কিছু করেই হাতেনাতে সফলতা পাওয়া যায় না। তবে মানসিক শক্তি রেখে চললে সাফল্য যে আসেই শামীম সেটি মাসখানেকের ভেতর বুঝতে পারেন, ‘প্রথমদিকে খুব একটা ডাউনলোড হতো না। তখন মানুষের মোবাইলও কম ছিল। তবে দ্রুত বাড়ছিল। প্রথম মাসে এক হাজারের মতো ছিল। এরপর অনেকেই যোগাযোগ করলেন। ধীরে ধীরে দারুণ সাড়া পেলাম।’
‘কী কী উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে অন্যরা বলতে থাকলেন। সবার পরামর্শ নিয়ে আমিও পরিবর্তন করতে থাকলাম। সব মিলিয়ে আজকের জায়গায়।’
মায়াবী কিবোর্ড আর রিদমিকের ভেতর কী পার্থক্য? এমন প্রশ্নের জবাবে শামীম বলেন, ‘মায়াবীতে প্রথমে ইংলিশ টু বাংলা হতো একটা, আরেকটি ছিল ফিক্সড কিবোর্ড। ক, খ, অ... এগুলো লেখা ছিল। আমি ইংলিশ থেকে বাংলা করার পর মনে হলো কীভাবে ফিক্সড লে-আউট করা যায়। তখন দেখলাম এ ধরনের প্রচলিত কয়েকটি আছে, যেমন বিজয়, ইউনিজয় ও প্রভাত। এগুলো দেখার পর মনে হলো নতুন করে না করে এগুলো একটা দিই, যেগুলো প্রচলিত। শুরুতে ছিল ইউনিজয় ও জাতীয়। মায়াবীর সঙ্গে পার্থক্য বলতে ওখানে ছিল ইংলিশ টু বাংলা এবং আরেকটা ফিক্সড। এখানে ইংলিশ টু বাংলা এবং প্রচলিত একটা লে-আউট।’‘আরেকটা বিষয় হচ্ছে সহজে সুইচ করা। আমি সব সময় চেষ্টা করেছি কিবোর্ডের বাটনগুলো যেন সুন্দর লে-আউটে থাকে, ব্যবহার করতে মানুষের ভালো লাগে। একটা ছোট, একটা বড়, ওপরে দশটা, নিচে সাতটা এমন যেন না হয়। অনেক কিবোর্ডে আবার নিচের দিকে ছোট-বড় উল্টাপাল্টা থাকে। আমার চেষ্টা ছিল সুন্দর একটা সামঞ্জস্য রাখা। বাম পাশেরটা বড় হলে, একদম শেষে ডান পাশেরটাও বড় হবে। স্পেসের ঠিক পাশেরটা যদি ছোট হয়, তাহলে শেষদিকের পাশেরটাও ছোট হবে। মানে কিবোর্ডের সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইনি।’ কিন্তু শামীম সমস্যায় পড়েন সুইচ করার বাটন অ্যাড করতে গিয়ে। সেটি দিতে গেলে সামঞ্জস্য নষ্ট হচ্ছিল। তখন চিন্তা করলেন কীভাবে এটা সহজ করা যায়। এরপর নিয়ে আসেন স্পেস বাটনে সোয়াইপ করে পরিবর্তন করার সিস্টেম, যা মানুষ পছন্দ করেছে।
২০১৫ সালের মার্চে কপিরাইটের কারণে রিদমিক কিছুটা বিপাকে পড়ে। ওই সময় বিজয় কিবোর্ডের স্বত্বাধিকারী এবং আনন্দ কম্পিউটারসের অভিযোগের ভিত্তিতে গুগল তাদের প্লে-স্টোর থেকে রিদমিক অপসারণ করে। তবু দমে যাননি শামীম হাসনাত। অল্প সময়ের ভেতর আবার রিদমিককে গুগল প্লে-স্টোরে নিয়ে আসেন। ওই সময় ‘ইউনিজয়’ কিবোর্ড লে-আউট সরিয়ে ফেলা হয়। নতুন করে এতে যুক্ত করেন ‘প্রভাত’ লে-আউট। সঙ্গে ছিল বেশ কিছু থিম।
‘গুগলে অভিযোগ দেওয়ার পর আমাদেরটা সরিয়ে দেওয়া হয়। আমরা তখন ইউনিজয় লে-আউট ব্যবহার করেছিলাম। এ কারণেই তিনি অভিযোগ করেন।’
অন্যরা কিবোর্ড বানিয়ে যেখানে টাকা আয় করেছেন, শামীম হাসনাত সেখানে কেবল নিজের তৈরি অ্যাপটাই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, ‘আমার কিবোর্ডে কোনো বিজ্ঞাপন নেই। মোবাইল কিবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিলে মানুষ খুব বেশি দিন ব্যবহার করতে চাইবে না। মোবাইলে বাংলা লেখা এমনিতেই একটু কঠিন, সেখানে মানুষের আগ্রহ নষ্ট করতে চাইনি।’
রিদমিক কিবোর্ড অ্যাপ থেকে কোনো আয় হয় না বলে এর পেছনে লোকবল নিয়োগ করেননি শামীম। কাজ করছেন একাই। তাই মাঝে মাঝে আপডেট দিতে দেরি হয়।
‘অক্টোবর, ২০১৯ ভার্সন’ নিয়ে শামীম জানান, এখন দৈনিক ব্যবহারকারী ৬৭ লাখ। মাসিক ১ কোটি ১০ লাখ। প্রতি ৩০ মিনিটে ১০ লাখের বেশি! আগের ভার্সনসহ মোট ব্যবহারকারী সাড়ে তিন কোটি!
রিদমিক ল্যাবস থেকে কিবোর্ডের পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করছেন শামীম, “আমরা ‘বইটই’ করেছি। এখানে বাংলা ই-বুক পড়া যায় এবং কেনা যায়। করেছি রিদমিক নিউজ। এখানে আপনি বিভিন্ন জনপ্রিয় নিউজের সারাংশ পড়তে পারবেন। সেটি পছন্দ হলে পুরো নিউজ পড়া যাবে।”
আজকের দিনে তরুণরা যেখানে পড়ালেখা শেষ করেই সরকারি চাকরির কথা ভাবেন, শামীম সেখানে নিজের প্রযুক্তি জ্ঞান কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। অকপটে বলে গেলেন, ‘যতটুকু মনে পড়ে আমি কখনো সরকারি চাকরি নিয়ে ভাবিনি। এখনো ভাবি না।’
শামীম শুধু বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করছেন না। চাকমা ভাষাভাষী মানুষের জন্য চাকমা ভাষার কিবোর্ড তৈরি করছেন, ‘অনেকে বলে চাকমা ভাষার মানুষদের জন্য কিবোর্ড তৈরি করতে। ওদের নিজস্ব একটা ফন্ট আছে। ওটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। কাজটি প্রায় শেষ।’
তারপর? তারপর শামীম বদলে দিতে যান প্লে-স্টোরে বাংলাদেশি অ্যাপের ‘চরিত্র’। এটাই এখন তার পরিকল্পনা। শামীমের কথায়, ‘প্লে-স্টোরে গিয়ে দেখবেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বাংলাদেশের অ্যাপগুলোর অবস্থা খুবই বাজে। বাজে বাজে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এই জায়গায় আমি পরিবর্তন আনতে চাই। আমাদের ফোকাস হচ্ছে কিছু ভালো অ্যাপ তৈরি করা। যেগুলো ব্যবহার করে মানুষ আনন্দ পাবেন। তারা ব্যবহার করে যেন বুঝতে পারেন এগুলো যত্নে নিয়ে করা হয়েছে।’
অনেক অনুরোধের পর রিদমিক কিবোর্ড আর ল্যাবের এই গল্প শোনাতে রাজি হন প্রচারবিমুখ শামীম। আলাপের শেষদিকে এই প্রসঙ্গ উঠতেই ‘ভেতরের শামীম’কে নিয়ে আসেন প্রকাশ্যে, ‘আমার প্রচার হলে লাভ কী বলেন! আমি কী তৈরি করেছি সেটা ব্যবহার করলে বরং আমাদের সবার লাভ। আমি যে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচারবিমুখ, এমন নয়।’ তাহলে কী?
এক কথায় শামীমের উত্তর, এভাবে থাকতেই পছন্দ করি!
শেয়ার করুন
অমৃত মলঙ্গী | ২৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

মুখের ভাষা কাগজে। কাগজ থেকে অন্তর্জালে। দুই লাইনের এই পথ পাড়ি দিতে বয়ে গেছে ইতিহাসের কত অধ্যায়। যার নেপথ্য কারিগর শত শত রথী-মহারথী। বাংলা ভাষাকে কাগজ থেকে কিবোর্ডে আনতে, শহর থেকে গ্রামের তরুণের বুকপকেটে ছড়িয়ে দিতে অনেক বাঙালির অবদান আছে। ফোনে বাংলা ভাষা লেখার মাধ্যমকে জনপ্রিয় করেছেন এমনই একজন, এমন এক বয়সে, যখন তিনি কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে সবে পা রেখেছেন! শামীম হাসনাত। রিদমিকের নির্মাতা। ময়মনসিংহের চরনিলক্ষিয়া গ্রাম থেকে উঠে আসা এই তরুণ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করে বুয়েটে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষে থাকার সময় বানিয়ে ফেলেন ফোনে বাংলা লেখার অ্যাপ রিদমিক কিবোর্ড। অথচ ওই সময় তার অ্যান্ড্রয়েড ফোনই ছিল না!
‘তখন ২০১২ সাল। আমাদের জাভা পড়ানো শুরু হয় ভার্সিটিতে,’ জানুয়ারির শীতের সকালে শামীম হাসনাত তার রিদমিক ল্যাবসে বসে ক্ষণিকের জন্য ফিরে যান সেই পুরনো দিনে, ‘আমাদের সিনিয়র এক ভাই, তিনি একটি সেশন নিয়েছিলেন অ্যান্ড্রয়েডের ওপর। প্রথম দিন ওখানে গেলাম। তিনি দেখালেন কীভাবে কোড লেখে, সেটা কীভাবে ইনস্টল করতে হয়, কীভাবে কনফিগারেশন করতে হয়।’
এরপর লম্বা একটা ছুটিতে বাড়ি গিয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন শামীম, ‘ওই সেশনটার পর আমার আর যাওয়া হয়নি। ক্লাসসহ নানা ব্যস্ততার কারণে সেশনে যোগ দিতে ইচ্ছা করেনি। তখনো আসলে কিবোর্ড তৈরির চিন্তাও আসেনি। এরপর চলে যায় আরও প্রায় তিন মাস।’
‘ছুটিতে বাড়ি যাই। তখন ওই সেশনটার ভিডিও আমার কাছে ছিল। বাড়িতেই জাভা প্র্যাকটিস করছিলাম। প্র্যাকটিসের সঙ্গে দেখার চেষ্টা করলাম কীভাবে ইংলিশ থেকে বাংলায় কনভার্ট করা যায়। এটা কয়েক দিনের ভেতর হয়ে গেল। কোড দিয়ে কীভাবে বাংলা লেখা যায়, আমার জানা ছিল না। তখন খুবই সাধারণত একটা কনভার্টার তৈরি করলাম। ইংলিশ থেকে বাংলা হয়। খুবই সিম্পল ছিল। কঠিন শব্দগুলো সংযুক্ত করা যেত না। এটুকু করার পর মনে হলো কিবোর্ড তৈরি করা যায় কি না। সংযুক্ত বা যেসব বিশেষ শব্দ আছে, যেমন রেফ, য-ফলা সেগুলো পরে করার চিন্তা ছিল।’
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সেই দিনগুলোতে শামীমের নিজের অ্যান্ড্রয়েড ফোন ছিল না। কিন্তু কৌতূহল ছিল তুমুল। কম্পিউটারে সহজে অভ্র দিয়ে বাংলা লেখার ব্যাপারটি তাকে অভিভূত করেছিল। অ্যান্ড্রয়েডের ব্যাপারে আগ্রহ থাকায় কীভাবে অ্যান্ড্রয়েড বাংলা লেখে সে ব্যাপারেও কৌতূহল কাজ করত। এক দিন গুগলে সার্চ দিয়ে মায়াবী নামে একটা কিবোর্ড পেলেন। এটি সেই সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল।
‘আমার ইচ্ছা ছিল ফোন কিনে আমি ওটা ইনস্টল করব। তখন দেখলাম আরও কয়েকজনের ফোনে ওটা আছে। কিন্তু ব্যবহার করার সময় নিচে বিজ্ঞাপন আসে। এভাবে ব্যবহার করতে ভালো লাগে না।’
নিজে অ্যাপ তৈরি করে সেটি প্লে-স্টোরে ছাড়ার চিন্তা মাথায় আসেনি শুরুতে শামীমের। তৈরি করার পর নিজের বড় ভাইকে দেন। তিনি ব্যবহার করার পর বলেন, ‘এটা তো খুবই ভালো হয়েছে। প্লে-স্টোরে দেওয়া যায়।’ পরে তিনিই প্লে-স্টোরে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেন।
কিছু করেই হাতেনাতে সফলতা পাওয়া যায় না। তবে মানসিক শক্তি রেখে চললে সাফল্য যে আসেই শামীম সেটি মাসখানেকের ভেতর বুঝতে পারেন, ‘প্রথমদিকে খুব একটা ডাউনলোড হতো না। তখন মানুষের মোবাইলও কম ছিল। তবে দ্রুত বাড়ছিল। প্রথম মাসে এক হাজারের মতো ছিল। এরপর অনেকেই যোগাযোগ করলেন। ধীরে ধীরে দারুণ সাড়া পেলাম।’
‘কী কী উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে অন্যরা বলতে থাকলেন। সবার পরামর্শ নিয়ে আমিও পরিবর্তন করতে থাকলাম। সব মিলিয়ে আজকের জায়গায়।’
মায়াবী কিবোর্ড আর রিদমিকের ভেতর কী পার্থক্য? এমন প্রশ্নের জবাবে শামীম বলেন, ‘মায়াবীতে প্রথমে ইংলিশ টু বাংলা হতো একটা, আরেকটি ছিল ফিক্সড কিবোর্ড। ক, খ, অ... এগুলো লেখা ছিল। আমি ইংলিশ থেকে বাংলা করার পর মনে হলো কীভাবে ফিক্সড লে-আউট করা যায়। তখন দেখলাম এ ধরনের প্রচলিত কয়েকটি আছে, যেমন বিজয়, ইউনিজয় ও প্রভাত। এগুলো দেখার পর মনে হলো নতুন করে না করে এগুলো একটা দিই, যেগুলো প্রচলিত। শুরুতে ছিল ইউনিজয় ও জাতীয়। মায়াবীর সঙ্গে পার্থক্য বলতে ওখানে ছিল ইংলিশ টু বাংলা এবং আরেকটা ফিক্সড। এখানে ইংলিশ টু বাংলা এবং প্রচলিত একটা লে-আউট।’‘আরেকটা বিষয় হচ্ছে সহজে সুইচ করা। আমি সব সময় চেষ্টা করেছি কিবোর্ডের বাটনগুলো যেন সুন্দর লে-আউটে থাকে, ব্যবহার করতে মানুষের ভালো লাগে। একটা ছোট, একটা বড়, ওপরে দশটা, নিচে সাতটা এমন যেন না হয়। অনেক কিবোর্ডে আবার নিচের দিকে ছোট-বড় উল্টাপাল্টা থাকে। আমার চেষ্টা ছিল সুন্দর একটা সামঞ্জস্য রাখা। বাম পাশেরটা বড় হলে, একদম শেষে ডান পাশেরটাও বড় হবে। স্পেসের ঠিক পাশেরটা যদি ছোট হয়, তাহলে শেষদিকের পাশেরটাও ছোট হবে। মানে কিবোর্ডের সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইনি।’ কিন্তু শামীম সমস্যায় পড়েন সুইচ করার বাটন অ্যাড করতে গিয়ে। সেটি দিতে গেলে সামঞ্জস্য নষ্ট হচ্ছিল। তখন চিন্তা করলেন কীভাবে এটা সহজ করা যায়। এরপর নিয়ে আসেন স্পেস বাটনে সোয়াইপ করে পরিবর্তন করার সিস্টেম, যা মানুষ পছন্দ করেছে।
২০১৫ সালের মার্চে কপিরাইটের কারণে রিদমিক কিছুটা বিপাকে পড়ে। ওই সময় বিজয় কিবোর্ডের স্বত্বাধিকারী এবং আনন্দ কম্পিউটারসের অভিযোগের ভিত্তিতে গুগল তাদের প্লে-স্টোর থেকে রিদমিক অপসারণ করে। তবু দমে যাননি শামীম হাসনাত। অল্প সময়ের ভেতর আবার রিদমিককে গুগল প্লে-স্টোরে নিয়ে আসেন। ওই সময় ‘ইউনিজয়’ কিবোর্ড লে-আউট সরিয়ে ফেলা হয়। নতুন করে এতে যুক্ত করেন ‘প্রভাত’ লে-আউট। সঙ্গে ছিল বেশ কিছু থিম।
‘গুগলে অভিযোগ দেওয়ার পর আমাদেরটা সরিয়ে দেওয়া হয়। আমরা তখন ইউনিজয় লে-আউট ব্যবহার করেছিলাম। এ কারণেই তিনি অভিযোগ করেন।’
অন্যরা কিবোর্ড বানিয়ে যেখানে টাকা আয় করেছেন, শামীম হাসনাত সেখানে কেবল নিজের তৈরি অ্যাপটাই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, ‘আমার কিবোর্ডে কোনো বিজ্ঞাপন নেই। মোবাইল কিবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিলে মানুষ খুব বেশি দিন ব্যবহার করতে চাইবে না। মোবাইলে বাংলা লেখা এমনিতেই একটু কঠিন, সেখানে মানুষের আগ্রহ নষ্ট করতে চাইনি।’
রিদমিক কিবোর্ড অ্যাপ থেকে কোনো আয় হয় না বলে এর পেছনে লোকবল নিয়োগ করেননি শামীম। কাজ করছেন একাই। তাই মাঝে মাঝে আপডেট দিতে দেরি হয়।
‘অক্টোবর, ২০১৯ ভার্সন’ নিয়ে শামীম জানান, এখন দৈনিক ব্যবহারকারী ৬৭ লাখ। মাসিক ১ কোটি ১০ লাখ। প্রতি ৩০ মিনিটে ১০ লাখের বেশি! আগের ভার্সনসহ মোট ব্যবহারকারী সাড়ে তিন কোটি!
রিদমিক ল্যাবস থেকে কিবোর্ডের পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করছেন শামীম, “আমরা ‘বইটই’ করেছি। এখানে বাংলা ই-বুক পড়া যায় এবং কেনা যায়। করেছি রিদমিক নিউজ। এখানে আপনি বিভিন্ন জনপ্রিয় নিউজের সারাংশ পড়তে পারবেন। সেটি পছন্দ হলে পুরো নিউজ পড়া যাবে।”
আজকের দিনে তরুণরা যেখানে পড়ালেখা শেষ করেই সরকারি চাকরির কথা ভাবেন, শামীম সেখানে নিজের প্রযুক্তি জ্ঞান কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। অকপটে বলে গেলেন, ‘যতটুকু মনে পড়ে আমি কখনো সরকারি চাকরি নিয়ে ভাবিনি। এখনো ভাবি না।’
শামীম শুধু বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করছেন না। চাকমা ভাষাভাষী মানুষের জন্য চাকমা ভাষার কিবোর্ড তৈরি করছেন, ‘অনেকে বলে চাকমা ভাষার মানুষদের জন্য কিবোর্ড তৈরি করতে। ওদের নিজস্ব একটা ফন্ট আছে। ওটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। কাজটি প্রায় শেষ।’
তারপর? তারপর শামীম বদলে দিতে যান প্লে-স্টোরে বাংলাদেশি অ্যাপের ‘চরিত্র’। এটাই এখন তার পরিকল্পনা। শামীমের কথায়, ‘প্লে-স্টোরে গিয়ে দেখবেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বাংলাদেশের অ্যাপগুলোর অবস্থা খুবই বাজে। বাজে বাজে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এই জায়গায় আমি পরিবর্তন আনতে চাই। আমাদের ফোকাস হচ্ছে কিছু ভালো অ্যাপ তৈরি করা। যেগুলো ব্যবহার করে মানুষ আনন্দ পাবেন। তারা ব্যবহার করে যেন বুঝতে পারেন এগুলো যত্নে নিয়ে করা হয়েছে।’
অনেক অনুরোধের পর রিদমিক কিবোর্ড আর ল্যাবের এই গল্প শোনাতে রাজি হন প্রচারবিমুখ শামীম। আলাপের শেষদিকে এই প্রসঙ্গ উঠতেই ‘ভেতরের শামীম’কে নিয়ে আসেন প্রকাশ্যে, ‘আমার প্রচার হলে লাভ কী বলেন! আমি কী তৈরি করেছি সেটা ব্যবহার করলে বরং আমাদের সবার লাভ। আমি যে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচারবিমুখ, এমন নয়।’ তাহলে কী?
এক কথায় শামীমের উত্তর, এভাবে থাকতেই পছন্দ করি!