বইয়ের বাতিঘর
আলমগীর নিষাদ | ২৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, বাংলাদেশে বইয়ের বিপণন নতুন মাত্রা পেয়েছে দীপঙ্কর দাশের হাত ধরে। বাংলা বাজারের বাইরে একসময় বাংলাদেশের বইয়ের প্রধান কেন্দ্র ছিল নিউমার্কেট, নীলক্ষেত আর আজিজ সুপার মার্কেট। এ শতকের প্রথম দশকের গোড়ায় একের পর এক বন্ধ হতে থাকে আজিজের দোকানগুলো। নীলক্ষেত হয়ে ওঠে জনপ্রিয়ধারার বইয়ের মার্কেট। বইয়ের দোকান বন্ধ হওয়ার পর হুমকির মুখে পড়ে শাহবাগ কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক তৎপরতাই। কিন্তু অচিরে সেই শূন্যতা পূরণ করেন দীপঙ্কর।
আজিজ আর নীলক্ষেতের বইয়ের পুরো ভাণ্ডারই তুলে আনেন তার স্বপ্নের বাতিঘরে। বাংলা মোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের আট তলায় পাঁচ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন এই বইয়ের দোকান। কেবল বইপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা নয়, দীপঙ্কর ভেঙে দেন বই বিপণনের প্রাচীন ধারণাও। তৈরি করেন পাঠক-ক্রেতাবান্ধব এক গ্রন্থস্থান। যেখানে একজন ক্রেতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবস্থান করতে পারেন। চা পান করে, বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করতে করতে খুঁজতে পারেন বই। অথবা এসির আরামে বসে কেবল আড্ডা দিয়ে ফিরেও যেতে পারেন। পাবলিক লাইব্রেরির মতো এখানে দীর্ঘসময় বই পড়তে বা নোট নিতেও দেখা যায় অনেককে। ক্রেতা-পাঠকের জন্য এ ধরনের অনুকূল পরিবেশ এ শহরে আগে ছিল না। লেখক-পাঠক-সমালোচকের মিলনমেলায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে দীপঙ্করের বইয়ের দোকান হয়ে ওঠে এ শহরের ‘বাতিঘর’।
দীপঙ্করের স্বপ্নযাত্রার শুরু ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড়ের ১০০ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান থেকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক আন্দোলনের নিবেদিত কর্মী হিসেবে, পাঠকের চাহিদার তাড়নাই তাকে নিয়ে আসে বই বিপণনের এ দুনিয়ায়। তার অভিজ্ঞতায় একদিকে ছিল সারা দেশে বইয়ের দোকানের শুকিয়ে মরার দৃশ্য। আরেকদিকে ছিল পাঠকের প্রয়োজনীয় বইটি কোথাও খুঁজে না পাওয়ার হাহাকার। প্রকাশক, বিক্রেতা ও ক্রেতারা যেন পরস্পর বিচ্ছিন্ন বর্তুলাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মহাশূন্যে।
পারস্পরিক এই দূরতিক্রম্যের কারণ অনুসন্ধান এবং তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করাই হয়ে ওঠে দীপঙ্কর দাশের অভীষ্ট। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পাঠক-ক্রেতার চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে গড়ে তোলেন সেতু। চট্টগ্রাম থেকে বাতিঘর ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা ও সিলেটে। চেরাগী পাহাড় মোড়ের ১০০ স্কয়ার ফুট থেকে তা এখন পরিণত হয়েছে ১০ হাজার স্কয়ার ফুটের তিনটি দোকানে।
যে ভাবে ভাবা হয়েছিল চেরাগী পাহাড়ের বাতিঘর, এর চেয়েও দ্রুত সাড়া ফেলে চট্টগ্রামে। প্রতিদিন কাছে-দূরে থেকে আসতে থাকেন অনেক পাঠক। তাদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খায় দীপঙ্করের অল্প পুঁজি ও ক্ষুদ্র আয়তনের পসরা। একপর্যায়ে ২০১২ সালে বিশালাকারে বাতিঘর উঠে আসে চট্টগ্রামের প্রেস ক্লাব ভবনের নিচতলায়।
তিন হাজার স্কয়ার ফুট জায়গা নিয়ে পুরনো জাহাজের নকশায় ঢেলে সাজানো হয় বাতিঘর। সেখানে ক্রমেই বাড়তে থাকে লেখক-পাঠক-ক্রেতার জমায়েত। ঢাকা-কলকাতা থেকে বড় বড় লেখক-সমালোচক আসেন, চলে সভা-সেমিনার-বিতর্ক। চট্টগ্রামের পাঠক-চিন্তকদের জন্য তা যেন এক অনির্বচনীয় জাগরণকাল। নতুনধারার সেই বইয়ের দোকানটি হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের নয়া
সংস্কৃতির বাতিঘর।
এরপর দীপঙ্কর দাশকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একে একে বিশালাকারে বাতিঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা ও সিলেটে। ঢাকায় বাতিঘর আসে ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে সিলেটে। সিলেটে জিন্দাবাজারের গোল্ডেন সিটি কমপ্লেক্সের দোতলায় দুই হাজার স্কয়ার ফুটের বাতিঘরটিও নির্মিত হয়েছে স্থানীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। সাজানো হয়েছে চা বাগান, আলি আমজদের ঘড়ি ও কিনব্রিজের নকশায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মিলিয়ে বাতিঘরের দৈনিক পাঠকের সংখ্যা এখন প্রায় পাঁচ হাজার আর ক্রেতার সংখ্যা গড়ে এক হাজার জন।
ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের আটতলায় মুঘল স্থাপনা বিশেষত লালবাগ কেল্লার আদলে পাঁচ হাজার স্কয়ার ফুটের দোকানে প্রতিদিন ভিড় করেন প্রায় ১৫০০ পাঠক। তাদের মধ্যে বই কেনেন প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নানা কর্মসূচি ও অডিটোরিয়ামে চলতে থাকা বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানের সুবাদেও বাতিঘরে প্রতিদিন আগমন ঘটে অনেক শিল্পানুরাগীর। বাতিঘরের অতিথিপরায়ণ বিপণন-নীতির কারণে মুঘলাই আটতলাটি এখন ঢাকার লেখক, পাঠক ও
সংস্কৃতিকর্মীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
বাতিঘরকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া আন্দোলন-জাত বলেই মনে করেন দীপঙ্কর দাশ। তিনি মনে করেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সংস্পর্শে না এলে তার মধ্যে গ্রন্থ বিপণনের এই উদ্যোগ হয়তো আসত না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক আন্দোলনের অভিজ্ঞতাই শেষ পর্যন্ত তাকে এই ব্যবসায় যুক্ত করেছে। দীপঙ্কর এখন স্বপ্ন দেখেন, দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর, এরপর সম্ভব হলে প্রতি জেলায় একটি করে বাতিঘর গড়ে তোলার।
১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দীপঙ্কর দাশ বলেন, বাংলাদেশে বই বিপণনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু মৌলিক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধানত, প্রকাশক ও বিক্রেতার মাঝখানে পরিবেশক পদ্ধতি এ দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশ্বের সর্বত্র প্রকাশক ও বিক্রেতার মধ্যে মধ্যস্থতার দায়িত্ব পালন করেন পরিবেশকরা। পেঙ্গুইনের মতো বড় বড় প্রকাশনার কোনো নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র নেই। ভারতেও অনেক পরিবেশক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রকাশকরাই একাধারে পরিবেশক ও গ্রন্থ বিক্রেতা। বই-প্রকাশক ছাড়া আর কোনো উৎপাদকই নিজেদের পণ্য এভাবে বিক্রি করেন না। বইমেলা এলে যে কারণে বই প্রকাশের তোড়জোড় শুরু হয়। বই এখানে একটি মৌসুমি ব্যবসা। সারা বছরের কাজ নয় বলে এটি ইন্ডাস্ট্রিও হতে পারেনি। এসব কারণে এখানে শক্তিশালী বই-বিপণন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
কখন কোন বই প্রকাশ হলো বা কোন বই আসছে, এসব খবর বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেন না আমাদের প্রকাশকরা। আধুনিক ডেটাবেইস থেকে শুরু করে বিক্রেতা ও পাঠকের কাছে তথ্য পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা নেই বেশির ভাগের। অধিকাংশ প্রকাশনারই আসলে কোনো সাজানো সিস্টেম নেই। অন্যদিকে, আমাদের বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোও পাঠক-রুচির বিভিন্নতার সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম হচ্ছে না। এ কারণেই দেখা যায়, একদিকে বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পাঠক বই খুঁজে পাচ্ছেন না। পাড়ার মুদি দোকানগুলো সুপারশপে পরিণত হলেও, আমাদের গ্রন্থ বিক্রেতারা এই ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। আধুনিক বিপণনব্যবস্থার সুযোগগুলো সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না অধিকাংশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে গ্রন্থ খাত চলছে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের মতো করে।
বইপাঠ বিষয়ে একটি বড় সামাজিক-রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতার কথাও তোলেন দীপঙ্কর দাশ। বলেন, বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও সচেতনতা আগের চেয়ে বহু গুণ বেড়েছে এ কথা সত্য, কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা পাঠকবান্ধব নয়। শিশুর কাঁধে বইয়ের বোঝা ও ফলাফলদৌড়ে ভিত্তিই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গ্রন্থপাঠের সংস্কৃতি। ফলে, অভিভাবক-শিক্ষকের আগ্রহ ও সামাজিক সচেতনতার পরও এ দেশে আশানুরূপ ‘পাঠকসমাজ’ গড়ে উঠছে না।
গ্রন্থ খাতে সরকারি প্রণোদনার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন দীপঙ্কর দাশ। তার মতে, অনেক শিল্প খাতকে এগিয়ে নিতে সাবসিডি দেওয়া হয়, কিন্তু গ্রন্থ খাত নিয়ে সেভাবে ভাবা হচ্ছে না। অথচ এটি অন্য বাণিজ্যিক পণ্যের চেয়ে ভীষণভাবেই আলাদা। বই বিপণনের বাজার ও লাভের হারও অন্য যেকোনো পণ্যের তুলনায় কম। ফলে ব্যবসার দিক থেকে খাতটি আকর্ষণীয় হতে পারছে না। এমনকি সুপার শপের দোকান ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভ্যাট দিতে হয় গ্রন্থ ব্যবসায়ীদের। বইকে অন্য বাণিজ্যিক পণ্যের কাতারে না ফেলে একে শিল্পপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা দরকার আছে বলে মনে করেন তিনি।
এসব চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাংলাদেশে বই বিপণনে নবযুগের সূচনা করতে চান দীপঙ্কর। শুরু থেকেই তিনি আধুনিক পরিচালন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। দেশি ও বিদেশি প্রকাশনার সঙ্গে নিয়মিত আদান-প্রদানসহ পাঠকের কাছে বইয়ের খবর পৌঁছে দিতেও বাতিঘরের তৎপরতা লক্ষণীয়। একই সঙ্গে তিনি শুরু করেছেন বই পরিবেশনার কাজও, অপেক্ষা কেবল কাঠামো গড়ে তোলার। ইতিমধ্যে দেশের প্রকাশকরা বাতিঘরের মতো বই বিক্রয় কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করেছেন। অনেকেই নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বাতিঘরের সঙ্গে।
দীপঙ্কর দাশের সামনে এখন অনেক কাজ। শিগগির চালু করতে চান অনলাইন বিক্রয় সার্ভিস। এরই মধ্যে শুরু করেছেন ফেইসবুক, মেইল বা টেলিফোনে বইয়ের অর্ডার নেওয়ার কাজ। সারা দেশে একটি রিডার সোসাইটি গড়ে তুলতে চান তিনি। সব বিভাগীয় শহরে করতে চান একটি করে বাতিঘর। যেখানে থাকবে লেখক-পাঠক কর্নার। চলবে বই নিয়ে নিয়মিত আলোচনা। দীপঙ্কর বলেন, লেখকদের স্টার ভ্যালুজ নির্মাণের দায়িত্বও নিতে হবে প্রকাশক, পরিবেশক ও বিক্রেতাদের। আধুনিক বই বিপণনব্যবস্থা গড়তে হলে এর একটাকেও বাদ দিয়ে হবে না।
শেয়ার করুন
আলমগীর নিষাদ | ২৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, বাংলাদেশে বইয়ের বিপণন নতুন মাত্রা পেয়েছে দীপঙ্কর দাশের হাত ধরে। বাংলা বাজারের বাইরে একসময় বাংলাদেশের বইয়ের প্রধান কেন্দ্র ছিল নিউমার্কেট, নীলক্ষেত আর আজিজ সুপার মার্কেট। এ শতকের প্রথম দশকের গোড়ায় একের পর এক বন্ধ হতে থাকে আজিজের দোকানগুলো। নীলক্ষেত হয়ে ওঠে জনপ্রিয়ধারার বইয়ের মার্কেট। বইয়ের দোকান বন্ধ হওয়ার পর হুমকির মুখে পড়ে শাহবাগ কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক তৎপরতাই। কিন্তু অচিরে সেই শূন্যতা পূরণ করেন দীপঙ্কর।
আজিজ আর নীলক্ষেতের বইয়ের পুরো ভাণ্ডারই তুলে আনেন তার স্বপ্নের বাতিঘরে। বাংলা মোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের আট তলায় পাঁচ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন এই বইয়ের দোকান। কেবল বইপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা নয়, দীপঙ্কর ভেঙে দেন বই বিপণনের প্রাচীন ধারণাও। তৈরি করেন পাঠক-ক্রেতাবান্ধব এক গ্রন্থস্থান। যেখানে একজন ক্রেতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবস্থান করতে পারেন। চা পান করে, বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করতে করতে খুঁজতে পারেন বই। অথবা এসির আরামে বসে কেবল আড্ডা দিয়ে ফিরেও যেতে পারেন। পাবলিক লাইব্রেরির মতো এখানে দীর্ঘসময় বই পড়তে বা নোট নিতেও দেখা যায় অনেককে। ক্রেতা-পাঠকের জন্য এ ধরনের অনুকূল পরিবেশ এ শহরে আগে ছিল না। লেখক-পাঠক-সমালোচকের মিলনমেলায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে দীপঙ্করের বইয়ের দোকান হয়ে ওঠে এ শহরের ‘বাতিঘর’।
দীপঙ্করের স্বপ্নযাত্রার শুরু ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড়ের ১০০ স্কয়ার ফুটের একটি দোকান থেকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক আন্দোলনের নিবেদিত কর্মী হিসেবে, পাঠকের চাহিদার তাড়নাই তাকে নিয়ে আসে বই বিপণনের এ দুনিয়ায়। তার অভিজ্ঞতায় একদিকে ছিল সারা দেশে বইয়ের দোকানের শুকিয়ে মরার দৃশ্য। আরেকদিকে ছিল পাঠকের প্রয়োজনীয় বইটি কোথাও খুঁজে না পাওয়ার হাহাকার। প্রকাশক, বিক্রেতা ও ক্রেতারা যেন পরস্পর বিচ্ছিন্ন বর্তুলাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মহাশূন্যে।
পারস্পরিক এই দূরতিক্রম্যের কারণ অনুসন্ধান এবং তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করাই হয়ে ওঠে দীপঙ্কর দাশের অভীষ্ট। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পাঠক-ক্রেতার চাহিদা ও প্রাপ্তির মধ্যে গড়ে তোলেন সেতু। চট্টগ্রাম থেকে বাতিঘর ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা ও সিলেটে। চেরাগী পাহাড় মোড়ের ১০০ স্কয়ার ফুট থেকে তা এখন পরিণত হয়েছে ১০ হাজার স্কয়ার ফুটের তিনটি দোকানে।
যে ভাবে ভাবা হয়েছিল চেরাগী পাহাড়ের বাতিঘর, এর চেয়েও দ্রুত সাড়া ফেলে চট্টগ্রামে। প্রতিদিন কাছে-দূরে থেকে আসতে থাকেন অনেক পাঠক। তাদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খায় দীপঙ্করের অল্প পুঁজি ও ক্ষুদ্র আয়তনের পসরা। একপর্যায়ে ২০১২ সালে বিশালাকারে বাতিঘর উঠে আসে চট্টগ্রামের প্রেস ক্লাব ভবনের নিচতলায়।
তিন হাজার স্কয়ার ফুট জায়গা নিয়ে পুরনো জাহাজের নকশায় ঢেলে সাজানো হয় বাতিঘর। সেখানে ক্রমেই বাড়তে থাকে লেখক-পাঠক-ক্রেতার জমায়েত। ঢাকা-কলকাতা থেকে বড় বড় লেখক-সমালোচক আসেন, চলে সভা-সেমিনার-বিতর্ক। চট্টগ্রামের পাঠক-চিন্তকদের জন্য তা যেন এক অনির্বচনীয় জাগরণকাল। নতুনধারার সেই বইয়ের দোকানটি হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের নয়া
সংস্কৃতির বাতিঘর।
এরপর দীপঙ্কর দাশকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একে একে বিশালাকারে বাতিঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা ও সিলেটে। ঢাকায় বাতিঘর আসে ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে সিলেটে। সিলেটে জিন্দাবাজারের গোল্ডেন সিটি কমপ্লেক্সের দোতলায় দুই হাজার স্কয়ার ফুটের বাতিঘরটিও নির্মিত হয়েছে স্থানীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। সাজানো হয়েছে চা বাগান, আলি আমজদের ঘড়ি ও কিনব্রিজের নকশায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মিলিয়ে বাতিঘরের দৈনিক পাঠকের সংখ্যা এখন প্রায় পাঁচ হাজার আর ক্রেতার সংখ্যা গড়ে এক হাজার জন।
ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের আটতলায় মুঘল স্থাপনা বিশেষত লালবাগ কেল্লার আদলে পাঁচ হাজার স্কয়ার ফুটের দোকানে প্রতিদিন ভিড় করেন প্রায় ১৫০০ পাঠক। তাদের মধ্যে বই কেনেন প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নানা কর্মসূচি ও অডিটোরিয়ামে চলতে থাকা বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানের সুবাদেও বাতিঘরে প্রতিদিন আগমন ঘটে অনেক শিল্পানুরাগীর। বাতিঘরের অতিথিপরায়ণ বিপণন-নীতির কারণে মুঘলাই আটতলাটি এখন ঢাকার লেখক, পাঠক ও
সংস্কৃতিকর্মীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
বাতিঘরকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া আন্দোলন-জাত বলেই মনে করেন দীপঙ্কর দাশ। তিনি মনে করেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সংস্পর্শে না এলে তার মধ্যে গ্রন্থ বিপণনের এই উদ্যোগ হয়তো আসত না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠক আন্দোলনের অভিজ্ঞতাই শেষ পর্যন্ত তাকে এই ব্যবসায় যুক্ত করেছে। দীপঙ্কর এখন স্বপ্ন দেখেন, দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর, এরপর সম্ভব হলে প্রতি জেলায় একটি করে বাতিঘর গড়ে তোলার।
১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দীপঙ্কর দাশ বলেন, বাংলাদেশে বই বিপণনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু মৌলিক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধানত, প্রকাশক ও বিক্রেতার মাঝখানে পরিবেশক পদ্ধতি এ দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশ্বের সর্বত্র প্রকাশক ও বিক্রেতার মধ্যে মধ্যস্থতার দায়িত্ব পালন করেন পরিবেশকরা। পেঙ্গুইনের মতো বড় বড় প্রকাশনার কোনো নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র নেই। ভারতেও অনেক পরিবেশক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রকাশকরাই একাধারে পরিবেশক ও গ্রন্থ বিক্রেতা। বই-প্রকাশক ছাড়া আর কোনো উৎপাদকই নিজেদের পণ্য এভাবে বিক্রি করেন না। বইমেলা এলে যে কারণে বই প্রকাশের তোড়জোড় শুরু হয়। বই এখানে একটি মৌসুমি ব্যবসা। সারা বছরের কাজ নয় বলে এটি ইন্ডাস্ট্রিও হতে পারেনি। এসব কারণে এখানে শক্তিশালী বই-বিপণন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
কখন কোন বই প্রকাশ হলো বা কোন বই আসছে, এসব খবর বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেন না আমাদের প্রকাশকরা। আধুনিক ডেটাবেইস থেকে শুরু করে বিক্রেতা ও পাঠকের কাছে তথ্য পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা নেই বেশির ভাগের। অধিকাংশ প্রকাশনারই আসলে কোনো সাজানো সিস্টেম নেই। অন্যদিকে, আমাদের বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোও পাঠক-রুচির বিভিন্নতার সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম হচ্ছে না। এ কারণেই দেখা যায়, একদিকে বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পাঠক বই খুঁজে পাচ্ছেন না। পাড়ার মুদি দোকানগুলো সুপারশপে পরিণত হলেও, আমাদের গ্রন্থ বিক্রেতারা এই ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। আধুনিক বিপণনব্যবস্থার সুযোগগুলো সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না অধিকাংশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে গ্রন্থ খাত চলছে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের মতো করে।
বইপাঠ বিষয়ে একটি বড় সামাজিক-রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতার কথাও তোলেন দীপঙ্কর দাশ। বলেন, বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও সচেতনতা আগের চেয়ে বহু গুণ বেড়েছে এ কথা সত্য, কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা পাঠকবান্ধব নয়। শিশুর কাঁধে বইয়ের বোঝা ও ফলাফলদৌড়ে ভিত্তিই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গ্রন্থপাঠের সংস্কৃতি। ফলে, অভিভাবক-শিক্ষকের আগ্রহ ও সামাজিক সচেতনতার পরও এ দেশে আশানুরূপ ‘পাঠকসমাজ’ গড়ে উঠছে না।
গ্রন্থ খাতে সরকারি প্রণোদনার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন দীপঙ্কর দাশ। তার মতে, অনেক শিল্প খাতকে এগিয়ে নিতে সাবসিডি দেওয়া হয়, কিন্তু গ্রন্থ খাত নিয়ে সেভাবে ভাবা হচ্ছে না। অথচ এটি অন্য বাণিজ্যিক পণ্যের চেয়ে ভীষণভাবেই আলাদা। বই বিপণনের বাজার ও লাভের হারও অন্য যেকোনো পণ্যের তুলনায় কম। ফলে ব্যবসার দিক থেকে খাতটি আকর্ষণীয় হতে পারছে না। এমনকি সুপার শপের দোকান ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভ্যাট দিতে হয় গ্রন্থ ব্যবসায়ীদের। বইকে অন্য বাণিজ্যিক পণ্যের কাতারে না ফেলে একে শিল্পপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা দরকার আছে বলে মনে করেন তিনি।
এসব চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাংলাদেশে বই বিপণনে নবযুগের সূচনা করতে চান দীপঙ্কর। শুরু থেকেই তিনি আধুনিক পরিচালন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। দেশি ও বিদেশি প্রকাশনার সঙ্গে নিয়মিত আদান-প্রদানসহ পাঠকের কাছে বইয়ের খবর পৌঁছে দিতেও বাতিঘরের তৎপরতা লক্ষণীয়। একই সঙ্গে তিনি শুরু করেছেন বই পরিবেশনার কাজও, অপেক্ষা কেবল কাঠামো গড়ে তোলার। ইতিমধ্যে দেশের প্রকাশকরা বাতিঘরের মতো বই বিক্রয় কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করেছেন। অনেকেই নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বাতিঘরের সঙ্গে।
দীপঙ্কর দাশের সামনে এখন অনেক কাজ। শিগগির চালু করতে চান অনলাইন বিক্রয় সার্ভিস। এরই মধ্যে শুরু করেছেন ফেইসবুক, মেইল বা টেলিফোনে বইয়ের অর্ডার নেওয়ার কাজ। সারা দেশে একটি রিডার সোসাইটি গড়ে তুলতে চান তিনি। সব বিভাগীয় শহরে করতে চান একটি করে বাতিঘর। যেখানে থাকবে লেখক-পাঠক কর্নার। চলবে বই নিয়ে নিয়মিত আলোচনা। দীপঙ্কর বলেন, লেখকদের স্টার ভ্যালুজ নির্মাণের দায়িত্বও নিতে হবে প্রকাশক, পরিবেশক ও বিক্রেতাদের। আধুনিক বই বিপণনব্যবস্থা গড়তে হলে এর একটাকেও বাদ দিয়ে হবে না।