প্রক্রিয়াজাত মাংসের ব্র্যান্ড ‘বেঙ্গল মিট’
মোস্তাফিজুর রহমান | ২৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
জীবনের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ খাদ্য। মানুষের শরীরবৃত্তিক বা বুদ্ধির বিকাশ উভয়ের জন্যই খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। দৈনন্দিন জীবনে খাদ্যের মধ্যে অন্যতম হলো গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি ইত্যাদি গৃহপালিত পশু-পাখির মাংস। এসব মাংস যেমন শরীরের জন্য পুষ্টিকর, তেমনি অস্বাস্থ্যকর হলে তা হয়ে ওঠে আরও ভয়ংকর। এর সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে মারাত্মক সব অসুখ । দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যে মাংসকে আরও নিরাপদ করে তোলার জন্য গড়ে ওঠে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মাংসের ব্র্যান্ড ‘বেঙ্গল মিট’। ঢাকা থেকে পাবনা যেতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিগুরুর কাছারি বাড়ি পার হয়ে কিছুদূর যেতেই বড়
রাস্তার পাশেই বেঙ্গল মিটের অবস্থান। তাদের রয়েছে বাংলাদেশের সর্বাধুনিক কসাইখানা। অস্ট্রেলিয়ার অন রেল ড্রেসিং প্রযুক্তিতে ২০০৬ সালে ১২ একর জায়গার ওপর কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, শুরু থেকেই রপ্তানিমুখী উৎপাদন দিয়ে বেঙ্গল মিটের যাত্রা শুরু। যার কারণে পরে দেশীয় বাজারে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির মাংস ছাড়া কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যায় বেঙ্গল মিটের জন্য। কিন্তু ব্যবসাটা শুরু হয় ফাইভ স্টার বা থ্রি স্টার রেস্তোরাঁ, যেখানে হাইজেনিক মাংসের চাহিদা অত্যধিক থাকে তাদের টার্গেট করে।
রপ্তানিমুখী উৎপাদনের ব্যাপারে বেঙ্গল মিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আ ফ ম আসিফ জানান, বর্তমানে সারা বিশ্বে হালাল মাংসের বাজার চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের (এক লাখ কোটি ডলারে এক ট্রিলিয়ন)।
এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে রয়েছে হালাল মাংসের বড় বাজার। ফলে এ খাতে প্রচুর সম্ভাবনা আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কথাবার্তার ফাঁকে সরেজমিনে দেখা গেল, এই এলাকার গরুর একটি বড় অংশ অস্ট্রেলীয় জাতের সঙ্গে মিশেল হয়েছে। ফলে এগুলোর স্বাস্থ্যও বেশ হৃষ্টপুষ্ট। বেঙ্গল মিটের গরু কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে আসিফ জানান, বাছাই করা কিছু গরু সরবরাহকারী আছেন, যাদের বেঙ্গল মিট কর্র্তৃপক্ষ বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে গরু পালনের স্বাস্থ্যগত ও নিরাপদ পদ্ধতি সম্পর্কে। গরু বাজার থেকে কেনা, এমনকি গরুকে কী ধরনের খাবার খাওয়াতে হবে এই প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে তাদের। এদের প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে সাহায্য করার পাশাপাশি বিদেশি জাতের যেসব ঘাস দেশের তাপমাত্রায় স্বল্পসময়ে ভালোভাবে গড়ে ওঠে, সে বিষয়েও সম্যক ধারণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া এই অঞ্চলে বিভিন্ন কারণে ভালো জাতের গরুর প্রাপ্যতা ও জোগান রয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে বেঙ্গল মিট থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। বেঙ্গল মিট এই সরবরাহকারীদের কাছ থেকে গরু নিয়ে কয়েক সপ্তাহ পরিচর্যা করে। তারপর জবাইয়ের জন্য পাঠানো হয়।
বেঙ্গল মিটের প্রায় ১০০ বিঘার মতো জমি রয়েছে। এই জমিতে তারা চাষ করেন বিভিন্ন জাতের ঘাস। এর মধ্যে আছে নেপিয়ার-জাতীয় ঘাস। এই ঘাস প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে লালন-পালন করা পশুদের খেতে দেওয়া হয়। গরু ও ছাগল বা খাসি বড় করা হয় এখানে। ঘাসের পাশাপাশি ভুট্টার চাষ করা হয় পশুখাদ্য হিসেবে।
জানা যায়, ওয়েইন গ্যাস্কেল বেঙ্গল মিটের একজন ডিরেক্টর। অস্ট্রেলিয়ান এই ভদ্রলোক শুরু থেকেই আছেন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এই কসাইখানার নকশা তারই করা। অর্থাৎ মেশিনপত্র থেকে শুরু করে কীভাবে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, এর পুরো তদারকিই করেন গ্যাস্কেল। অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও মাংস উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্পে বাইরের কয়েকটি দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়েছেন তিনি। আসিফ বলেন, ‘এই কসাইখানার মান দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার যেকোনো কসাইখানার সমান।’
পালন করা পশু : এখানে পালন করা ছাগলের আছে বেশ কয়েকটি জাত। অস্ট্রেলিয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতীয় যমুনা পরীর মধ্যে সংকরজাত, ব্ল্যাক বেঙ্গল, দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিশেষ জাতও আছে এখানে।
ওয়েইন গ্যাস্কেল ছাগল পালন অংশে দেখালেন দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিশেষ জাত।
তিনি জানান, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটয়ের মাংসের স্বাদ অতুলনীয় এবং একজন বিক্রেতার জন্যও ভালো দাম পড়ে। হয়তো স্বাদের কারণেই এর মাংস উৎপাদনের ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অস্ট্রেলীয় বা দক্ষিণ আফ্রিকান কিছু জাতের খাসির তুলনায় অনেক কম। আর দক্ষিণ আফ্রিকান এই বিশেষ জাতের খাসি খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। আর তাই বেঙ্গল মিট ছাগলগুলো বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক পালন করছে। আর বাণিজ্যিক ও অন্যান্য কারণে প্রাণী ও মৎস্যসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে মিলে কিছু পরীক্ষামূলক সংকরায়ণের কাজ করছেন তারা।
প্রতিটি ছাগলের কানে একটি করে ট্যাগ লাগানো। পশ্চিমে এই ট্যাগ দেখেই উৎপাদিত মাংস কোথা থেকে এলো এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয় বলে জানান গ্যাস্কেল।
বেঙ্গল মিট নিজস্ব তত্ত্বাবধানেও গরু পালন করে। এই অংশে দেখা গেল তাদের রয়েছে একশোরও বেশি গরু। এই গরুগুলো বেঙ্গল মিটে পালিত হচ্ছে প্রায় সাত মাস ধরে। আধুনিক পন্থায় পরিচর্যা করা এসব গরুরও আছে ট্যাগ।
পুরো কারখানায় পানি ও পরিষ্কার কাজের জন্য আছে নিজস্ব পানিশোধনাগার।
জবাই প্রক্রিয়া : প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বললেন, গরু জবাইয়ের আগে টিবি, অ্যানথ্রাক্সসহ বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া মাংস প্রক্রিয়াকরণের সব পর্যায়ে তাপমাত্রা বজায় রাখা হয়। প্রতিটি গরু জবাই করার আগে নির্দিষ্ট একটি ‘হোল্ডিং’ এলাকায় রাখা হয়। মানুষের শরীরে অস্ত্রোপচার করার আগে যেমন শুধু পানি খেতে দেওয়া হয়, এখানেও জবাই করার আগে একই নিয়ম মানা হয়। এর মধ্যে আবার জবাই করার আগে একজন পশুচিকিৎসক গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখেন।
এই স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হয়। একইভাবে গরু জবাই হওয়ার পরে আবার সাধারণ ‘পোস্টমর্টেম’ করা হয়, এভাবেই নিশ্চিত করা হয় ক্রেতা কোনো সমস্যাযুক্ত মাংস বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন না।
জবাই থেকে শুরু করে জবাই করা পশুর পোস্টমর্টেম প্রক্রিয়া এমনভাবে সমন্বয় করা, যাতে কোনো সমস্যা পাওয়া গেলে ওই পশুকে সঙ্গে সঙ্গে প্রোডাকশন লাইন থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়।
এই প্রক্রিয়ার আর একটি বিশেষ ও স্বাস্থ্যগত বিষয় হলো ভালোমতো রক্ত ঝরানো আর পশুর শরীর থেকে সরিয়ে ফেলা বর্জ্যগুলোকে পরে ভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
ঠাণ্ডা ও গরম পানিতে ধুয়ে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে চামড়া আর অতিরিক্ত মেদও আলাদা করে ফেলা হয়।
জবাই করা গরুর মাংস নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় হিমঘরে। পরে এই হিমঘর থেকে বের করে নিয়ে এসে মাংস টুকরো করা ও প্যাকেটজাত করা হয়।
গ্যাস্কেল জানান, গরুর মাংস যে কাটার পরপরই রান্না করলে সবচেয়ে ভালো স্বাদ পাওয়া যাবে, তা নয়। পশ্চিমা বিশ্বে আবহাওয়াগত ও বৈজ্ঞানিক কারণেই মাংস চিলারে রেখে বিক্রি করা হয়। যার তাপমাত্রা সাধারণত তিন থেকে পাঁচ ডিগ্রি থাকে।
আর তাই মাংস কাটাকাটি করা হয় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়। রীতিমতো মাইনাস ডিগ্রিতে চলে এই কাটাকাটির কাজ। জ্যাকেট পরে কাজ করছেন অনেকেই, মাথায় নেটও থাকে, যাতে মাংসে কোনো অযাচিত কিছু ঢুকে না পড়ে।
এই কারখানায় ঢুকতে গেলে রীতিমতো গামবুট পরে ঢুকতে হয়। স্যানিটাইজারে ধুতে হয় পায়ের বুট ও হাত। ছোট একটি জলাধারে এমন করে রাখা এই স্যানিটাইজার, কোনোভাবেই কেউ না পাড়িয়ে ঢুকতে পারবেন না কারখানার ভেতর। আর পশুজবাই অংশের কর্মচারীরা কোনোভাবেই মাংস কাটার অংশে ঢোকেন না। নিজেদের মাংস হালাল বলে জানায় বেঙ্গল মিট। তবে এ বিষয়ে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাহমুদ আল মামুন বলেন, ‘মালয়েশিয়া সরকারের হালাল সনদ দেওয়ার কর্র্তৃপক্ষ জাকিম থেকে আমরা সনদ নিয়েছি। এ ছাড়া দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আমাদের একটি গাইডলাইন করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী পশু জবাই করা হয়। আর পুরো প্রক্রিয়া সরেজমিনে দেখার জন্য ফাউন্ডেশনের একজন কর্মচারী বেঙ্গলের কারখানায় উপস্থিত থাকেন।’
পুরো ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন প্রায় ২৫০ জন মানুষ। যারা প্রায় সবাই এই এলাকারই বাসিন্দা। এ ছাড়া স্থানীয়দের কাছ থেকে মুরগি সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
মাংস বিক্রি : নির্দিষ্ট বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বিক্রি হয় বেঙ্গল মিটের মাংস। এ ছাড়া বেঙ্গল মিটের কর্মকর্তা ও ঢাকার বেশ কিছু
রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঢাকার মানসম্পন্ন রেস্তোরাঁগুলোতে বহুলাংশে বেঙ্গল মিটের মাংসই রসুইঘরে ঢোকে।
বাংলাদেশে প্রথাগতভাবে ‘কাট’কে প্রাধান্য দিয়ে মাংস বিক্রির চল কখনো ছিল এমন দাবি করা কঠিন। কাট বলতে পশুর শরীরের বিভিন্ন অংশের মাংসের ধরন ও এর সঙ্গে স্বাদের তারতম্যকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। পশ্চিমারা এই কাটের ভিত্তিতেই মাংস কেনাবেচার কাজটি সাধারণত করে থাকেন।
যেমন স্টেকের মাংসের ধরন আর বিফ বা মাটনকারি অথবা শিক কাবাবের মাংস আমরা যেভাবে খাই তার কাটার পদ্ধতি ও খাবারে স্বাদ নেওয়ার প্রক্রিয়া একেবারেই আলাদা। তবে বেঙ্গল মিট শুরু থেকেই করছে এই কাজটি।
এ ছাড়া রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের মেরিনেইট করা মাংস তৈরি করা হয় ভোক্তাদের জন্য। এই প্রতিষ্ঠান দুবাই, বাহরাইন, কুয়েত ও মালদ্বীপে মাংস রপ্তানি করছে প্রধানত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য।
কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি দেশের বাজারে ব্যবসা আরও বাড়াতে কাজ করছে বেঙ্গল। দেশ-বিদেশে স্বাস্থ্যসম্মত মাংসের বেশ চাহিদা থাকায় সরকার এ খাতে নজর দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন আসিফ। একই সঙ্গে সম্ভাবনাময় এ খাতে নতুন বিনিয়োগ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
শেয়ার করুন
মোস্তাফিজুর রহমান | ২৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

জীবনের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ খাদ্য। মানুষের শরীরবৃত্তিক বা বুদ্ধির বিকাশ উভয়ের জন্যই খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। দৈনন্দিন জীবনে খাদ্যের মধ্যে অন্যতম হলো গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি ইত্যাদি গৃহপালিত পশু-পাখির মাংস। এসব মাংস যেমন শরীরের জন্য পুষ্টিকর, তেমনি অস্বাস্থ্যকর হলে তা হয়ে ওঠে আরও ভয়ংকর। এর সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে মারাত্মক সব অসুখ । দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যে মাংসকে আরও নিরাপদ করে তোলার জন্য গড়ে ওঠে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মাংসের ব্র্যান্ড ‘বেঙ্গল মিট’। ঢাকা থেকে পাবনা যেতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিগুরুর কাছারি বাড়ি পার হয়ে কিছুদূর যেতেই বড়
রাস্তার পাশেই বেঙ্গল মিটের অবস্থান। তাদের রয়েছে বাংলাদেশের সর্বাধুনিক কসাইখানা। অস্ট্রেলিয়ার অন রেল ড্রেসিং প্রযুক্তিতে ২০০৬ সালে ১২ একর জায়গার ওপর কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, শুরু থেকেই রপ্তানিমুখী উৎপাদন দিয়ে বেঙ্গল মিটের যাত্রা শুরু। যার কারণে পরে দেশীয় বাজারে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির মাংস ছাড়া কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যায় বেঙ্গল মিটের জন্য। কিন্তু ব্যবসাটা শুরু হয় ফাইভ স্টার বা থ্রি স্টার রেস্তোরাঁ, যেখানে হাইজেনিক মাংসের চাহিদা অত্যধিক থাকে তাদের টার্গেট করে।
রপ্তানিমুখী উৎপাদনের ব্যাপারে বেঙ্গল মিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আ ফ ম আসিফ জানান, বর্তমানে সারা বিশ্বে হালাল মাংসের বাজার চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের (এক লাখ কোটি ডলারে এক ট্রিলিয়ন)।
এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে রয়েছে হালাল মাংসের বড় বাজার। ফলে এ খাতে প্রচুর সম্ভাবনা আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কথাবার্তার ফাঁকে সরেজমিনে দেখা গেল, এই এলাকার গরুর একটি বড় অংশ অস্ট্রেলীয় জাতের সঙ্গে মিশেল হয়েছে। ফলে এগুলোর স্বাস্থ্যও বেশ হৃষ্টপুষ্ট। বেঙ্গল মিটের গরু কোথা থেকে আসে জানতে চাইলে আসিফ জানান, বাছাই করা কিছু গরু সরবরাহকারী আছেন, যাদের বেঙ্গল মিট কর্র্তৃপক্ষ বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে গরু পালনের স্বাস্থ্যগত ও নিরাপদ পদ্ধতি সম্পর্কে। গরু বাজার থেকে কেনা, এমনকি গরুকে কী ধরনের খাবার খাওয়াতে হবে এই প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে তাদের। এদের প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে সাহায্য করার পাশাপাশি বিদেশি জাতের যেসব ঘাস দেশের তাপমাত্রায় স্বল্পসময়ে ভালোভাবে গড়ে ওঠে, সে বিষয়েও সম্যক ধারণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া এই অঞ্চলে বিভিন্ন কারণে ভালো জাতের গরুর প্রাপ্যতা ও জোগান রয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে বেঙ্গল মিট থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। বেঙ্গল মিট এই সরবরাহকারীদের কাছ থেকে গরু নিয়ে কয়েক সপ্তাহ পরিচর্যা করে। তারপর জবাইয়ের জন্য পাঠানো হয়।
বেঙ্গল মিটের প্রায় ১০০ বিঘার মতো জমি রয়েছে। এই জমিতে তারা চাষ করেন বিভিন্ন জাতের ঘাস। এর মধ্যে আছে নেপিয়ার-জাতীয় ঘাস। এই ঘাস প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে লালন-পালন করা পশুদের খেতে দেওয়া হয়। গরু ও ছাগল বা খাসি বড় করা হয় এখানে। ঘাসের পাশাপাশি ভুট্টার চাষ করা হয় পশুখাদ্য হিসেবে।
জানা যায়, ওয়েইন গ্যাস্কেল বেঙ্গল মিটের একজন ডিরেক্টর। অস্ট্রেলিয়ান এই ভদ্রলোক শুরু থেকেই আছেন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এই কসাইখানার নকশা তারই করা। অর্থাৎ মেশিনপত্র থেকে শুরু করে কীভাবে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, এর পুরো তদারকিই করেন গ্যাস্কেল। অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও মাংস উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্পে বাইরের কয়েকটি দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়েছেন তিনি। আসিফ বলেন, ‘এই কসাইখানার মান দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার যেকোনো কসাইখানার সমান।’
পালন করা পশু : এখানে পালন করা ছাগলের আছে বেশ কয়েকটি জাত। অস্ট্রেলিয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতীয় যমুনা পরীর মধ্যে সংকরজাত, ব্ল্যাক বেঙ্গল, দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিশেষ জাতও আছে এখানে।
ওয়েইন গ্যাস্কেল ছাগল পালন অংশে দেখালেন দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিশেষ জাত।
তিনি জানান, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটয়ের মাংসের স্বাদ অতুলনীয় এবং একজন বিক্রেতার জন্যও ভালো দাম পড়ে। হয়তো স্বাদের কারণেই এর মাংস উৎপাদনের ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অস্ট্রেলীয় বা দক্ষিণ আফ্রিকান কিছু জাতের খাসির তুলনায় অনেক কম। আর দক্ষিণ আফ্রিকান এই বিশেষ জাতের খাসি খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। আর তাই বেঙ্গল মিট ছাগলগুলো বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক পালন করছে। আর বাণিজ্যিক ও অন্যান্য কারণে প্রাণী ও মৎস্যসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে মিলে কিছু পরীক্ষামূলক সংকরায়ণের কাজ করছেন তারা।
প্রতিটি ছাগলের কানে একটি করে ট্যাগ লাগানো। পশ্চিমে এই ট্যাগ দেখেই উৎপাদিত মাংস কোথা থেকে এলো এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয় বলে জানান গ্যাস্কেল।
বেঙ্গল মিট নিজস্ব তত্ত্বাবধানেও গরু পালন করে। এই অংশে দেখা গেল তাদের রয়েছে একশোরও বেশি গরু। এই গরুগুলো বেঙ্গল মিটে পালিত হচ্ছে প্রায় সাত মাস ধরে। আধুনিক পন্থায় পরিচর্যা করা এসব গরুরও আছে ট্যাগ।
পুরো কারখানায় পানি ও পরিষ্কার কাজের জন্য আছে নিজস্ব পানিশোধনাগার।
জবাই প্রক্রিয়া : প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বললেন, গরু জবাইয়ের আগে টিবি, অ্যানথ্রাক্সসহ বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া মাংস প্রক্রিয়াকরণের সব পর্যায়ে তাপমাত্রা বজায় রাখা হয়। প্রতিটি গরু জবাই করার আগে নির্দিষ্ট একটি ‘হোল্ডিং’ এলাকায় রাখা হয়। মানুষের শরীরে অস্ত্রোপচার করার আগে যেমন শুধু পানি খেতে দেওয়া হয়, এখানেও জবাই করার আগে একই নিয়ম মানা হয়। এর মধ্যে আবার জবাই করার আগে একজন পশুচিকিৎসক গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখেন।
এই স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হয়। একইভাবে গরু জবাই হওয়ার পরে আবার সাধারণ ‘পোস্টমর্টেম’ করা হয়, এভাবেই নিশ্চিত করা হয় ক্রেতা কোনো সমস্যাযুক্ত মাংস বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন না।
জবাই থেকে শুরু করে জবাই করা পশুর পোস্টমর্টেম প্রক্রিয়া এমনভাবে সমন্বয় করা, যাতে কোনো সমস্যা পাওয়া গেলে ওই পশুকে সঙ্গে সঙ্গে প্রোডাকশন লাইন থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়।
এই প্রক্রিয়ার আর একটি বিশেষ ও স্বাস্থ্যগত বিষয় হলো ভালোমতো রক্ত ঝরানো আর পশুর শরীর থেকে সরিয়ে ফেলা বর্জ্যগুলোকে পরে ভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
ঠাণ্ডা ও গরম পানিতে ধুয়ে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে চামড়া আর অতিরিক্ত মেদও আলাদা করে ফেলা হয়।
জবাই করা গরুর মাংস নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় হিমঘরে। পরে এই হিমঘর থেকে বের করে নিয়ে এসে মাংস টুকরো করা ও প্যাকেটজাত করা হয়।
গ্যাস্কেল জানান, গরুর মাংস যে কাটার পরপরই রান্না করলে সবচেয়ে ভালো স্বাদ পাওয়া যাবে, তা নয়। পশ্চিমা বিশ্বে আবহাওয়াগত ও বৈজ্ঞানিক কারণেই মাংস চিলারে রেখে বিক্রি করা হয়। যার তাপমাত্রা সাধারণত তিন থেকে পাঁচ ডিগ্রি থাকে।
আর তাই মাংস কাটাকাটি করা হয় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়। রীতিমতো মাইনাস ডিগ্রিতে চলে এই কাটাকাটির কাজ। জ্যাকেট পরে কাজ করছেন অনেকেই, মাথায় নেটও থাকে, যাতে মাংসে কোনো অযাচিত কিছু ঢুকে না পড়ে।
এই কারখানায় ঢুকতে গেলে রীতিমতো গামবুট পরে ঢুকতে হয়। স্যানিটাইজারে ধুতে হয় পায়ের বুট ও হাত। ছোট একটি জলাধারে এমন করে রাখা এই স্যানিটাইজার, কোনোভাবেই কেউ না পাড়িয়ে ঢুকতে পারবেন না কারখানার ভেতর। আর পশুজবাই অংশের কর্মচারীরা কোনোভাবেই মাংস কাটার অংশে ঢোকেন না। নিজেদের মাংস হালাল বলে জানায় বেঙ্গল মিট। তবে এ বিষয়ে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাহমুদ আল মামুন বলেন, ‘মালয়েশিয়া সরকারের হালাল সনদ দেওয়ার কর্র্তৃপক্ষ জাকিম থেকে আমরা সনদ নিয়েছি। এ ছাড়া দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আমাদের একটি গাইডলাইন করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী পশু জবাই করা হয়। আর পুরো প্রক্রিয়া সরেজমিনে দেখার জন্য ফাউন্ডেশনের একজন কর্মচারী বেঙ্গলের কারখানায় উপস্থিত থাকেন।’
পুরো ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন প্রায় ২৫০ জন মানুষ। যারা প্রায় সবাই এই এলাকারই বাসিন্দা। এ ছাড়া স্থানীয়দের কাছ থেকে মুরগি সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
মাংস বিক্রি : নির্দিষ্ট বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বিক্রি হয় বেঙ্গল মিটের মাংস। এ ছাড়া বেঙ্গল মিটের কর্মকর্তা ও ঢাকার বেশ কিছু
রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঢাকার মানসম্পন্ন রেস্তোরাঁগুলোতে বহুলাংশে বেঙ্গল মিটের মাংসই রসুইঘরে ঢোকে।
বাংলাদেশে প্রথাগতভাবে ‘কাট’কে প্রাধান্য দিয়ে মাংস বিক্রির চল কখনো ছিল এমন দাবি করা কঠিন। কাট বলতে পশুর শরীরের বিভিন্ন অংশের মাংসের ধরন ও এর সঙ্গে স্বাদের তারতম্যকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। পশ্চিমারা এই কাটের ভিত্তিতেই মাংস কেনাবেচার কাজটি সাধারণত করে থাকেন।
যেমন স্টেকের মাংসের ধরন আর বিফ বা মাটনকারি অথবা শিক কাবাবের মাংস আমরা যেভাবে খাই তার কাটার পদ্ধতি ও খাবারে স্বাদ নেওয়ার প্রক্রিয়া একেবারেই আলাদা। তবে বেঙ্গল মিট শুরু থেকেই করছে এই কাজটি।
এ ছাড়া রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের মেরিনেইট করা মাংস তৈরি করা হয় ভোক্তাদের জন্য। এই প্রতিষ্ঠান দুবাই, বাহরাইন, কুয়েত ও মালদ্বীপে মাংস রপ্তানি করছে প্রধানত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য।
কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি দেশের বাজারে ব্যবসা আরও বাড়াতে কাজ করছে বেঙ্গল। দেশ-বিদেশে স্বাস্থ্যসম্মত মাংসের বেশ চাহিদা থাকায় সরকার এ খাতে নজর দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন আসিফ। একই সঙ্গে সম্ভাবনাময় এ খাতে নতুন বিনিয়োগ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।