
স্ত্রী সাপের ভগাঙ্কুর বা ক্লিটোরিস রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এক গবেষণায় বিস্তারিত জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, পূর্ববর্তী গবেষণায় সাপের এ অঙ্গকে ঘ্রাণ গ্রন্থি বা পুরুষ লিঙ্গের (পেনিস) অনুন্নত সংস্করণ হিসাবে ধারণা করা করেছিল।
প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, স্ত্রী সাপের দুটি আলাদা ভগাঙ্কুর রয়েছে- হেমিক্লিটোরিস যা টিস্যু দ্বারা পৃথক এবং লেজের নীচের অংশে ত্বক দ্বারা লুকানো।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্ত্রী সাপের যৌনাঙ্গ তাদের সমকক্ষ পুরুষের তুলনায় উপেক্ষিত হয়ে আসছিল। যার ফলে তাদের যৌন প্রজনন সম্পর্কে আমাদের বোঝার সীমাবদ্ধ তৈরি হয়।
পুরুষ সাপ এবং টিকটিকির হেমিপেনিস (একাধিক পুরুষাঙ্গ) আছে বলে জানা যায়। তাদের এক জোড়া লিঙ্গ প্রজননের সময় শরীরের বাইরে চলে আসে। অনেক প্রজাতির মধ্যে, হেমিপেনিস কাঁটা বা হুকের মধ্যে আবৃত থাকে।
গবেষণার প্রধান লেখক এবং অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্র মেগান ফলওয়েল বলেন, স্ত্রী যৌনাঙ্গ নিয়ে ট্যাবু থাকার কারণ সাপের ভগাঙ্কুর নিয়ে আগে তেমন ভাবনা তৈরি হয়নি।
তিনি বলেন, এটি খুঁজে বের করা সহজ জিনিস নয়। কারণ এ ক্লিটোরিস অত্যন্ত ক্ষুদ্র। প্রথমে একটি ডেথ অ্যাডারে (বিষাক্ত প্রজাতির সাপ) ভগাঙ্কুর পাই। যেখানে অঙ্গটি ‘হৃদয়ের মতো’ একটি ত্রিভুজ আকারের ছিল। আমার সৌভাগ্য যে ওই সাপের ক্লিটোরিস তুলনায় বড় ছিল।
সমীক্ষায় বলা হয়, মিলনের সময় সাপের যৌন অঙ্গগুলোর তাৎপর্যপূর্ণ কার্যকারিতা রয়েছে।
সাপের আচরণ সম্পর্কে আরো গবেষণা প্রয়োজন জানিয়ে ফলওয়েল বলেন, যোনি শিথিলকরণ এবং তৈলাক্তকরণের জন্য এক ধরনের উদ্দীপনা সংকেত তৈরি হয় যা নারী সাপকে সহবাসে সহায়তা করে। ফলে সঙ্গমের সময় পুরুষ সাপের হেমিপেনিসের হুক এবং কাঁটার ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়। .
তিনি জানান, এ সময়ে ডিম্বাশয়কে ডিম্ব স্ফুটনের জন্য এবং ডিম্বনালীকে সম্ভাব্যভাবে শুক্রাণু সঞ্চয়ের জন্য প্রস্তুত করার সংকেত তৈরি হয়।
গবেষকরা নয় প্রজাতির ১০টি সাপকে ব্যবচ্ছেদ করেন।
গবেষণার সহ-লেখক এবং লো ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউরোইকোলজিতে পোস্টডক্টরাল গবেষক ডা. জেনা ক্রো-রিডেল বলেন, কিছু ভগাঙ্কুর বেশ পেশীবহুল এবং বড় হয়। যার আকার এক মিলিমিটারের কম থেকে সাত মিলিমিটার পর্যন্ত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে হেমিক্লিটোরাস ‘ইরেক্টাইল টিস্যু’ দ্বারা গঠিত যা স্নায়ুর সঙ্গে যুক্ত এবং এটি আনন্দদায়ক হতে পারে বলেও অনুমান গবেষকদের।
খবর: দ্য গার্ডিয়ান।
পৃথিবীর উপরে কী কী রয়েছে, তা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু ভূভাগের ভেতরে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত রয়েছে যে বিরাট জগত, তার কতটুকুই বা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন! নতুন এক তথ্য চমকে দিয়েছে সবাইকে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীর উপরিভাগ যে অভিমুখে ঘুরছে, তার কেন্দ্র ঘুরছে ঠিক তার বিপরীত অভিমুখে। শুধু তাই নয়, কিছু দিন আগেই পৃথিবীর কেন্দ্র ঘোরা থামিয়ে দিয়েছিল। তার পর থেকেই এটি ঘুরছে উল্টো মুখে। কী হতে পারে এর ফলে? ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কি প্রাণীজগত? প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলেই।
সম্প্রতি নেচার জিয়োসায়েন্স একটি গবেষণার মাধ্যমে এই বিষয়টি তুলে ধরেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পৃথিবীর কেন্দ্র এক দিকে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ থেমে গিয়েছিল। তার পরেই হঠাৎ বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। এবং ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই। গবেষকদের দাবি, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল এখন ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করেছে। আর এটিই চিন্তায় ফেলেছে অনেককে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে পৃথিবীর কেন্দ্র হঠাৎ থমকে গিয়েছিল। তার পরে বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করে। সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, চিনের পিকিং ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এই বিষয়টি জানতে পেরেছেন। এবং এটিও জানা গিয়েছে, মোটামুটি প্রতি ৩৫ বছর পরপর পৃথিবীর কেন্দ্রভাগ নিজের ঘোরার দিক পরিবর্তন করতে পারে। তবে কখনও কখনও ৭০ বছরও চলে এটি।
১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে প্রথমবার পৃথিবীর কেন্দ্রের ঘূর্ণনের কথা টের পান বিজ্ঞানীরা। তাদের অনুমান, আবার ২০৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রস্থল নিজের ঘোরার অভিমুখ বদলাতে পারে। পিকিং ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হওয়া সমস্ত ভূমিকম্পের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছেন, ঘূর্ণনের এই পরিবর্তন সম্ভবত দিনের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত। পৃথিবী নিজের অক্ষে যে ভাবে সারা ক্ষণ ঘুরে চলেছে, তার উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে কেন্দ্রের ঘূর্ণন।
কিন্তু এটি কি বড় কোনও বিপদ ডেকে আনতে পারে? এই ঘটনার ফলে প্রাণীকূলের অস্তিত্ব কি বিপন্ন হতে পারে? গবেষকরা অবশ্য জানিয়েছেন, তেমন কোনও আশঙ্কা নেই। পৃথিবীর উপরিতলে এই ঘূর্ণনের প্রভাব টেরও পাওয়া যাবে না। ফলে এই মুহূর্তে প্রাণীকূলের কোনও ভয় নেই বলে আশ্বাস দিয়েছেন তারা।
৫০ হাজার বছরে একবার পৃথিবী ও সূর্যের কাছে আসে এমন একটি ধূমকেতু আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীর কাছ দিয়ে অতিক্রম করবে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে খালি চোখেই ধূমকেতুটি দেখা যাবে।
আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ধূমকেতুটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি দূরত্বে থাকবে। তখন বাইনোকুলারের সাহায্যে বা খালি চোখেই রাতের আকাশে এটি দেখা যাবে, যদি শহরাঞ্চলের বৈদ্যুতিক আলো বা চাঁদের আলো বেশি উজ্জ্বল না হয়।
তবে ওই সময়ে পূর্ণিমার কারণে ধূমকেতুটি দেখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে বলে ২১ ও ২২ জানুয়ারি এটিকে দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্যারিস অবজারভেটরির জ্যোতির্পদার্থবিদ নিকোলাস বিভার।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক জুইকি ট্রানজিয়েন্ট ফ্যাসিলিটির নাম অনুসারে ধূমকেতুটির নাম রাখা হয়েছে সি/২০২২ ই৩ (জেডটিএফ)। গত বছরের মার্চে বৃহস্পতি গ্রহকে অতিক্রম করার সময় এটিকে প্রথম লক্ষ্য করে জুইকি ট্রানজিয়েন্ট ফ্যাসিলিটি।
বিভার জানান, ধূমকেতুটি বরফ ও ধুলাবালির সমন্বয়ে গঠিত এবং এটি এক ধরণের সবুজাভ আলো বিকিরণ করে। ধূমকেতুটির ব্যাস মাত্র এক কিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে দেখতে পাওয়া সর্বশেষ দুইটি ধূমকেতুর চেয়ে আকারে অনেকটাই ছোট এটি।
এর আগে ২০২০ সালের মার্চে নিওওয়াইজ ও ১৯৯৭ সালে হেল-বপ নামের ধূমকেতু পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা গিয়েছিল। হেল-বপের ব্যাস ছিল প্রায় ৬০ কিলোমিটার। তবে আকারে ছোট হলেও এই ধূমকেতুটি পৃথিবীর অনেক কাছে আসবে বলে সেটিকে খালি চোখে দেখতে পাওয়া যাবে।
এই ধূমকেতুটি উর্ট মেঘ (Oort cloud) থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়, যেটি পৃথিবীর সৌরজগতের চারপাশে অবস্থিত রহস্যময় বরফ দিয়ে গঠিত একটি বিশাল গোলক।
এর আগে এই ধূমকেতুটি সর্বশেষ পৃথিবীর কাছে এসেছিলো প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে, আপার প্যালিওলিথিক তথা প্রাচীন প্রস্তর যুগের তৃতীয় এবং শেষভাগে (৫০০০০-১২০০০ বছর আগে)।
তাত্ত্বিক মহা সমন্বয়: আদি প্রাণকোষের সমস্ত মৌলিক উপাদান একসাথেই সৃষ্টি হয়েছিল
বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের সমর্থনে ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি বিজ্ঞানীদল তাদের নিজস্ব চিন্তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন, কিন্তু বেশিরভাগ যুক্তিই ছিল আকাশকুসুম অনুমানের অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা। যদিও এই প্রক্রিয়া বেশ কাজে দিয়েছিল, কিন্তু প্রাণ বিকাশের প্রতিটি সম্ভাবনাময় ধারণা বা অনুমান শেষ পর্যন্ত নতুন কোনো বড় প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। যে কারণে কিছু গবেষক এবার প্রাণ বিকাশের গবেষণায় আরো সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গিতে এতদিনের অমীমাংসীত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করলেন।
প্রাণের উৎপত্তির উৎস সন্ধানে এই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার প্রয়াস কয়েক বছর আগে বেগবান হয়। সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির বিজ্ঞানীরা ইতিপূর্বের বহুল চর্চিত ‘আরএনএ প্রথম নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করেছিল’ মতবাদের উপর কাজ শুরু করেন। কিন্তু ২০০৯ সালে আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীরা আবার একটি বড় ধরণের সমস্যার মুখে পড়ে গেলেন। পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে ঠিক কীভাবে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল তার মূল অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা তাদের মতবাদের পক্ষে প্রাণের মৌলিক উপাদান আরএনএ’র গাঠনিক উপাদান নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলেন। যে কারণে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ মোটেও আরএনএ থেকে হয় নি এমন ধারণাই করতে লাগলেন লোকে।
ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক জন ডেভিড সুদারল্যান্ড ১৯৮০ সাল থেকে এই সমস্যা অথবা সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। জন ডেভিড সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আমি মনে করি, আপনি যদি প্রমাণ করে দেখাতে পারেন, আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম তাহলে সেটা হবে অসাধারণ এক কাজ।‘ কিছুদিন পরেই সুদারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবরেটরিতে গবেষণার চাকরি পান। বেশিরভাগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানই গবেষকদলকে নতুন উদ্ভাবনে ক্রমাগত চাপের মুখে রাখে, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ‘মলিকিউলার বায়োলজি ল্যাবরেটরি’ কখনো কাজের জন্য চাপ দেয় না। সুতরাং সুদারল্যান্ড কৃত্রিমভাবে আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করা এত দুরূহ কেন সেটা নিয়েই গবেষণা শুরু করলেন এবং বছরের পর বছর পার করে দিলেন। এসময় তিনি ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে লাগলেন।
এই দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি সম্পুর্ন নতুন ধারণা প্রস্তাব করলেন। তিনি বললেন, আদি প্রাণকোষের সমস্ত মৌলিক উপাদান একসাথেই সৃষ্টি হয়েছিল।
জন সুদারল্যান্ড বলেন, ‘ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট ‘আরএনএ’র কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান ঠিকঠাক কাজ করে না।‘ প্রতিটি আরএনএ নিউক্লিওটাইড- শর্করা, একটি ভিত্তিমূল এবং ফসফেট দিয়ে তৈরি। কিন্তু গবেষণাগারে প্রমাণিত হয়েছে যে, আরএনএ’র মূল উপাদানের সাথে শর্করাকে মেলানো সম্ভব নয়। কারণ মলিকিউলের বেমানান আকার শর্করাকে মিশতে বাধা দেয়।‘
সুতরাং সুদারল্যান্ড সম্পূর্ণ ভিন্ন উপাদান দিয়ে আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করার জন্য গবেষণা শুরু করলেন। যথারীতি তার গবেষকদল ভিন্ন ধরণের শর্করা এবং সায়ানাইডের যৌগ সিনামাইডসহ পাঁচটি সাধারণ মলিকিউল দিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। গবেষক দল উপাদানগুলোকে কয়েক ধাপের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করলেন। ফলশ্রুতিতে চারটি আরএনএ নিউক্লিওটাইড এর দুটি উৎপন্ন হল। এই গবেষণা প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিলো সেই অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিলো এবং জন ডেভিড সুদারল্যান্ডের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।
অনেক পর্যবেক্ষক সুদারল্যান্ডের গবেষণার ফলাফলকে আরএনএ ঘরানার পক্ষে নতুন প্রমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। কিন্তু সুদারল্যান্ড নিজে ওই পর্যবেক্ষকদের সাথে একমত ছিলেন না। আরএনএ ঘরানার ক্ল্যাসিকাল তত্ত্ব অনুসারে, প্রথম অণুজীবের ভেতরে প্রাণের সব কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী ছিলো আরএনএ। কিন্তু সুদারল্যান্ড আরএনএ ঘরানার গবেষক ও পর্যবেক্ষকদের সেই ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে বললেন, তাদের মতামত ‘হতাশাজনকভাবে আশাবাদী’। তিনি বিশ্বাস করতেন আরএনএ সেখানে ছিলো কিন্তু তা একমাত্র উপাদান নয়।
সুদারল্যান্ড আরএনএ ঘরানার তত্ত্ব পরিহার করে সোসটাকের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেন। সোসটাক আরএনএ ঘরানার ‘নিজেই নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে প্রথমে’ এবং ইতালির বিজ্ঞানী পিয়েরে লুইগি লুইজি প্রস্তাবিত ‘কোষের খোলস বা কাঠামো গঠন হয়েছে প্রথমে’ এই দুই তত্ত্বের সমন্বয় করে মত দিয়েছিলেন দুটো কাজ একসঙ্গেই ঘটেছিলো।
তবে সুদারল্যান্ড আরও সামনে এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘প্রাণের সবকিছুই প্রথমে, একসঙ্গেই সৃষ্টি হয়েছিল’। তিনি চেষ্টা করলেন পারস্পরিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন বস্তুগত উপাদান থেকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে একবারে স্বয়ং সম্পূর্ণ কোষ সৃষ্টি করতে। তার প্রথম সূত্র ছিলো নিউক্লিওটাইডের সংশ্লেষণ সম্পর্কে কিছুটা বেমানান বিবরণ, যেটাকে শুরুতে মনে হয়েছিল ঘটনাচক্রের ফল।
সুদারল্যান্ডের কর্মপ্রক্রিয়ার শেষ ধাপে সুদারল্যান্ড নিউক্লিওটাইডে ফসফেট যুক্ত করে দেন। কিন্তু তিনি গবেষণায় যা পেলেন তা হল বিক্রিয়ার শুরুতেই ফসফেট মিশিয়ে দিলে সর্বোৎকৃষ্ট ফলাফল পেতে পারতেন, কারণ এতে নিউক্লিওটাইডের প্রাথমিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। এরকম পরিস্থিতিতে বিক্রিয়ার জন্য আগেই ফসফেট যুক্ত করা অত্যাবশ্যকীয় হলেও কাজটি ছিল খুব ঝামেলাপূর্ণ, কিন্তু সুদারল্যান্ড ঝামেলার মাঝেই দেখতে পেলেন দারুণ সম্ভাবনা।
এ থেকেই সুদারল্যান্ড ভাবতে শুরু করলেন ফসফেটের মিশ্রণটি ঠিক কতটা জটিল এবং ঝামেলাপূর্ণ হতে পারে। পৃথিবীর শৈশবকালে অবশ্যই শত শত রকমের রাসায়নিক উপাদানের একত্রে উপস্থিতি ছিল এবং এদের মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল তরল গাদ বা কাদামাটির মত বস্তু এবং সেগুলো যথাসম্ভব পরস্পর বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। ১৯৫০ সালে স্ট্যানলি মিলার ঠিক একই ধরণের কাদার মিশ্রণ বানিয়েছিলেন। স্ট্যানলি মিলারের কাদার মিশ্রণ ছিল সুদারল্যান্ডের মিশ্রণ থেকেও জটিল ও ঘন। সেই কাদার মধ্যে ছিল অণুজৈবিক মলিকিউল। কিন্তু সুদারল্যান্ড বলেন, ‘কাদার মিশ্রণের মধ্যে প্রচুর অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানও মিশে ছিল যাদের বেশিরভাগই অজৈবিক।‘
সুদারল্যান্ডের নতুন গবেষণার অর্থ দাঁড়ায় মিলারের গবেষণা পদ্ধতি যথেষ্ট ফলপ্রসূ ছিল না। বরং মিলারের গবেষণার প্রক্রিয়া ছিল খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। ফলে ভালো রাসায়নিক উপাদানগুলো মিশ্রণের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। সুতরাং সুদারল্যান্ড পৃথিবীর আদি অবস্থার সেই ‘গোল্ডিলকস কেমিস্ট্রি’ বের করার জন্য অনুসন্ধান শুরু করেন, যা এতটা বিশৃঙ্খল নয় যে তা অকেজো হয়ে পড়বে, আবার এতটাও সরল নয় যে তার সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে। রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণটিকে যথেষ্ট জটিল হতে হবে যাতে প্রাণের সব উপাদান একই সঙ্গে গঠিত হতে পারে এবং এরপর একসঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
অন্যভাবে বলা যেতে পারে, প্রায় চারশ কোটি বছর আগেকার আমাদের পৃথিবীতে ছিল একটি উত্তপ্ত পুকুরের মত জলাশয় এবং তা সেভাবেই পতিত অবস্থায় ছিল বছরের পর বছর, রাসায়নিক উপাদানগুলো প্রাণের বিকাশের জন্য উপযোগী হওয়ার অপেক্ষায়। তারপর একসময়ে হয়তো কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রথম প্রাণকোষটি সৃষ্টি হয়ে যায়।
মনে হতে পারে এ-তো অসম্ভব, যেমন-ভাবে মধ্য যুগের অপরসায়নবিদেরা বলতেন নানা অলীক গল্প। তবে সুদারল্যান্ডের তথ্য-প্রমাণ কিন্তু ক্রমেই গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছিল। ২০০৯ সাল থেকেই তিনি দেখাচ্ছেন, একই রাসায়নিক উপাদান যা তার গবেষণার জন্য দুটো আরএনএ নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করেছিল তারাই প্রাণের অন্যান্য অণুজীব উপাদান সৃষ্টিতে সমান ভূমিকা রাখতে পারে।
তাহলে অবশ্যই পরের পদক্ষেপ হবে আরও বেশি আরএনএ নিউক্লিওটাইড তৈরি করা। যদিও তিনি অধিক পরিমাণে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি করতে পারেন নি। কিন্তু ২০১০ সালে তিনি প্রায় কাছাকাছি ধরণের অণুজীব সৃষ্টি করতে সক্ষম হন যেগুলোকে নিউক্লিওটাইডে রূপান্তর করা সম্ভব। একইভাবে ২০১৩ সালে সুদারল্যান্ড অ্যামাইনো অ্যাসিডের মূল উপাদান সৃষ্টি করতে সক্ষম হন, যা প্রাণের সবচেয়ে মৌলিক উপাদান। এ-পর্যায়ে তিনি গবেষণায় বিক্রিয়া সুসম্পন্ন করতে আগের রাসায়নিক উপাদানের সাথে কপার সায়ানাইড যুক্ত করে দেন।
সায়ানাইডের সাথে সম্পৃক্ত রাসায়নিক উপাদানে প্রাণের কিছু সাধারণ বিষয়ের প্রমাণ উঁকি দিয়ে যায় এবং ২০১৫ সালে সুদারল্যান্ড সায়ানাইডযুক্ত রাসায়নিক উপাদান নিয়ে পুনরায় গবেষণা করতে মনোনিবেশ করেন। গবেষণায় তিনি দেখালেন একই রাসায়নিক মিশ্রণ প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লিপিড সৃষ্টিরও পূর্ব শর্ত, লিপিড হল সেই মলিকিউল যা কোষের দেয়াল তৈরি করে। সুদারল্যান্ডের সব গবেষণার রাসায়নিক বিক্রিয়া অতিবেগুনি আলোর প্রতিফলনে সম্পন্ন করা হয় এবং বিক্রিয়াতে ব্যবহার করা হয় গন্ধক এবং বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ব্যবহৃত হয় তামা।
জ্যাক উইলিয়াম সোসটাক বলেন, ‘প্রাণ বিকাশের প্রতিটি উপাদান মূলত রাসায়নিক বিক্রিয়ার একটি সাধারণ মর্মস্থল থেকেই উদ্ভূত হয়েছে।‘
যদি সুদারল্যান্ডের গবেষণা সঠিক হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে গত চল্লিশ বছর ধরে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে সে বিষয়ে যে গবেষণা চলমান সেটা ভুলভাবে চলছিল। কোষের জটিলতা এখন পরিষ্কার হয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা করছিলেন যে, আদি কোষের উপাদানগুলো পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হয়েছিলো একটি একটি করে।
সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আরএনএ প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল’ লেসলি ওরগেল এর এমন প্রস্তাবনার পরেই আসলে বিজ্ঞানীরা একটি উপাদানকে আরেকটি উপাদানের আগে পেতে চাইলেন এবং এরপর সেটি থেকে আরেকটি উপাদানকে উদ্ভাবন করতে চাইলেন। কিন্তু সুদারল্যান্ড মনে করলেন, প্রাণের উৎপত্তির রহস্য সমাধানের সবচেয়ে ভাল উপায় হল প্রাণের সব উপাদান একইসাথে সৃষ্টি হয়েছিল কী না সেটা আগে খুঁজে দেখা।
সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আমরা যেটা করলাম সেটা হল, একই সাথে প্রাণের সব উপাদান সৃষ্টি হওয়াটা অসম্ভব এই সেকেলে ধারণাকে বাতিল করে দিলাম।‘ প্রাণের সব মৌলিক উপাদানই একবারেই, একসঙ্গেই সৃষ্টি হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন সুদারল্যান্ড।
ফলে সোসটাক এখন সন্দেহ করছেন, প্রাণের অণুজীব উপাদানগুলো সৃষ্টি এবং সেগুলোকে একত্রিত করে জীবন্ত কোষে পরিণত করার যেসব গবেষণা চলছিলো সেসব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় একটি কারণে- গবেষণাগুলো ছিল অতি বেশি মাত্রায় সরল। এতদিন বিজ্ঞানীরা শুধু তাদের পছন্দের সামান্য কিছু রাসায়নিক উপাদান দিয়েই গবেষণা করতেন এবং পৃথিবীর প্রথমদিককার পরিবেশে হাজির ছিল এমন অন্যান্য সব রাসায়নিক উপাদানকে গবেষণার বাইরে রেখেছিলেন তারা। কিন্তু সুদারল্যান্ডের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রাণের উৎস সন্ধানে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়াতে আরো কিছু রাসায়নিক উপাদান যোগ করলে বিক্রিয়ার ফলাফলে আরও জটিলতা এবং বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করা সম্ভব।
২০০৫ সালে আদি কোষে আরএনএ এনজাইমের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে গিয়ে সোসটাক এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এনজাইমের দরকার হয়েছিলো ম্যাগনেসিয়াম। কিন্তু তা আবার কোষের চারপাশের ঝিল্লির মতো আবরণটা ধ্বংস করে দেয়।
এই সমস্যার সমাধানে অতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান যুক্ত করার ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। একটি নির্ভেজাল ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে ভেসিকল সৃষ্টির পরিবর্তে বিজ্ঞানীরা দুটির মিশ্রণ থেকে ভেসিকল সৃষ্টি করলেন। এই নতুন জটিল যৌগের ভেসিকল ম্যাগনেসিয়ামের সাথে টিকে থাকতে পারে এবং তার মানে হল তারা কার্যকর আরএনএ এনজাইমকেও ধারণ করতে পারবে। প্রথম জিনও সম্ভবত এই জটিলতাকে ধারণ করেছিল।
আধুনিক অণুজীব তাদের জিন বহনের জন্য নির্ভেজাল ডিএনএ ব্যবহার করে। কিন্তু প্রাণের উৎপত্তির সময় সম্ভবত নির্ভেজাল ডিএনএ’র অস্তিত্ব ছিল না। সেসময় সম্ভবত আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের জটিল মিশ্রণ ছিল। ২০১২ সালে সোসটাক দেখালেন, আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের এই জটিল মিশ্রণ ‘মোজাইকের’ মত দেখতে মলিকিউলে একত্রিত হয়েছিলো এবং এর আচার-আচরণ প্রায় খাঁটি আরএন’র মতই ছিলো। এই আরএনএ এবং ডিএনএ নিউক্লিওটাইডের জটিল মিশ্রণের শিকল ভাঁজও হতে পারতো।
এ থেকে বুঝা যায় আদি প্রাণকোষ খাঁটি আরএনএ বা ডিএনএ তৈরি করতে পারলো কি পারলো না সেটা কোনো সমস্যা ছিলো না। সোসটাক বলেন, ‘আদি কোষে হয়তো আরএনএ সদৃশ কোনো উপাদান ছিলো, যা আরএনএ’র আরো জটিল কোনো সংস্করণ।‘
হয়তো গবেষণাগারে সৃষ্ট টিএনএ এবং পিএনএ-র মতো আরএনএ-র বিকল্প কোনো উপাদানের জন্যও জায়গা ছিলো। টিএনএ এবং পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, ফলে পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ত্ব কখনো ছিলো কিনা নিশ্চিত নয়। তবে তারা যদি থেকে থাকে তাহলে প্রথমদিককার প্রাণকোষগুলো হয়তো আরএনএ-র পাশাপাশি তাদেরকেও ব্যবহার করেছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছে আরএনএ দিয়ে এই ধারণা ঠিক নয়, বরং সেখানে আরএনএ ছাড়াও আরো নানা উপাদান ছিলো।
এই গবেষণাগুলোর শিক্ষা হল যে, আদি প্রাণকোষ সৃষ্টি করে দেখানোর কাজকে একসময় যতটা কঠিন মনে হয়েছিল বাস্তবে তা হয়তো ততটা কঠিন নয়।
কিন্তু একটা সমস্যার সমাধান সুদারল্যান্ড বা সোসটাক কেউই দিতে পারেন নি এবং সেটা অনেক বড় একটা সমস্যা। প্রথম প্রাণের অবশ্যই শক্তি উৎপাদনের জন্য যেকোনো ধরণের বিপাক ক্রিয়ার ব্যবস্থা ছিল। যেখান থেকেই শুরু হোক না কেন প্রাণকে অবশ্যই শক্তি আহরণ করতে হয় আর নয়তো তা বেঁচে থাকতে পারবে না।
এই ইস্যুতে মাইক রাসেল, বিল মার্টিন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের ‘বিপাক ক্রিয়া প্রথমে’ এই তত্ত্বের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করেন সুদারল্যান্ড। সুদারল্যান্ড বলেন, ‘আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীরা যখন বিপাক ক্রিয়া প্রথমে উদ্ভূত হয়েছে এমন ধারণা পোষণকারী বিজ্ঞানীদের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হন তখন তারা একটা বিষয়ে একমত হন যে, যেভাবেই হউক না কেন, প্রথম প্রাণের উৎপত্তির সময় সেখানে বিপাক ক্রিয়ার উপস্থিতিও থাকতেই হবে। এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার শক্তির উৎস কী ছিলো সেটাই হল বড় প্রশ্ন। ‘
এমনকি যদি মার্টিন এবং রাসেলের তত্ত্ব- প্রাণের সূচনা হয়েছিল সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে লাভা মিশ্রিত খনিজ পানিতে, এমন তত্ত্ব যদি ভুলও হয় তবুও তাদের তত্ত্বের অনেক উপাদান সঠিক। এর মধ্যে একটি হল- প্রাণের বিকাশে নানা ধাতুর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা।
প্রকৃতিতে, অনেক এনজাইমেরই কেন্দ্রে একটি ধাতুর অণু পাওয়া যায়। অনেক সময় এই ধাতব অংশটাই এনজাইমের সবথেকে সচল এবং কর্মক্ষম অংশ, আর বাদবাকি অংশ এর সহায়ক কাঠামো হিসেবে কাজ করে। প্রথমদিকের প্রাণের এত জটিল এবং উন্নত এনজাইম ছিল না বরং প্রথম প্রাণ সম্ভবত আবরণবিহীন ধাতুকে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
জার্মান বিজ্ঞানী গুনটার ভাসটারশাওজার এই বিষয়টির উল্লেখ করেন। যখন তিনি দাবি করেছিলেন, প্রাণের সূচনা হয়েছিল লোহার পাইরাইটের ভেতর। একইভাবে রাসেল জোর দাবি তোলেন, সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে লাভা মিশ্রিত গরম পানিতে প্রচুর পরিমাণ ধাতব ছিল এবং সেগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করত। এদিকে মার্টিন তার গবেষণায় দেখান পৃথিবীতে প্রাপ্ত সব প্রাণীর সাধারণ পূর্ব পুরুষ যেই আদি-কোষ তাতে প্রচুর পরিমাণে লোহাভিত্তিক এনজাইম অবশ্যই থাকতে হবে।
এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, সুদারল্যান্ডের সৃষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো তামা এবং ঘটনাচক্রে গন্ধকের উপর নির্ভর করে। ভাসটারশাওজারও বিক্রিয়াতে গন্ধকের নির্ভরতার উপর জোর দিয়েছিলেন এবং সোসটাকের আদি-কোষের আরএনএ’র জন্য ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন হয়।
তবুও প্রাণের উৎপত্তির গবেষণায় সমুদ্রের গভীরের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সোসটাক বলেন, ‘আপনি যদি আধুনিক কোষের বিপাক ক্রিয়ার দিকে তাকান তাহলে সেখানে লোহা এবং গন্ধকের মিশ্রিত উপস্থিতি দেখতে পাবেন। যা থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়া যায় যে, প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের আশেপাশে, যেখানকার পানিতে প্রচুর পরিমাণে লোহা এবং গন্ধক ছিলো।
তবে সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের আশেপাশের পানিতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে এমন ধারণা একটি কারণে ভুল হতে বাধ্য। কেননা, গভীর সমুদ্রে কখনো প্রাণের বিকাশ সম্ভব নয়। সুদারল্যান্ড বলেন, আমরা প্রথম প্রাণের যে রসায়নটি উদঘাটন করলাম তা কিন্তু অতিবেগুনী রশ্মির ওপর খুবই নির্ভরশীল। আর অতি বেগুনী রশ্মির একমাত্র উৎস হল সূর্য। ফলে সুর্যের আলো পৌঁছাতে পারে এমন জায়গাতেই প্রাণের উৎপত্তি হতে হবে। কিন্তু গভীর সমুদ্রেতো তা পৌঁছাতে পারে না।‘
সোসটাক স্বীকার করে নেন, গভীর সমুদ্রে প্রাণের বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে অসম্ভবের বিষয় হল সমুদ্রের তলদেশ প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত বায়ুমণ্ডলীয় রাসায়নিক পরিবেশ থেকে অনেক দূরে, যেখান থেকে সায়ানাইডের মত প্রচুর পরিমাণ শক্তি উৎপাদনকারী উপাদান যোগ হতে পারে না। কিন্তু এই সমস্যার কারণে সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা থেকে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এমন তত্ত্বকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। হতে পারে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখগুলো ছিল সমুদ্রের অগভীর পানিতে যেখানে সূর্যের আলো এবং বায়ুমণ্ডলীয় রাসায়নিক পরিবেশ থেকে সায়ানাইড সহজেই প্রবেশ করতে পারে।
আরমেন মালকিদজানিয়ান বিকল্প একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, সম্ভবত সমতল ভূমিতে পুকুরের মতো কোনো অগভীর জলাশয়ে, যেখানে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে বের হওয়া লাভা এসে জমা হত, এমন কোনো স্থানে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল।
আরমেন মালকিদজানিয়ান গভীরভাবে কোষের রাসায়নিক গঠন পর্যবেক্ষণ করলেন- বিশেষত কোন ধরণের রাসায়নিক উপাদানকে কোষ নিজের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় আর কোনোগুলোকে বাইরে রাখে। তিনি দেখলেন, সব ধরণের প্রাণকোষ প্রচুর পরিমাণে ফসফেট, পটাশিয়াম এবং আরও কিছু ধাতব উপাদান ধারণ করে কিন্তু সেখানে সোডিয়ামের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে।
আজকের দিনের কোষগুলো পাম্প করার মাধ্যমে কোষের ভেতরে প্রয়োজনীয় উপাদান ঢুকাতে পারে আবার বাইরে বেরও করে দিতে পারে। কিন্তু আদি প্রাণকোষের এই সুবিধা ছিল না কারণ আদি কোষে এমন কাজের জন্য সহায়ক যন্ত্রপাতি বা অঙ্গ ছিল না। সুতরাং মালকিদজানিয়ান দাবী করেন, আদি কোষ এমন কোনো স্থানে বিকশিত হয়েছিল যেখানে আধুনিক কোষগুলোর রাসায়নিক উপাদানের মিশ্রণের মতো মিশ্রণের উপস্থিতিও ছিল। সুতরাং এখানেই গভীর সমুদ্রে প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছে, এমন ধারণা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কারণ, প্রতিটি কোষ অতি উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম এবং ফসফেট এবং খুব অল্প পরিমাণ সোডিয়াম বহন করে। অথচ সমুদ্রের পানিতে সোডিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি।
এ থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, সমুদ্রের তলদেশে থাকা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের আশেপাশে প্রাণের বিকাশ হয়েছে এই তত্ত্ব ঠিক নয়। তার বদলে বরং ভূ-পৃষ্ঠের কোনো সক্রিয় আগ্নেয়গিরির পাশের অগভীর গরম জলাশয়ে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে বললে সেটাই বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। এমন জলাশয়েই দেখা যায় তেমন পরিবেশ ঠিক যেমনটা প্রাণ বিকাশের জন্য দরকার। কারণ এমন জলাশয়েই পাওয়া যায় সেসব ধাতব উপাদানের সমস্ত মিশ্রণ যেগুলো আধুনিক কালের প্রাণকোষে দেখা যায়।
সোসটাক নিজেও এমন দৃশ্যের ভক্ত। তিনি মজা করে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার মনে হয় আমার প্রিয় দৃশ্য হতে পারে সমতল ভূপৃষ্ঠে সক্রিয় কোনো আগ্নেয়গিরি এলাকার অগভীর হ্রদ বা পুকুর। সেখানে হয়ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে গরম তরল প্রবাহ আছে কিন্তু সেগুলো গভীর সমুদ্রের আগ্নেয়গিরি নয়, বরং আমেরিকার মনটানা এবং আইডাহো প্রদেশের ইয়েলোস্টোন পার্কের অগভীর জলাশয়ের তলদেশে থাকা জ্বালামুখের মত।‘
সুদারল্যান্ডের প্রস্তাবিত প্রাণ সৃষ্টির রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্ভবত এরকম পরিবেশেই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে। বসন্তকালেই প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানের মেলবন্ধন ঘটে, কারণ তখন পানির স্তর কমে যায় এবং কিছু স্থান শুকিয়ে যায় এবং সেখানে প্রচুর পরিমাণে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি পড়ে। এ ছাড়া, সোসটাক বলেন, ‘অগভীর হ্রদ বা জলাশয়ই হতে পারে আদি প্রাণকোষের উৎপত্তির জন্য উপযুক্ত স্থান। যেখানে আদি প্রাণকোষ বেশিরভাগ সময় অপেক্ষাকৃত শীতল ছিল। আর এই পরিবেশ আরএনএ-র প্রতিরূপ সৃষ্টি এবং অন্যান্য সরল বিপাক ক্রিয়ার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু ওই পরিবেশেই মাঝে-মধ্যেই আদি কোষ কিছুটা সময়ের জন্য উত্তপ্ত হত, যার ফলে আরএনএ সূতাগুলো আলাদা হয়ে যেত এবং পরের ধাপে প্রতিরূপ সৃষ্টি করার জন্য তৈরি হয়ে যেত। সেই অগভীর জলাশয়ে গরম পানির স্রোত ছিল ফলে সেখানে হয়তো বিদ্যুৎশক্তি তৈরি হতো যা আদি কোষগুলোর বিভাজনে সাহায্য করত।
তবে সুদারল্যান্ড প্রাণের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে তৃতীয় একটি সম্ভাবনার প্রস্তাব করলেন। তিনি বললেন, ‘উল্কা পতনের স্থানগুলোতেও প্রাণের বিকাশ ঘটে থাকতে পারে।’
পৃথিবীর জন্মের পর প্রথম পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে শুধু এতে উল্কাপাত ঘটেছিল এবং আমরা এখনো মাঝে মাঝে উল্কা পতন দেখতে পাই। বড়সড় একটি উল্কার আঘাতে সমতলে সৃষ্টি হতো বিশালাকার গর্ত, গর্তে পানি জমে যে হ্রদের সৃষ্টি হয় সেখানেই হয়তো দেখা দেয় আরমেন মালকিদজানিয়ানের প্রস্তাবিত প্রাণ বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ। প্রথমত, উল্কাপিণ্ডগুলো প্রধানত ধাতব উপাদানে তৈরি ছিলো। সুতরাং উল্কার আঘাতে সৃষ্ট গর্তে বিপুল পরিমাণ লোহা এবং গন্ধকের উপস্থিতি থাকার কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল উল্কার আঘাতে এবং অতি উচ্চ তাপে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পাথরের আবরণ (Earth's Crust) গলে গিয়েছিল। যার ফলে পাথরে ফাটল ধরে ভেতর থেকে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো সৃষ্টি হয় এবং পানি গরম হয়।
সুদারল্যান্ড কল্পনা করেন ছোট ছোট নদী এবং পানির প্রবাহ উল্কার আঘাতে সৃষ্ট খাড়ির ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে, আর পাথর থেকে বয়ে আনছে সায়ানাইডভিত্তিক রাসায়নিক, আর উপর থেকে সূর্য ঢালছে অতিবেগুনী রশ্মির বিকিরণ। প্রতিটি স্রোতেই ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক মিশ্রণ আছে ফলে প্রতিটি স্রোতের মিলনে ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে এবং এভাবে সময়ের হাত ধরে জলাধারে উৎপাদিত হচ্ছে প্রথম প্রাণের আধার।
সবশেষে ওই স্রোতগুলো সেই গর্তের তলদেশে প্রায় সমুদ্রের তলদেশের মতো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো জলাশয় বা পুকুরে গিয়ে মিলিত হচ্ছে। এমন কোনো একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার পুকুরেই হয়তো পৃথিবীর প্রথম প্রাণকোষটি এর সবগুলো উপাদান সহ সৃষ্টি হয়।
সুদারল্যান্ড বলেন, ‘এটা প্রাণ সৃষ্টির খুবই সুবিন্যস্ত একটি দৃশ্য।‘ আর পরীক্ষাগারে প্রাপ্ত রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভিত্তিতেই এই দৃশ্যটি কল্পনায় আঁকলেন সুদারল্যান্ড। তিনি বললেন, ‘এই দৃশ্যটাই একমাত্র দৃশ্য যা কেউ রসায়নের সূত্র অনুযায়ী কল্পনা করতে পারেন।‘
সোসটাক কিন্তু কোনোটার সঙ্গেই পুরোপুরি একমত পোষণ করলেন না। তবে তিনি বললেন, সুদারল্যান্ডের তত্ত্ব গভীর মনোযোগের দাবীদার। সোসটাক বলেন, ‘আমি মনে করি, উল্কার আঘাতে সৃষ্ট গভীর খাদের দৃশ্যকল্পটি বেশ সুন্দর। সেখানে জমা হওয়া রাসায়নিক মিশ্রিত পানিতেও হয়তো প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব। একই সাথে আমি এও মনে করি যে, সমুদ্রের গভীরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পরিবেশেও প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে। দুটি বিতর্কের স্বপক্ষেই প্রচুর যুক্তি আছে।’
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিজ্ঞান-সভার বিতর্ক এবার যুক্তির লড়াইয়ের মঞ্চের মত চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কিন্তু মনে হয় না কোনো পক্ষই দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন। সিদ্ধান্ত হবে রসায়ন এবং আদি কোষের বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে। তবে এই দুটো স্থানের কোনো একটিতে যদি প্রাণ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর কোনো একটি উপস্থিত ছিলো না বলে প্রমাণ হয় তাহলে সেটি প্রাণের সম্ভাব্য উৎপত্তি স্থলের মর্যাদা হারাবে এবং অপরটি গৃহীত হবে।
এই বিতর্কের ইতিবাচক দিক হল, বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম দীর্ঘদিন ধরে চলমান পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে বিতর্কের একটি ব্যাপকভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেখতে যাচ্ছি আমরা। সুদারল্যান্ড বলেন, প্রাণের উৎপত্তির রহস্যটি এখন আরো বেশি সমাধানযোগ্য মনে হচ্ছে।
তবে সোসটাক এবং সুদারল্যান্ডের প্রস্তাবিত ‘প্রাণের সবকিছু একবারেই, একসঙ্গেই সৃষ্টি হয়েছিল’ তত্ত্ব এখনো অসম্পুর্ণই রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এটি আমাদের সামনে শুধুই একটি রেখা চিত্রের মতো একটি আখ্যান উপস্থাপন করে মাত্র। তবে এই দুই বিজ্ঞানীর পদক্ষেপগুলো বিগত কয়েক দশক ধরে চলমান নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষার ফলাফল দিয়ে সমর্থিত। ‘সবকিছু একবারে সৃষ্টি হয়েছিল’ তত্ত্ব প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত সবগুলো দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি সমন্বয়ও সাধন করে। এটি অন্যান্য প্রতিটি তত্ত্বের ইতিবাচক দিকগুলোকে একই সূতায় বাঁধার চেষ্টা করে এবং একই সাথে সেগুলোর সমস্যাগুলোও সমাধানের চেষ্টা করে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ‘সবকিছু একবারে সৃষ্টি হয়েছিল’ তত্ত্ব রাসেলের সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে লাভা মিশ্রিত গরম পানির স্রোতের এলাকায় প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল সেই তত্ত্বকেও ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে না বরং সেটার সবচেয়ে ভালো দিকগুলোকে গ্রহণ করে নেয়।
পরিশেষে বলা যায়, আমরা আসলে কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত করে জানতে পারবো না ৪০০ কোটি বছর আগে ঠিক কী ঘটেছিল। মার্টিন বলেন, ‘যদি কৃত্রিমভাবে এখন আদি পৃথিবীর সেই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা যায় এবং এসচেরিচিয়া কোলি নামের ব্যাকটেরিয়া উঁকি দেয় অন্য প্রান্তে তবুও প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে আমরা (প্রাণ) ওভাবেই আবির্ভুত হয়েছিলাম।‘
আমরা সর্বোচ্চ যা করতে পারি তা হল, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সকল সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে তার একটা সঙ্গতিপূর্ণ চিত্রকল্প আঁকতে পারি। গবেষণাগারে যেসব রাসায়নিক বিক্রিয়া ভিত্তিক পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালানো হয়েছে, আদি পৃথিবী সম্পর্কে আমরা যেসব তথ্য জানতে পেরেছি, এবং জীব বিজ্ঞান প্রাণের সবচেয়ে প্রাচীন গঠন সম্পর্কে যা কিছু উদঘাটন করেছে সেসবের ভিত্তিতেই পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত এই চিত্রকল্পটি তৈরি করতে হবে।
অবশেষে, গত প্রায় ১০০ বছর ধরে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নানা গবেষণা প্রচেষ্টার পর পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রকল্প দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
তার মানে, আমরা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এক বিভক্তির কাছাকাছি চলে আসছি, বিভক্তিটি হল- একদল মানুষ যারা প্রাণের যাত্রা শুরুর কাহিনী জানে আর অপর একদল যারা তা কখনোই জানতে পারেনি। ১৮৫৯ সালে ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশের আগে যারা মারা গেছে তাদের প্রতিটি মানুষ নিজেদের প্রকৃত উৎসের ইতিহাস না জেনেই মরে গেছে, কারণ তারা কেউ বিবর্তনের বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানত না। কিন্তু বর্তমান কালের সকল জীবিত মানুষ, কিছু বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী বাদে, চাইলেই প্রাণী জগতের সাথে আমাদের সম্পর্ক তথা আত্মীয়তার বিষয়টি জানতে পারবে। অনুরূপভাবে ১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগারিনের পৃথিবী প্রদক্ষিণের পর যারা জন্মেছে তারা এমন একটা সমাজে বসবাস করছে যে সমাজ মহাবিশ্বে ভ্রমণ করছে। এমনকি আমরা যদি কখনো সশরীরে মহাশূন্যে নাও যাই তবুও মহাকাশ ভ্রমণ একটি বাস্তব সত্য, বিভিন্ন নভোযান কিন্তু ঠিকই বাস্তবে মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই বাস্তব সত্য ঘটনাগুলো দুনিয়া সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমুল বদলে দিচ্ছে। আমাদেরকে আরো বুদ্ধিমান বা বিজ্ঞ করে তুলছে। বিবর্তনবাদ তত্ত্ব আমাদেরকে এবং আর আর সকল প্রাণকেও আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই সংরক্ষণের শিক্ষা দেয় ও তাগিদ যোগায় কেননা তারাও আমাদের মতোই। মানুষ সহ প্রাণিজগতের সকল জীবই একই আদি প্রাণ থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। বিবর্তনবাদ আমাদেরকে প্রতিটি প্রাণীকে মূল্যায়ন করতে শিখিয়েছে, কারণ মানুষ জানতে পেরেছে সব প্রাণীই তাদের দূর সম্পর্কের বা নিকটাত্মীয়। মহাকাশ ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা আমাদের বিশ্বকে দূর থেকে সার্বিকভাবে দেখত পারি এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারি; যা থেকে আমরা আমাদের পৃথিবীর অনন্যতা এবং তা যে কতটা ভঙ্গুর ও অসহায় তাও উপলব্ধি করতে পারি।
পৃথিবীতে আজ যারা জীবিত আছে তাদের মাঝে কিছু মানুষ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত সততার সাথে বলতে পারবে কোথা থেকে তারা এসেছে। মানুষ জানতে পারবে তাদের পূর্বপুরুষ কে এবং কোথায় ছিল তার বসবাস।
এই জ্ঞান আমাদেরকে আমূল বদলে দেবে। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা হয়তো জানতে পারবো কীভাবে মহাবিশ্বে প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়েছে এবং কোথায় তাকে খুঁজতে হবে। একইসাথে এ থেকে আমরা প্রাণের মর্মগত প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট সম্পর্কেও জানতে পারব। কিন্তু প্রাণের উৎপত্তির পর কীভাবে জন্ম নিলো প্রাণের প্রজ্ঞা, সে সম্পর্কে আমরা এখনো প্রায় কিছুই জানতে পারিনি।
(বিবিসি আর্থ-এ প্রকাশিত মাইকেল মার্শাল এর লেখা ’The secret of how life on earth began’ অবলম্বনে এই লেখা)
আরও পড়ুন…
পূর্ণাঙ্গ প্রাণকোষ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম (৫ম পর্ব)
প্রাণের উৎসের সন্ধানে সমুদ্রের তলদেশে অভিযান (৪র্থ পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (৩য় পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (২য় পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার গল্প (১ম পর্ব)
২০০০-এর প্রথম দশকের প্রথমদিকে প্রাণের প্রথম পথ চলা কীভাবে শুরু হয় এই বিষয়ে প্রধানত দুটো তত্ত্ব প্রচলিত ছিল। আরএনএ ঘরানার বিজ্ঞানীরা মনে করতেন প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে এমন অণুজীব থেকে। ইতিমধ্যে যেসব বিজ্ঞানী ‘বিপাক ক্রিয়া’ প্রথমে শুরু হয়েছিল বলে মনে করতেন তারা গভীর সমুদ্রতলে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে গরম তরল প্রবাহে কীভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ হাজির করলেন। যাইহোক, চলমান এই বিতর্কের মধ্যেই সামনে হাজির হয় তৃতীয় আরেকটি মতবাদ।
আমরা জানি পৃথিবীতে জীবন্ত সব প্রাণই কোষ দিয়ে গঠিত। প্রতিটি কোষই মূলত নরম তুলতুলে ছিদ্রযুক্ত গোলাকার বস্তু যার চারপাশ শক্ত পর্দার আবরণে ঘেরা। কোষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল কোষ প্রাণের সব প্রয়োজনীয় উপাদান একত্রে ধরে রাখে। যদি কোষের দেয়াল কোনো কারণে জীর্ণ হয়ে ধ্বসে যায় তাহলে কোষের মূল উপাদান বেরিয়ে পড়ে এবং কোষের মৃত্যু ঘটে। ঠিক যেমন, যদি কোনো মানুষের উদর থেকে নাড়ীভুঁড়ি কেটে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না।
কোষের বাইরের আবরণ এতোটাই প্রয়োজনীয় যে প্রাণের উৎস সন্ধানী কিছু গবেষক যুক্তি দেখালেন যে, কোষ সৃষ্টির আগেই কোষের বাইরের আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করতেন ‘বংশগতিই প্রথম’ এবং ‘বিপাক ক্রিয়াই প্রথম’ এই দুটি তত্ত্ব বিভ্রান্তিকর। তাদের বিকল্প মতবাদটি ছিল প্রাণের উৎপত্তিতে ‘কোষের কাঠামো গঠন প্রথম’ ঘটনা। এই মতবাদের পুরোধা ব্যক্তি হলেন ইটালির রোমে অবস্থিত রোমা ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিয়েরে লুইগি লুইজি।
লুইজির মতবাদের স্বপক্ষে যুক্তি ছিলো যথেষ্ট সহজ সরল এবং এর বিপক্ষে বিতর্ক করাও কঠিন। কারণ ‘বিপাক ক্রিয়া’ বা ‘নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম আরএনএ’ যেভাবেই প্রাণের যাত্রা শুরু হোক না কেন তার জন্য দরকার প্রচুর রাসায়নিকের একজায়গায় জড়ো হওয়া, যার জন্য আবার সবার আগে দরকার পড়ে একটি কনটেইনার বা ধারকের।
এই যুক্তি অনুযায়ী তাহলে প্রাণের যাত্রা শুরু হওয়ার একটাই মাত্র উপায় আছে, সেটা হল, যেকোনোভাবে আদি পৃথিবীর উত্তপ্ত ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেও প্রাণ সৃষ্টির কিছু কাঁচামাল একত্রিত হয়ে অবিকশিত কোষ বা প্রাথমিক কোষের জন্ম হওয়া। কিন্তু এখন চ্যালেঞ্জ হল এই তত্ত্ব প্রমাণ করতে হলে ল্যাবরেটরিতে একটা সরল এককোষী প্রাণ সৃষ্টি করে দেখাতে হবে।
লুইজি তার সব চিন্তার যোগসূত্র খুঁজে পেলেন আলেক্সান্ডার ওপারিনের কাছে এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রাণের সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনে পরিচালিত গবেষণার শুরুর দিকে। আলেক্সান্ডার ওপারিনের গবেষণার বিষয় ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে। ওপারিন গুরুত্বের সাথে দেখিয়েছিলেন কিছু রাসায়নিক জড়ো হচ্ছে থকথকে জেলি সদৃশ বস্তু বা কোয়াসারভেটের মধ্যে; যা এর কেন্দ্রে আরো কিছু বস্তু ধারণ করতে পারে। তিনি দাবী করেন কোয়াসারভেটগুলোই আসলে প্রাণকোষের প্রথম নমুনা।
যেকোনো চর্বিযুক্ত বা তৈলাক্ত বস্তু পানিতে এমন থকথকে জেলি সদৃশ বস্তু সৃষ্টি করে। আর এইসব রাসায়নিক উপাদান একসাথে লিপিড নামে পরিচিত। আর এভাবেই প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। এই মতবাদকে নাম দেওয়া হয় ‘লিপিড ঘরানা’।
কিন্তু শুধু এই থকথকে জেলি সদৃশ বস্তু (Blob or Film) বা কোয়াসারভেট সৃষ্টি করলেই সব সমাধান হয়ে গেল এমন নয় বিষয়টা। সেগুলোকে স্থিতিশীল থাকতে হবে এবং বিভাজিত হয়ে নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারতে হবে। এবং তাদের ভেতরে কী কী উপাদান পরিবাহিত হচ্ছে তার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। এতকিছু করতে হবে, কিন্তু বর্তমানে একটা কোষ যে পরিণত প্রোটিন ব্যবহার করে তা ছাড়াই।
সঠিক উপাদান সহ গবেষণাগারে প্রাণকোষের সেই প্রাথমিক নমুনা সৃষ্টি করা খুবই কঠিন কাজ। কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন বস্তু ব্যবহার করেও লুইজি এমনকিছু বানাতে পারলেন না যা দিয়ে প্রাণ-সদৃশ কিছু উপস্থাপন করা যায়।
এরপরে ১৯৯৪ সালে লুইজি এক সাহসী প্রস্তাবনা রাখলেন। তিনি বললেন, আদি প্রাণকোষে অবশ্যই আরএনএ থাকতে হবে। তিনি আরও দাবী করেন, এই আরএনএ নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতেও সক্ষম ছিল। লুইজির প্রস্তাবনা বিজ্ঞানে অনেক বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিলো। লুইজির প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আমলে নিলে প্রাণের উৎপত্তিতে ‘কোষের কাঠামো গঠন হয়েছে প্রথমে’ এই তত্ত্বকে বাতিল করে দিতে হয়। তবে লুইজির কাছে উপযুক্ত যুক্তিও ছিল।
ভেতরে জীন ছাড়া শুধু চার পাশের আবরণ সমেত একটি কোষ খুব বেশী কিছু করতে পারে না। সেই কোষ হয়তো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টি করতে পারবে কিন্তু তার নিজের বংশগতির কোনো তথ্য-উপাত্ত পরবর্তী কোষের মাঝে সঞ্চারিত করতে পারবে না। প্রাণকোষ কেবল তখনি বিবর্তিত হতে শুরু করবে এবং ক্রমাগত জটিলতর হয়ে উঠতে পারবে যখন কোষের ভেতরে জীন থাকবে।
এই তত্ত্ব খুব দ্রুত জ্যাক সোসটাকের সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। আমরা ইতিমধ্যে সোসটাকের আরএনএ নিয়ে গবেষণা তুলে ধরেছি। যখন লুইজি ছিলেন ‘কোষের কাঠামো গঠন হয়েছে প্রথমে’ তত্ত্বের প্রথম দিককার সমর্থক ঠিক তখন সোসটাক সমর্থন করতেন জীনতত্ত্বকে।
সোসটাক বলেন, ‘আমরা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনের গবেষণায় বিভিন্ন বৈঠকে মিলিত হয়েছি এবং এই দীর্ঘ বিতর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি, কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ বা কোনটা আগে শুরু হয়েছে। এক পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারলাম আদি কোষে দুটোরই উপস্থিতি ছিলো। আমরা সম্মত হলাম যে, প্রাণ সৃষ্টির জন্য কোষের কাঠামো গঠন এবং বংশগতি দুটোই একসঙ্গে সৃষ্টি হওয়া দরকার।‘
২০০১ সালে সোসটাক এবং লুইজি তাদের তত্ত্বের আরো সমন্বয় করলেন। বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘নেচার’-এ তারা এ বিষয়ে একটি লেখাও লিখলেন। সেখানে তারা বললেন, আদি প্রাণকোষ হয়তো এর ভেতরে নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে সক্ষম এমন আরএনএ সহই সৃষ্টি হয়েছিলো।
তাদের এই তত্ত্ব প্রাণের উৎস গবেষণার ক্ষেত্রে ছিলো একটি যুগান্তকারী ধারণা। সোসটাক শিগগিরই সিদ্ধান্ত নিলেন এই তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ যোগাড়ের জন্য গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ করবেন। কারণ এমন একটা তত্ত্বের সমর্থনে অবশ্যই প্রমাণ দরকার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাথমিক কোষ নিয়ে গবেষণা শুরু করবেন।
এর দুই বছর পর সোসটাক এবং তার দুই সহকর্মী গবেষণায় একটি বড় সাফল্যের ঘোষণা দেন।
সোসটাক এবং তার গবেষক-দল কোষের ভেসিকল (কোষের তরল ধারক) নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ভেসিকল দেখতে অনেকটা সর্পিল ঘন তরলের আকার যার গভীরে এবং বাইরের আবরণে দুটো ফ্যাটি অ্যাসিডের স্তর আছে। ভেসিকলের উৎপাদন ত্বরান্বিত করার উপায় খুঁজতে গিয়ে সোসটাকের গবেষক-দল অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার মত দেখতে থকথকে একটা বস্তুকে (Montmorillonite) বিক্রিয়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন। এই যৌগের মিশ্রণ যোগ করার পরেই ভেসিকলের উৎপাদন ১০০ গুণ দ্রুততর হয়ে গেল। কাদার মত বস্তুর পৃষ্ঠতল ভেসিকল উৎপাদনে অনুঘটকের কাজ করে, ঠিক যেমনটা এনজাইম করে থাকে।
এ ছাড়াও, ভেসিকল এলুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদার (Montmorillonite) কণা এবং কাদার পৃষ্ঠতল থেকে আরএনএ সূতা গ্রহণ করতে পারে। এইসব আদি কোষের নমুনা এখন বহন করছে জীন এবং অনুঘটক। আর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে একটা সরল কাঠামোর মধ্যে।
প্রাণের উৎপত্তি গবেষণায় অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের জটিল যৌগের কাদা (Montmorillonite) প্রয়োগের সিদ্ধান্ত কিন্তু হঠাৎ করেই নেওয়া হয়নি। কয়েক দশক ধরে চলমান গবেষণায় দেখা যাচ্ছিলো যে, প্রাণ সৃষ্টিতে এই যৌগ হয়ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলো।
অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের এই যৌগ (Montmorillonite) একটি সহজলভ্য দ্রব্য। এখনকার সময়ে আমাদের ব্যবহার্য নিত্যদিনের জিনিসপত্রে এটা হরহামেশা ব্যবহৃত হয়, এমনকি বিড়ালের বিছানা বানাতেও এটার ব্যবহার দেখা যায়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত ছাইয়ের ধুলা পৃথিবীর আবহাওয়াতে ভেঙ্গে-মিশে এই যৌগ সৃষ্টি হয়। যেহেতু পৃথিবীর শৈশবে অনেক আগ্নেয়গিরি ছিল সেহেতু অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ প্রচুর পরিমাণে ছিলো।
ফিরে যাই ১৯৮৬ সালে, তখন আমেরিকান রসায়নবিদ জেমস ফেরিস দেখালেন অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আসলে এমন একটি অনুঘটক, যা জৈব-কণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরও পরে তিনি আবিষ্কার করেন অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ আরএনএ সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখে। এই থেকে জেমস ফেরিস ধারণা করেন গড়পড়তা দেখতে কাদার মত এই যৌগটি আসলে প্রথম প্রাণ সৃষ্টির স্থান।
জ্যাক সোসটাক ফেরিসের এই ধারণা গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন এবং অ্যালুমিনিয়াম, সোডিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ ব্যবহার করে আদি কোষের নমুনা সৃষ্টি করতে কাজে লেগে গেলেন। এক বছর পরে সোসটাকের গবেষক-দল প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, প্রথমদিকের কোষ নিজের মতো করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে উঠতে পারে। এমনকি আদি-কোষে আরএনএ সংরক্ষিত থাকে এবং সময়ের হাত ধরে কোষের দেয়ালের বাইরের দিকটা অতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন আদি-কোষ একটা ফুলে ওঠা পাকস্থলী এবং যেকোনো সময় সশব্দে ফেটে পড়বে। ফেটে পড়া রোধ করতে গিয়ে কোষ অধিকমাত্রায় ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করে এবং তাদের সমন্বয়ে নিজের দেয়ালকে আরও মজবুত করে তোলে, ফলে কোষ আরো ফুলে আকারে আরো বড় হয় এবং ফেটে পড়ার আশংকা দূর হয়।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আদি-কোষ যেসব কোষের আরএনএ কম তাদের থেকে ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করে, ফলে সেই কোষগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ে। তার মানে এ থেকে বোঝা যায় আদি-কোষগুলো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং যে কোষের আরএনএ বেশী স্বাভাবিকভাবে সে কোষটিই জিতে যায়। এই অনুসিদ্ধান্ত আরও বিস্ময়কর কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে। যদি আদি-কোষ বেড়ে উঠতে পারে তাহলে সেটা বিভাজিতও হতে পারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিরূপ কোষও সৃষ্টি করতে পারে। তবে কি সোসটাকের গবেষণালব্ধ প্রাথমিক কোষ নিজের প্রতিরূপ বানাতে পারবে?
সোসটাকের প্রথম পরীক্ষায় দেখানো হয়েছে কীভাবে আদি-কোষ বিভাজিত হয়। আদি-কোষকে যদি ছোট ছিদ্র পথে ঢুকিয়ে দুমড়ে মুচড়ে টিউবের ভেতর দিয়ে প্রসারিত করে চালিত করা হয় তাহলে তা বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ তৈরি হয়। কিন্তু এভাবে কৃত্রিম চাপ প্রয়োগ করার পরই শুধু সোসটাকের তৈরি আদি কোষের নমুনা নিজের প্রতিরূপ বানাতে পারে, যা কোনো ভালো সমাধান নয়।
তবে, এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া একেবারে নির্ভেজাল, কারণ এখানে কোনো যান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম জড়িত নাই। এখানে শুধু চাপ প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। কারণ এই প্রক্রিয়ায় আদি কোষ তার নিজস্ব কিছু উপাদান হারায়। এছাড়াও এই পরীক্ষায় দেখা গেল সোসটাকের তৈরি আদি-কোষ শুধু তখনই বিভাজিত হতে পারে যখন ছোট ছিদ্রপথে বল প্রয়োগে প্রবেশ করানো হয়।
ভেসিকলকে বিভাজিত করার আরো উপায় আছে। যেমন কোষকে পানির প্রবল স্রোতে যুক্ত করা যাতে প্রচুর শক্তির সৃষ্টি হয়। এই কৌশল অবলম্বন করা হয় আদি-কোষের অভ্যন্তরীণ উপাদান বের হতে না দিয়ে কোষকে বিভাজিত করার জন্য।
অবশেষে ২০০৯ সালে জ্যাক সোসটাক এবং তার সহযোগী ছাত্র টিং ঝু একটা সমাধান বের করতে সক্ষম হন। তারা সামান্য একটু জটিল আদি-কোষ সৃষ্টি করলেন যার চতুর্দিকে একাধিক দেয়াল, যেন অনেকটা পেয়াজের মত। তবে গঠনে জটিলতা থাকলেও সহজেই তাদেরকে সৃষ্টি করা সম্ভব।
টিং ঝু যখন আদি-কোষের সাথে আরও বেশী ফ্যাটি অ্যাসিড যোগ করলেন তখন আদি-কোষের আকার পরিবর্তিত হয়ে গেল, সূতার মত দেখতে প্রান্তগুলো আরও লম্বা হয়ে গেল। আদি-কোষের আকার যথেষ্ট লম্বা হয়ে গেলে অল্প চাপেই তা বিভাজিত হয়ে কয়েক ডজন ছোট ছোট আদি-কোষে রূপান্তরিত হতে সক্ষম। নতুন সৃষ্ট কোষগুলোর প্রতিটিতেই আরএনএ রয়েছে। একটিতেও আরএনএ হারিয়ে গেল না বরং প্রতিটি ক্ষুদ্র আদি-কোষ তার পিতৃ-কোষ থেকে আসা আরএনএ’র প্রতিরূপ বহন করতে লাগল। তাছাড়া, আদি-কোষ নতুন কোষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া পৌনঃপুনিকভাবে চালিয়ে যেতে পারলো। নতুন সৃষ্ট কোষগুলোও বেড়ে উঠলো এবং বিভাজিত হতে শুরু করলো। ফলে আরো নতুন কোষ সৃষ্টি হতে লাগলো।
পরবর্তী পরীক্ষায় ঝু এবং সোসটাক আদি-কোষ ভেঙে নতুন কোষ জন্ম দেয়ার আরো ভিন্ন ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। গবেষণার এই পর্যায়ে মনে হচ্ছিল অবশেষে সমস্যার বুঝি সমাধান পাওয়া গেল। প্রাণের উৎপত্তির রহস্য বুঝি উদঘাটিত হতে চলেছে।
কিন্তু তাদের সৃষ্ট আদি-কোষ যথেষ্ট কার্যকরী ছিল না। লুইজি ভেবেছিলেন, আদি-কোষ আরএনএ প্রতিরূপ সৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু যতদূর বোঝা যায় তাদের সৃষ্ট আদি-কোষে আরএনএ শুধু অলস বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ করে না।
তাদের সৃষ্ট এই আদি-কোষের মতো কোষ থেকেই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ হয়েছে সেটা প্রমাণ করতে গেলে সোসটাককে দেখাতে হবে সেই কোষের ভেতরে থাকা আরএনএও নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে। কিন্তু তা প্রমাণ করে দেখানো এত সহজ নয়। কারণ দশকব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পরেও কোনো বিজ্ঞানী এমন কোনো আরএনএ সৃষ্টি করে দেখাতে পারেননি যা নিজেই নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে পারে। এই সমস্যার কারণেই প্রাণ বিকাশে আরএনএ তত্ত্ব ঘরানার গবেষণার কাজ প্রথমদিকে ব্যাহত হচ্ছিল এবং তখন পর্যন্ত কেউ এই সমস্যার সমাধান বের করতে পারেননি। এমনকি সোসটাক নিজেও চেষ্টা করেছিলেন তেমন আরএনএ তৈরি করতে কিন্তু পারেন নি।
সুতরাং সোসটাক লেসলি ওরগেলের গবেষণার ফলাফল ও তার লিখিত কাগজপত্র পুনরায় পড়তে শুরু করলেন। আমরা জানি লেসলি ওরগেল দীর্ঘদিন আরএনএ তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। পুরনো ধুলো পড়া কাগজের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রাণের উৎস গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র।
ওরগেল ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আরএনএ’র সূতার মত প্রান্তগুলো কীভাবে নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করে সেই গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ওরগেলের গবেষণার সারাংশ ছিল খুবই সহজ সরল এবং সাধারণ। একটি আরএনএ’র সূতা এবং একতাড়া আলগা নিউক্লিওটাইড তুলে নাও। এরপর নিউক্লিওটাইডগুলো ব্যবহার করে আরেকটি আরএনএ সূতা জড়ো কর। যা প্রথম আরএনএ’র পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। উদাহরণস্বরূপ, ধরি একটা আরএনএ’র সূতার প্রান্তে ‘CGC’ লিখিত আছে, যা থেকে উৎপাদিত হবে অনুরূপ আরেকটা সূতার মত প্রান্ত; যেটাতে লেখা থাকবে ‘GCG’। এই প্রক্রিয়াটা দুবার চালালেই মূল ‘CGC’ এর প্রতিরূপ পাওয়া যাবে।
ওরগেল বুঝতে পারলেন যে, কোনো অনুকূল পরিবেশে আরএনএ’র সূতা এই প্রক্রিয়ায় এনজাইমের সাহায্য ছাড়াই নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে পারে। সম্ভবত এভাবেই প্রথম প্রাণ নিজের জীনের প্রতিরূপ তৈরি করত।
১৯৮৭ সালে ওরগেল ১৪ নিউক্লিওটাইড লম্বা আরএনএ সূতা এবং অনুরূপ ১৪ নিউক্লিওটাইড লম্বা পরিপুরক আরএনএ সূতাও সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন। তিনি এর থেকে বেশী লম্বা আরএনএ বানাতে পারেননি। কিন্তু সোসটাকের চিন্তাকে আলোড়িত করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল।
সোসটাকের ছাত্রী ক্যাটারজিনা আদি কোষেও একই বিক্রিয়া চালাতে চাইলেন। কিন্তু তারা দেখলেন এর জন্য দরকার ম্যাগনেসিয়াম। যা একটি বড় সমস্যা। কারণ, ম্যাগনেসিয়াম আদি কোষকে ধ্বংস করে ফেলে।
সব সমস্যারই সমাধান আছে। এবং এই সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা হল সাইট্রাইট। যা লেবু, কমলা জাতীয় ফলে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিডের মতোই। প্রতিটি জীবন্ত কোষেই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সাইট্রিক অ্যাসিডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটা গবেষণা নিবন্ধে গবেষক-দল উল্লেখ করেন তারা বিক্রিয়ার সময় সাইট্রাইট যুক্ত করে দেন ফলে বিক্রিয়াতে অংশগ্রহণ থেকে ম্যাগনেসিয়ামকে বিরত রাখা সম্ভব হয়। এতে আদি-কোষ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং কোষের প্রতিরূপ সৃষ্টির প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চলতে থাকে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, এই গবেষক-দল ১৯৯৪ সালে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী পিয়ের লুইগি লুইজির প্রস্তাবিত তত্ত্বকেই পরীক্ষার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করলেন। জ্যাক সোসটাক বলেন, ‘আমরা কোষের ফ্যাটি অ্যাসিড ভেসিকলের ভেতরে আরএনএ’র অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টির রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করালাম।‘
এভাবে মাত্র এক দশকের বেশী কিছু সময়ের গবেষণায় জ্যাক সোসটাকের গবেষক-দল প্রাণের উৎস সন্ধানে যুগান্তকারী অর্জন সম্পন্ন করে ফেললেন।
তারা এমন কিছু আদি-কোষের নমুনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেন, যারা নিজেদের জীন বহন করে এবং বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় মলিকিউল সংগ্রহ করতে পারে। এই আদি-কোষ নিজেরাই নিজেদের বৃদ্ধি এবং বিভাজন করতে পারে এমনকি নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতাও পর্যন্ত করতে পারে। আর কোষের ভেতরে চলতে থাকে আরএনএ’র অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টির অবিরাম কর্মযজ্ঞও। যেকোনো বিচারেই তারা ছিলো প্রাণের মতোই।
তারা টিকেও থাকতে পারে। ২০০৮ সালে সোসটাকের গবেষক-দল আরেক পরীক্ষায় জানতে পারলেন, তাদের সৃষ্ট এই আদি-কোষ প্রায় ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও দিব্যি টিকে থাকতে পারে। অথচ এই পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রায় বর্তমান সময়ের বেশীরভাগ কোষই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ফলে সোসটাকের ধারণা আরও জোরালো হয় যে, তাদের সৃষ্ট আদি-কোষের সাথে প্রথম প্রাণের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। এর থেকে আরও প্রমাণিত হয় অবিরাম চলতে থাকা উল্কা পতনের প্রভাবে সৃষ্ট গরমেও আদি-কোষ বহাল তবিয়তে টিকে ছিল।
আরমিন মুলকিদজানিয়ান বলেন, ‘সোসটাক এক মহা কাজ করে ফেলেছেন।‘
কিন্তু তবুও সোসটাকের গবেষণার ফলাফল প্রায় ৪০ বছর ধরে চলমান প্রাণের উৎস গবেষণার বিপরীতে চলে গেল। ‘নিজেই নিজের প্রতিরূপ জন্ম দেওয়ার সক্ষমতা প্রথমে’ বা ‘কোষের খোলস বা কাঠামো গঠন হয়েছে প্রথমে’ এই দুই তত্ত্বের কোনো একটিকে প্রাধান্য না দিয়ে এই দুই মতবাদের সমন্বয় সাধন করে তিনি বলতে চাইলেন এই দুই প্রক্রিয়া সমান-তালে একসাথে চলছিল।
দুই মতবাদের সমন্বয় করার এই প্রচেষ্টা প্রাণের উৎস গবেষণায় আরো নতুন সমন্বিত প্রস্তাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। নতুন এই তত্ত্বে প্রাণ সৃষ্টির সংশ্লিষ্ট সব কর্মকাণ্ড এক সঙ্গেই শুরু হয়েছিলো বলে প্রস্তাব রাখা হয়। এই ‘সবকিছুই প্রথমে’ ধারণা ইতিমধ্যে যোগাড় করে ফেলেছে তথ্য-প্রমাণের বিশাল জ্ঞান সম্পদ। এবং তা হয়তো প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে চলমান গবেষণার সব বিতর্কের সম্ভাব্য সমাধান দিতে পারবে।
(বিবিসি আর্থ-এ প্রকাশিত মাইকেল মার্শাল এর লেখা ’The secret of how life on earth began’ অবলম্বনে এই লেখা)
শেষ পর্বে পড়ুন- তাত্ত্বিক মহা সমন্বয়: আদি প্রাণকোষের সমস্ত মৌলিক উপাদান একসঙ্গেই সৃষ্টি হয়েছিল
আরও পড়ুন...
প্রাণের উৎসের সন্ধানে সমুদ্রের তলদেশে অভিযান (৪র্থ পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (৩য় পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা (২য় পর্ব)
প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানে বিজ্ঞানীদের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার গল্প (১ম পর্ব)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
‘বস্তি এলাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। পানি সরবরাহ ও নর্দমা লাইন প্রায়ই এক হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে দূষিত ও নোংরা পানি পান করছেন তারা।’ এভাবে বলছিলেন ঢাকার বস্তির জীবন মান নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মী বাছেরা আক্তার।
শুধু বস্তি এলাকা নয়, দেশের সব এলাকার সুপেয় পানি সরবরাহের চিত্র এমনই। রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানিই না ফুটিয়ে পান করা যায় না। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ত। রাজশাহীর পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। খুলনায় সরবরাহ করা পানিও না ফুটিয়ে পান করা যায় না। রয়েছে লবণাক্ততাও। গভীর নলকূপের পানিও নিরাপদ নয়, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার কারণে ব্যবহার করাও দুষ্কর। পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎস সীমিত। পাহাড়ি ছড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদন্ডনদীর পানিও কমছে। সুপেয় পানি ও সেচের জন্য অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন।
এ পরিস্থিতিতে আজ ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘আসুন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি।’
সরকারের পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিষ্টি পানিসমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ সুপেয় পানির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি মিলছে না। এ ব্যর্থতা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও হুমকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় পানি বলা যায়। তবে সেখানে কোনো ময়লা ঢুকে পড়লে সেই পানিকে আর সুপেয় থাকে না। সুপেয় পানি না ফুটিয়েই পান করা যাবে।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইরে ময়লা ঢুকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন ঘটনা ঘটলে সেই পানিকে নিরাপদ বলা যাবে না। শুধু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানির মান ভালো হলে চলবে না, বাসা পর্যন্ত ভালো পানি পৌঁছে দিতে হবে। কেননা সরবরাহ লাইনের পানি নিরাপদ রাখাও সংস্থার দায়িত্ব।’
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এ জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। আশা করি সবাই মিলে কাজ করে পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে আমরা নির্ধারণ সময়ে লক্ষ্যপূরণ করতে পারব।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে ৫৯ ভাগ অর্থাৎ ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার ২২০ জন মানুষ সুপেয় পানি সুবিধার আওতায় এসেছে। আর সুপেয় পানি সুবিধার বাইরে রয়েছে ৪১ ভাগ অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৮০ জন মানুষ। এখনো দেশের ১০ ভাগ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে বলা হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চর এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওর এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা। দেশের এই ছয় শ্রেণির এলাকা বিস্তৃত রয়েছে ১০০টি উপজেলায়। দেশের ১৫৯ সিটি ও পৌরসভায় সরবরাহ করা পানির মানও একই। ওইসব এলাকায় ১৬৮টি পানি শোধনাগার, ১ হাজার ৫০০টি গভীর নলকূপে ১৫ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সরকার চালু রেখেছে। গ্রাম পর্যায়ের ২০ লাখ টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল। তবে আর্সেনিক ও মাত্রাতিরিক্ত আয়রন সে পানিও জনজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বিশে^র সবচেয়ে বড় ‘গণবিষ’-এর উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতিকে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বছরে আর্সেনিকে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর ২০০৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তে ২০১২ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে ৪২টি জেলার হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর এসব হাসপাতালে ১৮ হাজার ৬৬২ আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী সেবা গ্রহণ করে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের সরকারিভাবে স্থাপিত গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। সেই হিসাবে জনসংখ্যার বিবেচনায় সরকার ৮৩ জনে একটি পানির উৎস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র জনসংখ্যার বিবেচনায় বর্তমান পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ১১ ভাগ। আর শহর এলাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৮ ভাগ।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারকে সুপেয় পানি সরবরাহে শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে হবে। সেটা করতে হলে প্রতি বছর ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বর্তমান অগ্রগতি প্রায় এক ভাগ। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে সামনের দিনগুলোতে পানি সরবরাহ খাতের অর্জন আরও কম হতে পারে। এ জন্য লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে চারগুণ তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে বেসরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। আর সরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এ দুটো ধরে হিসাব করতে দাঁড়ায় প্রতি ১০ জনে একটি পানির উৎস রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় পানযোগ্য পানি খুবই দুষ্পাপ্য। এসব এলাকার বেশিরভাগ উপজেলায় গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। সরকার পানি সরবরাহ সেবার আওতায় আনতে পেরেছে ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষকে। এখনো ১ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ পানি সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে।
নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থা ৬ থেকে ৭ ফুট নিচেই ভূগর্ভস্থ উৎসে পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকায় পানি পেতে ২৫৫ থেকে ২৬০ মিটার নিচে নামতে হচ্ছে। খুলনায় ভূগর্ভস্থ পানি নেমে গেছে ২৫-৩০ ফুট। রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে এ অবস্থা থাকে। বর্ষার মৌসুমে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়।
অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার নেমে যায়। আর ২৫ ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫-১০ মিটার নেমে যায়। বর্ষার মৌসুমে এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। গ্রাম এলাকায় এ উৎস থেকে ৯৯ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই নদীর পানি কমে যাওয়ায় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনঃভরণ হয় না।
ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির উৎসের অভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চলে সারা বছর সুপেয় পানির সংকট থাকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যরকম সংকট। খরার মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে দেশের অন্যান্য এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির শূন্য স্তরের ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয়। ওইসব এলাকায় ১৬০ ফুটের আগে পানির দেখা মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক এবং পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারকে বর্ষায় কৃত্রিমভাবে মাটির নিচে পানি প্রবেশ করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে দেশ বড় ধরনের পানি সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
উপকূলে লবণাক্ততা সমস্যা : ভূতত্ত্ববিদদের মতে, উপকূলীয় এলাকার পানিতে একবার লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে ওখানকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নদীতে পানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাবে। একই সঙ্গে সাগরের দিক থেকে লবণ পানি প্রবেশের হার বাড়বে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরের উপকূলীয় এলকাগুলোতে আমরা গভীর নলকূপ বসাতে পারি না। এই এলাকায় নলকূপে লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে।’
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা বলছে ভূতত্ত্ববিদরা। কিন্তু ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৫৬টি যৌথ নদী থেকে ইতিমধ্যে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়েও যাচ্ছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারা নওরিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তর নিচে। এখন এই হার আরও বেড়েছে।’
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
২০১০ সালে ভোলার চর কুকরিমুকরি বনের ১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চেয়ে লিখেছিলাম। ‘১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চাই’ শিরোনামে দৈনিকে প্রকাশিত লেখাটি নিয়ে আলাপ ওঠেছিল তখন। চর কুকরিমুকরি বনের উত্তরাংশ বাবুগঞ্জ থেকে পাতিলার বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২০ ফুট প্রশস্ত পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য কুকরিমুকরি ইউনিয়ন পরিষদ বন বিভাগে আবেদন করে। ১৬ মে ২০১০ তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ন্যূনতম গাছ কাটার শর্তে সড়ক নির্মাণের অনুমতি দেয়। সড়কপথে দ্বীপচরে যাতায়াতের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় বাঁচাতে প্রাণদন্ড দেয়া হয়েছিল ১৫ হাজার গাছের। কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, পশুরের মতো অবিস্মরণীয় সব ম্যানগ্রোভ বৃক্ষপ্রজাতি।
চর কুকরিমুকরির পর এবার ভোলার ঢালচরের উপকূল বন বিপদে পড়েছে। উপকূল বন নিশ্চিহ্ন করে ঘরবাড়ি, বাণিজ্যিক মাছের ঘের, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ ছাড়া বনের গাছ কেটে ইটভাটায় বিক্রি হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, ঢালচরের প্রায় একশ একর বনভূমি উজাড় হয়েছে এভাবেই। মূলত বসতি স্থাপন, বেদখল, মাছের ঘের ও মাছ-ঘাট, এবং ইটভাটার কারণে। ঢালচর ইউনিয়নের চর সত্যেন মৌজার মাঝের চরে প্রায় ৭১ একর অরণ্যভূমি উজাড় করা হয়েছে। পুরো অঞ্চলে নিথর হয়ে পড়ে আছে বহু নিহত গাছের গুঁড়ি। চারধারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই রক্তাক্ত লাশ খ-গুলোই জানান দিচ্ছে কী নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক উপকূল বন। গণমাধ্যম জানায়, দ্রুত গাছ কাটার জন্য এখানে ভেকু মেশিন (যন্ত্রচালিত এক্সকাভেটর) ব্যবহার করা হয়। বন নিধনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ জড়িত থাকলেও গণমাধ্যমের কাছে এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
বন কেটে দখল নিয়ে যারা বসত গড়েছেন তাদের সবার ভাষ্য হলো, নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে এই বিরান হওয়া বনভূমিতে তারা আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রাকৃতিকভাবে তো এই বন বিরান হয়নি, নিষ্ঠুরভাবে একে বিরান করা হয়েছে। ঢালচরসহ ভোলা ও উপকূল অঞ্চলে মূলত প্রাকৃতিকভাবেই বিশেষ ম্যানগ্রোভ বন গড়ে ওঠে। ঢালচর সংরক্ষিত বনের আওতায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর এলাকা আছে। স্থানীয় বন বিভাগের ভাষ্য, ১৯৭৬ সালে ঢালচরের মাঝেরচরে বৃক্ষরোপণ করা হয় এবং নদীভাঙনকবলিত মানুষের আশ্রয়ের নামে ইতিমধ্যে ৭৬ একর বন উজাড় হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে বন উজাড়ের ঘটনায় বন বিভাগ ৩৫টি মামলা করেও বন বিনাশ রোধ করতে পারেনি। জোয়ার-ভাটা ও ভূমি ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে চরফ্যাশনের বাস্তুতন্ত্র প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে।
ঢালচর, পূর্বেরচর, ভাসানচর, বয়ারচর, চর আলিম, আন্ডারচর, কলাগাছিয়াচর ও শিবচরের মতো ভূখ-গুলো প্রায় ৮ হাজার একর ভূমি নিয়ে নতুনভাবে জেগেছে। এসব ভূমিতেও জোয়ার-ভাটায় ভেসে আসা বীজ দিনে দিনে নতুন বন-প্রতিবেশ গড়ে তুলবে। ঢালচরসহ পুরো উপকূল অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রহরী এই উপকূল বনগুলো। নিয়ত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, তীব্র তাপপ্রবাহ সব আপদ নিজের জীবন দিয়ে সামলিয়ে উপকূলকে নিরাপদ রাখে বনের বৃক্ষকুল। আর উপকূল-প্রহরী এই গাছগুলোকে খুন করে আমরা উপকূলকে বারবার বিপদের দিকে ঠেলছি। বৃক্ষপ্রাচীর ও বন ছাড়া আপদন্ডবিপদ সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়, বিধ্বস্ত মনপুরা কিংবা সিডরের অভিজ্ঞতা কী বলে? সুন্দরবনসহ উপকূল বনভূমি ও বৃক্ষকুল প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি ও মাত্রা নিজের জীবন দিয়ে দুর্বল করেছে। উপকূলে বন না থাকলে সব আপদন্ডবিপদে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি অসহনীয় হয়ে উঠত। কিন্তু আমরা আমাদের উপকূলের বৃক্ষকুল ও বনের কাছে একবিন্দু কৃতজ্ঞতাও জারি রাখিনি। বরং প্রতিদিন উপকূল বনকে ল-ভ- রক্তাক্ত করছি। ঢালচরের উপকূল বন সামগ্রিকভাবে সুরক্ষা করতে হবে। বৃক্ষ ও বন নিধনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ঢালচরসহ উপকূল বনের সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং করণীয় বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার ও তৎপরতা স্পষ্ট করতে হবে।
আয়তনে ছোট্ট হলেও প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে বাংলাদেশ অনন্য। সমতল, অববাহিকা, বরেন্দ্র, গড়, টিলা, পাহাড়, চর এলাকার পাশাপাশি দেশের নোয়াখালী, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সুন্দরবন অঞ্চলের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো দেশকে দিয়েছে বিশেষ আমেজ ও গতিময়তা। নোয়াখালীর নিঝুপ দ্বীপ, সুখচর, হাতিয়া, তমরুদ্দিন, নলচিরা, চান্দনন্দি, হারনি, চর কিং, বয়রারচর, চরপিয়া; ভোলার মনপুরা, চর মনিকা, চর সাকুচিয়া, চরনিজাম, ঢালচর, চর কুকরিমুকরি, গাজীপুর, ভেদরিয়া, সোনাচর, হাজিরহাট, চর নিউটন, চর পাতিলা, চর লক্ষ্মী, চর আইচা, নীলকমল, মদনপুর, মেদুয়া; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ; কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন বা নারিকেল জিঞ্জিরা, সোনাদিয়া, শাহপরীর দ্বীপ এবং সুন্দরবন অঞ্চলের আন্ডারচর, ডিমেরচর, দিয়ারচর, কালীরচর বা দুবলারচর দেশের গুরুত্বপূর্ণ উপকূল চর ও দ্বীপাঞ্চল। নদীপ্রবাহের বিস্তীর্ণ পলিমাটিতে গড়ে ওঠা এসব চর-দ্বীপ। মহেশখালী শৈল দ্বীপ আর সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ। প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক নানা বিন্যাস গড়ে উঠেছে এসব অঞ্চলে। এসব দ্বীপে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থান। মাছ, পাখি, সরীসৃপ, কাছিমসহ জলজ ও স্থলজ প্রাণবৈচিত্র্যের এক অবিস্মরণীয় আখ্যান তৈরি হয়েছে দেশের দ্বীপগুলোতে।
জলোচ্ছ্বাস ও ঝড় থেকে দেশের ভূগোল বুক আগলে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে এসব দ্বীপাঞ্চল। শত-সহস্র মাছের জোগান দিয়ে তরতাজা রাখছে রাষ্ট্রের অর্থনীতি। কিন্তু নিদারুণভাবে বাংলাদেশের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো এক ‘অচ্ছুত’ এবং বঞ্চিত ভূগোল। এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ নিরাপত্তা কোনো বিবেচনায় রাখা হয় না। এসব উপকূল চর ও দ্বীপগুলোর পরিবেশবিনাশ কিংবা সামাজিক সংঘাতের খবর খুব একটা প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েও আসে না। দেখা গেছে, একেবারেই স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য ও বিনাশ করে। এমনকি বৃহৎ অবকাঠামো, খনন, বাণিজ্যিক পর্যটন, করপোরেট মনস্তত্ত্বও উপকূল বনের প্রাকৃতিক বিকাশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে উপকূল চরের বন বাস্তুতন্ত্র এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত। বসতি স্থাপন কিংবা বাসস্থান সম্প্রসারণের নামে সবচেয়ে প্রথম কোপ পড়ে উপকূল বনে। এভাবেই আমরা হারিয়েছি চর কুকরিমুকরি কিংবা ঢালচরের বিশাল অংশ।
ঢেউয়ে ভেসে আসা কেউরগুলা, ছুনে গুলা, শিউলি গুলা, গাকগুলা, কেয়াড়াগুলা, সুগুলা, উন্দুরাগুলা, চরিকগুলা, গুরুপ ফলগুলো মাছের জালে উঠে বা হাতেও ধরা যায়। নানান জাতের ইলিশ, পাতা মাছ, ব্যাঙ মাছ, আটগোড়া মাছ উপকূল চর-দ্বীপের অনন্য প্রাণসত্তা। উপকূলীয় অনেক চর-দ্বীপে বিকশিত হওয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থানে শেয়াল, কাঠবিড়ালি, গুইসাপের পাশাপাশি হরিণেরও বংশবিস্তার ঘটছে। বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিতে থাকা চামচঠুঁটো বাটান পাখির বিচরণস্থল ঢালচরসহ আশপাশের উপকূল চরভূমি। যদি ঢালচরের বন সুরক্ষিত না থাকে তবে বহু বন্যপ্রাণ অচিরেই তাদের বিচরণ অঞ্চল ও খাদ্য উৎস হারাবে। ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য হবে।
সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধান করবে। সংবিধানের অঙ্গীকার অনুযায়ী ঢালচরের বনভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নদীভাঙা মানুষের আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করা জরুরি, কিন্তু সেটি প্রাকৃতিক বন উজাড় করে নয়। ঢালচরের বন বিষয়ে রাষ্ট্রকে অঙ্গীকার করতে হবে। বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ঢালচরের বন সুরক্ষায় তৎপর হতে হবে। স্থানীয় মানুষদের ঢালচরের বন ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এই বন সব আপদন্ডবিপদ থেকে চরবাসীকে সুরক্ষিত রাখছে। নির্দয়ভাবে বনের বিনাশ বন্ধ করে বনের প্রতি ঢালচরের প্রতিজন নাগরিককে সামাজিক ঢাল হিসেবে দাঁড়াতে হবে। ঢালচরের প্রাকৃতিক ঢাল উপকূল-বন আর বনের ঢাল ঢালচরের জনগণ। প্রাকৃতিক ও সামাজিক ঢালের এই সংহতি সক্রিয় হলেই বিকশিত হবে ঢালচরের বন বাস্তুতন্ত্র।
লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রাজধানীর একটি নামি স্কুলে আগের বছরগুলোর মতো এবারও শিক্ষার্থীদের বর্ষপঞ্জি দেওয়া হয়। তাতে মার্চের মাঝামাঝি তাদের প্রথম শ্রেণি-অভীক্ষা শুরুর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ পেয়ে শিক্ষকরা জানান, এ বছর শ্রেণি-অভীক্ষা হবে না। ফলে শিথিল অবস্থায় ছিল শিক্ষার্থীরা। প্রথম অভীক্ষার জন্য দেওয়া সিলেবাসও শেষ হয়নি তাদের। এখন হঠাৎ করে প্রচলিত নিয়মে শ্রেণি-অভীক্ষা নেওয়া শুরু করেছে স্কুলটি। দশ বিষয়েরই। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
শুধু রাজধানীর একটি স্কুলই নয়, দেশের বেশির ভাগ স্কুলেই এ বছর একই অবস্থা। নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে সবাই তালগোলে পড়ে গেছে। এ বছর প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছর প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে প্রচলিত কোনো পরীক্ষা বা মডেল টেস্ট নেওয়া যাবে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াই সারা বছর শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন চলবে। বছর শেষে মাত্র একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু তা না মেনে অনেক স্কুল শ্রেণি-অভীক্ষা বা সিটি পরীক্ষার সূচি প্রকাশ করেছে। কোনো স্কুল পরীক্ষা নিতেও শুরু করেছে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১০টি বিষয় রয়েছে। এসবের মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৪০ শতাংশ। আর জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি এই পাঁচ বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে যে বিষয়গুলো আনার পরিকল্পনা ছিল তা সঠিকভাবে আনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বইপত্র নিয়ে যা হয়েছে, মূল্যায়ন নিয়ে এর চেয়েও বেশি তালগোল অবস্থা তৈরি হবে। যে শিক্ষাক্রম হয়েছে, তা আমাদের শিক্ষকদের সক্ষমতার বাইরে। এই শিক্ষাক্রম অনুসরণ করার মতো শিক্ষক আমাদের নেই। বই যারা লিখেছেন তারাও নিরপেক্ষ থাকেননি।’ আগামী দিনের জন্য পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম আরও সময় নিয়ে ধাপে ধাপে করা উচিত ছিল। আগে যথাযথভাবে বইপত্র তৈরি করতে হবে, শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে; তারপর শিক্ষকদের তৈরি করতে হবে। চার-পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষক তৈরি করা সম্ভব নয়। আগামী বছরের জন্য এখন থেকেই এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রম চালু করে স্বস্তিতে নেই শিক্ষা প্রশাসন। গত মাসে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের অনুসন্ধানী পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী পাঠ ও ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান এই তিনটি বই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখনো সংশোধনের কাজ শেষ হয়নি। তিন মাস হতে চলছে বই তিনটি ঠিকমতো পড়াতে পারছেন না শিক্ষকরা। নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যান্য বইতেও অসংখ্য ভুল আর অসংগতি ধরা পড়ছে। অথচ দুটি বই প্রত্যাহার করেই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনটি বইয়ের সংশোধন বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত তা করা যায়। যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে ওই দুটির আরেকটি করে অংশ রয়েছে, যা পড়লে শিক্ষার্থীরা পুরো পাঠই পাবে। আগামী বছরের বইগুলোর ব্যাপারে আমরা আরও সচেতন থাকব। এ বছরের বইগুলোর যথাযথ পরিমার্জন করা হবে আগামী বছর।’
আগে পাঠ্যবইয়ের কোনো কিছু না বুঝলে সহায়ক বইয়ের সাহায্য নিতেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সহায়ক বই প্রকাশ করেনি। ফলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তারা প্রতিদিন লাইব্রেরিতে সহায়ক বইয়ের জন্য ধরনা দিচ্ছেন।
এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হয় প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল। দুপুরে ফল প্রকাশ হলেও বিকেলেই তা স্থগিত করা হয়। পরদিন ১ মার্চ রাতে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়। দেখা যায়, প্রথমবার প্রকাশিত ফলে যারা বৃত্তি পেয়েছিল, সংশোধিত ফলে তাদের অনেকের নাম নেই। অথচ বৃত্তি পেয়ে আনন্দ-উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ করে ফেলেছিল তারা। তাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা জেনে গিয়েছিল বৃত্তি পাওয়ার খবর। কিন্তু সংশোধিত ফলে যখন ওই শিক্ষার্থীর নাম এলো না তখন তাদের মন ভেঙে যায়।
১৪ বছর ধরে চালু থাকা সৃজনশীল পদ্ধতি শুরুতে বুঝতে হিমশিম খেয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এখন আবার নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ায় আবারও হিমশিম খাওয়ার দশায় পড়েছে তারা। অনেকেই তাল মেলাতে পারছে না। পরীক্ষা ও নম্বর বণ্টনের বিষয়টি তারা বুঝে উঠতে পারছে না। পরীক্ষার ওপর চাপ কমানোর ফলে স্কুলেও পড়ালেখার চাপ কমেছে। কোনো রকমে ক্লাস পার করেই দায় সারছেন অনেক শিক্ষক। আর অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমবিষয়ক মাত্র পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকরা কতটা আত্মস্থ হতে পেরেছেন তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। বাস্তবভিত্তিক ও শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত নিয়েও জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বোঝানো একজন শিক্ষকের পক্ষে কষ্টকর। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, বিজ্ঞানাগার ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ নেই বেশির ভাগ স্কুলে। এটা বড় সমস্যা। এই শিক্ষকরাই যেহেতু সরাসরি শিখনকালীন মূল্যায়ন করবেন, তারা কতটুকু নির্মোহভাবে তা করতে পারবেন সে ব্যাপারে অভিভাবকরা সন্দিহান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হবে। কারণ ধনী পরিবারের সন্তানরা এরই মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশিক্ষণ পাওয়া একাধিক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করেছেন। এগিয়ে যাচ্ছে তারা। আর প্রাইভেট পড়তে না পেরে পিছিয়ে পড়ছে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা। আবার শহরের স্কুলের চেয়ে গ্রামের স্কুলগুলো আগে থেকেই পিছিয়ে আছে। কারণ শহরের স্কুলগুলোতে বেশি বেতন ও প্রাইভেটে বেশি শিক্ষার্থী পাওয়ায় অপেক্ষাকৃত মেধাবীরা সেখানে শিক্ষকতা করেন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়বে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব শিক্ষক সমান যোগ্যতাসম্পন্ন নন। ফলে তারা এখনো সেভাবে নতুন শিক্ষাক্রমে অভ্যস্ত হতে পারেননি। একদল শিক্ষার্থী মনে করছে, তাদের পরীক্ষা নেই। তারা রিলাক্স মুডে রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সহায়ক সামগ্রী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর এখনো প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি। তারা কীভাবে বিষয়টির তদারকি করবেন, সেটা বড় সমস্যা।’