
নুরুল ইসলাম। বয়স ৬৫। রাজধানীর মিরপুর-১৩ এলাকায় ফুটপাতে পশরা বিছিয়ে টুপি বিক্রি করেন। থাকেন রূপসী বাংলা কলোনিতে।
বাড়ি কোথায় আপনার?
বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে।
ঢাকায় কবে থেকে?
আমিও আইছি, করোনাও দেহা দিছে।
ঢাকায় কেন আসছেন এই বয়সে?
আহা বাবা! এটা বড় কাহিনী।
বাচ্চা-কাচ্চা নাই?
আছে। বাচ্চা-কাচ্চা লইয়া আইয়া বিপদে পড়ছি।
আপনার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?
দুইটা ছেলে তিনটা মেয়ে।
মেয়েদের বিয়ে দেন নাই?
একজনকে দিছি।
দিনে কত টাকা ইনকাম হয়?
ইনকাম একেবারেই নাই। সারা দিনে ২০০-৩০০ টাকা হয়।
এই টাকায় সংসার চলে?
চলে না বাবা! অন্য কোনো ব্যবসা জানি না, চিনি না। একটা মাইয়া আছে গার্মেন্টস করে; সংসারটা সেই মাইয়াই ধইরা রাখছে।
এলাকায় করতেন কী?
সিলেটে চাকরি করতাম। পাথর তোলা কোম্পানিতে ম্যানেজারি করতাম। এটা বন্ধ হয়া গেছে। এখন বিপদে পড়ছি।
হঠাৎ টুপি বিক্রি করছেন কেন?
কী করবো বাবা! পেটটা তো চালইতে হয়।
আজকের দিনটি কেমন কাটছে?
কত কষ্ট!
আপনাকে সুযোগ দেওয়া হলে কোন স্বপ্নটি পূরণ করবেন?
আমার এই বয়সে আমি কী করবো বাবা? এহন তো কবরে টানতাছে না?
কত টাকা হলে আপনি ভালোভাবে চলতে পারবেন?
বাবা! এই জ্ঞানটা আমার কাছে আর নাই। অভাব কী জিনিস আগে জানতাম না। টাকার বিকল্প আছে বাবা! টাকা হইলেও চলা যায়, না হইলেও চলা যায়।
তারপরও?
টাকা হইলেই কি খরচের শেষ আছে বাবা! সেদিন দেখলাম এক লোক ১৫০০ টাকা কেজি ইলিশ মাছ কিনছে। দুই কেজি ইলিশ কিনলো ৩০০০ টাকা দিয়া। আমি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেইখা ... আমি তো এতো টাকা এখন গুনতেই পারি না।
এই তিন হাজার টাকা কামাই করতে আপনার কত দিন লাগে?
হায় হায়! ৩০০০ টাকা এহন কই পামু। কই পামু বাবা!
আপনি যদি মন্ত্রী হতেন তাহলে প্রথমে কোন কাজটি করতেন?
আমি তো দেশে মাঠের জমিন করতাম। ঢাকা শহরের কোনো কাজকর্ম আমার জানা নাই। গ্রামে ধান রোপন করতাম। ধান মাড়াই করতাম। তাই কৃষি কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতাম।
রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে ডিম-কলা বিক্রি করেন মো. মাসুদ। সন্ধ্যায় শুরু করেন, থাকেন ভোর রাত পর্যন্ত। বুধবার সন্ধ্যায় কথা হলো তার সঙ্গে।
দিনটা কেমন কাটছে?
সবে তো শুরু করলাম। আল্লাহ দিলে ভালো হবে। ৫টায় বসছি, ভোর ৫টা পর্যন্ত থাকব।
আপনি কতদিন ধরে এই ব্যবসা করছেন?
৮-১০ বছর।
শুরুটা কীভাবে?
ওই পারে (বাংলামোটর ওভার ব্রিজের নিচে) ফ্লেক্সিলোডের দোকানদারি করতাম আগে। ওই ব্যবসায় লস খাইছি। পরে অল্প অল্প করে ডিম বিক্রি করা শুরু করলাম। লোডের ব্যবসার আগে ভ্যান গাড়ি চালাইতাম।
গ্রামের বাড়ি কোথায় আপনার?
আমার বাড়ি মাদারীপুর। এখানে ব্যবসা করার জন্য আসছিলাম। প্রথমে মহল্লায় মহল্লায় কাঁচা-মাল বিক্রি করতাম। পরে ওইটা ভালো লাগল না। তাই ভ্যান গাড়ি চালাইছি। এরপর একজন ক্যাশ-পুঁজি দিয়ে ফ্লেক্সিলোডের দোকানে বসিয়ে দিল। পরে তাকে ক্যাশ বোঝাই দিয়ে চইলা আহি। আমার কাছে আর ক্যাশ ছিল না। এরপর থেকে সেদ্ধ ডিম বিক্রি করতাছি।
এই ব্যবসা কেমন লাগে?
মোটামুটি আল্লাহ ভালো রাখছে। চারপাশের মানুষজন খুব ভালো। কেউ কিছু বলে না। ভালোভাবেই দিন কাটছে।
এই ব্যবসার মাধ্যমে আপনি তাহলে সুখী?
হ্যাঁ। আমি সুখী। এর মধ্যে মানুষের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি। এই মনে করেন, মানুষ এক গ্লাস পানি খাচ্ছে। এর জন্য আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আমি। অন্যান্য ব্যবসায় হয়তো আরেকটু ভালো থাকতাম। তবে মনের দিক থেকে এটা দিয়ে আমি তৃপ্তি পাই। শান্তিতে আছি। মনে করেন লেভাররা এসে এক গ্লাস পানি খায়। এটা অনেক শুকরিয়া।
কেমন আয় হয় আপনার?
মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা ইনকাম আছে আল্লাহ দিলে।
এতে চলতে পারেন?
মোটামুটি আল্লাহ চালায়।
যদি বলা হয় কেমন টাকা হলে আপনি ভালোভাবে চলতে পারবেন...
আল্লাহ পাক চায় তো ডাল-ভাত খেয়ে দিন পার করতে পারলেই লাখ লাখ শুকরিয়া। কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার দরকার নাই।
ছেলে-মেয়ে ক’জন আপনার?
পরিবার নিয়ে পাম্পের গলিতে থাকি আমি। দুই ছেলে, এক মেয়ে আমার। ছেলে দুইটারে এসির কাজ শিখাইছি। শীতের দিনে কাজ তেমন হয় না। তবে গরমের দিনে মোটামুটি আল্লাহ চালায়।
আপনাকে একটা স্বপ্ন পূরণের সুযোগ দেওয়া হলে কি চাইবেন?
আমার কোনো কিছু চাওয়ার নেই। এইটাই (নিজের ব্যবসা) আমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। এটাই যথেষ্ট আমার জন্য। আল্লাহ যে ক’দিন বাঁচায়, মানুষের সেরা করতে পারলেই খুশি।
মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেলে কোন কাজটি করতেন?
না, ও দরকার নাই। ও দরকার নাই আমার। আল্লাহ পাক যেমন রাখছে সেটাই লাখ লাখ শুকরিয়া।
রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় অটোরিকশা চালায় আতিক। বাবা-মা বৃদ্ধ হওয়ায় ১৫ বছর বয়সী আতিক তিন বছর আগে থেকেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাড়ি হলেও জীবিকার তাগিদে মা-বাবা, ৩ ভাইসহ থাকেন খিলক্ষেতের উত্তরপাড়া।
দিনটি কেমন কাটছে?
চলতেছে ভালোই।
পড়াশোনা করেছ?
হ্যাঁ। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করেছি।
আর না পড়ার কারণ?
বাবা গরিব তাই পড়াতে পারেনি। (আতিক কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে) আমরা গরিব পড়তে নেই। সংসার চালাতে তাই অল্প বয়সেই আটোরিকশা ধরতে হয়েছে।
পড়ার সুযোগ করে দিলে পড়বে?
(এ প্রশ্ন করার পর আতিক কোন কথা বলছিল না। আমি অটোর পেছনে বসে বুঝতেছিলাম সে কাঁদছে।)
অটোরিকশায় আয় কেমন হয়?
হয় ভালোই। কোন দিন ১২’শ টাকা, আবার কোন দিন ৭’শ টাকা থাকে। মাসে ১৭-১৮ হাজার টাকার মতো থাকে।
এই টাকায় সংসার চলে?
চলে না। বড় ভাই মাসে কিছু টাকা দেয়। সব মিলিয়ে খাইয়া খুরচে আছি কষ্ট কইরা।
কত টাকা হলে ভালোভাবে চলতে পারবে?
সংসার বড় হওয়ায় খরচ বেশি। আমরা গরিব মানুষ তিন বেলা ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হলেই চলে। বাবা-মা অসুস্থ থাকায় তাদের ওষুধ কিনতে টাকা লাগে। সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকা হলে ভালোভাবে মাস চালানো যায়।
পেশা পরিবর্তন করার ইচ্ছে আছে?
এখান থেকে গাজীপুর চলে যামু বড় ভাইয়ের কাছে। ভাই একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। শুনছি সেলুনে বা কাঠমিস্ত্রির কাজে দেবে।
যদি একটি স্বপ্ন পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে কি চাইবে?
থাকলে আর কি করার। নাহ কোনও স্বপ্নই নাই আমার।
বাবা-মা’র জন্য কিছু করতে চাও?
ইচ্ছে ছিল, আর কী করার আছে। আল্লাহ গরিব করে বানাইছে আমাদের।
(অটোরিকশা করে আমার গন্তব্যে পৌঁছানোর পর নেমে দেখি আতিকের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। সে কথা বলতে পারছিল না।)
রাজধানীর বাংলামোটর থেকে হাতিরপুলের পুকুর পাড় যাওয়ার রাস্তায় প্রতিদিনই দেখা মেলে বাবুল চন্দ্র দাসের। দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ জুতা সেলাইয়ের কাজ করছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বাড়ি হলেও জীবিকার তাগিদে থাকেন মানিকনগরে।
দিনটি কেমন কাটছে আপনার?
তেমন ভালো না। আজকে সারাদিনে কাজ কর্ম নাই বলা যায়। বইসা রইছি। দুই আড়াইশ টাকার মতো কাজ হইছে।
এই পেশায় কিভাবে এলেন?
আমি ছোটবেলা থেকেই এই কাজ ধরছি। বাপ-মার অনেক অভাবের সংসারে লেখাপড়া করতে পারিনি। বাপে এই কাজ করছে। এখন আমিও এইটা কইরা পোলাপান নিয়ে চলতাছি। পোলাপানরে লেখাপড়া করাইতাছি। আমার ছেলে-মেয়ে তো আর এই কাজ করব না। ওরা অন্য কাজ করব। ভগমান যদি ওদের কপাল খুলে, হয়তো চাকরি-বাকরি করতে পারবে। এতটুকুই আমার জীবন।
কয় ছেলে-মেয়ে আপনার?
আমার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। ছোট ছেলে লেখাপড়া করতাছে। বড় ছেলে ছাইড়া দিছে। বিয়ে কইরা সেলুনের কাজ করে খাইতাছে। মাইয়া একটারে এইট পর্যন্ত পড়াইলেও টাকা পয়সার জন্য আর পারছি না। লেখাপড়া বন্ধ কইরা দিছি। কারণ এই কর্মে হয় না। কাজ তেমন নাই। খামোখা এতো টাকা খরচ করে তো আমি চলতে পারব না। কারণ আমার সংসার বড় হয়ে গেছে। মাইয়া পোলাপান টাকা থাকলে পড়াইতে মজা লাগে। আমি কর্ম না করতে পারলে কি করমু। আজকে ১০ টাকার কাম হইবো, আরেকদিন ৫ টাকার কাম… সংসারে তো খরচা লাগে বেশি।
কয় ঘণ্টা করে কাজ করেন প্রতিদিন?
সকাল ৮টায় শুরু করি, রাত ৭-৮ টা পর্যন্ত কাজ করি। কাজ কইরা মেস বাসা কইরা থাকি। ঢাকার শহরে পরিবার নিয়া অনেক খরচ। মেস বাসা কইরাই খাওয়া-দাওয়া করি, চলাফেরা করি। রাতে গিয়ে ভাত রান্না কইরা শুইয়া থাকব। এতটুকুই আমার চলাফেরা। ২০ টাকার কাম করলে ৫ টাকা খরচ করি। আর ৫ টাকা নিয়া আমি খাই, পোলাপান নিয়া চলি।
কত টাকা হলে আপনি ভালোভাবে চলতে পারবেন?
সারাদিন যদি কাজ করি আর চার-পাঁচ শ বা হাজার খানেক টাকা থাকে তাহলেই চলতে পারি। এখন তো প্লাস্টিক-বার্সিমের জুতা বাইর করছে। জুতার কাম তাই উইঠা গেছে গা। অফিসের লোকেরা কালি করলে করি। না হলে বইসা থাকতে হয়।
এই ব্যবসা তাহলে মন্দার দিকে?
হ্যাঁ। এই ব্যবসা আর আসবে না।
আপনাকে যদি একটি স্বপ্ন পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে কি চাইবেন?
আমার স্বপ্ন আর কি…। এই রাস্তায় (চর্মকারের কাজ) যদি আমি চলতে না পারি, তাহলে বাড়িতে গিয়ে একটা অটোরিকশা কিনা চালামু। আমার এতটুকুই স্বপ্ন। যে কদিন বাঁচি, এভাবেই চইলা যামু। অন্য কোনো ব্যবসা করতে আমি রাজি না।
যদি মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান, তাহলে দেশের কোন জিনিসটা বদলাতে চান?
জনগণ যেভাবে চলে আমার সেভাবেই চালাই যাইতে হবো…
কোন কাজগুলো প্রথম করবেন?
না, এটা বলতে চাই না। আমার এ নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নাই। ফুটপাতে কাম করি। খামোখা এইডি কইয়া লাভ নাই। রোডে বইয়া থাইকা আমি যদি কই বড় হইতাম, তাহলে হবে না। আমি গরিব আছি, যতটুকু আমার সমাজের ভেতরে চলতে পারি, আমার এতটুকু চলে গেলেই হবে। আমার উপরের লেভেলে যাওয়া পছন্দ না।
মসিউর রহমান মাসুম। দুধ বিক্রির পাশাপাশি চালান অটোরিকশা। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট বাড়ি হলেও তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকেন রাজধানীর খিলক্ষেতের নামাপাড়া।
নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় আসলেন কেন?
জীবিকার তাগিদে। গ্রামে পরিবার নিয়ে ভালোভাবে সংসার চলছিল না। তাই ঢাকায় এসেছি।
ঢাকায় কী পরিবার নিয়ে ভালোভাবে চলতে পারছেন?
না। এখানে আসার পর কষ্ট বেড়েছে। দুধ বিক্রির পাশাপাশি অটোরিকশা চালাচ্ছি, তারপরও যে ইনকাম হয় তা দিয়ে সংসার চলে না।
তিন বেলা খেতে পারেন?
তিন বেলা খেতে পারি। কিন্তু দুঃখ সন্তানদের ভালো খেতে দিতে পারি না। এনিয়ে মনে কষ্ট হয়।
আপনার মাসে আয় কেমন হয়?
তা সঠিকভাবে বলতে পারবো না। তবে, ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকার মতো হবে।
এই টাকায় সংসার চলে?
ভাই কি কমু এহন বর্তমানে খাইয়া খুরচে আছি কষ্ট কইরা।
বাড়িতে বাবা-মা আছে?
আছে।
তাদের জন্য টাকা পাঠান?
দিতে পারি না। আমার নিজেরই তো চলে না। তবে, বড় ধরনের সমস্যায় পড়লে দেওয়ার চেষ্টা করি।
কত টাকা হলে আপনি ভালোভাবে চলতে পারবেন?
টাকার চাহিদার তো শেষ নাই। যত আছে তত চাই। তবে, আমার মাসে ৩০ হাজার টাকা হলে বাবা-মাকে নিয়ে সুন্দরভাবে চলতে পারবো।
আজকের দিনটা কেমন গেল?
আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।
আপনাকে সুযোগ দেওয়া হলে কোন স্বপ্নটি পূরণ করবেন?
আমার স্বপ্ন হাসি দিয়ে বলেন, আমি তো গাড়ি চালাই আমার কোনো স্বপ্ন হতে পারে না। তবে আশা আছে আল্লাহ পাক যেন সন্তানদের মাদরাসায় পড়ানোর সুযোগ দেয়।
আপনি যদি মন্ত্রী হতেন তাহলে প্রথমে কোন কাজটি করতেন?
এটা তো আমার কাছে অবাস্তব স্বপ্ন। সুযোগ পেলে দেশের জন্য ভালো কিছু করতাম। গরিবদের সাহায্য করতাম।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’