ডানা মেলছে বাংলাদেশ
রূপান্তর ডেস্ক | ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উড়াল দিতে ডানা মেলছে বাংলাদেশ। জন্মকালে বিশে^র ১০ গরিবের তালিকায় থাকা বাংলাদেশ এখন মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপির আকারে ৪২তম বড় অর্থনীতি। আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে আরো বড় অর্থনীতির দেশ ভারতকেও পেছনে ফেলা বাংলাদেশ এখন বিশে^র নানা প্রান্তে উজ্জ্বল উদাহরণ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ বলছে, রূপান্তরের এই যাত্রায় গতিশীল বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যেই বিশে^র ২৬তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আশা প্রকাশ করেছেন, ২০৫০ সালে ২০তম অর্থনীতি হবে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ টিকবে তো?
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সামনে ঘোরতর অন্ধকার দেখছিলেন বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদরা। তাদের মধ্যে একটি প্রশ্নই ঘুরে-ফিরে আসছিলÑ বাংলাদেশ কি টিকে থাকতে পারবে? ১৯৭৬ সালে এ প্রশ্ন তুলে বই লিখেছিলেন নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ড. জাস্ট ফালান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জ্যাক আর পারকিনসন। কেবল এ দুজনই নয়, স্বাধীনতার পর তাবৎ দুনিয়ার অর্থনীতিবিদদের মধ্যেই এ প্রশ্ন জেগেছিল। ‘বাংলাদেশ : এ টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ বইয়ে লেখকদ্বয় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারে, তাহলে দুনিয়ার যেকোনো দেশই উন্নত হতে পারবে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে তৎকালীন প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিয়ে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম এই দেশে তখন খাবার নেই, বাড়ি নেই, পরিবহন নেই, শিল্প নেই। পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ে ৯০ ভাগ আসা পাটকলগুলোও ধ্বংস করা হয়। জাতিসংঘের তখনকার এক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে টাইম ম্যাগাজিন জানায়, ৪৬ লাখ ১৭ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিক ধ্বংস হয়।
প্রায় ১৪ লাখ পরিবার তাদের ঘরবাড়ি, গবাদি পশু ও জমি ফেলে রেখে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছাড়ে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা থেকে ১০ লাখ বাংলাদেশে ফিরে আসে। ফেরত আসার সময় ক্যাম্প থেকে পরিবারগুলোকে এক সেট করে সিসার হাঁড়িÑপাতিল, কিছু তেল, চারকোল, একটি করে চকলেট এবং ৫০ সেন্ট মূল্যের চাল ও খাদ্যশস্য দেওয়া হতো।
স্বাধীনতার পরপরই পরিকল্পনা কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ১৯৬৯-৭০ সালের পর্যায়ে ফিরিয়ে নিতে হলে ৩০০ কোটি ডলার দরকার। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ছিল ৭০ ডলার। এ পরিমাণ আয় নিয়ে বিশ্বের ১০-১২টি গরিব দেশের তালিকায় জায়গা হয় বাংলাদেশের। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত আমন চাষ, যুদ্ধে বিলীন ঘর-বাড়ি, শূন্য হাতে ভারত থেকে ফেরা উদ্বাস্তু, ফাঁকা রাজকোষসহ নানা সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশ তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিয়ে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার অর্থনীতিবিদ প্রফেসর হলিস বি চেনারিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মানসম্পন্ন (স্ট্যান্ডার্ড) মাথাপিছু আয়ের তালিকায় যেতে বাংলাদেশের কতদিন লাগবে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ১৯৬৫ সালকে মূল্যভিত্তি ধরে মাথাপিছু ৮০০ ডলার বা ১৯৭৩ সালকে মূল্যভিত্তি ধরে মাথাপিছু ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে বাংলাদেশের ১২৫ বছর লাগবে, যদি প্রতিবছর ২ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বাড়ে। ৩ শতাংশ হারে বাড়লে লাগবে ৯০ বছর।
না টিকলে কি হবে?
১৯৭২ সালে দুই মাস বাংলাদেশ ঘুরে দেখা যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অস্টিন রবিনসন ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও সম্ভাবনা দেখেছিলেন। সদ্যোজাত বাংলাদেশের সার্বিক বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ‘ইকোনমিক প্রসপেক্টাস অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণা করেন। ১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বরে লন্ডনের ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (ওডিআই) থেকে প্রকাশিত ওই গবেষণায় জনসংখ্যার উচ্চ বৃদ্ধির হারে বিশ্বে পরিচিত বাংলাদেশ সম্পর্কে তখন তিনি বলেছেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়েও দ্রুতহারে উন্নতি করবে বাংলাদেশ।’
ওডিআই থেকে প্রকাশিত ‘দি আউটলুক ফর বাংলাদেশ’ চ্যাপ্টারে রবিনসন বলেন, ‘একটি প্রশ্নই বারবার তোলা হচ্ছে, বাংলাদেশ টিকবে তো? একজন অর্থনীতিবিদের কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। টিকে না থাকলে কী হবে? মৃত্যু? কোনদিন কোন রাষ্ট্রের কী মৃত্যু হয়েছে?......বাংলাদেশ এখন পাঠ্যপুস্তকে মালথ্যাসের জনসংখ্যাতত্ত্বের আলোচনায় উপযুক্ত উদাহরণ। তবে স্থানীয় সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার করা গেলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়েও উচ্চহারে উন্নতি করবে বাংলাদেশ।’
অস্টিন রবিনসনের ভাবনা বাংলাদেশে বাস্তব হয়ে ফিরে এসেছে। ১৯৭৪ সালে করা বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.৪৮ শতাংশ, বর্তমানে তা কমে ১ শতাংশে নেমেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন ৭.৮৬ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছর শেষে ৮ শতাংশে পৌঁছাবে বলে দেশ রূপান্তকে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বাংলাদেশ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে, সামাজিক বিভিন্ন সূচকে ভারতের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তবে এই অর্জনের মধ্যেও স্বস্তি দেখছেন না অনেকে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ষাটের দশকে মালয়েশিয়ার অর্থনীতির চেয়েও সবল ছিল বাংলাদেশ। দুর্বল মালয়েশিয়া অনেক দূর এগিয়েছে, অনেক পেছনে পরে হাঁটছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না হওয়ার জন্য রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের অভাবকে দায়ী করছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান। ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ গ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি শুরু করেছেন এভাবে, ‘উইনস্টন চার্চিলের ভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশ একটি রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেয়ালি।
একদিকে এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকট অপ্রতুলতা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে; অন্যদিকে সুশাসনে নিশ্চিত অবক্ষয় ঘটেছে। বাংলাদেশের অনেক অর্জনের জন্য আমি গর্বিত। তবু রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের ক্রমাগত অধোগতি আমার প্রজন্মের যারা আমার মতো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের জন্য দৈহিক যন্ত্রণার চেয়েও মর্মান্তিক মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে।’
ধৈর্য ধরার আহ্বান ছিল বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনের শূন্য রাজকোষ আর বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়াই ভঙ্গুর অবকাঠামো, খাদ্যসংকট মোকাবিলাসহ পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়নে হিমশিম খেতে থাকে সরকার। তবুও তারা ভেঙে পড়েননি, জাতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ।
‘আমরা যে সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গঠনের চেষ্টা করছি, তার জন্য আমাদেরকে আজ কষ্ট স্বীকার করতে হবে; যাতে আগামীকাল আমাদের সন্তানের কষ্ট আমরা লাঘব করতে পারি’ ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ঘোষণাকালে তখনকার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এভাবেই যুদ্ধবিধ্বস্তবাংলাদেশের মানুষের সামনে রূঢ় বাস্তবতা ও আগামীর স্বপ্ন তুলে ধরেছিলেন। তার কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আগামী তিন বছর আপনাদের কিছু দিতে পারব না।’
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ যখন এই বাস্তবতা তুলে ধরলেন, তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নিজেই যেন বাস্তুহারা। পাকিস্তানি সেনারা শেষমুহূর্তে পুড়িয়ে গেছে টাকা-পয়সা, শিল্প-কারখানা। সেতু, কালভার্ট, বন্দর, জাহাজ সবই ধ্বংস করে গেছে তারা। ভারত থেকে ফেরা প্রায় কোটিখানেক মানুষ খালি হাতে ফিরেছে বাংলাদেশে। তাদের থাকার ঘর নেই, চাষাবাদের গরু-ছাগল নেই, মাটিতে বোনার মতো বীজও নেই।
‘বাংলাদেশ : মুজিবস রোড ফ্রম প্রিজন টু পাওয়ার’ শিরোনামে ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ৬০ লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে অর্থ সরাতে শুরু করে। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ১১৭ রুপি বা ১৬ ডলার রেখে পুরোটা সরিয়ে ফেলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও কয়েনগুলো ধ্বংস করতে থাকে। স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ নগদ অর্থের সংকটে পড়ে। রাস্তা থেকে প্রাইভেট কারগুলো অটো ডিলারের দোকান ঘুরে পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দরে যেতে থাকে।
ওই সময়কার কথা স্মরণ করে বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মী আবদুল মালেক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগে পাঞ্জাবিরা বস্তায় বস্তায় টাকা পোড়াইছে। আমার চোখের সামনেই অনেক টাকা, ধনসম্পদ পোড়াইতে দেখছি। আমাকে ওরা তখন কয়েক বস্তা টাকা নিতেও বলেছিল। কিন্তু আমি নেই নাই। আমি ভয়ে রাজি হই নাই। স্বাধীনতার পরে সরকার যদি আমাকে ধরে বলে তুমি এত টাকা কোথায় পেলে? ’
মনমরা হতে মানা করেছিলেন অর্থ সচিব
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার চিত্র মেলে ১৯৭৩-এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত দেশের প্রথম অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। তাতে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তেহাত্তরের জুন পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার দেড় বছরেও যে ভঙ্গুর অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি, তা স্পষ্ট বোঝা যায় তখনকার অর্থসচিব কে মাহমুদের কথায়। দেশের প্রথম অর্থনৈতিক সমীক্ষার ভূমিকায় তিনি বলেছেন, ‘১৯৭৩-এর জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর আগের সর্বশেষ স্বাভাবিক অর্থবছর হিসেবে ১৯৬৯-৭০-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন প্রচেষ্টা সত্ত্বে¡ও দেখা যাবে যে ১৯৭৩-এর জুন শেষে আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ১৯৬৯-৭০-এর পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি।’
‘আমি অবশ্যই বলছি যে, এটি বাংলাদেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র নয়। যদিও বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ১৯৬৯-৭০-এর সময়কার মতো উজ্জ্বল নয়; এটিও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশকে শুরু করতে হয়েছে। অতীত পারফরমেন্স নিয়ে আমাদের মনমরা হলে চলবে না। অদূর ভবিষ্যতে সকল খাতে আরো উজ্জ্বল সক্ষমতার সঙ্গে অনেক বেশি অর্জন হবে আমাদের’Ñএভাবেই হতাশা দূরে ঠেলে নতুন স্বপ্ন দেখতে জাতিকে অনুরোধ করেন দেশের প্রথম অর্থসচিব।
কয়েক ইঞ্চি কাগজ চিন্তায় ফেলে বান কি মুনকে
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন তখন তরুণ কূটনীতিক। দক্ষিণ কোরিয়ার দিল্লি মিশনে কর্মরত তিনি। দেশ স্বাধীনের পর বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা আসেন তিনি। দিল্লিø থেকে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে ধ্বংসস্তূপ ঠেলে রিকশায় চড়ে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসলেন। ঢাকার এশিয়া বিভাগের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক শেষে তার নাম আর ঢাকার টেলিফোন নম্বরটা চাইলেন, যাতে পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ করা যায়। ঢাকার ওই কর্মকর্তার কোনো ভিজিটিং কার্ড ছিল না।
ওই কর্মকর্তা সযত্নে টেবিলের একপাশে রাখা একটা এফোর সাইজের কাগজ সাবধানে হাতে তুলে নিয়ে তার এক কোনায় অনেক ছোট করে নাম আর টেলিফোন নম্বর লিখে শুধু সেই অংশটুকু ছিঁড়ে বান কি মুনের হাতে দেন। রিকশায় চড়ে আবার বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় বান কি মুন মনে মনে ভাবছিলেন বাংলাদেশি কর্মকর্তার সামান্য একটা সাদা কাগজ বাঁচানোর চেষ্টার কথা এবং নিশ্চিত হয়েছিলেন এই জাতি এক সময় নিজের পায়ে দাঁড়াবেই।
১৯৭৩ সালে তিনি আবার দিল্লির কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা এসেছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় রাষ্ট্রদূতের কলমটা কাজ করছিল না। তখন বান কি মুন তার কলমটা এগিয়ে দিয়েছিলেন চুক্তিটা স্বাক্ষর করার জন্য। সেই কলমটি এখনো সংরক্ষণ করে রেখেছেন বান কি মুন।
২০১৬ সালের এপ্রিলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম নিজের ফেসবুকে এ ঘটনার উল্লেখ করে বলেছেন, জেনেভায় খাওয়ার টেবিলে বসে মুনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন কলমটি এখনো সংরক্ষণে রেখেছেন তিনি? ‘উত্তর আসল, ১৯৭২-এর প্রথম সফর তাকে প্রচ- নাড়া দিয়েছিল। আর নতুন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষণের সাক্ষী থাকার অভিজ্ঞতা তো একজন কূটনীতিকের জীবনে বারবার আসে না’ যোগ করেন তিনি।
২০১১ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে বাংলাদেশ সফরে আসেন বান কি মুন। সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে তিনি বলেন, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি গতিশীল অর্থনীতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ শুধুমাত্র উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রেই অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে না, উন্নয়ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
টিকে থাকা নিয়ে যার সংশয়, সেই বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে তিনটি বিশ্বের প্রথম দেশ থেকে তিনটি সূচকেই অগ্রগতি অর্জন করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর ৪৭ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার চার হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২২ লাখ ৫০ হাজার কোটিতে উন্নীত হয়েছে। চলতি অর্থবছর শেষে আকার ৩০ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রতি দশকে ১ শতাংশ হারে বেড়েছে বাংলাদেশের। বর্তমানে ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
সরকারের বিভিন্ন পদে থাকার পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী হিসেবে এরশাদ সরকার ও বর্তমান সরকারের মেয়াদে ১২ বছর দায়িত্ব পালনের সময়কালে তার সেরা মুহূর্ত কোনটি, দেশ রূপান্তরের এমন প্রশ্নের উত্তরে সেকেন্ডের মধ্যেই মুহিত বলেন, অবশ্যই জাতিসংঘের কাছ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ পাওয়ার মুহূর্ত। ২০২৪ সালেই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাবে।
দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণা করে মুহিত বলেন, আগে বিদেশিদের সঙ্গে মিটিং করা মানেই নিজেকে ছোট করার মতো ছিল। কারো সঙ্গে দেখা করা, কথা বলা মানেই বাংলাদেশের জন্য সহযোগিতা চাওয়ার ব্যাপার ছিল। এখন আর সে অবস্থা নেই। গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সাধারণ সভাকালে বালিতে অর্থমন্ত্রী কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ যেকোনো দেশকে যে কোনো ধরনের সহায়তা দেবে বলে ঘোষণা দিয়ে আসেন মুহিত। এ প্রসঙ্গ তুলে ধরে মুহিত বলেন, এখন অন্যদের সাহায্য করার কথা বলতে ভালো লাগে।
কার লাভ, কার ক্ষতি?
আগে ১ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে ব্যাগ ভরে বাজার নিয়ে আসা যেত। এখন ৫০০ টাকা নিয়ে গেলেও বাজারের ব্যাগ ভরে না ৮২ বছর বয়সী আবদুল মালেকের। ঢাকায় ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি করেন ৬৫ বছর বয়সী মফিজ মিয়া বলেন। তিনি বলেন, আগে ৫ ট্যাকা লইয়া মেলায় গেছি। মাটির বড় তৌল (পাতিল) কিনছি, মাত্র দুই পয়সা দিয়া। চার কেজি জিলাপি কিনছি মাত্র ১ টেহা দিয়া। চার আনা কেজি আছিল। দুই কেজি খই কিনছি চার আনা দিয়া। ৭ টাকা ৮ টাকা দিয়া পেন্ডনের কাপড় কিনছি। এখন ৫ হাজার ট্যাকা দিয়াও ভালো কাপড় পাওয়া যায় না। কি দিন গেছে আর কি দিন আসছে? ৫০০ ট্যাহা লইয়া বাজারে গেলে থলির তলায় পইড়া থাহে বাজার।’
বয়স্ক মানুষদের বেশির ভাগই প্রশ্ন টাকার দাম এতো কমছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশি মুদ্রা চালু হলেও আগের বছর পাকিস্তানি রূপির যে মান ছিল, টাকাও একই মান পায়। তখন ১ ডলার কিনতে ৭ টাকা ৮৬ পয়সা লাগত। তারপর থেকেই ১৯৮৭ সাল পর্যন্তপ্রতিবছর টাকার দাম কমতে লাগল। এই ১৬ বছরের মধ্যে ১৯৭৮ সালেই কেবল টাকার দাম কমেনি। স্বাধীনতার পর টাকার দাম কমানোর ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির কাছ থেকে ১৯৭৪ ঋণ সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে টাকার অবমূল্যায়নের শর্ত দেয় সংস্থাটি। শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইএমএফের শর্ত মেনে সহায়তা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য তা গ্রহণ করতে হয়। ১৯৭৫ সালে সরকার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে টাকার মূল্য ৫৬ শতাংশ কমিয়ে দেয়। একাত্তরে যেখানে ১ ডলারে ৭ টাকা ৮৬ পয়সা পাওয়া যেত, পরের ১০ বছরেই ১ ডলার কিনতে ১৮ টাকা ৩১ পয়সা লাগত। অর্থাৎ, স্বাধীনতার সময় যে পণ্য কিনতে ৭ টাকা ৮৬ পয়সা লাগত, ১৯৮১ সালে ওই পণ্যের দাম না বাড়লেও কিনতে হতো ১৮ টাকা ৩১ পয়সা দিয়ে।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে টাকার দাম আরো অর্ধেক কমে যায়। কারণ, ওই সময় বিপুল পরিমাণ পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি হতে থাকে। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি হচ্ছিল না। ফলে দেশ বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়ে। তখন আমদানি কমাতে সরকার টাকার মূল্যমান আরো ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। তবে ১৯৮৫ থেকে পরের দুই বছর টাকার মান ডলারের বিপরীতে ১২ শতাংশ বাড়ে। তা সত্ত্বেও ১৯৮৭ সালে ৩১ টাকা দিয়ে ১ ডলার পাওয়া যায়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ টাকায়। বর্তমানে ১ ডলার কিনতে ৮৪-৮৬ টাকা দরকার হয়।
কোনো পণ্যের বাজারদর নির্ভর করে ওই পণ্য আমদানিতে কত টাকা খরচ হয় তার ওপর। ধরা যাক, ১৯৭১ সালে বিদেশ থেকে ১ ডলারে যে পণ্য কেনা হতো, বাংলাদেশে ওই পণ্যের দাম হতো ৭ টাকা ৮৬ পয়সা। এখন বিদেশে ওই পণ্যের দাম ১ ডলার হলেও বাংলাদেশে তা কিনতে লাগবে ৮৪-৮৬ টাকা। এছাড়া, পণ্যটি আমদানি করতে, স্থানীয় বাজারে বিপণন করতে যদি আরো ১ ডলার খরচ হয়, সেটি ধরলে ১৯৭১ সালে যে পণ্যের দাম ১৫-১৬ টাকা হতো, শুধু টাকার দাম কমার কারণেই তার দাম এখন ১৭০ টাকার বেশি।
টাকার দাম কমলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসী শ্রমিকদের লাভ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। ২০১৫ সালে একজন বাংলাদেশ থেকে একটি তৈরি পোশাক যুক্ত রাষ্ট্রে ১ ডলারে রপ্তানি হলে রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী পেতেন ৭৭ টাকা। এখন একই পোশাক ১ ডলারে রপ্তানি হলে তিনি পাচ্ছেন ৮৪ টাকার বেশি। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে ১ লিটার সয়াবিন তেল আমদানি করতে যদি ১ ডলার লাগতো, তখন ওই তেল কিনতে খরচ হতো ৭৭ টাকা, এখন ৮৪ টাকার বেশি। সে কারণেই তৈরি পোশাক শিল্পমালিকরা প্রায়শই টাকার দাম কমানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ দেয়।
‘পপুলার ইকোনমিকস অনপপুলার এসেস’ গ্রন্থে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, টাকার অবমূল্যায়ন হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় যে ধারণাটি হয়, তা হলো সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। বছরে টাকার মান ৫ শতাংশ হারে কমছে তা মূল্যস্ফীতি হিসেবে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলতে পারেন যে, টাকার মূল্যমান কী হবে, তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাজারই এটা নির্ধারণ করে। তাহলে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে, বাজারে সব সময় ডলারের দামই বাড়বে কেন? টাকার দাম কেন কখনো বাড়বে না?
নীতিগতভাবে সরকার টাকার মান কেমন হবে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রামান বিবেচনায় নিয়ে টাকার মূল্যমান নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করে বলে দেশ রূপান্তকে বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
আগে মালয়েশিয়া থেকে পড়তে আসত, এখন আমরা যাই
স্বাধীনতার সময়ও স্কুল বলতে ছিল দুই-তিনটা গ্রামে একটা। খড়ের চালা, টিনের ঘর, জানালা নাই। লুঙ্গি পরে, খালি পায়ে শিক্ষকরা ক্লাসে আসতেন। গায়ে থাকত পাঞ্জাবি বা শার্ট। তবে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না। হাইস্কুলেও লুঙ্গি পরে, খালি পায়ে ক্লাস করত। টিফিন জিনিসটা কী, তা-ই কারো মাথায় ছিল না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. শাহজাহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কলেজে উঠে প্রথম প্যান্ট, পায়জামা পরলাম, শার্ট ইং করা শিখলাম। তখন দেশে প্রথম স্পন্সের স্যান্ডেল চালু হলো। দাম ৬-৭ টাকা। একজোড়া স্পন্সের স্যান্ডেল কিনতে হলে ৩-৪ মন ধান বিক্রি করতে হতো।’
তিনি বলেন, প্রাইভেট পড়ার প্রচলন ছিল না। কোচিং কী জিনিস, তা কারো জানাই ছিল না। যেসব ছাত্রদের অবস্থা খুবই ভালো, তারা কালেভদ্রে শিক্ষকদের কাছে যেয়ে পড়ত। আমরাও কোনো কিছু না বুঝলে শিক্ষকদের বাসায় যেয়ে বুঝে আসতাম। সে জন্য কোনো পয়সা দিতে হতো না।
‘পত্রিকায় রেজাল্ট বের হতো। ঢাকার পত্রিকা পরদিন জেলা শহরে পৌঁছাত। গ্রামে তো যেতই না। আমরা যখন এসএসসি পাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে তখন একটাই বোর্ড, ঢাকা বোর্ড। যেদিন রেজাল্ট হলো, পরদিন স্কুলে গেলাম। যেয়ে শুনি রেজাল্ট এখনো আসে নাই। কোনো পত্রিকাও আসে নাই। বিকেলের দিকে কেউ একজন একটা পত্রিকা নিয়ে আসল, সবাই তাকে ঘিরে ধরল। সে তখন পত্রিকা হাতে নিয়ে দিল দৌড়।’
‘আমরাও পেছনে দৌড়াতে লাগলাম। পরে সে একটা আমবাগানের উঁচু জায়গায় দাঁড়াল। সেখান থেকে সে সবার রোল নম্বর বা পাসের ডিভিশন বলতে লাগল। আমাদের সময় দু-চারজন ফার্স্ট ডিভিশন পেত। তাদের সবাই সম্মানের সঙ্গে দেখত। গল্প শুনেছি, আরো আগে কেউ মেট্রিক পাস করলে মানুষ গরুর গাড়িতে চড়ে তাকে দেখতে আসত অনেক দূর থেকে। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে শিক্ষার হার ছিল ২২ দশমিক ২ শতাংশ। এখন ৭২ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে বাড়ি বাড়ি এসএসসি পাস ও পাড়ায় পাড়ায় উচ্চশিক্ষিতরা রয়েছে। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দেশে স্মতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিল ২৩ হাজার ৭৩১ জন। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ৮ লাখ ২৩ হাজার ১০২ জন। ১৯৭০-৭১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ, যা এখন এক কোটি ৮৬ লাখে পৌঁছেছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষক, সারা দেশে গড়ে উঠেছে বিপুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে একটি প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে এসেছে, শিক্ষার মান বাড়ছে কি?
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার শিক্ষা সম্প্রসারণে সাধারণভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে মেয়েদের শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশে যেখানে নারী শিক্ষার হার ছিল একেবারেই কম, সেখানে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কন্যাশিশু ভর্তির হার ছেলেশিশু ভর্তির হারের চেয়েও বেড়েছে।
তেহাত্তরের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ঘোষণা দেয় যে, তারা সরকার গঠন করলে শিক্ষার মানোন্নয়নে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে। ইশতেহারে দলটি বলে যে, ‘জাতি হিসেবে জনসংখ্যার হিসেবে আমরা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা খুবই পশ্চাদপদ। বোধগম্য কারণে বিদেশি সরকারগুলো অতীতে এদেশে শিক্ষা বিস্তারের দিকে নজর দেয়নি। ফলে আজ বাংলাদেশে শিক্ষিত ও দক্ষ মানুষের অভাব আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে একটি মারাত্মক অসুবিধা বলে গণ্য হচ্ছে। সরকার বিষয়টির ওপর তীক্ষè নজর দিচ্ছে।’
সরকারি কলেজে শিক্ষকতাকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানের ফারাক স্বচক্ষে দেখেছেন অধ্যাপক শাহজাহান। স্মৃতিচারণা করেন, ‘শিক্ষার মান তখন ভালোই ছিল। নকলের প্রবণতা ছিলই না। হয়তো দু-একটা সেন্টারে একজন করে ধরা পড়ত। প্রশ্ন ফাঁসের চিন্তাই করা যায়নি। তখনকার শিক্ষার মান এখন চিন্তাই করা যায় না। এত অবক্ষয় হয়েছে, ভাবতেই কষ্ট লাগে।’
স্বাধীনতার পর নকলের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তখন নকলবাজদের রুদ্রমূর্তিতে শিক্ষকরা টিকতেই পারতেন না। একটি বিধিবদ্ধ সংস্থায় সদস্য হিসেবে থাকা একজন আমার সামনেই বই খুলে পরীক্ষা দিয়েছে। আমাদের আরেক ছাত্র থাকত ঢাকায়, কিন্তু পরীক্ষা দিত পাবনায়। অর্থাৎ, সে পরীক্ষা না দিয়েই পাবনা থেকে পাস করে গেছে। তবে একটা জিনিস স্বীকার করি, আগে ফাইভ-সিক্সের ছাত্ররা পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি সম্পর্কে তেমন কিছু জানত না। পুঁথিগত বিদ্যায় সীমাবদ্ধ ছিল। এখনকার ছোট শিক্ষার্থীরা বাইরের জ্ঞান বেশি জানে।
দেশে শিক্ষা বাড়লেও আদব-কায়দা, মানসম্মান দেওয়া কিংবা নৈতিকতার বালাই দেখছেন না অধ্যাপক শাহজাহান। ‘এখন দেখি গলায় গলায় বন্ধু, তারাই একজন আরেকজনকে পশুর মতো জবাই করছে। এরা কেউই তো অশিক্ষিত না। আগে আমরা শিক্ষকদের সামনে মুখ তুলে কথা বলতে পারতাম না। এখন তো শিক্ষকদের কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে। শিক্ষকরাও জান বাঁচানোর জন্য তা করছে। শিক্ষার্থীদের মতো শিক্ষকদেরও এখন অনেক অবক্ষয় হয়েছে। দামি কাপড়ের মধ্যে ময়লা ঘিঞ্জি ভরা এখনকার সবারই। অন্যায় করে পার পেয়ে যাচ্ছে, তাই অন্যায় করতে কেউ দ্বিধা করছে না’Ñবলেন তিনি।
প্রাইম ব্যাংকের কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান টিপু নিজের ও কন্যার সময়কার শিক্ষকদের তুলনা করে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ‘তখন আমি ক্লাস সিক্সে, হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় অঙ্কে পেলাম ২৭, ক্লাসে শিক্ষক এসে ঘোষণা দিলেন, যারা লেটার মার্কস পায়নি তাদের ১০০ থেকে যেত নম্বর কম পেয়েছ, ততটি বেত্রাঘাত করা হবে। আমার কপালে ৭৩টি বেত্রাঘাত জুটল। ক্লাসের সকল সহপাঠীর সামনে এমন মারে খুব শরম পেয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষা হতে এইচএসসি পর্যন্ত সবকটি পরীক্ষায় অঙ্কে লেটার মার্কস নিয়ে পাস করেছি।’
‘মেয়েটা আমার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে, একই কলেজ হতে এইচএসসির প্রিটেস্ট পরীক্ষায় সায়েন্সের সব কটি সাবজেক্টে খুব খারাপ করল। কলেজ থেকে যথারীতি আমাকে ডাকল। গিয়ে দেখি আমার মতো অনেক অভিভাবককে ডাকা হয়েছে এবং অভিভাবক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কী কী ইত্যাদি তুলে ধরলেন শিক্ষকরা। জবাবে আমি শুধু বললাম, যে মেয়ে আপনাদের এখান হতে জিপিএ ৫ পেয়েছে, সে মেয়ে এত খারাপ করল; আপনারা আপনাদের কোনো দায়িত্ব পালন করেছেন কি? কী পড়িয়েছেন যে এতগুলো ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় খারাপ করল? আপনাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছেন? উপস্থিত শিক্ষকগণ খুব ক্ষুব্ধ হলেন। এরপর মেয়েটি ওই কলেজে যতদিন ছিল, ততদিন ওকে শিক্ষকরা নানাভাবে অপদস্থ করেছে, টিপ্পনি কেটেছে, সেদিন আমি প্রতিবাদ করেছিলাম বলে। মেয়েটি আমার মুখ বুজে সহ্য করেছে। আমাকে আর বলেনি। এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার পর আমি জানতে পারি।’
বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তÑ অনেকেই তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে এসব শিক্ষার্থীদের এ লেভেল পাসের পর। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হেলালউদ্দিন। মেয়ে এ বছর এ লেভেল পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের সিলেবাসের সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কোনো মিল না থাকায় মেয়েকে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারছেন না।
শিক্ষা পদ্ধতির ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে টিটু বলেন, একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এভাবে চলতে পারে না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে পারছে না। কারণ, তাদের নাকি ওই ধরনের সিলেবাস নেই। অথচ এরাই ভারত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে পড়ছে। তাহলে মেধা পাচার হবে না কেন? বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি জানা শিক্ষার্থীদের এভাবে দেশত্যাগে বাধ্য করে বাংলাদেশ এগুতে পারবে না।
শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ হলেও শিক্ষার মান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। দেশ রূপান্তকে তিনি বলেন, স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। অথচ উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে যারা পড়ান তাদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। সব মেধাবী ছাত্র ভালো শিক্ষক হয় না। একজন মেধাবী ছাত্র হয়তো ভালো গবেষক হয় কিন্তু ভালো শিক্ষক হওয়া এতটা সহজ নয়। ভালো শিক্ষক হতে বাড়তি দক্ষতা লাগে, যা প্রশিক্ষণ ছাড়া অর্জন করা খুবই কঠিন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাংলাদেশ ছাড়া সব দেশেই আছে।
তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মান না হোক, এই উপমহাদেশীয় শিক্ষা মানে তো থাকা উচিত। কিন্তু সেটা করতেও হিমশিম খাচ্ছে। একসময় মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়তে আসত। কিন্তু এখন উল্টো প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী একই সময়ে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়।
ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, আর এক শ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তারা বিজ্ঞাপন দিয়েই সার্টিফিকেট বিক্রি করে। তাদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করলেই তারা হাইকোর্টে গিয়ে মামলা করে। আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আবার তারা কুকর্ম চালিয়ে যায়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশ রূপান্তকে বলেন, শিক্ষার মান খারাপ হয়েছে। এসব ফার্স্টক্লাস দিয়ে কিছু হবে না। বাংলাদেশে শিক্ষা পরিকল্পনা পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে।
ঢাকায় এসে বুঝলাম, সৃষ্টিকর্তা আছেন
৮২ বছর বয়সী আবদুল মালেক ১৯৬৩ সালে বিমানবাহিনীর সুপারভাইজার পদে যোগ দেন। ওই সময় ঢাকার কাফরুল থেকে বর্তমান বঙ্গভবনে সাইকেল চালিয়ে যেতেন তিনি। যানজট বলতে কিছুই ছিল না, এত মানুষ, দালান কোঠাও ছিল না। প্রগতি সরণির রাস্তাটি তখন ইট-সুরকি বিছানো সরু রাস্তা ছিল। ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে বিসিএস কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন বছর কয়েক আগে অবসরে যাওয়া শওকত আলী ওয়ারেসি। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, চাকরিতে যোগদান করে বন্ধুদের সঙ্গে চকবাজারের একটি মেসে থাকা শুরু করেন তিনি। তখন চকবাজার থেকে গুলিস্তান হয়ে রাজস্ব ভবনে আসতে টেম্পোতে তার খরচ হতো চার আনার মতো। আর রিকশায় এলে এক-দেড় টাকা ভাড়া গুনতে হতো।
সেদিনের সেই ঢাকায় এখন রাস্তা বেড়েছে, চাওয়া হয়েছে। মানুষ, যানবাহনÑ সবই বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে অচল শহরের তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে ৪৭ বছর আগের ফাঁকা ঢাকা। এখন রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থা এতই খারাপ যে নাস্তিকের চিন্তায়ও সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব জেগে ওঠে। বছর দুই আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে একজন জাপানি নগর পরিকল্পনাবিদ এসে দেখা করেন। তার আগে ঢাকার মতিঝিলের রাস্তা ঘুরে দেখেন তিনি। ঢাকার রাস্তায় চলাচলের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে মুহিতকে তিনি বলেন, ‘আমি আগে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু ঢাকার রাস্তার পরিস্থিতি দেখে মনে হলো, নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু একটা আছেন। না হলে, ঢাকার রাস্তায় এত বিশৃঙ্খলা, এত মানুষ, এত গাড়ি, রিকশা। কেউ এগুলোকে চালাচ্ছে না, তবুও তো চলছে। আমি নিশ্চিত দূর থেকে মহাশক্তিশালী কেউ না কেউ এগুলোকে চালাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ছাড়া ঢাকায় মানুষের চলাচল সম্ভব হতো না।’
বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা শহরে মোট রাস্তার দৈর্ঘ্য ২২০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। প্রধান সড়ক ছাড়া বাস চলাচল করতে পারে না। কিন্তু ঢাকায় দরকার অন্তত ছয় হাজার কিলোমিটার রাস্তা। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপ্রতুল এই সড়কের ৭৬ শতাংশই দখল করে রাখে ব্যক্তিগত গাড়ি। আর গণপরিবহনের দখলে থাকে মাত্র ৬ থেকে ৮ শতাংশ।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সুশৃঙ্খল গণপরিবহনের অনুপস্থিতি, ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন ও পরিবহন অবকাঠামোর অভাবে ঢাকার মানুষের গতিবেগ ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারে নেমেছে, যা হাঁটার গতিবেগের চেয়ে সামান্য একটু বেশি। তিনি বলেন, ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার অন্যতম সমস্যা হলো অল্প রাস্তা, অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণ ও স্তর বিন্যাস, সুশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, প্রধান সড়কের বেশির ভাগ ব্যক্তি গত গাড়ির দখলে থাকা। ঢাকার মোট সড়কের মাত্র ৫-৬ ভাগ প্রধান সড়ক যেখানে গণপরিবহন চলতে পারে। আধুনিক নগর পরিকল্পনার ভিত্তিতে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। শুধু সড়ক যোগাযোগ দিয়ে এত বড় মেগাসিটির মানুষের চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এ জন্য রেল ও নদীপথের উন্নয়নও করতে হবে। ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ভবিষ্যৎ ঢাকার সাফল্য নির্ভর করবে আশপাশের নগরগুলোর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর। টঙ্গী, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ খুবই সম্ভাবনাময় নগরকেন্দ্র। সমন্বিত আঞ্চলিক পরিকল্পনা করে এসব নগর কেন্দ্রের সঙ্গে ঢাকাকে সংযুক্ত করতে হবে। সড়ক ও রেলের ক্ষেত্রে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন ছাড়া ভালো শহর গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
এখন আর লুঙ্গি খুলতে হয় না
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার কাছিকাটা গ্রামে জন্ম শওকত আলী ওয়ারেসির। ১৯৭৩ সালে এসএসসি পাস করে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। সেই সময় গ্রাম থেকে রাজশাহী যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। ‘তখন আমার গ্রাম থেকে রাজশাহী যেতে লাগত সারা দিন। গ্রাম থেকে হেঁটে, গরুর গাড়িতে করে গুরুদাসপুর যেয়ে বাসে চড়তাম। বাসে ওঠার আগে লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতাম। কারণ, প্যান্ট পরে এত ধুলা-কাঁদার রাস্তায় হাঁটা যেত না। গুরুদাসপুর থেকে ২০ মাইল দূরের নাটোর আসতে লাগত ৩ ঘণ্টার মতো। বাস ছিল হ্যান্ডেল মারা। বাসের সামনে হ্যান্ডেল মেরে স্টার্ট দিতে হতো। যেখানে পুকুর, কুয়া বা ডোবা দেখত, সেখানে থামিয়ে মেশিনে পানি দিয়ে আবার চলত। বাড়ি থেকে এভাবে নাটোর পৌঁছাতে লাগত ৫ ঘণ্টা। নাটোর থেকে একটু ভালো বাস পাওয়া যেত।
তিনি বলেন, বিসিএস পরীক্ষা রাজশাহী থেকে দিছি, ভাইভা দিতে ঢাকা আসছি ৮৩ সালে। তখন ঢাকা আসতে দুদিন লেগে যেত। বাড়ি থেকে জেলা শহরে যেয়ে রাত থেকে পরদিন ভোরে বাস ধরতে হতো। তখন ঢাকা আসার দুটি রাস্তা ছিল। একটি আরিচা-নগরবাড়ী হয়ে, অন্যটি রেলপথে। রেলে ঢাকা যেতে সিরাজগঞ্জ এসে লঞ্চে যমুনা নদী পার হতে হতো। সারা রাত লঞ্চঘাটে কাটানোর পর সকালে ময়মনসিংহের জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে এসে ট্রেনে উঠতে হতো।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সড়ক অবকাঠামো অনেক বেড়েছে। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো ছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত এই রেলসেতু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপন এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে মংলা বন্দরের সংযোগ ঘটনায়। ১৯৭১-৭২ সারা দেশে মোট পাকা রাস্তা ছিল ২২৪৩ মাইল বা ৩৬১০ কিলোমিটার। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, এখন দেশে জাতীয় মহাসড়ক ৩৮১২ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪২৪৬ কিলোমিটার ও ১২,২৪২ কিলোমিটার জেলা সড়ক নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তার দৈর্ঘ্যই ২১,৩০২ কিলোমিটার। এর বাইরে সারা দেশে রয়েছে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকারের পাকা ও কাঁচা সড়ক। এখন দেশের যেকোনো এলাকার সঙ্গে অপরাংশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে যমুনা নদীর ওপর ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক ও রেলযোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গেও ঢাকার সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা পাবে।
বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে উল্লেখ করে শওকত আলী ওয়ারেসি বলেন, এখন নাটোরের কাছিকাটা গ্রাম থেকে রাজশাহী যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। আর বাড়ি থেকে ঢাকা আসতে সময় লাগে মোটে তিন ঘণ্টা।
কেবল সড়কপথই নয়, কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নয়ন না হলেও রেল যোগাযোগও সম্প্রসারিত হয়েছে। ১৯৭১-৭২ সালে বাংলাদেশে রেলপথের পরিমাণ ছিল ১৭৭৬ মাইল। পরের ২০ বছরেও রেলপথের দৈর্ঘ্য বাড়েনি। তবে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গ বন্ধু সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপনের পর থেকে সরকার আবারও রেলপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। বর্তমানে সারা দেশে রেলপথের দৈর্ঘ্য প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের রেল সংযোগ স্থাপন হবে।
পাকিস্তান নেই, বৈষম্য আছে
সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যই ক্রমে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলমন্ত্রও ছিল ধনী-গরিবের বৈষম্য হ্রাস করা। এই বৈষম্য দূর করতেই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। সব ধরনের কলকারখানাÑপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করে নেন। বঙ্গ বন্ধু সরকারের পর রাষ্ট্রীয়করণের বদলে ব্যক্তি মালিকানাধীন বিনিয়োগে বেশি উৎসাহ দেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি যতই রাষ্ট্র খাত থেকে ব্যক্তি খাতে আসতে থাকে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যও তত বাড়তে থাকে। দিন দিন এ সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। সরকারের তরফ থেকেও বৈষম্য বাড়ার কথা স্বীকার করে বাজেটে ধনীদের ওপর করহার বাড়িয়ে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও বাস্তবে বৈষম্য বাড়ছেই।
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাজীব আহমেদ এই বৈষম্যের কথা তুলে ধরে গত ১৬ ডিসেম্বর নিজের ফেইসবুক পেইজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, ‘দুঃখজনকভাবে আমরা দেশের মধ্যেই কয়েকটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছি। গুলশানের তুলনায় মিরপুর, যাত্রাবাড়ী। চট্টগ্রামের তুলনায় রংপুর। সিলেটের তুলনায় বরিশাল।’
তিনি লিখেছেন, ‘বিএমডব্লিউ বিক্রিতে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষ দেশ, গণপরিবহন নিকৃষ্টতম। সবচেয়ে বড় পোশাক খাতের করপোরেট কর ১২%, ছোট ছোট খাতের ৩৫%। ধনীদের আয় বাড়ছে, শ্রমিকের প্রকৃত আয় ৪% কমেছে। ব্যাংকের এমডির বেতন ১৪ লাখ টাকা, একই ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী ১৬ ঘণ্টা কাজ করে পান ৮ হাজার টাকা। সরকারি কারখানার শ্রমিকদের বেতন ১৫ হাজার, বেসরকারি ৮ হাজার। বড়রা ব্যাংক লুট করে, তরুণ উদ্যোক্তা ঋণ পায় না। করপোরেটদের সুদের হার ৯%, গ্রামে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ হয় ২৭-৩৫% সুদে...স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর...’
ধনীদের সম্পদ এত বেশি বেড়েছে যে, ঢাকার অনেক ব্যবসায়ী পরিবারে ৮-১০টি করেও বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। একজন তৈরি পোশাক কারখানা মালিক বিএমডব্লিউ গাড়ি দেখিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, এই গাড়ি আমি ব্যবহার করি না। আমি স্পোর্টস মডেলের মার্সিডিজ বেঞ্চ ব্যবহার করি। চার সদস্যের পরিবারে কয়টি গাড়ি আছে, জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ছয়-সাতটি আছে। অনেক সময় আত্মীয়স্বজন আসে। সবাই মিলতে ঘুরতে গেলে বড় গাড়ি লাগে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে জিপগাড়ির ব্যবহার বাড়ছে। মূলত ধনিক শ্রেণির বিস্তারের কারণেই এ ধরনের দামি গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে চার হাজার ৮৯২টি জিপগাড়ির নিবন্ধন হয়েছে। দুই বছর আগে এটি ছিল ১৮৭০।
প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বলেছেন, ১৯৯১-৯২ সালে যেখানে সর্বাধিক ৫ শতাংশ ধনী পরিবারের জাতীয় আয়ের অংশ ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০.৬৬ শতাংশে। এরশাদ সরকারের আমলে ১ শতাংশ লোক দেশের ২৭ ভাগ সম্পদের মালিক ছিল। ২০০৭ সালে ১ শতাংশ লোক ৪০ শতাংশ সম্পদের মালিক। উন্নয়নের গতি চুইয়ে চুইয়ে নি¤œবর্গের দিকে যাবে বলে যে আশা করা হয়েছিল, বাস্তবে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না।
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান গত জানুয়ারিতে তথ্য দেন যে, সারা দেশে ১০ লাখ ৫১ হাজার ৮৩১ জন ভূমিহীন, ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৯০ জন গৃহহীন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিডিপি)-এর গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সমাজের সবচেয়ে নিচের দিকের পাঁচ শতাংশের আয় মোট আয়ের দশমিক ২৩ শতাংশ। যেখানে ২০১০ সালে ছিল দশমিক ৭৮ শতাংশ।
অন্যদিকে দেশে দিন দিন কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে নগদ কোটি টাকা রয়েছে, এমন মানুষের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় কোটি টাকার ওপরে আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা গত ৩০ জুনে পৌঁছেছে ৭৩ হাজার ৭১০টি। এর মধ্যে অবশ্য সবই ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট নয়। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টও রয়েছে। তবে ৮ বছর আগে এ সংখ্যাটি ছিল ২৬ হাজার ৫৪১। ১৯৭১ থেকে ’৭৪ সাল পর্যন্ত দেশে কোটি টাকার ওপরে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ২৭টি। পঁচাত্তরে তা বেড়ে ৫০টিতে দাঁড়ায়। ১৯৮০ সালে তা দ্বিগুণ হয়ে ১০৭ ও পরের ১০ বছরে বেড়ে ৯১৭টিতে পৌঁছায়।
আলো পৌঁছেছে অন্ধকারে
স্বাধীনতার সময় আলো বলতে গ্রাম-বাংলার মানুষ হয়তো চন্দ্র-সূর্যের আলো, কিংবা কেরোসিন পুড়িয়ে টিমটিমে জ্বলা কুপির আলোই বুঝত। সুইচ দিলে পুরো ঘর আলোতে ভরে উঠবেÑএ ধারণাই দেশের বেশির ভাগ মানুষের ছিল না। কারণ, বিদ্যুৎ কী জিনিস, তা-ই জানত না অনেকে। এখন আর সেদিন নেই! বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত মোট আয়তনের ৯০.৫ শতাংশ এলাকা। একসময় অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকা বাংলাদেশ আগামী দিনের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন হতো। তখন বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা সারা দেশে ছিল মোটে দুই লাখ ৩১ হাজার। বড় শহর ছাড়া বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়া ছিল বড়ই কঠিন ব্যাপার। মাথাপিছু বিদ্যুৎ ক্রয়হার ছিল ১০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ, বিদ্যুতের সংযোগ থাকলেও তাতে বিদ্যুৎ থাকত খুবই কম। ৪৭ বছর আগে বাংলাদেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, এখন চট্টগ্রামের কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানেই তার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ দরকার হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন মূলত গত ১০ বছরে। ১৯৮২ সালেও দেশের ৬.৫৬ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বাড়লেও উৎপাদনক্ষমতা না থাকায় মানুষের বাড়ি কিংবা শিল্প-কারখানা সর্বত্রই নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখে সরকার।
আওয়ামী লীগের ২০০৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ‘ভিশন ২০২১’ অনুযায়ী সরকার পরিকল্পনা করেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে সবার বাড়িতে জ্বলবে বিদ্যুতের বাতি। এ ক্ষেত্রে সফলতাও অনেক। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে কয়লা থেকে হাজার ৩৬৯ মেগাওয়াট ও ২০২০ সালের মধ্যে সৌর-প্যানেল থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে। ২০২১ সালের মধ্যে ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে আনা হবে দুই হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ; ২০৩০ সালের মধ্যে এসব দেশ থেকে আসবে ছয় হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। পরমাণু-বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২০২৪ সালে আসবে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট আর ২০৩০ সালের মধ্যে আসবে চার হাজার মেগাওয়াট।
ম্যাকনামারাকে রিসিভ করেননি তাজউদ্দীন, জেলিককে ‘না’ মুহিতের
বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তিনি তখন বারবার চেষ্টা করছিলেন বিশ্বব্যাংকের তখনকার প্রেসিডেন্ট রবার্ট স্ট্র্যান্স ম্যাকনামারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। উদ্দেশ্য ছিল, তার সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করা। বেশ কয়েকবার বিশ্বব্যাংকের দপ্তরে যেয়ে ম্যাকনামারার ব্যক্তি গত কর্মকর্তাকে গিয়ে অনুরোধ করেন মুহিত। একদিন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুহিতকে জানিয়ে দেন, প্রেসিডেন্ট তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না। কারণ, আপনি বাংলাদেশ বা পাকিস্তান সরকারের কোনো দায়িত্বে নেই, সাধারণ নাগরিক মাত্র।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পরপর একদিন ম্যাকনামারার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুহিতকে ফোন করলেন। বললেন, প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে চান। আমি তো শুনে অবাক। পরে আমি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি। ম্যাকনামারা আমাকে বললেন, আমি নিজ খরচে বাংলাদেশে যেতে চাই। তুমি যদি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারো, আমি যাব। মুহিত তখন ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে টেলিফোন করে ম্যাকনামারার এ প্রস্তাবের কথা জানালেন। তখন টেলিফোন করাও অনেক কঠিন কাজ ছিল। একদিন টেলিফোন করলে পরদিন সংযোগ পাওয়া যেত।
মুহিত বলেন, ম্যাকনামারা এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার সঙ্গে দেখা করবেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে জানানো হলো। বঙ্গবন্ধু তখনকার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলেছিলেন, বিমানবন্দরে ম্যাকনামারাকে রিসিভ করতে। কিন্ত তাজউদ্দীন তাতে রাজি হননি। তখন তাজউদ্দীন বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের কথার বাইরে কাজ করে না। তাই ওরা আমাদের কোনো সাহায্যও দেবে না। তাই আমি তাকে রিসিভ করতেও যাব না। পরে বঙ্গবন্ধু তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে পাঠান ম্যাকনামারাকে রিসিভ করতে। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ১২ ঘণ্টার ওই সফরে ম্যাকনামারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, সে সময় তাজউদ্দীন আহমদও পাশে ছিলেন।
ওই ঘটনার বর্ণনা করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশ রূপান্তকে বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সহায়তা দেওয়ার জন্য ম্যাকনামারা তখন অনেক চেষ্টা করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তিনি তা পারেননি। বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সহযোগিতা ছাড়াই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।
সেই ঘটনার অনেকটা পুনরাবৃত্তি ঘটেছে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুতে ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি ২০১১ সালের অক্টোবরে স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। পরের বছরের জুলাই মাসে তা বাতিলই করে দেয় সংস্থাটি। পরে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে বেশকিছু শর্ত দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে ফিরতে চেয়েছিল বিশ্বব্যাংক। শুরুতে সরকার তাতে রাজি থাকলেও সেতু নির্মাণে দেরি হওয়ার আশঙ্কায় ২০১৩ সালের বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংককে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণের কোনো প্রয়োজন নেই বাংলাদেশের। তার পর থেকে নিজস্ব অর্থায়নেই সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। তখন বিশ^ ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রবার্ট জেলিক।
২৬ টাকায় টিকে গেল জিহ্বা
ঘটনাটি গত বছরের। জিব্বায় ঘা নিয়ে ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে এক নিরক্ষর দম্পতি ঢাকার এক বিখ্যাত নাক কান গলার চিকিৎসকের কাছে ছুটে এলেন। সারাদিন বসে থেকেও ওই চিকিৎসকের দেখা পাননি তারা। কিন্তু রাত ১১টায় বের হওয়ার সময় চিকিৎসকের দয়া হলো। তিনি ডেকে নিলেন সেই দম্পতিকে। জিব্বাটা কুকুরের জিব্বার মতো লম্বা করে বের করতে বললেন তিনি। পুরুষ ওই রোগীকে একনজর দেখার পরই বললেন, ‘আপনার জিব্বায় ক্যানসার হয়েছে। জিব্বা কেটে ফেলে দিতে হবে। তিন লাখ টাকা নিয়ে সাত দিনের মধ্যে আমার চেম্বারে চলে আসুন। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর এখন কোনো ওষুধ দিয়েও লাভ নেই।’
বলেই ঘট ঘট করে চেম্বার ছেড়ে গেলেন চিকিৎসক। তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর চেম্বারের কর্মচারীরা আর একমুহূর্তও দেরি করতে চাইল না। তারা তাগাদা দিয়ে ওই দম্পাতিকে চেম্বার থেকে বের করে দিলেন।
দম্পতির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তারা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
গফরগাঁও ফিরে গেলেন। আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনরা সান্ত¡না দিতে এলেন এবং জমিজমা বিক্রি করে তিন লাখ টাকা নিয়ে অপারেশন করানোর পরামর্শ দিলেন। কিন্তু প্রতিবেশী রাজধানীবাসী এক শিক্ষার্থী তাকে পরামর্শ দিলেন অপারেশন করাতে হবে ভালো কথা। আপনি অপারেশন করাবেন। কিন্তু অপারেশন করানোর আগে আপনি ভারতের চেন্নাই যান। সেখানকার চিকিৎসকও যদি বলেন অপারেশন করাতে, তখন করাবেন।
গরু-বাছুর, জায়গা-জমি বিক্রি করে সাড়ে তিন লাখ টাক নিয়ে এক মাসের মধ্যে চেন্নাই গেলেন তারা। কোনো কিছু পড়তে পারেন না, স্থানীয় ভাষাও জানেন না তারা। ঠিকই পৌঁছে গেলেন মাদ্রাজের বিখ্যাত সিএমসি হসপিটালে। চিকিৎসক দেখেই বললেন আপনারা নাক কান গলা বিভাগে এসেছেন কেন? আপনাদের সমস্যা তো দাঁতের। তিনি একপ্রকার জোর করেই তাদেরকে ডেন্টাল বিভাগে পাঠালেন।
দাঁতের চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, তাদের কোনো অপারেশন করাতে হবে না। ওষুধেই অসুখ সারবে। একটা দাঁতের কোনা ভেঙে জিব্বায় গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য জিব্বা কেটে ফেলার কোনো দরকার নেই। দাঁত ঘষে ঠিক করে দিলেন আর ওষুধ লিখে দিলেন। দম্পতি ফার্মেসি বিভাগ থেকে ২৬ রুপির ওষুধ কিনে থ হয়ে গেলেন।
মাত্র ২৬ টাকার ওষুধে তাদের অসুখ ভালো হয়ে যাবে? তারা যেন নিজেদের বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। চিকিৎসক কোনো ভুল করলেন না তো? হসপিটালে উপস্থিত অনেককে কাগজপত্র দেখালেন। চিকিৎসকের কাছেও গেলেন আবার। চিকিৎসক আবার ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন।
চিকিৎসকের রুম থেকে বের হয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না ওই দম্পতি। একজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
হসপিটালের সিকিউরিটি দৌড়ে এলো তাদের কান্না থামাতে। কান্না তো থামেই না বরং তাদের কান্না দেখে উপস্থিত অন্যান্য বাংলাদেশি রোগীরাও কান্নাকাটি শুরু করেছেন।
শৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত সিকিউরিটি গার্ড তাদেরকে জোর করে হাসপাতাল থেকে বের করে দিল। এরপর হঠাৎ করেই বিস্ফোরণ ঘটল। স্লোগানের বিস্ফোরণ। সঙ্গী নিরক্ষর মহিলাটি বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে বাংলাদেশি ওই বিখ্যাত ডাক্তারের নাম ধরে বললেন, এর ফাঁসি চাই। সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকা কাঁপিয়ে দিয়ে উপস্থিত সব বাংলাদেশি স্লোগান ধরল ‘এর ফাঁসি চাই।’
লাল ফিতা সাদা হয়েছে দৌরাত্ম্য কমেনি
সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রশাসনের ফাইলগুলো লাল ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। লাল ফিতা ব্যবহার করার কারণ ছিল, ব্যবহার করতে করতে ফিতাতে ময়লা জমলেও তা খুব একটা বোঝা যেত না। কিন্তু লাল ফিতায় বন্দি ফাইল আটকে রেখে সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় ছিল প্রশাসনে অতিস্বাভাবিক ঘটনা। উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রিটিশ আমল থেকে সেই লাল ফিতা ও তার দৌরাত্ম্য পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলেও চলতে থাকে।
১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রশাসনের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা একটি দুর্নীতিযুক্ত প্রশাসন পেয়েছি। সাবেকি পুঁজিবাদী অর্থনীতির সূত্র ধরে আমাদের জীবনের সর্বস্তরে দুর্নীতি সম্প্রসারিত হয়েছে এবং আমাদের প্রশাসন কর্মীদের কিছু অংশ এখনো পুরাতন রীতি-নীতি ও ধাবধারা পরিত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীল লোভ-লালসাহীন কর্তব্যনিষ্ঠায় প্রমাণ দিতে পারেনি।’
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বহুবার প্রশাসনের দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং দিনের পর দিন সেবাপ্রার্থীদের জরুরি ফাইলগুলো আটকে রেখে টাকা আদায়ের কৌশল বেড়েছে। ফলে ‘লাল ফিতার দৌরাত্ম্য’ বাক্যের প্রচলন শুরু হয়ে যায় সর্বত্র। সরকারি চাকরিজীবীদের স্বেচ্ছাচার, কালক্ষেপণ ও ঘুষ নেওয়ার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় লালফিতা। এখন প্রশাসনে সেই লাল ফিতা আর নেই। লাল ফিতার বদলে সাদা ফিতা ব্যবহার হচ্ছে সরকারি দপ্তরগুলোতে। কিন্তু দৌরাত্ম্য কমেনি বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব শওকত আলী ওয়ারেসি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই লাল ফিতার ব্যবহার চলে আসছিল। ১৯৮৬ সালের দিকে উচ্চ আদালত থেকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা আসে। তখন প্রশাসনে ইংরেজির বদলে বাংলার ব্যবহার শুরু হয়। ওই সময়ই লাল ফিতার বদলে ফাইলগুলোতে সাদা ফিতা ব্যবহার শুরু হয়। যেহেতু লাল ফিতা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার ও কালক্ষেপণের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, তাই ওই ফিতা ব্যবহার থেকে সরে আসে প্রশাসন। ফিতার রং বদলালেও প্রশাসনের দৌরাত্ম্য কতটুকু কমেছে, জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা হাসতে থাকেন। পরক্ষণে বলেন, ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকেও ঢাকার দেয়ালগুলোতে চিকা মারা থাকত ‘ফাইল আটকিয়ে টাকা নেওয়া আর পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা নেওয়ার মধ্যে কোনো তফাত নেই।’ ‘তবে আমলাতন্ত্রের এখন আর ওই রকম দৌরাত্ম্য নেই। এখন সবকিছুর গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেন রাজনীতিবিদরা। তবে প্রশাসনের নিচের দিকে দৌরাত্মœ্য একটুও কমেনি। টাকা ছাড়া নিচের স্তরে কোনো কাজ হয় না’Ñঅভিমত সাবেক এই উচ্চপস্থ’ কর্মকর্তার।
ওয়ারেসির বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতিরও মিল পাওয়া যায়। লাল ফিতা সাদা হওয়ার পর প্রশাসনের দুর্নীতি আরো ব্যাপকতর হওয়ার চিত্র উঠে আসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদনে। ২০০১ থেকে পরপর চারবার বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে টিআই প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১৭তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। আগের বছর ছিল ১৫তম। ওয়ারেসি বলেন, দেশে দুর্নীতির পুরোটার সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তারা জড়িত নন। আমলাদের ক্ষমতা আগের মতো নেই। সচিবালয় বলেন, জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে আগে আমলারাই ছিলেন হর্তা-কর্তা। এখন সর্বত্রই রাজনীতিবিদদের প্রভাব বাড়ছে। পাকিস্তান আমলেও সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের দ্বন্দ্ব দেখা দিত। কিন্তু সব সময়ই বেসামরিক প্রশাসন সামরিক প্রশাসনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে চলত। ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সেও বেসামরিক প্রশাসনকে সামরিক প্রশাসনের ওপরে রাখা হতো। বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সময় এ পরিস্থিতি বদলে গেল। তার মতে, পাকিস্তান আমলে প্রশাসনের উচ্চ স্তরে নিয়োগের জন্য বর্তমান বিসিএসের মতোই সিএসএস পরীক্ষা হতো। ওই পরীক্ষায় মেধাতালিকায় থাকা প্রথম শ খানেক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনে নেওয়া হতো, যাদেরকে সিএসপি অফিসার বলা হতো। বাকিদের অন্যান্য ক্যাডারে চাকরি দেওয়া হতো। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এলো। তখন মেধাতালিকার প্রথম দিকে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের পররাষ্ট্র ও প্রশাসন ক্যাডারে দেওয়ার বদলে ২৮টি ক্যডার করে প্রার্থীদের পছন্দ অনুযায়ী চাকরি দেওয়া শুরু হলো। এভাবেই সিভিল প্রশাসন দুর্বল হতে থাকল, তাদের প্রভাবও কমতে থাকল। এখনো সে পদ্ধতিতেই নিয়োগ হচ্ছে।
নিজের কর্মজীবনের একটি ঘটনা তুলে ধরে শওকত আলী ওয়ারেসি বলেন, ২০০৪-২০০৫ সালের ঘটনা। তখন মাত্র উপসচিব হয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছি। তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী হঠাৎ আমাকে ডাকলেন। যাওয়ার পর হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন এবং একটি কম বয়সী ছেলেকে দেখিয়ে বলেন, ওই শেয়ারগুলো এই ছেলেটার নামে ট্রান্সফার করে দাও। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সারা দেশের পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেখভাল করে, ওই শেয়ারগুলোও পরিত্যক্ত ছিল। আমি কাগজটা নিয়ে যুগ্ম সচিবের কাছে এসে বললাম মন্ত্রী এই কথা বলেছেন। উনি কোনো দায়িত্ব নিতে চাইলেন না। আমি পুরোনো ফাইলপত্র ঘেঁটে নথি বের করলাম। দেখি, ওটা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় থাকা এক পাকিস্তানি নাগরিকের নামে। স্বাধীনতার পর ওই লোক বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে, শেয়ার সরকারের হাতে এসেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখভাল করছে।
সরকারি শেয়ার কাউকে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম আছে। প্রথমে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হবে যে, এই শেয়ারের কোনো মালিক নেই। পরে উন্মুক্ত দরপত্র দিতে হবে। সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে ওই শেয়ার বিক্রি করতে হবে। আমি এসব নিয়ম-কানুনের কথা রেডি করে বসে থাকলাম। কয়েকদিন পর মন্ত্রী আবার আমাকে ডাকলেন, গেলাম। উনি ধমক দিয়ে বললেন শেয়ারগুলো এখনো কেন ওই লোকের নামে দিচ্ছেন না? তখন আমি নিয়মের কথা বলতেই তিনি আরো জোরে ধমক দিয়ে বললেন, জানো ওই লোক কে? তখনকার প্রধানমন্ত্রীর ছেলের নাম ধরে তিনি বলেন যে, তিনি চান যে শেয়ারগুলো তাকে দেওয়া হোক। এক্ষুনি যেয়ে শেয়ারগুলো তাকে দিয়ে দেন। না হলে আপনার চাকরি থাকবে না? আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তবে শেয়ারগুলো ওই ছেলের নামে হস্তান্তর করলাম না। তবে আমার ভাগ্য ভালো যে, এর কয়েকদিনের মধ্যেই তার মন্ত্রিত্ব চলে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান একটি গল্প লিখেছেন। তিনি বলেছেন, আশির দশকে গল্পটি বেশ চালু ছিল। তখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশে শামরিক শাসন ছিল। উভয় দেশের সমরনায়ক শবেবরাতে নামাজ পড়তে বসলেন। দুজন দোয়া-দুরুদ পড়তে পড়তে বেহেশতে হৈচৈ ফেলে দেন। স্বয়ং জিবরাইল তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে নেমে আসেন। তিনি প্রথম পাকিস্তানে গেলেন এবং সমরনায়কের কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। সমরনায়ক বললেন, ‘সৃষ্টিকর্তা পাকিস্তানের প্রতি ঘোরতর অবিচার করেছেন। সব গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশে তেল দিলেও পাকিস্তানে দেননি।’ জিবরাইল বললেন, ‘ওরে কমবখত সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকর কর। তিনি তোকে তেল দেননি। কিন্তু আফগান সংকট দিয়েছেন। এই সংকট ভাঙিয়ে যত পারিস কামিয়ে নে।’
এরপর এলেন বাংলাদেশে। তারও একই দুঃখ। সব মুসলিম দেশ তেল পেয়েছে। এমনকি বাঙালিদের পরে মুসলিম হওয়া নালায়েক দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়াও তেল পেয়েছে। তেল পায়নি কেবল বাংলাদেশের মোমিন মুসলমানরা।’ জবাবে জিবরাইল বললেন, ‘বাংলাদেশের জন্য কিছু তেল ও গ্যাস বরাদ্দ রয়েছে। তবে তোর যে উড়নচ-ি স্বভাব, এসব তেল গ্যাস এখনই বের করা সম্ভব না। তোকে তেল দেওয়া হবে না। তোকা বন্যা দেওয়া হবে। যা পারিস রিলিফের মাল হতিয়ে নে।’
বাংলাদেশে দুর্নীতি বন্ধে রাজনীতিবিদরা বারবার অঙ্গীকার করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এভাবে যে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়, তা ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ‘সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সততা, নিয়মানুবর্তিতা, বাস্তবায়নানুগ উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন ও কঠোর শ্রমের আজ বড় প্রয়োজন। স্লোগান দিয়ে দুর্নীতি দূর হয় না, বুলি আওড়ে প্রবৃদ্ধি আনা যায় না, জনসাধারণকে সর্বকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া যায় না।’
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ নামক গ্রন্থের ২০১৬ সালের সংস্করণে বলা হয়েছে, দুর্নীতিরোধে আমাদের অক্ষমতা আজ সর্বজনবিদিত। সরকার বদলের পর পরই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রুজু হয় এবং সরকারি দলের রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অব্যবহিত আগের সরকার কর্র্তৃক রুজু করা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ দায়ের করা হয়, তার মধ্যে দুটি মামলা চূড়ান্তভাবে শেষ হয় এবং দোষী ব্যক্তি শাস্তি ভোগ করেন। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের দলে টানার জন্য তার জামিন দেওয়া-নেওয়া নিয়ে যে প্রহসনের সৃষ্টি হয়, তাতে আদালতের সুনাম ক্ষুণই হয়।’
ঢাকায় নামতেই মনে হয় এটি অত্যন্ত ধনী দেশ
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মো. আনিসুর রহমান তার আত্মজীবনী ‘পথে যা পেয়েছি’-এর দ্বিতীয় খ-ে বলেছেন, পরিকল্পনা কমিশনে সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়ার পর কৃচ্ছসাধনের জন্য পেট্রল ও গাড়ির অপচয় কমাতে সরকারকে প্রস্তাব দেন তিনি।
লিখিত ওই প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার সাপ্লাই অত্যন্ত কম, তাই এর ব্যবহারে যতটা সম্ভব মিতব্যয়ী হওয়া প্রয়োজন। একটি ক্ষেত্রে যেখানে এটি করা যায় এবং করা বাঞ্ছনীয় তা হলো পেট্রল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতে পেট্রল রেশন করা হয়েছিল এবং একটি কুপন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। বাংলাদেশে আজকে এরকম একটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা অনেক বেশি জরুরি। প্রাইভেট গাড়ির ওপর মাসিক পেট্রল কেনার একটা সিলিং ধার্য করা প্রয়োজন, মনে হয় প্রত্যেক গাড়ির জন্য মাসে দশ গ্যালন বরাদ্দ করে এবং এর জন্য একটা কুপন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। অফিসারদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সরকারি গাড়ি ব্যবহারের যে নিয়মাবলি আছে সেগুলির কড়া প্রয়োগ প্রয়োজন, এবং এর জন্য চার্জ বাড়িয়ে প্রতি মাইলে ১২ আনায় তোলা উচিত। মন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও এর কোনো অন্যথা হওয়া উচিত নয়। কোনো কোনো পদের অফিসাররা এবং মন্ত্রিবর্গ, বাসা থেকে অফিসে যেতে ও আসতে ফ্রি অফিসের গাড়ি পানÑএই প্রথাও বন্ধ করা উচিত।’
‘দেশের বাইরে থেকে আসলে ওপর থেকে ঢাকার ওপর নামতে গিয়ে প্রথমেই যে ধারণাটা হয় তা হলো, এটি একটি অত্যন্ত ধনী দেশ। বিলাসী গাড়ির প্রসেশন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বিদেশি মুদ্রা খরচ হয় বলে এসব গাড়ি আমদানি ও ব্যবহার উভয়েরই একটা সামাজিক খরচ আছে। বোধ করি আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, আমাদের মতো একটা দরিদ্র দেশে এরকম বিলাসী গাড়ির প্রদর্শন আমাদের দরিদ্র জনগণের জন্য নিদারুণ অপমানকর, সমতা নীতির বিরুদ্ধে এবং দেশ গড়ার কাজে দরিদ্র জনগণের উৎসাহের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব’Ñ চিঠিতে লেখেন তিনি।
আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমি জোর দিয়ে প্রস্তাব করছি যেম অবিলম্বে সমস্তবিলাসী গাড়ির স্পেয়ার পার্টস আমদানি বন্ধ করা হোক, যাতে হয় এ সমস্তগাড়ির দ্রুত মৃত্যু হয়, অথবা এরা বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায় যদি এদের জন্য বাজার থাকে।’
‘সরকারি কর্মচারীদের ব্যবহারের জন্য সরকারি খাতে মনে হয় খুব বেশি সংখ্যক গাড়ি আছে, এবং এদের অধিকাংশই বিলাসী জাতের। এটা একেবারেই অযৌক্তিক। সময় বাঁচাবার জন্য সরকারি অফিসারদের সরকারি কাজে যাতায়াতের জন্য দ্রুতযানের অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু এরকম যাতায়াতের ব্যবস্থা প্রয়োজনভিত্তিক হওয়া দরকার, স্ট্যাটাসভিত্তিক নয়। একা গাড়িতে যেতে একজন অফিসারের দুই-সিট গাড়িই শুধু প্রয়োজন, একটি সিট তার নিজের জন্য এবং একটি ড্রাইভারের জন্য। গাড়ির বাকি বসবার জায়গার অপচয় হয়, আর এসব গাড়ি কেনা ও চালু রাখবার খরচ পাবলিক ফান্ডের ওপর চার্জ হয়। বড় গাড়ির পেট্রল খরচও বেশি এবং ছোট গাড়ি দিয়েই যখন অফিসারদের যাতায়াত চলতে পারে তখন এই খরচ পাবলিক ফান্ড ও অপ্রচুর বিদেশি মুদ্রা দুইয়ের সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় খরচ’ বলেন আনিসুর রহমান।
তিনি বলেন, আমি প্রস্তাব করি যে, সরকারের মালিকানায় যে সব বড় গাড়ি আছে তাদের বেশির ভাগ জেনারেল পাবলিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হোক অথবা সম্ভব হলে বিদেশে রপ্তানি করে দেওয়া হোক এবং সরকারি অফিসারদের একা, দুজন বা তিনজন পর্যাপ্ত সরকারি কাজে যাতায়াতের জন্য ফিয়াট ৬০০ বা বেবি অস্টিনের চেয়ে অনধিক সাইজের গাড়ির ব্যবস্থা করা হোক। বাকি বড় গাড়িগুলো বড় দলকে নিয়ে যাওয়াার জন্য রাখা যেতে পারে। আবার বলছি, মন্ত্রীরা এই কৃচ্ছ্রসাধন ব্যবস্থা থেকে কোনো ব্যতিক্রম না দাবি করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন এ আশা করা যেতে পারে।
‘মোটামুটিভাবে আমার একটা ধারণা হচ্ছে যে, গত দশ মাসে দেশে কী হয়েছে এ সম্বন্ধে ঢাকার এলিটগর্ব বিস্মৃতির গর্ভে। বাংলাদেশের সচেতন জনগণ যারা দেশমুক্তির জন্য বীরের মতো সংগ্রাম করেছে এবং রক্ত দিয়েছে তারা আমাদের সত্যিকার অবস্থা বুঝে জেগে ওঠার জন্য খুব বেশি সময় দেবে না।’ Ñএভাবেই চিঠির সমাপ্ত টানেন আনিসুর রহমান। সে অবস্থার পরিবর্তন এখনো হয়নি। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা এখন বিএমডব্লিউও গাড়ি ব্যবহার করছেন। সরকারি কর্মকর্তারাও সর্বশেষ মডেলের গাড়ি কিনছেন সরকারি পয়সায়। সরকারের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য বিনাসুদে ঋণ পাচ্ছেন। সেই গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন জনগণের করের টাকা থেকে।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৮৬৩টি। ওই সময় সারা দেশে বাস ছিল সাত হাজার ৬১৬টি, ট্রাক ১৪ হাজার ২৮৮টি। ১৯৮০ সালেই ব্যক্তি গত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ৮৬৮-তে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৭০টি। ২০১৮ সালের প্রথম পাঁচ মাসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ১৫২৪টি করে ব্যক্তিগত গাড়ির নিবন্ধন হয়েছে। বর্তমানে ঢাকায় নিবন্ধিত বাস ২৮ হাজার ৮৯১টি।
বাংলাদেশের পরিকল্পনা একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্টতম
বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আনিসুর রহমান নিজের হাতেই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। নিজের করা ওই পরিকল্পনাকে একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্টতম বলে উল্লেখ করেন নিজেই। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যপদ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনায় পুরো সময় দেওয়া শুরু করেন তিনি। পরে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ওপর অরর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে আনিসুর রহমানকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হয়।
‘আমি বলেছিলাম যে, এই পরিকল্পনা একই সঙ্গে আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ এবং নিকৃষ্টতম ফসল। শ্রেষ্ঠ এই জন্য যে, এই পরিকল্পনা টেকনিক্যাল মেধা ও যোগ্যতার দিক দিয়ে বিশ্বের যে কোনো দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে তুলনীয়; নিকৃষ্টতম এই জন্য যে, এই পরিকল্পনা আকাশেই উড়ছে, দেশের মাটি স্পর্শ করতে পারেনি।’
বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন দুর্বলতার কারণে তিনি যে ওই কমিশনের সদস্য ছিলেন, সেই পরিচয়ে কোনো গর্ববোধ নেই আনিসুর রহমানের। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আজও আমাকে অনেকে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ‘প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য’ এই বলে যেন খুব শ্রদ্ধাভরে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি আমার এই পরিচয়ে খুব গর্ববোধ করি এ কথা বলতে পারি না, যদিও এই পরিচয় লুকোবার আমার কোনো পথ নেই।’
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকতা শওকত আলী ওয়ারেসি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালনকালে একটি ঘটনা স্মরণ করে দেশ রূপান্তকে বলেন, ২০১১-১২ সালের ঘটনা। বাজারে হলুদ, মরিচ, জিরার যে দাম, বিভিন্ন কম্পানির প্যাকেটজাত গুঁড়ার দাম তার চার-পাঁচগুণ। আমি আর অন্য অতিরিক্ত সচিব এ টি এম মর্তুজা রেজা চৌধুরী আলোচনা করলাম, গুঁড়ার দাম নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। ব্যবসায়ীদের ডাকলাম। তারা বললেন, নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে খুচরা ব্যবসায়ীদের ৩০%-এর বেশি মুনাফা দিতে হয়। তাই দাম বেশি। তখন আমি আর মর্তুজা গেলাম সচিবের কাছে। বললাম, এসব পণ্যকে অ্যাসেনসিয়াল পণ্য আইনে ঢুকিয়ে দিতে পারলে এগুলোর দাম প্রয়োজনে সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারবে। কিন্তু সচিব রাজি হলেন না।
‘পরে আমরা দুজন জিএম কাদেরের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, গেজেট জারি করে ঢুকিয়ে দাও। তখন আমরা বললাম, সচিব তো মাইন্ড করবেন। তখন আমরা মন্ত্রীকে বললাম, সচিব বিদেশ গেলে মর্তুজা ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পাবেন। ওই সময় আমরা এটা জারি করব। সে মতেই কাজ করলাম। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি’ দুজন অতিরিক্ত সচিব দীর্ঘদিন কষ্ট করে যে কাজটি করলেন, তা দেশের মানুষের কোনো কাজেই লাগল না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন করা হয়েছিল ২০০১ সালে। এরপর ১৬ বছরেও আইনটির বিধিমালা তৈরি করতে পারেনি ভূমি মন্ত্রণালয়। বিধিমালা তৈরি করতে না পারলেও কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ থেমে থাকেনি। উচ্চ আদালতের অবসারপ্রাপ্ত বিচারপতিদের কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ছয়জন চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন। এই সময়ে ভূমি বিরোধ নিয়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি আবেদন কমিশনে জমা পড়েছে। কিন্তু একটি আবেদনও নিষ্পত্তি হয়নি বিধিমালার অভাবে। সবশেষে ২০১৬ সালে আইনটির সংশোধনী আনা হয়। পরিবর্তিত আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
শুধু ভূমি মন্ত্রণালয়ই নয় এমন কোনো মন্ত্রণালয় পাওয়া যাবে না যাদের দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন বিধিমালার অভাবে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।
অপর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে শওকত আলী ওয়ারেসি বলেন, রোজায় ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেওয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিছে। খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়ে দেখা গেল কয়েকটি দোকানে দাম অনেক বেশি। খুচরা দোকানদাররা বলল, পাইকারি বাজার থেকেই বেশি দামে কিনছে তারা। রিসিটও দিল। তখন আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মিটিং ডাকলাম। সেখানে র্যাব, পুলিশ এনএসআইয়ের কর্মকর্তারাও থাকলেন। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো আট-১০ জন পাইকারি ব্যবসায়ীকে ওই দিনই গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশ আমাদের জানাল, তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আটক হবেন। কিন্তু হলো না। ঘণ্টা দুই পরে পুলিশ জানাল দাম বাড়ানো ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারে মন্ত্রী নিজেই নিষেধ করেছেন।
জন্মদিন আসত না অনেক শিশুর চল্লিশেই বুড়ো হতো বাংলাদেশিরা
স্বাধীনতার সময়কার চিকিৎসাসেবার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক মো. শাহজাহান বলেন, আগে গ্রাম এলাকায় পাস করা ডাক্তার ছিল না। এসএসসি পাস করার পর কয়েক মাসের কোর্স করা লোকরাই চিকিৎসা করত। তাদের ন্যাশনাল পাস ডাক্তার বলা হতো। আল্লাহর ওপর ভরসা করে চিকিৎসা চলত। তবে হাসপাতালে যেতে পারলে ভালো চিকিৎসা
হতো। সদর হাসপাতাল ছাড়া কোনো হাসপাতালই ছিল না। ইউনিয়নে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি থাকত।
তখন চিকিৎসা প্রায় পুরোপুরিই কবিরাজনির্ভর ছিল। দু-একজন হোমিও ডাক্তার ছিল। একেকজনের ১০-১২টা করে বাচ্চা হতো। প্রায় অর্ধেক শিশু আঁতুড়ঘরেই মারা যেত। স্বাস্থ্যজ্ঞানের অভাব ছিল। এখন তো আঁতুড়ঘর নেই। অনেকে আঁতুড়ঘর শব্দটিই জানে না।
‘আঁতুড়ঘর এমন একটা ঘর, যেখানে কোনোমতে একজন মানুষ ঢোকার মতো চিকন দরজা থাকে। কোনো জানালা থাকে না। ঘরটি হয় বাড়ির সবচেয়ে খারাপ ঘর। ঘরে কোন আলো বাতাস ঢুকে না। আগের দিনে হারিকেনও ছিল না। নবজাতক জন্মের পর কাঠ-গোবর পুড়িয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করে ঘর গরম রাখা হতো। তার মধ্যে থেকে অনেক নবজাতক সাতদিনের মধ্যেই মারা যেত। ধাত্রী হতো মুচিদের স্ত্রী, নাড়িও কাটত তারা। বাঁশের বেত দিয়ে কাটত। সেখানে ইনফেকশন হতো, ঘা হতো। বাচ্চারা কাঁদত। তখন কবিরাজ ডেকে আনা হতো। তেল পড়া, পানি পড়া দিয়ে কবিরাজ বলত, বাচ্চাকে ভুতে ধরেছে। এভাবেই কয়েকদিন পর মারা যেত। অনেক শিশুর জন্মদিনই আসত না। অর্থাৎ, জন্মের এক বছরের মধ্যেই অনেক শিশু মারা যেত’ যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক শাহজাহান বলেন, আগে কারো জ্বর হলে কবিরাজের কাছে যেত। কবিরাজ ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিত। সাগু আর বার্লি খেতে বলত। তাতে রোগী আরো কঙ্কাল হয়ে যেত। এমনকি ডায়রিয়া হলেও খাওয়ানো বন্ধ করে দিত। এভাবেই মানুষ মারা যেত।
তিনি বলেন, এখন তো ইউনিয়ন পর্যায়েও হাসপাতাল হয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে চিকিৎসাজ্ঞানও বেড়েছে। ফলে এখন শিশু মৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুহার কমেছে। তবে অন্য দেশগুলো চিকিৎসাসেবায় যতটা এগিয়েছে, বাংলাদেশ তা পারেনি। ফলে এখনো বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রোগীর বিদেশে যেয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ৪৭ বছরে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার অনেকটাই কমেছে। ১৯৭১ সালে ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার ছিল ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ জনে ২৩ জন শিশু ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যেত। ২০১৭ সালে তা কমে ৩.২ শতাংশে নেমেছে। মাতৃমৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
যেসব শিশু কৈশোর পেরিয়ে যৌবন পার করে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যেত, তাদেরও আয়ু ছিল গড়ে ৫০ বছর। স্বাধীনতার পর ৪০ বছর বয়স হলেই বৃদ্ধ হয়ে যেত বাংলাদেশের মানুষ। অপুষ্টি এবং অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন বেশিদূর টেনে নিতে পারত না বাংলাদেশিরা। স্বাস্থ্যসেবাও ছিল মারাত্মক অপ্রতুল। সে পরিস্থিতি পাল্টেছে। এখন ৪০ বছর বয়সেও তারুণ্যের ছাপ বাংলাদেশিদের চেহারায়। দশক দশক ব্যবধানে আয়ু বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৭২.৮ বছর। বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান এই গড় আয়ু পাকিস্তান, ভারতের চেয়েও বেশি।
জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী ও ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলাম বলনে, বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রসারের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৩১ শয্যার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গড়ার পাশাপাশি গুটিবসন্তনির্ভর যক্ষা এবং ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সরকার মনোনিবেশ করে। ১৯৭৬ সালের জনসংখ্যা নীতি; অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনগণের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি স্বাস্থ্য উন্নয়নে অবদান রেখেছে। খাবার স্যালাইন, ঘরে ঘরে গিয়ে পরিবার পরিকল্পনার সেবা পৌঁছানোর কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম, যক্ষারোগীকে চোখের সামনে ওষুধ খাইয়ে দেওয়া, খোলা মাঠে পায়খানা বন্ধ, কমিউনিটি লেড টোটাল স্যানিটেশনÑএসবই বাংলাদেশে উদ্ভাবিত; যা পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, সাফল্যের এসকল পালক মাথায় নিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংক্রান্তসহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে গিয়ে আমরা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। এসডিজি অর্জনে বাকি আছে আর মাত্র ১২ বছর; কিন্তু এখনো আমরা সবগুলো সুচকের পরিমাপের বেজলাইন-ই করতে পারিনি। অপুষ্টি কমানোর ক্ষেত্রে আমাদের শৈথিল্য; মাতৃ মৃত্যুহার স্থির হয়ে থাকা এবং সর্বোপরি সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তেমন কোনো অর্জন দেখাতে না পারা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসনের অভাব এবং ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নানা রকম কর্মসূচির অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
খায়রুল ইসলাম বলেন, আগামী দিনে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নজর দিতে হবে। ধারণাটি এরকম যে প্রতিটি নাগরিক তার স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে মানসম্মত সেবা পাবে এবং এই সেবা পেতে গিয়ে তাকে যেন কোনো রকম অর্থ কষ্টে পড়তে না হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে নাগরিককে যেন ধার-কর্জ করতে না হয়, ঘটিবাটি বিক্রি করতে না হয়। অন্যদিকে একজন ধনী যে মানের সেবা পাবে, একজন সাধারণ নাগরিকও সে মানের সেবা পাবার অধিকার রাখবেন। কাজেই সরকারকে এমন একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার আয়োজন করতে হবে, যেখানে সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান একটি সুশৃঙ্খল সেবাদান ব্যবস্থার আওতায় থাকবে, যেখান থেকে নাগরিকরা সুশৃঙ্খলভাবে মানসম্মত সেবা পাবে।
দুর্ভিক্ষের দেশ এখন চাল দাতা
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ পরপর চারটি শস্য উৎপাদনে মার খায়। ১৯৭১-৭২ সালে আমন উৎপাদন ১৯৬৯-৭০-এর তুলনায় ১৯ শতাংশ কম হয়। প্রয়োজনীয় বীজ, সার, উপকরণের অভাবে বাহাত্তরে বোরো উৎপাদন আগের বছরের চেয়েও ২০ কমে যায়। বাহাত্তর-তেহাত্তরে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম খরায় আউশ ও আমন উৎপাদন মার খায়। ১৯৬৯-৭০ সালে যেখানে ২৯.৬৩ লাখ টন আউস হয়েছিল, বাহাত্তর-তেহাত্তরে তা নামে ২২.৭৩ লাখ টনে। ফলে খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে লবণ, তেলসহ অন্য নিত্যপণ্যের দামও। বিশ্ববাজারেও ওই সময় খাদ্যপণ্য সংকট দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যসহ তেলের দর বেড়ে যায়।
অন্যদিকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ফলে সরকার চেষ্টা করেও প্রয়োজনমতো খাদ্যপণ্য আমদানি করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৩-৭৪ এর অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় বাজারে টাকার সরবরাহও অনেক বেড়ে যায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে দেশে যেখানে মুদ্রার সরবরাহ ছিল ৩৭৮.৫০ কোটি টাকা, তেহাত্তরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯৬ কোটি টাকা। পরের বছর জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৮১৬.৬০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সরকার কলকারখানার শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়ে দেয়। একদিকে খাদ্য সংকট, অন্যদিকে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ায় জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশের প্রথম তিন অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২-এর মার্চে প্রতি সের চালের দাম ছিল ১ টাকা ৪৬ পয়সা। চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের মার্চে তার দাম হয় ৬ টাকা ৬২ পয়সা। ৯৮ পয়সা সেরের গম কিনতে হতো ৫ টাকা ৮২ পয়সা দরে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় লবণের সের ৩৫ টাকায় ওঠে, যেখানে বাহাত্তরের শুরুতে প্রতি সেরের দাম ছিল ৫০ পয়সারও কম।
কেবল উৎপাদন কম হওয়ার কারণেই যে দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছে, তা মনে করেননি তখনকার সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখনকার অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছিল। ফলে ওই সময় সরকার ১০০ টাকার নোট বাতিল করে। টাকার মানও কমানো হয়। ১৯৭৪-৭৫ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়, আমদানি করা জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে, সেজন্য আমদানির লাইসেন্স ফি তুলে নেওয়া হয় এবং নিত্যপণ্যের আমদানি কর কমানো হয়। এসব উদ্যোগ নেওয়ার ফলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি থেকে জিনিসপত্রের দাম কমতে থাকে।
ওই সময়কার বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার পেছনে কেবল উৎপাদনের স্বল্পতাই কারণ ছিল না। চোরাকারবারি, মজুদদারিও এ জন্য দায়ী। এ ছাড়া ওই সময় বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য ভারতেও পাচার হতে থাকে। তা সত্ত্বেও দেশের স্বল্প বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো, যুদ্ধে সড়ক সেতু ও রেলসেতুগুলো ধ্বংস হওয়ায় তা সারা দেশে পৌঁছানো যায়নি।
যুদ্ধে ২৮৭টি রেলওয়ে সেতু কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেল লাইনগুলো উপড়ে ফেলা হয়েছিল। সড়কগুলোর সেতুও পুনর্নিমাণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর চার-পাঁচ মাসের মধ্যে তার কিছুটা মেরামত করা হয়। চারটি প্রধান রেলওয়ে সেতুই মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা বাংলাদেশের রেল যোগাযোগকে কার্যত অচল করে দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগে ব্যবহৃত এবং মোংলা বন্দরের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ স্থাপনকারী পদ্মা নদীর ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, তিস্তা ব্রিজ, ময়মনসিংহ সেতু ও মেঘনা নদীর ওপর থাকা তখনকার কিং জর্জ সিক্স সেতু। এসব সেতু দেশের দুই বন্দরের সঙ্গে সারা দেশের সংযোগ ঘটিয়ে খাদ্যপণ্য সরবরাহে সহায়ক হতো। এসব সেতু মেরামতে বড় ধরনের প্রকৌশল কর্মযজ্ঞের দরকার হয়ে পড়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালু করে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় ভারত, যা ১৯৭২ সালের শেষ দিকে সিঙ্গেল ট্র্যাক স্পেন বসিয়ে চালু করা সম্ভব হয়। ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে মেঘনা সেতু ও ময়মনসিংহ সেতু মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করা হয়।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অস্টিন রবিনসন ১৯৭২ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সফরকালে চট্টগ্রাম বন্দরে যান। তিনি দেখেন যে, বন্দরে খুব দ্রুতই খাদ্যপণ্য পৌঁছোচ্ছে। কিন্তু সেগুলো বন্দর থেকে সারা দেশে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। বন্দরে আসা খাদ্যপণ্য ঠিকঠাক মতো পৌঁছাতে পারলে দেশে খাদ্য সংকট এতটা প্রকট হতো না।
রবিনসন বলেছেন, বাহাত্তরে বিশ্বজুড়েই খাদ্য উৎপাদন কমে যায়। ফলে নগদ টাকায় খাদ্যপণ্য কিনতে হয়। এ কারণে অন্য সব ধরনের কেনাকাটা বন্ধ রাখতে হয় সরকারকে। ফলে দেশে অন্য পণ্যের সংকট দেখা দেয়। তাতে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধ-পরবর্তী এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ইউরোপের দেশগুলো যেসব পদক্ষেপ নেয়, তা নেওয়ার সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ছিল না। আবার নিজস্ব অর্থায়নে যোগাযোগ অবকাঠামো পুনঃস্থাপন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ পুনর্গঠনও জরুরি হয়ে পড়ে। তখন কিছু দেশ সহায়তার আশ্বাসও দেয়। তবে বিপুল চাহিদার বাংলাদেশের সংকট মোকাবিলায় তা সামান্যই ভূমিকা রাখে।
জন্মকালেই দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদনে বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও কৃষিতে সরকারের প্রণোদনা। বর্তমানে দেশের মোট জমির ৬০ ভাগ সেচের আওতায় এসেছে। ফলে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। উচ্চ ফলনশীল ধানের আবির্ভাবও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছ। বন্যা, খরা, লবণাক্ত তা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। খাদ্য সংকটের দেশ বাংলাদেশ এখন ধান ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে। ২০১৫ সালের মে মাসে বাংলাবান্ধা বন্দর দিয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প কবলিত নেপালে ১০ হাজার টন চাল অনুদান হিসেবে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য হাওরে বন্যা ও ব্লাস্টরোগে উৎপাদন কম হওয়ায় গত বছর আবার আমদানিও করতে হয়েছে।
কেবল খাদ্যশস্য উৎপাদনই নয়, মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে।
ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বদরুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত তিন দশকে দেশে যদিও জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে আরো বেশি হারে; প্রায় তিনগুণ। এতে আত্মপ্রসাদ লাভ করার কোনো কারণ নেই। কারণ খাদ্য নিরাপত্তা শুধু উদরপূর্তির মাধ্যমে পর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ নয়; এর সাথে জটিল অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জৈবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া জড়িত। সেসব ক্ষেত্রে এখনো অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এদের হার যথাক্রমে ছয় দশমিক দুই শতাংশ এবং চার দশমিক শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা আছে। সেটি অর্জনে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
শূন্য থেকে ৩১ বিলিয়ন ডলারে রিজার্ভ
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের সময় বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার কোনো মজুদ ছিল না। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রা যা ছিল, ১৬ ডিসেম্বরের আগে আগে তা নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারিতেও বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রাজকোষ ছিল পুরোই ফাঁকা। ওই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশি টাকায় মোটে ১৭ কোটি ২৬ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা জমে সরকারের কোষাগারে, যা তখনকার ডলারে মাত্র ২১ মিলিয়ন। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় মোটে ৯৬ কোটি টাকা। তারপর থেকে রেমিটেন্সের ওপর ভর করে বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়াতে পারেনি।
১৯৮১ সালে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ১২১ মিলিয়ন ডলার, পরের ১০ বছরে তা বেড়ে হয় ৮২৫ মিলিয়ন ডলারে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৩৮৬ ডলার। ২০১০ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য গত বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার কারণেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস পেয়েছে বাংলাদেশ।
কম রপ্তানি করে বেশি আমদানি করা বাংলাদেশের রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা প্রবাসীদের। কারণ, জন্ম থেকেই বাংলাদেশ রপ্তানির তুলনায় আমদানি করেছে অনেক বেশি। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ২৯৮ কোটি টাকা, আমদানি হয় ৭৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঘাটতি ছিল ৪৩৩ কোটি টাকা। এরপর যতই দিন গেছে, রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানিও। গত অর্থবছর আমদানি হয়েছে ৫৯ বিলিয়ন ডলারের, রপ্তানি হয়েছে ৩৭ বিলিয়ন ডলার।
নাতি-পুতির প্রশ্নের উত্তর দেবেন কি?
জন্ম নেওয়ার সময়ই অর্ধেক সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলছে বাংলাদেশের শিশুরা। ধনী দেশগুলোতে জন্ম নেওয়া শিশু বড় হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যতটা সফল হবে, বাংলাদেশে আজ জন্ম নেওয়া শিশু পড়ে থাকবে তার অর্ধেক দূরত্ব পেছনে।
বাংলাদেশে আজ যে কন্যাশিশুটি জন্ম নিচ্ছে, দেশের বিদ্যমান পুরো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা ভোগ করে যখন সে বড় হবে, তখন তার উৎপাদনশীলতা হবে ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখনো তার দেশের শিশুদের জন্য উপযুক্ত মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষম মানুষগুলো পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অভাবে অন্য দেশের মানুষের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, উৎপাদনক্ষমতা ও দক্ষতায় পিছিয়ে থাকবে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্সে (মানবসম্পদ সূচক) বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন তথ্যই রয়েছে।
কোনো দেশ তার শিশুদের জন্য সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করলে ওই দেশের স্কোর বা নম্বর ১ ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের স্কোর এ ক্ষেত্রে দশমিক ৪৮। অর্থাৎ শিশুদের জন্য সর্বোচ্চ যে মানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থাকা দরকার, বাংলাদেশে তার অর্ধেকও নেই।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে নেপাল দশমিক ৪৯ ও শ্রীলঙ্কা দশমিক ৫৮ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। এছাড়া ভারতের স্কোর দশমিক ৪৪, পাকিস্তানের দশমিক ৩৯ ও মিয়ানমারের দশমিক ৪৭। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ চীনের স্কোর দশমিক ৬৭।
বাংলাদেশের শিশুদের ৩৬ শতাংশই শরীরের প্রতি যতœশীল নয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর ফলে শারীরিক দুর্বলতা ও অক্ষমতা নিয়ে তাদের সারা জীবন বেঁচে থাকতে হয়।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আজ যে শিশুটি জন্ম নিল, তার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৩ শতাংশ শিশু পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা যাচ্ছে। আর যে শিশুটি ১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচল, ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সের মধ্যে বিভিন্ন রোগে তাদের ১৩ শতাংশই মারা যায়।
গত অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেন, প্রযুক্তির বিকাশ আগামী দিনে মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। অটোমেশন, রোবটের ব্যবহার বাড়লে একদিকে কাজ কমে যাবে, অন্যদিকে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। নয়া সেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে এখন থেকেই উপযুক্ত শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে নতুন প্রজন্মকে। না হলে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে টিকে থাকাই মুশকিল হবে নিজেদের।
জিম ইয়ং কিম বলেন, প্রযুক্তি যদি প্রত্যাশা বাড়ায় এবং কাজের ধরন পাল্টে দেয়, আমাদের অবশ্যই কিছু কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। মানুষ তাহলে কী করবে? কীভাবে তারা তাদের পরিবারের খরচ মেটাবে? জটিল বিশ্ব ব্যবস্থায় মানুষ কীভাবে তার স্বপ্ন পূরণ করবে?
‘উত্তর একটিই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। জনগণের জন্য সরকারগুলোর উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষ যাতে তার সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগাতে পারে, সেজন্য উপযুক্ত শিক্ষা, দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
‘আমাদের নাতি-পুতিরা যখন প্রশ্ন করবে তুমি যখন জানলে দুনিয়া আমার জন্য খুবই কঠিন হবে, তখন আমার ভালোর জন্য তুমি কী করেছিলে? তুমি যখন দেখলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের মধ্য দিয়েই পুরো দেশের কোটি মানুষের উন্নয়ন সম্ভব ছিল, তখন তুমি আমার জন্য কী করেছ? এখনই প্রস্তুতি না নিলে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কিছু থাকবে না’Ñ সতর্ক করে দেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট।
থ্রিজি সুবিধা সম্প্রসারণের পর বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত দেশের মোট ৮ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫২.২০%। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে মোবাইলে টেলিমেডিসিন সেবা, ই-কমার্সসহ নানা সেবার ব্যবহার বাড়ছে।
শেয়ার করুন
রূপান্তর ডেস্ক | ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উড়াল দিতে ডানা মেলছে বাংলাদেশ। জন্মকালে বিশে^র ১০ গরিবের তালিকায় থাকা বাংলাদেশ এখন মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপির আকারে ৪২তম বড় অর্থনীতি। আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে আরো বড় অর্থনীতির দেশ ভারতকেও পেছনে ফেলা বাংলাদেশ এখন বিশে^র নানা প্রান্তে উজ্জ্বল উদাহরণ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ বলছে, রূপান্তরের এই যাত্রায় গতিশীল বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যেই বিশে^র ২৬তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আশা প্রকাশ করেছেন, ২০৫০ সালে ২০তম অর্থনীতি হবে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ টিকবে তো?
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সামনে ঘোরতর অন্ধকার দেখছিলেন বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদরা। তাদের মধ্যে একটি প্রশ্নই ঘুরে-ফিরে আসছিলÑ বাংলাদেশ কি টিকে থাকতে পারবে? ১৯৭৬ সালে এ প্রশ্ন তুলে বই লিখেছিলেন নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ড. জাস্ট ফালান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জ্যাক আর পারকিনসন। কেবল এ দুজনই নয়, স্বাধীনতার পর তাবৎ দুনিয়ার অর্থনীতিবিদদের মধ্যেই এ প্রশ্ন জেগেছিল। ‘বাংলাদেশ : এ টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ বইয়ে লেখকদ্বয় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারে, তাহলে দুনিয়ার যেকোনো দেশই উন্নত হতে পারবে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে তৎকালীন প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিয়ে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম এই দেশে তখন খাবার নেই, বাড়ি নেই, পরিবহন নেই, শিল্প নেই। পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ে ৯০ ভাগ আসা পাটকলগুলোও ধ্বংস করা হয়। জাতিসংঘের তখনকার এক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে টাইম ম্যাগাজিন জানায়, ৪৬ লাখ ১৭ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিক ধ্বংস হয়।
প্রায় ১৪ লাখ পরিবার তাদের ঘরবাড়ি, গবাদি পশু ও জমি ফেলে রেখে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছাড়ে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা থেকে ১০ লাখ বাংলাদেশে ফিরে আসে। ফেরত আসার সময় ক্যাম্প থেকে পরিবারগুলোকে এক সেট করে সিসার হাঁড়িÑপাতিল, কিছু তেল, চারকোল, একটি করে চকলেট এবং ৫০ সেন্ট মূল্যের চাল ও খাদ্যশস্য দেওয়া হতো।
স্বাধীনতার পরপরই পরিকল্পনা কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ১৯৬৯-৭০ সালের পর্যায়ে ফিরিয়ে নিতে হলে ৩০০ কোটি ডলার দরকার। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ছিল ৭০ ডলার। এ পরিমাণ আয় নিয়ে বিশ্বের ১০-১২টি গরিব দেশের তালিকায় জায়গা হয় বাংলাদেশের। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত আমন চাষ, যুদ্ধে বিলীন ঘর-বাড়ি, শূন্য হাতে ভারত থেকে ফেরা উদ্বাস্তু, ফাঁকা রাজকোষসহ নানা সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশ তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিয়ে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার অর্থনীতিবিদ প্রফেসর হলিস বি চেনারিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মানসম্পন্ন (স্ট্যান্ডার্ড) মাথাপিছু আয়ের তালিকায় যেতে বাংলাদেশের কতদিন লাগবে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ১৯৬৫ সালকে মূল্যভিত্তি ধরে মাথাপিছু ৮০০ ডলার বা ১৯৭৩ সালকে মূল্যভিত্তি ধরে মাথাপিছু ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে বাংলাদেশের ১২৫ বছর লাগবে, যদি প্রতিবছর ২ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বাড়ে। ৩ শতাংশ হারে বাড়লে লাগবে ৯০ বছর।
না টিকলে কি হবে?
১৯৭২ সালে দুই মাস বাংলাদেশ ঘুরে দেখা যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অস্টিন রবিনসন ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও সম্ভাবনা দেখেছিলেন। সদ্যোজাত বাংলাদেশের সার্বিক বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ‘ইকোনমিক প্রসপেক্টাস অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণা করেন। ১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বরে লন্ডনের ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (ওডিআই) থেকে প্রকাশিত ওই গবেষণায় জনসংখ্যার উচ্চ বৃদ্ধির হারে বিশ্বে পরিচিত বাংলাদেশ সম্পর্কে তখন তিনি বলেছেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়েও দ্রুতহারে উন্নতি করবে বাংলাদেশ।’
ওডিআই থেকে প্রকাশিত ‘দি আউটলুক ফর বাংলাদেশ’ চ্যাপ্টারে রবিনসন বলেন, ‘একটি প্রশ্নই বারবার তোলা হচ্ছে, বাংলাদেশ টিকবে তো? একজন অর্থনীতিবিদের কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। টিকে না থাকলে কী হবে? মৃত্যু? কোনদিন কোন রাষ্ট্রের কী মৃত্যু হয়েছে?......বাংলাদেশ এখন পাঠ্যপুস্তকে মালথ্যাসের জনসংখ্যাতত্ত্বের আলোচনায় উপযুক্ত উদাহরণ। তবে স্থানীয় সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার করা গেলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়েও উচ্চহারে উন্নতি করবে বাংলাদেশ।’
অস্টিন রবিনসনের ভাবনা বাংলাদেশে বাস্তব হয়ে ফিরে এসেছে। ১৯৭৪ সালে করা বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.৪৮ শতাংশ, বর্তমানে তা কমে ১ শতাংশে নেমেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন ৭.৮৬ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছর শেষে ৮ শতাংশে পৌঁছাবে বলে দেশ রূপান্তকে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বাংলাদেশ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে, সামাজিক বিভিন্ন সূচকে ভারতের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তবে এই অর্জনের মধ্যেও স্বস্তি দেখছেন না অনেকে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ষাটের দশকে মালয়েশিয়ার অর্থনীতির চেয়েও সবল ছিল বাংলাদেশ। দুর্বল মালয়েশিয়া অনেক দূর এগিয়েছে, অনেক পেছনে পরে হাঁটছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না হওয়ার জন্য রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের অভাবকে দায়ী করছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান। ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ গ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি শুরু করেছেন এভাবে, ‘উইনস্টন চার্চিলের ভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশ একটি রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেয়ালি।
একদিকে এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকট অপ্রতুলতা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে; অন্যদিকে সুশাসনে নিশ্চিত অবক্ষয় ঘটেছে। বাংলাদেশের অনেক অর্জনের জন্য আমি গর্বিত। তবু রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের ক্রমাগত অধোগতি আমার প্রজন্মের যারা আমার মতো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের জন্য দৈহিক যন্ত্রণার চেয়েও মর্মান্তিক মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে।’
ধৈর্য ধরার আহ্বান ছিল বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনের শূন্য রাজকোষ আর বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়াই ভঙ্গুর অবকাঠামো, খাদ্যসংকট মোকাবিলাসহ পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়নে হিমশিম খেতে থাকে সরকার। তবুও তারা ভেঙে পড়েননি, জাতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ।
‘আমরা যে সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গঠনের চেষ্টা করছি, তার জন্য আমাদেরকে আজ কষ্ট স্বীকার করতে হবে; যাতে আগামীকাল আমাদের সন্তানের কষ্ট আমরা লাঘব করতে পারি’ ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ঘোষণাকালে তখনকার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এভাবেই যুদ্ধবিধ্বস্তবাংলাদেশের মানুষের সামনে রূঢ় বাস্তবতা ও আগামীর স্বপ্ন তুলে ধরেছিলেন। তার কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আগামী তিন বছর আপনাদের কিছু দিতে পারব না।’
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ যখন এই বাস্তবতা তুলে ধরলেন, তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নিজেই যেন বাস্তুহারা। পাকিস্তানি সেনারা শেষমুহূর্তে পুড়িয়ে গেছে টাকা-পয়সা, শিল্প-কারখানা। সেতু, কালভার্ট, বন্দর, জাহাজ সবই ধ্বংস করে গেছে তারা। ভারত থেকে ফেরা প্রায় কোটিখানেক মানুষ খালি হাতে ফিরেছে বাংলাদেশে। তাদের থাকার ঘর নেই, চাষাবাদের গরু-ছাগল নেই, মাটিতে বোনার মতো বীজও নেই।
‘বাংলাদেশ : মুজিবস রোড ফ্রম প্রিজন টু পাওয়ার’ শিরোনামে ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ৬০ লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে অর্থ সরাতে শুরু করে। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ১১৭ রুপি বা ১৬ ডলার রেখে পুরোটা সরিয়ে ফেলে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও কয়েনগুলো ধ্বংস করতে থাকে। স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ নগদ অর্থের সংকটে পড়ে। রাস্তা থেকে প্রাইভেট কারগুলো অটো ডিলারের দোকান ঘুরে পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দরে যেতে থাকে।
ওই সময়কার কথা স্মরণ করে বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মী আবদুল মালেক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগে পাঞ্জাবিরা বস্তায় বস্তায় টাকা পোড়াইছে। আমার চোখের সামনেই অনেক টাকা, ধনসম্পদ পোড়াইতে দেখছি। আমাকে ওরা তখন কয়েক বস্তা টাকা নিতেও বলেছিল। কিন্তু আমি নেই নাই। আমি ভয়ে রাজি হই নাই। স্বাধীনতার পরে সরকার যদি আমাকে ধরে বলে তুমি এত টাকা কোথায় পেলে? ’

মনমরা হতে মানা করেছিলেন অর্থ সচিব
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার চিত্র মেলে ১৯৭৩-এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত দেশের প্রথম অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। তাতে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তেহাত্তরের জুন পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার দেড় বছরেও যে ভঙ্গুর অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি, তা স্পষ্ট বোঝা যায় তখনকার অর্থসচিব কে মাহমুদের কথায়। দেশের প্রথম অর্থনৈতিক সমীক্ষার ভূমিকায় তিনি বলেছেন, ‘১৯৭৩-এর জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর আগের সর্বশেষ স্বাভাবিক অর্থবছর হিসেবে ১৯৬৯-৭০-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন প্রচেষ্টা সত্ত্বে¡ও দেখা যাবে যে ১৯৭৩-এর জুন শেষে আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ১৯৬৯-৭০-এর পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি।’
‘আমি অবশ্যই বলছি যে, এটি বাংলাদেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র নয়। যদিও বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ১৯৬৯-৭০-এর সময়কার মতো উজ্জ্বল নয়; এটিও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশকে শুরু করতে হয়েছে। অতীত পারফরমেন্স নিয়ে আমাদের মনমরা হলে চলবে না। অদূর ভবিষ্যতে সকল খাতে আরো উজ্জ্বল সক্ষমতার সঙ্গে অনেক বেশি অর্জন হবে আমাদের’Ñএভাবেই হতাশা দূরে ঠেলে নতুন স্বপ্ন দেখতে জাতিকে অনুরোধ করেন দেশের প্রথম অর্থসচিব।
কয়েক ইঞ্চি কাগজ চিন্তায় ফেলে বান কি মুনকে
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন তখন তরুণ কূটনীতিক। দক্ষিণ কোরিয়ার দিল্লি মিশনে কর্মরত তিনি। দেশ স্বাধীনের পর বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা আসেন তিনি। দিল্লিø থেকে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে ধ্বংসস্তূপ ঠেলে রিকশায় চড়ে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসলেন। ঢাকার এশিয়া বিভাগের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক শেষে তার নাম আর ঢাকার টেলিফোন নম্বরটা চাইলেন, যাতে পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ করা যায়। ঢাকার ওই কর্মকর্তার কোনো ভিজিটিং কার্ড ছিল না।
ওই কর্মকর্তা সযত্নে টেবিলের একপাশে রাখা একটা এফোর সাইজের কাগজ সাবধানে হাতে তুলে নিয়ে তার এক কোনায় অনেক ছোট করে নাম আর টেলিফোন নম্বর লিখে শুধু সেই অংশটুকু ছিঁড়ে বান কি মুনের হাতে দেন। রিকশায় চড়ে আবার বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় বান কি মুন মনে মনে ভাবছিলেন বাংলাদেশি কর্মকর্তার সামান্য একটা সাদা কাগজ বাঁচানোর চেষ্টার কথা এবং নিশ্চিত হয়েছিলেন এই জাতি এক সময় নিজের পায়ে দাঁড়াবেই।
১৯৭৩ সালে তিনি আবার দিল্লির কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা এসেছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় রাষ্ট্রদূতের কলমটা কাজ করছিল না। তখন বান কি মুন তার কলমটা এগিয়ে দিয়েছিলেন চুক্তিটা স্বাক্ষর করার জন্য। সেই কলমটি এখনো সংরক্ষণ করে রেখেছেন বান কি মুন।
২০১৬ সালের এপ্রিলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম নিজের ফেসবুকে এ ঘটনার উল্লেখ করে বলেছেন, জেনেভায় খাওয়ার টেবিলে বসে মুনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন কলমটি এখনো সংরক্ষণে রেখেছেন তিনি? ‘উত্তর আসল, ১৯৭২-এর প্রথম সফর তাকে প্রচ- নাড়া দিয়েছিল। আর নতুন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষণের সাক্ষী থাকার অভিজ্ঞতা তো একজন কূটনীতিকের জীবনে বারবার আসে না’ যোগ করেন তিনি।
২০১১ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে বাংলাদেশ সফরে আসেন বান কি মুন। সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে তিনি বলেন, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি গতিশীল অর্থনীতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ শুধুমাত্র উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রেই অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে না, উন্নয়ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
টিকে থাকা নিয়ে যার সংশয়, সেই বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে তিনটি বিশ্বের প্রথম দেশ থেকে তিনটি সূচকেই অগ্রগতি অর্জন করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর ৪৭ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার চার হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২২ লাখ ৫০ হাজার কোটিতে উন্নীত হয়েছে। চলতি অর্থবছর শেষে আকার ৩০ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রতি দশকে ১ শতাংশ হারে বেড়েছে বাংলাদেশের। বর্তমানে ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
সরকারের বিভিন্ন পদে থাকার পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী হিসেবে এরশাদ সরকার ও বর্তমান সরকারের মেয়াদে ১২ বছর দায়িত্ব পালনের সময়কালে তার সেরা মুহূর্ত কোনটি, দেশ রূপান্তরের এমন প্রশ্নের উত্তরে সেকেন্ডের মধ্যেই মুহিত বলেন, অবশ্যই জাতিসংঘের কাছ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ পাওয়ার মুহূর্ত। ২০২৪ সালেই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাবে।
দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণা করে মুহিত বলেন, আগে বিদেশিদের সঙ্গে মিটিং করা মানেই নিজেকে ছোট করার মতো ছিল। কারো সঙ্গে দেখা করা, কথা বলা মানেই বাংলাদেশের জন্য সহযোগিতা চাওয়ার ব্যাপার ছিল। এখন আর সে অবস্থা নেই। গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সাধারণ সভাকালে বালিতে অর্থমন্ত্রী কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ যেকোনো দেশকে যে কোনো ধরনের সহায়তা দেবে বলে ঘোষণা দিয়ে আসেন মুহিত। এ প্রসঙ্গ তুলে ধরে মুহিত বলেন, এখন অন্যদের সাহায্য করার কথা বলতে ভালো লাগে।
কার লাভ, কার ক্ষতি?
আগে ১ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে ব্যাগ ভরে বাজার নিয়ে আসা যেত। এখন ৫০০ টাকা নিয়ে গেলেও বাজারের ব্যাগ ভরে না ৮২ বছর বয়সী আবদুল মালেকের। ঢাকায় ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি করেন ৬৫ বছর বয়সী মফিজ মিয়া বলেন। তিনি বলেন, আগে ৫ ট্যাকা লইয়া মেলায় গেছি। মাটির বড় তৌল (পাতিল) কিনছি, মাত্র দুই পয়সা দিয়া। চার কেজি জিলাপি কিনছি মাত্র ১ টেহা দিয়া। চার আনা কেজি আছিল। দুই কেজি খই কিনছি চার আনা দিয়া। ৭ টাকা ৮ টাকা দিয়া পেন্ডনের কাপড় কিনছি। এখন ৫ হাজার ট্যাকা দিয়াও ভালো কাপড় পাওয়া যায় না। কি দিন গেছে আর কি দিন আসছে? ৫০০ ট্যাহা লইয়া বাজারে গেলে থলির তলায় পইড়া থাহে বাজার।’
বয়স্ক মানুষদের বেশির ভাগই প্রশ্ন টাকার দাম এতো কমছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশি মুদ্রা চালু হলেও আগের বছর পাকিস্তানি রূপির যে মান ছিল, টাকাও একই মান পায়। তখন ১ ডলার কিনতে ৭ টাকা ৮৬ পয়সা লাগত। তারপর থেকেই ১৯৮৭ সাল পর্যন্তপ্রতিবছর টাকার দাম কমতে লাগল। এই ১৬ বছরের মধ্যে ১৯৭৮ সালেই কেবল টাকার দাম কমেনি। স্বাধীনতার পর টাকার দাম কমানোর ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির কাছ থেকে ১৯৭৪ ঋণ সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে টাকার অবমূল্যায়নের শর্ত দেয় সংস্থাটি। শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইএমএফের শর্ত মেনে সহায়তা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য তা গ্রহণ করতে হয়। ১৯৭৫ সালে সরকার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে টাকার মূল্য ৫৬ শতাংশ কমিয়ে দেয়। একাত্তরে যেখানে ১ ডলারে ৭ টাকা ৮৬ পয়সা পাওয়া যেত, পরের ১০ বছরেই ১ ডলার কিনতে ১৮ টাকা ৩১ পয়সা লাগত। অর্থাৎ, স্বাধীনতার সময় যে পণ্য কিনতে ৭ টাকা ৮৬ পয়সা লাগত, ১৯৮১ সালে ওই পণ্যের দাম না বাড়লেও কিনতে হতো ১৮ টাকা ৩১ পয়সা দিয়ে।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে টাকার দাম আরো অর্ধেক কমে যায়। কারণ, ওই সময় বিপুল পরিমাণ পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি হতে থাকে। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি হচ্ছিল না। ফলে দেশ বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়ে। তখন আমদানি কমাতে সরকার টাকার মূল্যমান আরো ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। তবে ১৯৮৫ থেকে পরের দুই বছর টাকার মান ডলারের বিপরীতে ১২ শতাংশ বাড়ে। তা সত্ত্বেও ১৯৮৭ সালে ৩১ টাকা দিয়ে ১ ডলার পাওয়া যায়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ টাকায়। বর্তমানে ১ ডলার কিনতে ৮৪-৮৬ টাকা দরকার হয়।
কোনো পণ্যের বাজারদর নির্ভর করে ওই পণ্য আমদানিতে কত টাকা খরচ হয় তার ওপর। ধরা যাক, ১৯৭১ সালে বিদেশ থেকে ১ ডলারে যে পণ্য কেনা হতো, বাংলাদেশে ওই পণ্যের দাম হতো ৭ টাকা ৮৬ পয়সা। এখন বিদেশে ওই পণ্যের দাম ১ ডলার হলেও বাংলাদেশে তা কিনতে লাগবে ৮৪-৮৬ টাকা। এছাড়া, পণ্যটি আমদানি করতে, স্থানীয় বাজারে বিপণন করতে যদি আরো ১ ডলার খরচ হয়, সেটি ধরলে ১৯৭১ সালে যে পণ্যের দাম ১৫-১৬ টাকা হতো, শুধু টাকার দাম কমার কারণেই তার দাম এখন ১৭০ টাকার বেশি।
টাকার দাম কমলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসী শ্রমিকদের লাভ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। ২০১৫ সালে একজন বাংলাদেশ থেকে একটি তৈরি পোশাক যুক্ত রাষ্ট্রে ১ ডলারে রপ্তানি হলে রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী পেতেন ৭৭ টাকা। এখন একই পোশাক ১ ডলারে রপ্তানি হলে তিনি পাচ্ছেন ৮৪ টাকার বেশি। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে ১ লিটার সয়াবিন তেল আমদানি করতে যদি ১ ডলার লাগতো, তখন ওই তেল কিনতে খরচ হতো ৭৭ টাকা, এখন ৮৪ টাকার বেশি। সে কারণেই তৈরি পোশাক শিল্পমালিকরা প্রায়শই টাকার দাম কমানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ দেয়।

‘পপুলার ইকোনমিকস অনপপুলার এসেস’ গ্রন্থে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, টাকার অবমূল্যায়ন হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় যে ধারণাটি হয়, তা হলো সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। বছরে টাকার মান ৫ শতাংশ হারে কমছে তা মূল্যস্ফীতি হিসেবে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলতে পারেন যে, টাকার মূল্যমান কী হবে, তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাজারই এটা নির্ধারণ করে। তাহলে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে, বাজারে সব সময় ডলারের দামই বাড়বে কেন? টাকার দাম কেন কখনো বাড়বে না?
নীতিগতভাবে সরকার টাকার মান কেমন হবে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রামান বিবেচনায় নিয়ে টাকার মূল্যমান নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করে বলে দেশ রূপান্তকে বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
আগে মালয়েশিয়া থেকে পড়তে আসত, এখন আমরা যাই
স্বাধীনতার সময়ও স্কুল বলতে ছিল দুই-তিনটা গ্রামে একটা। খড়ের চালা, টিনের ঘর, জানালা নাই। লুঙ্গি পরে, খালি পায়ে শিক্ষকরা ক্লাসে আসতেন। গায়ে থাকত পাঞ্জাবি বা শার্ট। তবে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না। হাইস্কুলেও লুঙ্গি পরে, খালি পায়ে ক্লাস করত। টিফিন জিনিসটা কী, তা-ই কারো মাথায় ছিল না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. শাহজাহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কলেজে উঠে প্রথম প্যান্ট, পায়জামা পরলাম, শার্ট ইং করা শিখলাম। তখন দেশে প্রথম স্পন্সের স্যান্ডেল চালু হলো। দাম ৬-৭ টাকা। একজোড়া স্পন্সের স্যান্ডেল কিনতে হলে ৩-৪ মন ধান বিক্রি করতে হতো।’
তিনি বলেন, প্রাইভেট পড়ার প্রচলন ছিল না। কোচিং কী জিনিস, তা কারো জানাই ছিল না। যেসব ছাত্রদের অবস্থা খুবই ভালো, তারা কালেভদ্রে শিক্ষকদের কাছে যেয়ে পড়ত। আমরাও কোনো কিছু না বুঝলে শিক্ষকদের বাসায় যেয়ে বুঝে আসতাম। সে জন্য কোনো পয়সা দিতে হতো না।
‘পত্রিকায় রেজাল্ট বের হতো। ঢাকার পত্রিকা পরদিন জেলা শহরে পৌঁছাত। গ্রামে তো যেতই না। আমরা যখন এসএসসি পাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে তখন একটাই বোর্ড, ঢাকা বোর্ড। যেদিন রেজাল্ট হলো, পরদিন স্কুলে গেলাম। যেয়ে শুনি রেজাল্ট এখনো আসে নাই। কোনো পত্রিকাও আসে নাই। বিকেলের দিকে কেউ একজন একটা পত্রিকা নিয়ে আসল, সবাই তাকে ঘিরে ধরল। সে তখন পত্রিকা হাতে নিয়ে দিল দৌড়।’
‘আমরাও পেছনে দৌড়াতে লাগলাম। পরে সে একটা আমবাগানের উঁচু জায়গায় দাঁড়াল। সেখান থেকে সে সবার রোল নম্বর বা পাসের ডিভিশন বলতে লাগল। আমাদের সময় দু-চারজন ফার্স্ট ডিভিশন পেত। তাদের সবাই সম্মানের সঙ্গে দেখত। গল্প শুনেছি, আরো আগে কেউ মেট্রিক পাস করলে মানুষ গরুর গাড়িতে চড়ে তাকে দেখতে আসত অনেক দূর থেকে। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে শিক্ষার হার ছিল ২২ দশমিক ২ শতাংশ। এখন ৭২ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে বাড়ি বাড়ি এসএসসি পাস ও পাড়ায় পাড়ায় উচ্চশিক্ষিতরা রয়েছে। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দেশে স্মতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিল ২৩ হাজার ৭৩১ জন। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ৮ লাখ ২৩ হাজার ১০২ জন। ১৯৭০-৭১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ, যা এখন এক কোটি ৮৬ লাখে পৌঁছেছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষক, সারা দেশে গড়ে উঠেছে বিপুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে একটি প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে এসেছে, শিক্ষার মান বাড়ছে কি?
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার শিক্ষা সম্প্রসারণে সাধারণভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে মেয়েদের শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশে যেখানে নারী শিক্ষার হার ছিল একেবারেই কম, সেখানে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কন্যাশিশু ভর্তির হার ছেলেশিশু ভর্তির হারের চেয়েও বেড়েছে।
তেহাত্তরের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ঘোষণা দেয় যে, তারা সরকার গঠন করলে শিক্ষার মানোন্নয়নে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে। ইশতেহারে দলটি বলে যে, ‘জাতি হিসেবে জনসংখ্যার হিসেবে আমরা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা খুবই পশ্চাদপদ। বোধগম্য কারণে বিদেশি সরকারগুলো অতীতে এদেশে শিক্ষা বিস্তারের দিকে নজর দেয়নি। ফলে আজ বাংলাদেশে শিক্ষিত ও দক্ষ মানুষের অভাব আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে একটি মারাত্মক অসুবিধা বলে গণ্য হচ্ছে। সরকার বিষয়টির ওপর তীক্ষè নজর দিচ্ছে।’
সরকারি কলেজে শিক্ষকতাকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানের ফারাক স্বচক্ষে দেখেছেন অধ্যাপক শাহজাহান। স্মৃতিচারণা করেন, ‘শিক্ষার মান তখন ভালোই ছিল। নকলের প্রবণতা ছিলই না। হয়তো দু-একটা সেন্টারে একজন করে ধরা পড়ত। প্রশ্ন ফাঁসের চিন্তাই করা যায়নি। তখনকার শিক্ষার মান এখন চিন্তাই করা যায় না। এত অবক্ষয় হয়েছে, ভাবতেই কষ্ট লাগে।’
স্বাধীনতার পর নকলের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তখন নকলবাজদের রুদ্রমূর্তিতে শিক্ষকরা টিকতেই পারতেন না। একটি বিধিবদ্ধ সংস্থায় সদস্য হিসেবে থাকা একজন আমার সামনেই বই খুলে পরীক্ষা দিয়েছে। আমাদের আরেক ছাত্র থাকত ঢাকায়, কিন্তু পরীক্ষা দিত পাবনায়। অর্থাৎ, সে পরীক্ষা না দিয়েই পাবনা থেকে পাস করে গেছে। তবে একটা জিনিস স্বীকার করি, আগে ফাইভ-সিক্সের ছাত্ররা পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি সম্পর্কে তেমন কিছু জানত না। পুঁথিগত বিদ্যায় সীমাবদ্ধ ছিল। এখনকার ছোট শিক্ষার্থীরা বাইরের জ্ঞান বেশি জানে।
দেশে শিক্ষা বাড়লেও আদব-কায়দা, মানসম্মান দেওয়া কিংবা নৈতিকতার বালাই দেখছেন না অধ্যাপক শাহজাহান। ‘এখন দেখি গলায় গলায় বন্ধু, তারাই একজন আরেকজনকে পশুর মতো জবাই করছে। এরা কেউই তো অশিক্ষিত না। আগে আমরা শিক্ষকদের সামনে মুখ তুলে কথা বলতে পারতাম না। এখন তো শিক্ষকদের কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে। শিক্ষকরাও জান বাঁচানোর জন্য তা করছে। শিক্ষার্থীদের মতো শিক্ষকদেরও এখন অনেক অবক্ষয় হয়েছে। দামি কাপড়ের মধ্যে ময়লা ঘিঞ্জি ভরা এখনকার সবারই। অন্যায় করে পার পেয়ে যাচ্ছে, তাই অন্যায় করতে কেউ দ্বিধা করছে না’Ñবলেন তিনি।
প্রাইম ব্যাংকের কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান টিপু নিজের ও কন্যার সময়কার শিক্ষকদের তুলনা করে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ‘তখন আমি ক্লাস সিক্সে, হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় অঙ্কে পেলাম ২৭, ক্লাসে শিক্ষক এসে ঘোষণা দিলেন, যারা লেটার মার্কস পায়নি তাদের ১০০ থেকে যেত নম্বর কম পেয়েছ, ততটি বেত্রাঘাত করা হবে। আমার কপালে ৭৩টি বেত্রাঘাত জুটল। ক্লাসের সকল সহপাঠীর সামনে এমন মারে খুব শরম পেয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষা হতে এইচএসসি পর্যন্ত সবকটি পরীক্ষায় অঙ্কে লেটার মার্কস নিয়ে পাস করেছি।’
‘মেয়েটা আমার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে, একই কলেজ হতে এইচএসসির প্রিটেস্ট পরীক্ষায় সায়েন্সের সব কটি সাবজেক্টে খুব খারাপ করল। কলেজ থেকে যথারীতি আমাকে ডাকল। গিয়ে দেখি আমার মতো অনেক অভিভাবককে ডাকা হয়েছে এবং অভিভাবক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কী কী ইত্যাদি তুলে ধরলেন শিক্ষকরা। জবাবে আমি শুধু বললাম, যে মেয়ে আপনাদের এখান হতে জিপিএ ৫ পেয়েছে, সে মেয়ে এত খারাপ করল; আপনারা আপনাদের কোনো দায়িত্ব পালন করেছেন কি? কী পড়িয়েছেন যে এতগুলো ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় খারাপ করল? আপনাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছেন? উপস্থিত শিক্ষকগণ খুব ক্ষুব্ধ হলেন। এরপর মেয়েটি ওই কলেজে যতদিন ছিল, ততদিন ওকে শিক্ষকরা নানাভাবে অপদস্থ করেছে, টিপ্পনি কেটেছে, সেদিন আমি প্রতিবাদ করেছিলাম বলে। মেয়েটি আমার মুখ বুজে সহ্য করেছে। আমাকে আর বলেনি। এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার পর আমি জানতে পারি।’
বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তÑ অনেকেই তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে এসব শিক্ষার্থীদের এ লেভেল পাসের পর। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হেলালউদ্দিন। মেয়ে এ বছর এ লেভেল পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের সিলেবাসের সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কোনো মিল না থাকায় মেয়েকে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারছেন না।
শিক্ষা পদ্ধতির ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে টিটু বলেন, একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এভাবে চলতে পারে না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে পারছে না। কারণ, তাদের নাকি ওই ধরনের সিলেবাস নেই। অথচ এরাই ভারত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে পড়ছে। তাহলে মেধা পাচার হবে না কেন? বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি জানা শিক্ষার্থীদের এভাবে দেশত্যাগে বাধ্য করে বাংলাদেশ এগুতে পারবে না।
শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ হলেও শিক্ষার মান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। দেশ রূপান্তকে তিনি বলেন, স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। অথচ উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে যারা পড়ান তাদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। সব মেধাবী ছাত্র ভালো শিক্ষক হয় না। একজন মেধাবী ছাত্র হয়তো ভালো গবেষক হয় কিন্তু ভালো শিক্ষক হওয়া এতটা সহজ নয়। ভালো শিক্ষক হতে বাড়তি দক্ষতা লাগে, যা প্রশিক্ষণ ছাড়া অর্জন করা খুবই কঠিন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাংলাদেশ ছাড়া সব দেশেই আছে।
তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মান না হোক, এই উপমহাদেশীয় শিক্ষা মানে তো থাকা উচিত। কিন্তু সেটা করতেও হিমশিম খাচ্ছে। একসময় মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়তে আসত। কিন্তু এখন উল্টো প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী একই সময়ে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়।
ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, আর এক শ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তারা বিজ্ঞাপন দিয়েই সার্টিফিকেট বিক্রি করে। তাদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করলেই তারা হাইকোর্টে গিয়ে মামলা করে। আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আবার তারা কুকর্ম চালিয়ে যায়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশ রূপান্তকে বলেন, শিক্ষার মান খারাপ হয়েছে। এসব ফার্স্টক্লাস দিয়ে কিছু হবে না। বাংলাদেশে শিক্ষা পরিকল্পনা পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে।
ঢাকায় এসে বুঝলাম, সৃষ্টিকর্তা আছেন
৮২ বছর বয়সী আবদুল মালেক ১৯৬৩ সালে বিমানবাহিনীর সুপারভাইজার পদে যোগ দেন। ওই সময় ঢাকার কাফরুল থেকে বর্তমান বঙ্গভবনে সাইকেল চালিয়ে যেতেন তিনি। যানজট বলতে কিছুই ছিল না, এত মানুষ, দালান কোঠাও ছিল না। প্রগতি সরণির রাস্তাটি তখন ইট-সুরকি বিছানো সরু রাস্তা ছিল। ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে বিসিএস কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন বছর কয়েক আগে অবসরে যাওয়া শওকত আলী ওয়ারেসি। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, চাকরিতে যোগদান করে বন্ধুদের সঙ্গে চকবাজারের একটি মেসে থাকা শুরু করেন তিনি। তখন চকবাজার থেকে গুলিস্তান হয়ে রাজস্ব ভবনে আসতে টেম্পোতে তার খরচ হতো চার আনার মতো। আর রিকশায় এলে এক-দেড় টাকা ভাড়া গুনতে হতো।
সেদিনের সেই ঢাকায় এখন রাস্তা বেড়েছে, চাওয়া হয়েছে। মানুষ, যানবাহনÑ সবই বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে অচল শহরের তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে ৪৭ বছর আগের ফাঁকা ঢাকা। এখন রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থা এতই খারাপ যে নাস্তিকের চিন্তায়ও সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব জেগে ওঠে। বছর দুই আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে একজন জাপানি নগর পরিকল্পনাবিদ এসে দেখা করেন। তার আগে ঢাকার মতিঝিলের রাস্তা ঘুরে দেখেন তিনি। ঢাকার রাস্তায় চলাচলের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে মুহিতকে তিনি বলেন, ‘আমি আগে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু ঢাকার রাস্তার পরিস্থিতি দেখে মনে হলো, নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু একটা আছেন। না হলে, ঢাকার রাস্তায় এত বিশৃঙ্খলা, এত মানুষ, এত গাড়ি, রিকশা। কেউ এগুলোকে চালাচ্ছে না, তবুও তো চলছে। আমি নিশ্চিত দূর থেকে মহাশক্তিশালী কেউ না কেউ এগুলোকে চালাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ছাড়া ঢাকায় মানুষের চলাচল সম্ভব হতো না।’
বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা শহরে মোট রাস্তার দৈর্ঘ্য ২২০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। প্রধান সড়ক ছাড়া বাস চলাচল করতে পারে না। কিন্তু ঢাকায় দরকার অন্তত ছয় হাজার কিলোমিটার রাস্তা। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপ্রতুল এই সড়কের ৭৬ শতাংশই দখল করে রাখে ব্যক্তিগত গাড়ি। আর গণপরিবহনের দখলে থাকে মাত্র ৬ থেকে ৮ শতাংশ।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সুশৃঙ্খল গণপরিবহনের অনুপস্থিতি, ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন ও পরিবহন অবকাঠামোর অভাবে ঢাকার মানুষের গতিবেগ ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারে নেমেছে, যা হাঁটার গতিবেগের চেয়ে সামান্য একটু বেশি। তিনি বলেন, ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার অন্যতম সমস্যা হলো অল্প রাস্তা, অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণ ও স্তর বিন্যাস, সুশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, প্রধান সড়কের বেশির ভাগ ব্যক্তি গত গাড়ির দখলে থাকা। ঢাকার মোট সড়কের মাত্র ৫-৬ ভাগ প্রধান সড়ক যেখানে গণপরিবহন চলতে পারে। আধুনিক নগর পরিকল্পনার ভিত্তিতে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। শুধু সড়ক যোগাযোগ দিয়ে এত বড় মেগাসিটির মানুষের চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এ জন্য রেল ও নদীপথের উন্নয়নও করতে হবে। ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ভবিষ্যৎ ঢাকার সাফল্য নির্ভর করবে আশপাশের নগরগুলোর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর। টঙ্গী, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ খুবই সম্ভাবনাময় নগরকেন্দ্র। সমন্বিত আঞ্চলিক পরিকল্পনা করে এসব নগর কেন্দ্রের সঙ্গে ঢাকাকে সংযুক্ত করতে হবে। সড়ক ও রেলের ক্ষেত্রে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন ছাড়া ভালো শহর গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
এখন আর লুঙ্গি খুলতে হয় না
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার কাছিকাটা গ্রামে জন্ম শওকত আলী ওয়ারেসির। ১৯৭৩ সালে এসএসসি পাস করে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। সেই সময় গ্রাম থেকে রাজশাহী যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। ‘তখন আমার গ্রাম থেকে রাজশাহী যেতে লাগত সারা দিন। গ্রাম থেকে হেঁটে, গরুর গাড়িতে করে গুরুদাসপুর যেয়ে বাসে চড়তাম। বাসে ওঠার আগে লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতাম। কারণ, প্যান্ট পরে এত ধুলা-কাঁদার রাস্তায় হাঁটা যেত না। গুরুদাসপুর থেকে ২০ মাইল দূরের নাটোর আসতে লাগত ৩ ঘণ্টার মতো। বাস ছিল হ্যান্ডেল মারা। বাসের সামনে হ্যান্ডেল মেরে স্টার্ট দিতে হতো। যেখানে পুকুর, কুয়া বা ডোবা দেখত, সেখানে থামিয়ে মেশিনে পানি দিয়ে আবার চলত। বাড়ি থেকে এভাবে নাটোর পৌঁছাতে লাগত ৫ ঘণ্টা। নাটোর থেকে একটু ভালো বাস পাওয়া যেত।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সড়ক অবকাঠামো অনেক বেড়েছে। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো ছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত এই রেলসেতু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপন এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে মংলা বন্দরের সংযোগ ঘটনায়। ১৯৭১-৭২ সারা দেশে মোট পাকা রাস্তা ছিল ২২৪৩ মাইল বা ৩৬১০ কিলোমিটার। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, এখন দেশে জাতীয় মহাসড়ক ৩৮১২ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪২৪৬ কিলোমিটার ও ১২,২৪২ কিলোমিটার জেলা সড়ক নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তার দৈর্ঘ্যই ২১,৩০২ কিলোমিটার। এর বাইরে সারা দেশে রয়েছে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকারের পাকা ও কাঁচা সড়ক। এখন দেশের যেকোনো এলাকার সঙ্গে অপরাংশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে যমুনা নদীর ওপর ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক ও রেলযোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গেও ঢাকার সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা পাবে।
বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে উল্লেখ করে শওকত আলী ওয়ারেসি বলেন, এখন নাটোরের কাছিকাটা গ্রাম থেকে রাজশাহী যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। আর বাড়ি থেকে ঢাকা আসতে সময় লাগে মোটে তিন ঘণ্টা।
কেবল সড়কপথই নয়, কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নয়ন না হলেও রেল যোগাযোগও সম্প্রসারিত হয়েছে। ১৯৭১-৭২ সালে বাংলাদেশে রেলপথের পরিমাণ ছিল ১৭৭৬ মাইল। পরের ২০ বছরেও রেলপথের দৈর্ঘ্য বাড়েনি। তবে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গ বন্ধু সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপনের পর থেকে সরকার আবারও রেলপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। বর্তমানে সারা দেশে রেলপথের দৈর্ঘ্য প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের রেল সংযোগ স্থাপন হবে।
পাকিস্তান নেই, বৈষম্য আছে
সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যই ক্রমে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলমন্ত্রও ছিল ধনী-গরিবের বৈষম্য হ্রাস করা। এই বৈষম্য দূর করতেই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। সব ধরনের কলকারখানাÑপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করে নেন। বঙ্গ বন্ধু সরকারের পর রাষ্ট্রীয়করণের বদলে ব্যক্তি মালিকানাধীন বিনিয়োগে বেশি উৎসাহ দেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি যতই রাষ্ট্র খাত থেকে ব্যক্তি খাতে আসতে থাকে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যও তত বাড়তে থাকে। দিন দিন এ সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। সরকারের তরফ থেকেও বৈষম্য বাড়ার কথা স্বীকার করে বাজেটে ধনীদের ওপর করহার বাড়িয়ে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও বাস্তবে বৈষম্য বাড়ছেই।
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রাজীব আহমেদ এই বৈষম্যের কথা তুলে ধরে গত ১৬ ডিসেম্বর নিজের ফেইসবুক পেইজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, ‘দুঃখজনকভাবে আমরা দেশের মধ্যেই কয়েকটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছি। গুলশানের তুলনায় মিরপুর, যাত্রাবাড়ী। চট্টগ্রামের তুলনায় রংপুর। সিলেটের তুলনায় বরিশাল।’
তিনি লিখেছেন, ‘বিএমডব্লিউ বিক্রিতে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষ দেশ, গণপরিবহন নিকৃষ্টতম। সবচেয়ে বড় পোশাক খাতের করপোরেট কর ১২%, ছোট ছোট খাতের ৩৫%। ধনীদের আয় বাড়ছে, শ্রমিকের প্রকৃত আয় ৪% কমেছে। ব্যাংকের এমডির বেতন ১৪ লাখ টাকা, একই ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী ১৬ ঘণ্টা কাজ করে পান ৮ হাজার টাকা। সরকারি কারখানার শ্রমিকদের বেতন ১৫ হাজার, বেসরকারি ৮ হাজার। বড়রা ব্যাংক লুট করে, তরুণ উদ্যোক্তা ঋণ পায় না। করপোরেটদের সুদের হার ৯%, গ্রামে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ হয় ২৭-৩৫% সুদে...স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর...’
ধনীদের সম্পদ এত বেশি বেড়েছে যে, ঢাকার অনেক ব্যবসায়ী পরিবারে ৮-১০টি করেও বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। একজন তৈরি পোশাক কারখানা মালিক বিএমডব্লিউ গাড়ি দেখিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, এই গাড়ি আমি ব্যবহার করি না। আমি স্পোর্টস মডেলের মার্সিডিজ বেঞ্চ ব্যবহার করি। চার সদস্যের পরিবারে কয়টি গাড়ি আছে, জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ছয়-সাতটি আছে। অনেক সময় আত্মীয়স্বজন আসে। সবাই মিলতে ঘুরতে গেলে বড় গাড়ি লাগে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে জিপগাড়ির ব্যবহার বাড়ছে। মূলত ধনিক শ্রেণির বিস্তারের কারণেই এ ধরনের দামি গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে চার হাজার ৮৯২টি জিপগাড়ির নিবন্ধন হয়েছে। দুই বছর আগে এটি ছিল ১৮৭০।
প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বলেছেন, ১৯৯১-৯২ সালে যেখানে সর্বাধিক ৫ শতাংশ ধনী পরিবারের জাতীয় আয়ের অংশ ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০.৬৬ শতাংশে। এরশাদ সরকারের আমলে ১ শতাংশ লোক দেশের ২৭ ভাগ সম্পদের মালিক ছিল। ২০০৭ সালে ১ শতাংশ লোক ৪০ শতাংশ সম্পদের মালিক। উন্নয়নের গতি চুইয়ে চুইয়ে নি¤œবর্গের দিকে যাবে বলে যে আশা করা হয়েছিল, বাস্তবে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না।
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান গত জানুয়ারিতে তথ্য দেন যে, সারা দেশে ১০ লাখ ৫১ হাজার ৮৩১ জন ভূমিহীন, ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৯০ জন গৃহহীন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিডিপি)-এর গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সমাজের সবচেয়ে নিচের দিকের পাঁচ শতাংশের আয় মোট আয়ের দশমিক ২৩ শতাংশ। যেখানে ২০১০ সালে ছিল দশমিক ৭৮ শতাংশ।

অন্যদিকে দেশে দিন দিন কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে নগদ কোটি টাকা রয়েছে, এমন মানুষের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় কোটি টাকার ওপরে আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা গত ৩০ জুনে পৌঁছেছে ৭৩ হাজার ৭১০টি। এর মধ্যে অবশ্য সবই ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট নয়। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টও রয়েছে। তবে ৮ বছর আগে এ সংখ্যাটি ছিল ২৬ হাজার ৫৪১। ১৯৭১ থেকে ’৭৪ সাল পর্যন্ত দেশে কোটি টাকার ওপরে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ২৭টি। পঁচাত্তরে তা বেড়ে ৫০টিতে দাঁড়ায়। ১৯৮০ সালে তা দ্বিগুণ হয়ে ১০৭ ও পরের ১০ বছরে বেড়ে ৯১৭টিতে পৌঁছায়।
আলো পৌঁছেছে অন্ধকারে
স্বাধীনতার সময় আলো বলতে গ্রাম-বাংলার মানুষ হয়তো চন্দ্র-সূর্যের আলো, কিংবা কেরোসিন পুড়িয়ে টিমটিমে জ্বলা কুপির আলোই বুঝত। সুইচ দিলে পুরো ঘর আলোতে ভরে উঠবেÑএ ধারণাই দেশের বেশির ভাগ মানুষের ছিল না। কারণ, বিদ্যুৎ কী জিনিস, তা-ই জানত না অনেকে। এখন আর সেদিন নেই! বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত মোট আয়তনের ৯০.৫ শতাংশ এলাকা। একসময় অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকা বাংলাদেশ আগামী দিনের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন হতো। তখন বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা সারা দেশে ছিল মোটে দুই লাখ ৩১ হাজার। বড় শহর ছাড়া বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়া ছিল বড়ই কঠিন ব্যাপার। মাথাপিছু বিদ্যুৎ ক্রয়হার ছিল ১০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ, বিদ্যুতের সংযোগ থাকলেও তাতে বিদ্যুৎ থাকত খুবই কম। ৪৭ বছর আগে বাংলাদেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, এখন চট্টগ্রামের কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানেই তার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ দরকার হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন মূলত গত ১০ বছরে। ১৯৮২ সালেও দেশের ৬.৫৬ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বাড়লেও উৎপাদনক্ষমতা না থাকায় মানুষের বাড়ি কিংবা শিল্প-কারখানা সর্বত্রই নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখে সরকার।
আওয়ামী লীগের ২০০৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ‘ভিশন ২০২১’ অনুযায়ী সরকার পরিকল্পনা করেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে সবার বাড়িতে জ্বলবে বিদ্যুতের বাতি। এ ক্ষেত্রে সফলতাও অনেক। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে কয়লা থেকে হাজার ৩৬৯ মেগাওয়াট ও ২০২০ সালের মধ্যে সৌর-প্যানেল থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে। ২০২১ সালের মধ্যে ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে আনা হবে দুই হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ; ২০৩০ সালের মধ্যে এসব দেশ থেকে আসবে ছয় হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। পরমাণু-বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২০২৪ সালে আসবে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট আর ২০৩০ সালের মধ্যে আসবে চার হাজার মেগাওয়াট।
ম্যাকনামারাকে রিসিভ করেননি তাজউদ্দীন, জেলিককে ‘না’ মুহিতের বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তিনি তখন বারবার চেষ্টা করছিলেন বিশ্বব্যাংকের তখনকার প্রেসিডেন্ট রবার্ট স্ট্র্যান্স ম্যাকনামারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। উদ্দেশ্য ছিল, তার সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করা। বেশ কয়েকবার বিশ্বব্যাংকের দপ্তরে যেয়ে ম্যাকনামারার ব্যক্তি গত কর্মকর্তাকে গিয়ে অনুরোধ করেন মুহিত। একদিন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুহিতকে জানিয়ে দেন, প্রেসিডেন্ট তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না। কারণ, আপনি বাংলাদেশ বা পাকিস্তান সরকারের কোনো দায়িত্বে নেই, সাধারণ নাগরিক মাত্র।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পরপর একদিন ম্যাকনামারার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুহিতকে ফোন করলেন। বললেন, প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে চান। আমি তো শুনে অবাক। পরে আমি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি। ম্যাকনামারা আমাকে বললেন, আমি নিজ খরচে বাংলাদেশে যেতে চাই। তুমি যদি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারো, আমি যাব। মুহিত তখন ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে টেলিফোন করে ম্যাকনামারার এ প্রস্তাবের কথা জানালেন। তখন টেলিফোন করাও অনেক কঠিন কাজ ছিল। একদিন টেলিফোন করলে পরদিন সংযোগ পাওয়া যেত।
মুহিত বলেন, ম্যাকনামারা এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার সঙ্গে দেখা করবেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে জানানো হলো। বঙ্গবন্ধু তখনকার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলেছিলেন, বিমানবন্দরে ম্যাকনামারাকে রিসিভ করতে। কিন্ত তাজউদ্দীন তাতে রাজি হননি। তখন তাজউদ্দীন বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের কথার বাইরে কাজ করে না। তাই ওরা আমাদের কোনো সাহায্যও দেবে না। তাই আমি তাকে রিসিভ করতেও যাব না। পরে বঙ্গবন্ধু তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে পাঠান ম্যাকনামারাকে রিসিভ করতে। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ১২ ঘণ্টার ওই সফরে ম্যাকনামারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, সে সময় তাজউদ্দীন আহমদও পাশে ছিলেন।
ওই ঘটনার বর্ণনা করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশ রূপান্তকে বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সহায়তা দেওয়ার জন্য ম্যাকনামারা তখন অনেক চেষ্টা করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তিনি তা পারেননি। বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সহযোগিতা ছাড়াই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।
সেই ঘটনার অনেকটা পুনরাবৃত্তি ঘটেছে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুতে ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি ২০১১ সালের অক্টোবরে স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। পরের বছরের জুলাই মাসে তা বাতিলই করে দেয় সংস্থাটি। পরে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে বেশকিছু শর্ত দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে ফিরতে চেয়েছিল বিশ্বব্যাংক। শুরুতে সরকার তাতে রাজি থাকলেও সেতু নির্মাণে দেরি হওয়ার আশঙ্কায় ২০১৩ সালের বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংককে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণের কোনো প্রয়োজন নেই বাংলাদেশের। তার পর থেকে নিজস্ব অর্থায়নেই সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। তখন বিশ^ ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রবার্ট জেলিক।
২৬ টাকায় টিকে গেল জিহ্বা
ঘটনাটি গত বছরের। জিব্বায় ঘা নিয়ে ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে এক নিরক্ষর দম্পতি ঢাকার এক বিখ্যাত নাক কান গলার চিকিৎসকের কাছে ছুটে এলেন। সারাদিন বসে থেকেও ওই চিকিৎসকের দেখা পাননি তারা। কিন্তু রাত ১১টায় বের হওয়ার সময় চিকিৎসকের দয়া হলো। তিনি ডেকে নিলেন সেই দম্পতিকে। জিব্বাটা কুকুরের জিব্বার মতো লম্বা করে বের করতে বললেন তিনি। পুরুষ ওই রোগীকে একনজর দেখার পরই বললেন, ‘আপনার জিব্বায় ক্যানসার হয়েছে। জিব্বা কেটে ফেলে দিতে হবে। তিন লাখ টাকা নিয়ে সাত দিনের মধ্যে আমার চেম্বারে চলে আসুন। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর এখন কোনো ওষুধ দিয়েও লাভ নেই।’
বলেই ঘট ঘট করে চেম্বার ছেড়ে গেলেন চিকিৎসক। তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর চেম্বারের কর্মচারীরা আর একমুহূর্তও দেরি করতে চাইল না। তারা তাগাদা দিয়ে ওই দম্পাতিকে চেম্বার থেকে বের করে দিলেন।
দম্পতির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তারা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
গফরগাঁও ফিরে গেলেন। আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনরা সান্ত¡না দিতে এলেন এবং জমিজমা বিক্রি করে তিন লাখ টাকা নিয়ে অপারেশন করানোর পরামর্শ দিলেন। কিন্তু প্রতিবেশী রাজধানীবাসী এক শিক্ষার্থী তাকে পরামর্শ দিলেন অপারেশন করাতে হবে ভালো কথা। আপনি অপারেশন করাবেন। কিন্তু অপারেশন করানোর আগে আপনি ভারতের চেন্নাই যান। সেখানকার চিকিৎসকও যদি বলেন অপারেশন করাতে, তখন করাবেন।
গরু-বাছুর, জায়গা-জমি বিক্রি করে সাড়ে তিন লাখ টাক নিয়ে এক মাসের মধ্যে চেন্নাই গেলেন তারা। কোনো কিছু পড়তে পারেন না, স্থানীয় ভাষাও জানেন না তারা। ঠিকই পৌঁছে গেলেন মাদ্রাজের বিখ্যাত সিএমসি হসপিটালে। চিকিৎসক দেখেই বললেন আপনারা নাক কান গলা বিভাগে এসেছেন কেন? আপনাদের সমস্যা তো দাঁতের। তিনি একপ্রকার জোর করেই তাদেরকে ডেন্টাল বিভাগে পাঠালেন।
দাঁতের চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, তাদের কোনো অপারেশন করাতে হবে না। ওষুধেই অসুখ সারবে। একটা দাঁতের কোনা ভেঙে জিব্বায় গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য জিব্বা কেটে ফেলার কোনো দরকার নেই। দাঁত ঘষে ঠিক করে দিলেন আর ওষুধ লিখে দিলেন। দম্পতি ফার্মেসি বিভাগ থেকে ২৬ রুপির ওষুধ কিনে থ হয়ে গেলেন।
মাত্র ২৬ টাকার ওষুধে তাদের অসুখ ভালো হয়ে যাবে? তারা যেন নিজেদের বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। চিকিৎসক কোনো ভুল করলেন না তো? হসপিটালে উপস্থিত অনেককে কাগজপত্র দেখালেন। চিকিৎসকের কাছেও গেলেন আবার। চিকিৎসক আবার ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন।
চিকিৎসকের রুম থেকে বের হয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না ওই দম্পতি। একজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
হসপিটালের সিকিউরিটি দৌড়ে এলো তাদের কান্না থামাতে। কান্না তো থামেই না বরং তাদের কান্না দেখে উপস্থিত অন্যান্য বাংলাদেশি রোগীরাও কান্নাকাটি শুরু করেছেন।
শৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত সিকিউরিটি গার্ড তাদেরকে জোর করে হাসপাতাল থেকে বের করে দিল। এরপর হঠাৎ করেই বিস্ফোরণ ঘটল। স্লোগানের বিস্ফোরণ। সঙ্গী নিরক্ষর মহিলাটি বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে বাংলাদেশি ওই বিখ্যাত ডাক্তারের নাম ধরে বললেন, এর ফাঁসি চাই। সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকা কাঁপিয়ে দিয়ে উপস্থিত সব বাংলাদেশি স্লোগান ধরল ‘এর ফাঁসি চাই।’

লাল ফিতা সাদা হয়েছে দৌরাত্ম্য কমেনি
সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রশাসনের ফাইলগুলো লাল ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। লাল ফিতা ব্যবহার করার কারণ ছিল, ব্যবহার করতে করতে ফিতাতে ময়লা জমলেও তা খুব একটা বোঝা যেত না। কিন্তু লাল ফিতায় বন্দি ফাইল আটকে রেখে সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় ছিল প্রশাসনে অতিস্বাভাবিক ঘটনা। উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রিটিশ আমল থেকে সেই লাল ফিতা ও তার দৌরাত্ম্য পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলেও চলতে থাকে।
১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রশাসনের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা একটি দুর্নীতিযুক্ত প্রশাসন পেয়েছি। সাবেকি পুঁজিবাদী অর্থনীতির সূত্র ধরে আমাদের জীবনের সর্বস্তরে দুর্নীতি সম্প্রসারিত হয়েছে এবং আমাদের প্রশাসন কর্মীদের কিছু অংশ এখনো পুরাতন রীতি-নীতি ও ধাবধারা পরিত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীল লোভ-লালসাহীন কর্তব্যনিষ্ঠায় প্রমাণ দিতে পারেনি।’
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বহুবার প্রশাসনের দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং দিনের পর দিন সেবাপ্রার্থীদের জরুরি ফাইলগুলো আটকে রেখে টাকা আদায়ের কৌশল বেড়েছে। ফলে ‘লাল ফিতার দৌরাত্ম্য’ বাক্যের প্রচলন শুরু হয়ে যায় সর্বত্র। সরকারি চাকরিজীবীদের স্বেচ্ছাচার, কালক্ষেপণ ও ঘুষ নেওয়ার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় লালফিতা। এখন প্রশাসনে সেই লাল ফিতা আর নেই। লাল ফিতার বদলে সাদা ফিতা ব্যবহার হচ্ছে সরকারি দপ্তরগুলোতে। কিন্তু দৌরাত্ম্য কমেনি বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব শওকত আলী ওয়ারেসি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই লাল ফিতার ব্যবহার চলে আসছিল। ১৯৮৬ সালের দিকে উচ্চ আদালত থেকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা আসে। তখন প্রশাসনে ইংরেজির বদলে বাংলার ব্যবহার শুরু হয়। ওই সময়ই লাল ফিতার বদলে ফাইলগুলোতে সাদা ফিতা ব্যবহার শুরু হয়। যেহেতু লাল ফিতা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার ও কালক্ষেপণের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, তাই ওই ফিতা ব্যবহার থেকে সরে আসে প্রশাসন। ফিতার রং বদলালেও প্রশাসনের দৌরাত্ম্য কতটুকু কমেছে, জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা হাসতে থাকেন। পরক্ষণে বলেন, ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকেও ঢাকার দেয়ালগুলোতে চিকা মারা থাকত ‘ফাইল আটকিয়ে টাকা নেওয়া আর পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা নেওয়ার মধ্যে কোনো তফাত নেই।’ ‘তবে আমলাতন্ত্রের এখন আর ওই রকম দৌরাত্ম্য নেই। এখন সবকিছুর গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেন রাজনীতিবিদরা। তবে প্রশাসনের নিচের দিকে দৌরাত্মœ্য একটুও কমেনি। টাকা ছাড়া নিচের স্তরে কোনো কাজ হয় না’Ñঅভিমত সাবেক এই উচ্চপস্থ’ কর্মকর্তার।

ওয়ারেসির বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতিরও মিল পাওয়া যায়। লাল ফিতা সাদা হওয়ার পর প্রশাসনের দুর্নীতি আরো ব্যাপকতর হওয়ার চিত্র উঠে আসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদনে। ২০০১ থেকে পরপর চারবার বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে টিআই প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১৭তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। আগের বছর ছিল ১৫তম। ওয়ারেসি বলেন, দেশে দুর্নীতির পুরোটার সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তারা জড়িত নন। আমলাদের ক্ষমতা আগের মতো নেই। সচিবালয় বলেন, জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে আগে আমলারাই ছিলেন হর্তা-কর্তা। এখন সর্বত্রই রাজনীতিবিদদের প্রভাব বাড়ছে। পাকিস্তান আমলেও সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের দ্বন্দ্ব দেখা দিত। কিন্তু সব সময়ই বেসামরিক প্রশাসন সামরিক প্রশাসনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে চলত। ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সেও বেসামরিক প্রশাসনকে সামরিক প্রশাসনের ওপরে রাখা হতো। বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সময় এ পরিস্থিতি বদলে গেল। তার মতে, পাকিস্তান আমলে প্রশাসনের উচ্চ স্তরে নিয়োগের জন্য বর্তমান বিসিএসের মতোই সিএসএস পরীক্ষা হতো। ওই পরীক্ষায় মেধাতালিকায় থাকা প্রথম শ খানেক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনে নেওয়া হতো, যাদেরকে সিএসপি অফিসার বলা হতো। বাকিদের অন্যান্য ক্যাডারে চাকরি দেওয়া হতো। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এলো। তখন মেধাতালিকার প্রথম দিকে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের পররাষ্ট্র ও প্রশাসন ক্যাডারে দেওয়ার বদলে ২৮টি ক্যডার করে প্রার্থীদের পছন্দ অনুযায়ী চাকরি দেওয়া শুরু হলো। এভাবেই সিভিল প্রশাসন দুর্বল হতে থাকল, তাদের প্রভাবও কমতে থাকল। এখনো সে পদ্ধতিতেই নিয়োগ হচ্ছে।
নিজের কর্মজীবনের একটি ঘটনা তুলে ধরে শওকত আলী ওয়ারেসি বলেন, ২০০৪-২০০৫ সালের ঘটনা। তখন মাত্র উপসচিব হয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছি। তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী হঠাৎ আমাকে ডাকলেন। যাওয়ার পর হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন এবং একটি কম বয়সী ছেলেকে দেখিয়ে বলেন, ওই শেয়ারগুলো এই ছেলেটার নামে ট্রান্সফার করে দাও। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সারা দেশের পরিত্যক্ত সম্পত্তি দেখভাল করে, ওই শেয়ারগুলোও পরিত্যক্ত ছিল। আমি কাগজটা নিয়ে যুগ্ম সচিবের কাছে এসে বললাম মন্ত্রী এই কথা বলেছেন। উনি কোনো দায়িত্ব নিতে চাইলেন না। আমি পুরোনো ফাইলপত্র ঘেঁটে নথি বের করলাম। দেখি, ওটা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় থাকা এক পাকিস্তানি নাগরিকের নামে। স্বাধীনতার পর ওই লোক বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে, শেয়ার সরকারের হাতে এসেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখভাল করছে।
সরকারি শেয়ার কাউকে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম আছে। প্রথমে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হবে যে, এই শেয়ারের কোনো মালিক নেই। পরে উন্মুক্ত দরপত্র দিতে হবে। সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে ওই শেয়ার বিক্রি করতে হবে। আমি এসব নিয়ম-কানুনের কথা রেডি করে বসে থাকলাম। কয়েকদিন পর মন্ত্রী আবার আমাকে ডাকলেন, গেলাম। উনি ধমক দিয়ে বললেন শেয়ারগুলো এখনো কেন ওই লোকের নামে দিচ্ছেন না? তখন আমি নিয়মের কথা বলতেই তিনি আরো জোরে ধমক দিয়ে বললেন, জানো ওই লোক কে? তখনকার প্রধানমন্ত্রীর ছেলের নাম ধরে তিনি বলেন যে, তিনি চান যে শেয়ারগুলো তাকে দেওয়া হোক। এক্ষুনি যেয়ে শেয়ারগুলো তাকে দিয়ে দেন। না হলে আপনার চাকরি থাকবে না? আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তবে শেয়ারগুলো ওই ছেলের নামে হস্তান্তর করলাম না। তবে আমার ভাগ্য ভালো যে, এর কয়েকদিনের মধ্যেই তার মন্ত্রিত্ব চলে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান একটি গল্প লিখেছেন। তিনি বলেছেন, আশির দশকে গল্পটি বেশ চালু ছিল। তখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশে শামরিক শাসন ছিল। উভয় দেশের সমরনায়ক শবেবরাতে নামাজ পড়তে বসলেন। দুজন দোয়া-দুরুদ পড়তে পড়তে বেহেশতে হৈচৈ ফেলে দেন। স্বয়ং জিবরাইল তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে নেমে আসেন। তিনি প্রথম পাকিস্তানে গেলেন এবং সমরনায়কের কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। সমরনায়ক বললেন, ‘সৃষ্টিকর্তা পাকিস্তানের প্রতি ঘোরতর অবিচার করেছেন। সব গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশে তেল দিলেও পাকিস্তানে দেননি।’ জিবরাইল বললেন, ‘ওরে কমবখত সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকর কর। তিনি তোকে তেল দেননি। কিন্তু আফগান সংকট দিয়েছেন। এই সংকট ভাঙিয়ে যত পারিস কামিয়ে নে।’
এরপর এলেন বাংলাদেশে। তারও একই দুঃখ। সব মুসলিম দেশ তেল পেয়েছে। এমনকি বাঙালিদের পরে মুসলিম হওয়া নালায়েক দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়াও তেল পেয়েছে। তেল পায়নি কেবল বাংলাদেশের মোমিন মুসলমানরা।’ জবাবে জিবরাইল বললেন, ‘বাংলাদেশের জন্য কিছু তেল ও গ্যাস বরাদ্দ রয়েছে। তবে তোর যে উড়নচ-ি স্বভাব, এসব তেল গ্যাস এখনই বের করা সম্ভব না। তোকে তেল দেওয়া হবে না। তোকা বন্যা দেওয়া হবে। যা পারিস রিলিফের মাল হতিয়ে নে।’

বাংলাদেশে দুর্নীতি বন্ধে রাজনীতিবিদরা বারবার অঙ্গীকার করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এভাবে যে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়, তা ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ‘সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সততা, নিয়মানুবর্তিতা, বাস্তবায়নানুগ উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন ও কঠোর শ্রমের আজ বড় প্রয়োজন। স্লোগান দিয়ে দুর্নীতি দূর হয় না, বুলি আওড়ে প্রবৃদ্ধি আনা যায় না, জনসাধারণকে সর্বকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া যায় না।’
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ নামক গ্রন্থের ২০১৬ সালের সংস্করণে বলা হয়েছে, দুর্নীতিরোধে আমাদের অক্ষমতা আজ সর্বজনবিদিত। সরকার বদলের পর পরই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রুজু হয় এবং সরকারি দলের রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অব্যবহিত আগের সরকার কর্র্তৃক রুজু করা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ দায়ের করা হয়, তার মধ্যে দুটি মামলা চূড়ান্তভাবে শেষ হয় এবং দোষী ব্যক্তি শাস্তি ভোগ করেন। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের দলে টানার জন্য তার জামিন দেওয়া-নেওয়া নিয়ে যে প্রহসনের সৃষ্টি হয়, তাতে আদালতের সুনাম ক্ষুণই হয়।’
ঢাকায় নামতেই মনে হয় এটি অত্যন্ত ধনী দেশ
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মো. আনিসুর রহমান তার আত্মজীবনী ‘পথে যা পেয়েছি’-এর দ্বিতীয় খ-ে বলেছেন, পরিকল্পনা কমিশনে সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়ার পর কৃচ্ছসাধনের জন্য পেট্রল ও গাড়ির অপচয় কমাতে সরকারকে প্রস্তাব দেন তিনি।
লিখিত ওই প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার সাপ্লাই অত্যন্ত কম, তাই এর ব্যবহারে যতটা সম্ভব মিতব্যয়ী হওয়া প্রয়োজন। একটি ক্ষেত্রে যেখানে এটি করা যায় এবং করা বাঞ্ছনীয় তা হলো পেট্রল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতে পেট্রল রেশন করা হয়েছিল এবং একটি কুপন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। বাংলাদেশে আজকে এরকম একটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা অনেক বেশি জরুরি। প্রাইভেট গাড়ির ওপর মাসিক পেট্রল কেনার একটা সিলিং ধার্য করা প্রয়োজন, মনে হয় প্রত্যেক গাড়ির জন্য মাসে দশ গ্যালন বরাদ্দ করে এবং এর জন্য একটা কুপন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। অফিসারদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সরকারি গাড়ি ব্যবহারের যে নিয়মাবলি আছে সেগুলির কড়া প্রয়োগ প্রয়োজন, এবং এর জন্য চার্জ বাড়িয়ে প্রতি মাইলে ১২ আনায় তোলা উচিত। মন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও এর কোনো অন্যথা হওয়া উচিত নয়। কোনো কোনো পদের অফিসাররা এবং মন্ত্রিবর্গ, বাসা থেকে অফিসে যেতে ও আসতে ফ্রি অফিসের গাড়ি পানÑএই প্রথাও বন্ধ করা উচিত।’
‘দেশের বাইরে থেকে আসলে ওপর থেকে ঢাকার ওপর নামতে গিয়ে প্রথমেই যে ধারণাটা হয় তা হলো, এটি একটি অত্যন্ত ধনী দেশ। বিলাসী গাড়ির প্রসেশন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বিদেশি মুদ্রা খরচ হয় বলে এসব গাড়ি আমদানি ও ব্যবহার উভয়েরই একটা সামাজিক খরচ আছে। বোধ করি আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, আমাদের মতো একটা দরিদ্র দেশে এরকম বিলাসী গাড়ির প্রদর্শন আমাদের দরিদ্র জনগণের জন্য নিদারুণ অপমানকর, সমতা নীতির বিরুদ্ধে এবং দেশ গড়ার কাজে দরিদ্র জনগণের উৎসাহের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব’Ñ চিঠিতে লেখেন তিনি।
আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমি জোর দিয়ে প্রস্তাব করছি যেম অবিলম্বে সমস্তবিলাসী গাড়ির স্পেয়ার পার্টস আমদানি বন্ধ করা হোক, যাতে হয় এ সমস্তগাড়ির দ্রুত মৃত্যু হয়, অথবা এরা বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায় যদি এদের জন্য বাজার থাকে।’
‘সরকারি কর্মচারীদের ব্যবহারের জন্য সরকারি খাতে মনে হয় খুব বেশি সংখ্যক গাড়ি আছে, এবং এদের অধিকাংশই বিলাসী জাতের। এটা একেবারেই অযৌক্তিক। সময় বাঁচাবার জন্য সরকারি অফিসারদের সরকারি কাজে যাতায়াতের জন্য দ্রুতযানের অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু এরকম যাতায়াতের ব্যবস্থা প্রয়োজনভিত্তিক হওয়া দরকার, স্ট্যাটাসভিত্তিক নয়। একা গাড়িতে যেতে একজন অফিসারের দুই-সিট গাড়িই শুধু প্রয়োজন, একটি সিট তার নিজের জন্য এবং একটি ড্রাইভারের জন্য। গাড়ির বাকি বসবার জায়গার অপচয় হয়, আর এসব গাড়ি কেনা ও চালু রাখবার খরচ পাবলিক ফান্ডের ওপর চার্জ হয়। বড় গাড়ির পেট্রল খরচও বেশি এবং ছোট গাড়ি দিয়েই যখন অফিসারদের যাতায়াত চলতে পারে তখন এই খরচ পাবলিক ফান্ড ও অপ্রচুর বিদেশি মুদ্রা দুইয়ের সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় খরচ’ বলেন আনিসুর রহমান।
তিনি বলেন, আমি প্রস্তাব করি যে, সরকারের মালিকানায় যে সব বড় গাড়ি আছে তাদের বেশির ভাগ জেনারেল পাবলিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হোক অথবা সম্ভব হলে বিদেশে রপ্তানি করে দেওয়া হোক এবং সরকারি অফিসারদের একা, দুজন বা তিনজন পর্যাপ্ত সরকারি কাজে যাতায়াতের জন্য ফিয়াট ৬০০ বা বেবি অস্টিনের চেয়ে অনধিক সাইজের গাড়ির ব্যবস্থা করা হোক। বাকি বড় গাড়িগুলো বড় দলকে নিয়ে যাওয়াার জন্য রাখা যেতে পারে। আবার বলছি, মন্ত্রীরা এই কৃচ্ছ্রসাধন ব্যবস্থা থেকে কোনো ব্যতিক্রম না দাবি করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন এ আশা করা যেতে পারে।
‘মোটামুটিভাবে আমার একটা ধারণা হচ্ছে যে, গত দশ মাসে দেশে কী হয়েছে এ সম্বন্ধে ঢাকার এলিটগর্ব বিস্মৃতির গর্ভে। বাংলাদেশের সচেতন জনগণ যারা দেশমুক্তির জন্য বীরের মতো সংগ্রাম করেছে এবং রক্ত দিয়েছে তারা আমাদের সত্যিকার অবস্থা বুঝে জেগে ওঠার জন্য খুব বেশি সময় দেবে না।’ Ñএভাবেই চিঠির সমাপ্ত টানেন আনিসুর রহমান। সে অবস্থার পরিবর্তন এখনো হয়নি। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা এখন বিএমডব্লিউও গাড়ি ব্যবহার করছেন। সরকারি কর্মকর্তারাও সর্বশেষ মডেলের গাড়ি কিনছেন সরকারি পয়সায়। সরকারের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য বিনাসুদে ঋণ পাচ্ছেন। সেই গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন জনগণের করের টাকা থেকে।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৮৬৩টি। ওই সময় সারা দেশে বাস ছিল সাত হাজার ৬১৬টি, ট্রাক ১৪ হাজার ২৮৮টি। ১৯৮০ সালেই ব্যক্তি গত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ৮৬৮-তে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৭০টি। ২০১৮ সালের প্রথম পাঁচ মাসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ১৫২৪টি করে ব্যক্তিগত গাড়ির নিবন্ধন হয়েছে। বর্তমানে ঢাকায় নিবন্ধিত বাস ২৮ হাজার ৮৯১টি।
বাংলাদেশের পরিকল্পনা একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্টতম
বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আনিসুর রহমান নিজের হাতেই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। নিজের করা ওই পরিকল্পনাকে একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্টতম বলে উল্লেখ করেন নিজেই। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যপদ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনায় পুরো সময় দেওয়া শুরু করেন তিনি। পরে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ওপর অরর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে আনিসুর রহমানকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হয়।
‘আমি বলেছিলাম যে, এই পরিকল্পনা একই সঙ্গে আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ এবং নিকৃষ্টতম ফসল। শ্রেষ্ঠ এই জন্য যে, এই পরিকল্পনা টেকনিক্যাল মেধা ও যোগ্যতার দিক দিয়ে বিশ্বের যে কোনো দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে তুলনীয়; নিকৃষ্টতম এই জন্য যে, এই পরিকল্পনা আকাশেই উড়ছে, দেশের মাটি স্পর্শ করতে পারেনি।’

বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন দুর্বলতার কারণে তিনি যে ওই কমিশনের সদস্য ছিলেন, সেই পরিচয়ে কোনো গর্ববোধ নেই আনিসুর রহমানের। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আজও আমাকে অনেকে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ‘প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য’ এই বলে যেন খুব শ্রদ্ধাভরে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি আমার এই পরিচয়ে খুব গর্ববোধ করি এ কথা বলতে পারি না, যদিও এই পরিচয় লুকোবার আমার কোনো পথ নেই।’
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকতা শওকত আলী ওয়ারেসি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালনকালে একটি ঘটনা স্মরণ করে দেশ রূপান্তকে বলেন, ২০১১-১২ সালের ঘটনা। বাজারে হলুদ, মরিচ, জিরার যে দাম, বিভিন্ন কম্পানির প্যাকেটজাত গুঁড়ার দাম তার চার-পাঁচগুণ। আমি আর অন্য অতিরিক্ত সচিব এ টি এম মর্তুজা রেজা চৌধুরী আলোচনা করলাম, গুঁড়ার দাম নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। ব্যবসায়ীদের ডাকলাম। তারা বললেন, নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে খুচরা ব্যবসায়ীদের ৩০%-এর বেশি মুনাফা দিতে হয়। তাই দাম বেশি। তখন আমি আর মর্তুজা গেলাম সচিবের কাছে। বললাম, এসব পণ্যকে অ্যাসেনসিয়াল পণ্য আইনে ঢুকিয়ে দিতে পারলে এগুলোর দাম প্রয়োজনে সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারবে। কিন্তু সচিব রাজি হলেন না।

‘পরে আমরা দুজন জিএম কাদেরের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, গেজেট জারি করে ঢুকিয়ে দাও। তখন আমরা বললাম, সচিব তো মাইন্ড করবেন। তখন আমরা মন্ত্রীকে বললাম, সচিব বিদেশ গেলে মর্তুজা ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পাবেন। ওই সময় আমরা এটা জারি করব। সে মতেই কাজ করলাম। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি’ দুজন অতিরিক্ত সচিব দীর্ঘদিন কষ্ট করে যে কাজটি করলেন, তা দেশের মানুষের কোনো কাজেই লাগল না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন করা হয়েছিল ২০০১ সালে। এরপর ১৬ বছরেও আইনটির বিধিমালা তৈরি করতে পারেনি ভূমি মন্ত্রণালয়। বিধিমালা তৈরি করতে না পারলেও কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ থেমে থাকেনি। উচ্চ আদালতের অবসারপ্রাপ্ত বিচারপতিদের কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ছয়জন চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন। এই সময়ে ভূমি বিরোধ নিয়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি আবেদন কমিশনে জমা পড়েছে। কিন্তু একটি আবেদনও নিষ্পত্তি হয়নি বিধিমালার অভাবে। সবশেষে ২০১৬ সালে আইনটির সংশোধনী আনা হয়। পরিবর্তিত আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
শুধু ভূমি মন্ত্রণালয়ই নয় এমন কোনো মন্ত্রণালয় পাওয়া যাবে না যাদের দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন বিধিমালার অভাবে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।
অপর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে শওকত আলী ওয়ারেসি বলেন, রোজায় ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেওয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিছে। খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়ে দেখা গেল কয়েকটি দোকানে দাম অনেক বেশি। খুচরা দোকানদাররা বলল, পাইকারি বাজার থেকেই বেশি দামে কিনছে তারা। রিসিটও দিল। তখন আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মিটিং ডাকলাম। সেখানে র্যাব, পুলিশ এনএসআইয়ের কর্মকর্তারাও থাকলেন। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো আট-১০ জন পাইকারি ব্যবসায়ীকে ওই দিনই গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশ আমাদের জানাল, তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আটক হবেন। কিন্তু হলো না। ঘণ্টা দুই পরে পুলিশ জানাল দাম বাড়ানো ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারে মন্ত্রী নিজেই নিষেধ করেছেন।
জন্মদিন আসত না অনেক শিশুর চল্লিশেই বুড়ো হতো বাংলাদেশিরা
স্বাধীনতার সময়কার চিকিৎসাসেবার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক মো. শাহজাহান বলেন, আগে গ্রাম এলাকায় পাস করা ডাক্তার ছিল না। এসএসসি পাস করার পর কয়েক মাসের কোর্স করা লোকরাই চিকিৎসা করত। তাদের ন্যাশনাল পাস ডাক্তার বলা হতো। আল্লাহর ওপর ভরসা করে চিকিৎসা চলত। তবে হাসপাতালে যেতে পারলে ভালো চিকিৎসা
হতো। সদর হাসপাতাল ছাড়া কোনো হাসপাতালই ছিল না। ইউনিয়নে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি থাকত।
তখন চিকিৎসা প্রায় পুরোপুরিই কবিরাজনির্ভর ছিল। দু-একজন হোমিও ডাক্তার ছিল। একেকজনের ১০-১২টা করে বাচ্চা হতো। প্রায় অর্ধেক শিশু আঁতুড়ঘরেই মারা যেত। স্বাস্থ্যজ্ঞানের অভাব ছিল। এখন তো আঁতুড়ঘর নেই। অনেকে আঁতুড়ঘর শব্দটিই জানে না।

‘আঁতুড়ঘর এমন একটা ঘর, যেখানে কোনোমতে একজন মানুষ ঢোকার মতো চিকন দরজা থাকে। কোনো জানালা থাকে না। ঘরটি হয় বাড়ির সবচেয়ে খারাপ ঘর। ঘরে কোন আলো বাতাস ঢুকে না। আগের দিনে হারিকেনও ছিল না। নবজাতক জন্মের পর কাঠ-গোবর পুড়িয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করে ঘর গরম রাখা হতো। তার মধ্যে থেকে অনেক নবজাতক সাতদিনের মধ্যেই মারা যেত। ধাত্রী হতো মুচিদের স্ত্রী, নাড়িও কাটত তারা। বাঁশের বেত দিয়ে কাটত। সেখানে ইনফেকশন হতো, ঘা হতো। বাচ্চারা কাঁদত। তখন কবিরাজ ডেকে আনা হতো। তেল পড়া, পানি পড়া দিয়ে কবিরাজ বলত, বাচ্চাকে ভুতে ধরেছে। এভাবেই কয়েকদিন পর মারা যেত। অনেক শিশুর জন্মদিনই আসত না। অর্থাৎ, জন্মের এক বছরের মধ্যেই অনেক শিশু মারা যেত’ যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক শাহজাহান বলেন, আগে কারো জ্বর হলে কবিরাজের কাছে যেত। কবিরাজ ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিত। সাগু আর বার্লি খেতে বলত। তাতে রোগী আরো কঙ্কাল হয়ে যেত। এমনকি ডায়রিয়া হলেও খাওয়ানো বন্ধ করে দিত। এভাবেই মানুষ মারা যেত।
তিনি বলেন, এখন তো ইউনিয়ন পর্যায়েও হাসপাতাল হয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে চিকিৎসাজ্ঞানও বেড়েছে। ফলে এখন শিশু মৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুহার কমেছে। তবে অন্য দেশগুলো চিকিৎসাসেবায় যতটা এগিয়েছে, বাংলাদেশ তা পারেনি। ফলে এখনো বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রোগীর বিদেশে যেয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ৪৭ বছরে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার অনেকটাই কমেছে। ১৯৭১ সালে ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার ছিল ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ জনে ২৩ জন শিশু ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যেত। ২০১৭ সালে তা কমে ৩.২ শতাংশে নেমেছে। মাতৃমৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
যেসব শিশু কৈশোর পেরিয়ে যৌবন পার করে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যেত, তাদেরও আয়ু ছিল গড়ে ৫০ বছর। স্বাধীনতার পর ৪০ বছর বয়স হলেই বৃদ্ধ হয়ে যেত বাংলাদেশের মানুষ। অপুষ্টি এবং অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন বেশিদূর টেনে নিতে পারত না বাংলাদেশিরা। স্বাস্থ্যসেবাও ছিল মারাত্মক অপ্রতুল। সে পরিস্থিতি পাল্টেছে। এখন ৪০ বছর বয়সেও তারুণ্যের ছাপ বাংলাদেশিদের চেহারায়। দশক দশক ব্যবধানে আয়ু বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৭২.৮ বছর। বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান এই গড় আয়ু পাকিস্তান, ভারতের চেয়েও বেশি।
জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী ও ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলাম বলনে, বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রসারের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৩১ শয্যার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গড়ার পাশাপাশি গুটিবসন্তনির্ভর যক্ষা এবং ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সরকার মনোনিবেশ করে। ১৯৭৬ সালের জনসংখ্যা নীতি; অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনগণের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি স্বাস্থ্য উন্নয়নে অবদান রেখেছে। খাবার স্যালাইন, ঘরে ঘরে গিয়ে পরিবার পরিকল্পনার সেবা পৌঁছানোর কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম, যক্ষারোগীকে চোখের সামনে ওষুধ খাইয়ে দেওয়া, খোলা মাঠে পায়খানা বন্ধ, কমিউনিটি লেড টোটাল স্যানিটেশনÑএসবই বাংলাদেশে উদ্ভাবিত; যা পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, সাফল্যের এসকল পালক মাথায় নিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংক্রান্তসহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে গিয়ে আমরা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। এসডিজি অর্জনে বাকি আছে আর মাত্র ১২ বছর; কিন্তু এখনো আমরা সবগুলো সুচকের পরিমাপের বেজলাইন-ই করতে পারিনি। অপুষ্টি কমানোর ক্ষেত্রে আমাদের শৈথিল্য; মাতৃ মৃত্যুহার স্থির হয়ে থাকা এবং সর্বোপরি সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তেমন কোনো অর্জন দেখাতে না পারা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসনের অভাব এবং ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নানা রকম কর্মসূচির অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
খায়রুল ইসলাম বলেন, আগামী দিনে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নজর দিতে হবে। ধারণাটি এরকম যে প্রতিটি নাগরিক তার স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে মানসম্মত সেবা পাবে এবং এই সেবা পেতে গিয়ে তাকে যেন কোনো রকম অর্থ কষ্টে পড়তে না হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে নাগরিককে যেন ধার-কর্জ করতে না হয়, ঘটিবাটি বিক্রি করতে না হয়। অন্যদিকে একজন ধনী যে মানের সেবা পাবে, একজন সাধারণ নাগরিকও সে মানের সেবা পাবার অধিকার রাখবেন। কাজেই সরকারকে এমন একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার আয়োজন করতে হবে, যেখানে সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান একটি সুশৃঙ্খল সেবাদান ব্যবস্থার আওতায় থাকবে, যেখান থেকে নাগরিকরা সুশৃঙ্খলভাবে মানসম্মত সেবা পাবে।
দুর্ভিক্ষের দেশ এখন চাল দাতা
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ পরপর চারটি শস্য উৎপাদনে মার খায়। ১৯৭১-৭২ সালে আমন উৎপাদন ১৯৬৯-৭০-এর তুলনায় ১৯ শতাংশ কম হয়। প্রয়োজনীয় বীজ, সার, উপকরণের অভাবে বাহাত্তরে বোরো উৎপাদন আগের বছরের চেয়েও ২০ কমে যায়। বাহাত্তর-তেহাত্তরে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম খরায় আউশ ও আমন উৎপাদন মার খায়। ১৯৬৯-৭০ সালে যেখানে ২৯.৬৩ লাখ টন আউস হয়েছিল, বাহাত্তর-তেহাত্তরে তা নামে ২২.৭৩ লাখ টনে। ফলে খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে লবণ, তেলসহ অন্য নিত্যপণ্যের দামও। বিশ্ববাজারেও ওই সময় খাদ্যপণ্য সংকট দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যসহ তেলের দর বেড়ে যায়।
অন্যদিকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ফলে সরকার চেষ্টা করেও প্রয়োজনমতো খাদ্যপণ্য আমদানি করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৩-৭৪ এর অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় বাজারে টাকার সরবরাহও অনেক বেড়ে যায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে দেশে যেখানে মুদ্রার সরবরাহ ছিল ৩৭৮.৫০ কোটি টাকা, তেহাত্তরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯৬ কোটি টাকা। পরের বছর জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৮১৬.৬০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সরকার কলকারখানার শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়ে দেয়। একদিকে খাদ্য সংকট, অন্যদিকে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ায় জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশের প্রথম তিন অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২-এর মার্চে প্রতি সের চালের দাম ছিল ১ টাকা ৪৬ পয়সা। চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের মার্চে তার দাম হয় ৬ টাকা ৬২ পয়সা। ৯৮ পয়সা সেরের গম কিনতে হতো ৫ টাকা ৮২ পয়সা দরে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় লবণের সের ৩৫ টাকায় ওঠে, যেখানে বাহাত্তরের শুরুতে প্রতি সেরের দাম ছিল ৫০ পয়সারও কম।
কেবল উৎপাদন কম হওয়ার কারণেই যে দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছে, তা মনে করেননি তখনকার সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখনকার অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছিল। ফলে ওই সময় সরকার ১০০ টাকার নোট বাতিল করে। টাকার মানও কমানো হয়। ১৯৭৪-৭৫ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়, আমদানি করা জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে, সেজন্য আমদানির লাইসেন্স ফি তুলে নেওয়া হয় এবং নিত্যপণ্যের আমদানি কর কমানো হয়। এসব উদ্যোগ নেওয়ার ফলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি থেকে জিনিসপত্রের দাম কমতে থাকে।
ওই সময়কার বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার পেছনে কেবল উৎপাদনের স্বল্পতাই কারণ ছিল না। চোরাকারবারি, মজুদদারিও এ জন্য দায়ী। এ ছাড়া ওই সময় বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য ভারতেও পাচার হতে থাকে। তা সত্ত্বেও দেশের স্বল্প বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো, যুদ্ধে সড়ক সেতু ও রেলসেতুগুলো ধ্বংস হওয়ায় তা সারা দেশে পৌঁছানো যায়নি।
যুদ্ধে ২৮৭টি রেলওয়ে সেতু কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেল লাইনগুলো উপড়ে ফেলা হয়েছিল। সড়কগুলোর সেতুও পুনর্নিমাণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর চার-পাঁচ মাসের মধ্যে তার কিছুটা মেরামত করা হয়। চারটি প্রধান রেলওয়ে সেতুই মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যা বাংলাদেশের রেল যোগাযোগকে কার্যত অচল করে দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগে ব্যবহৃত এবং মোংলা বন্দরের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ স্থাপনকারী পদ্মা নদীর ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, তিস্তা ব্রিজ, ময়মনসিংহ সেতু ও মেঘনা নদীর ওপর থাকা তখনকার কিং জর্জ সিক্স সেতু। এসব সেতু দেশের দুই বন্দরের সঙ্গে সারা দেশের সংযোগ ঘটিয়ে খাদ্যপণ্য সরবরাহে সহায়ক হতো। এসব সেতু মেরামতে বড় ধরনের প্রকৌশল কর্মযজ্ঞের দরকার হয়ে পড়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালু করে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় ভারত, যা ১৯৭২ সালের শেষ দিকে সিঙ্গেল ট্র্যাক স্পেন বসিয়ে চালু করা সম্ভব হয়। ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে মেঘনা সেতু ও ময়মনসিংহ সেতু মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করা হয়।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অস্টিন রবিনসন ১৯৭২ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সফরকালে চট্টগ্রাম বন্দরে যান। তিনি দেখেন যে, বন্দরে খুব দ্রুতই খাদ্যপণ্য পৌঁছোচ্ছে। কিন্তু সেগুলো বন্দর থেকে সারা দেশে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। বন্দরে আসা খাদ্যপণ্য ঠিকঠাক মতো পৌঁছাতে পারলে দেশে খাদ্য সংকট এতটা প্রকট হতো না।
রবিনসন বলেছেন, বাহাত্তরে বিশ্বজুড়েই খাদ্য উৎপাদন কমে যায়। ফলে নগদ টাকায় খাদ্যপণ্য কিনতে হয়। এ কারণে অন্য সব ধরনের কেনাকাটা বন্ধ রাখতে হয় সরকারকে। ফলে দেশে অন্য পণ্যের সংকট দেখা দেয়। তাতে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধ-পরবর্তী এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ইউরোপের দেশগুলো যেসব পদক্ষেপ নেয়, তা নেওয়ার সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ছিল না। আবার নিজস্ব অর্থায়নে যোগাযোগ অবকাঠামো পুনঃস্থাপন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ পুনর্গঠনও জরুরি হয়ে পড়ে। তখন কিছু দেশ সহায়তার আশ্বাসও দেয়। তবে বিপুল চাহিদার বাংলাদেশের সংকট মোকাবিলায় তা সামান্যই ভূমিকা রাখে।
জন্মকালেই দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদনে বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও কৃষিতে সরকারের প্রণোদনা। বর্তমানে দেশের মোট জমির ৬০ ভাগ সেচের আওতায় এসেছে। ফলে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। উচ্চ ফলনশীল ধানের আবির্ভাবও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছ। বন্যা, খরা, লবণাক্ত তা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। খাদ্য সংকটের দেশ বাংলাদেশ এখন ধান ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে। ২০১৫ সালের মে মাসে বাংলাবান্ধা বন্দর দিয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প কবলিত নেপালে ১০ হাজার টন চাল অনুদান হিসেবে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য হাওরে বন্যা ও ব্লাস্টরোগে উৎপাদন কম হওয়ায় গত বছর আবার আমদানিও করতে হয়েছে।
কেবল খাদ্যশস্য উৎপাদনই নয়, মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে।
ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর চাল ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বদরুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত তিন দশকে দেশে যদিও জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে আরো বেশি হারে; প্রায় তিনগুণ। এতে আত্মপ্রসাদ লাভ করার কোনো কারণ নেই। কারণ খাদ্য নিরাপত্তা শুধু উদরপূর্তির মাধ্যমে পর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ নয়; এর সাথে জটিল অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জৈবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া জড়িত। সেসব ক্ষেত্রে এখনো অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এদের হার যথাক্রমে ছয় দশমিক দুই শতাংশ এবং চার দশমিক শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা আছে। সেটি অর্জনে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
শূন্য থেকে ৩১ বিলিয়ন ডলারে রিজার্ভ
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের সময় বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার কোনো মজুদ ছিল না। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রা যা ছিল, ১৬ ডিসেম্বরের আগে আগে তা নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারিতেও বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রাজকোষ ছিল পুরোই ফাঁকা। ওই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশি টাকায় মোটে ১৭ কোটি ২৬ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা জমে সরকারের কোষাগারে, যা তখনকার ডলারে মাত্র ২১ মিলিয়ন। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় মোটে ৯৬ কোটি টাকা। তারপর থেকে রেমিটেন্সের ওপর ভর করে বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়াতে পারেনি।
১৯৮১ সালে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ১২১ মিলিয়ন ডলার, পরের ১০ বছরে তা বেড়ে হয় ৮২৫ মিলিয়ন ডলারে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৩৮৬ ডলার। ২০১০ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য গত বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার কারণেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস পেয়েছে বাংলাদেশ।
কম রপ্তানি করে বেশি আমদানি করা বাংলাদেশের রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা প্রবাসীদের। কারণ, জন্ম থেকেই বাংলাদেশ রপ্তানির তুলনায় আমদানি করেছে অনেক বেশি। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ২৯৮ কোটি টাকা, আমদানি হয় ৭৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঘাটতি ছিল ৪৩৩ কোটি টাকা। এরপর যতই দিন গেছে, রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানিও। গত অর্থবছর আমদানি হয়েছে ৫৯ বিলিয়ন ডলারের, রপ্তানি হয়েছে ৩৭ বিলিয়ন ডলার।
নাতি-পুতির প্রশ্নের উত্তর দেবেন কি?
জন্ম নেওয়ার সময়ই অর্ধেক সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলছে বাংলাদেশের শিশুরা। ধনী দেশগুলোতে জন্ম নেওয়া শিশু বড় হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যতটা সফল হবে, বাংলাদেশে আজ জন্ম নেওয়া শিশু পড়ে থাকবে তার অর্ধেক দূরত্ব পেছনে।
বাংলাদেশে আজ যে কন্যাশিশুটি জন্ম নিচ্ছে, দেশের বিদ্যমান পুরো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা ভোগ করে যখন সে বড় হবে, তখন তার উৎপাদনশীলতা হবে ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখনো তার দেশের শিশুদের জন্য উপযুক্ত মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষম মানুষগুলো পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অভাবে অন্য দেশের মানুষের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, উৎপাদনক্ষমতা ও দক্ষতায় পিছিয়ে থাকবে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্সে (মানবসম্পদ সূচক) বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন তথ্যই রয়েছে।
কোনো দেশ তার শিশুদের জন্য সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করলে ওই দেশের স্কোর বা নম্বর ১ ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের স্কোর এ ক্ষেত্রে দশমিক ৪৮। অর্থাৎ শিশুদের জন্য সর্বোচ্চ যে মানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থাকা দরকার, বাংলাদেশে তার অর্ধেকও নেই।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে নেপাল দশমিক ৪৯ ও শ্রীলঙ্কা দশমিক ৫৮ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। এছাড়া ভারতের স্কোর দশমিক ৪৪, পাকিস্তানের দশমিক ৩৯ ও মিয়ানমারের দশমিক ৪৭। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ চীনের স্কোর দশমিক ৬৭।
বাংলাদেশের শিশুদের ৩৬ শতাংশই শরীরের প্রতি যতœশীল নয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর ফলে শারীরিক দুর্বলতা ও অক্ষমতা নিয়ে তাদের সারা জীবন বেঁচে থাকতে হয়।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আজ যে শিশুটি জন্ম নিল, তার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৩ শতাংশ শিশু পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই মারা যাচ্ছে। আর যে শিশুটি ১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচল, ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সের মধ্যে বিভিন্ন রোগে তাদের ১৩ শতাংশই মারা যায়।
গত অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেন, প্রযুক্তির বিকাশ আগামী দিনে মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। অটোমেশন, রোবটের ব্যবহার বাড়লে একদিকে কাজ কমে যাবে, অন্যদিকে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। নয়া সেই কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে এখন থেকেই উপযুক্ত শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে নতুন প্রজন্মকে। না হলে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে টিকে থাকাই মুশকিল হবে নিজেদের।
জিম ইয়ং কিম বলেন, প্রযুক্তি যদি প্রত্যাশা বাড়ায় এবং কাজের ধরন পাল্টে দেয়, আমাদের অবশ্যই কিছু কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। মানুষ তাহলে কী করবে? কীভাবে তারা তাদের পরিবারের খরচ মেটাবে? জটিল বিশ্ব ব্যবস্থায় মানুষ কীভাবে তার স্বপ্ন পূরণ করবে?
‘উত্তর একটিই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। জনগণের জন্য সরকারগুলোর উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষ যাতে তার সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগাতে পারে, সেজন্য উপযুক্ত শিক্ষা, দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
‘আমাদের নাতি-পুতিরা যখন প্রশ্ন করবে তুমি যখন জানলে দুনিয়া আমার জন্য খুবই কঠিন হবে, তখন আমার ভালোর জন্য তুমি কী করেছিলে? তুমি যখন দেখলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের মধ্য দিয়েই পুরো দেশের কোটি মানুষের উন্নয়ন সম্ভব ছিল, তখন তুমি আমার জন্য কী করেছ? এখনই প্রস্তুতি না নিলে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কিছু থাকবে না’Ñ সতর্ক করে দেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট।
থ্রিজি সুবিধা সম্প্রসারণের পর বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত দেশের মোট ৮ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫২.২০%। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে মোবাইলে টেলিমেডিসিন সেবা, ই-কমার্সসহ নানা সেবার ব্যবহার বাড়ছে।