সুস্বাস্থ্য পরমায়ুতে উজ্জ্বল বাংলাদেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
মাত্র সোয়া দুই বছর; উদযাপন করব বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। নেওয়া হচ্ছে নানা প্রস্তুতি। স্বাধীনতার ঠিক পরপর বিভিন্ন খাতে আমাদের অবস্থা কী ছিল, এখন কেমন তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের চিন্তাভাবনা অনেকেই করতে শুরু করেছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ কেমন হবে, তার একটি রূপরেখা ‘রূপকল্প ২০২১’ নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রকাশ করেছিল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে। ২০৩০ সালে বাংলাদেশ কেমন হবে তারও একটি চিত্রকল্প পেশ করেছিল আরেকটি রাজনৈতিক দল।
এসব প্রকাশনা থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা ও আপামর জনগণ সমালোচনায় অতীতাশ্রয়ী হলেও সবাই সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। সে কারণেই রাজনীতিবিদদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে হয়, দিকনির্দেশনা দিতে হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের চিন্তাভাবনাগুলোকে প্রভাবিত করে বিভিন্ন তথ্যভিত্তিক নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ এবং পেশাজীবীদের মতামত। এই নিবন্ধের অবতারণা সে রকম প্রেক্ষাপট থেকেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হবার পর ১৯৭২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি মাত্র। তখন আমাদের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪০ বছর। আজকের বাংলাদেশে ৭৩ বছর গড় আয়ু নিয়ে যখন ১৯৭২ সালকে স্মরণ করি, তখন আমাদের কাছে এক বিস্ময় মনে হয়।
‘অর্থনৈতিক দারিদ্র্য সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতের ব্যতিক্রমী অর্জন এক বৈপরীত্য; আরেকটি বিস্ময়। বাংলাদেশের অনেক কিছুই অবাক করা। এখানে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু হার, জন্মহার ধারাবাহিকভাবে কমেছে; টিকার হার বেড়েছে; যক্ষ্মার প্রকোপ কমেছে। কিন্তু কমেনি অপুষ্টি, বাড়েনি স্বাস্থ্যসেবার ব্যবহার। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সমাজের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী ও নারীদের সেবাপ্রদান বরাবর অগ্রাধিকার পেয়েছে। এজন্য অন্য অনেক কারণের মধ্যে যে কারণটিকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সংক্রান্ত ল্যান্সেট সিরিজে গবেষকরা অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করেছে তা হলো- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান সাম্যতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বাস্থ্য খাত এই চেতনাটিকে কেবল ধারণই করেনি, বাস্তবায়নও করেছে।
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রসারের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৩১ শয্যার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গড়ার পাশাপাশি গুটি বসন্ত নির্ভর যক্ষ্মা এবং ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সরকার মনোনিবেশ করে। ১৯৭৬ সালের জনসংখ্যা নীতি; অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনগণের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি স্বাস্থ্য উন্নয়নে অবদান রেখেছে। আমলাতন্ত্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সুস্পষ্ট বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৮২ সালে নেওয়া জাতীয় ওষুধনীতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত এবং শিল্প খাতের অগ্রগতিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে।
প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের বাংলাদেশের ওষুধের বাজার; বাংলাদেশের ওষুধ এখন আমেরিকাসহ প্রায় ১৫০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানির মালিক আর নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আইনপ্রণেতাদের স্বার্থসংঘাত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ওষুদের দাম সাম্প্রতিককাল ছাড়া অনেকদিন খুব একটা বাড়েনি।
এনজিওদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে সরকারের উদারনীতি এবং সহযোগিতার হাত জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচির দ্রুত প্রসারে প্রভাব ফেলেছে। যুদ্ধকালীন হাসপাতালের আদলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় গ্রামীণ নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও চাকরির সুযোগ দেওয়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ইতিহাসে একটা বড় ঘটনা। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) আলমা আতা ঘোষণা মূলত বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার কাঠামোরই প্রতিফলন। খাবার স্যালাইন, ঘরে ঘরে গিয়ে পরিবার পরিকল্পনার সেবা পৌঁছানোর কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম, যক্ষ্মারোগীকে চোখের সামনে ওষুধ খাইয়ে দেওয়া, খোলা মাঠে পায়খানা বন্ধ, কমিউনিটি লেড টোটাল স্যানিটেশন- এ সবই বাংলাদেশে উদ্ভাবিত; যা পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জনস্বাস্থ্যের এসব সেবা মূলত স্বাস্থ্যকর্মীরাই দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটেছে জনমানুষের দ্বারা।
এছাড়া, স্বাস্থ্য খাতে বহুমুখী এবং অনিয়ন্ত্রিত বাজারকেন্দ্রিক সেবার প্রচলন শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসে প্রাথমিকভাবে প্রভাব ফেলেছে। উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীকে রাখা; এনজিওদের নারীকেন্দ্রিক উন্নয়ন, নারীকেন্দ্রিক ক্ষুদ্রঋণ, নারীশিক্ষা ইত্যাদি স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বিশেষত সাম্যতা ও ন্যায্যতার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া রয়েছে চার দশকব্যাপী বিদেশি সাহায্য, নতুন নতুন উদ্ভাবন, গবেষণা ও মূল্যায়ন এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন। এ সাফল্য কেবল একটি সরকারের সাফল্যের পালকের সংখ্যা বাড়াবে না; বরং বিভিন্ন সরকারের আমলে নেওয়া ও ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্য খাতের কর্মসূচির সাফল্যকে বিবৃত করেছে।
সাফল্যের এসব পালক মাথায় নিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংক্রান্ত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে গিয়ে আমরা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। এসডিজি অর্জনে বাকি আছে আর মাত্র ১২ বছর; কিন্তু এখনো আমরা সবগুলো সূচকের পরিমাপের বেসলাইনই করতে পারিনি। অপুষ্টি কমানোর ক্ষেত্রে আমাদের শৈথিল্য; মাতৃ মৃত্যুহার স্থির হয়ে থাকা এবং সর্বোপরি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তেমন কোনো অর্জন দেখাতে না পারা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসনের অভাব এবং ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নানা রকম কর্মসূচির অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। অসংগঠিত প্রাইভেট সেক্টরের উদ্ভব এবং দেশজুড়ে গড়ে ওঠা প্রায় দু’লাখ ওষুধের দোকান রয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ এদের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ বা নিবন্ধনের ব্যাপারে নিশ্চুপ। অনিয়ন্ত্রিত ও অনিবন্ধিত থাকার কারণে এসব দোকানপাটে ওষুধের বিশেষত অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বাড়ছে, গড় চিকিৎসা খরচ বাড়ছে। বাংলাদেশে গড় চিকিৎসা খরচ এরই মধ্যে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অনিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট সেক্টরের কারণে এই ব্যয় আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতির সুফল বাংলাদেশের মানুষ ও শিল্প খাত পেতে শুরু করলেও এর মূলনীতিগুলোকে পাশ কাটিয়ে ওষুধের দাম আবারো মানুষের সাধ্যের বাইরে যেতে শুরু করেছে। ওষুধের মান, মূল্য ও নীতিনির্ধারণী সংস্থায় কোম্পানির মালিক কাম আইনপ্রণেতাদের স্বার্থসংঘাতমূলক উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সময় এসেছে। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে কিছু সংস্কার করতে হবে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে অনেকে স্বাস্থ্যবিমার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণাটি এরকম যে, প্রতিটি নাগরিক তার স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে মানসম্মত সেবা পাবে এবং এই সেবা পেতে গিয়ে তাকে যেন কোনরকম অর্থ কষ্টে পড়তে না হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে নাগরিককে যেন ধারকর্জ করতে না হয়, ঘটিবাটি বিক্রি করতে না হয়। অন্যদিকে একজন ধনী যে মানের সেবা পাবে, একজন সাধারণ নাগরিকও সে মানের সেবা পাবার অধিকার রাখবেন। কাজেই সরকারকে এমন একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার আয়োজন করতে হবে, যেখানে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান একটি সুশৃঙ্খল সেবাদান ব্যবস্থার আওতায় থাকবে, যেখান থেকে নাগরিকরা সুশৃঙ্খলভাবে মানসম্মত সেবা পাবে। আর এই সেবামূল্য অর্থায়নের ব্যাপারে সরকার এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, যেখানে নাগরিক তার সামর্থ্যমাফিক নিজে; চাকরিরত হলে তার প্রতিষ্ঠান কিংবা সমিতি এবং সরকার মিলে নিশ্চিত করবে যেন সেবা পেতে গিয়ে নাগরিককে কোনো অর্থকষ্টে পড়তে না হয়। এই ব্যবস্থার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানি থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। সরকার নিজেই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে পারে। কাজেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সরকারকে প্রথমেই সেবার ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে, যেখানে সরকারি-বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানই সরকারের তত্ত্বাবধানে মানসম্পন্ন সেবা দেবে।
এখন দেখা যাক সেবার মান উন্নত করার ব্যাপারে সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে। জেলা এবং বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রোগীর ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা। অন্যদিকে উপজেলা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি সেবার পর্যাপ্ত ব্যবহার হচ্ছে না। এর মূল কারণ জনবল সংকট। চুক্তিভিত্তিতে অবসরের পরেও সচিব নিয়োগ করা যায়; কিন্তু উপজেলা বা ইউনিয়নে চুক্তিভিত্তিতে ডাক্তার ও অন্যান্য স্টাফ নিয়োগ করার নজির দেখা যায় না। এছাড়া এসব পর্যায়ে থাকা বেসরকারি খাতে নিয়োজিত ডাক্তার এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের সেবাদানকারীর আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা এখনো সফলতার সঙ্গে করা যায়নি। প্রথম দিকে এই ছোট্ট দুটি সংস্কার করা গেলে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবায় একটা ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। কীভাবে বেসরকারি খাতের সেবাদানকারীকে সামগ্রিক সেবার আওতাভুক্ত করা হবে এবং কীভাবে তাদের পারিতোষিক প্রদান করা হবে- সে ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের ধ্যানধারণা আছে, যা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে এসবের পাশাপাশি রয়েছে দুর্নীতিসহ নানা রকম সুশাসনের ঘাটতি। চৌগাছা ও ঝিনাইদহতে একজন ডা. এমদাদ এবং একজন পৌর মেয়র মিন্টু করে দেখিয়েছেন যে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং তা বাস্তবায়িত করা গেলে সীমিত সম্পদের মধ্যেও সেবার মানোন্নয়ন সম্ভব। কোটি টাকার প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের সব উপজেলায় কীভাবে এমন নেতৃত্ব স্কেল আপ (গড়ে তোলা) সম্ভব হবে?
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অর্থায়নের একটি কৌশলপত্র ২০১২ সালে অনুমোদিত হয়েছিল। পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে, ২০৩২ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে কৌশলগুলো বাস্তবায়িত হবে। কৌশলপত্রে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে ও অনানুষ্ঠানিক খাতে প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষ জড়িত আছে, তাদের সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার আওতায় এনে সামগ্রিক অর্থায়নের ৩২% আহরণ করা যাবে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন মাইক্রো ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যবিমার হিসাব-নিকাশ দেখে এই কৌশলকে এখন আর সম্ভাবনাময় বিবেচনা করা যাচ্ছে না। এছাড়া সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা করার জন্য যে ধরনের সক্ষমতা সরকারি এবং বেসরকারি খাতে থাকা দরকার তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। সর্বোপরি বাংলাদেশে আয়কর জিডিপি অনুপাতও অত্যন্ত অপ্রতুল; সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার জন্য অনুকূল নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হামিদ নানারকম বিশ্লেষণ ও প্রাক্কলন করে দেখিয়েছেন যে, এরচেয়ে সরকার প্রবর্তিত স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির আদলে যদি দেশের সমস্ত দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সরকার বাৎসরিক প্রিমিয়াম দিয়ে একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনে, তাহলে বছরে মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এই পরিমাণ টাকা আসলে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বাৎসরিক বাজেটের ৮.৫% মাত্র। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সামগ্রিক ব্যয়ের যে প্রবণতা, তাতে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা প্রতিবছরই অব্যয়িত থেকে যায়। কাজেই এই প্রস্তাবনাটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এটা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের সকল দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার আওতার আসবে। ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ অর্থাৎ এসডিজির অন্যতম মূলশর্ত এই প্রক্রিয়ায় পূরণ করা যাবে।
নির্বাচনী ইশতেহার কিংবা স্বাস্থ্য খাত সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্জন করতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা ভিন্ন স্বাস্থ্য খাতের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার সংক্রান্ত সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মতামত কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে, পেশাজীবীসহ সকল অংশীজনদের নিয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশ ধাপে ধাপে কিংবা বৈপ্লবিকভাবে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার এনেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার কীভাবে করা হবে, সে সিদ্ধান্ত দ্রুত রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে।
আমরা যারা জনস্বাস্থ্য পেশায় নিয়োজিত, আমাদের মধ্যে রয়েছে এক মিশ্র অনুভূতি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক অর্জনে আমরা যেমন গর্বিত, তেমনি রয়েছে কিছু আফসোসও; হয়তো আমরা আরো ভালো করতে পারতাম। আমরা আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগে থেমে থাকার পাত্র নই। আমাদের অর্জন আমাদের আশান্বিত করে; উদ্দীপ্ত করে সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আমরা স্বপ্ন দেখি এমন এক বাংলাদেশের, যেখানে সকল নাগরিক মানসম্মত স্বাস্থ্য সুবিধা পাচ্ছেন কোনোরকম অর্থকষ্ট ছাড়াই। আমাদের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসে সুস্থ্য-সবল বাঙালি, ন্যূনতম ২১২২ কিলোক্যালোরি খাবারের নিশ্চয়তায় হৃষ্টপুষ্ট জাতি, যারা এস এম সুলতানের ছবির মতো পেশিবহুল পৌরুষদীপ্ত; সুঠাম যুবতী, ঋতুমতী, পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিনের লালিমায় আপন প্রভায় উজ্জ্বল। যৌথ প্রচেষ্টার কর্ষিত জমিতে উভয়ে মিলে রোপণ করে সুপুষ্ট চারা, বেড়ে ওঠে ফসল; উদ্দাম বাতাসে হাত-পা ছড়িয়ে বেড়ে ওঠে শিশু; উজ্জ্বল স্বাস্থ্য আর পরমায়ুতে বেড়ে ওঠে সমৃদ্ধিশীল জাতি ২০৩০ সালের মধ্যে। আমরা আশাবাদী স্বাস্থ্য পরমায়ুতে উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়ে উঠবে রাজনীতিবিদদের দিকনির্দেশনায়; অংশীজন ও জনমানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই।
শেয়ার করুন
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

মাত্র সোয়া দুই বছর; উদযাপন করব বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। নেওয়া হচ্ছে নানা প্রস্তুতি। স্বাধীনতার ঠিক পরপর বিভিন্ন খাতে আমাদের অবস্থা কী ছিল, এখন কেমন তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের চিন্তাভাবনা অনেকেই করতে শুরু করেছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ কেমন হবে, তার একটি রূপরেখা ‘রূপকল্প ২০২১’ নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রকাশ করেছিল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে। ২০৩০ সালে বাংলাদেশ কেমন হবে তারও একটি চিত্রকল্প পেশ করেছিল আরেকটি রাজনৈতিক দল।
এসব প্রকাশনা থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা ও আপামর জনগণ সমালোচনায় অতীতাশ্রয়ী হলেও সবাই সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। সে কারণেই রাজনীতিবিদদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে হয়, দিকনির্দেশনা দিতে হয়। তবে এসব ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের চিন্তাভাবনাগুলোকে প্রভাবিত করে বিভিন্ন তথ্যভিত্তিক নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ এবং পেশাজীবীদের মতামত। এই নিবন্ধের অবতারণা সে রকম প্রেক্ষাপট থেকেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হবার পর ১৯৭২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি মাত্র। তখন আমাদের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪০ বছর। আজকের বাংলাদেশে ৭৩ বছর গড় আয়ু নিয়ে যখন ১৯৭২ সালকে স্মরণ করি, তখন আমাদের কাছে এক বিস্ময় মনে হয়।
‘অর্থনৈতিক দারিদ্র্য সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতের ব্যতিক্রমী অর্জন এক বৈপরীত্য; আরেকটি বিস্ময়। বাংলাদেশের অনেক কিছুই অবাক করা। এখানে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু হার, জন্মহার ধারাবাহিকভাবে কমেছে; টিকার হার বেড়েছে; যক্ষ্মার প্রকোপ কমেছে। কিন্তু কমেনি অপুষ্টি, বাড়েনি স্বাস্থ্যসেবার ব্যবহার। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সমাজের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী ও নারীদের সেবাপ্রদান বরাবর অগ্রাধিকার পেয়েছে। এজন্য অন্য অনেক কারণের মধ্যে যে কারণটিকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সংক্রান্ত ল্যান্সেট সিরিজে গবেষকরা অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করেছে তা হলো- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান সাম্যতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বাস্থ্য খাত এই চেতনাটিকে কেবল ধারণই করেনি, বাস্তবায়নও করেছে।
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রসারের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৩১ শয্যার থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গড়ার পাশাপাশি গুটি বসন্ত নির্ভর যক্ষ্মা এবং ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সরকার মনোনিবেশ করে। ১৯৭৬ সালের জনসংখ্যা নীতি; অবকাঠামো নির্মাণ এবং জনগণের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি স্বাস্থ্য উন্নয়নে অবদান রেখেছে। আমলাতন্ত্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সুস্পষ্ট বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৮২ সালে নেওয়া জাতীয় ওষুধনীতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত এবং শিল্প খাতের অগ্রগতিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে।
প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের বাংলাদেশের ওষুধের বাজার; বাংলাদেশের ওষুধ এখন আমেরিকাসহ প্রায় ১৫০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানির মালিক আর নিয়ন্ত্রক সংস্থায় আইনপ্রণেতাদের স্বার্থসংঘাত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ওষুদের দাম সাম্প্রতিককাল ছাড়া অনেকদিন খুব একটা বাড়েনি।
এনজিওদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে সরকারের উদারনীতি এবং সহযোগিতার হাত জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচির দ্রুত প্রসারে প্রভাব ফেলেছে। যুদ্ধকালীন হাসপাতালের আদলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় গ্রামীণ নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও চাকরির সুযোগ দেওয়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ইতিহাসে একটা বড় ঘটনা। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) আলমা আতা ঘোষণা মূলত বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার কাঠামোরই প্রতিফলন। খাবার স্যালাইন, ঘরে ঘরে গিয়ে পরিবার পরিকল্পনার সেবা পৌঁছানোর কমিউনিটিভিত্তিক কার্যক্রম, যক্ষ্মারোগীকে চোখের সামনে ওষুধ খাইয়ে দেওয়া, খোলা মাঠে পায়খানা বন্ধ, কমিউনিটি লেড টোটাল স্যানিটেশন- এ সবই বাংলাদেশে উদ্ভাবিত; যা পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জনস্বাস্থ্যের এসব সেবা মূলত স্বাস্থ্যকর্মীরাই দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটেছে জনমানুষের দ্বারা।
এছাড়া, স্বাস্থ্য খাতে বহুমুখী এবং অনিয়ন্ত্রিত বাজারকেন্দ্রিক সেবার প্রচলন শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসে প্রাথমিকভাবে প্রভাব ফেলেছে। উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীকে রাখা; এনজিওদের নারীকেন্দ্রিক উন্নয়ন, নারীকেন্দ্রিক ক্ষুদ্রঋণ, নারীশিক্ষা ইত্যাদি স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বিশেষত সাম্যতা ও ন্যায্যতার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া রয়েছে চার দশকব্যাপী বিদেশি সাহায্য, নতুন নতুন উদ্ভাবন, গবেষণা ও মূল্যায়ন এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন। এ সাফল্য কেবল একটি সরকারের সাফল্যের পালকের সংখ্যা বাড়াবে না; বরং বিভিন্ন সরকারের আমলে নেওয়া ও ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্য খাতের কর্মসূচির সাফল্যকে বিবৃত করেছে।
সাফল্যের এসব পালক মাথায় নিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংক্রান্ত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে গিয়ে আমরা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। এসডিজি অর্জনে বাকি আছে আর মাত্র ১২ বছর; কিন্তু এখনো আমরা সবগুলো সূচকের পরিমাপের বেসলাইনই করতে পারিনি। অপুষ্টি কমানোর ক্ষেত্রে আমাদের শৈথিল্য; মাতৃ মৃত্যুহার স্থির হয়ে থাকা এবং সর্বোপরি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তেমন কোনো অর্জন দেখাতে না পারা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসনের অভাব এবং ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নানা রকম কর্মসূচির অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। অসংগঠিত প্রাইভেট সেক্টরের উদ্ভব এবং দেশজুড়ে গড়ে ওঠা প্রায় দু’লাখ ওষুধের দোকান রয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ এদের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ বা নিবন্ধনের ব্যাপারে নিশ্চুপ। অনিয়ন্ত্রিত ও অনিবন্ধিত থাকার কারণে এসব দোকানপাটে ওষুধের বিশেষত অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বাড়ছে, গড় চিকিৎসা খরচ বাড়ছে। বাংলাদেশে গড় চিকিৎসা খরচ এরই মধ্যে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অনিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট সেক্টরের কারণে এই ব্যয় আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতির সুফল বাংলাদেশের মানুষ ও শিল্প খাত পেতে শুরু করলেও এর মূলনীতিগুলোকে পাশ কাটিয়ে ওষুধের দাম আবারো মানুষের সাধ্যের বাইরে যেতে শুরু করেছে। ওষুধের মান, মূল্য ও নীতিনির্ধারণী সংস্থায় কোম্পানির মালিক কাম আইনপ্রণেতাদের স্বার্থসংঘাতমূলক উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সময় এসেছে। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে কিছু সংস্কার করতে হবে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে অনেকে স্বাস্থ্যবিমার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণাটি এরকম যে, প্রতিটি নাগরিক তার স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে মানসম্মত সেবা পাবে এবং এই সেবা পেতে গিয়ে তাকে যেন কোনরকম অর্থ কষ্টে পড়তে না হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে নাগরিককে যেন ধারকর্জ করতে না হয়, ঘটিবাটি বিক্রি করতে না হয়। অন্যদিকে একজন ধনী যে মানের সেবা পাবে, একজন সাধারণ নাগরিকও সে মানের সেবা পাবার অধিকার রাখবেন। কাজেই সরকারকে এমন একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার আয়োজন করতে হবে, যেখানে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান একটি সুশৃঙ্খল সেবাদান ব্যবস্থার আওতায় থাকবে, যেখান থেকে নাগরিকরা সুশৃঙ্খলভাবে মানসম্মত সেবা পাবে। আর এই সেবামূল্য অর্থায়নের ব্যাপারে সরকার এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, যেখানে নাগরিক তার সামর্থ্যমাফিক নিজে; চাকরিরত হলে তার প্রতিষ্ঠান কিংবা সমিতি এবং সরকার মিলে নিশ্চিত করবে যেন সেবা পেতে গিয়ে নাগরিককে কোনো অর্থকষ্টে পড়তে না হয়। এই ব্যবস্থার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানি থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। সরকার নিজেই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে পারে। কাজেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সরকারকে প্রথমেই সেবার ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে, যেখানে সরকারি-বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানই সরকারের তত্ত্বাবধানে মানসম্পন্ন সেবা দেবে।
এখন দেখা যাক সেবার মান উন্নত করার ব্যাপারে সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে। জেলা এবং বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রোগীর ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা। অন্যদিকে উপজেলা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি সেবার পর্যাপ্ত ব্যবহার হচ্ছে না। এর মূল কারণ জনবল সংকট। চুক্তিভিত্তিতে অবসরের পরেও সচিব নিয়োগ করা যায়; কিন্তু উপজেলা বা ইউনিয়নে চুক্তিভিত্তিতে ডাক্তার ও অন্যান্য স্টাফ নিয়োগ করার নজির দেখা যায় না। এছাড়া এসব পর্যায়ে থাকা বেসরকারি খাতে নিয়োজিত ডাক্তার এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের সেবাদানকারীর আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা এখনো সফলতার সঙ্গে করা যায়নি। প্রথম দিকে এই ছোট্ট দুটি সংস্কার করা গেলে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবায় একটা ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। কীভাবে বেসরকারি খাতের সেবাদানকারীকে সামগ্রিক সেবার আওতাভুক্ত করা হবে এবং কীভাবে তাদের পারিতোষিক প্রদান করা হবে- সে ব্যাপারে বিভিন্ন রকমের ধ্যানধারণা আছে, যা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে এসবের পাশাপাশি রয়েছে দুর্নীতিসহ নানা রকম সুশাসনের ঘাটতি। চৌগাছা ও ঝিনাইদহতে একজন ডা. এমদাদ এবং একজন পৌর মেয়র মিন্টু করে দেখিয়েছেন যে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং তা বাস্তবায়িত করা গেলে সীমিত সম্পদের মধ্যেও সেবার মানোন্নয়ন সম্ভব। কোটি টাকার প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের সব উপজেলায় কীভাবে এমন নেতৃত্ব স্কেল আপ (গড়ে তোলা) সম্ভব হবে?
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অর্থায়নের একটি কৌশলপত্র ২০১২ সালে অনুমোদিত হয়েছিল। পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে, ২০৩২ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে কৌশলগুলো বাস্তবায়িত হবে। কৌশলপত্রে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে ও অনানুষ্ঠানিক খাতে প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষ জড়িত আছে, তাদের সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার আওতায় এনে সামগ্রিক অর্থায়নের ৩২% আহরণ করা যাবে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন মাইক্রো ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যবিমার হিসাব-নিকাশ দেখে এই কৌশলকে এখন আর সম্ভাবনাময় বিবেচনা করা যাচ্ছে না। এছাড়া সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা করার জন্য যে ধরনের সক্ষমতা সরকারি এবং বেসরকারি খাতে থাকা দরকার তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। সর্বোপরি বাংলাদেশে আয়কর জিডিপি অনুপাতও অত্যন্ত অপ্রতুল; সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার জন্য অনুকূল নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হামিদ নানারকম বিশ্লেষণ ও প্রাক্কলন করে দেখিয়েছেন যে, এরচেয়ে সরকার প্রবর্তিত স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির আদলে যদি দেশের সমস্ত দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সরকার বাৎসরিক প্রিমিয়াম দিয়ে একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনে, তাহলে বছরে মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এই পরিমাণ টাকা আসলে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বাৎসরিক বাজেটের ৮.৫% মাত্র। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সামগ্রিক ব্যয়ের যে প্রবণতা, তাতে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা প্রতিবছরই অব্যয়িত থেকে যায়। কাজেই এই প্রস্তাবনাটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এটা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের সকল দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার আওতার আসবে। ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ অর্থাৎ এসডিজির অন্যতম মূলশর্ত এই প্রক্রিয়ায় পূরণ করা যাবে।
নির্বাচনী ইশতেহার কিংবা স্বাস্থ্য খাত সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্জন করতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা ভিন্ন স্বাস্থ্য খাতের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার সংক্রান্ত সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মতামত কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে, পেশাজীবীসহ সকল অংশীজনদের নিয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশ ধাপে ধাপে কিংবা বৈপ্লবিকভাবে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার এনেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার কীভাবে করা হবে, সে সিদ্ধান্ত দ্রুত রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে।
আমরা যারা জনস্বাস্থ্য পেশায় নিয়োজিত, আমাদের মধ্যে রয়েছে এক মিশ্র অনুভূতি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক অর্জনে আমরা যেমন গর্বিত, তেমনি রয়েছে কিছু আফসোসও; হয়তো আমরা আরো ভালো করতে পারতাম। আমরা আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগে থেমে থাকার পাত্র নই। আমাদের অর্জন আমাদের আশান্বিত করে; উদ্দীপ্ত করে সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আমরা স্বপ্ন দেখি এমন এক বাংলাদেশের, যেখানে সকল নাগরিক মানসম্মত স্বাস্থ্য সুবিধা পাচ্ছেন কোনোরকম অর্থকষ্ট ছাড়াই। আমাদের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসে সুস্থ্য-সবল বাঙালি, ন্যূনতম ২১২২ কিলোক্যালোরি খাবারের নিশ্চয়তায় হৃষ্টপুষ্ট জাতি, যারা এস এম সুলতানের ছবির মতো পেশিবহুল পৌরুষদীপ্ত; সুঠাম যুবতী, ঋতুমতী, পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিনের লালিমায় আপন প্রভায় উজ্জ্বল। যৌথ প্রচেষ্টার কর্ষিত জমিতে উভয়ে মিলে রোপণ করে সুপুষ্ট চারা, বেড়ে ওঠে ফসল; উদ্দাম বাতাসে হাত-পা ছড়িয়ে বেড়ে ওঠে শিশু; উজ্জ্বল স্বাস্থ্য আর পরমায়ুতে বেড়ে ওঠে সমৃদ্ধিশীল জাতি ২০৩০ সালের মধ্যে। আমরা আশাবাদী স্বাস্থ্য পরমায়ুতে উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়ে উঠবে রাজনীতিবিদদের দিকনির্দেশনায়; অংশীজন ও জনমানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই।