শিক্ষার গুণগত মান রাখা সম্ভব হচ্ছে না
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
দেশ স্বাধীনের পর কীভাবে দেশে শিক্ষার প্রসার ঘটল?
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন শিক্ষার গুরুত্বটা আমাদের দেশের মানুষ তেমনভাবে অনুধাবন করেনি। ব্রিটিশ শাসনামলে যেহেতু ইংরেজি শিক্ষা বেশি প্রভাবিত ছিল, তখন থেকেই বাঙালি মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অনেক অনীহা ছিল। সেই আমলে মানুষ ফতোয়া দিত, ইংরেজি হচ্ছে ইহুদিদের শিক্ষা। গোটা উপমহাদেশেই একই অবস্থা তৈরি হয়েছিল। ফলে স্যার সৈয়দ আহমদ আধুনিক শিক্ষার জন্য আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ওই সময়ে সাধারণ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। তারা জমির মালিক ছিল না, তারা ছিল বর্গাচাষি। তারা মূলত নি¤œবিত্ত ছিল। ফলে লেখাপড়ার প্রয়োজনীয়তা তারা তখন অনুভব করেনি।
এরপর যখন দেশ স্বাধীন হলো তখন দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে, অফিস-আদালতে কাজ করার জন্য শিক্ষিত মানুষের চাহিদা তৈরি হলো। কারণ, দেশ স্বাধীনের আগে দেশ পরিচালনা করত অবাঙালিরা। ফলে স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শিক্ষার ওপর জোর দিলেন। কারণ স্কুলের শিক্ষক, ম্যানেজার, কেরানি, পিয়নসহ অনেক কর্মকর্তার প্রয়োজন হলো।
তখন উচ্চশিক্ষা ছিল দুর্লভ। ওই সময় যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল ন্যূনতম গ্রাজুয়েট এমন কিছু তরুণদের ইস্ট ইউরোপীয় দেশগুলোতে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসলেন বঙ্গবন্ধু। তখন তারাই দেশে বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের চাকরিতে নিয়োগ পেলেন। এর পর থেকেই দেশে শিক্ষার গুরুত্ব তৈরি হলো, সাধারণ মানুষও এর গুরুত্ব অনুধাবন করল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী বাড়তে শুরু করল।
দেশ স্বাধীনের সময় দেশে মাত্র ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেখানে মাত্র ১২ হাজার ছাত্র পড়াশোনা করত। এসব প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য পাওয়া যেত না, তেমনি লেখাপড়া করার জন্য অনুমতিও ছিল না। ওইসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাত্র ৪ জন ছাত্রী পড়েছিল। প্রথমে তারা পড়তে চাইলেও তাদের ভর্তি করা হয়নি। পরে তারা হাইকোর্ট থেকে রায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেছে। বর্তমানে এ অবস্থা নেই। গোটা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
দেশে বর্তমানে কয়েক লাখ স্কুল রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজের সংখ্যা প্রায় ২ হাজারের বেশি, মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ৩ হাজারের বেশি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪৯টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মোট ১০৩টি। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বর্তমানে মোট ৩৮ লক্ষ ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। এ পর্যায়ে ছাত্রীর সংখ্যা ৪২ থেকে ৪৩ শতাংশ। আগে যেখানে কয়েক কিলোমিটার পর পর একটা স্কুল খুঁজে পাওয়া যেত না সেখানে প্রতি গ্রামেই একটা করে স্কুল। এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, গ্রাম থেকে শহরে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব নেই। ফলে এখন লেখাপড়া অনেক সহজলভ্য হয়েছে। আর এই সহজলভ্য হওয়ার কারণে লেখাপড়ার প্রতি মানুষের অনেক আগ্রহ বেড়েছে। বর্তমানে যুগের চাহিদার কারণে আমাদের দেশে অনেক বেশি ডাক্তার প্রয়োজন, কৃষিবিদ প্রয়োজন, ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন, দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন হওয়ার কারণে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়িয়েছে সরকার। স্কুল থেকে শুরু করে, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ, মাদ্রাসা সবই বেড়েছে। লেখাপড়া আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে।
উচ্চশিক্ষার প্রসার হয়েছে, বিস্তার হয়েছে। লেখাপড়া মানুষের নাগালের মধ্যে এসেছে কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গুণগত শিক্ষার। চাহিদার তুলতায় আমাদের দেশে গুণগত শিক্ষা ও শিক্ষক দুটোরই অভাব রয়েছে।
কীভাবে বোঝা সম্ভব শিক্ষার মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না?
মান অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যদি ধরি, কলেজ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। যে শিক্ষক ইন্টারমিডিয়েটেও ক্লাস নেয়, আবার অনার্সের স্টুডেন্টদেরও পড়ায়। শিক্ষক সংকটের কারণেও মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না। এমনটি বেশ কিছু পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে।
স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে অথচ উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে যারা পড়ান তাদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। সব মেধাবী ছাত্র ভালো শিক্ষক হয় না। একজন মেধাবী ছাত্র হয়তো ভালো গবেষক হয় কিন্তু ভালো শিক্ষক হওয়া এতটা সহজ নয়। ভালো শিক্ষক হতে বাড়তি দক্ষতা লাগে, যা প্রশিক্ষণ ছাড়া অর্জন করা খুবই কঠিন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাংলাদেশ ছাড়া সব দেশেই আছে।
বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মান না হোক, এই উপমহাদেশীয় শিক্ষা মানে তো থাকা উচিত। কিন্তু সেটা করতেও হিমশিম খাচ্ছে। একসময় মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়তে আসত। কিন্তু এখন উল্টো প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী একই সময়ে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়।
স্কুল পর্যায়ের লেখাপড়ার পদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন আছে কি?
স্কুল লেভেলে এত পরীক্ষার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাত্র একটি পাবলিক পরীক্ষা থাকা উচিত। বর্তমানে স্কুল পর্যায়ে বিনা পয়সায় লেখাপড়া হচ্ছে, বিনামূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষার চাপে শিশুদের মেধাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। লেখাপড়া সহজ না করে ক্রমেই কঠিন করা হচ্ছে। ফলে স্কুল পর্যায়ের শিশুদের লেখাপড়া আরো সহজ করা উচিত। ফিনল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া- এই দুটো দেশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা সবচেয়ে মানসম্মত। সেখানে শিশুদের বই স্কুলেই থাকে। বাড়িতে নিতে দেওয়া হয় না। যতক্ষণ স্কুলে থাকবে ঠিক ততক্ষণই পড়াশোনা করবে। অথচ আমাদের দেশে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত শুধু পড়াশোনার ওপরেই থাকে।
আমরা ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরেই মাঠে দৌড়ে চলে যেতাম খেলার জন্য। কিন্তু এখন স্কুল শেষ হলেই খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে বাবা-মা তার বাচ্চাকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে দৌড়ান। দিনে চার-পাঁচটা কোচিংয়ে পড়তে যায়। কারণ জিপিএ-৫ পেতে হবে। আমি মনে করি প্রাইভেট কোচিং দেশ থেকে আইন করে তুলে দেওয়া উচিত। প্রাইভেট কোচিংটাকে ফৌজদারি মামলা হিসেবে গণ্য করা উচিত। শিক্ষকরা স্কুলে না পড়িয়ে কোচিংয়ে পড়ায়। এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
মূলত আমাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতিরই ভুল। এমন কোনো কাজ নেই শিশুদের জীবন বরবাদ করার জন্য, তা করা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের যত প্রতিযোগিতা থেকে বের করে আনা হবে ততই তাদের মেধার বিকাশ ঘটবে, সৃজনশীল হবে।
স্কুলের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যাবে, ঐতিহাসিক স্থান দেখবে, সেগুলো সম্পর্কে জানবে। মূলত এটাই তো তাদের লার্নিং। কিন্তু এসব স্থানে তাদের নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ কীভাবে স্বাধীন হলো, বাংলা ভাষা কীভাবে রাষ্ট্রভাষা হলো এগুলো শেখানো হয় না। তাহলে তারা শিখবে কী?
এ ছাড়া তথাকথিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কারিকুলাম নিয়মিত মনিটরিং করা এবং ট্রেনিং ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়া। ডিগ্রি পাস করছে, কোনো কাজ পাচ্ছে না, তাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। এসব স্কুলে কারিকুলামের ঠিক নেই, মেধাবী শিক্ষকদের ঠিক নেই, কোনো নিয়মকানুনেরও ঠিক নেই। শুধু টাকা বানানোর ধান্দা।
উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখতে করণীয় কী?
উচ্চশিক্ষার মান ঠিক রাখতে প্রথম কাজ হলো- কোর্স কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানে আনা। গতানুগতিক কারিকুলাম থেকে বের হয়ে এটাকে ডেভেলপ করা। একই সঙ্গে মানসম্মত টেক্সট বই ও রেফারেন্স বই ব্যবহার করা। দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া।
মূলত আমাদের দেশের লেখাপড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে পাঠ্যবই মুখস্থ করা আর সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক। এখান থেকে আমাদেরকে সরে আসতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব ছেলেমেয়েদের এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজে ফিরিয়ে আনতে হবে। জিপিএ-৫-এর পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাহলে অনেক প্রতিভাবান ও মেধাবী ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসবে। না হলে জাতি ক্রমেই বিকলাঙ্গ হবে।
এ ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক পথে আনতে সরকারের প্রথম কাজ হবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা। কারণ এগুলো মারা গেছে। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে। মান ঠিক রাখার চেষ্টাও করছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে মানের ল্যাব দরকার অনেকগুলোতেই তা নেই। তবে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় হেকেপ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব স্থাপন করেছি। কিন্তু সেসব ল্যাব ব্যবহার করার মতো দক্ষ লোক নেই। এটাও মান নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ।
অন্যদিকে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যারা ভালো করছে। কিছু শ্রেণির আছে যারা ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে। আর একশ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যারা ভালো হওয়ার চেষ্টা তো দূরে থাক তাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো সার্টিফিকেট বিক্রি করা। তারা বিজ্ঞাপন দিয়েই সার্টিফিকেট সেল করে। এদের নিয়ে আমরা বড় সমস্যায় রয়েছি। তাদের সঠিক পথে আনার চেষ্টা করলেই তারা হাইকোর্টে গিয়ে মামলা করে। আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আবার তারা কুকর্ম চালিয়ে যায়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা।
শেয়ার করুন
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

দেশ স্বাধীনের পর কীভাবে দেশে শিক্ষার প্রসার ঘটল?
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন শিক্ষার গুরুত্বটা আমাদের দেশের মানুষ তেমনভাবে অনুধাবন করেনি। ব্রিটিশ শাসনামলে যেহেতু ইংরেজি শিক্ষা বেশি প্রভাবিত ছিল, তখন থেকেই বাঙালি মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অনেক অনীহা ছিল। সেই আমলে মানুষ ফতোয়া দিত, ইংরেজি হচ্ছে ইহুদিদের শিক্ষা। গোটা উপমহাদেশেই একই অবস্থা তৈরি হয়েছিল। ফলে স্যার সৈয়দ আহমদ আধুনিক শিক্ষার জন্য আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ওই সময়ে সাধারণ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। তারা জমির মালিক ছিল না, তারা ছিল বর্গাচাষি। তারা মূলত নি¤œবিত্ত ছিল। ফলে লেখাপড়ার প্রয়োজনীয়তা তারা তখন অনুভব করেনি।
এরপর যখন দেশ স্বাধীন হলো তখন দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে, অফিস-আদালতে কাজ করার জন্য শিক্ষিত মানুষের চাহিদা তৈরি হলো। কারণ, দেশ স্বাধীনের আগে দেশ পরিচালনা করত অবাঙালিরা। ফলে স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শিক্ষার ওপর জোর দিলেন। কারণ স্কুলের শিক্ষক, ম্যানেজার, কেরানি, পিয়নসহ অনেক কর্মকর্তার প্রয়োজন হলো।
তখন উচ্চশিক্ষা ছিল দুর্লভ। ওই সময় যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল ন্যূনতম গ্রাজুয়েট এমন কিছু তরুণদের ইস্ট ইউরোপীয় দেশগুলোতে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসলেন বঙ্গবন্ধু। তখন তারাই দেশে বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের চাকরিতে নিয়োগ পেলেন। এর পর থেকেই দেশে শিক্ষার গুরুত্ব তৈরি হলো, সাধারণ মানুষও এর গুরুত্ব অনুধাবন করল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী বাড়তে শুরু করল।
দেশ স্বাধীনের সময় দেশে মাত্র ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেখানে মাত্র ১২ হাজার ছাত্র পড়াশোনা করত। এসব প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য পাওয়া যেত না, তেমনি লেখাপড়া করার জন্য অনুমতিও ছিল না। ওইসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাত্র ৪ জন ছাত্রী পড়েছিল। প্রথমে তারা পড়তে চাইলেও তাদের ভর্তি করা হয়নি। পরে তারা হাইকোর্ট থেকে রায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেছে। বর্তমানে এ অবস্থা নেই। গোটা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
দেশে বর্তমানে কয়েক লাখ স্কুল রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজের সংখ্যা প্রায় ২ হাজারের বেশি, মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ৩ হাজারের বেশি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪৯টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মোট ১০৩টি। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বর্তমানে মোট ৩৮ লক্ষ ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। এ পর্যায়ে ছাত্রীর সংখ্যা ৪২ থেকে ৪৩ শতাংশ। আগে যেখানে কয়েক কিলোমিটার পর পর একটা স্কুল খুঁজে পাওয়া যেত না সেখানে প্রতি গ্রামেই একটা করে স্কুল। এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, গ্রাম থেকে শহরে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব নেই। ফলে এখন লেখাপড়া অনেক সহজলভ্য হয়েছে। আর এই সহজলভ্য হওয়ার কারণে লেখাপড়ার প্রতি মানুষের অনেক আগ্রহ বেড়েছে। বর্তমানে যুগের চাহিদার কারণে আমাদের দেশে অনেক বেশি ডাক্তার প্রয়োজন, কৃষিবিদ প্রয়োজন, ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন, দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন হওয়ার কারণে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়িয়েছে সরকার। স্কুল থেকে শুরু করে, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ, মাদ্রাসা সবই বেড়েছে। লেখাপড়া আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে।
উচ্চশিক্ষার প্রসার হয়েছে, বিস্তার হয়েছে। লেখাপড়া মানুষের নাগালের মধ্যে এসেছে কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গুণগত শিক্ষার। চাহিদার তুলতায় আমাদের দেশে গুণগত শিক্ষা ও শিক্ষক দুটোরই অভাব রয়েছে।
কীভাবে বোঝা সম্ভব শিক্ষার মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না?
মান অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যদি ধরি, কলেজ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। যে শিক্ষক ইন্টারমিডিয়েটেও ক্লাস নেয়, আবার অনার্সের স্টুডেন্টদেরও পড়ায়। শিক্ষক সংকটের কারণেও মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না। এমনটি বেশ কিছু পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে।
স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে অথচ উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে যারা পড়ান তাদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। সব মেধাবী ছাত্র ভালো শিক্ষক হয় না। একজন মেধাবী ছাত্র হয়তো ভালো গবেষক হয় কিন্তু ভালো শিক্ষক হওয়া এতটা সহজ নয়। ভালো শিক্ষক হতে বাড়তি দক্ষতা লাগে, যা প্রশিক্ষণ ছাড়া অর্জন করা খুবই কঠিন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাংলাদেশ ছাড়া সব দেশেই আছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মান না হোক, এই উপমহাদেশীয় শিক্ষা মানে তো থাকা উচিত। কিন্তু সেটা করতেও হিমশিম খাচ্ছে। একসময় মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে প্রচুর শিক্ষার্থী পড়তে আসত। কিন্তু এখন উল্টো প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী একই সময়ে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়।
স্কুল পর্যায়ের লেখাপড়ার পদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন আছে কি?
স্কুল লেভেলে এত পরীক্ষার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাত্র একটি পাবলিক পরীক্ষা থাকা উচিত। বর্তমানে স্কুল পর্যায়ে বিনা পয়সায় লেখাপড়া হচ্ছে, বিনামূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষার চাপে শিশুদের মেধাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। লেখাপড়া সহজ না করে ক্রমেই কঠিন করা হচ্ছে। ফলে স্কুল পর্যায়ের শিশুদের লেখাপড়া আরো সহজ করা উচিত। ফিনল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া- এই দুটো দেশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা সবচেয়ে মানসম্মত। সেখানে শিশুদের বই স্কুলেই থাকে। বাড়িতে নিতে দেওয়া হয় না। যতক্ষণ স্কুলে থাকবে ঠিক ততক্ষণই পড়াশোনা করবে। অথচ আমাদের দেশে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত শুধু পড়াশোনার ওপরেই থাকে।
আমরা ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরেই মাঠে দৌড়ে চলে যেতাম খেলার জন্য। কিন্তু এখন স্কুল শেষ হলেই খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে বাবা-মা তার বাচ্চাকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে দৌড়ান। দিনে চার-পাঁচটা কোচিংয়ে পড়তে যায়। কারণ জিপিএ-৫ পেতে হবে। আমি মনে করি প্রাইভেট কোচিং দেশ থেকে আইন করে তুলে দেওয়া উচিত। প্রাইভেট কোচিংটাকে ফৌজদারি মামলা হিসেবে গণ্য করা উচিত। শিক্ষকরা স্কুলে না পড়িয়ে কোচিংয়ে পড়ায়। এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
মূলত আমাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতিরই ভুল। এমন কোনো কাজ নেই শিশুদের জীবন বরবাদ করার জন্য, তা করা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের যত প্রতিযোগিতা থেকে বের করে আনা হবে ততই তাদের মেধার বিকাশ ঘটবে, সৃজনশীল হবে।
স্কুলের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যাবে, ঐতিহাসিক স্থান দেখবে, সেগুলো সম্পর্কে জানবে। মূলত এটাই তো তাদের লার্নিং। কিন্তু এসব স্থানে তাদের নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ কীভাবে স্বাধীন হলো, বাংলা ভাষা কীভাবে রাষ্ট্রভাষা হলো এগুলো শেখানো হয় না। তাহলে তারা শিখবে কী?
এ ছাড়া তথাকথিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কারিকুলাম নিয়মিত মনিটরিং করা এবং ট্রেনিং ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়া। ডিগ্রি পাস করছে, কোনো কাজ পাচ্ছে না, তাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। এসব স্কুলে কারিকুলামের ঠিক নেই, মেধাবী শিক্ষকদের ঠিক নেই, কোনো নিয়মকানুনেরও ঠিক নেই। শুধু টাকা বানানোর ধান্দা।
উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখতে করণীয় কী?
উচ্চশিক্ষার মান ঠিক রাখতে প্রথম কাজ হলো- কোর্স কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানে আনা। গতানুগতিক কারিকুলাম থেকে বের হয়ে এটাকে ডেভেলপ করা। একই সঙ্গে মানসম্মত টেক্সট বই ও রেফারেন্স বই ব্যবহার করা। দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া।
মূলত আমাদের দেশের লেখাপড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে পাঠ্যবই মুখস্থ করা আর সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক। এখান থেকে আমাদেরকে সরে আসতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব ছেলেমেয়েদের এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজে ফিরিয়ে আনতে হবে। জিপিএ-৫-এর পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাহলে অনেক প্রতিভাবান ও মেধাবী ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসবে। না হলে জাতি ক্রমেই বিকলাঙ্গ হবে।
এ ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক পথে আনতে সরকারের প্রথম কাজ হবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা। কারণ এগুলো মারা গেছে। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে। মান ঠিক রাখার চেষ্টাও করছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে মানের ল্যাব দরকার অনেকগুলোতেই তা নেই। তবে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় হেকেপ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব স্থাপন করেছি। কিন্তু সেসব ল্যাব ব্যবহার করার মতো দক্ষ লোক নেই। এটাও মান নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ।
অন্যদিকে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যারা ভালো করছে। কিছু শ্রেণির আছে যারা ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে। আর একশ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যারা ভালো হওয়ার চেষ্টা তো দূরে থাক তাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো সার্টিফিকেট বিক্রি করা। তারা বিজ্ঞাপন দিয়েই সার্টিফিকেট সেল করে। এদের নিয়ে আমরা বড় সমস্যায় রয়েছি। তাদের সঠিক পথে আনার চেষ্টা করলেই তারা হাইকোর্টে গিয়ে মামলা করে। আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আবার তারা কুকর্ম চালিয়ে যায়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা।