হারিয়ে যাওয়া বড়দিনের ফিরে আসা
লায়লা আরজুমান্দ | ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
কাজী নজরুল ইসলাম ছোটবেলায় কাজ করতেন রুটির দোকানে। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স ছোটবেলায় কাজ করতেন জুতার কালির কারখানায়। কালির বোতলে লেবেল লাগানোর কাজ করতেন ডিকেন্স। সপ্তাহে পেতেন ছয় শিলিং। তা দিয়ে কোনোমতো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতেন তিনি। দেনার দায়ে তার বাবা-মাসহ পরিবারের প্রায় সবাইকে জেলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। ছোট বলে ছাড় পেয়েছিলেন তিনি আর তার বোন। বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। খুব সকালে বের হয়ে যেতেন কাজে। ফিরতেন রাতে। শৈশবের এই কষ্ট তার মনে বেশ দাগ কাটে। এই ডিকেন্সের ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারল’ বইটি প্রকাশের পর নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় বড়দিন।
পরে সাহিত্যে এক নতুন বিপ্লবের নাম হয়ে যায় চার্লস ডিকেন্স। কালজয়ী সব উপন্যাস রচনা করে ইতিহাসে স্থান করে নেন ডিকেন্স। তিনি একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, সচিত্র প্রতিবেদক ও সমালোচক। ‘অলিভার টুইস্ট’, ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারল’, ডেভিড কপারফিল্ড’, ‘অ্যা টেল অব টু সিটিস’-এর মতো কালজয়ী উপন্যাস তারই লেখা।
প্রেক্ষাপট
ক্রিসমাস বা বড়দিন খ্রিস্টানদের সব থেকে বড় উৎসব। এই অনুষ্ঠানের বয়স ছাড়িয়েছে দুই হাজার বছর। এখন যেমন পার্টি আর আনন্দ করে বড়দিন উদ্্যাপন করা হয়, একটা সময় সেটা সম্ভব ছিল না মোটেও। যুগে যুগে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নানাভাবে উদ্্যাপন করা হয়েছে বড়দিনকে।
মধ্যযুগে বড়দিন পালনের প্রধান আকর্ষণ ছিল প্রজা ও রাজাদের মধ্যে উপহার আদান-প্রদান, খেলাধুলা, ভোজ, নাচ-গানের উৎসব।
তবে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রোটেস্ট্যান্টদের উত্থানের পর থেকে ক্রিসমাসকে ক্যাথলিক উৎসব হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। বহু জায়গায় ক্রিসমাস বর্জনের ডাক আসে। ক্রিসমাসের পর দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডের শাসকরা ১৬৪৭ সাল থেকে ক্রিসমাস পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এমনকি আমেরিকার বোস্টনে ১৬৫৯ থেকে ১৬৮১ সাল পর্যন্ত আইন পাস করে ক্রিসমাস উদ্্যাপন বন্ধ রাখা হয়েছিল।
১৮০০ সাল পর্যন্ত ইউরোপে বড়দিন তেমন জাঁকজমক করে পালন করা হতো না। কারণ এই পার্টি বা আনন্দ করাকে অনেকটা ধর্মবিরোধী কাজ বলে ধরা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকটা ছিল শ্রেণি কলহ আর বিক্ষোভ আন্দোলনের সময়। এমনকি ১৮২৮ সালে নিউইয়র্কে সর্বপ্রথম পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয় ক্রিসমাসের দাঙ্গা ঠেকাতে।
এ সময় মূলত চার্লস ডিকেন্সের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারল’-এর মধ্য দিয়ে দিনটি উৎসব, উচ্ছ্বাস, আনন্দ, উদ্্যাপন, উপভোগের দিন হিসেবে ক্রিসমাসের পুনর্জাগরণ ঘটে। এরপর ক্রিসমাস হয়ে উঠে এক উচ্ছ্বাসের আরেক নাম। তিনি যে সময়টাতে বই লেখেন, সে সময়টাতে ক্রিসমাস উদ্্যাপনকে বাহুল্য মনে করা হতো। প্রাপ্তবয়স্ব ও শিশুরা দিনে ৯-১০ ঘণ্টা কাজ করত। ক্রিসমাসে থাকত না কোনো ছুটি।
প্রতিবাদ
ডিকেন্সের ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারোল’ লেখাটি আসলে একটি প্রতিবাদ। সমাজ পরিবর্তনের একটি দুর্দান্ত প্রয়োজন তিনি অনুভব করতেন। কারণ তিনি দেখেছেন নিম্ন শ্রেণির মানুষকে সহ্য করা হতো না সেই সমাজে একেবারে। তাদের ছিল না ভালোভাবে জীবন ধারণের কোনো সুযোগ-সুবিধা। ক্রিসমাস যেন শুধু সমাজের উচ্চ শ্রেণির লোকদের জন্য।
তিনি এমন একসময়ে বইটা লিখেছেন, যখন খাদ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সুন্দর জীবনযাপন করতে সাধারণ মানুষের নাভিস্বাস উঠে যাচ্ছিল।
তিনি উচ্চ শ্রেণির মানুষদের লজ্জা দিতে চেয়েছিলেন। বস্তিতে বসবাসরত মানুষগুলো কতটা অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করে, তা তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে শিশুদের কঠিন শৈশবের বিভিন্ন বিষয় তিনি তুলে আনতে চেয়েছেন তার লেখায়। যেটা কি না কয়েক গুণ বেশি শক্তি দিয়ে সমাজে আঘাত করবে।
নিম্ন শ্রেণির মানুষদেরও বাঁচার অধিকার রয়েছে। অনন্তকাল ধরে সমাজের এই অবস্থা তো চলতে পারে না। ডিকেন্স তার বেশির ভাগ বইয়ে এ ধরনের চরিত্র তুলে ধরেন। যাতে পাঠকসমাজ কিছুটা হলেও লজ্জা পায়। তাদের চিন্তার জগতে পরিবর্তন আসে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন আমরা প্রতিটি ব্যক্তিই আসলে দারিদ্র্যের জন্য দায়ী।
ডিকেন্স বইটি লিখেছিলেন ক্রিসমাসে ধনীদের হীরা কেনার জন্য নয় বরং ওই একটি দিনে তারা যেন দুমুঠো ভালো খাবার খেতে পারে। ওই দিনটি যেন পারিবারিক আনন্দের একটি দিন হয় সে চিন্তা করে। কারণ গরিবের জীবনে আনন্দের খুবই অভাব। দিনটি যেন হয় সবার। হাসি আর গানে ভরে থাকে যেন সবার অন্তর। ছড়িয়ে পড়ে যেন হাসি-আনন্দের ফোয়ারা।
‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারোল’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এবেনিজার স্ক্রুজ। সে খুবই কৃপণ। গরিব, নিচু শ্রেণির মানুষদের সে দেখতে পারে না একেবারেই। তবে তার এই স্বভাব বদলে যায় তিনটি ভূতের আগমনে। তাদের কাছাকাছি থেকে এবেনিজার স্ক্রুজও বদলে যেতে থাকেন। যেন ডিকেন্স রূপকভাবে সমাজ পরিবর্তনের ইংগিত দিয়েছেন। যদি এভাবেই বদলে যেত সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষরা!
বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘দয়ালু, ক্ষমাশীল, পরহিতকর, সুখী সময়। বছরের এ সময়টাতে নর-নারী নিজেদের মনের কপাট খুলে দেয়। এ সময় তারা সমাজের নিচুতলার মানুষের কথাও ভাবেন।’
বিভিন্ন অনুষঙ্গ
ডিকেন্সের বই প্রকাশের সময় থেকেই মূলত ক্রিসমাসে নতুন নতুন অনুষঙ্গ জনপ্রিয় হতে থাকে। ধীরে ধীরে ক্রিসমাসের আজকের এই রূপ দেখতে পাই আমরা। ডিকেন্সের সময়ের আগে এসব অনুষঙ্গ থাকলেও সেটা জনপ্রিয়তা পায়নি।
কার্ড
১৮৪৩ সালে ডিকেন্স যখন বই প্রকাশনায় ব্যস্ত, সে সময় প্রথম বাণিজ্যিক ক্রিসমাস কার্ডের উদ্ভাবন করেন স্যার হেনরি কোল। তিনি চিত্রশিল্পী জন ক্যালকটকে বলেন, উৎসবের আমেজে একটি নকশা করে দিতে। আর তিনি সেটার হাজার কপি বাজারে ছাড়েন। প্রতিটি কার্ড তিনি এক শিলিং করে বিক্রি করেন।
এই কার্ডে দেখা যায় উৎসব পালনরত একটি পরিবার। তবে এর পাশাপাশি একটি দরিদ্র পরিবারও রয়েছে। তাদের খাদ্য ও পোশাক দান করা হচ্ছে। কার্ডে ছিল নববর্ষ ও ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা। ইংল্যান্ডের এই কার্ড সংস্কৃতি খুব দ্রুত আমেরিকায়ও ছড়িয়ে পড়ে।
ক্রিসমাস ট্রি
কার্ডের পর ক্রিসমাস উদ্্যাপনের আরেকটি অনুষঙ্গ প্রবেশ করে। সেটা হলো ক্রিসমাস ট্রি। ১৮৪৮ সালে লন্ডনের একটি প্রভাবশালী দৈনিকে একটি ছবি ছাপা হয়। ছবিটির বিশেষত্ব হচ্ছে ইতিহাসে এটিই প্রথম ক্রিসমাস ট্রির আত্মপ্রকাশ। ছবিতে দেখা যায় ক্রিসমাস ট্রির পাশে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটেনের রাজকুমারী ভিক্টোরিয়া ও জার্মান রাজকুমার আলবার্ট।
রাাজকুমার তাদের বিয়ের উপহার হিসেবে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে নিয়ে আসেন এই ক্রিসমাস ট্রি। রাজপরিবারের অভিজাত মহল পেরিয়ে দ্রুতই সেটি জায়গা করে নেয় সাধারণ মানুষের কাছে। কয়েক বছরের মধ্যেই ইংরেজদের ঘরে ঘরে ক্রিসমাস উৎসবের অপরিহার্য অংশ হিসেবে শোভা পেতে থাকে এই ক্রিসমাস ট্রি। তবে ক্রিসমাস ট্রি কিন্তু জার্মান সভ্যতার অনুষঙ্গ হিসেবে আগে থেকেই ছিল। জার্মানদের শীতকালীন উৎসবের একটি অপরিহার্য অংশ ছিল একটি গাছকে আলো দিয়ে সাজানো। এই গাছ জার্মান যুবরাজের হাত ধরে ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে ক্রিসমাস ট্রি রূপে।
ক্রিসমাস ক্র্যাকার
প্রায় কাছাকাছি সময়ে ক্রিসমাসে আরেক অনুষঙ্গ প্রবেশ করে। নাম ক্রিসমাস ক্র্যাকার নামে এর প্রচলন শুরু করেন টম স্মিথ। রঙিন কাগজে মোড়ানো বিভিন্ন ধরনের চকোলেট থাকত এতে।
আগের রাতে উপহার
বেশ কিছুদিন পর থমাস নাস্ট নামে এক বিখ্যাত কার্টুনিস্টের আঁকা একটি ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায় সান্তা ক্লজ হরিণটানা গাড়িতে চড়ে কাঁধে উপহারের ঝোলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের উপহার দিচ্ছে। এভাব ক্রিসমাসের আগের রাতে উপহারের রীতিটি জনপ্রিয় হয়ে যায়।
বিশেষ করে সমাজের দুস্ত শিশুদের কাছে বিষয়টা হয়ে দাঁড়ায় অনেক আকাক্সক্ষার। কেউ হঠাৎ এসে উপহার দিয়ে যাবে এটা ভাবতেই তারা রোমাঞ্চ অনুভব করত।
এভাবে ধীরে ধীরে চার্লস ডিকেন্সের বই প্রকাশের পর থেকে ক্রিসমাস একটি সর্বজনীন পারিবারিক উৎসবে রূপান্তরিত হতে থাকে। পত্রিকাগুলো এরপর থেকে ছাপাতে থাকে ক্রিসমাস উপলক্ষে নানা রকম রেসিপি।
তবে ডিকেন্স শুধু ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারোল’ বই লিখেই ক্ষান্ত হননি। এই বইয়ের পর তিনি ক্রিসমাস নিয়ে আরো চারটি লেখা লিখে বড়দিনের এখনকার রীতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন।
এভাবেই নতুন করে ফিরে আসে বড়দিনের সর্বজনীন আনন্দ। এখনকার যে বড়দিন তার পেছনের গল্পটা এমনই।
শেয়ার করুন
লায়লা আরজুমান্দ | ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

কাজী নজরুল ইসলাম ছোটবেলায় কাজ করতেন রুটির দোকানে। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স ছোটবেলায় কাজ করতেন জুতার কালির কারখানায়। কালির বোতলে লেবেল লাগানোর কাজ করতেন ডিকেন্স। সপ্তাহে পেতেন ছয় শিলিং। তা দিয়ে কোনোমতো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতেন তিনি। দেনার দায়ে তার বাবা-মাসহ পরিবারের প্রায় সবাইকে জেলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। ছোট বলে ছাড় পেয়েছিলেন তিনি আর তার বোন। বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। খুব সকালে বের হয়ে যেতেন কাজে। ফিরতেন রাতে। শৈশবের এই কষ্ট তার মনে বেশ দাগ কাটে। এই ডিকেন্সের ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারল’ বইটি প্রকাশের পর নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় বড়দিন।
পরে সাহিত্যে এক নতুন বিপ্লবের নাম হয়ে যায় চার্লস ডিকেন্স। কালজয়ী সব উপন্যাস রচনা করে ইতিহাসে স্থান করে নেন ডিকেন্স। তিনি একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, সচিত্র প্রতিবেদক ও সমালোচক। ‘অলিভার টুইস্ট’, ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারল’, ডেভিড কপারফিল্ড’, ‘অ্যা টেল অব টু সিটিস’-এর মতো কালজয়ী উপন্যাস তারই লেখা।
প্রেক্ষাপট
ক্রিসমাস বা বড়দিন খ্রিস্টানদের সব থেকে বড় উৎসব। এই অনুষ্ঠানের বয়স ছাড়িয়েছে দুই হাজার বছর। এখন যেমন পার্টি আর আনন্দ করে বড়দিন উদ্্যাপন করা হয়, একটা সময় সেটা সম্ভব ছিল না মোটেও। যুগে যুগে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নানাভাবে উদ্্যাপন করা হয়েছে বড়দিনকে।
মধ্যযুগে বড়দিন পালনের প্রধান আকর্ষণ ছিল প্রজা ও রাজাদের মধ্যে উপহার আদান-প্রদান, খেলাধুলা, ভোজ, নাচ-গানের উৎসব।
তবে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রোটেস্ট্যান্টদের উত্থানের পর থেকে ক্রিসমাসকে ক্যাথলিক উৎসব হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। বহু জায়গায় ক্রিসমাস বর্জনের ডাক আসে। ক্রিসমাসের পর দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডের শাসকরা ১৬৪৭ সাল থেকে ক্রিসমাস পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এমনকি আমেরিকার বোস্টনে ১৬৫৯ থেকে ১৬৮১ সাল পর্যন্ত আইন পাস করে ক্রিসমাস উদ্্যাপন বন্ধ রাখা হয়েছিল।
১৮০০ সাল পর্যন্ত ইউরোপে বড়দিন তেমন জাঁকজমক করে পালন করা হতো না। কারণ এই পার্টি বা আনন্দ করাকে অনেকটা ধর্মবিরোধী কাজ বলে ধরা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকটা ছিল শ্রেণি কলহ আর বিক্ষোভ আন্দোলনের সময়। এমনকি ১৮২৮ সালে নিউইয়র্কে সর্বপ্রথম পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয় ক্রিসমাসের দাঙ্গা ঠেকাতে।
এ সময় মূলত চার্লস ডিকেন্সের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারল’-এর মধ্য দিয়ে দিনটি উৎসব, উচ্ছ্বাস, আনন্দ, উদ্্যাপন, উপভোগের দিন হিসেবে ক্রিসমাসের পুনর্জাগরণ ঘটে। এরপর ক্রিসমাস হয়ে উঠে এক উচ্ছ্বাসের আরেক নাম। তিনি যে সময়টাতে বই লেখেন, সে সময়টাতে ক্রিসমাস উদ্্যাপনকে বাহুল্য মনে করা হতো। প্রাপ্তবয়স্ব ও শিশুরা দিনে ৯-১০ ঘণ্টা কাজ করত। ক্রিসমাসে থাকত না কোনো ছুটি।
প্রতিবাদ
ডিকেন্সের ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারোল’ লেখাটি আসলে একটি প্রতিবাদ। সমাজ পরিবর্তনের একটি দুর্দান্ত প্রয়োজন তিনি অনুভব করতেন। কারণ তিনি দেখেছেন নিম্ন শ্রেণির মানুষকে সহ্য করা হতো না সেই সমাজে একেবারে। তাদের ছিল না ভালোভাবে জীবন ধারণের কোনো সুযোগ-সুবিধা। ক্রিসমাস যেন শুধু সমাজের উচ্চ শ্রেণির লোকদের জন্য।
তিনি এমন একসময়ে বইটা লিখেছেন, যখন খাদ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সুন্দর জীবনযাপন করতে সাধারণ মানুষের নাভিস্বাস উঠে যাচ্ছিল।
তিনি উচ্চ শ্রেণির মানুষদের লজ্জা দিতে চেয়েছিলেন। বস্তিতে বসবাসরত মানুষগুলো কতটা অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করে, তা তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে শিশুদের কঠিন শৈশবের বিভিন্ন বিষয় তিনি তুলে আনতে চেয়েছেন তার লেখায়। যেটা কি না কয়েক গুণ বেশি শক্তি দিয়ে সমাজে আঘাত করবে।
নিম্ন শ্রেণির মানুষদেরও বাঁচার অধিকার রয়েছে। অনন্তকাল ধরে সমাজের এই অবস্থা তো চলতে পারে না। ডিকেন্স তার বেশির ভাগ বইয়ে এ ধরনের চরিত্র তুলে ধরেন। যাতে পাঠকসমাজ কিছুটা হলেও লজ্জা পায়। তাদের চিন্তার জগতে পরিবর্তন আসে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন আমরা প্রতিটি ব্যক্তিই আসলে দারিদ্র্যের জন্য দায়ী।
ডিকেন্স বইটি লিখেছিলেন ক্রিসমাসে ধনীদের হীরা কেনার জন্য নয় বরং ওই একটি দিনে তারা যেন দুমুঠো ভালো খাবার খেতে পারে। ওই দিনটি যেন পারিবারিক আনন্দের একটি দিন হয় সে চিন্তা করে। কারণ গরিবের জীবনে আনন্দের খুবই অভাব। দিনটি যেন হয় সবার। হাসি আর গানে ভরে থাকে যেন সবার অন্তর। ছড়িয়ে পড়ে যেন হাসি-আনন্দের ফোয়ারা।
‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারোল’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এবেনিজার স্ক্রুজ। সে খুবই কৃপণ। গরিব, নিচু শ্রেণির মানুষদের সে দেখতে পারে না একেবারেই। তবে তার এই স্বভাব বদলে যায় তিনটি ভূতের আগমনে। তাদের কাছাকাছি থেকে এবেনিজার স্ক্রুজও বদলে যেতে থাকেন। যেন ডিকেন্স রূপকভাবে সমাজ পরিবর্তনের ইংগিত দিয়েছেন। যদি এভাবেই বদলে যেত সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষরা!
বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘দয়ালু, ক্ষমাশীল, পরহিতকর, সুখী সময়। বছরের এ সময়টাতে নর-নারী নিজেদের মনের কপাট খুলে দেয়। এ সময় তারা সমাজের নিচুতলার মানুষের কথাও ভাবেন।’
বিভিন্ন অনুষঙ্গ
ডিকেন্সের বই প্রকাশের সময় থেকেই মূলত ক্রিসমাসে নতুন নতুন অনুষঙ্গ জনপ্রিয় হতে থাকে। ধীরে ধীরে ক্রিসমাসের আজকের এই রূপ দেখতে পাই আমরা। ডিকেন্সের সময়ের আগে এসব অনুষঙ্গ থাকলেও সেটা জনপ্রিয়তা পায়নি।
কার্ড
১৮৪৩ সালে ডিকেন্স যখন বই প্রকাশনায় ব্যস্ত, সে সময় প্রথম বাণিজ্যিক ক্রিসমাস কার্ডের উদ্ভাবন করেন স্যার হেনরি কোল। তিনি চিত্রশিল্পী জন ক্যালকটকে বলেন, উৎসবের আমেজে একটি নকশা করে দিতে। আর তিনি সেটার হাজার কপি বাজারে ছাড়েন। প্রতিটি কার্ড তিনি এক শিলিং করে বিক্রি করেন।
এই কার্ডে দেখা যায় উৎসব পালনরত একটি পরিবার। তবে এর পাশাপাশি একটি দরিদ্র পরিবারও রয়েছে। তাদের খাদ্য ও পোশাক দান করা হচ্ছে। কার্ডে ছিল নববর্ষ ও ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা। ইংল্যান্ডের এই কার্ড সংস্কৃতি খুব দ্রুত আমেরিকায়ও ছড়িয়ে পড়ে।
ক্রিসমাস ট্রি
কার্ডের পর ক্রিসমাস উদ্্যাপনের আরেকটি অনুষঙ্গ প্রবেশ করে। সেটা হলো ক্রিসমাস ট্রি। ১৮৪৮ সালে লন্ডনের একটি প্রভাবশালী দৈনিকে একটি ছবি ছাপা হয়। ছবিটির বিশেষত্ব হচ্ছে ইতিহাসে এটিই প্রথম ক্রিসমাস ট্রির আত্মপ্রকাশ। ছবিতে দেখা যায় ক্রিসমাস ট্রির পাশে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটেনের রাজকুমারী ভিক্টোরিয়া ও জার্মান রাজকুমার আলবার্ট।
রাাজকুমার তাদের বিয়ের উপহার হিসেবে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে নিয়ে আসেন এই ক্রিসমাস ট্রি। রাজপরিবারের অভিজাত মহল পেরিয়ে দ্রুতই সেটি জায়গা করে নেয় সাধারণ মানুষের কাছে। কয়েক বছরের মধ্যেই ইংরেজদের ঘরে ঘরে ক্রিসমাস উৎসবের অপরিহার্য অংশ হিসেবে শোভা পেতে থাকে এই ক্রিসমাস ট্রি। তবে ক্রিসমাস ট্রি কিন্তু জার্মান সভ্যতার অনুষঙ্গ হিসেবে আগে থেকেই ছিল। জার্মানদের শীতকালীন উৎসবের একটি অপরিহার্য অংশ ছিল একটি গাছকে আলো দিয়ে সাজানো। এই গাছ জার্মান যুবরাজের হাত ধরে ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে ক্রিসমাস ট্রি রূপে।
ক্রিসমাস ক্র্যাকার
প্রায় কাছাকাছি সময়ে ক্রিসমাসে আরেক অনুষঙ্গ প্রবেশ করে। নাম ক্রিসমাস ক্র্যাকার নামে এর প্রচলন শুরু করেন টম স্মিথ। রঙিন কাগজে মোড়ানো বিভিন্ন ধরনের চকোলেট থাকত এতে।
আগের রাতে উপহার
বেশ কিছুদিন পর থমাস নাস্ট নামে এক বিখ্যাত কার্টুনিস্টের আঁকা একটি ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায় সান্তা ক্লজ হরিণটানা গাড়িতে চড়ে কাঁধে উপহারের ঝোলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের উপহার দিচ্ছে। এভাব ক্রিসমাসের আগের রাতে উপহারের রীতিটি জনপ্রিয় হয়ে যায়।
বিশেষ করে সমাজের দুস্ত শিশুদের কাছে বিষয়টা হয়ে দাঁড়ায় অনেক আকাক্সক্ষার। কেউ হঠাৎ এসে উপহার দিয়ে যাবে এটা ভাবতেই তারা রোমাঞ্চ অনুভব করত।
এভাবে ধীরে ধীরে চার্লস ডিকেন্সের বই প্রকাশের পর থেকে ক্রিসমাস একটি সর্বজনীন পারিবারিক উৎসবে রূপান্তরিত হতে থাকে। পত্রিকাগুলো এরপর থেকে ছাপাতে থাকে ক্রিসমাস উপলক্ষে নানা রকম রেসিপি।
তবে ডিকেন্স শুধু ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারোল’ বই লিখেই ক্ষান্ত হননি। এই বইয়ের পর তিনি ক্রিসমাস নিয়ে আরো চারটি লেখা লিখে বড়দিনের এখনকার রীতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন।
এভাবেই নতুন করে ফিরে আসে বড়দিনের সর্বজনীন আনন্দ। এখনকার যে বড়দিন তার পেছনের গল্পটা এমনই।