পিয়ং ইয়ংয়ের বাদশাহ কিম জং উন
পরাগ মাঝি | ২ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০
আমেরিকাকে হুমকি দিয়ে নতুন বছর শুরু করলেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন। বাবা কিম জং ইল এবং দাদা কিম ইল সাং সারা পৃথিবী থেকেই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন উত্তর কোরিয়াকে। একের পর এক পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে পূর্বসূরীদের দেখানো পথেই হেঁটেছেন মাত্র ২৭ বছর বয়সে ক্ষমতায় আসা উন। এই বিধ্বংসী রূপ দেখে তাকে ‘অপরিপক্ব’ আখ্যা দিয়েছিলেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। কিন্তু মাত্র সাত বছরের মধ্যেই নিজের নেতৃত্বকে অনেক পরিণত অবস্থানে নিয়ে এসেছেন ‘রকেটম্যান’ খ্যাত একনায়ক, করছেন শান্তির সন্ধানও। বিবিসি অবলম্বনে লিখেছেন পরাগ মাঝি
একটি শেষকৃত্য
২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর। পিয়ংইয়ংয়ে সেদিন প্রচন্ড ঠান্ডা। বিরামহীন তুষারপাতের মধ্যেই একটি কালো লম্বা লিনকল কন্টিনেন্টাল মডেলের গাড়ি ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটির ছাদে শে^ত চন্দ্রমল্লিকা দিয়ে সাজানো একটি কফিন শয্যায় শুয়ে আছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-ইল। রাস্তার দুপাশে কালো পোশাকে অসংখ্য মানুষের জনসমাগম। সৈনিকদের পেছনে দাঁড়িয়ে তারা শুধু কেঁদেই চলেছে। আর বুক চাপড়ে আর্তনাদ করে উঠছে, ‘পিতা..., পিতা...’।
গাড়িটির পাশ দিয়েই এগিয়ে চলেছেন মৃত একনায়কের ছেলে এবং উত্তরাধিকারী কিম জং-উন। ২৭ বছর বয়সী এই ছেলেকেও শোকে বিহ্বল দেখা যাচ্ছে। তাকে মাঝেমধ্যেই চোখের জলেও ভেসে যেতে দেখা যাচ্ছে। কিমের ঠিক পেছনেই হাঁটছিলেন তার ফুফা চ্যাং সং থায়েক। উত্তর কোরিয়ার দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ভাবা হতো তাকে। গাড়িটির অন্যপাশে হাঁটছেন সেনাবাহিনীর প্রধান রি ইয়ং-হো এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়ং চান। এসব বুড়ো ব্যক্তিই এখন পিয়ংইয়ংয়ের পরিচালক হবেন এমন অনেক গুঞ্জন চলছে চারদিকে।
১৯৫০-এর দশকে কিম জং উনের দাদা কিম ইল-সাং উত্তর কোরিয়ায় বংশানুক্রমিক একনায়কতন্ত্রের সূচনা করেন, যা ছিল কমিউনিস্ট বিশ্বে একটি নতুন সংযোজন। প্রায় দুই দশক ধরে ইল-সাং তার বড় ছেলে কিম জং-ইলকে উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি যেখানেই যেতেন, ছেলেকে সব সময় সঙ্গে রাখতেন। ১৯৯৪ সালে ইল-সাং মৃত্যুবরণ করার পরই কিম জং-উন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনিও যখন হঠাৎ করেই ২০১১ সালে মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার ছেলে উত্তর কোরিয়ার তৃতীয় সর্বোচ্চ নেতা হতে তার শিক্ষানবিসকাল শুরু করেন। এ সময় অনেক বিশেষজ্ঞই ভাবছিলেন দেশটির একনায়কতন্ত্রের হয়তো অবসান হতে চলেছে। কিন্তু তারা ভুল প্রমাণিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
কয়েক মাসের মধ্যেই সেনাপ্রধান রি ইয়ং-হো এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়ং-চান দুজনই বরখাস্ত হলেন। রি’র নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে এখনো রহস্য রয়ে গেছে। পরে ২০১৩ সালে কিম জং-উন তার সবচেয়ে নাটকীয় খেলটি দেখালেন। তার ফুফা চ্যাং সংস-থায়েককে পার্টির একটি মিটিং থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসসঘাতকতার অভিযোগ আনা হয় এবং যথারীতি মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, তার মৃত্যুদণ্ড বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে কিম জং-উন যত পদে ক্ষমতার রদবদল করেন, তার দাদার আমল থেকে এমনটি আর হয়নি। পাশের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, উল্লিখিত চার বছরে উত্তর কোরিয়ায় ১৪০ উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর অন্তত ২০০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত এবং কারাবন্দি করা হয়। কিম তাকেই সরিয়ে দিয়েছেন, তাকে তার পথের কাঁটা হিসেবে সন্দেহ করেছেন। সরিয়ে দেওয়া ব্যক্তির স্থলে অনুগত তরুণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। কিমের এসব কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারই বোন কিম ইয়ো-জং। ২০১৭ সালে ৩০ বছর বয়সে ইয়োকে পলিটব্যুরোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পিয়ংইয়ংয়ের শক্তি কেন্দ্রে কার অবস্থান, তা নিয়ে আজ আর কারো দ্বিধা নেই, কিম জং-উনই হলেন সর্বোচ্চ নেতা।
ছোট্ট সেতুতে চা-পর্ব
২০১৮ সালে এপ্রিলের উষ্ণ একটি দিন সেদিন। কিম জং-উন বসে আছেন চারদিকে জঙ্গলাকীর্ণ একটি কাঠের সেতুতে। এটি উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার একটি নো ম্যান’স ল্যান্ড। দুই কোরিয়ার মাঝখানে এই সীমান্তপুলটিতে কোনো দেশের সৈনিকই অবস্থান করেন না। পিয়ংইয়ংয়ে সেদিনের সেই তীব্র ঠান্ডার ছয় বছর কেটে গেছে। কিম তার চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর মনোযোগ দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের কথা শুনছেন। দুজনের এই মিলন চিত্রটি বিশ^জুড়েই প্রচারিত হয়েছে। তবে, তারা কী নিয়ে কথা বলছেন, তা বোঝার সাধ্য কারো নেই। প্রায় আধঘণ্টার ওই নিঃশব্দ বাক্যালাপটিকে অনেকেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, কিছু বুঝে ওঠার জন্য।
এই মিটিংয়ের কয়েক মাস আগেই জাপানের ওপর দিয়ে মিসাইল ছুড়েছিলেন এবং উত্তর কোরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রে গুলিবৃষ্টির হুমকি দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি বসে আছেন, হাসছেন, এমনকি খুব গভীর আলোচনায় ডুবে গেছেন তার সাম্রাজ্যেরই শত্রু বিবেচিত হয় একটি পক্ষের সঙ্গে!
ওই আলোচনাটির পর অনেক প্রশ্নই উত্থাপিত হতে পারে। কী চান আসলে কিম? এটা কি তার কোন ধাপ্পাবাজি, কিংবা উষ্ণ আক্রমণ? কিম কি তার বাপ-দাদার অনুসৃত পরিকল্পনার অতিরিক্ত কিছু করছেন?
ছোট্ট জেনারেল
১৯৯২ সালে পিয়ংইয়ংয়ের একটি বাড়িতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আট বছর বয়সী এক বালকের একটি বিশেষ জন্মদিন। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে আট বছরের বালকটি একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে জেনারেলের পোশাক। খেলনা নয়, কোরিয়ান পিপলস আর্মির সত্যিকার জেনারেলের পোশাক তার শরীরের মাপে বানানো। দেশটির অন্যান্য বয়স্ক জেনারেলরা একে একে উপস্থিত হচ্ছেন এবং ছোট্ট জেনারেলকে কুর্নিশ করে নিজ নিজ জায়গায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। আট বছরের ওই ছোট্ট জেনারেলই হলেন কিম জং-উন।
ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ‘জেনারেল কিম’-এর জন্মদিনের এই গল্পটি করেছিলেন কিমেরই ফুফু কো ইয়ং সুক। তিনি এবং তার স্বামী দুই দশক আগেই উত্তর কোরিয়া থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। বর্তমানে তারা নিউইয়র্ক শহরের বাইরে নিভৃত জীবনযাপন করেন।
জন্মদিনের কথা উল্লেখ করে কো বলেন, ‘একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে উনের বেড়ে ওঠা ছিল অসম্ভব।’
জন্মদিনের কয়েক বছর পরই কো ইয়ং সুককে নিযুক্ত করা হয় সুইজারল্যান্ডের একটি স্কুলে পাড়াশোনারত কিম জং-উনকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। তার বর্ণনায়, কিশোর কিম ছিল রগচটা আর অহংকারী। কো বলেন, ‘সে কখনোই গোলযোগ বাধাত না। কিন্তু সে ছিল অধৈর্য এবং সহ্যক্ষমতা ছিল খুব কম। যখন তার মা তাকে মাত্রাতিরিক্ত খেলাধুলা কমিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার কথা বলত, তখন সে কিছুই বলত না, তবে নিজস্ব উপায়ে প্রতিবাদ করতÑ যেমন : কয়েকদিনের জন্য খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিত।’
কিমের ছোটবেলার এই গল্পগুলো উত্তর কোরিয়ায় তার নেতৃত্বে আসার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কারণ, তার বড় দুই ভাই ছিল। তাদের একজন তার সহোদর কিম জং-চোল এবং অন্যজন সৎভাই কিম জং-নম।
কিম জং-উন যে ক্ষমতায় আসছেন, তার প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীটি করেছিলেন জাপানি সুশি শেফ ক্যানজি ফুজিমটো।
১৯৯০-এর দশকে ফুজিমটো কিমের আশপাশে থাকাদের একজন ছিলেন। তিনি উনের বাবা কিম জং-ইলের জন্য জাপানি খাবার বানাতেন। ফুজিমটো দাবি করেন, তিনি কিম জং-উনের খেলার সঙ্গীও ছিলেন। ২০০১ সালে ফুজিমটো জাপানে ফিরে আসেন এবং উত্তর কোরিয়ায় থাকার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কিম জং-উন এবং কিম জং-চোল এ দুই ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতিচারণা করে ফুজি বলেন, ‘যখন আমি প্রথমবারের মতো দুই ভাইয়ের মুখোমুখি হলাম, তখন তারা দুজনই সামরিক পোশাক পরেছিলেন। তারা প্রত্যেক কর্মীর সঙ্গেই হাত মেলাচ্ছিলেন। পরে যখন আমার পালা এলো কিম জং-উন আমার হাতে একটি বরফের টুকরো রেখে দিল। যেন সে বোঝাতে চাইছিল তোমার মতো সব জাপানিকেই আমি ঘৃণা করি। সেদিনের অভিজ্ঞতা আমি কখনোই ভুলব না। উনের বয়স তখন মাত্র সাত।’
২০০৩ সালে দ্বিতীয় বই প্রকাশ করেন ফুজিমটো। এই বইয়ে ফুজি লেখেন, ‘কিম জং চোল বাবার উত্তরাধিকার পাবেন এমনটাই ধারণা করা হতো। কিন্তু আমার সন্দেহ হতো। কিম জং-ইল প্রায়ই বলতেন, জং চোল এত যোগ্য নয়, সে মেয়েদের মতো। ইলের কাছে তার ছোট ছেলেই ছিলেন সবচেয়ে প্রিয়। উন তার বাবার মতোই ছিলেন।’ ছোট ছেলেকে উত্তরাধিকার দেওয়ার ইচ্ছাটি ইল কখনোই জনসমক্ষে বলেননি। বাল্যকাল থেকে অনেক গোপনেই তিনি তার ছেলেকে প্রস্তুত করছিলেন।
ভাইদের মধ্যে উত্তরাধিকারের লড়াই
২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের একটি রেস্তোরাঁয় জমায়েত হয়েছে কয়েকজন বন্ধু। তারা এসেছে মূলত সিতি ইশায়াহ্র ২৫তম জন্মদিনকে উদযাপন করতে। বন্ধুদের ভিডিওতে তাকে খুব হাসতে এবং গান গাইতে দেখা গেছে। সিতি উত্তেজিত ভঙ্গিতে সেদিন তার বন্ধুদের একটি বিশেষ খবর জানায়। সিতি জানায়, সে একটি টিভি রিয়েলিটি শোতে চাকরি পেয়েছে। অবশেষে সে জন্মস্থান কুয়ালালামপুরের জ¦রাজীর্ণ চাকরিটি ছেড়ে দিচ্ছে। বন্ধুরা তাকে উৎসাহিত করে বলল, ‘তুমি তো স্টার হয়ে যাচ্ছো!’
পরদিন সকালে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে সিথি তার লক্ষ্যবস্তুকে খুঁজে পেল। গোলগাল চেহারা আর টাক মাথার এক যুবক, যিনি একটি নীল টি-শার্ট আর স্পোর্টস জ্যাকেট পরেছেন। ওই ব্যক্তিটি চেক ইনের জন্য যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন, সিতি তখনই তার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং মুখে তরলজাতীয় কিছু একটা মাখিয়ে দিলেন।
‘কী করছেন, আপনি?’ ভাঙা ইংরেজিতে ব্যক্তিটি বলে উঠলেন সিতির উদ্দেশে।
‘দুঃখিত’ বলে ভিড়ের মধ্যে পালিয়ে গেলেন সিতি। আর কয়েক মিটার দূরেই একটি ক্যাফেতে বসেছিল উত্তর কোরিয়ান কয়েকজন গুপ্তচর। ঘটনার পরপরই সিসিফুটেজে তাদের গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। পরে তারা দুবাইয়ের ফ্লাইট ধরে।
এদিকে, মুখে তরলমাখা ব্যক্তিটি অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করলেন। তার মুখের ত্বক ফেটে যাচ্ছিল এবং ক্রমেই তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি অচেতন হয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়লেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাকে হাসপাতালে পাঠালেন। লোকটির পাসপোর্টে লেখা ছিল তিনি একজন উত্তর কোরিয়ার কূটনীতিক। তার নাম কিম চোল। আসলে ওই ব্যক্তি ছিলেন কিম জং-উনের সৎ বড় ভাই কিম জং-নম। তার মুখে শক্তিশালী বিষাক্ত তরল ‘নার্ভ এজেন্ট-ভিএক্স’ মাখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার বিন্দু পরিমাণ শ^াসনালিতে প্রবেশ করলে মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু কী কারণে নমকে হত্যা করা হলো?
উন এবং নমের বাবা কিম জং-ইলের দাম্পত্য জীবন ছিল জটিল। দাপ্তরিকভাবে দুজনসহ তার তিন স্ত্রী ছিলেন। তাদের গর্ভে ইলের পাঁচ সন্তান জন্ম নেয়। নম তার প্রথম সন্তান, যার জন্ম হয়েছিল প্রথম স্ত্রী সং হাই-রিমের গর্ভ থেকে। আর উনের জন্ম হয়েছিল ইলের দ্বিতীয় স্ত্রী জাপানে জন্ম নেওয়া অভিনেত্রী কো ইয়ং-হুইয়ের গর্ভে। বৃদ্ধ একনায়ক তার স্ত্রী এবং সন্তানদের সব সময় আড়ালেই রাখতেন। আলাদা আলাদা বাড়িতে সন্তানসহ স্ত্রীরা ছিলেন একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন। উন এবং নম একজনের পিতৃস্নেহ পেলেও তাদের কখনো দেখা হয়নি।
সবার বড় ছেলে হিসেবে কিম জং-নমই ছিলেন প্রধান উত্তরাধিকারী। কিন্তু ২০০১ সালে একটি ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে জাপানে ঢোকার চেষ্টা করে গ্রেপ্তার হন। টোকিওর ডিজনিল্যান্ড দেখার পরিকল্পনা ছিল তার। বাবা ইলের কাছে এটি ছিল একটি অমার্জনীয় অপরাধ। তাই উত্তরাধিকার থেকে নমকে বঞ্চিত করে চীনে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
তবে, ইয়োজি গমি নামে এক জাপানি সাংবাদিক দাবি করেন, ডিজনিল্যান্ডে যাওয়াই নমের উত্তরাধিকার হারানোর কারণ নয়, বরং এই অধিকার তিনি হারিয়েছিলেন আরো আগেই। আর এটার সূচনা হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে, যখন নম সুইজারল্যান্ডের একটি স্কুলে পড়াশোনা করতেন। ইউরোপে কাটানো নয় বছর গভীর প্রভাব ফেলেছিল নমের মনে। ১৯৯০-এর দশকে উত্তর কোরিয়া মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে সাহায্য বন্ধ হয়ে এবং বন্যার কবলে পড়ে এমন দশা হয় দেশটির। চার বছরের দুর্ভিক্ষে দেশটিতে প্রায় ৩০ লাখ লোক প্রাণ হারায়। নম এ সময় তার বাবাকে উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া বদলে ফেলার জন্য বলেছিলেন। তিনি চাইছিলেন যেন চীনা ধাঁচের অর্থনীতি গড়ে ওঠে। যেখানে প্রাইভেট সেক্টরও গড়ে উঠবে। ছেলের এমন প্রস্তাবে রাগে ফেটে পড়েছিলেন ইল। তিনি তখন নমকে তার চিন্তা পরিবর্তন করতে বললেন, নয়তো তাকে পিয়ং ইয়ংয়ের বাইরে ছুড়ে ফেলার হুশিয়ারি দেন। উত্তরাধিকার হারানোর কারণ হিসেবে নম ইয়োজিকে এই তথ্যগুলোই দিয়েছিলেন।
নমের পরের লাইনে ছিলেন কিম জং-চোল। কিন্তু চোলকে উত্তরাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে ইল কখনোই সিরিয়াসলি ভাবেননি। বরং তিনি তার সবচেয়ে কম বয়সী ছেলেকেই বেছে নিয়েছিলেন, যে কি না তার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং হিংস্র ছিল। বাবার মৃত্যুর পর কিম ক্ষমতা গ্রহণ করলে ইয়োজিকে নম তার প্রাণসংশয়ের কথাও বলেছিলেন।
চেইন স্মোকার, রকেটম্যান ও শান্তি
২০১৭ সালের ৪ জুলাই সকাল। আমেরিকার একটি গোয়েন্টা স্যাটেলাইট উত্তর কোরিয়ার অনেক ওপর দিয়ে যেতে যেতে পিয়ঙ্গান প্রদেশে ব্যতিক্রম কিছু কার্যকলাপ লক্ষ করে। ১৬ চাকার একটি বিশাল ট্রাক একটি খোলা প্রান্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আর ট্রাকের ওপর ছিল একটি বিশাল মিসাইল। তর পরের কয়েক ঘণ্টা আমেরিকার গোয়েন্দা সদস্যরা পর্যবেক্ষণ করে দেখে মিসাইলটি ট্রাক থেকে নামানো হয়েছে এবং এটিকে পরিচালনার জন্য জ্বালানি পূর্ণ করা হচ্ছে। এ সময় তারা একজন ব্যক্তিকেও খেয়াল করেন, যিনি মিসাইলটির চারদিকে হাঁটছেন এবং একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছেন। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন, এই ব্যক্তি আর কেউ নন, কিম জং-উন। কিছুক্ষণ পর মিসাইলটির প্রধান ইঞ্জিন চালু করা হয় এবং আকাশে উড়াল দেয় মিসাইলটি। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এটি জাপান সাগরে গিয়ে পতিত হয়। কিম জং-উন তখন উল্লসিত হয়ে ওঠেন। পরে তার হাসিমুখের ছবি প্রকাশিত হয়, যেখানে তাকে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করতেও দেখা যায়।
পিয়ংইয়ং দাবি করেন, ওই মিসাইলটি তাদের নতুন সংযোজন, যা আমেরিকার মাটিতে গিয়ে আঘাত করতে সক্ষম। প্রচুর অর্থ খরচ এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও উত্তর কোরিয়া ধারাবাহিকভাবে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে থাকে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম। ২০১১ সালে বাবার মৃত্যুর পর নাটকীয়ভাবে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক প্রকল্পগুলোকে চালু করেন কিম এবং সফল হন।
২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর উত্তর কোরিয়া ‘হাসং-১৫’ নামে এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, যা ভারী পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে পারে এবং এটি আমেরিকার মূল ভূমিতেও আঘাত করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরাও এখন মোটামুটি একমত, কিম চাইলেই এখন আমেরিকার মাটিতে আঘাত করতে পারবে যেকোনো সময়। কিন্তু পিয়ংইয়ংয়ের রাজা কেন এত বিপুলসংখ্যক পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদ বাড়ালেন। যেখানে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য এমন পারমাণবিক ব্যবস্থার প্রযোজন নেই উত্তর কোরিয়ার। তবে, কেন এসব অস্ত্র নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হলেন রকেটম্যান? এ প্রশ্নের উত্তরেও ‘শান্তি’কেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার অলিম্পিক দল পাঠিয়ে দারুণ এক শান্তির বার্তা দিয়েছিলেন কিম। গত বছর সিঙ্গাপুরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একটি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিও করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুনের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতেও পরমাণু অস্ত্র পুরোপুরি পরিত্যাগেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। আর কোনো মিসাইল পরীক্ষা চালাবেন না বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কোরিয়ান উপদ্বীপকে নিরাপদ রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবার তিনি। তবে, পরমাণু অস্ত্রবিশেষজ্ঞ দুইয়ো কিম বলেন, ‘এসবের মানে এই নয়, পুরোপুরি নিরস্ত্র হয়ে যাবেন কিম উন।’ তার মতে, পরপর ছয়টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তিধর ক্লাবে উত্তর কোরিয়ার নাম লিপিবদ্ধ করাই ছিল কিম জং-উনের প্রথম লক্ষ্য। আর কম বয়সী এই নেতা এভাবেই তার ব্যক্তিত্বকে জানান দিলেন, যেন তাকে গণনায় ধরা হয়। নিঃসন্দেহে পৃথিবীজুড়েই কিম এখন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্ব নিয়ে শান্তির আলোচনা এবার করাই যেতে পারে, তাই নয় কি?
শেয়ার করুন
পরাগ মাঝি | ২ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০

আমেরিকাকে হুমকি দিয়ে নতুন বছর শুরু করলেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন। বাবা কিম জং ইল এবং দাদা কিম ইল সাং সারা পৃথিবী থেকেই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন উত্তর কোরিয়াকে। একের পর এক পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে পূর্বসূরীদের দেখানো পথেই হেঁটেছেন মাত্র ২৭ বছর বয়সে ক্ষমতায় আসা উন। এই বিধ্বংসী রূপ দেখে তাকে ‘অপরিপক্ব’ আখ্যা দিয়েছিলেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। কিন্তু মাত্র সাত বছরের মধ্যেই নিজের নেতৃত্বকে অনেক পরিণত অবস্থানে নিয়ে এসেছেন ‘রকেটম্যান’ খ্যাত একনায়ক, করছেন শান্তির সন্ধানও। বিবিসি অবলম্বনে লিখেছেন পরাগ মাঝি
একটি শেষকৃত্য
২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর। পিয়ংইয়ংয়ে সেদিন প্রচন্ড ঠান্ডা। বিরামহীন তুষারপাতের মধ্যেই একটি কালো লম্বা লিনকল কন্টিনেন্টাল মডেলের গাড়ি ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটির ছাদে শে^ত চন্দ্রমল্লিকা দিয়ে সাজানো একটি কফিন শয্যায় শুয়ে আছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-ইল। রাস্তার দুপাশে কালো পোশাকে অসংখ্য মানুষের জনসমাগম। সৈনিকদের পেছনে দাঁড়িয়ে তারা শুধু কেঁদেই চলেছে। আর বুক চাপড়ে আর্তনাদ করে উঠছে, ‘পিতা..., পিতা...’।
গাড়িটির পাশ দিয়েই এগিয়ে চলেছেন মৃত একনায়কের ছেলে এবং উত্তরাধিকারী কিম জং-উন। ২৭ বছর বয়সী এই ছেলেকেও শোকে বিহ্বল দেখা যাচ্ছে। তাকে মাঝেমধ্যেই চোখের জলেও ভেসে যেতে দেখা যাচ্ছে। কিমের ঠিক পেছনেই হাঁটছিলেন তার ফুফা চ্যাং সং থায়েক। উত্তর কোরিয়ার দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ভাবা হতো তাকে। গাড়িটির অন্যপাশে হাঁটছেন সেনাবাহিনীর প্রধান রি ইয়ং-হো এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়ং চান। এসব বুড়ো ব্যক্তিই এখন পিয়ংইয়ংয়ের পরিচালক হবেন এমন অনেক গুঞ্জন চলছে চারদিকে।
১৯৫০-এর দশকে কিম জং উনের দাদা কিম ইল-সাং উত্তর কোরিয়ায় বংশানুক্রমিক একনায়কতন্ত্রের সূচনা করেন, যা ছিল কমিউনিস্ট বিশ্বে একটি নতুন সংযোজন। প্রায় দুই দশক ধরে ইল-সাং তার বড় ছেলে কিম জং-ইলকে উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি যেখানেই যেতেন, ছেলেকে সব সময় সঙ্গে রাখতেন। ১৯৯৪ সালে ইল-সাং মৃত্যুবরণ করার পরই কিম জং-উন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনিও যখন হঠাৎ করেই ২০১১ সালে মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার ছেলে উত্তর কোরিয়ার তৃতীয় সর্বোচ্চ নেতা হতে তার শিক্ষানবিসকাল শুরু করেন। এ সময় অনেক বিশেষজ্ঞই ভাবছিলেন দেশটির একনায়কতন্ত্রের হয়তো অবসান হতে চলেছে। কিন্তু তারা ভুল প্রমাণিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
.jpg)
কয়েক মাসের মধ্যেই সেনাপ্রধান রি ইয়ং-হো এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়ং-চান দুজনই বরখাস্ত হলেন। রি’র নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে এখনো রহস্য রয়ে গেছে। পরে ২০১৩ সালে কিম জং-উন তার সবচেয়ে নাটকীয় খেলটি দেখালেন। তার ফুফা চ্যাং সংস-থায়েককে পার্টির একটি মিটিং থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসসঘাতকতার অভিযোগ আনা হয় এবং যথারীতি মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, তার মৃত্যুদণ্ড বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে কিম জং-উন যত পদে ক্ষমতার রদবদল করেন, তার দাদার আমল থেকে এমনটি আর হয়নি। পাশের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, উল্লিখিত চার বছরে উত্তর কোরিয়ায় ১৪০ উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর অন্তত ২০০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত এবং কারাবন্দি করা হয়। কিম তাকেই সরিয়ে দিয়েছেন, তাকে তার পথের কাঁটা হিসেবে সন্দেহ করেছেন। সরিয়ে দেওয়া ব্যক্তির স্থলে অনুগত তরুণ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। কিমের এসব কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারই বোন কিম ইয়ো-জং। ২০১৭ সালে ৩০ বছর বয়সে ইয়োকে পলিটব্যুরোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পিয়ংইয়ংয়ের শক্তি কেন্দ্রে কার অবস্থান, তা নিয়ে আজ আর কারো দ্বিধা নেই, কিম জং-উনই হলেন সর্বোচ্চ নেতা।
ছোট্ট সেতুতে চা-পর্ব
২০১৮ সালে এপ্রিলের উষ্ণ একটি দিন সেদিন। কিম জং-উন বসে আছেন চারদিকে জঙ্গলাকীর্ণ একটি কাঠের সেতুতে। এটি উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার একটি নো ম্যান’স ল্যান্ড। দুই কোরিয়ার মাঝখানে এই সীমান্তপুলটিতে কোনো দেশের সৈনিকই অবস্থান করেন না। পিয়ংইয়ংয়ে সেদিনের সেই তীব্র ঠান্ডার ছয় বছর কেটে গেছে। কিম তার চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর মনোযোগ দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের কথা শুনছেন। দুজনের এই মিলন চিত্রটি বিশ^জুড়েই প্রচারিত হয়েছে। তবে, তারা কী নিয়ে কথা বলছেন, তা বোঝার সাধ্য কারো নেই। প্রায় আধঘণ্টার ওই নিঃশব্দ বাক্যালাপটিকে অনেকেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, কিছু বুঝে ওঠার জন্য।
এই মিটিংয়ের কয়েক মাস আগেই জাপানের ওপর দিয়ে মিসাইল ছুড়েছিলেন এবং উত্তর কোরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রে গুলিবৃষ্টির হুমকি দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি বসে আছেন, হাসছেন, এমনকি খুব গভীর আলোচনায় ডুবে গেছেন তার সাম্রাজ্যেরই শত্রু বিবেচিত হয় একটি পক্ষের সঙ্গে!
ওই আলোচনাটির পর অনেক প্রশ্নই উত্থাপিত হতে পারে। কী চান আসলে কিম? এটা কি তার কোন ধাপ্পাবাজি, কিংবা উষ্ণ আক্রমণ? কিম কি তার বাপ-দাদার অনুসৃত পরিকল্পনার অতিরিক্ত কিছু করছেন?
ছোট্ট জেনারেল
১৯৯২ সালে পিয়ংইয়ংয়ের একটি বাড়িতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আট বছর বয়সী এক বালকের একটি বিশেষ জন্মদিন। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে আট বছরের বালকটি একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে জেনারেলের পোশাক। খেলনা নয়, কোরিয়ান পিপলস আর্মির সত্যিকার জেনারেলের পোশাক তার শরীরের মাপে বানানো। দেশটির অন্যান্য বয়স্ক জেনারেলরা একে একে উপস্থিত হচ্ছেন এবং ছোট্ট জেনারেলকে কুর্নিশ করে নিজ নিজ জায়গায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। আট বছরের ওই ছোট্ট জেনারেলই হলেন কিম জং-উন।

ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ‘জেনারেল কিম’-এর জন্মদিনের এই গল্পটি করেছিলেন কিমেরই ফুফু কো ইয়ং সুক। তিনি এবং তার স্বামী দুই দশক আগেই উত্তর কোরিয়া থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। বর্তমানে তারা নিউইয়র্ক শহরের বাইরে নিভৃত জীবনযাপন করেন।
জন্মদিনের কথা উল্লেখ করে কো বলেন, ‘একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে উনের বেড়ে ওঠা ছিল অসম্ভব।’
জন্মদিনের কয়েক বছর পরই কো ইয়ং সুককে নিযুক্ত করা হয় সুইজারল্যান্ডের একটি স্কুলে পাড়াশোনারত কিম জং-উনকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। তার বর্ণনায়, কিশোর কিম ছিল রগচটা আর অহংকারী। কো বলেন, ‘সে কখনোই গোলযোগ বাধাত না। কিন্তু সে ছিল অধৈর্য এবং সহ্যক্ষমতা ছিল খুব কম। যখন তার মা তাকে মাত্রাতিরিক্ত খেলাধুলা কমিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার কথা বলত, তখন সে কিছুই বলত না, তবে নিজস্ব উপায়ে প্রতিবাদ করতÑ যেমন : কয়েকদিনের জন্য খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিত।’
কিমের ছোটবেলার এই গল্পগুলো উত্তর কোরিয়ায় তার নেতৃত্বে আসার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কারণ, তার বড় দুই ভাই ছিল। তাদের একজন তার সহোদর কিম জং-চোল এবং অন্যজন সৎভাই কিম জং-নম।
কিম জং-উন যে ক্ষমতায় আসছেন, তার প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীটি করেছিলেন জাপানি সুশি শেফ ক্যানজি ফুজিমটো।
১৯৯০-এর দশকে ফুজিমটো কিমের আশপাশে থাকাদের একজন ছিলেন। তিনি উনের বাবা কিম জং-ইলের জন্য জাপানি খাবার বানাতেন। ফুজিমটো দাবি করেন, তিনি কিম জং-উনের খেলার সঙ্গীও ছিলেন। ২০০১ সালে ফুজিমটো জাপানে ফিরে আসেন এবং উত্তর কোরিয়ায় থাকার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কিম জং-উন এবং কিম জং-চোল এ দুই ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতিচারণা করে ফুজি বলেন, ‘যখন আমি প্রথমবারের মতো দুই ভাইয়ের মুখোমুখি হলাম, তখন তারা দুজনই সামরিক পোশাক পরেছিলেন। তারা প্রত্যেক কর্মীর সঙ্গেই হাত মেলাচ্ছিলেন। পরে যখন আমার পালা এলো কিম জং-উন আমার হাতে একটি বরফের টুকরো রেখে দিল। যেন সে বোঝাতে চাইছিল তোমার মতো সব জাপানিকেই আমি ঘৃণা করি। সেদিনের অভিজ্ঞতা আমি কখনোই ভুলব না। উনের বয়স তখন মাত্র সাত।’
২০০৩ সালে দ্বিতীয় বই প্রকাশ করেন ফুজিমটো। এই বইয়ে ফুজি লেখেন, ‘কিম জং চোল বাবার উত্তরাধিকার পাবেন এমনটাই ধারণা করা হতো। কিন্তু আমার সন্দেহ হতো। কিম জং-ইল প্রায়ই বলতেন, জং চোল এত যোগ্য নয়, সে মেয়েদের মতো। ইলের কাছে তার ছোট ছেলেই ছিলেন সবচেয়ে প্রিয়। উন তার বাবার মতোই ছিলেন।’ ছোট ছেলেকে উত্তরাধিকার দেওয়ার ইচ্ছাটি ইল কখনোই জনসমক্ষে বলেননি। বাল্যকাল থেকে অনেক গোপনেই তিনি তার ছেলেকে প্রস্তুত করছিলেন।
ভাইদের মধ্যে উত্তরাধিকারের লড়াই
২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের একটি রেস্তোরাঁয় জমায়েত হয়েছে কয়েকজন বন্ধু। তারা এসেছে মূলত সিতি ইশায়াহ্র ২৫তম জন্মদিনকে উদযাপন করতে। বন্ধুদের ভিডিওতে তাকে খুব হাসতে এবং গান গাইতে দেখা গেছে। সিতি উত্তেজিত ভঙ্গিতে সেদিন তার বন্ধুদের একটি বিশেষ খবর জানায়। সিতি জানায়, সে একটি টিভি রিয়েলিটি শোতে চাকরি পেয়েছে। অবশেষে সে জন্মস্থান কুয়ালালামপুরের জ¦রাজীর্ণ চাকরিটি ছেড়ে দিচ্ছে। বন্ধুরা তাকে উৎসাহিত করে বলল, ‘তুমি তো স্টার হয়ে যাচ্ছো!’
পরদিন সকালে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে সিথি তার লক্ষ্যবস্তুকে খুঁজে পেল। গোলগাল চেহারা আর টাক মাথার এক যুবক, যিনি একটি নীল টি-শার্ট আর স্পোর্টস জ্যাকেট পরেছেন। ওই ব্যক্তিটি চেক ইনের জন্য যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন, সিতি তখনই তার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং মুখে তরলজাতীয় কিছু একটা মাখিয়ে দিলেন।
‘কী করছেন, আপনি?’ ভাঙা ইংরেজিতে ব্যক্তিটি বলে উঠলেন সিতির উদ্দেশে।
‘দুঃখিত’ বলে ভিড়ের মধ্যে পালিয়ে গেলেন সিতি। আর কয়েক মিটার দূরেই একটি ক্যাফেতে বসেছিল উত্তর কোরিয়ান কয়েকজন গুপ্তচর। ঘটনার পরপরই সিসিফুটেজে তাদের গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। পরে তারা দুবাইয়ের ফ্লাইট ধরে।
এদিকে, মুখে তরলমাখা ব্যক্তিটি অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করলেন। তার মুখের ত্বক ফেটে যাচ্ছিল এবং ক্রমেই তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি অচেতন হয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়লেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাকে হাসপাতালে পাঠালেন। লোকটির পাসপোর্টে লেখা ছিল তিনি একজন উত্তর কোরিয়ার কূটনীতিক। তার নাম কিম চোল। আসলে ওই ব্যক্তি ছিলেন কিম জং-উনের সৎ বড় ভাই কিম জং-নম। তার মুখে শক্তিশালী বিষাক্ত তরল ‘নার্ভ এজেন্ট-ভিএক্স’ মাখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার বিন্দু পরিমাণ শ^াসনালিতে প্রবেশ করলে মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু কী কারণে নমকে হত্যা করা হলো?
উন এবং নমের বাবা কিম জং-ইলের দাম্পত্য জীবন ছিল জটিল। দাপ্তরিকভাবে দুজনসহ তার তিন স্ত্রী ছিলেন। তাদের গর্ভে ইলের পাঁচ সন্তান জন্ম নেয়। নম তার প্রথম সন্তান, যার জন্ম হয়েছিল প্রথম স্ত্রী সং হাই-রিমের গর্ভ থেকে। আর উনের জন্ম হয়েছিল ইলের দ্বিতীয় স্ত্রী জাপানে জন্ম নেওয়া অভিনেত্রী কো ইয়ং-হুইয়ের গর্ভে। বৃদ্ধ একনায়ক তার স্ত্রী এবং সন্তানদের সব সময় আড়ালেই রাখতেন। আলাদা আলাদা বাড়িতে সন্তানসহ স্ত্রীরা ছিলেন একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন। উন এবং নম একজনের পিতৃস্নেহ পেলেও তাদের কখনো দেখা হয়নি।
সবার বড় ছেলে হিসেবে কিম জং-নমই ছিলেন প্রধান উত্তরাধিকারী। কিন্তু ২০০১ সালে একটি ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে জাপানে ঢোকার চেষ্টা করে গ্রেপ্তার হন। টোকিওর ডিজনিল্যান্ড দেখার পরিকল্পনা ছিল তার। বাবা ইলের কাছে এটি ছিল একটি অমার্জনীয় অপরাধ। তাই উত্তরাধিকার থেকে নমকে বঞ্চিত করে চীনে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
তবে, ইয়োজি গমি নামে এক জাপানি সাংবাদিক দাবি করেন, ডিজনিল্যান্ডে যাওয়াই নমের উত্তরাধিকার হারানোর কারণ নয়, বরং এই অধিকার তিনি হারিয়েছিলেন আরো আগেই। আর এটার সূচনা হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে, যখন নম সুইজারল্যান্ডের একটি স্কুলে পড়াশোনা করতেন। ইউরোপে কাটানো নয় বছর গভীর প্রভাব ফেলেছিল নমের মনে। ১৯৯০-এর দশকে উত্তর কোরিয়া মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে সাহায্য বন্ধ হয়ে এবং বন্যার কবলে পড়ে এমন দশা হয় দেশটির। চার বছরের দুর্ভিক্ষে দেশটিতে প্রায় ৩০ লাখ লোক প্রাণ হারায়। নম এ সময় তার বাবাকে উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া বদলে ফেলার জন্য বলেছিলেন। তিনি চাইছিলেন যেন চীনা ধাঁচের অর্থনীতি গড়ে ওঠে। যেখানে প্রাইভেট সেক্টরও গড়ে উঠবে। ছেলের এমন প্রস্তাবে রাগে ফেটে পড়েছিলেন ইল। তিনি তখন নমকে তার চিন্তা পরিবর্তন করতে বললেন, নয়তো তাকে পিয়ং ইয়ংয়ের বাইরে ছুড়ে ফেলার হুশিয়ারি দেন। উত্তরাধিকার হারানোর কারণ হিসেবে নম ইয়োজিকে এই তথ্যগুলোই দিয়েছিলেন।
নমের পরের লাইনে ছিলেন কিম জং-চোল। কিন্তু চোলকে উত্তরাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে ইল কখনোই সিরিয়াসলি ভাবেননি। বরং তিনি তার সবচেয়ে কম বয়সী ছেলেকেই বেছে নিয়েছিলেন, যে কি না তার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং হিংস্র ছিল। বাবার মৃত্যুর পর কিম ক্ষমতা গ্রহণ করলে ইয়োজিকে নম তার প্রাণসংশয়ের কথাও বলেছিলেন।
চেইন স্মোকার, রকেটম্যান ও শান্তি
২০১৭ সালের ৪ জুলাই সকাল। আমেরিকার একটি গোয়েন্টা স্যাটেলাইট উত্তর কোরিয়ার অনেক ওপর দিয়ে যেতে যেতে পিয়ঙ্গান প্রদেশে ব্যতিক্রম কিছু কার্যকলাপ লক্ষ করে। ১৬ চাকার একটি বিশাল ট্রাক একটি খোলা প্রান্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আর ট্রাকের ওপর ছিল একটি বিশাল মিসাইল। তর পরের কয়েক ঘণ্টা আমেরিকার গোয়েন্দা সদস্যরা পর্যবেক্ষণ করে দেখে মিসাইলটি ট্রাক থেকে নামানো হয়েছে এবং এটিকে পরিচালনার জন্য জ্বালানি পূর্ণ করা হচ্ছে। এ সময় তারা একজন ব্যক্তিকেও খেয়াল করেন, যিনি মিসাইলটির চারদিকে হাঁটছেন এবং একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলেছেন। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন, এই ব্যক্তি আর কেউ নন, কিম জং-উন। কিছুক্ষণ পর মিসাইলটির প্রধান ইঞ্জিন চালু করা হয় এবং আকাশে উড়াল দেয় মিসাইলটি। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এটি জাপান সাগরে গিয়ে পতিত হয়। কিম জং-উন তখন উল্লসিত হয়ে ওঠেন। পরে তার হাসিমুখের ছবি প্রকাশিত হয়, যেখানে তাকে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করতেও দেখা যায়।
পিয়ংইয়ং দাবি করেন, ওই মিসাইলটি তাদের নতুন সংযোজন, যা আমেরিকার মাটিতে গিয়ে আঘাত করতে সক্ষম। প্রচুর অর্থ খরচ এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও উত্তর কোরিয়া ধারাবাহিকভাবে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে থাকে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম। ২০১১ সালে বাবার মৃত্যুর পর নাটকীয়ভাবে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক প্রকল্পগুলোকে চালু করেন কিম এবং সফল হন।
২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর উত্তর কোরিয়া ‘হাসং-১৫’ নামে এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, যা ভারী পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে পারে এবং এটি আমেরিকার মূল ভূমিতেও আঘাত করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরাও এখন মোটামুটি একমত, কিম চাইলেই এখন আমেরিকার মাটিতে আঘাত করতে পারবে যেকোনো সময়। কিন্তু পিয়ংইয়ংয়ের রাজা কেন এত বিপুলসংখ্যক পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদ বাড়ালেন। যেখানে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য এমন পারমাণবিক ব্যবস্থার প্রযোজন নেই উত্তর কোরিয়ার। তবে, কেন এসব অস্ত্র নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হলেন রকেটম্যান? এ প্রশ্নের উত্তরেও ‘শান্তি’কেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার অলিম্পিক দল পাঠিয়ে দারুণ এক শান্তির বার্তা দিয়েছিলেন কিম। গত বছর সিঙ্গাপুরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একটি পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিও করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুনের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতেও পরমাণু অস্ত্র পুরোপুরি পরিত্যাগেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। আর কোনো মিসাইল পরীক্ষা চালাবেন না বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কোরিয়ান উপদ্বীপকে নিরাপদ রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবার তিনি। তবে, পরমাণু অস্ত্রবিশেষজ্ঞ দুইয়ো কিম বলেন, ‘এসবের মানে এই নয়, পুরোপুরি নিরস্ত্র হয়ে যাবেন কিম উন।’ তার মতে, পরপর ছয়টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তিধর ক্লাবে উত্তর কোরিয়ার নাম লিপিবদ্ধ করাই ছিল কিম জং-উনের প্রথম লক্ষ্য। আর কম বয়সী এই নেতা এভাবেই তার ব্যক্তিত্বকে জানান দিলেন, যেন তাকে গণনায় ধরা হয়। নিঃসন্দেহে পৃথিবীজুড়েই কিম এখন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্ব নিয়ে শান্তির আলোচনা এবার করাই যেতে পারে, তাই নয় কি?